ইদরিশ বলল, ভাইজান ভাল কইরা দেহেন। এর নাম অচিন বৃক্ষ।
বলেই থু করে আমার পায়ের কাছে এক দলা থু থু ফেলল। লোকটির কুৎসিৎ অভ্যাস, প্রতিটি বাক্য দু’বার করে বলে। দ্বিতীয়বার বলার আগে একদলা থু থু ফেলে।
ভাইজান ভাল কইরা দেহেন, এর নাম অচিন বৃক্ষ।
অচিন পাখির কথা গানের মধ্যে প্রায়ই থাকে, আমি অচিন বৃক্ষের কথা এই প্রথম শুনলাম এবং দেখলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে এরা সবাই বৃক্ষ শব্দটা উচ্চারণ করছে শুদ্ধভাবে। তৎসম শব্দের উচ্চারণে কোন গন্ডগোল হচ্ছে না। অচিন বৃক্ষ না বলে অচিন গাছও বলতে পারত, তা বলছে না। সম্ভবত গাছ বললে এর মর্যাদা পুরোপুরি রক্ষিত হয় না।
ইদরিশ বলল, ভাল কইরা দেহেন ভাইজান, ত্রিভুবনে এই বৃক্ষ নাই।
তাই না-কি?
জ্বে। ত্রিভুবনে নাই।
ত্রিভুবনে এই গাছ নাই শুনেও আমি তেমন চমৎকৃত হলাম না। গ্রামের মানুষদের কাছে ত্রিভুবন জায়গাটা খুব বিশাল নয়। এদের ত্রিভুবন হচ্ছে আশে পাশের আট দশটা গ্রাম। হয়ত আশে পাশে এরকম গাছ নেই।
কেমন দেখতাছেন ভাইজান?
ভাল।
এই রকম গাছ আগে কোন দিন দেখছেন?
না।
ইদরিশ বড়ই খুশী হল। থু করে বড় একদলা থু থু ফেলে খুশীর প্রকাশ ঘটাল।
বড়ই আচানক, কি বলেন ভাইজান?
আচানক তো বটেই।
ইদরিশ এবার হেসে ফেলল। পান খাওয়া লাল দাঁত প্রায় সব ক’টা বের হয়ে এল। আমি মনে মনে বললাম, কী যন্ত্রণা! এই অচিন বৃক্ষ দেখার জন্যে আমাকে মাইলের উপরে হাঁটতে হয়েছে। বর্ষা কবলিত গ্রামের দু’মাইল হাঁটা যে কি জিনিস, যারা কোনদিন হাঁটেন নি তারা বুঝতে পারবেন না। জুতা খুলে খালি পায়ে হাঁটতে হয়েছে। হুক ওয়ার্মের জীবাণু যে শরীরে ঢুকে গেছে সে বিষয়ে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত।
গাছটা দেখতাছেন কেমন কন দেহি ভাইজান?
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। এরা শুধু গাছ দেখিয়ে খুশী নয়, প্রশংসা সূচক কিছুও শুনতে চায়। আমি কোন বৃক্ষ প্রেমিক নই। সব গাছ আমার কাছে এক রকম মনে হয়। আশে পাশের মানুষদেরই আমি চিনি না, গাছ চিনব কি করে? মানুষজন তাও কথা বলে নিজেদের পরিচিত করার চেষ্টা করে। গাছেরা তেমন কিছুই করে না।
অচিন বৃক্ষ কেমন দেখলেন ভাইজান?
আমি ভাল করে দেখলাম। মাঝারি সাইজের কাঁঠাল গাছের মত উঁচু। পাতাগুলি তেঁতুল গাছের পাতার মত ছোট ছোট। গাছের কাণ্ড পাইন গাছের কাণ্ডের মত মসৃণ। গাছ প্রসঙ্গে কিছু না বললে ভাল দেখায় না বলেই বললাম, ফুল হয়?
ইদরিশ কথা বলার আগেই, পাশে দাঁড়ানো রোগা লোকটা বলল, জ্বে না–ফুল ফুটনের ‘টাইম’ হয় নাই। ‘টাইম’ হইলেই ফুটবে। এই গাছে ফুল আসতে মেলা ‘টাইম’ লাগে।
বয়স কত এই গাছের?
