আমিও তোমার মতো বুড়ো হব—বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব
কালীদহে বেনো জলে পার;
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।
—জীবনানন্দ দাশ, বোধ
১৯২০ সালের দিকে আলবার্ট আইনস্টাইন এক গভীর সমস্যা নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। সমস্যাটি মহাবিশ্বের প্রকৃতি এবং এর সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে। তাঁর মতো বিজ্ঞানীর অবশ্য এসব সমস্যা নিয়ে খুব বেশি হাবুডুবু খাওয়ার কথা নয়। আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব এবং আপেক্ষিকতার সাধারণ বা ব্যাপক তত্ত্ব দুইটিই বিজ্ঞানের জগতে এখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। অভিকর্ষ বলের প্রভাবে স্থান-কালের বক্রতা যে আলোর গতিকেও বাঁকিয়ে দিতে পারে, তা এডিংটনের পরীক্ষায় হাতে- কলমে প্রমাণিত হয়ে গেছে ১৯১৯ সালের জুনের দুই তারিখে। যে বুধ গ্রহের বিচলন নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ নিয়ম দিয়ে কোনোভাবেই মেলানো যাচ্ছিল না, আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বসংক্রান্ত গণনার ছাঁচে ফেলে খাপে খাপ মিলিয়ে দেওয়া গেছে। আইনস্টাইন তখন নিজেই রীতিমতো এক তারকা।
আইনস্টাইন চাইলে এ সময় একটু সাহসী হতে পারতেন। তাঁর তত্ত্ব থেকেই কিন্তু বেরিয়ে আসতে শুরু করেছিল যে আমাদের মহাবিশ্ব ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে, মানে আকাশের যাবতীয় গ্রহ-নক্ষত্র-তারকা, গ্যালাক্সিরা সব একে অন্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু আইনস্টাইন নিজেই সেটা বুঝতে পারলেন না। বুঝতে পারলেন না বলাটা বোধ হয় ঠিক হলো না। বলা উচিত মানতে চাইলেন না। মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে গ্যালাক্সিগুলোর একে অন্যের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি তাঁর গাণিতিক সমীকরণে একটা কাল্পনিক ধ্রুবক যোগ করে দিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, এতে মহাবিশ্ব চুপসে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে ভারসাম্য বা স্থিতাবস্থাপ্রাপ্ত হবে। এটাই সেই বিখ্যাত ‘মহাজাগতিক ধ্রুবক’; গ্রিক অক্ষর ল্যামডা দিয়ে নামাঙ্কিত করে স্থিতিশীল মহাবিশ্বের মডেলের প্রতি আস্থা স্থাপন করেছিলেন আইনস্টাইন। এই ধরনের মহাবিশ্ব সংকুচিতও হয় না, প্রসারিতও হয় না। সে সময় অধিকাংশ পদার্থবিজ্ঞানীই মহাবিশ্বকে এভাবে দেখতেন। কিন্তু সবাই দেখলেই আইনস্টাইনকে দেখতে হবে কেন? চিন্তা-চেতনার জগতে বহু ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন বিপ্লবী। নিউটনের চিরচেনা পরম মহাবিশ্বের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে বানিয়েছিলেন আপেক্ষিকতার এক নতুন জগৎ। অথচ মহাবিশ্বের প্রসারণের বেলায় তিনি ‘ঝাঁকের কই’ হয়েই রইলেন কেন যেন।
এর প্রায় বারো বছর পর আমেরিকান জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী এডউইন হাবল যখন টেলিস্কোপের সাহায্যে চাক্ষুষ প্রমাণ হাজির করলেন,দেখিয়ে দিলেন যে, মহাবিশ্ব স্থিতিশীল মোটেই নয়, বরং সত্যই প্রসারিত হচ্ছে, তখন আইনস্টাইন মুখ কাঁচুমাচু করে স্বীকার করে নিলেন যে, সমীকরণের মধ্যে মহাকর্ষীয় ধ্রুবক বসানোটা ‘জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল’ ছিল’ ও ।
যে আইনস্টাইন সব সময়ই স্থবিরতাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন সারা জীবন ধরে, সেখানে তিনি কেন স্থবির মহাবিশ্বকে সত্য বলে ভেবে নিয়েছিলেন, তা আমাদের রীতিমতো বিস্মিত করে। বিস্মিত করেছিল প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক জেমস পিবলসকেও। তিনি বলেন, ‘স্ট্যাটিক মহাবিশ্ব তো কাঠামোগতভাবেই স্বসংগতিপূর্ণ নয়। সূর্য তো সারা জীবন ধরে জ্বলে থাকতে পারে না। এ ব্যাপারটা আইনস্টাইন বুঝতে পারেননি, এটা আমাকে অবাক করে দেয়, এখনো’।
