শ্লোকঃ ১৬

আব্রহ্মভুবনাল্লোকাঃ পুনরাবর্তিনোহর্জুন ।

মামুপেত্য তু কৌন্তেয় পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে ৷৷ ১৬ ॥

আব্রহ্ম – ব্ৰহ্মলোক পর্যন্ত; ভুবনাৎ – পৃথিবী থেকে লোকাঃ– লোকসমূহ। পুনঃপুনরায়; আবর্তিনঃ – আবর্তনশীল; অর্জুন – হে অর্জুন, মাম্ আমাকে উপেত্য—প্রাপ্ত হলে; তু— কিন্তু; কৌন্তেয় হে কুন্তীপুত্র, পুনর্জন্ম — পুনর্জন্ম, ন না; বিদ্যতে হয়।

গীতার গান

চতুর্দশ ভুবনেতে যত লোক হয় ৷

ব্রহ্মলোক পর্যন্ত সে নিত্য কেহ নয় ।।

সে সব লোকেতে স্থান গমনাগমন ।

সকল লোকেতে আছে জনম মরণ ৷৷

ভক্তির আশ্রয় যেবা আমাকে যে পায় ৷

কেবল তাহার মাত্র পুনর্জন্ম নয় ৷।

অনুবাদঃ হে অর্জুন! এই ভুবন থেকে ব্রহ্মলোক পর্যন্ত সমস্ত লোকই পুনরাবর্তনশীল অর্থাৎ পুনর্জন্ম হয়। কিন্তু হে কৌন্তেয়। আমাকে প্রাপ্ত হলে আর পুনর্জা হয় না।

তাৎপর্যঃ কর্ম, জ্ঞান, হঠ আদি যোগ সাধনকারী যোগীদের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিব্য ধামে প্রবেশ করতে হলে, পরিশেষে কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে ভক্তিযোগ অনুশীলন করার মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করতে হবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই দিবা ধামে একবার প্রবেশ করলে আর এই জড় জগতে ফিরে আসতে হয় না। এই জড় জগতের সর্বোচ্চ লোকে অথবা দেবলোকে প্রবেশ করলেও জন্ম-মৃত্যুর চক্রের অধীনেই থাকতে হয়। মর্তবাসীরা যেমন উচ্চলোকে উন্নীত হয়, তেমনই ব্রহ্মলোক, চন্দ্রলোক, ইন্দ্ৰলোক আদি উচ্চলোকের অধিবাসীরাও এই গ্রহলোকে পতিত হয়। ছান্দোগ্য উপনিষদে উল্লিখিত ‘পঞ্চাগ্নি-বিদ্যা’ নামক যজ্ঞ অনুষ্ঠানের দ্বারা যে-কেউ ব্রহ্মলোকে উত্তীর্ণ হতে পারেন, কিন্তু ব্রহ্মলোকে যদি তিনি কৃষ্ণভাবনার অনুশীলন না করেন, তবে তাঁকে আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসতে হয়। উচ্চতর গ্রহলোকে যাঁরা কৃষ্ণভাবনায় উন্নতি সাধন করেন, তাঁরা উত্তরোত্তর উচ্চতর গ্রহলোক প্রাপ্ত হন এবং মহাপ্রলয়ের পর সনাতন চিন্ময় ধামে প্রবেশ করেন। শ্রীধর স্বামী ভগবদ্গীতার ভাষ্য রচনায় এই শ্লোকটি উদ্ধৃত করেছেন—

ব্ৰহ্মণা সহ তে সর্বে সম্প্রাপ্তে প্রতিসঞ্চারে ।

পরস্যান্তে কৃতাত্মানঃ প্রবিশস্তি পরং পদম্ ॥

“এই জড় ব্রহ্মাণ্ডের প্রলয়ের পর নিরন্তর কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত ব্রহ্মা ও তাঁর ভক্তগণ তাঁদের ইচ্ছা অনুসারে পরব্যোমস্থিত অপ্রাকৃত ব্রহ্মাণ্ডে এবং বিশেষ বিশেষ চিন্ময় গ্রহলোকে স্থানান্তরিত হন।

শ্লোকঃ ১৭

সহস্রযুগপর্যন্তমহর্ষদ ব্রহ্মণো বিদুঃ ৷

রাত্রিং যুগসহস্রান্তাং তেহহোরাত্রবিদো জনাঃ ॥ ১৭ ॥

সহস্ৰ — সহজ, গুগ—চতুর্যুগ, পর্যন্ত— ব্যাপী, অহঃ – দিন; য—না: ব্ৰহ্মণঃ- ব্রহ্মার; বিদুঃ—যাঁরা জানেন; রাত্রি রাত্রি: যুগ—চতুর্যুগ সহস্রান্তাম্— তেমনই, সহস্র চতুর্যুগের অন্তে, তে— সেই অহোরাত্র দিন ও রাত্রির; বিদঃ তত্ত্ববেত্তা জনাঃ—মানুষেরা।

গীতার গান

মানুষের সহস্র যে চতুর্যুগ যায় ৷

ব্রহ্মার সে একদিন করিয়া গণয় ৷।

সেইরূপ একরাত্রি ব্রহ্মার গণন ।

রাত্রিদিন ব্রহ্মার যে করহ মনন ॥

অনুবাদঃ মনুষ্য মানের সহস্র চতুর্যুগে ব্রহ্মার একদিন হয় এবং সহস্র চতুর্যুগে তাঁর এক রাত্রি হয়। এভাবেই যাঁরা জানেন, তাঁরা দিবা-রাত্রির তত্ত্ববেতা।