তা ধরেন দুই হাজারের কম না। বেশীও হইতে পারে।
বলেই লোকটা সমর্থনের আশায় চারিদিকে তাকাল। উপস্থিত জনতা অতি দ্রুত মাথা নাড়তে লাগল। যেন এই সময়ে কারো মনেই সন্দেহের লেশ মাত্র নেই। আমি অত্যন্ত বিরক্ত হলাম। গ্রামের লোকজন কথাবর্তা বলার সময় তাল ঠিক রাখতে পারে না। হুট করে বলে দিল দু’হাজার বছর। আর তাতেই সবাই কেমন মাথা নাড়ছে। আমি ইদরিশের দিকে তাকিয়ে বললাম, ইদরিশ মিয়া, গাছ তো দেখা হল, চল যাওয়া যাক।
আমার কথায় মনে হল সবাই খুব অবাক হচ্ছে।
ইদরিশ হতভম্ব গলায় বলল, এখন যাইবেন কি? গাছ তো দেখাই হইল না। তার উপরে, মাষ্টার সাবরে খবর দেওয়া হইছে। আসতাছে।
আমার চারপাশে সতেরো আঠারোজন মানুষ আর একপাল উলঙ্গ শিশু। অচিন বৃক্ষের লাগোয়া বাড়ি থেকে বৌ-ঝিরা উকি দিচ্ছে। একজন এককাদী ডাব পেড়ে নিয়ে এল। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, কালো রঙের বিশাল একটা চেয়ারও একজন মাথায় করে আনছে। এই গ্রামের এটাই হয়ত একমাত্র চেয়ার। অচিন বৃক্ষ যারা দেখতে আসেন তাদের সবাইকে এই চেয়ারে বসতে হয়।
অচিন বৃক্ষের নীচে চেয়ার পাতা হল। আমি বসলাম। একজন কে হাত পাখা দিয়ে আমাকে প্রবল বেগে হাওয়া করতে লাগল। স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলের হেডমাষ্টার সাহেব চলে এলেন। বয়স অল্প, তবে অল্প বয়সেই গাল টাল ভেঙ্গে একাকার। দেখেই মনে হয় জীবন যুদ্ধে পরাজিত একজন মানুষ। বেঁচে থাকতে হয় বলেই বেঁচে আছে। ছাত্র পড়াচ্ছেন। হেডমাষ্টার সাহেবের নাম মুহম্মদ কুদুস। তাঁর সম্ভবত হাঁপানি আছে। বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছেন। নিজেকে সামলে কথা বলতে অনেক সময় লাগল।
স্যারের কি শইল ভাল?
জ্বি ভাল।
আসতে একটু দেরি হইল। মনে কিছু নিবেন না স্যার।
না মনে কিছু নিচ্ছি না।
বিশিষ্ট লোকজন শহর থাইক্যা অচিন বৃক্ষ দেখতে আসে-বড় ভাল লাগে। বিশিষ্ট লোকজনের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়।
আপনি ভুল করছেন ভাই। আমি বিশিষ্ট কেউ নই।
এই তোমরা স্যারকে হাত পা ধোয়ার পানি দেও নাই, বিষয় কি?
হাত পা ধুয়ে কি হবে? আবার তো কাদা ভাঙতেই হবে।
হেডমাষ্টার সাহেব অত্যন্ত বিস্মিত হলেন, খাওয়া দাওয়া করবেন না? আমার বাড়িতে পাক-শাক হইতেছে। চাইরটা ডাল-ভাত, বিশেষ কিছু নয়। গেরাম দেশে কিছু জোগাড় যন্ত্রও করা যায় না। বিশিষ্ট মেহমানরা আসেন। গত বৎসর ময়মনসিংহের এ ডি সি সাহেব আসছিলেন। এডিসি রেভিন। বিশিষ্ট ভদ্রলোক। অচিন বৃক্ষের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে এক হাজার টাকা দেওয়ার ওয়াদা করলেন।
তাই নাকি? এর জ্বি। অবশ্যি টাকা এখনো পাওয়া যায় নাই। এরা কাজের মানুষ। নানান কাজের চাপে ভুলে গেছেন আর কি। আমাদের মত ত না যে কাজ কর্ম কিছু নাই! এদের শতেক কাজ। তবু ভাবতেছি একটা পত্র দিব। আপনে কি বলেন?