অবশ্য কে তখন জানত আইনস্টাইনের ভুল তো আর যে সে ভুল নয়! তাঁর সমীকরণে যে মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের আমদানিকে ‘জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন তিনি নিজে, সেই ভুলই আবার সিন্দাবাদের ভূতের মতো কাঁধে সওয়ার হয়ে ফিরে এসেছে নতুন উদ্যমে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে।
একটি ধ্রুবকের জন্মকথা
আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার আগেই আইনস্টাইন বুঝতে পেরেছিলেন, মহাকর্ষ এবং সমত্বরণে গতিশীল বস্তু সমতুল্য। g শক্তির অভিকর্ষ
রুশ-আমেরিকান বিজ্ঞানী জর্জ গ্যামোর আত্মজীবনীতে এই স্বীকারোক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। গ্যামো বলেছেন, ‘when I was discussing cosmological problems with Einstein, he remarked that the introduction of the cosmological term was the biggest blunder of his life.’ [My World Line (1970)]
ক্ষেত্র বিশিষ্ট একটি লিফটের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকার সাথে g সমত্বরণে চলমান একটি রকেটে মহাশূন্যের ভেতর দিয়ে চলার মধ্যে আসলে কোনোই পাৰ্থক্য নেই।
আইনস্টাইন আরো একটি ব্যাপার ক্রমান্বয়ে বুঝতে পারলেন। নিউটন আমাদের স্থান-কালের জন্য যে পরম কাঠামোর একটা দৃষ্টিনন্দন ছবি বানিয়ে গিয়েছিলেন, সেটা হয়তো পুরোপুরি ঠিক নয়। অবশ্য আইনস্টাইনের এ চিন্তাটা একেবারে মৌলিক ছিল কি না তা হলফ করে বলা যায় না। অনেকে বলেন, এর পেছনে অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ ও দার্শনিক মাখ (Ernst Mach)-এর একটা প্রভাব আছে। মাখ আইনস্টাইনের আগেই স্থান-কালের ক্ষেত্রে নিউটনীয় পরম কাঠামোর ধারণা পরিত্যাগ করেছিলেন, এবং এর সমালোচনাও করেছিলেন। ‘বাহ্যিক বল প্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু চিরকাল স্থির থাকবে আর গতিশীল বস্তু সুষম দ্রুতিতে সরল পথে চলতে থাকবে’—নিউটনের এই সূত্রটার সাথে আমরা সবাই আমাদের স্কুলজীবনে পরিচিত হয়েছি। প্রাত্যহিক জীবনেও এর ব্যবহার আমরা দেখি অহরহ। টেবিলের ওপর কোনো কিছু ফেলে রাখলে সেটা সেভাবেই থাকে। আপনার টেবিলে রাখা রসালো খাবারগুলো হঠাৎ আমার ঘরের টেবিলে এসে উপস্থিত হয় না। এটা হলে কী মজাটাই না হতো! ঠিক একইভাবে একটা বস্তু যখন সমবেগে গতিশীল থাকে তখন সেটা সেভাবেই থাকতে চায়। সেজন্য একটা চলমান বাসের ড্রাইভার হঠাৎ ব্রেক চাপলে আমরা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ি। কিন্তু এই যে গতি- জড়তা বা স্থিতি-জড়তার ব্যাপারগুলো ঘটছে, সেটা কার সাপেক্ষে? এটা ব্যাখ্যার জন্য নিউটনকে তৈরি করতে হয়েছিল পরম স্থানের ধারণার, যে অনড় কাঠামো সংজ্ঞায়িত করবে সমস্ত স্থানীয় জাড্য কাঠামোকে (local inertial frames) । মাখ অবশ্য প্রস্তাব করেছিলেন, পদার্থের এই বণ্টন সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে জাড্য কাঠামোর সাপেক্ষে, এবং সেটা কোনো পরম স্থান-কালের ধারণা আরোপ না করেই। পরবর্তীতে আইনস্টাইনের সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের ভিত্তিও কিন্তু গড়ে উঠেছিল অনেকটা এই ধারণার ওপরই।
আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বই প্রথমবারের মতো মহাবিশ্বের সার্বিক রূপরেখার একটি আশাব্যঞ্জক ছবি আমাদের জন্য আঁকতে সমর্থ হয়েছিল। তাঁর তত্ত্ব থেকেই আমরা প্রথমবারের মতো জানতে পারলাম, স্থানের মধ্য দিয়ে পদার্থ কিভাবে চলবে;শুধু তা-ই নয়, কিভাবে স্থান-কালের উদ্ভব হতে পারে তারও অভিনব একটা ছবি পেয়ে গেলাম আমরা। কিন্তু পেলে কী হবে, আইনস্টাইনের মাথায় ছিল তখন মাখ সাহেবের ভূত। মাখ সাহেব নিউটনের পরম কাঠামো ত্যাগ করতে সমর্থ হলেও তিনি সুস্থিত মহাবিশ্বের ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন, ‘মাখের প্রিন্সিপাল’ বলে একটা নিয়মও তিনি বানিয়েছিলেন নিজের ধারণার সমর্থনে। আইনস্টাইনও একই ভুলের ফাঁদে পা দিলেন। তিনি এমন একটা মহাবিশ্ব মনে মনে কল্পনা করে ফেললেন, যে মহাবিশ্ব সময়ের সাথে সাথে আকারে বাড়েও না, কমেও না। একেবারে অনড়, অবিচল ও সুস্থিত মহাবিশ্ব। আর তা করতে গিয়ে তাঁর সমীকরণের বাঁ দিকে আমদানি করলেন সেই হতচ্ছাড়া ধ্রুবকের, যাকে আমরা ‘ল্যামডা’ বলে চিনি।
আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে পাওয়া আইনস্টাইনের মূল সমীকরণটি ছিল খুব সোজা, অনেকটা এরকমের –
Gμv = 8πGTμv
যেখানে Guv স্থানের বক্রতার নির্দেশক, Tμv -স্ট্রেস এনার্জি টেনসর এবং G হচ্ছে নিউটনের মহাকর্ষ ধ্রুবক।
ল্যামডা বসানোর পর সমীকরণটার চেহারা বদলে গিয়ে দাঁড়াল এরকমের –
Gμv + Agμv = 8πGTμv
সমীকরণের বাঁ দিকে এভাবে এই ল্যামডা বসিয়ে দিয়ে আইনস্টাইন ভাবলেন—খুব যাহোক, মহাবিশ্বটাকে অযথা টানাটানির হাত থেকে রক্ষা করা গেছে।
কিন্তু আইনস্টাইনের উৎসাহের বেলুন ক্রমেই চুপসে যেতে শুরু করল। বেলুনে প্রথম সুইটা ফোটালেন উইলিয়াম ডি সিটার নামে এক ডাচ জ্যোতির্বিজ্ঞানী। ১৯১৭ সালে ডি সিটার দেখালেন যে আইনস্টাইনের মহাকর্ষ ধ্রুবক গোনায় ধরেই তাঁর সমীকরণের এমন একটা সমাধান পাওয়া যায়,যেটা তাঁর উপসংহারের সাথে বেমানান। সিটারের সমাধান থেকে বেরিয়ে এল—মহাবিশ্বকে স্থিতিশীল হয়ে বসে থাকতে হবে এমন দিব্যি কেউ দিয়ে দেয়নি, এটি প্রসারিত হতে পারে, এমনকি পদার্থের অনুপস্থিতিতেও। তবে ডি সিটারের গণিত মেনে নিলেও এই ধরনের মহাবিশ্বের বাস্তবতাকে আইনস্টাইন কখনোই পাত্তা দেননি। ফলে এই মডেলটি কেবল একাডেমিক আঁতেলদের চিন্তায় খোরাক জোগান ছাড়া আর বাড়তি কিছু করে উঠতে পারেনি।
কিন্তু ১৯২২ সালে আইনস্টাইনের বেলুনে যে খোঁচাটা লাগল তা বেশ বড়সড়। রুশ বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফ্রিডম্যান প্রসারণশীল এবং সংকোচনশীল মহাবিশ্বের মডেল তৈরি করলেন কোনো রকম মহাকর্ষীয় ধ্রুবক ছাড়াই। ফ্রিডম্যান দেখালেন, মহাবিশ্বের গড় ঘনত্বের ওপর ভিত্তি করে মহাবিশ্ব আজীবন প্রসারিত হতে পারে (উন্মুক্ত মহাবিশ্বের মডেল) কিংবা একটা সময় পর সংকুচিত হতে পারে (বদ্ধ মহাবিশ্বের মডেল), কিংবা হতে পারে দুয়ের মাঝামাঝি কিছু (সামতলিক মহাবিশ্ব); এবং এর জন্য মহাজাগতিক ধ্রুবক-টুবক গোনায় ধরার দরকার নেই।
১৯৩০ সালে বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন একটা গবেষণাপত্রে দেখালেন, আইনস্টাইন যে মহাবিশ্বকে স্থিতিশীল ধরে নিচ্ছেন, সেটা আসলে স্থিতিশীল নয়। আসলে অভিকর্ষ এবং মহাজাগতিক পদটি এত নিখুঁতভাবে সাম্যাবস্থায় আছে, যে এ থেকে সামান্য বিচ্যুতি ঘটলেই মহাবিশ্ব হুড় হুড় করে প্রসারিত হতে থাকবে, নয়তো নিজের মধ্যেই হুমড়ি খেয়ে পড়বে।
১৯৩১ সালে আইনস্টাইনের ‘সুস্থিত মহাবিশ্ব’ নামের সাধের বেলুনটা ফাটিয়েই দিলেন জ্যোতির্বিদ এডউইন হাবল। তাঁর পর্যবেক্ষণ থেকে সবাই নিশ্চিত হয়ে গেল যে মহাবিশ্ব আসলে প্রসারিত হচ্ছে। আইনস্টাইনও তৎক্ষণাৎ তাঁর মহাজাগতিক ধ্রুবককে ‘তাত্ত্বিকভাবে অসংগতিপূর্ণ’ অভিধায় অভিহিত করে বাতিল করে দিলেন। অভিহিত করলেন জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হিসেবে। কিন্তু কে জানত আইনস্টাইনের সেই ‘মহাভুলের’ও ভুল ধরিয়ে দিয়ে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে ‘কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট’ আবার নতুন উদ্যমে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে ফিরে আসবে?
