মৌসুমীকে জানতে, মৌসুমীর ওপর প্রাথমিক পরীক্ষা চালাতে আদ্রায় যাবো ঠিক করে ফেললাম। ২৯ আগস্ট ৮৯ সন্ধ্যায় পাভলভ ইনস্টিটিউটে ডাঃ বাসুদেব মুখোপাধ্যায়কে পেয়ে গেলাম। ডাঃ মুখোপাধ্যায় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি মৌসুমীর কাছে গিয়েছিলেন। ১৩ আগস্ট ৮৯-র আনন্দবাজারে এঁকেই পাভলভ ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা ডাঃ ডি এন গাঙ্গুলীর ছাত্র বলে পরিচয় দেওয়া হয়েছিল। ডাঃ মুখোপাধ্যায়কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “মৌসুমীকে পরীক্ষা করে কি মনে হল আপনার?”
-“অসাধারণ! কথা বললে অবাক হয়ে যাবেন। যে কোনও প্রশ্ন করুন, কম্পিউটারের মত উত্তর দিয়ে যাবে। আপনিও কি যাবেন নাকি?”
বললাম, “যাওয়ার ইচ্ছে আছে। আপনি কি ধরনের প্রশ্ন করেছিলেন?”
-“ওঁ অনেক কিছুই। যেমন অসাধারণ স্মৃতি, তেমনই মেধা। এইটুকুন তো বয়েস, এর মধ্যেই ডাচ, জার্মান ও দস্তুর মতো শিখে ফেলেছে। স্মার্টলি ডাচ, জার্মান বলে।”
এই পর্যন্ত বলেই সুর পাল্টালেন বাসুদেববাবু, “আমি মশাই শুধুই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, আপনার মত গোয়েন্দা নই। দেখুন, আপনি হয়তো মৌসুমীর মধ্যে অন্য কিছু খুঁজে পাবেন।”
কথায় শ্লেষের সুর স্পষ্ট। অবতার, অলৌকিক ক্ষমতাধর ওঁ জ্যোতিষীদের দাবি যাচাই করতে সত্যানুসন্ধান করি বটে, কিন্তু গোয়েন্দাগিরি তো আমার নেশা বা পেশা নয়! এই ধরনের ঠেস দেওয়া কথা কি নিজের প্রতি আস্থাহীনতার ফল? মৌসুমীর মেধা বিষয়ে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, সেটা সঠিক নাও হতে পারে মনে করেই কি এমন কথা বললেন?
২ সেপ্টেম্বর ৮৯ রাতে ‘হাওড়া-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার’ ধরলাম। সঙ্গী হলেন চিত্র-সাংবাদিক কল্যাণ চক্রবর্তী ও আমাদের সমিতির সদস্য মানিক মৈত্র। ট্রেনে সহযোগী হিসেবে পেলাম সুবীর চট্টোপাধ্যায় ও শঙ্কর মালাকারকে। ওঁরাও মৌসুমীর বাড়িই যাচ্ছেন ‘প্রমা সাংস্কৃতিক সংস্থা’র তরফ থেকে। ৭ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রসদনে মৌসুমীকে অভিনন্দন জানাবেন প্রমার তরফ থেকে প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়, তারই প্রয়োজনে কিছু কথা সারতে। ইতিমধ্যে পত্র-পত্রিকায় এই অনুষ্ঠানের বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপনও প্রকাশ করেছে প্রমা।
আদ্রায় যখন পৌঁছলাম তখন সকাল ছ’টা। ঝড়িয়াডিহির রেল কোয়ার্টারে মৌসুমীদের বাড়ি পৌঁছলাম সারে ছ’টায়। পাহারারত পুলিশ ঢোকার মুখে বাধা দিলেন। মৌসুমীর বাবা সাধনবাবুর সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন সুবীরবাবু। সাধনবাবু ভিতরে নিয়ে গেলেন। এক ঘরের ছোট্ট কোয়ার্টার। সামনে একফালি কাঠের জাফরি ঘেরা বারান্দা। ভিতরে রান্না ঘর। ঘরে দিনের বেলাতেও আলো জ্বালতে হয়। সাধনবাবু আলাপ করিয়ে দিলেন স্ত্রী শিপ্রা ও দুই মেয়ে মৌসুমী এবং মহুয়ার সঙ্গে।
সাধনবাবু টানা ঘণ্টা দুয়েক মৌসুমী বিষয়ে নানা কথা শোনালেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পত্র-পত্রিকায় মৌসুমীকে নিয়ে প্রকাশিত লেখা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে আসা চিঠি ও টেলিগ্রাম। জানালেন ২১, ২২, ২৩ সেপ্টেম্বর মৌসুমীকে নিয়ে দিল্লিতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে। অফিস ‘স্পেশাল লিভ’ দিয়েছে। আমন্ত্রণের চিঠি দেখতে চাওয়ায় বললেন, চিঠি অফিসে আছে। শুনলাম আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত প্যারাসাইকোলজিস্ট আইন স্টিভেনসন সাধনবাবুকে চিঠি পাঠিয়ে জানিয়েছেন, মৌসুমীকে পরীক্ষা করতে আসছেন।
সাধনবাবুর কথার মাঝেই জিজ্ঞেস করলাম, “কিছু কিছু পত্রিকায় লেখা হয়েছে মৌসুমীর জ্ঞান গ্র্যাজুয়েশন লেভেলের। মৌসুমী বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করছে। কথাগুলো কি সত্যি?”
সাধনবাবু জানালেন, “গ্র্যাজুয়েশন কি বলছেন, ওর জ্ঞান অনার্স লেভেলের। ও মাধ্যমিকে বসতে বাধ্য হচ্ছে, মাধ্যমিক না দিলে কলেজে ভর্তি করায় আইনগত অসুবিধে আছে বলে। তবে এটুকু জেনে রাখুন মাধ্যমিক ও ফার্স্ট হবেই এবং রেকর্ড নাম্বার পেয়েই। ওর হাই স্ট্যান্ডার্ডের উত্তর কজন এগজামিনার বুঝবেন সে বিষয়েই সন্দেহ আছে। আর ওর গবেষণার যে সব খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা সবই সত্যি। ওর রিসার্চের কাজ শেষ হলে পৃথিবী জুড়ে হৈ-চৈ পড়ে যাবে। একটুও না বাড়িয়েই বলছি, প্রত্যাশা রাখছি ও নোবেল প্রাইজ পাবে এবং শিগগিরই।”
“কি বিষয় নিয়ে রিসার্চ করছ তুমি?” মৌসুমীকে প্রশ্নটা করলে উত্তর দিলেন সাধনবাবুই “তিনটি বিষয় নিয়ে রিসার্চ করছে। বিষয় তিনটি খুবই গোপনীয়। আর যেসব সাংবাদিক এসেছিলেন তাঁদের কাউকে বলিনি। আপনাকে বলেই শুধু বলছি- এয়ার পলিউশন, সোলার এনার্জি ও কোলকে সালফার মুক্ত করার বিষয় নিয়ে বর্তমানে গবেষণা করছে। পরবর্তীতে জেনেটিক্স নিয়ে গবেষণার ইচ্ছে আছে। অনেক দেশের নজর ওর ওপর রয়েছে। গবেষণার বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে বিদেশী শক্তি ওঁকে কিডন্যাপ করতে পারে। তাই এই গোপনীয়তা।”
“মৌসুমী তোমার গবেষণার কাজ কেমন এগোচ্ছে?”
