শব্দটা ‘অপসংস্কৃতি’ অথবা ‘অসংস্কৃতি’ এই বিতর্ক আপাতত স্থগিত রাখছি ‘অপসংস্কৃতি’ কথাটি যে ব্যাকরণের দিক থেকে শুদ্ধ এই বিষয়ে মত প্ৰকাশ করেছিলেন ভাষাতত্ত্ববিদ সুকুমার সেন।

অপসংস্কৃতি কী? যে সংস্কৃতি একটি সংস্কৃতি গোষ্ঠীকে সামগ্রিকভাবে এবং গোষ্ঠীর প্রত্যেক সদস্যের জীবন ও চেতনার, মননের পুষ্টিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে, সুস্থ বিকাশের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, অসুস্থ বিকাশের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, তাইই অপসংস্কৃতি ।

আমরা তাকেই বলব সুস্থ-সংস্কৃতি যা একটি সংস্কৃতি গোষ্ঠীর জীবনকে সুস্থ বিকাশের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই সুস্থ বিকাশের প্রকাশ দেখা যায় সংস্কৃতি গোষ্ঠীর মধ্যে সমগ্রভাবে এবং গোষ্ঠীর প্রত্যেক সদস্যের মধ্যে।

বর্তমান ভারতবর্ষের প্রতিটি মানুষের জীবনযাত্রাকে, মননকে

দূষিত করে তুলেছে দুর্নীতি। এই দুর্নীতিও ভারতবর্ষের

বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর জীবনধারারই অঙ্গ,

অর্থাৎ সংস্কৃতিরই অঙ্গ। সমাজের সুস্থ

বিকাশের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী

এই সংস্কৃতিকে আমরা অবশ্যই

অপসংস্কৃতি বলে

চিহ্নিত করব।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের একশো ষাটটি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে দুর্নীতিতে আজ ভারতবর্ষ প্রথম তিনের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। দুর্নীতির বিশাল নেট ওয়ার্কে জড়িয়ে থাকার অভিযোগে অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্ৰী, রাজ্য-মন্ত্রী, বিচারপতি, পুলিশ, প্রশাসন, সেনা, আয়কর, বিক্রয়কর, কাস্টমস, রেল, ব্যাঙ্ক, বেতার, দূরদর্শন, স্টেট ট্রান্সপোর্ট, রেশনের দোকান, স্কুল, কলেজ, কে নয়? ভারতীয় রাজনীতিতে যে দুর্নীতি ও লুঠ চলেছে শেয়ার কেলেংকারি, বফর্স, ইঞ্জিন সংক্রান্ত কেলেংকারি সেই দুর্নীতির হিমশৈলের ভাসমান চূড়াটুকু মাত্র। এদেশে এখনও চাকরি কিনতে হয় নগদ টাকা দামে । চাকুরি ক্রেতাকে হয় হতে হবে রাজনীতিকের ক্রীতদাস, নতুবা তুলে দিতে হবে নগদ টাকা । আমাদের পশ্চিমবঙ্গে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক পদের নিলামে দর চড়ে চল্লিশ হাজার। হাইস্কুলের ষাট হাজার। আমাদের দেশে অক্ষমরাও ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে সক্ষম বিবেচিত হয় সাত থেকে এগারো লাখ টাকা ডোনেশন নামক ঘুষ দেওয়ার রেস্ত থাকলে। দূরদর্শনে স্ক্রিপ্ট পাশ হয় লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে। বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের শেষকৃত্যের সময় শ্মশানে স্বপন নামক জনৈক রাজনৈতিক সমাজবিরোধীর হাতে চূড়ান্ত লাঞ্ছিত হন মন্ত্রী থেকে যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার, বুদ্ধিজীবী থেকে প্রাক্তন সাংসদ। স্বপনের অশালীন তাণ্ডবে আর যাই হোক, একটা বিষয়ে অনেকের চোখ খুলে গেছে। তাঁরা আজ আমাদের সমাজের চেপে রাখা কুৎসিত ঘাটা দেখতে পাচ্ছেন। পত্র-পত্রিকার কল্যাণে জানা যাচ্ছে, স্বপনের সঙ্গে ইয়ার-দোস্তের সম্পর্ক ছিল অনেক অতি পদস্থ পুলিশ অফিসারদের। অনেক আদর্শবাদী, গরিবদরদী, সমাজ সংস্কারক, বিপ্লবী রাজনীতিকের মুখোশধারী সমাজের নেতারা স্বপনের মেয়ের জন্মদিনে নিমন্ত্রণ পেলে বর্তে যেতেন। স্বপন এক বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তির শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে বহু বিখ্যাত ও প্রচার-মাধ্যমগুলোর সামনে এমন অশালীন তাণ্ডব ও হামলা চালানোয় স্বপনের শাস্তি হতে পারে, কিন্তু সে তো সমালোচনার মুখ চাপা দিতে। স্বপনের মতো হাজারো, লাখো সমাজবিরোধীরা তো একদিনে গজিয়ে ওঠেনি। রাজনীতির প্রয়োজনেই এদের সৃষ্টি। সৃষ্টির চেয়ে স্রষ্টা চিরকালই মহৎ। তাই স্বপনের স্রষ্টা আমাদের সমাজের ক্রিম, আমাদের নেতারা সমস্ত রকম আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে। এক স্বপন ধরা পড়ল কি ধ্বংস হল, তাতে স্রষ্টাদের কিছুই আসে যায় না। সৃষ্টি করে আরও এক স্বপন। স্বপনের জায়গা কোনও দিনই ফাঁকা থাকে না। এক যায়, আর এক উঠে আসে। নির্বাচনে হারা-জেতার অনেক অঙ্কই তো স্বপনদের হাতে ।

স্বপনের ঘটনাই কেন হাজির করলাম? কেন সাংসদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাথায় লাঠি মারা রাজনৈতিক মস্তান লালুর ঘটনা টানলাম না? এমনতর প্রশ্ন কারও মাথায় উঁকি-ঝুঁকি মারলে জানাই—না, কোনও রাজনৈতিক দলকে ছোট বা বড় করার উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, স্বপনের ঘটনাটা হাজির করলাম একটি দৃষ্টান্ত টানতে, দেখাতে মস্তান ও মুখোশ আঁটা নেতাদের কুৎসিত চেহারাটা। আর এইসব নিয়েই তো আমাদের সংস্কৃতি যা অবশ্যই অপসংস্কৃতি ।