শূন্যতার শক্তি
আইনস্টাইন তাঁর বিখ্যাত সমীকরণ থেকে মহাজাগতিক ধ্রুবক বা ল্যামডাকে ‘ত্যাজ্য’ করে দেওয়ার পর থেকে অন্তত ছয় দশক পদার্থবিজ্ঞানীরা এ নিয়ে টু শব্দ করেননি। তবে আজ আমরা জানি, আইনস্টাইন যদি তাঁর সমীকরণে তাড়াহুড়ো করে এই মহাজাগতিক ধ্রুবক যোগ না-ও করতেন, আজকের পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এর সংযোজন অপরিহার্যই ছিল। কিন্তু এই নতুন দিনের মহাজাগতিক ধ্রুবক আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা থেকে উঠে আসেনি, এসেছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ‘রহস্যময়’ দুনিয়া থেকে।
মজার ব্যাপার হলো, নতুনভাবে ফিরে পাওয়া এই মহাজাগতিক পদটির ধারণা আইনস্টাইনের পুরনো মহাজাগতিক ধ্রুবকের চেয়ে ভিন্ন। আইনস্টাইনের মূল ক্ষেত্র সমীকরণটি (Gμv = 8πGTμv ) মোটা দাগে স্থানের বক্রতার (Gμv) সাথে ভর-শক্তির বিন্যাসের (Tμv) একটা সম্পর্ক নির্দেশ করে। যখন আইনস্টাইন তাঁর ‘কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট’টি যোগ করেছিলেন, তিনি সেটা করেছিলেন সমীকরণের বাম দিকে (Gμv + Agμv = 8πGTμv)। তিনি এটাকে স্পেস বা স্থানের বৈশিষ্ট্য হিসেবেই দেখেছিলেন। কিন্তু আজ যখন আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাঁদের নতুন মহাজাগতিক ধ্রুবক নিয়ে ঘষামাজা করছেন, তাঁদের সেটা বসাতে হচ্ছে সমীকরণের ডান দিকে (Gμv = 8πG[Tμv + Pvacgμv]) আর ডান দিকে বসানোর ফলে এর অর্থই গেছে রাতারাতি বদলে। অত্যন্ত বিপ্লবাত্মক এই অর্থ। এখন এই নতুন পদের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের একধরনের শক্তি-ঘনত্বকে (energy density) তুলে ধরেন, মহাবিশ্ব প্রসারিত হলেও এর মান অপরিবর্তিত থাকে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। সাধারণ পদার্থের ক্ষেত্রে আমরা জানি যে, পদার্থ যত প্রসারিত হয়, তত এর ঘনত্ব কমতে থাকে। চিন্তা করে দেখুন, একটা ঘরে কোথাও বোটকা গন্ধ থাকলে আমরা দরজা-জানালা খুলে দিই। ফলে বদ্ধ বাতাস প্রসারিত হয়ে (মানে ঘনত্ব কমে গিয়ে) চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায়, গন্ধের তীব্রতাও কমে আসে। কিন্তু মহাবিশ্বের শুরুতে ব্যাপারটা সেরকম ছিল না। তখন
আসলে আইনস্টাইনের মূল সমীকরণে এর মান ছিল ঋণাত্মক। সেটাই নতুন সমীকরণের অপর পাশে এসে ধনাত্মক মান ধারণ করেছে।
যে অদ্ভুতুড়ে পদার্থটা রাজত্ব করত, সেটা প্রসারিত করা হলেও এর ঘনত্ব থাকত অপরিবর্তিত। ফলে এর ভর আর অধিকৃত আয়তনের সম্পর্কটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সমানুপাতিক। এর আয়তন যত বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তার ভর। আর তার চেয়েও অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো, যে মহাকর্ষ শক্তির হিসাবটা উঠে আসছে গণনা থেকে সেটা আকর্ষণমূলক নয়, বরং বিকর্ষণমূলক। বিকর্ষণমূলক অভিকর্ষ বল? নিউটন বেঁচে থাকলে দুঃখে অক্কাই পেতেন হয়তো। এত কষ্ট করে পৃথিবীর বুকে আপেলের পতনকে আকর্ষণ বল দিয়ে ব্যাখ্যা করেছিলেন, সেই ছবিটাই যাচ্ছে একেবারে উল্টে। বাংলা ব্লগে সুকুমার রায়ের আদলে লেখা ‘উল্টো রাজার দেশ’ নামের কবিতাটার মতো-
উল্টো রাজার দেশে রে ভাই
উল্টোভাবে বাঁচা
ঘরের মেঝে উপর দিকে
মেঝের দিকে মাচা।
স্বপ্নবাজ মামুন, উল্টো রাজার দেশ-১, নাগরিকব্লগ, ১৮ জুলাই, ২০১১
