শ্লোকঃ ১০
প্রয়াণকালে মনসাচলেন
ভক্ত্যা যুক্তো যোগবলেন চৈব ।
ভ্রুবোর্মধ্যে প্রাণমাবেশ্য সম্যক
স তং পরং পুরুষমুপৈতি দিব্যম্ ॥ ১০॥
প্রয়াণকালে—মৃত্যুর সময়; মনসা মনের দ্বারা; অচলেন –অঞ্চলভাবে; ভক্ত্যা- ভক্তি সহকারে যুক্তঃ — সংযুক্ত, যোগবলেন— যোগশক্তির বলে, চও; এব অবশ্যই; ভ্ৰুবোঃ—ভ্রূযুগল মধ্যে—মধ্যে প্রাণম্ – প্রাণবায়ুকে আবেশ্য— স্থাপন করে, সমার্—সম্পূর্ণরূপে, সঃ – তিনি; তম্ — সেই; পরম্পরম পুরুষম্ – পুরুষকে; উপেতি—প্রাপ্ত হন। দিবাম — দিবা।
গীতার গান
অচল মনেতে যেবা, প্রয়াণকালেতে কিবা,
ভক্তিযুক্ত হয়ে যোগবলে ।
ভ্রূর মধ্যে রাখি প্রাণ, যদি হয় সে স্মরণ,
দিব্য পুরুষ তাহারে মিলে ৷।
অনুবাদঃ যিনি মৃত্যুর সময় অচঞ্চল চিত্তে, ভক্তি সহকারে, পূর্ণ যোগশক্তির বলে ভ্রূযুগলের মধ্যে প্রাণবায়ুকে স্থাপন করে পরমেশ্বর ভগবানকে স্মরণ করেন, তিনি অবশ্যই সেই দিব্য পরম পুরুষকে প্রাপ্ত হন।
তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, মৃত্যুর সময় মনকে ভক্তি সহকারে ভগবানের ধ্যানে একাগ্র করা উচিত। যাঁরা যোগ সাধন করছেন, তাঁদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, দুই ভ্রূর মধ্যে ‘আজ্ঞাচক্রে তাদের প্রাণশক্তিকে স্থাপন করতে হবে। এখানে ‘বট্চক্র যোগের মাধ্যমে ধ্যানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। শুদ্ধ ভক্ত এই ধরনের যোগাভ্যাস করেন না, কিন্তু যেহেতু তিনি সর্বদাই কৃষ্ণভাবনায় মগ্ন থাকেন, তাই তিনি মৃত্যুর সময়ে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের কৃপায় তাঁকে স্মরণ করতে পারেন। এই অধ্যায়ের চতুর্দশ শ্লোকে সেই কথার ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
এই শ্লোকে যোগবলেন কথাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, ‘ষটচক্র যোগ বা ভক্তিযোগই হোক না কেন, কোন একটি যোগ অভ্যাস না করলে মৃত্যুর সময়ে এই অপ্রাকৃত স্তরে উন্নীত হওয়া যায় না। মৃত্যুর সময় আকস্মিকভাবে ভগবানকে স্মরণ করা যায় না। কোন একটি যোগের অনুশীলন, বিশেষ করে ভক্তিযোগ পদ্ধতির অনুশীলন অবশ্যই করতে হবে। যেহেতু মৃত্যুর সময় মন অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, তাই আজীবন যোগ অভ্যাস করার মাধ্যমে ভগবানকে স্মরণ করার অভ্যাস করতে হয়, যাতে সেই চরম মুহূর্তে তাঁকে স্মরণ করা যায়।
শ্লোকঃ ১১
যদক্ষরং বেদবিদো বদন্তি
বিশন্তি যদ্ যতয়ো বীতরাগাঃ ৷
যদিচ্ছন্তো ব্রহ্মচর্যং চরন্তি
তত্তে পদং সংগ্রহেণ প্রবক্ষ্যে ॥ ১১॥
মৎ—যাঁকে, অক্ষরম্—অবিনাশী; বেদবিদঃ – (বদবিং, বদন্তি — বলেন; বিশন্তি— প্রবেশ করেন; যৎ—যাতে যতয়ঃ — সন্ন্যাসীগণ; বীতরাগাঃ — বিষয়ে আসক্তিশূন্য; যৎ—যাঁকে; ইচ্ছন্তঃ— ইচ্ছা করে, ব্রহ্মচর্যম্—রহ্মচর্য, চরন্তি — পালন করেন; তৎ— সেই; তে—তোমাকে; পদ—পদ; সংগ্রহেণ – সংক্ষেপে; প্রবক্ষ্যে – বলব।
গীতার গান
বেদজ্ঞানী যে অক্ষর, লাভে হয় তৎপর,
যাহাতে প্রবিষ্ট হয় যতিগণ ।
বীতরাগ ব্রহ্মচারী, সদা আচরণ করি,
সে তথ্য বলি শুন বিবরণ ॥
অনুবাদঃ বেদবিৎ পণ্ডিতেরা র্যাকে ‘অক্ষর’ বলে অভিহিত করেন, বিষয়ে আসক্তি না সন্ন্যাসীরা যাতে প্রবেশ করেন, ব্রহ্মচারীরা যাঁকে লাভ করার ইচ্ছায় ব্রহ্মচর্য পালন করেন, তাঁর কথা আমি সংক্ষেপে তোমাকে বলব।