আমাদের এই দেশে স্কুলে ভর্তির ব্যাপারটা নিয়েও হস্তক্ষেপ করছে রাজনৈতিক দলগুলো। ‘অ্যাডমিশন টেস্টে পাশ করেছে, অতএব ভর্তি হবে’– ওসব মামদোবাজির দিন আর রাখেনি তা-বড় রাজনৈতিক দলগুলো। পুরসভার চেয়ারম্যান, কমিশনার, পঞ্চায়েত প্রধান, এম এল এ, এম পি, মন্ত্ৰী, সকলেই ছাত্র-ছাত্রীদের পাইকারি রেটে ভর্তির সুপারিশ করে পাঠাচ্ছেন। ফলে অবস্থাটা কেমন দাঁড়াচ্ছে, দেখাতে দৃষ্টান্ত হাজির করছি মাত্র একটি।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার সোনারপুর বিদ্যাপীঠে ১৯৯২-এর ২২ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষার্থী ছিল ৩৭৩ জন। পরীক্ষায় সফল ১৮৫ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। রাজপুর পুরসভার তরফ থেকে ৪৪ জনের নাম সুপারিশ করে পাঠানো হয়। সোনারপুর এক নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত থেকেও সুপারিশ করে পাঠানো হয় ২০০ জনের নাম। এর অর্থ ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একজনেরও স্থান হবে না ওই বিদ্যালয়ে। এমন চিত্রটাই বে-সরকারি স্কুলের ক্ষেত্রে ব্যাপকতর । এই তো আমাদের সংস্কৃতি ৷

শহর কলকাতার উপকণ্ঠে বিরাটিতে ভয়াবহ গণধর্ষণের পর ধর্ষিতা নারীদের পক্ষে সোচ্চার না হয়ে ধর্ষকদের পক্ষে ওকালতি করে যিনি বলেছিলেন, “ওইসব ধর্ষিতারা নষ্ট চরিত্রের” তিনি একজন নারী, প্রগতির ধ্বজাধারী বিপ্লবী রাজনৈতিক নেত্রী। তবে কি আমরা ওই নেত্রীর কথা মান্য করে ধরে নেব, যাদের সমাজ ‘নষ্টা’ বলে চিহ্নিত করেছে, তাদের যখন যেমন ইচ্ছে ব্যবহার করার, ধর্ষণ করার অধিকার পুরুষদের আছে? শোনা যায়, ধর্ষক বলে চিহ্নিতরা ওই নেত্রীর রাজনৈতিক দলের লোক, “সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ”? এই তো আমাদের সংস্কৃতি।

’৯২-এর গোড়ায় দমদমে জনৈক বড় বিপ্লবী দলের বড় মাপের নেতার বিপ্লবী ছেলেকে সাট্টার আসর থেকে বহু অর্থ সমেত গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই বিপ্লবীর বিরুদ্ধে রয়েছে ধর্ষণের অভিযোগ। এক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফুটবল খেলোয়াড়ের বাড়ির কাজে সাহায্যকারী একটি মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছিলেন বলেই খ্যাতির জোরে ওই খেলোয়াড় বহু কাঠ খড় পোড়ানোর পর অভিযোগ দায়ের করতে পেরেছিলেন। কিন্তু ওই গ্রেফতারের পরই নাকি এক মন্ত্রী ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশের কাছে ‘জবাবদিহি’ চেয়েছেন— তার স্নেহভাজনকে এমনভাবে হেনস্তা করার জন্য। এ-সবই তো আমাদের সংস্কৃতি, অস্বীকার করতে পারি কি?

মালদহের মানিকচকে গণধর্ষণের ঘটনার পর আমরা কী দেখলাম? অন্যতম অভিযুক্তকে নিয়ে স্থানীয় এলাকায় সভা করে এলেন জনৈক মার্কসবাদী মন্ত্রী। এতে অপরাধীর হাত আরও লম্বা হবে, এই তো স্বাভাবিক। আমরা পুলিশের দক্ষতা দেখেছি চন্দন বসুর হারানো ব্রিফকেস চোখের পলকে খুঁজে বের করতে, কিন্তু এরাই আবার হাতের নাগালে খুনে-গুন্ডা, ধর্ষণকারীদের ঘুরতে দেখেও পরম আলিস্যে হাই তুলে হিসেব কষে মনে মনে, কোন্ অপরাধীর কাছ থেকে কতটা হিস্যা বাগান যায়। সাধারণ মানুষ আজ আর পুলিশকে বিশ্বাস করেন না। অনেক ভুক্ত ভোগীদের চোখেই পুলিশরা আজ ‘অর্গাইজড ক্রিমিন্যাল’। এ-সব নিয়েই তো আমাদের সংস্কৃতি

‘৯২-এর ২৫ মার্চ লন্ডনে সারা বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদপত্র, সংবাদমাধ্যম ও দূরদর্শনের সাংবাদিকরা ভারতের সর্বত্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ শুনলেন। অভিযোগুলো হাজির করেছিলেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এই অভিযোগগুলোতে ভারতীয় সমাজ, সরকার ও বিচার ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা করা হয়েছিল। “ভারত : অত্যাচার, ধর্ষণ ও জেল হাজতে মৃত্যু” শিরোনামের এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ধৃতদের বিচার বিভাগের সামনে হাজির না করে সম্পূর্ণ বে-আইনিভাবে নানা ধরনের অমানবিক, পাশবিক ও নিষ্ঠুর অত্যাচার চালানো এখন ভারতবর্ষের পুলিশদের দৈনন্দিন রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের প্রতি বছর হাজারে হাজারে বিচারাধীন মানুষ হাজতে মার খেয়ে মারা যায়। শয়ে শয়ে অসহায় মহিলা জেলের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়। রিপোর্টে এও মন্তব্য করা হয়েছে, ভারতের হাজতগুলোতে বিচারাধীন বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ওপর পুলিশের প্রচণ্ড অত্যাচার ও তার দরুন মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই চলবে। কারণ, পুলিশরা জানে, প্রতিটি হত্যার অপরাধ থেকে তারা দিব্যি পার পেয়ে যাবে। ভারতের বহু ক্ষেত্রে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্তদের তুলে আনা হয়। বে-আইনিভাবে আটক রেখে বর্বরোচিত অত্যাচার চালিয়ে যায়। তাতে হয় মানুষটি এক সময় ভেঙে

পড়ে, নতুবা এক সময় মারা পড়ে। এইসব অত্যাচারী পুলিশরা বস্তুত রাজনৈতিক দলগুলিরই আজ্ঞাবহ। নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে নেতারা পুলিশদের আজ্ঞাবহ, নীতিহীন একদল ‘অর্গানাইজড ক্রিমিনাল’ করে তুলেছে। এই পুলিশরা রাজ্যে রাজ্যে শাসকদলগুলোর স্বার্থে নেতাদের রাজনৈতিক স্বার্থে নিরাপরাধীদের ওপর অত্যাচার চালায়। পুলিশরা যখন প্রতিটি বে-আইনি কাজ-কর্মের সঙ্গে যুক্ত অপরাধীদের সঙ্গে ওঠা-বসা করে, অপরাধ সংগঠিত করতে দেওয়ার বিনিময়ে ঘুষ খায় বা ভাগ নেয়, তখন রাজনৈতিক নেতারা নিজের ও দলের স্বার্থে বাধ্য হয় পুলিশদের এইসব বে-আইনি কাজকর্ম চালিয়ে যেতে সাহায্য করতে।

