আজ যবে প্রভাতের নব যাত্রীদল

ডেকে গেল রাত্রিশেষে, ‘চল আগে চল’

‘চল আগে চল’ গাহে ঘুম-জাগা পাখি,

কুয়াশা-মশারি ঠেলে জাগে রক্ত-আঁখি

নবারুণ নব আশা। আজি এই সাথে,

এই নব জাগরণ-আনা নব প্রাতে

তোমারে স্মরিনু বীর প্রাতঃস্মরণীয় !

স্বর্গ হতে এ স্মরণ-প্রীতি অর্ঘ্য নিয়ো !

নিয়ো নিয়ো সপ্তকোটি বাঙালির তব

অশ্রু-জলে স্মৃতি-পূজা অৰ্ঘ অভিনব !

 

আজও তারা ক্রীতদাস, আজও বদ্ধ- কর

শৃঙ্খল-বন্ধনে দেব ! আজও পরস্পর

করে তারা হানাহানি, ঈর্ষা-অস্ত্রে যুঝি

ছিটায় মনের কালি-নিরস্ত্রের পুঁজি !

মন্দভাষ গাঢ় মসি দিব্য অস্ত্র তার !

‘দুই-সপ্ত কোটি ধৃত খর তরবার’

সে শুধু কেতাবি কথা, আজও সে স্বপন !

সপ্তকোটি তিক্ত জিহ্বা বিষ-রসায়ন

উদ্‌গারিছে বঙ্গে নিতি, দগ্ধ হল ভূমি !

বঙ্গে আজ পুষ্প নাই, বিষ লহো তুমি !

কে করিবে নমস্কার! হায় যুক্তকর

মুক্ত নাহি হল আজও ! বন্ধন-জর্জর

এ কর পারে না দেব ছুঁইতে ললাট !

 

কে করিবে নমস্কার ?

কে করিবে পাঠ

তোমার বন্দনা-গান? রসনা অসাড় !

কথা আছে বাণী নাই ছন্দে নাচে হাড় !

 

ভাষা আছে আশা নাই, নাই তাহে প্ৰাণ,

কে করিবে এই জাতিরে নবমন্ত্র দান !

অমৃতের পুত্র কবি অন্নের কাঙাল,

কবি আর ঋষি নয়, প্রাণের অকাল

করিয়াছে হেয় তারে! লেখনী ও কালি

যত না সৃজিছে কাব্য ততোধিক গালি !

কণ্ঠে যার ভাষা আছে অন্তরে সাহস,

সিংহের বিবরে আজ পড়ে সে অবশ !

গর্দান করিয়া উঁচু যে পারে গাহিতে

নব জীবনের গান, বন্ধন-রশিতে

চেপে আছে টুটি তার ! জুলুম-জিঞ্জির

মাংস কেটে বসে আছে, হাড়ে খায় চিড়

আর্ত প্রতিধ্বনি তার! কোথা প্রতিকার !

যারা আছে-তারা কিছু না করে নাচার !

 

নেহারিব তোমারে যে শির উঁচু করি,

তাও নাহি পারি, দেব! আইনের ছড়ি

মারে এসে গুপ্ত চেড়ী। যাইবে কোথায় !

আমার চরণ নহে মম বশে, হায়।

এক ঘর ছাড়ি আর ঘরে যেতে নারি,

মদজাতি হয়ে আছে পর্দা-ঘেরা নারী !

এ লাঞ্ছনা, এ পীড়ন, এ আত্মকলহ,

আত্মসুখপরায়ণ পরাবৃত্তি মোহ-

তব বরে দূর হোক! এ জাতির পরে

হে যোগী, তোমার যেন আশীর্বাদ ঝরে !

যে-আত্মচেতনা-বলে যে আত্মবিশ্বাসে

যে-আত্মশ্রদ্ধার জোরে জীবন উচ্ছ্বাসে

উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে মরা জাতি বাঁচে,

যোগী, তব কাছে জাতি সেই শক্তি যাচে !

 

স্বর্গে নহে, আমাদের অতি কাছাকাছি

আছ তুমি হে তাপস, তাই মোরা যাচি

তব বর, শক্তি তব ! জেনেছিলে তুমি

স্বর্গাদপি গরীয়সী এই বঙ্গভূমি !

দিলে ধর্ম, দিলে কর্ম, দিলে ধ্যান জ্ঞান,

তবু সাধ মিটিল না, দিলে বলিদান

আত্মারে জননি-পদে, হাঁকিলে, “মাভৈঃ !

ভয় নাই, নব দিনমণি ওঠে ওই !

ওরে জড়, ওঠ তোরা !” জাগিল না কেউ,

তোমারে লইয়া গেল পারাপারী ঢেউ।

 

অগ্রে তুমি জেগেছিলে অগ্রজ শহিদ,

তুমি ঋষি, শুভ প্রাতে টুটেছিল নিদ,

তব পথে যাত্রী যারা রাত্রি-দিবা ধরি

ঘুমাল গভীর ঘুম, আজ তারা মরি

বেলাশেষে জাগিয়াছে ! সম্মুখে সবার

অনন্ত তমিস্রাঘোর দুর্গম কান্তার!

পশ্চাতে ‘অতীত’ টানে জড় হিমালয়,

সংশয়ের ‘বর্তমান’ অগ্রে নাহি হয়,

তোমা-হারা দেখে তারা অন্ধ ‘ভবিষ্যৎ’,

যাত্রী ভীরু, রাত্রি গুরু, কে দেখাবে পথ !

 

হে প্রেমিক, তব প্রেম বরিষায় দেশে

এল ঢল বীরভূমি বরিশাল ভেসে।

সেই ঢল সেই জল বিষম তৃষায়

যাচিছে ঊষর বঙ্গ তব কাছে হায় !

পীড়িত এ বঙ্গ তব কাছে হায় !

পীড়িত এ বঙ্গ পথ চাহিছে তোমার,

অসুর নিধনে কবে আসিবে আবার !

 

হুগলি,

মাঘ, ১৩৩২

error: Content is protected !!