তাৎপর্যঃ পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ যচক্র যোগাভ্যাসের জন্য অর্জুনকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এই যোগাভ্যাসের মাধ্যমে প্রাণবায়ুকে দুই ভ্রূর মাঝখানে স্থাপন করতে হয়। অর্জুন যচক্র যোগাভ্যাস জানতেন না বলে মেনে নিয়ে, পরবর্তী শ্লোকগুলিতে পরমেশ্বর তাঁর অভ্যাস পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে ব্যাখ্যা করেছেন যে, ব্রহ্ম যদিও অদ্বয়, তবুও তাঁর বিভিন্ন প্রকাশ ও রূপ আছে। বিশেষত নির্বিশেষবাদীদের কাছে অক্ষর বা ওঁ শব্দ ব্রহ্ম থেকে অভিন্ন। শ্রীকৃষ্ণ এখানে সেই ব্রহ্মের বর্ণনা করেছেন, যাঁর মধ্যে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীগণ প্রবেশ করেন। বৈদিক শিক্ষার রীতি অনুসারে, বিদ্যার্থীদের শুরু থেকেই ‘ও’ উচ্চারণের শিক্ষা দেওয়া হয় এবং তাঁরা আচার্যদেবের সান্নিধ্যে থেকে পূর্ণ ব্রহ্মচর্য পালন করে নির্বিশেষ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেন। এভাবেই তাঁরা ব্রহ্মের দুটি স্বরূপ সম্বন্ধে অবগত হন। শিষ্যের পারমার্থিক উন্নতির জন্য এই অনুশীলন অতি আবশ্যক। আধুনিক যুগে এই রকম ব্রহ্মচারী জীবন যাপন করা একেবারেই অসম্ভব। আধুনিক যুগে সমাজ ব্যবস্থার এমন পরিবর্তন হয়েছে যে, বিদ্যার্থীর জীবনের শুরু থেকে ব্রহ্মচর্য পালন করা সম্ভব নয়। সারা বিশ্বে জ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগের জন্য অনেক শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে, কিন্তু এমন একটিও শিক্ষাকেন্দ্র কোথাও নেই, যেখানে ব্রহ্মচর্য আচরণ করার শিক্ষা দেওয়া হয়। ব্রহ্মচর্য আচরণ না করে পারমার্থিক উন্নতি লাভ করা অত্যন্ত কঠিন। তাই শ্রীচেতন্য মহাপ্রভু প্রচার করে গেছেন যে, বর্তমান কলিযুগে শাস্ত্ৰবিধান অনুসারে হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে—এই মহামন্ত্র কীর্তন করা ছাড়া পরমতত্ত্ব উপলব্ধির আর কোন উপায় নেই।
শ্লোকঃ ১২
সর্বদ্বারাণি সংযম্য মনো হৃদি নিরুধ্য চ
মূধ্ন্যাধায়াত্মনঃ প্রাণমাস্থিতো যোগধারণাম্ ॥ ১২ ৷৷
সবদ্বারাণি—শরীরের সব কয়টি দ্বার; সংযম্য – সংযত করে, মনঃ —— মনকে; হৃদি- হৃদয়ে; নিরুধ্য— নিরোধ করে; চ–৩; মূর্ত্তি—হৃদয়ের মধ্য, আধায় — স্থাপন করে; আত্মনঃ—আত্মার; প্রাণম্ — প্রাণবায়ুকে, আস্থিতঃ স্থিত, যোগধারণা— যোগধারণা।
গীতার গান
সমস্ত ইন্দ্রিয় দ্বার, রুদ্ধ হয়েছে যার,
বিষয়েতে অনাসক্তি নাম ৷
মনকে নিরোধ করি, হৃদয়েতে স্থির করি,
যেই জন হয়েছে নিষ্কাম ।।
প্রাণকে ভ্রূর মাঝে, যোগ্য সেই যোগীসাজে,
সমর্থ যোগ ধারণে সেই।
অনুবাদঃ ইন্দ্রিয়ের সব কয়টি দ্বার সংযত করে, মনকে হৃদয়ে নিরোধ করে এবং হৃদয়ের মধ্যে প্রাণ স্থাপন করে যোগে স্থিত হতে হয়।
তাৎপর্যঃ এখানে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে, যোগাভ্যাস করার জন্য সর্বপ্রথমে ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির সব কয়টি দ্বার বন্ধ করতে হবে। এই অভ্যাসকে বলা হয় ‘প্রত্যাহার’, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়-বিষয় থেকে ইন্দ্রিয়গুলিকে সম্বরণ করা। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক এই জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলিকে সম্পূর্ণভাবে সংযত করে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার বাসনা দমন করতে হয়। এভাবেই মন তখন হৃদয়ে পরমাত্মায় একাগ্র হয় এবং প্রাণবায়ুর মস্তকে ঊর্ধ্বারোহণ হয়। ষষ্ঠ অধ্যায়ে এই পদ্ধতির বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু পূর্বেই বলা হয়েছে যে, এই যুগে এই প্রকার যোগের অভ্যাস করা বাস্তব- সম্মত নয়। এই যুগের সর্বোত্তম সাধনা হচ্ছে কৃষ্ণভাবনা। ভক্তি সহকারে যিনি তাঁর মনকে নিরন্তর শ্রীকৃষ্ণের ধ্যানে মগ্ন রাখতে পারেন। তাঁর পক্ষে অবিচলিতভাবে অপ্রাকৃত সমাধিতে স্থিত হওয়া অত্যন্ত সহজ।