দিন। চিঠি দিয়ে মনে করিয়ে দিন।
আবার বিরক্ত হন কিনা কে জানে। এরা কাজের মানুষ, চিঠি দিয়ে বিরক্ত করাও ঠিক না। এই চায়ের কি হইল?
চা হচ্ছে নাকি?
জ্বি, বানাতে বলে এসেছি। চায়ের ব্যবস্থা আমার বাড়িতে আছে। মাঝে মধ্যে হয়। বিশিষ্ট মেহমানরা আসেন। এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির এক প্রফেসার সাহেব এসেছিলেন–বিরাট জ্ঞানী লোক। এদের দেখা পাওয়া তো ভাগ্যের কথা, কি বলেন স্যার?
তা তো বটেই।
চা চলে এল।
চা খেতে খেতে এই গ্রামের অচিন বৃক্ষ কী করে এল সেই গল্প হেডমাষ্টার সাহেবের কাছে শুনলাম। এক ডাইনী না-কি এই গাছের উপর ‘সোয়ার’ হয়ে আকাশ পথে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার পানির পিপাসা হয়। এইখানে সে নামে। পানি খেয়ে তৃষ্ণা নিবারিত করে। পানি ছিল বড়ই মিঠা। ডাইনী তখন সন্তুষ্ট হয়ে গ্রামের লোকদের বলে–তোমাদের মিঠা পানি খেয়েছি তার প্রতিদানে এই গাছ দিয়ে গেলাম। গাছটা যত্ন করে রাখবে। অনেক অনেক দিন পরে গাছে ফুল ধরবে। তখন তোমাদের দুঃখ থাকবে না। এই গাছের ফুল সর্বরোগের মহৌষধ। একদিন উপাস থেকে খালি পেটে এই ফুল খেলেই হবে।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, আপনি এই গল্প বিশ্বাস করেন?
হেডমাষ্টার সাহেব অবাক হয়ে বললেন, বিশ্বাস করব না কেন? বিশ্বাস না। করার তো কিছু নাই।
যে যুগে মানুষ চাঁদে হাঁটাহাটি করছে সেই যুগে আপনি বিশ্বাস করছেন গাছে। চড়ে ডাইনী এসেছিল?
জগতে অনেক আচানক ব্যাপার হয় জনাব। যেমন ধরেন ব্যাঙের মাথায় মণি। যে মণি সাত রাজার ধন। অন্ধকার রাতে ব্যাঙ এই মণি শরীর থেকে বের করে। তখন চারদিক আলো হয়ে যায়। আলো দেখে পোকারা আসে। ব্যাঙ সেই পোকা ধরে ধরে খায়।
আপনি ব্যাঙের মণি দেখেছেন?
জ্বি জনাব। নিজের চোখে দেখা। আমি তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র।
আমি চুপ করে গেলাম। যিনি ব্যাঙের মণি নিজে দেখেছেন বলে দাবী করেন তাঁর সঙ্গে কুসংস্কার নিয়ে তর্ক করা বৃথা। তাছাড়া দেখা গেল ব্যাঙের মণি তিনি একাই দেখেন নি–‘আমার আশে পাশে যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের অনেকেও দেখেছে।
দুপুরে হেডমাষ্টার সাহেবের বাসাতে খেতে গেলাম। আমি এবং ইদরিশ। হেডমাষ্টার সাহেবের হত দরিদ্র অবস্থা দেখে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। প্রাইমারী স্কুলের একজন হেডমাষ্টার সাহেবের যদি এই দশা হয় তখন অন্যদের না জানি কি অবস্থা। অথচ এর মধ্যেই পোলাও রান্না হয়েছে। মুরগীর কোরমা করা হয়েছে। দরিদ্র মানুষটির অনেকগুলি টাকা বের হয়ে গেছে এই বাবদে।
আপনি এসেছেন বড় ভাল লাগতেছে। অজ পাড়াগায়ে থাকি। দু একটা জ্ঞানের কথা নিয়ে যে আলাপ করব সেই সুবিধা নাই। চারদিকে মূর্খের দল। অচিন বৃক্ষ থাকায় আপনাদের মত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আসেন। বড় ভাল লাগে। কিছু জ্ঞানের কথা শুনতে পারি।
বেচারা জ্ঞানের কথা শুনতে চায়। কোন জ্ঞানের কথাই আমার মনে এল না। আমি বললাম, রান্না তো চমৎকার হয়েছে। কে বেঁধেছে আপনার স্ত্রী?