এবারের উত্তর মৌসুমীই দিল, “খুব ভালমতই এগোচ্ছে, আশা করছি এর জন্যে নোবেল পাব আড়াই বছরের মধ্যে।”
ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে নানারকম গল্প-সল্প, হালকা রসিকতা, মুড়ি-তেলেভাজা, চা ইত্যাদির মাঝে মাঝে মৌসুমীকে যত বারই প্রশ্ন করেছি প্রায় ততবারই উত্তর দিয়েছেন সাধনবাবু এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিপ্রাদেবী। ইতিমধ্যে ওঁরা দুজনেই জানালেন, বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের কথা, যারা প্রত্যেকেই মৌসুমীর জ্ঞানের দীর্ঘ পরীক্ষা নিয়ে বিস্মিত হয়েছেন। আমাকে সাধনবাবু বললেন, “আপনি যে কোনও কেন্দ্রীয় বা রাজ্য মন্ত্রীর নাম জিজ্ঞেস করুন, দেখবেন পটাপট উত্তর দেবে, অথবা জিজ্ঞেস করুন না কোনও দেশের রাষ্ট্র প্রধানের নাম। অথবা অন্য কিছুও জিজ্ঞেস করতে পারেন।”
সাধনবাবু মৌসুমীকে জিজ্ঞেস করলেন, “রাজীব গান্ধী কবে প্রধানমন্ত্রী হন?”
মৌসুমী বলে গেল, “থার্টি ফার্স্ট অক্টোবর নাইনটিন এইটটি ফোর।”
সাধনবাবুর আবার প্রশ্ন, “কবে কলকাতার জন্ম হয়েছিল?”
সাধনবাবুর চকচকে চোখে উৎসাহিত প্রশ্নে ও মৌসুমীর জবাবে সুবীরবাবু ও শঙ্করবাবু যথেষ্ট উৎসাহিত হচ্ছিলেন।
সুবীরবাবু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “সব ঠিক ঠিক উত্তর দিচ্ছে তো?”
বললাম, “হ্যাঁ।”
ইতিমধ্যে সাধনবাবু আরও অনেক প্রশ্ন করেছেন। আমাকেও এই ধরনের প্রশ্ন করে মৌসুমীর স্মরণ শক্তির পরীক্ষা নিতে আবারও উৎসাহিত করলেন সাধনবাবু ও শিপ্রাদেবী।
না, জিজ্ঞেস করলাম না। কারণ মৌসুমীর বাবা মা যেভাবে আমাকে পরীক্ষা নিতে মানসিক ভাবে চালিত করবেন সেভাবে পরীক্ষা নইলে যে বাস্তবিকই পরীক্ষাটা আর পরীক্ষা থাকবে না, সে বিষয়ে সচেতন ছিলাম।
পত্র-পত্রিকা পড়ে ও দূরদর্শনের কল্যাণে জেনেছিলাম সাধনবাবু বিজ্ঞানী। মৌসুমী তাঁকে বিজ্ঞান গবেষণার সাহায্য করে। এও জেনেছি, মৌসুমীর মা শিপ্রাদেবীও ভাল ছাত্রী ছিলেন। কিন্তু সাধনবাবু ও শিপ্রাদেবীর কথাবার্তায়, ব্যবহারে এই জানাকে সত্য বলে মেনে নিতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল দুজনের বাক চাতুর্যকে তারিফ করেও বাস্তব সত্যকে টেনে আনতে বললাম, “ডাক্তার ডি এন গাংগুলী আনন্দবাজারের প্রতিবেদককে বলেছেন, “মোসুমীর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তির পিছনে আছে সম্ভবত বহু প্রজন্ম পূর্বের কোনও সুপ্ত জিন, এই মেয়েটির মধ্যে যার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।” এই পরিপ্রেক্ষিতে আপনার ও আপনার স্ত্রীর কাছে আপনাদের পূর্ব পুরুষদের বিষয়ে জানতে চাই।”
সাধনবাবু জানালেন, “আমাদের পূর্বপুরুষদের কেউ শ্রুতিধর ছিলেন বলে কোন দিনই শুনিনি।” আরও জানালেন চাষ-বাসই ছিল পূর্ব পুরুষদের জীবিকা। সাধনবাবু ও তাঁর দাদাই প্রথম চাকরী করছেন। শিপ্রাদেবী জানালেন, “আমার বাবা ঠাকুরদারা ছিলেন বড় বড় অফিসার।”
“কি ধরনের অফিসার?” প্রশ্ন করে জানতে পারলাম, বাবা ছিলেন গ্রামের পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার এবং ঠাকুরদা ছিলেন বাঁকুড়া জেলার একটি গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার।
সাধনবাবু ৬৯ সালে স্কুল ফাইনালে পাশ করেছেন থার্ড ডিভিশনে। ৭৩-এ পাশ কোর্সের বি এস সি পাশ করেন। বিষয় ছিল ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথমেটিক্স। ৭৮-এ ধানবাদের ফুয়েল রিসার্চ ইন স্টিটিউট-এ স্টেনোগ্রাফার হন এবং বর্তমানে জুনিয়র সাইনটিস্ট পদে কাজ করেছেন।
শিপ্রা দেবী স্কুল ফাইনাল পাস করেছেন ৭৪-এ থার্ড ডিভিশনে। ৭৮-এ পাশ কোর্সে বি এ পাশ করেন। স্টেনোগ্রাফি জানেন। ৮৬-তে ইনটিগ্রেটেড চাইল্ড ডেভলাপমেন্ট-এ সুপারভাইজার পদে যোগ দেন।
শিপ্রা দেবী লক্ষ্মীর ভক্ত। সাধনবাবু মা কালীর। শিপ্রা দেবীকে জিজ্ঞেস করলাম, “একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, আপনি নাকি মৌসুমীর জন্মের সময় দেখেছিলেন মা লক্ষ্মী শ্বেতবর্ণা সরস্বতীর রূপ নিয়ে আপনার কোলের কাছে এসে মিলিয়ে যান। ঘটনাটা কি সত্যি?”
শিপ্রা দেবী উত্তর দিলেন, “পুরোপুরি সত্যি।”
“আপনি কি বিশ্বাস করেন মৌসুমীই সরস্বতী?”
“মৌসুমী এই বয়সেই যেভাবে গবেষণার কাজ দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে চলেছে তাতে এমনটা বিশ্বাস করা কি অবাস্তব কিছু?”