তাৎপর্যঃ জড় ব্রহ্মাণ্ডের স্থায়িত্বকাল সীমিত। এর প্রকাশ হয় কল্পের সৃষ্টিচক্রে। ব্রহ্মার একদিনকে কল্প বলা হয়। এক কল্পে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি—এই চারটি যুগ এক হাজার বার আবর্তিত হয়। সত্যযুগের লক্ষণ হচ্ছে সদাচার, বুদ্ধিমত্তা ও ধর্ম। সেই যুগে অজ্ঞান ও পাপ প্রায় থাকে না বললেই চলে। এই যুগের স্থায়িত্ব ১৭,২৮,০০০ বছর। ত্রেতাযুগে পাপকর্মের সূচনা হয় এবং এই যুগের স্থায়িত্ব ১২,৯৬,০০০ বছর। দ্বাপর যুগে ধর্মের অবনতি ঘটে এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়। এই যুগের স্থায়িত্ব ৮,৬৪,০০০ বছর এবং সব শেষে কলিযুগ (গত ৫,০০০ বছর ধরে এই যুগ চলছে)। এই যুগে কলহ, অজ্ঞানতা, অধর্ম ও পাপাচারের প্রাবল্য দেখা যায় এবং যথার্থ ধর্মাচরণ প্রায় লুপ্ত । এই যুগের স্থায়িত্ব প্রায় ৪,৩২,০০০ বছর। কলিযুগে অধর্ম এত বৃদ্ধি পায় যে, এই যুগের শেষে পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং কল্কি অবতাররূপে অবতীর্ণ হয়ে অসুরদের বিনাশ করেন এবং তাঁর ভক্তদের পরিত্রাণ করে আর একটি সত্যযুগের সূচনা করেন। তারপর এই প্রক্রিয়া আবার চলতে থাকে। এই চারটি যুগ যখন এক হাজার বার আবর্তিত হয়, তখন ব্রহ্মার একদিন হয় এবং সমপরিমাণ কালে এক রাত্রি হয়। এই রকম দিন ও রাত্রি সমন্বিত বর্ষ অনুসারে ব্রহ্মা একশ বছর বেঁচে থেকে তারপর দেহ আগ করেন। এই একশ বছর পৃথিবীর অনুসারে ৩,০০০০,০০০০০০০ বছরের সমান। এই গণনা অনুসারে ব্রহ্মার আয়ু কল্পনাপ্রসূত ও অক্ষয় বলে মনে হয়, কিন্তু নিতাতার পরিপ্রেক্ষিতে এর স্থায়িত্ব বিদ্যুৎ চমকের মতো ক্ষণস্থায়ী। অতলান্তিক মহাসাগরের বুদ্বুদের মতো কারণ সমুদ্রে অসংখ্য ব্রহ্মার নিতা উদয় ও লয় হয়ে চলেছে। ব্রহ্মা ও তাঁর সৃষ্টি জড় ব্রহ্মাণ্ডের অংশ এবং তাই তা নিরন্তর প্রবহমান।

জড় ব্রহ্মাণ্ডে এমন কি ব্রহ্মাণ্ড জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যাধির চক্র থেকে মুক্ত নন। তবুও এই জড় জগতের পরিচালনায় তিনি সরাসরিভাবে ভগবানের সেবা করছেন, তাই তিনি সদ্যমুক্তি লাভ করেন। উচ্চ স্তরের সন্ন্যাসীরা ব্রহ্মার বিশিষ্টলোক ব্রহ্মালোক প্রাপ্ত হন, যা হচ্ছে জড় জগতের সর্বোচ্চ গ্রহলোক এবং অন্য সমস্ত স্বর্গীয় গ্রহলোকের বিনাশ হয়ে যাওয়ার পরেও তা বর্তমান থাকে। কিন্তু জড়া প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে ব্রহ্মা ও ব্রহ্মলোকের সমস্ত বাসিন্দাদের যথাসময়ে মৃত্যু হয়।

শ্লোকঃ ১৮

অব্যক্তাদ ব্যক্তয়ঃ সর্বাঃ প্রভবন্ত্যহরাগমে ৷

রাত্র্যাগমে প্রলীয়ন্তে তত্রৈবাব্যক্তসংজ্ঞকে ॥ ১৮ ॥

অব্যক্তাৎ- অব্যক্ত থেকে; ব্যক্তয়ঃ— জীবসমূহ: সর্বাঃ — সমস্ত প্রভবস্তি — প্রকাশিত হয়; অহরাগমে—দিনের শুরুতে; রাত্র্যাগমে—রাত্রি সমাগমে প্রলীয়ন্তে—লীন হয়ে যায়, তত্র—সেখানে; এর— অবশ্যই অব্যক্ত-অব্যক্ত সংজ্ঞকে নামক ।

গীতার গান

সেই রাত্রি অবসানে অব্যক্ত হইতে ৷

ব্যক্ত হয় এ ত্রিলোক ব্রহ্মার দিনেতে ॥

আবার সে রাত্রিকালে হইবে প্রনয় ।

অব্যক্ত হইতে জন্ম অব্যক্তে মিলায় ॥

অনুবাদঃ ব্রহ্মার দিনের সমাগমে সমস্ত জীব অব্যক্ত থেকে অভিব্যক্ত হয় এবং ব্রহ্মার রাত্রির আগমে তা পুনরায় অব্যক্তে লয় প্রাপ্ত হয়।

error: Content is protected !!