অভিনন্দনপত্র
১৬-১১-১৩৩৯
লাখুটিয়ার জমিদার বাবু সুরেন্দ্রকুমার রায়চৌধুরী লামচরি আগমন উপলক্ষে।
কৃপাসিন্ধু, দয়ার সাগর, বিপত্তারণ এ ধরায়;
মহামহিম! মহিমার্ণব মহাত্মা বাবু এস.কে.রায়।
জয় ভগবান, সর্বশক্তিমান,
জয় জয় ভবপতি।
এ বিশ্ব সংসার রচনা তোমার,
তোমাতেই থাকে মতি।
জয় সুরপতি, অগতির গতি,
জয় ব্রক্ষ্ম সনাতন।
জয় দেবরাজে, গোলক সমাজে,
মা’র প্রজা দেবগন।
জয় হৈমবতী, দক্ষসুতা সতী।
জয় জয় বীণাপাণি,
তব কৃপাছবি কালিদাস কবি,
রাষ্ট্র চরাচরে জানি।
জয় লক্ষ্মী মাতা, নরে রত্নদাতা।
জয় অন্নপূর্ণা মাতঃ।
জয় জগদ্ধাত্রী, তুমি পূজাপাত্রী –
কিন্তু আমি নারি তা তো।
আমি যে যবন, না জানি পূজন,
নাহি মানি বেদবাণী।
কোরানে বারণ, ত্যাগী সে কারণ।
কৃপা কর শূলপাণি।
যদিও যবন আমি দেবধর্ম অরি,
তথাপি কতক দেবে সদা মান্য করি।
মাতা দেবী, পিতা দেব, দেব শিক্ষাগুরু;
পূজি এ সকলে দিয়ে ভক্তির অগুরু।
পরম দেবতা যিনি রাজ্য অধিকারী
সর্বশাস্ত্রমতে তাঁর পূজা দিতে পারি।
কিন্তু ভগবান মোর সদাই বিমুখ,
তাই আমি নাহি পাই রাজপূজা সুখ।
অর্থের অভাবে নারি করিতে অর্চনা,
বিদ্যার অভাবে নারি করিতে বন্দনা।
হৃদয়ে বাসনা কিন্তু লক্ষ্মী মোর বাম,
কোথায় পাইব আমি পূজা সরঞ্জাম?
কোথায় পাইব আমি দূর্বা-চন্দন-ফল?
কোথায় পাইব আমি পূত গঙ্গাজল?
কোথায় পাইব পশু পদে দিতে বলি?
কোথায় পাইব আমি পূজা-ফুল-কলি?
কোথায় পাইব আমি পূজার ব্রাক্ষ্মন?
আমাকে সৃজিল বিভু অস্পৃশ্য যবন।
অলক্ষ্যে দেবতা থাকে, লক্ষ্যেতে প্রতীমা –
সেই পূজা দিতে নাহি সরঞ্জামী সীমা;
সাক্ষাতে দেবতা হলে তার পূজা দিতে
মহজ্জন বিনে আর কে পারে মহীতে?
লঙ্কায় সাক্ষাৎ দিল দেবী দশভূজা,
নয়নকমল দিয়ে রাম দিল পূজা।
আপনিও আমাদের সাক্ষাত দেবতা,
তাই ভেবে হল মোর জ্ঞানের জড়তা।
কি দিয়ে পূজিব আমি ও হেমচরণ?
কেমনে লইব আমি ও-পদে শরণ?
কি দিব কি দিব ব’লে হয়ে হতজ্ঞান,
শ্রীচরণে করিলাম (মম) দেহপ্রাণ দান।
হেন লয় মতি
(তব) কন্ঠে সরস্বতী
করয় বসতি সদা খুশিতে।
বুঝি সে কারণে
উঁচু নিচু জনে
মধুর বচনে দেখি তুষিতে।
মা লক্ষ্মী অলক্ষ্যে
আপনার কক্ষে
নিশিদিন রক্ষে ধনের গোলা,
তাই বিতরণে
দীন-দুঃখী জনে
ভিক্ষায় ভোজনে রয়েছে খোলা।
(তব) যশের সৌরভ,
কুলের গৌরব,
কাজের পৌরব সকল পূরা।
উঠেছে গগনে
ঠেকেছে সঘনে,
করমশৈলের কিরতীচূড়া।
ভুবনে মেলে না
(তব) রূপের তুলনা –
জিনে রূপা-সোনা অঙ্গের কান্তি।
দেব আশীর্বাদে
এড়িয়ে বিপদে
আছেন সম্পদে, হৃদয়ে শাস্তি।
অতি গুণবান,
মহা ধনবান,
বিশিষ্ট ধীমান ধরায় ধরা।
রাখে নিরঞ্জনে
শান্তি নিকেতনে
পুত্র-কন্যাগণে সতত ভরা।
মদন দেবের সমান রূপ, কুবের সমান ধন।
ইন্দ্রের সম মোদের ভূপ, ভীমের সমান পণ।
কর্মে বিশ্বকর্মা যথা, ধর্মে যেন যুধিষ্টির।
মধুর সম মুখের কথা, সত্যবাদী, মতি ধীর।
বৃন্দাবনে রাখালরাজে, বাজাত মোহন বেণু,
শুনতে তাহা বনের মাঝে হাজির হইত ধেনু;
মহারাজের মুখের বাণী যেমন কালার বাঁশী,
ত্যাগ করিয়া অন্ন-পানি তাহাই শুনিতে আসি।
প্রজা পুত্র, রাজা পিতা, তাই পরমাদ –
পুত্র হইয়া কি দিব পিত্রে আশীর্বাদ?