অ্যামনেস্টির রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, পুলিশরা হাজতে বিচারাধীন মহিলাদের ওপর যে পাশবিক অত্যাচার চালায় তাতে শুধু নিচের তলার পুলিশরা জড়িত মনে করলে ভুল করা হবে। বহু ক্ষেত্রেই উঁচুতলার সম্মতি বা আজ্ঞা থাকে এ-সব ব্যাপারে। বিশেষ ঘটনা এই যে অত্যাচারিতাদের মধ্যে গর্ভবতী মহিলা থেকে ছ’বছরের শিশুও আছে। এ-সবই তো আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গেই মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। এ-অন্যায় ‘চলছে, চলবে’ করে ধারাবাহিক হয়ে ঘটেই চলেছে আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনে ।

এই অংশটা লেখার সময় দূরদর্শনের খবরে জানতে পারলাম আই.এ.এস -এর প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গেছে। এ তো নতুন কিছু নয়। দুর্নীতির হাত ধরে যাঁরা প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুযোগে আই.এ.এস. বনে যান, যাঁরা দুর্নীতির হাত ধরেই জীবিকা শুরু করেন, তাঁরা ভবিষ্যতে ভয়ংকর রকমের দুর্নীতিগ্রস্ত হবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। এমনটা বলার অর্থ—এই নয় যে, শুধুমাত্র টুকে পাশ করা বন্ধ করলেই আমলাদের দুর্নীতি বন্ধ হবে, আমলাদের দুর্নীতি বন্ধ হবে, আমলাদের চরিত্র পাল্টে যাবে। কারণ, আরও দুর্নীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে আমলাদের চরিত্র। এরই পাশাপাশি এও সত্যি—এই টুকে পাশ করার সংস্কৃতিও টুকলিবাজদের প্রভাবিত করছে।

তিন বছর আগের ঘটনা। ব্রহ্মপুত্র ও তার শাখানদীগুলো বর্ষার শুরুতেই ফুলে ফেঁপে ভাসিয়ে দিল অসমের উপত্যকা অঞ্চল। ভেসে গেল হাজারটা মানুষের প্রাণ, লক্ষ লক্ষ গৃহপালিত পশু, বিস্তীর্ণ শয্যক্ষেত, লক্ষ লক্ষ বাড়ি বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে খোলা আকাশের নীচে গৃহহীন, খাদ্যহীন, পানীয়হীন, বস্ত্রহীন অসহায় মানুষগুলো শুধু ভাগ্যকে দুষতে দুষতে দিন কাটাতে লাগল । এরই মাঝে হানা দিল দূষিত জলবাহিত আন্ত্রিক রোগ। প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী নিয়মমাফিক হেলিকপ্টারে ফর ফর করে চক্কর দিলেন দলা দলা পিঁপড়ের মতো জমাট হয়ে থাকা মানুষগুলোর মাথার ওপর। মানুষগুলো চিৎকার করল, হাত নাড়ল। প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি ফিরে যেতে উড়ে এলেন কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দল। অনুসন্ধান চালিয়ে রিপোর্ট দিলেন। রিপোর্টের ভিত্তিতে কেন্দ্র বন্যাত্রাণে বরাদ্দ করল কুড়ি কোটি টাকা। বরাদ্দ নিয়ে অসমের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বাক্-বিতণ্ডা হল বিস্তর। কিন্তু বরাদ্দ বাড়ল না। ‘হাতি কা দাঁত আউর মরদ কা বাত’-এর কি নড়চড় হতে আছে?

এরপরই বন্যায় পাঞ্জাবের কিছু কিছু গ্রাম গেল ভেসে। মানুষ না মরলেও শস্যের ক্ষয়-ক্ষতি হল। খবর পেতেই প্রধানমন্ত্রী ছুটলেন বন্যাপীড়িতদের দেখতে। বন্যাদুর্গতদের দেখে শোকার্ত প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকদের আসা এবং পর্যবেক্ষণের পর রিপোর্ট দেওয়ার জন্য অপেক্ষা না করে সমস্ত নিয়ম-কানুনকে বন্যার জলের মতোই ভাসিয়ে দিয়ে ঘোষণা করলেন, পাঞ্জাবের জন্য একশো কোটি টাকা বরাদ্দ করা হল।

এই নিয়ে আবার নতুন করে বিতণ্ডা। প্রধানমন্ত্রী মেনে নিলেন অসমের বন্যায় ক্ষয়-ক্ষতির সঙ্গে পাঞ্জাবের বন্যার ক্ষয়ক্ষতির কোনও তুলনাই চলে না। সেই সঙ্গে অকাট্য যুক্তিও হাজির করলেন তাঁর কাজের সমর্থনে: অসমের লোকেরা গরিব, তাই ওদের কম দিলেও চলে, পাঞ্জাবের মানুষরা অনেক বেশি অবস্থাপন্ন, তাই ওদের বেশি পরিমাণে অর্থ সাহায্য না দিলে অন্যায় হত।

সমাজতন্ত্রের নবীন সূর্য যে নীতিতে বলেছেন, বড় লোকদের অভাববোধ বেশি তাই ওদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বেশি বেশি করে সুযোগ-সুবিধে দেওয়াটাই রাষ্ট্রের কর্তব্য। গরিবদের অভাববোধ কম, ওদের ছিটেফোঁটা দিলেও চলে। মেরুদণ্ডহীনদের দেশে এটাই জীবনদর্শন, এটাই সংস্কৃতি। প্রাদেশিকতার জন্ম এ-ভাবেই হয়। প্রাদেশিকতা হঠাৎ করে ধূমকেতুর মতো হাজির হয় না। আর এও তো শুধু একটি মাত্র দৃষ্টান্ত। এমন দৃষ্টান্ত সব সময়ই ছড়িয়ে থাকে সর্বত্র। মগজ ধোলাইয়ে অন্ধ না হলে, নজরে পড়বেই । আমাদের দেশে যিনিই কেন্দ্রের মন্ত্রী হন, তিনিই তাঁর দপ্তরের সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধার বান ডাকান নিজের রাজ্যে—এ তো অবধারিত সত্য। আর এমন জাতীয় কর্মকেই আমরা স্বাভাবিক বলে ধরেই নিয়েছি, এই যেন নিয়তি, এ-দেশের ক্রীড়ামন্ত্রী ক্রীড়ার উন্নতির চেয়ে কৃপাধন্য সৃষ্টিতে ব্যাপৃত থাকেন বেশি। ফলে খেলাধুলার জগতেও ভারত যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় আমাদের প্রতিযোগীরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেশবাসীকে নিরাশ করেছেন। নৈরাশ্যের গ্লানি আমাদের প্রত্যেককেই স্পর্শ করেছে। কিন্তু এটা কোনও প্রতিযোগীর ব্যক্তিগত দোষত্রুটির বিষয় নয় ৷ এই সামগ্রিক ব্যর্থতা আমাদের পচন ধরা, দুর্নীতিতে ভরা সামাজিক ব্যবস্থারই প্রতিফলন। এই নিয়েই তো আমাদের সংস্কৃতি।