“মৌসুমী কি কি ভাষা তুমি জান?” জিজ্ঞেস করায় মৌসুমীর বাবা ও মা জানালেন, বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, জার্মান ও ডাচ ভাষা জানে।”
আমার লেখা ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ বইটি থেকে দুটি বাক্য একটি সাদা পাতায় লিখে ফেলল মানিক। পাতাটা এগিয়ে দিল মৌসুমীর কাছে। অনুরোধ করলাম চারটি ভাষাতেই বাক্য দুটি অনুবাদ করে দিতে। সাধনবাবু বললেন, “ও পরীক্ষা করতে চাইছেন? আপনাদের এতো ঝামেলার ও কষ্টের কোনও দরকার হবে না।” তাক থেকে একটা বই বের করে তার থেকে একটা পৃষ্ঠা মৌসুমীর সামনে মেলে ধরে বললেন, “এখান থেকে বাংলাটা পড়ে চারটে ভাষাতেই অনুবাদ করে কাকুদের শুনিয়ে দাও।”
সাধনবাবুর রাখা বইটা তুলে নিয়ে বললাম, “হিন্দি, ডাচ, জার্মানের কিছুই বুঝবো না। তাইতেই মৌসুমীকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছি। যারা জানেন তাঁদের দেখিয়ে নেব।”
মৌসুমী বার কয়েক পড়ে বলল, “ইংরেজি করতে পারবো না।” বললাম, “তাই লিখে দাও।” ‘English-এর জায়গায় ‘No’ লিখে তলায় নিজের নাম সই করে দিল। হিন্দিতে প্রথম দুটি বাক্য অনুবাদ করলো। ইতিমধ্যে মা বললেন, “কেন তুমি ইংরেজি পারবে না, চেষ্টা কর না।” মৌসুমী বলল, “যুগের ইংরেজি কি?” মা বললেন, “তুমি তো জান যুগের ইংরেজি era। চেষ্টা কর চেষ্টা কর।’ মৌসুমী ‘In modern era’ পর্যন্ত লিখে প্রথম বাক্যটা অসমাপ্ত রাখলো কয়েকটা ডট চিহ্ন দিয়ে। তারপর দ্বিতীয় বাক্যটা শেষ করলো। Dutch লিখে লিখলো No। German লিখেও No। তারপর স্বাক্ষর ও তারিখ।
সাধনবাবু আমাকে কিছু বলছিলেন, শুনছিলাম। সেই সুযোগে শিপ্রা দেবী মৌসুমীকে ইংরেজি অনুবাদের অসমাপ্ত অংশটুকুর ইংরেজিটা বলে দিয়ে লেখালেন আমাদের পাঁচ আগন্তুকের উপস্থিতিতেই। আমি শিপ্রা দেবীকে বললাম, “পরীক্ষাটা মৌসুমীর নিচ্ছি, আপনার নয়। অতএব, আপনার বলে দেওয়া অংশটা কাটুন।” অসন্তুষ্ট শিপ্রা দেবী লম্বা দাগ টেনে কাটলেন। অবশ্য না কেটে মৌসুমীর ইংরেজি জ্ঞানের প্রমাণ হিসেবে ধরে নিলেও মৌসুমীর মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সামান্যতম তারতম্য ঘটতো না। কারণ শিপ্রা দেবীর অনুবাদও ছিল সম্পূর্ণ ভুলে ভরা। কাটা অংশে মৌসুমী, সাধনবাবু ও সুবীর চট্টোপাধ্যায় স্বাক্ষর করলেন।
শিপ্রা দেবী আবার মুখ খুললেন, “মৌসুমী, তুমি ডাচ ও জার্মান যে সব শব্দগুলো শিখেছো সেগুলো বলে দাও তো।” বললাম, “তার কোন প্রয়োজন নেই। ‘ধন্যবাদ’ কথাটা ২৫টি ভাষায় কেউ বলতে বা লিখতে শিখলে এই প্রমাণ হয় না যে সে ২৫টি ভাষা জানে।”
দুটি বাক্যের হিন্দি অনুবাদে মৌসুমী ভুল করেছিল ১৩টি। একথা পরের দিন জেনেছিলাম কলকাতা ৫৫-র রাষ্ট্রভাষা জ্ঞানচক্রের অধ্যক্ষ নিমাই মণ্ডলের কাছ থেকে। ইংরেজি অনুবাদের অবস্থা আরও খারাপ। প্রথম বাক্যটির কথা তো আগেই বলেছি। দ্বিতীয় বাক্যটির অনুবাদও ছিল আগাগোড়া অর্থহীন ও ভুলে ভরা।
সাধনবাবু এক সময় বলতে শুরু-করলেন, “বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী ও পত্র-পত্রিকা মৌসুমীকে ‘প্রডিজি’ বলে ঘোষণা করেছে। মৌসুমীর আই কিউ অবশ্যই প্রডিজি মিনিমাম লেভেলের চেয়ে অনেক বেশি, ওর আই কিউ ২৮০।”
তৈরিই ছিলাম। নর্মান সুলিভান-এর লেখা ‘টেস্ট ইয়োর ইনটেলিজেন্স’ বই-এর
‘ইজি’ গ্রুপ থেকে তিনটি এবং ‘মোর ডিফিকাল্ট’ গ্রুপ থেকে দুটি আই কিউ দিলাম। যারা আই কিউ ক্ষমতার নূন্যতম দাবীদার তারা প্রত্যকেই এই পাঁচটির মধ্যে অন্তত তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম। মৌসুমী আমাদের প্রত্যেককে নিরাশ করে সাধনবাবুর দাবির চূড়ান্ত অসাড়তা প্রমাণ করলো দুটির ক্ষেত্রে “পারবো না” জানিয়ে এবং তিনটির ক্ষেত্রে ভুল উত্তর দিয়ে।
তিনটি অংক দেওয়া হল। যার মধ্যে দুটি সিক্স সেভেন লেভেলের। প্রথম অংকটি- দুটি মৌলিক সংখ্যার যোগফল ৭৫। সম্ভাব্য সংখ্যা দুটি কত? ইংরেজিতে লেখা প্রশ্নটা মানিককেই পড়ে দিতে হল। মৌসুমী মানে বুঝতে পারছিল না। বাংলা মানে করে মৌলিক সংখ্যার ব্যাখ্যা করে দেওয়া হল- যে সংখ্যাকে শুধু মাত্র সেই সংখ্যা এবং ১ দিয়ে ভাগ করা যায় তাকেই বলে মৌলিক সংখ্যা।
এত বোঝানোর পরও মৌসুমী লিখলো ৫২ ও ২৩। উত্তরটা অবশ্যই ভুল। কারণ, ৫২ কে ২, ৪, ১৩ ইত্যাদি দিয়ে ভাগ করা যায়।
দ্বিতীয় অংকটি ছিল, রাম শ্যামের দোকানে এলো। ৫০ টাকার জিনিস কিনে ১০০ টাকা দিল। শ্যামের কাছে খুচরো না থাকায় শ্যাম মধুর দোকান থেকে রামের ১০০ টাকা দিয়ে খুচরো এনে ৫০ টাকা রামকে দিল, রাম চলে গেল। মধু এসে জানালো ১০০ টাকাটা নকল। শ্যাম মধুকে ১০০ টাকার একটা নোট ফেরত দিতে বাধ্য হল। শ্যামের কত টাকা ক্ষতি হল?
মৌসুমী বার কয়েক প্রশ্নটা পড়লো। ওর বাবাও প্রশ্নটা বুঝিয়ে দিতে সাহায্য করলেন। মৌসুমী বাবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, “২০০ টাকা হবে না বাবা।”
সাধনবাবু বললেন, “তাই লেখো। এই কথার মধ্য দিয়েই সাধনবাবু মৌসুমীকে ২০০ টাকা লেখার সঙ্কেত দিলেন। আমি নিশ্চিত, সাধনবাবুর কাছে উত্তরটা অন্য কিছু মনে হলে “আর একটু ভাব” জাতীয় কিছু বলে বুঝিয়ে দিতেন উত্তর ঠিক হচ্ছে না।
মৌসুমী উত্তর ২০০ টাকা লিখে স্বাক্ষর করলো। এই উত্তরটাও মৌসুমী ও সাধনবাবুর ভুল হল। উত্তর হবে ১০০ টাকা। কারণ, শ্যাম মধুর কাছ থেকে ১০০ টাকা পেয়েছিল, ১০০ টাকাই ফিরিয়ে দিল। লাভ-ক্ষতি শূন্য। ক্ষতি শুধু রামকে দেওয়া ৫০ টাকার জিনিস ) ৫০টি টাকা।
ব্যর্থতা ও অনিশ্চিত অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সাধনবাবু বললেন, “ও ফিজিক্স, কেমেস্ট্রিতে অনার্স স্ট্যান্ডার্ডের। ওকে বুঝতে হলে ওই সব নিয়ে প্রশ্ন করুন।”
এমন একটা অবস্থার জন্যও তৈরি ছিলাম। পাঁচটা প্রশ্ন লিখে উত্তর দেওয়ার মত জায়গা রেখে হাজির করলাম মৌসুমীর সামনে। প্রশ্নগুলো অবশ্যই উচ্চ মাধ্যমিক থেকে বি এস সই পাশ কোর্স মানের। প্রশ্ন প্রশ্ন “What is the formula of Chrome alum?”
