অশিক্ষা, পদে পদে অনিশ্চয়তা এবং পরিবেশ মানুষকে ভাগ্য-নির্ভর করে
অদৃষ্ট্যবাদ যেখানে অশিক্ষা থেকে উঠে আসে

গীতা যে উঠোনে পিঁড়ি পেতে বসেছিলেন, সেটাকে ‘বারো বস্তি এক উঠোন’ বললেই বোধহয় ঠিক হয়। গীতার চুল বেঁধে দিচ্ছিলেন একটি মহিলা। গীতার আশে-পাশে আবো জনা দশেক মহিলা ভিড় করে এসে দাঁড়িয়েছেন। এঁরাও বারো বস্তিরই বাসিন্দা, এঁদের কয়েকজনের কোলে-কাঁখে হাড়-জিবজিবে পেট-ফোলা শিশু। অপুষ্টি ও অতিমাত্রায় পরিশ্রম হাত ধরাধরি করে মহিলাদের যৌবনকে বরণ করেছে।

“লেখাপড়া শিখে কী করব ? চাকরী করতে তো আর আমরা যাব না। ভাগ্যে আমাদের যা লেখা আছে, তা লেখাপড়া শিখে কি খণ্ডাতে পারব ?” গীতার চুল বেঁধে দিচ্ছিলেন যে রুগ্না প্রবীণা মহিলা, তিনিই আমাদের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বললেন ।

ঘটনাটা বছর দু’য়েক আগের। আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম কলকাতার বউবাজার অঞ্চলের কিছু বস্তিতে। ঘুরে ঘুরে চেষ্টা করছিলাম এই অঞ্চলের একটি মহিলাগোষ্ঠির মধ্যে লেখাপড়া শেখার ইচ্ছে জাগিয়ে তুলতে। উদ্দেশ্য ছিল, ওঁদের লেখাপড়া শেখার ও পাশাপাশি কুসংস্কারমুক্ত করার চেষ্টা। আর তখনই অনেকেই এই ধরনের প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন আমাদের দিকে। এই মহিলারা রাতের ঘুমকে বাক্সবন্দী করে বউবাজার স্ট্রিট ও তার আশ- পাশের গলিগুলোর পুরুষমানুষগুলোর দিকে নজর রাখেন। বিকেল না হতেই রাস্তাগুলো বাড়ি ফেরতা উথাল-পাথাল মানুষের ঢেউ, চলেছে শিয়ালদা স্টেশনের দিকে। শুধু মানুষ আর মানুষ। রঙ মেখে নিজের শরীরটাকে আকর্ষনীয় করতে যতটা সম্ভব দামী পোশাক পরেন এঁরা। দেখে বোঝার উপায় থাকে না, বাড়িতে এঁরাই পরেন এক টুকরো ত্যানা কাপড় । এঁদের বাড়ির ছেলেরা মা’য়ের দুধ না ছাড়তেই নেমে পড়ে পেট চালাবার যুদ্ধে । এত নিপীড়ন ও বঞ্চনার পরও এঁদের কারও কোনও অভিযোগ দেখিনি সমাজের কারও প্রতি । নিজেরই ভাগ্যফল বলেই সব কিছুকে মেনে নিয়েছেন।

তিন বছর আগের আর একটি ঘটনা। ঘটনাস্থল বিহারের সিংভূম জেলার বান্দিজারি গ্রাম। ওই গ্রামে অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল বহু মানুষ। খবর পেয়ে গিয়েছিলাম। দেখেছিলাম গ্রামবাসীদের পান করার একমাত্র জল তীব্র দুর্গন্ধে ভরা, রঙ কালচে শ্যাওলা মতন । এমন সর্বনাশা মড়কের খবর আমাদের কাছে পৌঁছলেও সরকারি প্রশাসকের কানে পৌঁছয়নি। টিকিটির দেখা মেলেনি স্থানীয় বিধায়ক বা সাংসদের। তৈরি নরকে একটি করে তাজা মানুষ অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবাদহীনভাবে মৃত্যুকে বরণ করেছেন। গ্রামের মানুষ রোগীদের দূরের হাসপাতালে পাঠাবার প্রযোজনীয়তাও অনুভব করেননি। ধরেই নিয়েছিলেন, ভাগ্যে যাঁদের মৃত্যু লিখেই রেখেছেন ‘বোঙ্গা’, তাঁকে বাঁচাবার সাধ্য কোনও মানুষেরই নেই।