এই উল্টো রাজার দেশের মতো ব্যাপারটাই ঘটেছিল মহাবিশ্বের শুরুতে, আর সেজন্যই প্রায় ভরহীন একেবারে শূন্যাবস্থা থেকে এই বিপুল বিশাল মহাবিশ্বের উদ্ভব হতে পেরেছে। পদার্থবিজ্ঞানীরা এ প্রসারণকে বলেন ‘ইনফ্লেশন’ বা স্ফীতি। এই স্ফীতি তত্ত্বের কথা আমাদের এই বইয়ে বারেবারেই ঘুরে ফিরে আসবে। কারণ শূন্য থেকে মহাবিশ্বের উৎপত্তির ভিত্তিভূমিই হচ্ছে স্ফীতি তত্ত্ব যা মূল ধারার পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জোরালো তত্ত্ব। স্ফীতি তত্ত্বের জনক এমআইটির অধ্যাপক বিজ্ঞানী অ্যালেন গুথ তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছিলেন, শুরুতে এই স্ফীতির প্রসারণ এমনকি আলোর গতিকেও হার মানিয়েছিল। স্টিফেন হকিং ও লিওনার্ড স্লোডিনো তাঁদের বিখ্যাত ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’ বইয়ে সেটাকে রসিয়ে রসিয়ে লিখেছেন এভাবে-
আপনি যদি জিম্বাবুয়ের অধিবাসী না হন,যেখানে সম্প্রতি মুদ্রাস্ফীতি ২০০,০০০,০০০ শতাংশকেও ছাড়িয়ে গেছে, তাহলে হয়তো স্ফীতি শব্দটা তেমন বিস্ফোরক শোনাবে না। কিন্তু একদম রয়েসয়ে করা অনুমান অনুযায়ীও মহাজাগতিক মহাবিশ্ব গুণে স্ফীত সময় স্ফীতির ১,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ হয়েছিল মাত্র .০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০১ সেকেন্ডে। এ যেন একটা ১ সেন্টিমিটার ব্যাসের মুদ্রা হঠাৎ ফুলে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির দশ মিলিয়ন গুণ বড় হয়ে গেল। শুনে মনে হতে পারে, এতে আপেক্ষিকতার তত্ত্ব লঙ্ঘিত হচ্ছে, কারণ আমরা জানি, কোনো কিছুই আলোর গতির চেয়ে দ্রুত যেতে পারে না,কিন্তু আসলে তা নয়। কারণ গতির এই সীমা স্থান-কালের নিজস্ব প্রসারণের ওপর খাটে না।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এই শক্তি-ঘনত্ব কেবল থাকতে পারে ‘এম্পটি স্পেস’ বা শূন্যস্থানে। কাজেই, শূন্যতাকে আমরা সাধারণভাবে যেরকম শূন্য মনে করি, সেরকম সাদামাঠা সে নয়। এ এক রহস্যময় শক্তির আধার যেন। নামে ‘শূন্য’ হলেও এর সূক্ষ্ম স্তরে সবসময়ই নানান ধরনের প্রক্রিয়া ঘটে চলেছে। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন সেখানে পদার্থ-কণা এবং প্রতিপদার্থ-কণা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তৈরি হচ্ছে,আবার তারা নিজেকে সেই শক্তিতে বিলীন করে দিচ্ছে। এই কণাগুলোকে আমরা বলি অসদ কণা বা ভার্চুয়াল পার্টিকেল। আর অসদ কণা তৈরির এই চলমান প্রক্রিয়াটিকে আমরা চলতি কথায় বলি ‘ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন’। এই ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনের ব্যাপারটা আমরা খালি চোখে না দেখলেও নানা ধরনের
16 Stephen Hawking & Leonard Mlodinow, The Grand Design, Bantam, 2010 (অনুবাদ, তানভীরুল ইসলাম, মুক্তমনা)
সূক্ষ্ম পরীক্ষার মাধ্যমে এর অস্তিত্ব শনাক্ত করা গিয়েছে। সেই ১৯৪৭ সালের দিকেই বিজ্ঞানী উইলিস ল্যাম্ব পরীক্ষার সাহায্যে প্রমাণ করেন যে, অসদ কণার প্রভাব গোনায় না ধরলে হাইড্রোজেন পরমাণুর শক্তিস্তরের গণনাগুলো কখনোই সঠিক ফলাফল দেবে না’ 7 । সত্যিই তা-ই। তাঁর এই পরীক্ষণকে বিজ্ঞানের জগতে সবচেয়ে সফল পরীক্ষাগুলোর একটি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়’ ৪। ল্যাম্ব তাঁর অসদ কণিকা নিয়ে যুগান্তকারী গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৫৫ সালে। আর তখন থেকেই কিন্তু বিজ্ঞানীরা জানেন অসদ কণিকাগুলোর অস্তিত্ব সত্যি সত্যিই আছে”।