মৌসুমী পরিষ্কার অক্ষরে লেখা ইংরেজিও পড়তে পারছিল না। পড়ে বাংলা মানে করে দেওয়ার পরও মৌসুমী উত্তরের সঙ্কেতের আশায় বাবার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। বাবা বললেন, “মনে নেই পটাসিয়াম অ্যালার্মের ফর্মুলা?” বাবার সব চেষ্টাতে ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়ে মৌসুমী লিখ “No”। করলো স্বাক্ষর।
দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল What is the clue of chemical reactions?” মৌসুমীকে পূর্ববৎ বাংলা মানে করে দিতে হল। মৌসুমী আবার দীর্ঘ সময় সময় নিয়ে শেষ পর্যন্ত লিখলো “No”। করলো স্বাক্ষর।
তৃতীয় প্রশ্ন “What is the equvalent weight of an acid?” প্রশ্ন নিয়ে মৌসুমী এবারও খাবি খেল। সাধনবাবু বললেন, “অ্যাসিড কাকে বলে মনে নেই।” মৌসুমী দম দেওয়া পুতুলের মত বলে গেল, অ্যাসিড কাকে বলে। সাধনবাবু মেয়েকে বার বার করে ধরিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু মৌসুমী আবার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে লিখলো “No”।
চতুর্থ প্রশ্ন “What is dynamic allotropy?” বাংলা মানে বলে দেওয়া স্বত্বেও মৌসুমীর কিছুই বোধগম্য হল না। বাবা allotropy-র মানে ধরিয়ে দিতে বলেছিলেন, “কারন মানে হিরে।” না, মৌসুমী তাও উত্তর খুঁজে পায়নি। লিখেছিল “No”।
শেষ প্রশ্নে ছিল What is the condition for the angle of contact to wet the surfave?” এবার বাংলা করে দেওয়া স্বত্বেও মৌসুমী কেন, সাধনবাবুও মানে ধরতে পারলেন না।
প্রতিটি প্রশ্ন-উত্তরের পাতায় সাধনবাবু ও সাক্ষী হিসেবে সুবীরকুমার চ্যাটার্জির স্বাক্ষর করিয়ে নিলাম।
সাধনবাবুর নিজের বাড়ি রেল-কোয়ার্টারের কাছেই। সেখানেই মৌসুমীর গবেষণাগার। আমরা সকলেই গেলাম সেখানে। ছোট বাড়ি। তারই ঘরের দেওয়ালের র্যাকের দুটি সারিতে কয়েকটা টেস্ট টিউব, রাউন্ড বটম ফ্লাস্ক ইত্যাদি সাজান। এটাকে গবেষণাগার বললে গবেষণা ব্যাপারটাকেই ছেলেখেলা পর্যায়ে টেনে নামান হয়।
সাধনবাবুকে বললাম, “আলোকপাত পড়ে জানলাম, মৌসুমীর টাইপের স্পিড ইংরেজিতে ৯০ এবং বাংলায় ৪০। ওর টাইপের স্পিড নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্ন কথা লেখা হয়েছে। কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে- আমার মত অনেকেই বুঝে উঠতে পারছেন না। এ বিষয়ে আপনার মুখ থেকেই শুনতে চাই।”
সাধনবাবু জানালেন, “ইংরেজিতে ওর স্পিড মিনিটে ৬০, তবে বাংলায় ধরে ধরে টাইপ করে। কোনও স্পিড নেই।”
ইংরেজি টাইপের পরীক্ষা নিতে চাওয়ায় শিপ্রা দেবী একটা বই এগিয়ে দিলেন মেয়ের দিকে। আমি সেই বইটা সরিয়ে এগিয়ে দিলাম ‘সানডে’ পত্রিকার ২৩-২৯ জুলাই সংখ্যার পৃষ্ঠা ২১। মৌসুমী তাইপ করলো ১ মিনিট সময়ে যতটা পারলো। স্বাক্ষর করলো নিজেই। সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর দিলেন সাধনবাবু ও সুবীরবাবু। সাধনবাবু এও লিখে দিলেনঃ এটা এক মিনিটে টাইপ হয়েছে।
দমদম মতিঝিল কলেজের গায়ে হিলনার কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট-এর ইন্সট্রাক্টর নিরঞ্জন দাসের সঙ্গে দেখা করে মৌসুমীর করা তাইপের পাতাটা দিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, এটার টাইপিং স্পিড কত? শ্রীদাস এই কাজেই লিখে দিলেন স্পিড ২২। অবশ্য টাইপিং নির্ভুল ছিল না। ভুল ছিল তিনটি। আমরা কয়েকজন টাইপ
শিক্ষার্থীর উপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখেছি, তাঁরা ওই অংশটুকু ৩৫ থেকে ৪৫ সেকেন্ডের মধ্যে করে দিতে পেরেছেন।
বিদায় লগ্নে মৌসুমীর বাবা অনুরোধ করলেন, মেয়ের ওই অকৃতকার্যতাকে প্রকাশ না করার জন্য। সেই সঙ্গে ৭ সেপ্টেম্বরের সন্ধ্যায় রবীন্দ্র সদনে মৌসুমীকে অভিনন্দন জানাবার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানালেন।
আমাদের পাঁচ আগন্তুককে রিক্সায় তুলে দিতে এলেন সাধনবাবু। সাধনবাবুকে বললাম, “মৌসুমী খুব সুন্দর যথেষ্ট সম্ভাবনাময় একটি মেয়ে। ওর মুখ চেয়ে আপনাকে একটি অনুরোধ, ওকে না বুঝিয়ে মুখস্ত করাবেন না। এতে প্রচার হয়তো পাবেন কিন্তু এই না বুঝে মুখস্ত করার প্রবণতা ওর বুদ্ধি বিকাশের পক্ষে বাধা হতে পারে।”
৭ আগস্ট ‘The Telegraph” দৈনিক পত্রিকায় বক্স করে প্রকাশিত হল মৌসুমীকে পরীক্ষা করার ও তার অনুত্তীর্ণ হওয়ার খবর।
৭ আগস্ট সন্ধ্যায় আমাদের সমিতির পক্ষে আমি এবং কয়েকজন ‘রবীন্দ্র সদন’-এ উপস্থিত ছিলাম মৌসুমীর অভিনন্দন অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করতে।
মৌসুমীকে অভিনন্দন জানিয়ে ঘোষণা মত অন্নদাশঙ্কর রায় কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। মামুলি প্রশ্ন। সচেতন দর্শকরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন অন্নদাশঙ্কর রায়ের ইংরেজিতে করা প্রশ্ন “ডু ইউ ওয়ান্ট হ্যাপিনেস?” স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারিত হলেও ও মানে ধরতে পারলো না। উত্তর দিল “আই ওয়ান্ট টু বি এ সায়েন্টিস্ট”। অন্নদাশঙ্কর হেঁসে ফেলে আবার প্রশ্নটা করলেন। মৌসুমী বিষয়টা ধরতে চেয়েছিল কিন্তু পারছিল না। পাশে বসা কৃষ্ণ ধর প্রশ্নটা বাংলা করে দিলেন। এরপরও অন্নদাশঙ্কর যেসব ইংরেজি প্রশ্ন করেছিলেন, তার বাংলা অনুবাদ করে দিতে হয় পাশে বসা কৃষ্ণ ধরকে।
