শ্লোকঃ ১৯

ভূতগ্রামঃ স এবায়ং ভূত্বা ভূত্বা প্রলীয়তে ৷

রাত্র্যাগমেহবশঃ পার্থ প্রভবত্যহরাগমে ॥ ১৯ ॥

ভূতগ্রামঃ- জীবসমষ্টি; সঃ – সেই; এব— অবশ্যই; অয়ম্—এই; ভূত্বা ভূত্বা — পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করে, প্রলীয়তে লয় প্রাপ্ত হয়; রাত্রি রাত্রি; আগমে — সমাগমে; অবশঃ—আপনা থেকেই পার্থ- হে পৃথাপুত্র প্রভবতি — প্রকাশিত হয়, তাহঃ- দিনের বেলা; আগমে — আগমনে।

গীতার গান

চরাচর যাহা কিছু সেই উদ্ভব প্রলয় ।

পুনঃ পুনঃ জন্ম আর পুনঃ পুনঃ ক্ষয়।।

অনুবাদঃ হে পার্থ। সেই ভূতসমূহ পুনঃ পুনঃ উৎপন্ন হয়ে ব্রহ্মার রাত্রি সমাগমে লয় প্রাপ্ত হয় এবং পুনরায় দিনের আগমনে তারা আপনা থেকেই প্রকাশিত হয়। তাৎপর্য

তাৎপর্যঃ অন্ন-বুদ্ধিসম্পন্ন জীব যারা এই জড় জগতে থাকবার চেষ্টা করে, তারা বিভিন্ন উচ্চতর গ্রহলোকে উন্নীত হতে পারে এবং তার পরে আবার তাদের এই পৃথিবী গ্রহে পতন হয়। ব্রহ্মার দিবসকালে এই জড় জগতের অভ্যন্তরে ঊর্ধ্ব ও নিম্ন লোকগুলিতে তারা তাদের কার্যকলাপ প্রদর্শন করতে পারে, কিন্তু ব্রহ্মার রাত্রির আগমনে তারা আবার সকলেই লয় প্রাপ্ত হয়। জড়-জাগতিক কার্যকলাপের জন্য ব্রহ্মার দিবাভাগে তারা বিভিন্ন কলেবর প্রাপ্ত হয় এবং রাত্রে তাদের সেই সমস্ত কলেবরের বিনাশ হয় এবং এই সময়ে জীবসমূহ শ্রীবিষ্ণুর বিগ্রহে একসঙ্গে অবস্থান করে। তারপর ব্রহ্মার দিনের আবির্ভাবে তারা আবার অভিব্যক্ত হয়। ভূত্বা ভূত্বা প্রলীয়তে—দিনের বেলায় তারা প্রকাশিত হয় এবং রাত্রিবেলায় তারা আবার লয় প্রাপ্ত হয়। অন্তিমে, ব্রহ্মার আয়ু যখন শেষ হয়ে যায়, তখন তারা সকলে বিলীন হয়ে যায় এবং কোটি কোটি বছর ধরে অপ্রকাশিত থাকে। তারপর আর একটি কল্পে ব্রহ্মা যখন আবার জন্মগ্রহণ করে, তখন তারা পুনরায় ব্যক্ত হয়। এভাবেই জীব জড় জগতের মোহের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। কিন্তু যে সম বুদ্ধিমান ব্যক্তি কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণ করেন, তাঁরা হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে/ হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে— এই মহামন্ত্র কীর্তন করে মানব-জীবনকে সম্পূর্ণরূপে ভগবৎ-সেবায় নিয়োগ করেন। এভাবেই, এমন কি এই জীবনে তারা শ্রীকৃষ্ণের দিব্য ধানে প্রবেশ করে পুনর্জন্ম থেকে মুক্ত, সচ্চিদানন্দময় জীবন প্রাপ্ত হন।

শ্লোকঃ ২০

পরস্তস্মাত্তু ভাবোহন্যোহব্যক্তোহব্যক্তাৎ সনাতনঃ।

যঃ স সর্বেষু ভূতেষু নশ্যৎসু ন বিনশ্যতি ॥ ২০ ॥

পরঃ–শ্রেষ্ঠ; তস্মাৎ- সেই; ভূ– কিন্তু; ভাবঃ – প্রকৃতি; অন্যঃ — অন্য; অব্যক্তঃ – অব্যক্ত, অব্যক্তাৎ – অব্যক্ত থেকে; সনাতনঃ নিত্য, যঃ যা; সঃ- তা: সর্বেষু — সমস্ত; ভূতেষু প্রকাশ: নশাংসু — নিষ্ট হলেও; না: বিনশ্যতি — বিনষ্ট হয়।

গীতার গান

তাহার উপরে যেই ভাবের নির্ণয় ।

সনাতন সেই ধাম অক্ষয় অব্যয় ৷।

সকল সৃষ্টির নাশ এ জগতে হয় ৷

সনাতন ধাম নহে হইবে প্রলয় ॥

অনুবাদঃ কিন্তু আর একটি অব্যক্ত প্রকৃতি রয়েছে, যা নিত্য এবং ব্যক্ত ও অব্যক্ত বস্তুর অতীত। সমস্ত ভূত বিনষ্ট হলেও তা বিনষ্ট হয় না।