সুন্দববনের ভয়ংকর সৌন্দর্য নিয়ে কাব্য করা যতটা সোজা, সুন্দরবনের মানুষগুলোর ভয়ংকর দারিদ্র্যতা ও লাঞ্ছনাভরা জীবন নিয়ে কাব্য করা ততটাই কঠিন। এখানকার মহিলা- পুরুষ মা বাচ্চারা পর্যন্ত কাকভোরেই নদী আর খাঁড়িগুলোতে নেমে পড়ে মাছ ধরতে। দিনান্তে তাই বেচে জোটে একবেলা পান্তার খোরাকি। মাছ ধরতে গিয়ে কখনও কখনও ধরা পড়ে কামটের কামড়ে ৷ ধারাল ক্ষুর দিয়ে কাটার মতই জলের তলায় নিঃসাড়ে পা কেটে নিয়ে যায় হাঙর, স্থানীয় মানুষেরা যাকে বলে কামট। এর পর কেউ কেউ পা হারিয়ে জান বাঁচায়, কেউ কেউ মারা যায় অবিরাম রক্তক্ষরণে। কাছাকাছি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে রক্ত নেই, তাই কামটের কামড়ের পর মৃত্যুটাই এখানে স্বাভাবিক। যদিও কামটে কামড়ের ঘটনা এখানে আকছারই ঘটছে, কিন্তু তবুও সরকার পরম উদাসীন। আর স্থানীয় মানুষগুলো ? না, ওরা কোনও দাবি তোলে না, অভিযোগহীন এই মানুষগুলো ভাগ্যের হাতেই ছেড়ে দিয়েছে নিজেদের জীবন।

একই ঘটনার পুররাবৃত্তি ঘটে সাপে কাটা রোগীদের ক্ষেত্রে। প্রতি বছরই সাপের কামড়ে মারা যায় এ অঞ্চলের বহু মানুষ। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে সাপে কাটা রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয ইনজেকশন না থাকায় মানুষগুলো বাধ্য হয়েই শেষ চেষ্টা করতে ওঝা-গুণিনদের স্মরণাপন্ন হয়। বিষাক্ত সাপ ঠিক মত বিষ ঢাললে তাকে বাঁচানোর সাধ্য ওঝা, গুণিনের হয় না। রোগী মরে । দারিদ্র্যের নগ্ন লাঞ্ছনায় যে পড়া মানুষগুলো ‘জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে সবই ভাগ্যের লিখন’, ধরে নিয়ে ক্ষোভের পরিবর্তে শোক পালন করে ।

হিঙ্গলগঞ্জের মাস্টারমশাই শশাংঙ্ক মণ্ডল ক্ষোভের সঙ্গেই জানিয়েছিলেন, “সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণে সরকার যত সচেষ্ট, মানুষ সংরক্ষণে তার এক শতাংশ চিন্তাও সরকারের নেই।”

সত্যিই নেই। বাঘ পুষতে, তাদের সময়মত খাবার জোটাতে কত পরিকল্পনা, কত অফিস, কত কর্মচারী। আর মানুষগুলোর জন্যে? সুন্দরবনের হত-দরিদ্র ক্ষুধার্ত জেলে, মৈলে ও বাউলেরা জঙ্গলে যায় বাঁচতে। এর জন্য বন দপ্তরের পাশ নিতে হয়। কাঠ কাটা: ও মধু সংগ্রহের জন্য পাশ। তারপর এবং অনেকেই বাঁচতে পারে না বাঘের থাবা থেকে। গোসাবা, কাটাখালি গ্রামে এমন একটি পরিবার পাওয়া যাবে না, যে পরিবার থেকে কেউ বাঘের পেটে যায়নি ।

বাঘের থাবা থেকে যারা বেঁচে ফেরে তাদের জন্য থাবা মেলে বসে থাকে সুন্দরবনের ডাকাত ও মহাজনরা।

গোসাবার ফতেমা বিবি যৌবনে তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন বাঘের থাবার তলায়। সব: হারিয়েও ফতেমা বিবির চোখ শশাংঙ্ক মাস্টারের মতন জ্বলে ওঠে না ক্ষোভে ৷ কপাল চাপড়ে নিজের ভাগ্যকেই দোষে ।

ভয়ংকর দারিদ্র্যে নুয়ে পড়া মানুষগুলো পেটে পান্তা, পরনে ত্যানা আর মাথা গোঁজার মতন একটা অন্ধকারময় ঝুপড়ি পেলেই বর্তে যায়। ‘শিক্ষালাভের অধিকার’, ‘চিকিৎসালাভের অধিকার’ কথাগুলো ওদের কাছে অর্থহীন বিলাসিতা মাত্র। বঞ্চনার জন্য ওরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে না। অধিকার ছিনিয়ে নিতে ওদের চোখ বাঘের মতন ভয়ংকর হয়ে জ্বলে ওঠে না। বঞ্চিত মানুষগুলো প্রতিটি বঞ্চনার জন্য নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে বিলাপ করে, চোখের জল ফেলে।

এইসব বঞ্চিত মানুষগুলো অদৃষ্টবাদী হয়েছে অজ্ঞতা থেকে। সমাজে তাদের অধিকারের সীমা না জানায় আর্থিক পরিবেশ বা আর্থসামাজিক পরিবেশই কিন্তু এই দারিদ্র্য ও সেই কারণে অজ্ঞতার জন্য দায়ী।

error: Content is protected !!