সাধনবাবু কিছু বলতে উঠলেন। মেয়ের বিষয়ে অনেক কিছুই বললেন। আবারও ঘোষণা করলেন হিন্দি, ইংরাজি, ডাচ, জার্মান ভাষা জানে। সাধনবাবুই মেয়েকে কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। ও উত্তর দিল। আমি প্রমা সংস্থার অন্যতম ব্যবস্থাপক সুধীরবাবু ও শঙ্করবাবুকে বললাম আমাকে কিছু প্রশ্ন করার অনুমতি দেবেন? সভার পরিচালক অমিতাভ চৌধুরী আমাকে অনুরোধ করলেন কোনও প্রশ্ন না করতে এবং সাধনবাবুর মিথ্যা ভাষণের প্রতিবাদ না করতে। যুক্তি হিসাবে শ্রীচৌধুরী দুটি কারণ দেখিয়েছিলেন। একঃ মেয়েটি তার অভিনন্দন অনুষ্ঠানেই অপমানিত হলে পরম আঘাত পাবে। দুইঃ অনুষ্ঠানে গোলমাল হতে পারে। অগ্রজ-প্রতিম অমিতাভ চৌধুরীর অনুরোধকে আদেশ হিসেবে শিরোধার্য করে নিয়েছিলাম।
৭ সেপ্টেম্বর টেলিগ্রাফে মৌসুমীর বিষয়ে আমাদের সমিতির মতামত প্রকাশিত হওয়ার পর দিনই, অর্থাৎ ৮ সেপ্টেম্বরের টেলিগ্রাফে দেখলাম সাধনবাবু টেলিগ্রাফের সাংবাদিককে জানিয়েছেন, সে দিনের পরীক্ষায় খারাপ করার কারণ মৌসুমী সেদিন ‘ব্যাড মুড’এ ছিল এবং কিছু প্রশ্ন ছিল সাধনবাবুরও বোধশক্তির অগম্য। মৌসুমীকে নাকি আমি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট লেভেলের প্রশ্ন করেছি। আই কিউ-এর প্রশ্নগুলো নাকি ব্যাঙ্কের প্রবেশনারি অফিসার নিয়োগ পরীক্ষায় দেওয়া হয়। অনুবাদ করতে দিয়েছিলাম গ্র্যাজুয়েশন লেভেলের। তারপরই সাধনবাবু আবার পরীক্ষা করার জন্য আমার ও আমাদের সমিতির উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন।
সেই সঙ্গে জানিয়েছেন এটা ভুললে চলবে না সে সাত বছরের শিশু এবং ১৯৯১-এ মাধ্যমিকে বসবে।
মৌসুমীর মুড ছিল না বলে সবই ভুল করেছে, এমনটা বিশ্বাস করা কঠিন। তবু আমরা সাধনবাবুর দেওয়া আবার পরীক্ষা গ্রহণের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছি।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, বেতার, দূরদর্শন, সংবাদ সরবরাহ সংস্থা সহ প্রচার মাধ্যমগুলো, রাজ্য শিক্ষামন্ত্রী, তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী, মধ্য শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রীকে লিখিত এক বক্তব্যে আমাদের সমিতির পক্ষে সভাপতি ডাঃ বিষ্ণু মুখার্জি জানান, মৌসুমীকে পরীক্ষা করতে কি কি ধরনের প্রশ্ন করা হয়েছিল, তারই এক সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে মৌসুমীর ব্যর্থতার খবর। আরও জানান, মৌসুমী লিখিত ভাবেই জানিয়েছে ‘ডাচ’, ‘জার্মান’, জানে না, হিন্দি ও ইংরেজিতে অনুবাদের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, ইংরেজিতে টাইপ করেছে ২২ স্পিডে, তাও টাইপে
ভুল ছিল। মৌসুমীর বাবা দাবী করেছেন- অনুবাদ করতে দেওয়া হয়েছিল গ্রাজুয়েট লেভেলের, আই কিউ ছিল ব্যাঙ্কের প্রবেশনারি অফিসার নিয়োগ পরীক্ষা পর্যায়ের এবং প্রশ্নগুলো ছিল পোস্ট গ্রাজুয়েট লেভেলের। আমরা সেভেন, এইটের কয়েকজন ভাল ছাত্র-ছাত্রীকে ওইসব অংক, আই কিউ ও ইংরেজি অনুবাদ করতে দিয়ে দেখেছি, তারা প্রত্যেকে প্রতিটি ক্ষেত্রে সঠিক উত্তর দানে সমর্থ হয়েছিল। মৌসুমীর বাবা আমাদের সমিতিকে জানিয়েছিলেন, মৌসুমীর জ্ঞান যদিও অনার্স গ্রাজুয়েটের মান অতিক্রম করেছে, কিন্তু শুধুমাত্র আইনসম্মত ভাবে উচ্চশিক্ষা লাভের প্রয়োজনে ও ৯১-তে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসছে। মৌসুমীর বাবা যেহেতু জানিয়েছিলেন পরীক্ষা গ্রহণের দিন মৌসুমী মুডে ছিল না, আমরা মৌসুমীকে কিছু প্রস্তাব রাখছি।
১। মৌসুমী যখন ভাল ‘মুডে’ থাকবে তখন আবার ওর পরীক্ষা নিতে প্রস্তুত আছি। আমাদের সংস্থা মৌসুমীর এবং ওর মা-বাবার যাতায়াত খরচ পর্যন্ত বহন করবে।
২। সংবাদপত্র, দূরদর্শন, বেতার এবং অন্যান্য প্রচার-মাধ্যম, শিক্ষা দপ্তর ও অন্যান্য সরকারি দপ্তর মৌসুমীর বিষয়ে পরীক্ষা চালাতে চাইলে নিশ্চয়ই সহযোগিতা করবো।
৩। মৌসুমীর মা-বাবা মৌসুমীর মেধার সত্যিকার মান বিষয়ে জনসাধারণকে অবহিত করুন।
তাঁরা কখনো বলছেন মৌসুমীর জ্ঞান অনার্স গ্রাজুয়েট মানের, কখনো বা বলছেন, এটা ভুললে চলবে না, মৌসুমী ৯১-এ মাধ্যমিক দেবে।
বহু ভাষাভাষী পত্র-পত্রিকায় আমাদের সমিতির এই বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। কিছু পত্র-পত্রিকা মৌসুমীকে আবার পরীক্ষায় হাজির করতে সম্ভাব্য সমস্ত রকম চেষ্টা করেছেন, কিন্তু মৌসুমীর বাবা-মা তাঁদের দাবির সত্যতা প্রমাণে এগিয়ে আসেননি।
সেই সময় সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘কোল্ডফিল্ড টাইমস’-এ প্রকাশিত একটি লেখায় বলেছিলাম-
সাধনবাবুকে একটা স্পষ্ট কথা বলি, আপনি নিজে চিতা-ভাবনা করে জানান মৌসুমীর মৌসুমীর জ্ঞান কোন পর্যায়ের। তারপর তা আবার ঘোষণা করুন। আপনিই এতোদিন সংবাদ মাধ্যমগুলোকে বলেছেন মৌসুমী গবেষণা করছে, জ্ঞান অনার্স লেভেলের, দারুণ আই কিউ, দারুণ টাইপ স্পিড, বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, জার্মান ও ডাচ জানে (যা ৭ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রসদনেও প্রকাশ্যে বলেছেন), আজ তা হলে বলছেন কেন এটা ভুললে চলবে না ও সাত বছরের মেয়ে ১৯৯১-তে মধ্যমিক দেবে। আপনি কি মানুষকে বোকা বানাতে সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিতে চাইছেন?
