শ্লোকঃ ২৫
ধূমো রাত্রিস্তথা কৃষ্ণঃ ষণ্মাসা দক্ষিণায়নম্ ।
তত্র চান্দ্রমসং জ্যোতির্যোগী প্রাপ্য নিবর্ততে ৷। ২৫ ।৷
ধূমঃ—ধূম: রাত্রিঃ-রাত্রি, তথা–; কৃষ্ণঃ – কৃষ্ণপক্ষ, যক্ষ্মাসাঃ — ছয় মাস দক্ষিণায়ন – দক্ষিণায়ন, তত্র সেই মার্গে, চান্দ্রমসম্— চন্দ্রলোক, জ্যোতিঃ- জ্যোতি, যোগী—যোগী; প্রাণা – লাভ করে, নিবর্ততে— প্রত্যাবর্তন করেন।
গীতার গান
তারা ইষ্টাপূর্তি কর্মে রাত্রি কৃষ্ণপক্ষে ৷
ধূন বা দক্ষিণায়ন চন্দ্ৰ জ্যোতি লক্ষে ॥
মার্গ সেই আশ্রয়েতে পুনরাগমন ।
কর্মযোগী নাহি করে ব্রহ্ম নিরূপণ ॥
অনুবাদঃ ধূম, রাত্রি, কৃষ্ণপক্ষ অথবা দক্ষিণায়নের ছয় মাস কালে দেহত্যাগ করে যোগী চন্দ্রলোকে গমনপূর্বক সুখভোগ করার পর পুনরায় মর্ত্যলোকে প্রত্যাবর্তন করেন।
তাৎপর্যঃ শ্রীমদ্ভাগবতের তৃতীয় স্কন্ধে কপিল মুনি উল্লেখ করেছেন যে, পৃথিবীতে যাঁরা সকাম কর্ম ও যজ্ঞ অনুষ্ঠানে দক্ষ, তাঁরা দেহত্যাগ করার পর চন্দ্রলোকে গমন করেন। এই সমস্ত উন্নত আত্মার সেখানে দেবতাদের গণনা অনুসারে ১০,০০০ বছর বাস করেন এবং সোহারস পান করে জীবন উপভোগ করেন। কিন্তু শেষকালে এক সময় তাঁদের আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসতে হয়। এর থেকে আমরা বুঝাতে পারি যে, চন্দ্রলোকে অনেক উন্নত স্তরের জীব আছেন, যদিও তাঁরা ইন্দ্রিয়গোচর নন।
শ্লোকঃ ২৬
শুক্লকৃষ্ণে গতী হ্যেতে জগতঃ শাশ্বতে মতে ৷
একয়া যাত্যনাবৃত্তিমন্যয়াবর্ততে পুনঃ ৷৷ ২৬ ৷।
শুক্ল—শুরু; কৃষ্ণে—কৃষ্ণ, গতী – মার্গ: হি— অবশ্যই; এতে — এই দুই ভাগতঃ- জগতের; শাশ্বতে— বৈদিক, মতে— মতে, একয়া—একটির দ্বারা; যাতি—প্রাপ্ত হয়; অনাবৃত্তিম্ — অপ্রত্যাবর্তন, অন্যয়া — অন্যটির দ্বারা, আবর্ততে প্রত্যাবর্তন করে, পুনঃপুনরায়।
গীতার গান
অতএব দুই মার্গ শুক্ল কৃষ্ণ নাম ৷
শাশ্বত যে দুই পথ হই বৰ্তমান ৷।
শুক্রমার্গে যার গতি তার অনাবৃত্তি ।
কৃষ্ণমার্গে যার গতি সে আবৃত্তি ।।
অনুবাদঃ বৈদিক মতে এই জগৎ থেকে দেহত্যাগের দুটি মার্গ রয়েছে—একটি শুরু এবং অপরটি কৃষ্ণ। শুক্লমার্গে দেহত্যাগ করলে তাকে আর ফিরে আসতে হয় না, কিন্তু কৃষ্ণমার্গে দেহত্যাগ করলে ফিরে আসতে হয়।
