শ্লোকঃ ২২
পুরুষঃ স পরঃ পার্থ ভক্ত্যা লভ্যস্তুনন্যয়া ।
যস্যান্তঃস্থানি ভূতানি যেন সর্বমিদং ততম্ ॥ ২২ ৷৷
পুরুষঃপরমেশ্বর ভগবান; সঃ— তিনি; পরঃ পরম, যাঁর থেকে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই; পার্থ—হে পৃথাপুত্র; ভক্ত্যা — ভগবদ্ভক্তির দ্বারা; লভ্যঃ- লাভ করা যায়; ভূ– কিন্তু; অনন্যয়া—অনন্যা; যস্য – যাঁর, অন্তঃস্থানি মধ্যে; ভূতানি — এই সমস্ত গড় প্রকাশ; যেন—যাঁর দ্বারা; সর্বম— সমস্ত; ইদম্—এই, ততম্—পরিব্যাপ্ত।
গীতার গান
পরমপুরুষ সেই নিত্য ধামে বাস ।
হে পার্থ ! অনন্য ভক্তি তাহার প্রয়াস ॥
তাঁহারই অন্তরেতে হয় সমস্ত জগত ।
অন্তর্যামী সে পুরুষ সর্বত্র বিস্তৃত ॥
অনুবাদঃ হে পার্থ। সর্বশ্রেষ্ঠ পরমেশ্বর ভগবানকে অনন্যা ভক্তির মাধ্যমেই কেবল লাভ করা যায়। তিনি যদিও তাঁর ধামে নিত্য বিরাজমান, তবুও সর্বব্যাপ্ত এবং সব কিছু তাঁর মধ্যেই অবস্থিত।
তাৎপর্যঃ এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, সেই পরম ধাম, যেখান থেকে আর পুনরাগমন হয় না, তা হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ধাম। ব্রহ্মসংহিতায় এই পরম ধামকে আনন্দচিন্ময়রস বলে বর্ণনা করা হয়েছে, অর্থাৎ যেখানে সব কিছুই চিন্ময় আনন্দে পরিপূর্ণ। সেখানে যত রকমের বিচিত্রতার প্রকাশ, তা সবই দিব্য আনন্দে পরিপূর্ণ — কোন কিছুই জড় নয়। এই সমস্ত বৈচিত্র পরমেশ্বর ভগবানের চিন্ময় আত্মবিস্তার, কারণ সেই ধাম পূর্ণরূপে ভগবানের অন্তরঙ্গা শক্তিতে অধিষ্ঠিত। সেই কথা সপ্তম অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই জড় জগতের পরিপ্রেক্ষিতে ভগবান যদিও তাঁর পরম ধামে নিত্য অধিষ্ঠিত, কিন্তু তবুও তাঁর অপরা শক্তির দ্বারা তিনি সর্বব্যাপ্ত। এভাবেই তাঁর পরা ও অপরা শক্তির মাধ্যমে তিনি প্রাকৃত ও অপ্রাকৃত, উভয় জগতেই সর্বদাই বিদ্যমান। যস্যান্তঃস্থানি কথাটির অর্থ হচ্ছে, তিনি সব কিছুই তাঁর মধ্যে ধারণ করে আছেন – তা সে পরা শক্তিই হোক অথবা অপরা শক্তিই হোক। এই দুই শক্তির দ্বারা ভগবান সর্বব্যাপ্ত।
এখানে ভক্তরা শব্দটির দ্বারা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কেবল ভক্তির দ্বারাই শ্রীকৃষ্ণের পরম ধামে অথবা অগণিত বৈকুণ্ঠলোকে প্রবেশ করা সম্ভব। অন্য কোনও পন্থায় সেই পরম ধাম লাভ করা যায় না। বেদেও (গোপাল-তাপনী উপনিষদ ৩/২) এই পরম ধাম ও পরম পুরুষোত্তম ভগবানের বর্ণনা আছে। একো বশী সর্বন্ধঃ কৃষ্ণঃ- সেই পরম ধামে কেবল এক পরম পুরুষোত্তম ভগবান আছেন, যাঁর