এই গণনা করা হয় বিখ্যাত ডিরাক সমীকরণের মাধ্যমে।
18 Lawrence M. Krauss, A Universe from Nothing: Why There Is Something Rather than Nothing, Free Press, 2012.
19 Gordon Kane, Are virtual particles really constantly popping in and out of existence? Or are they merely a mathematical bookkeeping device for quantum mechanics? Scientific American, 2006
আমরা যদি কোয়ান্টাম বলবিদ্যা থেকে পাওয়া নতুন বাস্তবতাকে মেনে নিই, তবে নতুন চোখে শূন্যতাকে দেখতে হবে আমাদের। কারণ, কোয়ান্টাম বলবিদ্যার চোখে শূন্যতা বলে সেভাবে কিছু নেই। সেখানে প্রতিমুহূর্তেই অসদ কণিকাগুলো একেবারে যেন ভূতের মতো হুস করে নাকের ডগায় উদ্ভূত হচ্ছে আবার সেখানেই তিরোহিত হচ্ছে। এভাবেই তারা শূন্যস্থানে শক্তি সরবরাহ করে চলেছে অনবরত। কাজেই শূন্যস্থানের মধ্যে শক্তি আসলে লুকিয়ে আছে। এই লুকিয়ে থাকা শক্তিটাই ইদানীং আমাদের মহাবিশ্বের উৎপত্তি আর পরিণতির পেছনে বিজ্ঞানীদের গবেষণার মূল নিয়ামক হয়ে উঠেছে যেন। ব্যাপারটি নজরে পড়েছিল সদ্য প্রয়াত বাঙালি বিজ্ঞানী অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের চোখেও (প্রথিতযশা এই বিজ্ঞানীর অবদানের কথা আমরা ত্রয়োদশ অধ্যায়ে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করব),সেই আশির দশকেই। তিনি তাঁর ১৯৮৩ সালে লেখা বিখ্যাত ‘মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি’ (The Ultimate Fate of the Universe) বইয়ের ‘কৃষ্ণবিবর চিরকালের জন্য নয়’ (A Black hole is not forever) অধ্যায়ে লিখেছিলেন”___
কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূত্র অনুযায়ী, ‘শূন্য’স্থান আসলে সম্পূর্ণভাবে শূন্য নয়, বরং কণা এবং প্রতিকণাদের অসদ যুগলে (virtual pairs) পরিপূর্ণ, যা অব্যাহতভাবে শূন্যস্থানে তৈরি হচ্ছে আবার সেখানেই বিলুপ্ত হচ্ছে। আগেই বলা হয়েছে যে কোনো কণার বিপরীতে প্রকৃতিতে ‘প্রতিকণিকা’ থাকে যার চার্জ মূল কণার বিপরীত, কিন্তু ভর সমান; আর এরা যুগল আকারে একেবারেই পরিশুদ্ধ শক্তি কিংবা বিকিরণ থেকে উদ্ভূত হতে পারে। এই কণা আর প্রতিকণার যুগলকে ‘ভার্চুয়াল’ বা অসদ বলা হচ্ছে, কারণ, প্রকৃত কণাদের মতো এদের কণা ত্বরকের (particle detector) মাধ্যমে সরাসরি শনাক্ত করা যায় না। তাদের পরোক্ষ প্রভাব অবশ্য পরিমাপ করা যায়, এবং তাদের অস্তিত্ব শনাক্ত করা হয়েছে আহিত হাইড্রোজেন পরমাণুর বর্ণালি থেকে প্রাপ্ত ল্যাম্বের অপবর্তন (Lamb shift) থেকে। এই অসদ কণা তৈরি করার জন্য শক্তির জোগানটা আসে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি থেকে।… দেখে মনে হয় অসদ কণিকাগুলো যেন অনিশ্চয়তা নীতি দিয়ে পরিচালিত কোনো ব্যাংক থেকে স্বল্পকালীন ঋণ নিয়ে নিজের অস্তিত্বকে বাস্তব করে তুলছে। এই ব্যাপারটিকে বলে ‘ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন’।
Jamal N. Islam, The Ultimate Fate of the Universe, Cambridge University Press; 1983, page 91.