হৃদয় মন্দিরে কিন্তু আবেগ নাকাড়া
আশীর্বাদ দিতে মোকে দিচ্ছে তবু সাড়া।
‘সুর’ অর্থ স্বর্গপুরী, ‘ইন্দ্র’ অর্থ রাজা,
মিলিয়ে উভয় শব্দ তব নাম তাজা।
‘সুরেন্দ্র’ নামের অর্থ হয় স্বর্গরাজ।
আশীর্বাদ করি রাজ্য হোক স্বর্গমাঝ।
ধরাধামে বিত্তবৃদ্ধি হোক দিনে দিনে।
রবি যেন স্থান না পায় তব রাজ্য বিনে।
উন্নতি পতাকা তব উঠুক আকাশে,
তারকা হইয়া থাক তারকার পাশে।
ষড়রিপু পরাজিত হোক মর্মদেশে,
বাহ্যিক হিংসুকগণ লয় হোক শেষে।
রোগাসুর যেন নাহি যায় তব হর্মে,
দ্বারেতে দাঁড়িয়ে যেন রক্ষা করে ধর্মে।
(তব গৃহে) না বহে শোকের ঝড়, নিবারুক হরি,
গোকূলে রাখিল যথা গোবর্ধন ধরি।
বিধাতার কৃপাবৃষ্টি হইয়ে যথাকালে
আশাবৃক্ষে হোক ফল প্রতি ডালে ডালে।
পবন বহিয়ে তব যশের সুগন্ধ
দিগন্তে বিতরে যেন নাহি রয় বন্ধ।
ধনে, জনে, মানে গৃহ হোক ভরপুর।
মর্যাদা বাড়ুক যথা গৌরীশৃঙ্গচূড়।
চন্দ্রের সুকান্তি হোক, রবির প্রতাপ,
দেহমন শুচি হোক, ঐহিকে নিষ্পাপ।
উমার চিন্তায় মহেশ পাগল,
রতির চিন্তায় কাম,
সীতায় চিন্তায় রাঘব পাগল,
রাধায় চিন্তায় শ্যাম।
শ্যামের চিন্তায় পাগল হইয়ে
জয়দেব উদাসীন,
রামপ্রসাদও হইয়ে পাগল
কালীপদে হয় লীন।
মহৎ চিন্তায় পাগল হইল
বিবেকানন্দ স্বামী,
অন্নের চিন্তায় মগ্ন হইয়া
পাগল হলেম আমি।
অন্য চিন্তা নাই কিছুই আমার
অন্নের চিন্তাই সার,
অন্নের ভাবনা ভাবিয়া ভাবিয়া
অস্থিচর্ম হই সার।
দারিদ্র রাক্ষুসী আসিয়া ভবনে
করিয়াছে গ্রাস মোকে।
বিধির হাতে সব নিধির তোড়া
(কেন) আমায় রাখিল শোকে?
মাথা হইল মোর মজ্জাবিহীন,
তিক্ত হইল ভাষ।
এ হেতু বলিয়া গিয়াছে অতীতে
মহাকবি কালিদাস –
“দরিদ্রস্যঃ গুণাঃ সর্বেঃ ভস্মাচ্ছাদিতঃ বহ্নিবৎ,
অন্নঃ চিন্তাঃ চমৎকরাঃ কা তরেঃ কবিতা কুতঃ।”
শক্তি সুবুদ্ধি সকল ফু’রাল,
সম্বল মোটেই নাই,
মহারাজের চরণতরী আমি
কি ল’য়ে দেখতে যাই?
(টাকা) কোথায় পাইব? কোথায় যাইব?
সতত তাহাই ভাবি।
কি দিয়ে এখন করিব পূরণ
বকেয়া করের দাবি?
মহারাজের চরণতলে এই মিনতি করি,
বিপদসিন্ধু উদ্ধারিবেন দিয়ে চরণতরী।
দাসানুদাস আপনার,
আরজ আলী মাতুব্বার।
চরবাড়িয়া লামচড়ি,
পূর্ব পাড়ায় বসত করি।
তেরশ উনচল্লিশ সাল,
ষোলই ফাল্গুন বৈকাল।