শ্লোকঃ ২৮

বেদেষু যজ্ঞেষু তপঃসু চৈব

দানেষু যৎ পুণ্যফলং প্রদিষ্টম্ ।

অত্যেতি তৎ সর্বমিদং বিদিত্বা

যোগী পরং স্থানমুপৈতি চাদ্যম্ ॥ ২৮ ॥

বেদেষু বেদ পাঠে, যজ্ঞেষু — যজ্ঞানুষ্ঠানে, তপঃসু – তপস্যায়, চ–ও; এব অবশ্যই; দানেষুদানে; যৎ – যে, পুণ্যফলম্ — পুণ্যকল, প্রদিষ্টস্—নির্দেশিত হয়েছে, অত্যেতি — অতিক্রম করে, তং সর্ব— সেই সমস্ত; ইদম্—এই, বিদিত্বা- জেনে; যোগী — ভক্ত; পরা — পরম স্থানম্ — স্থান; উপেতি-প্রাপ্ত হন; চ–ও; আদ্যম— আদি।

গীতার গান

বেদাদি শাস্ত্রেতে যাহা,     যজ্ঞ তপ দান তাহা,

পুণ্যফল যাহা সে প্রদিষ্ট ৷

সে যোগ যে অবলম্বে,     পায় তাহা অবিলম্বে,

সম্যক বুঝিয়া নিজ ইষ্ট।।

অনুবাদঃ ভক্তিযোগ অবলম্বন করলে তুমি কোন ফলেই বঞ্চিত হবে না। বেদপাঠ, যজ্ঞ অনুষ্ঠান, তপস্যা, দান আদি যত প্রকার জ্ঞান ও কর্ম আছে, সেই সমুদয়ের যে ফল, তা তুমি ভক্তিযোগ দ্বারা লাভ করে আদি ও পরম ধাম প্রাপ্ত হও।

তাৎপর্যঃ এই শ্লোকটি কৃষ্ণভাবনামৃত ও ভক্তিযোগের বিশেষ বর্ণনা সমন্বিত সপ্তম ও অষ্টম অধ্যায়ের সারমর্ম। শ্রীগুরুদেবের তত্ত্বাবধানে বেদ অধ্যয়ন ও তপশ্চর্যার অনুশীলন করা অত্যন্ত আবশ্যক। বৈদিক প্রথা অনুসারে ব্রহ্মাচারীকে গুরুগৃহে থেকে অনুগত ভূত্যের মতো গুরুদেবের সেবা করতে হয় এবং তাকে গুরুদেবের জন্য দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করতে হয়। শ্রীগুরুদেবের আজ্ঞানুসারেই কেবল সে ভোজন করে, এবং যদি কোনদিন গুরুদেব তাকে ভোজনে না ডাকেন, তা হলে সেই দিন সে উপবাসী থাকে। এগুলি ব্রহ্মচর্য-রাতের কয়েকটি বৈদিক সিদ্ধান্ত।

পাঁচ বৎসর থেকে কুড়ি বৎসর পর্যন্ত গুরুর তত্ত্বাবধানে বেদ অধ্যয়ন করার পর ব্রহ্মচারী শিক্ষার্থী পরম চরিত্রবান মানুষ হতে সক্ষম হন। বেদ অধ্যয়ন করার উদ্দেশ্য আরাম কেদারায় উপরেশনরত মনোধর্মীদের মনোরঞ্জন করা নয়, তার উদ্দেশ্য চরিত্র গঠন করা। এই প্রশিক্ষণের পরে ব্রহ্মচারী গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ করে বিবাহ করতে পারেন। গৃহস্থাশ্রমেও তাঁকে নানা রকম যজ্ঞানুষ্ঠান করতে হয়, যাতে তিনি অধিকতর সিদ্ধি লাভের উদ্দেশ্যে পরমার্থ সাধনে সচেষ্ট হন। ভগবদ্গীতার বর্ণনা অনুযায়ী দেশ, কাল ও পাত্র বিচারে এবং সত্ত্ব, রজ ও তমোগুণের পার্থক্য নির্ণয় করে যথোপযুক্তভাবে দানধ্যান করাও তাঁর অবশ্য কর্তব্য। তারপর গৃহস্থাশ্রম থেকে নিবৃত্ত হয়ে বানপ্রস্থ গ্রহণ করে বনবাসী হয়ে বন্ধল ধারণ করে ক্ষৌরকর্ম পরিহার করে তাকে নানা রকম তপশ্চর্যার অনুশীলন করতে হয়। এভাবেই সহ্মচর্য, গার্হস্থা, বানপ্রস্থ এবং সবশেষে সন্ন্যাস আশ্রমের বিধি-বিধান পালন করে জীবনের পরম সিদ্ধির স্তরে উন্নীত হতে হয়। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ স্বৰ্গলোকে উন্নীত হন এবং তার পরে আরও উন্নতি সাধন করার পরে পরব্যোমে নির্বিশেষ ব্রহ্মজ্যোতি অথবা বৈকুণ্ঠলোকে বা কৃষ্ণলোকে পরম মুক্তি লাভ করেন। বৈদিক সাহিত্যে এই পথের দিগ্‌দর্শন দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু কৃষ্ণভাবনামৃতের সৌন্দর্য এতই অনুপম যে, কেবল ভগবানকে ভক্তি করার একটিমাত্র সাধনার মাধ্যমেই এই সমস্ত আশ্রম এবং বৈদিক কর্মকাণ্ডের সমস্ত আচার অনুষ্ঠান অতিক্রম করা যায়।

