‘দর্শন’ হল জীবন ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে দেখার পদ্ধতি, দৃষ্টিভঙ্গি। ‘অধ্যাত্মবাদ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল ‘আত্মা সম্বন্ধীয় মতবাদ’। অধ্যাত্মবাদ স্বতঃপ্রমাণ হিসেবে ধরে নেয়—“আত্মা জন্মহীন, নিত্য, অক্ষয়, অনাদি। শরীর হত হলেও আত্মা হত হয় না।”

আত্মা সম্বন্ধে এ’কথা হিন্দুদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ গীতায় বলা হয়েছে। আত্মার ধর্ম আমরা গীতায় পেলাম। আত্মা সম্বন্ধে আরও বলা হয়েছে—আত্মাকে শাণিত অস্ত্র দ্বারা খণ্ডন করা যায় না, আগুনে দগ্ধ করা যায় না ইত্যাদি। এই হল আত্মার ধর্ম; হিন্দুধর্মের আত্মা। মৃত্যুর পর ‘পরলোক’ চিন্তা, আত্মা সংক্রান্ত চিন্তা—এও অধ্যাত্মবাদেরই চিন্তা। পরলোকে গত জন্মের পাপ-পুণ্যের হিসাব করে স্বর্গের সুখ বা নরকের যন্ত্রণা ভোগের কথা—আত্মা সংক্রান্ত মতবাদেরই কথা।

নরকে আত্মাকে ধারাল অস্ত্র দিয়ে কাটা, গরম তেলে দগ্ধ

করার কথা আছে। আর একদিকে বলা হচ্ছে আত্মাকে

কাটা যায় না, দগ্ধ করা যায় না। এ’সবই তো

অধ্যাত্মবাদের স্ববিরোধিতা। এমন স্ববিরোধী

দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জীবন ও বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে

কীভাবে দেখা যাবে? বিশ্ব-নিরীক্ষণ

পদ্ধতি না হলে ‘দর্শন’

বলি কী করে ?

‘আত্মা’ ও ‘মন’ যে এক ও অভিন্ন—এ বিষয়ে বহু ধর্মীয়বেত্তাই সহমত। বহু থেকে এক-আধটি নমুনা পেশ করছি।

আচার্য শংকর তাঁর ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে বলেছেন, “মন হল আত্মার উপাধিস্বরূপ।” সাংখ্য দর্শন মতে— আত্মা চৈতন্যস্বরূপ। (সাংখ্যসূত্র ৫/৬৯) ও (সাংখ্যপ্রবচনভাষ্য 2/82/89)

শ্রীভাষ্যকার রামানুজের মতে “আত্মা চৈতন্যস্বরূপ।” (যতীন্দ্রমতদীপিকা, পৃষ্ঠা ৯৮ আনন্দ আশ্রম সংকলন)

জৈন দর্শনে বলা হয়েছে, “চৈতন্যই জীবের লক্ষণ বা আত্মার ধর্ম।” (ষড়দর্শনসমুচ্চয়, পৃষ্ঠা ৫০ চৌখাম্বা সং)

স্বামী বিবেকানন্দের মতে— চৈতন্য বা চেতনাই আত্মা। (বিবেকানন্দ রচনাসমগ্র, অখণ্ড সংকলন, প্রকাশক: নবপত্র, পৃষ্ঠা ১৬২)

স্বামী অভেদানন্দের মতে, “আত্মা বা মন মস্তিষ্কের বহির্ভূত পদার্থ, মস্তিষ্কজাত নয়।” (মরণের পরে, পৃষ্ঠা ৯৮)

এই কয়েকটি উদাহরণ থেকে আমরা নিশ্চিতভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, এইসব আধ্যাত্মবাদী দার্শনিকরা ‘আত্মা ও মন’ এক ও অভিন্ন মনে করতেন এবং আত্মা বা মন ‘নিত্য’, ‘অক্ষয়’, ‘অমর’—বিশ্বাস করতেন ।