ব্যক্তিগত জীবনে পাড়ার রাজনৈতিক মস্তানকে দেখলে আমরা বিগলিত হয়ে হাত কচ্‌লে জিজ্ঞেস করি, “ভালো তো?” দুর্নীতিগ্রস্ত কোনও মন্ত্রীর সংগে পরিচয় থাকলে আমরা সেই খবরটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বহুজনকে বলে গর্ব অনুভব করি। পচনধরা ধনীর সঙ্গে গা ছোঁয়া-ছুঁয়ি করতে পারলেও ধন্য হয়ে যাই। প্রতিবাদের পরিবর্তে আপসকামিতাকেই জীবনদর্শন হিসেব গ্রহণ করেছি। প্রতিরোধের প্রাচীর গড়তে যেন ভুলে গেছি। আমাদের মধ্যে যাঁরা শ্রেণিচেতনার জন্য লাফালাফি করেন, গলা ফুলিয়ে গলগল করে রাশিরাশি কথা উগরে দেন, তাঁদের মধ্যে সংখ্যাগুরুরাই দুর্গাপুজোকে শারদোৎসব নাম নিয়ে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার মিলনোৎসব হিসেবে হপ্তা খানেকের জন্য শ্রেণিচেতনার চিন্তাকে ছুটি দিই। তারপর আবার এক সপ্তাহের জন্য শ্রেণিচেতনা মুলতবি রাখি ধনী বন্ধুর সঙ্গে শৈলশহর গ্যাংটকে গরম কাটাতে আসতে। ধনী বন্ধুর লক আউট করা কারখানার শ্রমিকভাইদের কথা কয়েকটা দিনের জন্য শীত-শেষের লেপের মতোই গুটিয়ে তুলে রাখি। আদর্শ তো কোনও শখের খেলনা হতে পারে না, আজ আদর্শ নিয়ে চলব, কাল আদর্শ নিয়ে চলব, পরশুর জন্য আদর্শ গুটনো থাকবে, এবং তারপর দিনই আদর্শের নকশিকাঁথা খুলে বসব ।

আমাদের সমাজের অনেক বিপ্লবীর, অনেক বিজ্ঞান আন্দোলনকর্মীর মগজে যে চিন্তাটা কিবিল্ করে খেলে বেড়াচ্ছে, তা হল—সব্বাইকে নিয়েই যখন আন্দোলন গড়তে হবে, সব্বাইকে নিয়েই যখন চলতে হবে, তখন কোনও মানুষ বা সংগঠনের চ্যুতি, স্খলন নিয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয় । এতে ঠগ বাছতেই গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। তখন আন্দোলন করবেটা কে?

নীতি বিসর্জন দিয়ে নৈতিক সংগ্রাম চালানো কখনও যায়নি, যাবেও না। যাঁরা আপস করার কথা বলেন, বিচ্যুতদের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে দ্রুত দলে ভারী হয়ে ওঠার মধ্যেই আন্দোলনের সার্থকতা খুঁজে পান, তাঁদের কাছে প্রশ্ন: আপোষ ও মানিয়ে নেওয়ার অর্থ যদি হয় আদর্শকে বিসর্জন দেওয়া, তবে কি জবাব দেব নিজের বিবেকের কাছে?

তবে এ-কথা বলি ‘বিচ্যুত’ ও ‘ভুল বোঝা’ দু’টি গুণগতভাবে সম্পূর্ণ পৃথক। একজন দুর্নীতিপরায়ণ জনপ্রতিনিধি বা জনসেবক অবশ্যই বিচ্যুত। এই বিচ্যুত মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রামে নামা যায় না। এরা সংগ্রামকে ভাঙিয়েও আখেরই গোছাবে। ফলে সংগ্রামের ‘দফা হবে রফা’। কিন্তু একজন বিজ্ঞানকর্মী, যিনি কিনা বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গড়তে চান, তিনি নিশ্চযই একজন জীবনযুদ্ধে হতাশাগ্রস্ত গ্রহরত্নধারণকারীকে এড়িয়ে চলবেন না। এই বঞ্চিত মানুষদের জন্যই তো আন্দোলন, এই নিপীড়িত মানুষদের নিয়েই তো আন্দোলন। এদের যে ভুল বুঝিয়ে রাখা হয়েছে, অদৃষ্টবাদী করে’ তোলা হয়েছে—এ কথা বোঝানোই তো আন্দোলন কর্মীদের কর্তব্য। এই হতদরিদ্র অদৃষ্টবাদী মানুষগুলো বিচ্যুত নয়, এরা ভুল চিন্তার শিকার। এদের প্রকৃত সত্য যে দিন বোঝাতে পারব, সে দিন ওরা নিজেরাই আংটিটি খুলে রাখবে। কিন্তু এর পরিবর্তে কোনও বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মী বা নেতা যদি আংটিধারীকে দলে টানতে নিজেও একটি গ্রহরত্নের আংটি ধারণ করে বোঝাতে প্রয়াসী হন— ‘আমি তোমাদেরই লোক’ –তবে বলতে বাধ্য হব, এতে সমাজ বা সমাজের সংস্কৃতির কোনও উত্তরণই ঘটবে না, আন্দোলন সংগঠিত হবে না, আগাছার মতোই একটা দল বাড়বে শুধু। আদর্শ ছাড়া বিপ্লব কোনও দিনই সংগঠিত হয়নি, হবেও না। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সমাজে মেকি আন্দোলনকারী, আপসপন্থী ধান্দাবাজরাই সংখ্যাগুরু। সুসংস্কৃতির স্বার্থেই প্রয়োজন এইসব বিচ্যুতদের নিয়ে চলা নয়, ওদের চিহ্নিত করে বিচ্ছিন্ন করা।