নাম শ্রীকৃষ্ণ। তিনি পরম করুণাময় বিগ্রহ এবং যদিও তিনি সেখানে এক হয়ে অবস্থান করে আছেন, কিন্তু তিনিই লক্ষ লক্ষ অসংখ্য অংশ রূপ ধারণ করে বিরাজ করছেন। বেদে পরমেশ্বরকে এমন একটি গাছের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যে গাছটি স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থেকেও নানা ধরনের ফল, ফুল বহন করছে এবং এমন সব পাতা সৃষ্টি করে চলেছে, যা নিয়ত বদলে যাচ্ছে। ভগবানের অংশ- প্রকাশ বৈকুণ্ঠলোকগুলির অধিপতি হচ্ছেন চতুর্ভূজধারী এবং তারা পুরুষোত্তম, ত্রিবিক্রম, কেশব, মাধব, অনিরুদ্ধ, হৃষীকেশ, সম্বর্ষণ, প্রদ্যুম্ন, শ্রীধর, বাসুদেব, দামোদর, জনার্দন, নারায়ণ, বামন, পদ্মনাভ আদি বিবিধ নামে পরিজ্ঞাত।
ব্রহ্মসংহিতায় (৫/৩৭) দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, যদিও ভগবান তাঁর পরম ধাম গোলোক বৃন্দাবনে নিত্য বিরাজমান, তবুও তিনি সর্বব্যাপ্ত, যার ফলে সব কিছুই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়ে চলেছে (গোলোক এর নিবসতাধিলাত্মভূতঃ)। বেদে (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩/৮) উল্লেখ আছে যে, পরাসা শক্তিবিবিধের শ্রয়তে/ স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়া চ—তাঁর শক্তিসমূহ এতই সুদূরপ্রসারী যে, তারা গুনিনাক্ত ও ত্রুটিহীনভাবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব কিছুই পরিচালনা করে চলেছেন, যদিও পরমেশ্বর ভগবান বহু বহু দূরে অবস্থিত।
শ্লোকঃ ২৩
যত্র কালে ত্বনাবৃত্তিমাবৃত্তিং চৈব যোগিনঃ ।
প্রয়াতা যান্তি তং কালং বক্ষ্যামি ভরতর্ষভ ।। ২৩ ।।
যত্র যে, কালে—সময়ে, ভু—কিন্তু; অনাবৃত্তিম্ — ফিরে আসে না; আবৃত্তি- ফিরে আসে; চ– এর – অবশ্যই; যোগিনঃ — বিভিন্ন প্রকার যোগী: প্রয়াতাঃ মৃত্যু হলে, যান্তি—প্রাপ্ত হন। তম্—সেই কালম্—কাল, বক্ষ্যামি বলব, ভারত ড – হে ভারতশ্রেষ্ঠ।
গীতার গান
যে কালেতে অনাবৃত্তি যোগীর সম্ভব ।
বলিতেছি শুন তাহা ভরত ঋষভ ॥
অনুবাদঃ হে ভারতশ্রেষ্ঠ! যে কালে মৃত্যু হলে যোগীরা এই জগতে ফিরে আসেন অথবা ফিরে আসেন না, সেই কালের কথা আমি তোমাকে বলব ।
তাৎপর্যঃ ভগবানের পূর্ণ শরণাগত অনন্য ভক্তগণ কখনও চিন্তা করেন না, তাঁরা কিভাবে ও কখন দেহত্যাগ করবেন। তাঁরা সব কিছুই শ্রীকৃষ্ণের হাতে ছেড়ে দেন এবং তাই তাঁরা অনায়াসে ও অতি আনন্দের সঙ্গে ভগবৎ-ধামে ফিরে যান। কিন্তু যারা অনন্য ভক্ত নয়, যারা কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, হঠযোগ আদি অন্যান্য সাধনার উপর নির্ভর করে, তাদের অবশ্যই উপযুক্ত সময়ে দেহত্যাগ করতে হয়, যার ফলে তারা নিশ্চিতভাবে জানতে পারে যে, এই জন্ম-মৃত্যুর সংসারে তাদের আর ফিরে আসতে হবে কি হবে না।