স্কুলের পাঠ শেষ করা প্রতিটি ছেলেমেয়ে শরীর বিজ্ঞানের প্রাথমিক পাঠেই জেনে গেছে যে—‘মন’ হল মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষের কাজকর্মের ফল। বুঝে গেছে যে, মৃত্যুর পর দেহ বিলীন হয়। বিলীন হয় দেহাংশ, মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষ। মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষ নেই, কিন্তু তার কাজকর্ম আছে, কাজকর্মের ফল হিসেবে মনও আছে, অর্থাৎ আত্মা আছে—এমনটা শুধু বোকা কল্পনাকেই সম্ভব।

এই আলোচনা শেষে আমরা নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি, চিন্তা চেতনা, মন-ই যদি আত্মা হয়, তবে সেই আত্মা কখনই অমর হতে পারে না। আত্মার অমরত্ব তত্ত্বের উপরই দাঁড়িয়ে আছে পরমাত্মার কল্পনা ।

আত্মা-পরমাত্মার মিথ্যে তত্ত্বের উপর নির্ভরশীল অধ্যাত্মবাদ শেষ পর্যন্ত

কোনওভাবেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কিছুকে দেখার, বিশ্লেষণ

করার, বোঝার পদ্ধতি বা দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে না ।

এরপরও আত্মা-পরমাত্মার বিশ্বাস-নির্ভর

অধ্যাত্মবাদকে ‘দর্শন’ বলেচিহ্নিত করলে তা

হবে ভুল।

এই ভুল দর্শন মানুষের ‘ধর্ম’কেগুণ বা বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তে অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক শক্তির উপর বিশ্বাসের নানা প্রথা ও আচার পদ্ধতি বলে প্রচার করে আসছে। বিভিন্ন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের উপাসনা পদ্ধতি, এই সংক্রান্ত রীতিনীতি, পরমাত্মা, ইহকাল, পরকাল বিষয়ক মত ‘ধর্ম’ বলে প্রচারিত হয়ে আসছে।

‘ধর্ম’ আমাদের কাছে যথেষ্ট তালগোল পাকানো ব্যাপার। এরজন্য হয়তো কিছুটা দায় আমাদের ভাষার দীনতা। ইংরেজি ভাষায় কিন্তু একটা স্পষ্ট সীমারেখা টেনে দেওয়া হয়েছে property ও religion-এর মধ্যে। Property-র অর্থ SAMSAD ENGLISH-BENGALI DICTIONARY-তে বলা হয়েছে characteristic বৈশিষ্ট্য; any quality গুণ বা ধর্ম। Religion শব্দের অর্থ হিসেবে লেখা আছে belief in a higher unseen controlling power, esp. in a personal God, অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক শক্তির বিশেষত ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস; any system of faith and worship অর্থাৎ যে কোনও উপাসনা রীতির প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস। ইংরেজি property ও religion শব্দের মধ্যে একটা স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে। SAMSAD এর অভিধানে তাই property, natural quality of behaviour or function- এর অর্থ বোঝাতে লেখা আছে মানবধর্ম, কালধর্ম, আগুনের ধর্ম। আমাদের ধর্ম শব্দে এই ধরনের বিভাজন নেই। তাই গোল বাঁধার সম্ভাবনাও বেশি।

আসুন না আমরাও স্পষ্ট একটা সীমারেখা তৈরি করি। মানুষের ধর্ম’

বলতে আমরা মানুষের ‘বৈশিষ্ট্য’ বা ‘গুণ’কেই চিহ্নিত করি।

বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়কে তাদের ঈশ্বর বিশ্বাস ও

উপাসনার রীতিনীতির নির্ভরতাকে ‘উপাসনা-ধর্ম’

বলে পরিচিত করতে শুরু করি। আমরাই

পারি ধর্মের পুরনো সংজ্ঞাকে বাতিল

করতে। আমরাই পারি

নতুন শব্দ সৃষ্টি

করতে।

error: Content is protected !!