ওইটুকু একটা বাচ্চা মেয়ের পক্ষে ২২ স্পিডে টাইপ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, কিন্তু ৬০-৯০ -এ তোলার মিথ্যে চেষ্টা কেন? কোন উদ্দেশ্যে ডাচ, জার্মানের মিথ্যে গল্প ফাঁদছেন? কোন উদ্দেশ্যে ওর গায়ে অনার্স লেভেলের তকমা এঁটেছেন? হবেষ্ক ইত্যাদি উদ্ভট কথা বলেছেন? বহু সংবাদ মাধ্যমকেই এইসব কথা বলার পর এখনি কি আবার ‘বলিনি’ বলবেন ভাবছেন? আপনি যে বাস্তবিকই ওসব কথা বলেছেন, এমন প্রমাণ হাজির করলে কি করবেন ভেবেছেন কি? আবার একটি বিনীত অনুরোধ, মৌসুমীকে ‘দেবী’ বা ‘দেবশিশু’ বানিয়ে শেষ করে দেবেন না।
একটি স্বার্থান্বেষী মহল থেকে চক্রান্তও শুরু হয়ে যায় তারপরেই। প্রচার করতে থাকেন, ‘সাত বছরের বাচ্চার পিছনে লেগেছে’, ‘বাঙ্গালী হয়ে বাঙ্গালীকে বাঁশ দিচ্ছে’, ‘নাম কেনার জন্য চিপ স্টান্ট দিচ্ছে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এদের উদ্দেশ্যে জানাই- ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি মানসিকতার প্রচার চায়। যুক্তি মিথ্যেকে আশ্রয় করে থাকতে পারে না। কোন রাজনৈতিক নেতা, কোন বিখ্যাত ব্যক্তি, কোন প্রচার মাধ্যম কাকে সমর্থন করেছে দেখে সত্যানুসন্ধানে নামা বা না নামাটা আমাদের সমিতি ঠিক করে না। যারা সাত বছরের বাচ্চার প্রসঙ্গ তুলেছেন, সাত বছরের বাচ্চাটির ক্ষতি তাঁরাই করছেন। তিলে তিলে মিথ্যে প্রচারের পাঁকে ডুবিয়ে দিচ্ছেন একটা শিশুর সম্ভাবনাকে, একটা সত্যকে। ধ্বংস করতে চাইছেন একটা আন্দোলনকে, সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে। মিথ্যাচারীদের সহানুভূতি ও কৃপার উপর কোনও আন্দোলন কোন দিনই গড়ে ওঠেনি, গড়ে উঠবেও না। সমালোচকদের প্রতি আর একটা জিজ্ঞাসা- আপনারা কি চান এরপর থেকে যুক্তিবাদী সমিতি বয়স, লিঙ্গ, বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী ইত্যাদি বিচার করে মিথ্যাচারিতা ধরতে নামবে? যারা সমালোচনার গণ্ডি পার হয়ে ‘নাম কেনার মিথ্যা চিপ স্টান্ট’ বলে নোংড়া কুৎসা ছড়াচ্ছেন, তাঁদের কাছে আমাদের চ্যালেঞ্জ- সাহস থাকলে সামনাসামনি প্রমাণ করুন আপনাদের বক্তব্যের সত্যতা।
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উদযাপন ও পশ্চিমবঙ্গ নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি’র অষ্টম রাজ্য সম্মেলন উপলক্ষে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে বক্তা হিসেবে ১০ সেপ্টেম্বর ৯০ আমন্ত্রিত ছিলাম। কয়েক হাজার শিক্ষক ও সাক্ষরতা কর্মীদের সোচ্চার জিজ্ঞাসা ছিল মৌসুমীকে ঘিরে। উত্তরে সব কিছুই জানিয়েছিলাম। অনেকেই প্রশ্ন করেছিলেন, মৌসুমী কি সত্যিই মাধ্যমিকে প্রথম হবে বলে মনে করেন?
বলেছিলাম, আগের দাবী প্রমাণের ক্ষেত্রে দেখেছি মৌসুমীর মা-বাবা যে ধরনের ভূমিকা পালন করেছেন, তাতে এমনটা ঘটা অস্বাভাবিক নয়, মৌসুমীর মাধ্যমিক পরীক্ষা গ্রহণ কেন্দ্রেও কিছু ফাঁক ও ফাঁকির ব্যবস্থা থেকেই যাবে, অর্থাৎ বাইরে থেকে মৌসুমীকে সহায়তা করার সুযোগ থেকেই যাবে।
১৭ সেপ্টেম্বর ৯০-এ ‘আজকাল’ দৈনিক পত্রিকায় ‘রবিবাসর’-এ পাভলভ ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর ডাঃ ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি লেখা প্রকাশিত হল। ১৩ আগস্ট আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর বক্তব্য থেকে তিনি অদ্ভুত রকম সরে এসেছেন, লক্ষ্য করলাম। ১৭ সেপ্টেম্বর লিখছেন, “মৌসুমীর সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় হয়নি। কাগজপত্রে তার কথা পড়েছি, আর শুনেছি আমার সহকর্মী ডঃ বাসুদেব মুখোপাধ্যায়ের কাছে। ডঃ মুখোপাধ্যায় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি মৌসুমীর কাছে গিয়েছিলেন। তাঁর কাছে শুনে তিনি আর সকলের মত কোন প্রশ্ন না করে মৌসুমীকে শুধু অবজার্ভ করে গেছেন। তাঁর কাছে যা শুনেছি এবং কাগজপত্র যা পড়েছি তাতে তো অবাক হওয়ার কিছু নেই। সকলেই বলেছেন, মৌসুমীর তাৎক্ষনিক স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর। …সুতরাং মৌসুমীকে নিয়ে হৈ-চৈ করার কোন কারণ নেই। মনে রাখতে হবে স্মৃতির সঙ্গে বুদ্ধির কোন সম্পর্ক নেই। তার স্মৃতির মত বুদ্ধি ততটা নেই শুনেছি।”
কিন্তু বাসুদেববাবুর কাছ থেকে শুনে ও কাগজপত্র পড়ে আনন্দবাজার প্রতিনিধিকে যে জানিয়েছিলেন, মৌসুমীর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পিছনে সুপ্ত জিনের আত্মপ্রকাশের সম্ভাবনার কথা। মৌসুমীর বুদ্ধির যে স্তর তাতে বিদেশে বিশেষত আমেরিকায় ওর শিক্ষার ব্যবস্থা করার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। এরপর এমন কি ঘটলো, যাতে মাত্র ১ মাস ৪ দিনের মধ্যেই তাঁর মত খ্যাতিমান মানসিক ব্যাধির চিকিৎসককে এমন অস্বাভাবিক রকমের মত পাল্টে বিপরীত কথা বলতে বাধ্য হলেন? তবে কি ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ৭ সেপ্টেম্বর “Pridigy fails test by rationalist” শিরোনামের প্রকাশিত খবরটিই তাঁকে এই বিপরীত বক্তব্য প্রকাশে বাধ্য করেছে? ওই সংবাদের শেষ পঙক্তিতে ছিল “Mr. Ghosh believes that Mousami has an extra-ordinary memory and may have been tutored to answer questions by rote.” অর্থাৎ ‘শ্রী ঘোষ মনে করেন, মৌসুমীর স্মৃতি অসাধারণ এবং ওকে কিছু প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করান হয়েছে।” আর তাইতেই কি মৌসুমীর স্মৃতিকে ‘খুব প্রখর’ বলে মেনে নিয়েছেন? জানিনা, প্রমা সাংস্কৃতিক সংস্থার কর্ণধার সুবীর চট্টোপাধ্যায় ও শঙ্কর মালাকারের সঙ্গে ওই ৩ সেপ্টেম্বরই আমার মৌসুমীর স্মৃতি বিষয়ে যে সব কথাবার্তা