জি না জনাব। আমার কনিষ্ট ভগ্নি। আমার স্ত্রী খুবই অসুস্থ। দীর্ঘ দিন শয্যাশায়ী।
সে-কি?
হার্টের ভাল্বের সমস্যা। ঢাকা নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তাররা বলেছেন, লাখ দুই টাকা খরচ করলে একটা কিছু করা যাবে। কোথায় পাব এত টাকা বলেন দেখি।
আমি চুপ করে গেলাম।
হেড মাষ্টার সাহেব সহজ ভঙ্গিতে বললেন, আপনি যখন আসছেন আমার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করিয়ে দিব। সে শহরের মেয়ে। মেট্রিক পাশ।
তাই না-কি?
জ্বি। মেট্রিক ফার্স্ট ডিভিশন ছিল। টোটেল মার্ক ছয়শ এগারো। জেনারেল অংকে পেয়েছে ছিয়াত্তর। আর চারটা নম্বর হলে লেটার হত।
হেড মাষ্টার সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।
ওর আবার লেখালেখির শখ আছে।
বলেন কি?
শরীরটা যখন ভাল ছিল তখন কবিতা লিখত। তা এই মূখের জায়গায় কবিতার মত জিনিস কে বুঝবে বলেন? আপনি আসছেন দু’একটা পড়ে দেখবেন।
জ্বি নিশ্চয়ই পড়ব।
মহসিন সাহেব বলে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন, তিনি একটি কবিতার কপি করে নিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন অনেক পত্রিকায় সাথে তাঁর যোগাযোগ আছে ছাপিয়ে দিবেন।
ছাপা হয়েছে?
হয়েছে নিশ্চয়ই। কবিতাটা ভাল ছিল, নদীর উপরে লেখা। পত্রিকা টত্রিকা তো এখানে কিছু আসে না। জনার উপায় নাই। একটা পত্রিকা পড়তে হলে যেতে হয় মশাখালির বাজার। চিন্তা করেন অবস্থা। শেখ সাহেবের মৃত্যুর খবর পেয়েছি দু’দিন পরে, বুঝলেন অবস্থা।
অবস্থা তো খারাপ বলেই মনে হচ্ছে।
তাও অচিন বৃক্ষ থাকায় দুনিয়ার সাথে একটা যোগাযোগ আছে। আসেন ভাইসাব, আমার স্ত্রীর সঙ্গে একটু কথা বলেন। সে শহরের মেয়ে। ময়মনসিংহ শহরে পড়াশোনা করেছে।
আমি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। অপরিচিত অসুস্থ একজন মহিলার সঙ্গে আমি কী কথা বলব? ব্যাপার দেখে মনে হচ্ছে অচিন বৃক্ষ দেখতে যারা আসেন তাঁদের সবাইকে এই মহিলার সঙ্গেও দেখা করতে হয়।
মহিলার সঙ্গে দেখা হল।
মহিলা না বলে মেয়ে বলাই উচিত। উনিশ কুড়ির বেশী বয়স হবে না। বিছানার সঙ্গে মিশে আছে। মানুষ নয় যেন মিশরের মমি। বিশিষ্ট অথিতিকে দেখে তার মধ্যে কোন প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা গেল না। তবে বিড় বিড় করে কী যেন বলল। হেডমাষ্টার সাহেব তার মুখের কাছে ঝুঁকে পড়লেন। পরক্ষণেই হাসি মুখে বললেন–আপনাকে সালাম দিচ্ছে।
আমি ক বলব ভেবে পেলাম না। কিছু একটা বলতে হয় অথচ বলার মত কিছু পাচ্ছি না। মেয়েটি আবার বিড় বিড় করে কী যেন বলল, হেডমাষ্টার সাহেব বললেন-রেনু বলছে আপনার খাওয়া দাওয়ার খুব কষ্ট হল। ওর কথা আর কেউ বুঝতে পারে না। আমি পারি।
আমি বললাম, চিকিৎসা হচ্ছে তো? না-কি এম্নি রেখে দিয়েছেন?