ইদং বিদিত্বা শব্দ দুটির দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, ভগবদ্গীতার এই অধ্যায় ও সপ্তম অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ যে উপদেশ দিয়েছেন, তা পুঁথিগত বিদ্যা বা জল্পনা- কল্পনার মাধ্যমে বোঝবার চেষ্টা করা উচিত নয়। পক্ষান্তরে, শুদ্ধ ভক্তের সঙ্গ লাভ করে তাঁর কাছ থেকে এর তত্ত্ব শ্রবণের মাধ্যমে হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করা উচিত। সপ্তম অধ্যায় থেকে শুরু করে দ্বাদশ অধ্যায় পর্যন্ত ভগবদ্‌গীতার সারমর্ম ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রথম ছয়টি অধ্যায় এবং শেষের ছয়টি অধ্যায় যেন মাঝের ছয়টি অধ্যায়কে আবৃত করে রেখেছে— যেগুলি বিশেষভাবে স্বয়ং পরমেশ্বর দ্বারা সংরক্ষিত হয়েছে। যদি কোন ভাগ্যবান ভক্তসঙ্গে ভগবদ্‌গীতার, বিশেষ করে মারাখানের এই ছয়টি অধ্যায়ের তত্ত্ব যথার্থভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন, তা হলে তার জীবন সমস্ত তপ, যজ্ঞ, দান, ধ্যান, মনোধর্ম আদির ঊর্ধ্বে দিবা কীর্তির দ্বারা গৌরবান্বিত হয়, কেন না শুধুমাত্র কৃষ্ণভাবনার মাধ্যমেই তিনি এই সব রকম কর্মেরই সুফল অর্জন করতে পারেন।

ভগবদ্গীতার প্রতি যাঁর কিছুমাত্র বিশ্বাস আছে, তাঁর পক্ষে কোনও ভক্তজনের কাছ থেকেই ভগবদ্গীতার শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। কারণ, চতুর্থ অধ্যায়ের প্রারম্ভেই স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, ভগবদ্গীতার তত্ত্বজ্ঞান কেবল ভক্তজনই উপলব্ধি করতে পারেন, অন্য কেউ যথাযথভাবে ভগবদ্গীতার উদ্দেশ্য বুঝতে পারে না। সুতরাং, মনোধর্মীদের কাছ থেকে ভগবদ্গীতার ব্যাখ্যা না শুনে কোনও কৃষ্ণভক্তের কাছে তা শোনা উচিত। এটিই হচ্ছে শ্রদ্ধার লক্ষণ। কেউ যখন কোনও ভক্তের সন্ধান করতে থাকে এবং অবশেষে ভক্তের সান্নিধ্য লাভ করতে সক্ষম হয়, তখনই তার পক্ষে যথাযথভাবে ভগবদ্গীতার অধ্যয়ন ও উপলব্ধির সার্থক প্রচেষ্টার সূচনা হয়। সাধুসঙ্গের প্রভাবেই ভগবৎ-সেবায় প্রবৃত্তি জন্মায়। এই ভগবৎ-সেবার ফলে শ্রীকৃষ্ণের নাম, রূপ, লীলা, পরিকর আদি হৃদয়ে স্ফুরিত হয় এবং এই সকল বিষয়ে সমস্ত সংশয় সম্পূর্ণরূপে দূর হয়। এভাবেই সমস্ত সংশয় দূর হলে অধ্যয়নে মনোনিবেশ হয় তখন ভগবদ্‌গীতা অধ্যয়ন করে আস্বাদন করা যায় এবং কৃষ্ণভাবনার প্রতি অনুরাগ ও ভাবের উদয় হয়। আরও উন্নত স্তরে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি পূর্ণ প্রেমানুরাগের উদয় হয়। এই পরম সিদ্ধির স্তরে ভক্ত চিদাকাশে অবস্থিত শ্রীকৃষ্ণের ধাম গোলোক বৃন্দাবনে প্রবিষ্ট হন, যেখানে তিনি চিন্ময় শাশ্বত অনন্দ লাভ করেন।

ভক্তিবেদান্ত কহে শ্রীগীতার গান ।

শুনে যদি শুদ্ধ ভক্ত কৃষ্ণগত প্ৰাণ ৷।

ইতি—পরমতত্ত্ব লাভ বিষয়ক ‘অক্ষরব্রহ্মযোগ’ নামক শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার অষ্টম অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।

error: Content is protected !!