গুপ্ত শক্তি
অবশ্য শূন্যতার মধ্যে শক্তি লুকিয়ে আছে, এটা জানা গেলেও ঠিক কতটুকু শক্তি এর মধ্যে লুকিয়ে আছে, সেটা নিয়ে বিজ্ঞানীরা ঐকমত্যে পৌছতে পারেননি; ব্যাপারটি এখনো তাঁদের কাছে মূল্যবান গবেষণার বিষয়। মহাবিশ্বের ত্বরণ ও প্রসারণের জন্য দায়ী যে গুপ্ত শক্তির (Dark energy) কথা আমরা ইদানীং হরহামেশা শুনি, তার পেছনে এই ‘শূন্য শক্তির’ ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়। নব্বইয়ের দশকে অনেকটা সৌভাগ্যক্রমেই সল পার্লমুটার আর ব্রায়ান স্মিট নামক দুজন পদার্থবিদের নেতৃত্বে দুটি আলাদা আলাদা দলের সুপারনোভা নিয়ে ঐতিহাসিক পরীক্ষায় ব্যাপারটা বেরিয়ে আসে।
সে সময় বিজ্ঞানীদের সবাই ধারণা করতেন, ১৩০০ কোটি বছর আগে যে মহাবিস্ফোরণ ঘটেছিল, তার পর থেকে মহাবিশ্ব প্রসারিত হতে শুরু করেছে এবং সেই প্রসারণের হার নিশ্চয় সময়ের সাথে সাথে কমতে শুরু করবে। একটা টেনিস বল ওপরে ছুড়ে দিলে যেমন ওপরে ওঠার সময় বলটার বেগ ধীরে ধীরে কমতে থাকে, তারপর মাধ্যাকর্ষণের টানে আবার আপনার হাতে ফেরত চলে আসে – ঠিক তেমনি মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরাও ভাবতেন মহাবিশ্বের প্রসারণ ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে পেতে একটা সময় থেমে যাবে, আর তারপর তা আবার ধীরে ধীরে ‘ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন’। তো মহাবিশ্বের প্রসারণটা ঠিক কী হারে কমছে সেটা বের করতেই ১৯৯৮ সালে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার আয়োজন করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। সল পার্লমুটার আর ব্রায়ান স্মিটের দলবলের টাইপ ১এ সুপারনোভা- সংক্রান্ত পরীক্ষা থেকে যে ফলাফল পাওয়া গেল তা অবিশ্বাস্য! বিজ্ঞানীরা দেখলেন, মহাবিশ্বের প্রসারণের হার আসলে কমছে না, বরং বেড়ে চলেছে। মানে মহাবিশ্বের মন্দন হচ্ছে না, হচ্ছে ত্বরণ। নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ এই আবিষ্কারটাই আইনস্টাইনের সমীকরণের বাতিল করে দেওয়া সেই ‘মহাজাগতিক ধ্রুবক’-কে বিজ্ঞানের জগতে নতুনভাবে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
মহাজাগতিক ধ্রুবক সমস্যা
বিজ্ঞানীরা জানেন, শূন্যতার মধ্যে শক্তির পরিমাণ মহাবিশ্বের সামগ্রিক গুপ্ত শক্তির চেয়ে বেশি হতে পারে না। বড়জোর প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে ১০৮ আর্গ। অথচ কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সমীকরণগুলো সমাধান করে শূন্যতার শক্তির যে মান পাওয়া যায়, তা জলহস্তীর মতো বিশালকায়—প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে ১০১১২ আর্গ। অর্থাৎ বাস্তব মানের চেয়ে কাগজে-কলমে গণনা ১০১২০ গুণ বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এটা একটা সমস্যা। ছোটখাটো নয়, খুব বড়সড় সমস্যাই। সমস্যাটিকে পদার্থবিজ্ঞানে চিহ্নিত করা হয় ‘কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট প্রবলেম’ বা ‘মহাজাগতিক ধ্রুবক সমস্যা’ হিসেবে। সমস্যাটির দিকে প্রথম নজর দিয়েছিলেন রুশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইয়াকভ জেলডোভিচ ১৯৬৭ সালে, যখন তিনি প্রথমবারের মতো শূন্যস্থানের শক্তি-ঘনত্ব নির্ণয় করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তার পর থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবেই বিরাজ করছে বিজ্ঞানের জগতে। স্টিফেন ওয়েইনবার্গের ১৯৮৯ সালের গবেষণা প্রবন্ধে সমস্যাটির ভালো সারমর্ম পাওয়া যায়”। তবে সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা কিছুটা হলেও হদিস করতে পেরেছেন কেন তাদের গণনা আর বাস্তবতায় এত ফারাক হচ্ছিল। একটি গণনা থেকে দেখা গেছে, ফার্মিয়নের মধ্যে যে ঋণাত্মক শূন্য শক্তি লুকিয়েছিল, সেটা তারা গোনায় ধরেননি। সেটা গোনায় ধরলে গণনা আর বাস্তবতার ফারাক অনেক কমে আসে”। আরেকটি আভাস পাওয়া গেছে বিখ্যাত ‘হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপাল’-এর সঠিক ব্যবহারের মধ্যে। মহাবিশ্বের শূন্য শক্তি- ঘনত্ব (vacuum energy density) নির্ণয় করা হয়েছে মহাবিশ্বের সকল শূন্য-বিন্দু শক্তি স্তরের যোগফল থেকে (sum over all the zero point energy states)। এই যোগফল বের করার সময় ধরে নেওয়া হয়েছিল সেই