হেডমাষ্টার সাহেব এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। মেয়েটি বিড় বিড় করে আবারো কী যেন বলল। হেডমাষ্টার সাহেব বুঝিয়ে দিলেন-ও জিজ্ঞেস করছে অচিন বৃক্ষ দেখে খুশী হয়েছেন কি-না।
আমি বললাম হয়েছি। খুব খুশী হয়েছি।
মেয়েটি বলল, ফুল ফুটলে আরেকবার আসবেন। ঠিকানা দিয়ে যান। ফুল ফুটলে আপনাকে চিঠি লিখবে।
মেয়েটি এই কথাগুলি বেশ স্পষ্ট করে বলল, আমার বুঝতে কোন অসুবিধা হল না। আমি বললাম, আপনি বিশ্রাম করুন, আমি যাই।
হেডমাষ্টার সাহেব আমাকে এগিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন। আমি রাজী হলাম না। এই ভদ্রলোকের এখন উচিত তার স্ত্রীর কাছে থাকা। যত বেশী সময় সে তার স্ত্রীর পাশে থাকবে ততই মঙ্গল। এই মেয়েটির দিনের আলো যে নিভে এসেছে তা যে কেউ বলে দিতে পারে।
আমি এবং ইদরিশ ফিরে যাচ্ছি।
আসার সময় যতটা কষ্ট হয়েছিল ফেরার সময় ততটা হচ্ছে না। আকাশে মেঘ করায় রোদের হাত থেকে রক্ষা হয়েছে। তার উপর ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে। ইদরিশের সঙ্গে গল্প করতে করতে এগুচ্ছি।
আমি বললাম, হেডমাষ্টার সাহেব তার স্ত্রীর চিকিৎসা করাচ্ছে না?
করাইতাছে। বিষয় সম্পত্তি যা ছিল সব গেছে পরিবারের পিছনে। অখন বাড়ি ভিটা পর্যন্ত বন্দক।
তাই না-কি?
জ্বি। এই মানুষটা পরিবারের জন্যে পাগল। সারা রাইত ঘুমায় না। স্ত্রীর ধারে বইস্যা থাকে। আর দিনের মধ্যে দশটা চক্কর দেয় অচিন বৃক্ষের কাছে।
কেন?
ফুল ফুটেছে কি না দেখে। অচিন বৃক্ষের ফুল হইল অখন শেষ ভরসা।
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম।
খেয়া ঘাটের সামনে এসে আমাকে থমকে দাঁড়াতে হল। দেখা গেল হেডমাষ্টার সাহেব ছুটতে ছুটতে আসছেন। ছুটে আসা জনিত পরিশ্রমে খুবই কাহিল হয়ে পড়া একজন মানুষ যার সারা শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। ছুটে আসার কারণ হচ্ছে স্ত্রীর কবিতার খাতা আমাকে দেখাতে ভুলে গিয়েছিলেন। মনে পড়ায় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন।
আমরা একটা অশ্বথ গাছের ছায়ার নীচে বসলাম। হেডমাষ্টার সাহেবকে খুশী করার জন্যেই দু’নম্বরী খাতার প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত পড়ে বললাম, খুব ভাল হয়েছে।
হেডমাষ্টার সাহেবের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বললেন–এখন আর কিছু লিখতে পারে না। শরীরটা বেশী খারাপ।
আমি বললাম, শরীর ভাল হলে আবার লিখবেন।
হেডমাষ্টার সাহেব বললেন, আমিও রেনুরে সেইটাই বলি–অচিন বৃক্ষের ফুল। ফুটারও বেশী বাকি নাই। ফুল ফুটার আগে পচা শ্যাওলার গন্ধ ছাড়ার কথা। গাছ। সেই গন্ধ ছাড়া শুরু করেছে। আর কেউ সেই গন্ধ পায় না। আমি পাই।
আমি গভীর মমতায় ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
তিনি ইতস্তত করে বললেন, প্রথম কবিতাটা আরেকবার পড়েন স্যার। প্রথম কবিতাটার একটা ইতিহাস আছে।
কী ইতিহাস?