তাৎপর্যঃ আচার্য বলদের বিদ্যাভূষণ ছান্দোগ্য উপনিষদ (৫/১০/৩৫ ) থেকে জড় জগতে গমনাগমনের এই রকমই একটি শ্লোকের বিবরণ উদ্ধৃত করেছেন। যাঁরা অনন্ত কাল ধরে দার্শনিক জ্ঞান ও সকান কর্মের অনুশীলন করে আসছেন, তাঁরা নিরন্তর গমনাগমন করছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণারবিন্দের শরণাগত হন না বলে তাঁরা যথার্থ মুক্তি লাভ করতে পারেন না।
শ্লোকঃ ২৭
নৈতে সৃতী পার্থ জানন্ যোগী মুহ্যুতি কশ্চন ৷
তস্মাৎ সর্বেষু কালেষু যোগযুক্তো ভবার্জুন ॥ ২৭ ॥
ন—না, এতে —এই দুটি, সূতী—মার্গ, পার্থ – হে পৃথাপুর, জানন্—জেনে যোগী — ভগবদ্ভক্ত: মুহাতি — মোহগ্রস্ত; কশ্চন— কোন; তস্মাৎ— অতএব সর্বেষু কালেষু –সর্বদা, যোগযুক্তঃ কৃষ্ণভাবনায় যুক্ত, ভব – হও, অর্জুন – হে অর্জুন।
গীতার গান
কিন্তু পার্থ ভক্ত মোর দুই মার্গ জানি ।
মোহপ্রাপ্ত নাহি হয় ভক্তিযোগ মানি ৷৷
অতএব হে অর্জুন! মোরে নিত্য স্মর ৷
ভক্তিযোগযুক্ত হও কভু না পাসর ৷।
অনুবাদঃ হে পার্থ ! ভক্তেরা এই দুটি মার্গ সম্বন্ধে অবগত হয়ে কখনও মোহগ্রস্ত হন না। অতএব হে অর্জুন! তুমি ভক্তিযোগ অবলম্বন কর।
তাৎপর্যঃ শ্রীকৃষ্ণ এখনে অর্জুনকে উপদেশ দিচ্ছেন যে, সংসার আগ করার জন্য জীবাত্মা এই দুটি মার্গের যে কোন একটা মার্গ গ্রহণ করতে পারে বলে তাঁর চিন্তিত হবার কোন কারণ নেই। ভগবস্তুত তাঁর প্রয়াণ ইচ্ছাকৃতভাবে হবে, না দৈবক্রমে হবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন না। ভক্তের কর্তব্য হচ্ছে সুদৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করা। তাঁর জানা উচিত যে, এই দুটি মার্গের যে কোনটিই ক্লেশকর। কৃষ্ণভাবনায় আবিষ্ট হবার শ্রেষ্ঠ পন্থা হচ্ছে সর্বদাই শ্রীকৃষ্ণের সেবায় যুক্ত হওয়া। এর ফলে ভগবৎ-ধাম প্রাপ্তির পথ নিরাপদ, নিশ্চিত ও সরল হয়। এই শ্লোকে যোগযুক্ত কথাটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। যিনি দৃঢ়তাপুর্বক যোগ অভ্যাস করেন, তিনি তাঁর সমস্ত কার্যকলাপের মাধ্যমে সর্বদাই কৃষ্ণভাবনায় যুক্ত থাকেন। শ্রীল রূপ গোস্বামীপাদের উপদেশ হচ্ছে যে, অনাসক্তস্য বিষয়ান যথার্হমুপযুঞ্জতঃ– জড় বিষয়ের প্রতি অনাসক্ত থাকতে হবে এবং সমস্ত কিছু কৃষ্ণভাবনামৃত দ্বারা পরিপূর্ণ করে তুলতে হবে। এভাবেই ‘যুক্তবৈরাগ্য’ পন্থার মাধ্যমে অতি সহজে পরম সিদ্ধি লাভ করা যায়। তাই, আত্মার গমন পথের এই সমস্ত বিবরণে ভক্ত কখনই বিচলিত হন না, কারণ তিনি জানেন। যে, ভক্তিযোগ সাধন করার ফলে তিনি অবশ্যই ভগবৎ-ধাম প্রাপ্ত হবেন।