তাৎপর্যঃ শ্রীকৃষ্ণের পরা বা চিন্ময় শক্তি অপ্রাকৃত ও নিত্য। ব্রহ্মার দিন ও রাত্রে যথাক্রমে ব্যক্ত ও অব্যক্ত হয় যে অপরা প্রকৃতি, তার প্রভাব থেকে তা সম্পূর্ণ মুক্ত। শ্রীকৃষ্ণের পরা শক্তি গুণগতভাবে জড়া প্রকৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত। সপ্তম অধ্যায়ে এই পরা ও অপরা প্রকৃতি সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

শ্লোকঃ ২১

অব্যক্তোহক্ষর ইত্যুক্তস্তমাহুঃ পরমাং গতিম্ ।

যং প্রাপ্য ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম ॥ ২১ ॥

অব্যক্তঃ—অব্যক্ত; অক্ষরঃ—অক্ষর: ইতি—এভাবে; উক্তঃ বলা হয়, তম— তাকে, আহুঃ—বলে; পরমাম্― পরন; গতি — গতি; যম্ — যাঁকে প্রাপ্য – পেয়ে ন- নাঃ নিবর্তন্তে— ফিরে আসে; তদ্ধাম — সেই ধাম; পরমম্ — পরম; নম— আমার।

গীতার গান

সেই সে অব্যক্ত নাম ‘অক্ষর’ তাহার।

জীবের সে গতি নাম পরমা যাহার ৷।

সে গতি হইলে লাভ না আসে ফিরিয়া।

আমার সে নিত্য ধান সংসার জিনিয়া ॥

অনুবাদঃ সেই অব্যক্তকে অক্ষর বলে, তাই সমস্ত জীবের পরমা গতি। কেউ যখন সেখানে যায়, তখন আর তাঁকে এই জগতে ফিরে আসতে হয় না। সেটিই হচ্ছে আমার পরম ধাম।

তাৎপর্যঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরম ধামকে ব্রহ্মসংহিতায় “চিন্তামণি ধাম’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে এবং এই ধামে সমস্ত বাসনা পূর্ণ হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরম ধাম গোলোক বৃন্দাবন চিন্তামণি দিয়ে তৈরি প্রাসাদে পরিপূর্ণ। সেখানকার গাছগুলি কল্পতরু, যা ইচ্ছামাত্র আকাঙ্ক্ষিত খাদ্যদ্রব্য দান করে। সেখানকার গাভীগুলি ‘সুরভী’, যারা অপর্যাপ্ত পরিমাণে দুগ্ধ দান করে। এই নিত্য ধামে সহস্রশত লক্ষ্মী নিরন্তর অনাদির আদিপুরুষ সর্ব কারণের কারণ শ্রীগোবিন্দের সেবা করছেন। শ্রীকৃষ্ণ নিরন্তর তাঁর বেণুবাদন করেন (বেগুং কণন্তম্)। তাঁর দিবা শ্রীবিগ্রহ ত্রিভুবনকে আকৃষ্ট করে। তাঁর চক্ষুদ্বয় কমলদলের মতো এবং তাঁর শ্রীবিগ্রহের বর্ণ মেঘের মতো ঘনশ্যাম। তাঁর অপূর্ব সুন্দর রূপ কোটি কোটি কন্দৰ্পকে বিমোহিত করে। তাঁর পরনে পীত বসন, গলায় বনমালা আর মাথায় তাঁর শিখিপুচ্ছ। ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ চিন্ময় জগতের সর্বোচ্চ লোকে তাঁর স্বীয় ধাম গোলোক বৃন্দাবন সম্বন্ধে কেবল একটু আভাস দিয়েছেন। ব্রহ্মসংহিতাতে তাঁর বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায়। বৈদিক শাস্ত্রে (কঠ উপনিষদ ১/৩/১১) উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভগবানের চিন্ময় ধামের থেকে উত্তম আর কিছুই নেই এবং সেই ধামই হচ্ছে পরম গতি (পুরুষান পরং কিঞ্চিৎ সা কাষ্ঠা পরমা গতিঃ)। সেই ধাম প্রাপ্ত হলে কেউ আর এই জড় জগতে ফিরে আসে না। শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীকৃষ্ণের পরম ধামের মধ্যে কোন ভেদ নেই, তাঁরা সমান চিগুণ-সম্পন্ন। দিল্লি থেকে ৯০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত বৃন্দাবন চিৎ-জগতের সর্বোচ্চে গোলোক বৃন্দাবনের প্রতিরূপ। শ্রীকৃষ্ণ যখন এই পৃথিবীতে অবতরণ করেছিলেন, তখন তিনি মধুরা জেলার ৮৪ বর্গমাইল পরিধি- বিশিষ্ট সেই বৃন্দাবন ধামে তাঁর দিব্য লীলাখেলা।

error: Content is protected !!