সিদ্ধযোগী এই জড় জগৎ ত্যাগ করবার জন্য উপযুক্ত স্থান ও কাল নির্ণয় করতে পারেন। কিন্তু তিনি যদি সিদ্ধ না হন, তবে তাঁর সাফল্য নির্ভর করে, দৈবক্রমে যদি তিনি কোন বিশেষ উপযুক্ত সময়ে তাঁর দেহ ত্যাগ করতে পারেন, তার উপর। যেই উপযুক্ত সময়ে দেহত্যাগ করলে আর ফিরে আসতে হয় না, তা পরবর্তী শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বর্ণনা করেছেন। আচার্য শ্রীল বলদের বিদ্যাভূষণের মত অনুসারে, এখানে উল্লিখিত কাল শব্দে কালের অধিষ্ঠাতা দেবতাকে উল্লেখ করা হয়েছে।
শ্লোকঃ ২৪
অগ্নির্জ্যোতিরহঃ শুক্রঃ যন্মাসা উত্তরায়ণম্ ৷
তত্র প্রয়াতা গচ্ছন্তি ব্রহ্ম ব্রহ্মবিদো জনাঃ ।। ২৪ ।।
অগ্নিঃ—অগ্নি: জ্যোতিঃ – জ্যোতি, অহঃ – দিন, শুরুঃ শুক্লপক্ষ; বণ্মাসাঃ — হয় মাস; উত্তরায়ণম্—উত্তরায়ণ, তত্র – সেই মার্গে; প্রয়াতাঃ – দেহ ত্যাগকারী: গচ্ছত্তি — গমন করেন; ব্রহ্ম — ব্রহ্মে ব্রহ্মবিদঃ — ব্রহ্মজ্ঞানী; জনাঃ—ব্যক্তি।
গীতার গান
ব্রহ্মবিৎ পুরুষ যে জ্যোতি শুভদিনে ৷
উত্তরায়ণ কালেতে করিলে প্রয়াণে ॥
ব্রহ্মলাভ হয় তার অনাবৃত্তি গতি ৷
কর্মীর জ্ঞানীর সেই সাধারণ মতি ॥
অনুবাদঃ ব্রহ্মবিৎ পুরুষগণ অগ্নি, জ্যোতি, শুভদিন, শুক্লপক্ষে ও ছয় মাস উত্তরায়ণ কালে দেহত্যাগ করলে ব্রহ্ম লাভ করেন।
তাৎপর্যঃ অগ্নি, জ্যোতি, দিন, পক্ষ আদির উল্লেখ থেকে জানা যায় যে, এই সকলের এক- একজন বিশেষ অধিষ্ঠাতা দেবতা আছেন, যাঁরা আত্মার গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করেন। মৃত্যুর সময় মন জীবাত্মাকে নবজীবনের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। দৈবক্রমে অথবা সাধনার প্রভাবে এই শ্লোকে বর্ণিত সময়ে দেহত্যাগ করলে নির্বিশেষ ব্রহ্মজ্যোতি প্রাপ্ত হওয়া যায়। উত্তম যোগী তাঁর ইচ্ছা অনুসারে কোন বিশেষ স্থানে, কোন বিশেষ সময়ে দেহত্যাগ করতে পারেন। অন্য কোন মানুষের সেই নিয়ন্ত্রণ সামর্থ্য নেই। দৈবক্রমে শুভ মুহূর্তে যদি কারও দেহত্যাগ হয়, তবে সে জন্ম-মৃত্যুর চক্রে পুনরাগমন করবে না, নতুবা অবশ্যই তাকে এই জড় জগতে ফিরে আসতে হবে। কিন্তু কৃষ্ণভাবনাময় শুদ্ধ ভত দৈবক্রমে অথবা স্বেচ্ছায়, শুভ অথবা অশুভ, যে সময়েই দেহত্যাগ করুন না কেন, তাঁর কখনও পুনরাগমনের আশঙ্কা থাকে না।