হয়েছিল তা যদি কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে ডাক্তার গাংগুলীর নজরে পড়ত, তারপরও ডঃ গাংগুলী মৌসুমীর স্মৃতি বিষয়ে নিজের বর্তমান মতে স্থির থাকতেন কি না? সুবীরবাবু ও শঙ্করবাবুকে বলেছিলাম, “মৌসুমীর যে স্মৃতি দেখে আপনারা বিস্মিত তেমন স্মৃতি শক্তি তৈরি করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আপনারা তো অনুষ্ঠান স্পন্সর করেন। স্মৃতি শক্তির এক মজার পরীক্ষার সঙ্গে উৎসাহী দর্শকদের পরীক্ষা করতেই না হয় স্পন্সর করলেন। ফেব্রুয়ারী নাগাদ রবীন্দ্রসদন ‘বুক’ করুন। হিন্দু, বেথুন, রামকৃষ্ণ মিশন, সেন্ট জেভিয়াস, সাউথ পয়েন্টের মত ভাল স্কুলের ক্লাস এইট-নাইনের ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে ছটি আগ্রহ ভাল ছাত্র-ছাত্রী বেছে আমার হাতে তুলে দিন সাত দিনের মধ্যে। অনুষ্ঠানের দিন দর্শকদের সামনে হাজির করুন মৌসুমীকে ও আমার হাতে তুলে দেওয়া ছাত্র- ছাত্রীদের। হলের যে কোনও একটা অংশকে বেছে নিয়ে পঞ্চাশটির মত দর্শকাসন রঙ্গিন রিবন দিয়ে ঘিরে দিন। রিবন ঘেরা দর্শক এর এক এক করে নিজেরদের নাম বলতে বলুন। নামগুলো টেপ-রেকর্ডারে ধরে রাখুন। তারপর মৌসুমী ও ওই ছ’টা ছেলে-মেয়েকে দর্শকদের নাম বলতে বলুন। দেখুন, মৌসুমী কতজনের ঠিক নাম বলতে পারে। আশা রাখি আমার ছ’জনই প্রতিটি দর্শকের নাম বলতে পারবে।
সুবীরবাবু ও শঙ্করবাবু যথেষ্ট উৎসাহ দেখিয়ে বলেছিলেন, “মৌসুমীরা দু-চার দিনের মধেই তো কলকাতায় আসছে, সেই সময় এ বিষয়ে সাধনবাবুর সঙ্গে কথা বলে নেব। ওঁরা রাজি হলে নিশ্চয়ই স্পন্সর করবো।” জানুয়ারী ৯১ অতিক্রান্ত। সুবীরবাবুর মৌসুমীকে হাজির করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। প্রসঙ্গত জানাই, চলতি কথায় যাকে ‘স্মৃতিশক্তি বাড়ানো’ বলে, সেই ‘স্মৃতি বৃদ্ধি’ বিষয়ে জানতে ও স্মৃতি বাড়াতে উৎসাহী পাঠক-পাঠিকাদের উৎসাহ মেটাতে ;স্মৃতি প্রসঙ্গ’ নিয়ে ভবিষ্যতে একটি বই লেখার ইচ্ছে আছে।
মৌসুমী প্রসঙ্গে দুটি ঘটনার উল্লেখ করছি। প্রথম ঘটনাঃ ১৭ সেপ্টেম্বর ৮৯ আজকাল পত্রিকার সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় অমিতাভ চৌধুরী লিখলেন, “মৌসুমীকে নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে বছর দুয়েক। মৌসুমী যে একটি অসাধারণ প্রতিভা সে বিষয়ে কোন কাজেরই দ্বিমত নেই। কিন্তু যে মেয়ে বলে আগামী আড়াই বছরের মধ্যে, অর্থাৎ সাড়ে ন’বছর বয়সে সে নোবেল প্রাইজ পাবে, তখন সন্দেহ হয় তার এই প্রতিভা ঠিক পথে পরিচালিত হচ্ছে তো? তাছাড়া সেদিন রবীন্দসদনে সে প্রতিভার পরিচয় দিলেও অন্নদাশঙ্কর যেসব ইংরেজি প্রশ্ন করেছিলেন, তার বাংলা অনুবাদ করে দিতে হয় পাশে বসা কৃষ্ণ ধরকে।” ……”মৌসুমীর বিস্ময়কর প্রতিভা স্বীকার করে নিয়েও বলতে ইচ্ছে করছে, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? প্রথমত একটা রঙ্গমঞ্চে তাকে হাজির করে একমাত্র তার বাবাই অনবরত প্রশ্ন করে যাবেন এবং সে সবকটির নির্ভুল উত্তর দেবে- এর মধ্যে কোথাও কোন গণ্ডগোল আছে বলে মনে হয়।” ……”মৌসুমীর প্রতিভা যাচাইয়ের ভার তার বাবার ওপর না ছেড়ে অন্য কোন বিশেষজ্ঞ কমিটির হাতে দেওয়া উচিৎ।”
দ্বিতীয় ঘটনাঃ আদ্রা থেকে ফেরার পর মৌসুমীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আগে সম্পাদক অশোক দাশগুপ্তের সঙ্গে মৌসুমীর প্রসঙ্গ নিয়ে ফোনে কথা হয়। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, মৌসুমী অন্য পত্রিকা প্রতিনিধিদের সামনে অত দ্রুততর সঙ্গে টাইপ করছে কি করে?
বলেছিলাম, “সাংবাদিকদের সামনে মৌসুমী টাইপ করেছিল নিশ্চয়ই ওর মা-বাবার এগিয়ে দেওয়া কোনও বইয়ের অংশ, যে সব অংশ ও দীর্ঘকাল ধরে টাইপ করে করে অতি-অভ্যস্ত। মৌসুমীর অসাধারণ সব উত্তরদান-প্রসঙ্গে জানিয়েছিলাম, “সাধারণত মৌসুমীকে প্রশ্ন করার দায়িত্ব পালন করে সাধনবাবু স্বয়ং। এমনিভাবে উনি প্রশ্ন করা শুরু করেন যেন সাংবাদিকদের সাহায্য ও সহযোগিতা করতেই ওঁর প্রশ্নকর্তার ভূমিকা নেওয়া। সাধনবাবুর বাক্য-বিন্যাসে মোহিত হয়ে এরপর কেউ যদি সাধনবাবুর ধরনের প্রশ্ন করতে থাকেন, তবে দেখা যাবে মৌসুমী সঠিক উত্তর দিয়ে চমকে দিচ্ছে। সাধনবাবুর দ্বারা চালিত না হয়ে প্রশ্ন করলে অর্থাৎ প্রকৃত পরীক্ষা করলে মৌসুমীর তেমন বিস্ময়কর প্রতিভার কিন্তু হদিশ মিলবে না।”
১৭ সেপ্টেম্বর ৮৯ ‘আজকাল’, ‘রবিবাসর’-এর একটা পুরো পৃষ্ঠা ছিল মৌসুমীকে নিয়ে লেখায় ও ছবিতে সাজান। তাতে ছিল মৌসুমীর এক দীর্ঘ ইন্টারভিউ। ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছিল সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের পরে। নিয়েছিলেন অরুন্ধতী মুখার্জী। শ্রীমতি মুখার্জীর লেখা দুজনের কথোপকথনের কিছু অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি। “মৌসুমীকে প্রশ্ন করার ভার নিলেন ওর বাবা- সাধন চক্রবর্তী। জিজ্ঞেস করলেন, আগামী পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কি কি উদ্দেশ্যে। মৌসুমী প্রথমত, দ্বিতীয়ত করে পাঁচটি পয়েন্টে টনা মুখস্ত বলে গেল। উদ্ভূত দ্রুত উচ্চারণে- একবারও না থেমে। আর আমি সুযোগ পেলাম না। ওর সাত বছরের মেয়ের পক্ষে নিতান্ত অনুপযুক্ত প্রশ্ন করে চললেন ইংরেজিতে। ইংরেজি উত্তরও। সবই সঠিক। গড়গড় করে উত্তর- কোন অ্যাকসেন্টের বালাই না রেখেই। বিজ্ঞান, অংক, ইতিহাস সবের ওপর প্রশ্নবান ছুঁড়লেন তিনি। একটি বানও বিদ্ধ করতে পারেনি তার মেয়েকে।” ……”প্রায় আধঘণ্টা চলল বাবা-মেয়ের ক্যুইজ টাইম। জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি যা বলছ বাংলায় বলতে পারবে?”