হেডমাষ্টার সাহেব লাজুল গলায় বললেন, রেনুকে আমি তখন প্রাইভেট পড়াই। একদিন বাড়ির কাজ দিয়েছি। বাড়ির কাজের খাতা আমার হাতে দিয়ে দৌড় দিয়া পালাইল। আর তো আসে না। খাতা খুইল্যা দেখি কবিতা। আমারে নিয়া লেখা। কী সর্বনাশ বলেন দেখি। যদি এই খাতা অন্যের হাতে পড়ত, কি অবস্থা হইত বলেন?
অন্যের হাতে পড়বে কেন? বুদ্ধিমতী মেয়ে, সে দিবে আপনার হাতেই।
তা ঠিক। রেনুর বুদ্ধির কোন মা-বাপ নাই। কি বুদ্ধি কি বুদ্ধি। তার বাপ মা বিয়ে ঠিক করল–ছেলে পূবালী ব্যাংকের অফিসার। চেহারা সুরত ভাল। ভাল বংশ। পান চিনি হয়ে গেল। রেনু চুপ করে রইল। তারপর একদিন তার মারে গভীর রাতে ঘুম থেকে ডেকে বলল, মা তুমি আমারে বিষ জোগাড় কইরা দেও। আমি বিষ খাব। রেনুর মা বললেন, কেন? রেনু বলল–আমার পেটে সন্তান আছে মা। কতবড় মিথ্যা কথা, কিন্তু বলল ঠাণ্ডা গলায়। ঐ বিয়ে ভেঙ্গে গেল। রেনুর মা-বাবা তাড়াহুড়া করে আমার সঙ্গে বিয়ে দিলেন। নিজের ঘরের কথা আপনাকে বলে ফেললাম, আপনি স্যার মনে কিছু নিবেন না।
না–আমি কিছু মনে করি নি।
সবাইরেই বলি। বলতে ভাল লাগে।
হেডমাষ্টারের চোখ চক চক করতে লাগল। আমি বললাম, আপনি ভাববেন না। আপনার স্ত্রী আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন।
তিনি জড়ালো গলায় বললেন, একটু দোয়া করবেন স্যার। ফুলটা যেন তাড়াতাড়ি ফুটে।
পড়ন্ত বেলায় খেয়া নৌকায় উঠলাম। হেডমাষ্টার সাহেব মূর্তির মত ওপারে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যেই এক ধরনের প্রতীক্ষার ভঙ্গি আছে। সেই প্রতীক্ষা অচিন বৃক্ষের অচিন ফুলের জন্যে। যে প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছে হতদারিদ্র গ্রামের অন্যসব মানুষরাও। এবং কী আশ্চর্য, আমার মত কঠিন নাস্তিকের মধ্যেও সেই প্রতীক্ষার ছায়া। নদী পার হতে হতে আমার কেবলি মনে হচ্ছে-আহা ফুটুক। অচিন বৃক্ষে একটি ফুল হলেও ফুটুক। কত রহস্যময় ঘটনাই তো এ পৃথিবীতে ঘটে। তার সঙ্গে যুক্ত হউক আরো একটি।
হেডমাষ্টার সাহেবও পাড়ে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন। তার হাতে হাতীর ছবি আঁকা দু’নম্বরী একটা কবিতার খাতা। দূর থেকে কেন জানি তাঁকে অচিন বৃক্ষের মত লাগছে। হাতগুলি যেন অচিন বৃক্ষের শাখা। বাতাস পেয়ে দুলছে।
“অয়োময়” গল্প সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