গত মে ৯২ দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার একটি গ্রামের ‘নাইট গার্ড’দের হাতে মারা পড়ল একাধিক তরুণ। তরুণদের অপরাধ, তারা এক আত্মীয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রণ খেয়ে স্টেশনে এসে শেষ ট্রেনটিও না পেয়ে আবার বিয়ে বাড়িতে ফিরে না গিয়ে স্টেশনেই রাতটা কাটাবে বলে শুয়েছিল। নাইট গার্ডরা ওদের স্টেশনে পাকড়াও করলে ওরা বার বারই জানিয়েছে আমরা অমুকের বাড়িতে বিয়ে উপলক্ষে এসেছিলাম, আমাদের কথায় বিশ্বাস করতে হবে না। ওই বাড়িতে নিয়ে চলুন, খোঁজ করুন, সত্যি কি মিথ্যে জানতে পারবেন। কিন্তু ও-সব যুক্তির ছেঁদো কথায় নাইট গার্ডদের মনের চিঁড়ে ভেজেনি। লক্‌লক্‌ করে উঠেছিল ওদের ভেতরের হিংস্রতার আগুন। ওরা ওই তরতাজা তরুণদের কানের ভিতর দিয়ে, চোখের ভিতর দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিল লৌহ শলাকা। সেই সঙ্গে ইট দিয়ে ঠুকে ঠুকে ভেঙেছিল হাত-পা বুকের পাঁজরগুলো। আদা থেঁতলানোর মতোই থেঁতলে দিয়েছিল গোটা শরীরটা । তীব্র যন্ত্রণায় মানুষগুলো শলাকাবিদ্ধ শূকরের মতোই ব্যর্থ আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভরিয়ে তুলেছিল। তরুণরা মারা গেল। কারো বুক খালি করে দিয়ে চোখের জল ঝরিয়ে ওরা বিদায় নিল। বর্বরদের চেয়েও বর্বরদের মতো অত্যাচার চালিয়ে যারা হত্যা করল, সেই নিষ্ঠুর হত্যাকারীরাও তো আপনার আমার বাড়িরই ছেলে। ওরা তো বেসিক্যালি খুনে নয়। তবে? তবে?

এ তো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এই পচনধরা সমাজে এমন ঘটনা প্রতিনিয়ত আকছার ঘটেই চলেছে। ছাপোষা, নিরীহ, বঞ্চিত মানুষগুলো হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো কথায় কথায় হিংস্র হয়ে দলবদ্ধভাবে আক্রমণ চালাচ্ছে সামান্য সন্দেহ কারো দিকে বিদ্ধ করলেই। যুক্তি-প্রমাণের ব্যাপার-স্যাপারকে সামান্যতম পাত্তা না দিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে, রক্তচোষা সন্দেহে, গুজবে পরম বিশ্বাস রেখে উত্তেজনার আগুনে নিজেদের তাতিয়ে এরা নিরীহতার গণ্ডি থেকে হিংস্রতার গণ্ডিতে পা রেখেছে, হয়ে উঠেছে হিংস্র খুনি। প্রতিটি অবদমিত বঞ্চনাই এ-ভাবে সৃষ্টি করছে হিংস্রতার গণ-হিস্টিরিয়া, হিংস্রতার বিস্ফোরণ। এ-সব নিয়েই তো আমাদের বহমান সমাজ, আমাদের সংস্কৃতি ।

আমাদের দেশের নাগরিকদের অধিকার নিয়ন্ত্রণ করে সমাজ বিরোধীরা।

আমাদের দেশের নাগরিক-অধিকার নিয়ন্ত্রণ করে নপুংসক, ক্ষমতালোভী অর্থলোভী সরকারি আমলা। আমাদের দেশের নাগরিক-অধিকার নিয়ন্ত্রণ করে আমাদেরই করের টাকায় পালিত উর্দি পরিহিত সবচেয়ে সংগঠিত সমাজবিরোধীরা।

যাঁদের দেখে শ্রদ্ধা করা যায়, উদ্দীপ্ত হওয়া যায়, আদর্শকে

জীবনের শ্বাস-প্রশ্বাস করে আদর্শের জন্য জীবনকে তুচ্ছ

করা যায় এমন মানুষের সংখ্যা আমাদের দেশে

অতিক্ষীয়মাণ। এই তো আমাদের সমাজের

আসল চেহারা, যা আমাদের সংস্কৃতি।

এত শোষণ, এত দুর্নীতির অনাবিল স্রোত, এতে লাভবান মানুষের সংখ্যা কোটিতে গুটিক; ওরা বণিক-ধনিক সম্প্রদায় ও তাদের কিছু উচ্ছিষ্টভোগী । আসমুদ্রহিমাচলে নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষরাই তো সংখ্যাগুরু। বঞ্চনাকারী এইসব মানুষরা বঞ্চিতদের তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভের দুর্বার বিস্ফোরণে শেষ হয়ে যাবে, অপেক্ষা শুধু বিস্ফোরণের। বণিক-ধনিক-শাসককুলের কাছে এই তথ্যটি মোটেই অজানা নয়। তারা দেখেছে নব্বই-এর দশকের গোড়াতেই কী করে এক একটি বিশাল শক্তিধর দেশের সরকারের গদি উল্টেছে। গদি উল্টেছে জন-প্রতিরোধে। বিশাল পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাধ্য হয়নি জন-রোষকে প্রতিহত করার। এই কথা বলার উদ্দেশ্য কোনও দেশের প্রাক্তন সরকারকে সমর্থন বা অসমর্থন নয়। উদ্দেশ্য একটিই : দৃষ্টান্ত হাজির করে বোঝার ব্যাপারটা সোজা করা। এ-দেশের শোষকরা ভালোই জানে সংখ্যাগুরু শোষিত মানুষদের ক্ষুব্ধতাকে পায়ের তলায় দাবিয়ে রাখার ক্ষমতা পুলিশ, সেনা ও রাষ্ট্রশক্তির নেই। তাই নানা কৌশলে শোষিত মানুষদের ক্ষুব্ধতার আগুনে জল ঢালে রাষ্ট্রনায়করা।

সমাজের হুজুরের দল ও তাদের উচ্ছিষ্টভোগীরা চায় না মজুরের

দল জানুক তাদের প্রতিটি বঞ্চনার কারণ এই সমাজেরই কিছু

মানুষের লোভ, দুর্নীতি, এই সমাজব্যবস্থা। অজ্ঞতার অন্ধকারে

থেকে বঞ্চিত মানুষগুলো যদি বঞ্চনার কারণ হিসেবে

স্বর্গের দেবতা, আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র, পূর্বজন্মের

কর্মফল, অদৃষ্ট ইত্যাদিকে চিহ্নিত করে, তবে

তো কেল্লা ফতে। ওদের ক্ষুব্ধতাকে

স্তব্ধ করতে পুলিশ মিলিটারি

নামাতেই হয় না।

সমস্ত জন-চেতনা যদি বঞ্চনার কারণ হিসেবে হুজুরের দল ও তাদের সাঙাতদের দায়ী করে, নিজেদের অধিকার ফিরিয়ে নিতে ময়দানে নেমে পড়ে, তবে যে পুলিশ, মিলিটারি দিয়েও ক্ষমতায় থাকা যাবে না, এ সত্য হুজুরদের ভালোমতই জানা, তাই হুজুরের দল চায়, অন্ধ বিশ্বাসগুলো মানুষের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখুক, দৃষ্টিকে করে রাখুক ঘোলাটে। তাহলে অনেক সহজে, অবহেলিত বঞ্চিতদের প্রতিবাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিয়ে হুজুর-মজুর সম্পর্ক, শোষক-শোষিতের সম্পর্ক বজায় রাখা যাবে।