পাশ থেকে ওর বাবা- হ্যাঁ পারবে।
ইংরেজিতে আবার প্রশ্ন, রাজীব গান্ধী কবে প্রধানমন্ত্রী হন?
-থার্টি ফার্স্ট অক্টোবর নাইন্টিন এইট্টি ফোর।
প্রশ্নটা বাংলায় বলে বাংলায় উত্তর চাইলাম। এবারও স্মার্ট মেয়ে মৌসুমী দ্রুততার সঙ্গে বলল, থার্টি ফার্স্ট অক্টোবর নাইন্টিন এইট্টি ফোর।
(এখানেও সাধারণ বোধ-বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত না হয়ে স্রেফ মুখস্ত উগড়ে গেছে।)
আবার ওর বাবা প্রশ্ন করলেন, কলকাতার জন্ম কবে হয়েছিল? এটা কলকাতার কত বছর? কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন? প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কবে হয়েছিল?
এবার বাধা দিলাম আমরা- পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা জিনিসটা কি?
-উত্তর দেয়নি মৌসুমী।”
…”স্টেফি গ্রাফের নাম শুনেছ?
-১৯৮৮-র গোল্ডেন গার্ল।
-সে কি করে?
-(একটু চুপ থেকে) রান …রান করে…
পাশ থেকে উৎসাহে ওর বাবা বললেন, বল, বল, কর মিটার।”
মৌসুমী এই বয়সে মৌসুমী যা পারে, অনেকেই তা পারে না। মৌসুমীর স্বাভাবিক বুদ্ধি বিকাশের স্বার্থেই তার মা বাবার উচিৎ ওই ধরনের মুখস্ত করাবার প্রবণতা থেকে বিরত থাকা। মৌসুমী জীবন্ত সরস্বতী বা সরস্বতীর অংশ, প্রমাণ করতে গিয়ে তাঁরা তাৎক্ষণিক লাভের আশায় শুধুমাত্র মানুষকে প্রতারিতই করছেন না, একটি শিশুকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছেন।
“অলৌকিক নয়,লৌকিক- ২য় খন্ড ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
♦ কিছু কথাঃ যুক্তিবাদ প্রসঙ্গে
একঃ ভূতের ভর
♦ ভূতের ভরঃ বিভিন্ন ধরন ও ব্যাখ্যা
♦ গুরুর আত্মার খপ্পরে জনৈকা শিক্ষিকা
♦ প্রেমিকের আত্মা ও এক অধ্যাপিকা
ভূতে পাওয়া যখন ম্যানিয়াস ডিপ্রেসিভ
♦ সবার সামনে ভূত শাড়ি করে ফালা
♦ গ্রামে ফিরলেই ফিরে আসে ভূতটা
♦ একটি আত্মার অভিশাপ ও ক্যারেটে মাস্টার
দুইঃ পত্র পত্রিকার খবরে ভূত
♦ ট্যাক্সিতে ভূতের একটি সত্যি কাহিনী ও এক সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক
♦ এক সত্যি ভূতের কাহিনী ও এক বিজ্ঞানী
♦ বেলঘরিয়ার গ্রীন পার্কে ভূতুরে বাড়িতে ঘড়ি ভেসে বেড়ায় শূন্যে
♦ দমদমের কাচ-ভাঙ্গা হল্লাবাজ-ভূত
তিনঃ যে ভূতুরে চ্যালেঞ্জের মুখে বিপদে পড়েছিলাম
চারঃ ভূতুরে চিকিৎসা
♦ ফিলিপিনো ফেইথ হিলার ও ভূতুরে অস্ত্রোপচার
♦ ফেইথ হিলার ও জাদুকর পি.সি. সরকার (জুনিয়র)
♦ পরকাল থেকে আসা বিদেহী ডাক্তার
♦ বিদেহী ডাক্তার দ্বারা আরোগ্য লাভ
♦ ডাইনী সম্রাজ্ঞী ঈপ্সিতার ভূতুরে চিকিৎসা
পাঁচঃ ভূতুরে তান্ত্রিক
♦ গৌতম ভারতী ও তাঁর ভূতুরে ফটোসম্মোহন
♦ ভূতুরে সম্মোহনে মনের মত বিয়েঃ কাজী সিদ্দীকির চ্যালেঞ্জ
ছয়ঃ ডাইনি ও আদিবাসী সমাজ
বাঁকুড়া জেলা হ্যান্ডবুক, ১৯৫১ থেকে
♦ ডাইনি, জানগুরু প্রথার বিরুদ্ধে কি করা উচিৎ
♦ ডাইনি হত্যা বন্ধে যে সব পরিকল্পনা এখুনি সরকারের গ্রহণ করা উচিৎ
♦ জানগুরুদের অলৌকিক ক্ষমতার রহস্য সন্ধানে
সাতঃ আদিবাসী সমাজের তুক-তাক, ঝাড়- ফুঁক
♦ ‘বিষ-পাথর’ ও ‘হাত চালান’এ বিষ নামান
আটঃ ঈশ্বরের ভর
♦ ঈশ্বরের ভর কখনো মানসিক রোগ, কখনো অভিনয়
♦ কল্যাণী ঘোষপাড়ায় সতীমা’ইয়ের মেলায় ভর
♦ হাড়োয়ার উমা সতীমার মন্দিরে গণ-ভর
♦ আর একটি হিস্টিরিয়া ভরের দৃষ্টান্ত
♦ একই অঙ্গে সোম-শুক্কুর ‘বাবা’ ও মা’য়ের ভর
♦ অবাক মেয়ে মৌসুমী’র মধ্যে সরস্বতীর অধিষ্ঠান (?) ও প্রডিজি প্রসঙ্গঃ
♦ প্রডিজি কি? ও কিছু বিস্ময়কর শিশু প্রতিভা
♦ বংশগতি বা জিন প্রসঙ্গে কিছু কথা
♦ বিস্ময়কর স্মৃতি নিয়ে দু-চার কথা
♦ দুর্বল স্মৃতি বলে কিছু নেই, ঘাটতি শুধু স্মরণে
♦ মানবগুণ বিকাশে বংশগতি ও পরিবেশের প্রভাব
♦ মানবগুণ বিকাশে পরিবেশের প্রভাব
♦ মানব-জীবনে প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব
♦ মানব-জীবনে আর্থ-সামাজিক পরিবেশের প্রভাব
♦ মানব জীবনে সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রভাব
♦ অবাক মেয়ে মৌসুমীর রহস্য সন্ধানে
♦ বক্সিংয়ের কিংবদন্তী মহম্মদ আলি শূন্যে ভাসেন আল্লা-বিশ্বাসে!