Steven Weinberg, The cosmological constant problem, Reviews of Modern Physics, Volume 61, Issue 1, pp. 1-23, January 1989
Victor J. Stenger, The Fallacy of Fine-Tuning: Why the Universe Is Not Designed for Us, Prometheus Books, 2011
স্তরগুলোর সংখ্যা এর আয়তনের সমানুপাতিক। কিন্তু সাম্প্রতিক ‘হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপাল’ থেকে জানা গেছে, ব্যাপারটা আয়তনের সমানুপাতিক না হয়ে ক্ষেত্রফলের সমানুপাতিক হওয়াটাই যৌক্তিক, যেটা ঘটে কৃষ্ণবিবরের ক্ষেত্রে। আমাদের মহাবিশ্বের স্তরের সংখ্যা একই আয়তনের কৃষ্ণবিবরের চেয়ে বেশি হতে পারে না। এই অনুজ্ঞার ভিত্তিতে গণনা করে দেখা গেছে, এর মান বাস্তব মানের খুব কাছাকাছি চলে আসে”। তবে এ ব্যাপারে শেষ কথা বলার সময় আসেনি, জুরির রায় এখনো বিভক্ত। তবে, মহাজাগতিক ধ্রুবকের মান গণনা নিয়ে সমস্যা থাকলেও মহাবিশ্বের সার্বিক ছবিটা আঁকতে সেটা কিন্তু কোন সমস্যা তৈরি করছে না। লরেন্স ক্রাউস, টার্নারসহ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, কিছু অজানা প্রক্রিয়া থাকতে পারে, যেটা এখনো বিজ্ঞানীরা খুঁজে বের করতে পারেননি। এর খোঁজ পাওয়া গেলে দেখা যাবে, সমীকরণের পদগুলো কাটাকাটি করে একে সেই বাস্তবতার কাছাকাছি স্বল্প মানে নামিয়ে এনেছে ।
কাজেই সারমর্ম দাঁড়াল—যে মহাজাগতিক পদটিকে আইনস্টাইন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হিসেবে চিহ্নিত করে বাতিল করেছিলেন, সেটাকেই আমরা আবার আশির দশকে পূর্ণোদ্যমে ফিরে আসতে দেখলাম ইনফ্লেশন বা স্ফীতিতত্ত্বের মাধ্যমে। কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে মহাবিশ্ব উদ্ভূত হবার পর যে বিকর্ষণশক্তি মহাবিশ্বকে প্রসারিত করে দ্রুত স্ফীতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল, আজ সেটা এই মহাজাগতিক ধ্রুবকের সাথেই সম্পর্কিত বলে অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন। আর ১৯৯৮ সালে যে রহস্যময় ‘ডার্ক এনার্জি’ বা গুপ্ত শক্তির খোঁজ পেলেন বিজ্ঞানীরা, তার অস্তিত্বের পেছনেও সম্ভবত রয়েছে এই ধ্রুবকেরই জটিল মারপ্যাচ। এগুলো বোঝা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ, এর সাথে আধুনিক ‘কোয়ান্টাম শূন্যতা’র একটা গভীর সম্পর্ক আছে। আর তাছাড়া, এই বিকর্ষণশক্তি আর গুপ্ত শক্তির প্রভাব পড়েছে বিজ্ঞানীদের মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি নিয়ে ইদানীংকার ভাবনাতেও। তবে সেটা আর এখন নয়, এ নিয়ে কিছু কথা বলা যাবে ত্রয়োদশ অধ্যায়ে। আপাতত আমরা মহাবিশ্বের উৎপত্তির পেছনে সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত যে ধারণা সেই ‘বিগ ব্যাং’ বা মহাবিস্ফোরণের গল্প শুনব।
Victor J. Stenger, The Problem with the Cosmological Constant, CSI, Volume 21.1, Spring 2011.
Lawrence M. Krauss and Michael S. Turner, A Cosmic Conundrum, Scientific American 15, 66-73, 2006
♦ দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ শূণ্যের ভীতি
♦ তৃতীয় অধ্যায়ঃ পশ্চিমে নয়, পুবের দিকে
♦ চতুর্থ অধ্যায়ঃ শূন্য এল ইউরোপে
♦ পঞ্চম অধ্যায়ঃ প্রকৃতির শূন্যবিদ্বেষ ?
♦ ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ বিজ্ঞানে শূন্যের আভাস
♦ সপ্তম অধ্যায়ঃ আইনস্টাইনের বিশ্ব
♦ অষ্টম অধ্যায়ঃ শূন্যতার শক্তি
♦ নবম অধ্যায়ঃ মহাবিস্ফোরণের কথা
♦ দশম অধ্যায়ঃ বিগ ব্যাং-এর আগে কী ছিল?
♦ একাদশ অধ্যায়ঃ কোয়ান্টাম শূন্যতা ও মহাবিশ্বের উৎপত্তি
♦ দ্বাদশ অধ্যায়ঃ হিগস কণার খোঁজে
♦ ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি
♦ চতুর্দশ অধ্যায়ঃ অনন্ত মহাবিশ্বের সন্ধান শূন্য ও অসীমের মেলবন্ধন
♦ পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ অন্তিম প্রশ্নের মুখোমুখি: কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?
“শূন্য থেকে মহাবিশ্ব” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