কথাগুলি যে কী ভয়ঙ্কর রকম সত্যি, তার উদাহরণ টানতে দু-তিনটে ঘটনার উল্লেখ করছি।

গীতা যে উঠোনে পিঁড়ি পেতে বসেছিলেন, সেটাকে ‘বারো বস্তি এক উঠোন’ বললেই বোধহয় ঠিক হয়। গীতার চুল বেঁধে দিচ্ছিলেন একটি মহিলা।

গীতার আশে-পাশে আরও জনা দশেক মহিলা ভিড় করে এসে দাঁড়িয়েছেন। এঁরাও বারো বস্তিরই বাসিন্দা, এঁদের কয়েকজনের কোলে-কাঁখে হাড়- জিরজিরে পেট-ফোলা শিশু। অপুষ্টি ও অতিমাত্রায় পরিশ্রম হাত ধরাধরি করে মহিলাদের যৌবনকে বরণ করেছে।

লেখাপড়া শিখে কী করব? চাকরি করতে তো আর আমরা যাব না। ভাগ্যে আমাদের যা লেখা আছে, তা লেখাপড়া শিখে কি খণ্ডাতে পারব?” গীতার চুল বেঁধে দিচ্ছিলেন যে রুগ্‌ণা প্রবীণা মহিলা, তিনিই আমাদের উদ্দেশে কথাগুলো বললেন।

ঘটনাটা বছর ক’য়েক আগের। আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম কলকাতার বউবাজার অঞ্চলের কিছু বস্তিতে। ঘুরে ঘুরে চেষ্টা করছিলাম এই অঞ্চলের একটি মহিলাগোষ্ঠীর মধ্যে লেখাপড়া শেখার ইচ্ছে জাগিয়ে তুলতে। উদ্দেশ্য ছিল, ওঁদের লেখাপড়া শেখার ও পাশাপাশি কুসংস্কারমুক্ত করার চেষ্টা। আর তখনই অনেকেই এই ধরনের প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন আমাদের দিকে। এই মহিলারা রাতের ঘুমকে বাক্সবন্দি করে বউবাজার স্ট্রিট ও তার আশপাশের গলিগুলোর পুরুষমানুষগুলোর দিকে নজর রাখেন। বিকেল না হতেই রাস্তাগুলোয় বাড়ি ফেরতা উথাল পাথাল মানুষের ঢেউ, চলেছে শিয়ালদা স্টেশনের দিকে। শুধু মানুষ আর মানুষ। রং মেখে নিজের শরীরটাকে আকর্ষণীয় করতে যতটা সম্ভব দামি পোশাক পরেন এঁরা। দেখে বোঝার উপায় থাকে না, বাড়িতে এঁরাই পরেন একটুকরো ত্যানা কাপড়। এঁদের বাড়ির ছেলেরা মা’য়ের দুধ না ছাড়তেই নেমে পড়ে পেট চালাবার যুদ্ধে। এত নিপীড়ন ও বঞ্চনার পরও এঁদের কারও কোনও অভিযোগ দেখিনি সমাজের কারও প্রতি। নিজেরই ভাগ্যফল বলেই সব কিছুকে মেনে নিয়েছেন।

কুড়ি বছর আগের আর একটি ঘটনা। ঘটনাস্থল বিহারের সিংভূম জেলার বান্দিজারি গ্রাম। ওই গ্রামে অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল বহু মানুষ। খবর পেয়ে গিয়েছিলাম। দেখেছিলাম গ্রামবাসীদের পান করার একমাত্র জল তীব্র দুর্গন্ধে ভরা, রং কালচে শ্যাওলা মতন। এমন সর্বনাশা মড়কের খবর আমাদের কাছে পৌঁছলেও সরকারি প্রশাসকের কানে পৌঁছয়নি। টিকিটির দেখা মেলেনি স্থানীয় বিধায়ক বা সাংসদের। তৈরি নরকে একটি করে তাজা মানুষ অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবাদহীনভাবে মৃত্যুকে বরণ করেছেন। গ্রামের মানুষ রোগীদের দূরের হাসপাতালে পাঠাবার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেননি। ধরেই নিয়েছিলেন, ভাগ্যে যাঁদের মৃত্যু লিখেই রেখেছেন ‘বোঙ্গা’, তাঁকে বাঁচাবার সাধ্য কোনও মানুষেরই নেই। ওদের কোনও অভিযোগ ছিল না সমাজের প্রতি, নির্বাচিত সরকারের প্রতি।

সুন্দরবনের ভয়ংকর সৌন্দর্য নিয়ে কাব্য করা যতটা সোজা, সুন্দরবনের মানুষগুলোর ভয়ংকর দারিদ্র ও লাঞ্ছনাভরা জীবন নিয়ে কাব্য করা ততটাই কঠিন। এখানকার মহিলা-পুরুষ বা বাচ্চারা পর্যন্ত কাকভোরেই নদী আর খাঁড়িগুলোতে নেমে পড়ে মাছ ধরতে। দিনান্তে তাই বেচে জোটে একবেলা পান্তার খোরাকি। মাছ ধরতে গিয়ে কখনও কখনও ধরা পড়ে কামটের কামড়ে। ধারালো ক্ষুর দিয়ে কাটার মতোই জলের তলায় নিঃসাড়ে পা কেটে নিয়ে যায় হাঙর, স্থানীয় মানুষরা যাকে বলে কামট। এর পর কেউ কেউ পা হারিয়ে জান বাঁচায়, কেউ কেউ মারা যায় অবিরাম রক্তক্ষরণে। কাছাকাছি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে রক্ত নেই, তাই কামটের কামড়ের পর মৃত্যুটাই এখানে স্বাভাবিক। যদিও কামটের কামড়ের ঘটনা এখানে আকছারই ঘটছে, কিন্তু তবুও সরকার পরম উদাসীন। আর স্থানীয় মানুষগুলো? না, ওরা কোনও দাবি তোলে না, অভিযোগহীন এই মানুষগুলো ভাগ্যের হাতেই ছেড়ে দিয়েছে নিজেদের জীবন।

একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে সাপে কাটা রোগীদের ক্ষেত্রে। প্রতি বছরই সাপের কামড়ে মারা যায় এ অঞ্চলের বহু মানুষ। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে সাপে কাটা রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় ইনজেকশন না থাকায় মানুষগুলো বাধ্য হয়েই শেষ চেষ্টা করতে ওঝা-গুনিনদের শরণাপন্ন হয়। বিষাক্ত সাপ ঠিক মতো বিষ ঢাললে তাকে বাঁচানোর সাধ্য ওঝা, গুনিনের হয় না। রোগী মরে।

দারিদ্র্যের নগ্ন লাঞ্ছনায় নুয়ে পড়া মানুষগুলো

‘জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে সবই ভাগ্যের লিখন’,

ধরে নিয়ে ক্ষোভের পরিবর্তে

শোক পালন করে।

হিঙ্গলগঞ্জের মাস্টারমশাই শশাঙ্ক মণ্ডল ক্ষোভের সঙ্গেই জানিয়েছিলেন, “সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণে সরকার যত সচেষ্ট, মানুষ সংরক্ষণে তার এক শতাংশ চিন্তাও সরকারের নেই।”

সত্যিই নেই। বাঘ পুষতে, তাদের সময়মতো খাবার জোটাতে কত পরিকল্পনা, কত অফিস, কত কর্মচারী। আর মানুষগুলোর জন্যে? সুন্দরবনের হত দরিদ্র ক্ষুধার্ত জেলে, মউলে ও বাউলেরা জঙ্গলে যায় বাঁচতে। এর জন্য বন দপ্তরের পাশ নিতে হয়। কাঠ কাটা ও মধু সংগ্রহের জন্য পাশ। তারপর এরা অনেকেই বাঁচতে পারে না বাঘের থাবা থেকে। গোসাবা, কাটাখালি গ্রামে এমন একটি পরিবার পাওয়া যাবে না, যে পরিবার থেকে কেউ বাঘের পেটে যায়নি।

বাঘের থাবা থেকে যারা বেঁচে ফেরে তাদের জন্য থাবা মেলে বসে থাকে সুন্দরবনের ডাকাত ও মহাজনরা ।

গোসাবার ফতেমা বিবি যৌবনে তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন বাঘের থাবার তলায়। সব হারিয়েও ফতেমা বিবির চোখ শশাঙ্ক মাস্টারের মতন জ্বলে ওঠে না ক্ষোভে। কপাল চাপড়ে নিজের ভাগ্যকেই দোষে।

ভয়ংকর দারিদ্র্যে নুয়ে পড়া মানুষগুলো পেটে পাত্তা, পরনে ত্যানা, আর মাথা গোঁজার মতন একটা অন্ধকারময় ঝুপড়ি পেলেই বর্তে যায়। ‘শিক্ষালাভের অধিকার’, ‘চিকিৎসালাভের অধিকার’ কথাগুলো ওদের কাছে অর্থহীন বিলাসিতা মাত্র। বঞ্চনার জন্য ওরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে না। অধিকার ছিনিয়ে নিতে ওদের চোখ বাঘের মতন ভয়ংকর হয়ে জ্বলে ওঠে না। বঞ্চিত মানুষগুলো প্রতিটি বঞ্চনার জন্য নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে বিলাপ করে, চোখের জল ফেলে।

দুর্নীতির সঙ্গে হাত ধরাধরি করে কিছু মানুষ যখন চূড়ান্ত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করেও টাকা ফুরোতে পারছে না, টাকার কলেবর বৃদ্ধিতে এ-দেশের ব্যাঙ্কে স্থান সংকুলান হচ্ছে না বলে সুইস ব্যাঙ্কে পাচার করতে হচ্ছে, ঠিক তখন আমাদের দেশের কয়েক লক্ষ কারখানা বন্ধ হয়ে রয়েছে। কয়েক কোটি বেকার মানুষ ক্ষুধায়, চিন্তায়, দারিদ্র্যে, লাঞ্ছনায় জর্জরিত। বেকারত্বের তীব্র জ্বালা থেকে পরিত্রাণ পেতে অনেকেই বেছে নিয়েছেন আত্মহননের পথ। অনেকে হয়েছেন অপ্রকৃতিস্থ। অবস্থা উত্তরণের জন্য অনেকেই মন্দিরে কি দরগায় মানত করেছেন, কেউ বা দৌড়োদৌড়ি করেছেন জ্যোতিষীর কাছে—যদি ভাগ্যটা ফেরানো যায়। কারও স্ত্রী পরম নিষ্ঠাভরে ব্রত পালন করেছেন অনেক দেব-দেবীর উদ্দেশেই। কেউ বা হত্যে দিয়ে পড়েছেন তারকেশ্বরে বা ভেঙ্কটেশ্বরের মন্দিরে। কেউ বা বাবাজি বা মাতাজিদের পায়ে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করেছেন, “আমাকে বাঁচান প্রভু”। কিন্তু এই দুর্নীতি ও অবক্ষয়ের এই সমাজে কোনও প্রভুরই বাঁচাবার ক্ষমতা নেই।

কোনও ঈশ্বর, কোনও অবতার, কোনও জ্যোতিষীর কি ক্ষমতা

আছে প্রতিটি বেকার তাদের কাছে পরম শ্রদ্ধা, আন্তরিকতা

ও বিশ্বাসের সঙ্গে বেকারত্বের জ্বালা ঘোচাবার

প্রার্থনা করলে সে প্রার্থনা পূর্ণ করার?

উত্তর–না, না, এবং না।

বিনা চিকিৎসায় ছেলে আমার মারা গেল, আমি দোষ দিলাম বিধিলিপির, চিকিৎসার সুযোগ পাওয়ার অধিকার নিয়ে কোনও প্রশ্ন তুললাম না। কারণ সেই প্রশ্ন আমার মাথায়ই আসেনি। আমার ভাই স্রেফ অর্থের অভাবে পড়াশুনো করতে পারল না। আমি দোষ দিলাম ভাগ্যের।

লেখাপড়া শেখার অধিকার নিয়ে কোনওই দাবি তুললাম না। কারণ ওই দাবির কথা আমার মাথাতেই খেলেনি। আমি স্ত্রীকে ধর্ষিতা হতে দেখলাম। লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে স্ত্রী গায়ে আগুন দিয়ে মারা গেল, আমি ভাবলাম জ্যোতিষী ঠিকই বলেছিল-তোমার বউটা তাড়াতাড়ি মারা যাবে। আমি একবার ভাবলাম না, এ লজ্জা তো আমার স্ত্রী’র নয়, এ-লজ্জা গোটা সমাজের। আমি দেখলাম ধর্ষণকারী মস্তানরা পাড়াতেই বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মুখ না খোলার জন্য একে ওকে শাসাচ্ছে। থানায় ডাইরি করতে যেতেই থানার বড়বাবু খ্যাক খ্যাক করে হেসে বললেন, “কী করে বুঝলি তোর বউকে ধর্ষণই করা হয়েছে? ওকে ধর্ষণ করা হয়েছে, তা প্রমাণ করতে পারবি তো?”

তারপর তো আসছে ‘কে ধর্ষণ করছে তার প্রমাণ সাক্ষী-সাবুদ’, আমি চেঁচালাম, “বউটা মরার আগে এক ঘর লোকের সামনে হাবু, মানিক আর খ্যাঁদার নাম বলে গেছে, ওরা তিনজনই পাড়ার মধ্যে বুক ফুলিয়ে ঘুরছে হুজুর। সাক্ষীদের ভয় দেখাচ্ছে, আমাকেও ভয় দেখিয়েছে।”

আবার বিশ্রী রকম ভাবে হেসে উঠলেন বড়বাবু, “তোর তো দারুণ সাহস দেখছি! অন্য কেউ যদি তোর মতো সাহস করে সাক্ষী দিতে না আসে, তখন কী হবে?”

“খেতে আমার ভাইটা ওদের তিনজনকে দেখেছিল হুজুর।”

“কী দেখেছিল?”

“ওরা আমার বউটাকে ……”

“কিন্তু হারুরা যদি বলে পয়সা দিয়েই করছিলাম। তোর ভাইটা দেখে ফেলার জন্যে লজ্জা বাঁচাতে গপ্পো ফেঁদেছিল তোর বউটা।”

ফ্যাল ফ্যাল করে বড়বাবুর কথাগুলো শুনে বেরিয়ে এসে ভাবলাম- সত্যিই তো সাক্ষী-সাবুদ-আইন-আদালত কি চারটিখানি কথা। বড়বাবুই বা কী করবে, ওকেও আইন মেনেই তো চলতে হবে। জ্যোতিষীর ভবিষ্যৎবাণীর কথাটাই আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। বউটা বড় ভালো ছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল—সত্যিই ‘অদৃষ্টের মার দুনিয়ার বার’। মানুষের সৃষ্টি প্রবঞ্চনে মনের জ্বালা কিছুটা মিটল। ঠিক করেই ফেললাম, আজ বাসুদেব বাড়ি কীর্তনের আসরে যাব। ঠাকুরের কাছে মনটা সঁপে দিলে শান্তি পাব।

এই ‘আমি’ আজ ভারতে কোটি কোটি ছড়িয়ে রয়েছে, বঞ্চনা যাদের মধ্যে ঘৃণার সৃষ্টি করতে পারেনি।

প্রিয় পাঠক, প্রিয় বঞ্চিত মানুষ, প্রতিটি বঞ্চনার কারণকে ঘৃণা

করুন। ঘৃণাই আপনার সংগ্রামের শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে

উঠবে। আপনার ঘৃণার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে

বিস্ফোরক শক্তি, লুকিয়ে রয়েছে শোষক ও

শাসক নামের দৈতদের প্রাণ-ভোমরা।

আপনার আমার ঘৃণাই ঝড় হয়ে ওদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে আবর্জনার স্তূপে । অত্যাচারিতের, বঞ্চিতের এই ঘৃণা ও ক্ষুব্ধতার আগুনে জল ঢালতেই হুজুরের দল চায় দেশের কোটি কোটি বঞ্চিত মানুষ সত্যের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকুক, বিশ্বাস করুক ঈশ্বর, অলৌকিকত্ব, পূর্বজন্ম, কর্মফল, ভাগ্য ইত্যাদির অলীক অস্তিত্বে। ওরা বিশ্বাস করুক—যারাই সরকারের, রাষ্ট্রশক্তির বিরোধিতা করছে তারাই দেশদ্রোহী। ওরা পরিবেশ বলতে গাছ-পালা আর প্রকৃতি নিয়ে মেতে থাকুক, ভুলে থাকুক আর্থ-সামাজিক ও সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশের কথা—যার প্রভাব মানুষের জীবনে প্রাকৃতিক পরিবেশের চেয়ে অনেক বেশি রকম জোরালো। ক্ষুব্ধতার গরম বাষ্পে শোষক-যন্ত্র প্রেসার কুকারটি যেন বিস্ফোরণে খান-খান্ না হয়, তারই জন্যে ‘সেবা’র সেফটি ভাল্ব লাগানো হয়। বঞ্চিত-প্রেমিক তরুণ সমাজকে সেবামূলক কাজে আটকে রাখতে হাজির করা হয় নানা চতুর পরিকল্পনা। যুব সমাজকে ভুলিয়ে রাখতে হাজির হয় উত্তেজক নানা, নেশা, পুজোর রমরমা, মাদকতাময় সংগীত, চলচ্চিত্র, নাটক। দাবি, পাল্টাদাবি, অর্থহীন মিটিং-মিছিল, পেশিশক্তি, আগ্নেয়াস্ত্র, পাড়া দখল, অঞ্চল দখল, বিরোধীদের হাত কেটে নেওয়া-জিব কেটে নেওয়া-চোখ উপড়ে নেওয়া-ইজ্জত লুটে নেওয়া-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া-পাড়া জ্বালিয়ে দেওয়া, এইসব তো আমাদের সমাজের চলমান-চিত্র, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের অপসংস্কৃতি।

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ বিভ্রান্তির সংস্কৃতিঃ বাঁচাও তাহারে মারিয়া

অধ্যায়ঃ দুই

♦ অপসংস্কৃতি ও সুস্থ সংস্কৃতিঃ পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হোক সুচেতনার পথে

অধ্যায়ঃ তিন

♦ সাংস্কৃতিক বিপ্লবঃ পৃথিবীর পথে হাজার বছর হাঁটা

অধ্যায়ঃ চার

♦ ভারতবর্ষে সাংস্কৃতিক আন্দোলনঃ কেউ কথা রাখেনি

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ নকশালবাড়ির সংগ্রামে উব্ধুদ্ধ সাংস্কৃতিক আন্দোলন

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ যুক্তিবাদী আন্দোলন, সার্বিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনঃ এসো আমরা আগুনে হাত রেখে প্রেমের গান গাই

অধ্যায়ঃ সাত

♦ ‘যুক্তিবাদ’ একটা সম্পূর্ণ দর্শন, একটা বস্তুবাদী বিশ্ব-নিরীক্ষণ পদ্ধতিঃ কুয়াশা কাটে, কাটে নেশা, আকাশের ঘষা-সূর্য স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়

অধ্যায়ঃ আট

♦ যুক্তির পথচলাঃ লোভের অন্ধকারে ঢোকে না দিনের আলো

অধ্যায়ঃ নয়

♦ অতি ব্যবহৃত কিছু শব্দঃ সিন্দুকেতে মন ভরেছে ভেতরে তার কি আছে কেই বা রাখে খোঁজ?

“সংস্কৃতিঃ সংঘর্ষ ও নির্মাণ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒ মন্তব্য করুন⇐

error: Content is protected !!