শ্লোকঃ ৭
তস্মাৎ সর্বেষু কালেষু মামনুস্মর যুধ্য চ ।
মধ্যর্পিতমনোবুদ্ধির্মামেবৈষ্যস্যসংশয়ঃ ।। ৭ ।।
তস্মাৎ—অতএব; সর্বেষু — সন; কালেষু — সময়ে নাম— আমাকে অনুস্মর— স্মরণ করে; যুধ্য—যুদ্ধ কর; চ—ও, মমি —আমাতে, অর্পিত — সমর্পিত হলে; মনঃ— মন; বুদ্ধিঃ—বুদ্ধি; মাম্ আমাকে; এর অবশ্যই; এ্যসি — পারে; অসংশয়ঃ— নিঃসন্দেহে।
গীতার গান
অতএব তুমি সদা আমাকে স্মরিবে ।
কায়মন বুদ্ধি সব আমাকে অৰ্পিবে ৷৷
সেভাবে থাকিলে মোরে পাইবে নিশ্চয় ।
আমাতে অর্পিত মন যদি অসংশয় ॥
অনুবাদঃ অতএব, হে অর্জুন! সর্বদা আমাকে স্মরণ করে তোমার স্বভাব বিহিত যুদ্ধ কর, তা হলে আমাতে তোমার মন ও বুদ্ধি অর্পিত হবে এবং নিঃসন্দেহে তুমি আমাকেই লাভ করবে।
তাৎপর্যঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে অর্জুনকে যে উপদেশ দিয়েছেন, তা জড়-জাগতিক কার্যকলাপে নিয়োজিত প্রতিটি মানুষের পক্ষেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভগবান বলছেন না যে, মানুষকে তার কর্তব্যকর্ম পরিত্যাগ করতে হবে। মানুষ তার নিজের কর্তব্যকর্ম করে যেতে পারে এবং সেই সঙ্গে হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করতে পারে। তার ফলে সে জড়-জাগতিক কলুষতা থেকে মুক্ত হতে পারে এবং শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে তার মন ও বুদ্ধিকে নিয়োজিত করতে পারে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নাম কীর্তন করার ফলে জীব নিঃসন্দেহে পরম ধাম কৃষ্ণলোকে উত্তীর্ণ হবে।
শ্লোকঃ ৮
অভ্যাসযোগযুক্তেন চেতসা নান্যগামিনা ।
পরমং পুরুষং দিব্যং যাতি পার্থানুচিন্তয়ন্ ॥ ৮॥
অভ্যাস—অভ্যাস; যোগযুক্তেন – যোগে যুক্ত হয়ে; চেতসা — মন ও বুদ্ধির দ্বারা ন অন্যগামিনা—অনন্যগামী; পরমম্ – পরম, পুরুষম্ — পুরুষকে; দিব্যম্-দিব্য; মাতি — প্রাপ্ত হন, পার্থ – হে পৃথাপুত্র; অনুচিন্তয়ন্—অনুক্ষণ চিন্তা করে।
গীতার গান
কঠিন নহে ত এই অভ্যাস করিলে ।
মনকে অন্যত্র সদা নাহি যেতে দিলে ৷।
হে পার্থ সেভাবে চিন্তি পরম পুরুষে ৷
নিশ্চয়ই পাইবে তুমি দেহ অবশেষে ।।
অনুবাদঃ হে পার্থ। অভ্যাস যোগে যুক্ত হয়ে অনন্যগামী চিত্তে যিনি অনুক্ষণ পরম পুরুষের চিন্তা করেন, তিনি অবশ্যই তাকেই প্রাপ্ত হবেন।
তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাকে স্মরণ করার গুরুত্ব প্রতিপন্ন করেছেন। হার কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের স্মৃতি পুনর্জাগরিত হয়। এভাবেই পরমেশ্বর ভগবানের নাম সমন্বিত অপ্রাকৃত শব্দতরঙ্গ শ্রবণ ও কীর্তন করার মাধ্যমে আমাদের কান, জিভ ও মন ভগবানের সেবায় নিয়োজিত হয়। এভাবেই ভগবানের দিবা নাম আশ্রয় করে তাঁর ধ্যান করা অত্যন্ত সহজ এবং তা করার ফলে আমরা ভগবানের কাছে ফিরে যেতে পারি। পুরুষম্ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ভোক্তা। জীব যদিও ভগবানের তটস্থা শক্তিজাত, কিন্তু সে জড় কলুষের দ্বারা আচ্ছন্ন। তাই সে নিজেকে ভোক্তা মনে করে, কিন্তু সে কখনই পরম ভোক্তা হতে পারে না। এখানে স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে যে, নারায়ণ, বাসুদেব আদি বিভিন্ন স্বাংশ প্রকাশ রূপে পরমেশ্বর ভগবানই হচ্ছেন পরম ভোক্তা।
হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করে ভগবদ্ভক্ত তাঁর আরাধ্য ভগবানের শ্রীনারায়ণ, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাম আদি যে কোন একটি রূপকে নিরন্তর স্মরণ করতে পারেন। এই অনুশীলনের ফলে তাঁর অন্তর কলুষমুক্ত হয়ে পবিত্র হয় এবং জীবনের অন্তিমকালে সতত কীর্তন করার প্রভাবে তিনি ভগবৎ-ধামে স্থানান্তরিত হন। যোগ অনুশীলন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের অন্তঃস্থিত পরমাত্মার ধ্যান করা। তেমনই, হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করার ফলে মন পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীচরণকমলে আবিষ্ট হয়। মন চঞ্চল, তাই তাকে জোর করে শ্রীকৃষ্ণের চিন্তায় নিয়োজিত করতে হয়।
এই সম্পর্কে ওঁয়াপোকার উদাহরণের অবতারণা করা হয়, যে সর্বক্ষণ প্রজাপতি হওয়ার চিন্তায় মগ্ন থাকার ফলে, সেই জীবনেই প্রজাপতিতে রূপান্তিত হয়। সেই রকম, আমরাও যদি সর্বক্ষণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চিন্তা করি, তবে আমরাও নিঃসন্দেহে এই জীবনের শেষে ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই মতো চিন্ময় দেহ প্রাপ্ত হব।
শ্লোকঃ ৯
কবিং পুরাণমনুশাসিতারম
অণোরণীয়াংসমনুস্মরেদ যঃ।
সর্বস্য ধাতারমচিন্ত্যরুপম
আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ ॥ ৯ ॥
কবিম্—সর্বজ্ঞ, পুরাণম্ — অনাদি, অনুশাসিতারম্ — নিয়ন্তা: অণোঃ—সূক্ষ্ম থেকে; অণীয়াংসম্—সূক্ষ্মতর; অনুস্মরেৎ — নিরস্তর স্মরণ করেন; যঃ- যিনি; সর্বস্য সব কিছুর: ধাতারম্—বিধাতা: অচিন্ত্য অচিন্ত্য; রূপস্ – রূপ; আদিত্যবর্ণম্ — সূর্যের মতো জ্যোতির্ময়, তমসঃ — অন্ধকারের; পরস্তাৎ—অতীত।
গীতার গান
পরম পুরুষ ধ্যান, শুনহ তাহার জ্ঞান,
সর্বজ্ঞ তিনি সে সনাতন ।
নিয়ন্তা সে অতি সূক্ষ্ম, বিধাতা সে অন্তরীক্ষ,
অগোচর জড় বুদ্ধি মন ॥
যে জন স্মরণ করে, নিত্য সেই পুরুষেরে,
আদিত্যের ন্যায় স্বপ্রকাশ ।
প্রকৃতির পরপারে, যে জানে সে বিধাতারে,
স্বরাট তিনি চিদ্ বিলাস |
অনুবাদঃ সর্বজ্ঞ, সনাতন, নিয়ন্তা, সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর, সকলের বিধাতা, জড় বুদ্ধির অতীত, অচিন্ত্য ও পুরুষরূপে পরমেশ্বর ভগবানের ধ্যান করা উচিত। তিনি সূর্যের মতো জ্যোতির্ময় এবং এই জড়া প্রকৃতির অতীত।
তাৎপর্যঃ কিভাবে ভগবানের কথা চিত্র করতে হয়, সেই কথা এই শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে প্রথম কথা হচ্ছে যে, তিনি নির্বিশেষ বা শূনা নন। নির্বিশেষ অথবা শূন্যের ধ্যান করা যায় না। সেটি অত্যন্ত কঠিন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে চিন্তা করার পন্থা খুবই সহজ এবং এখানে বাস্তব সম্মত ভাবেই তা বর্ণনা করা হয়েছে। সর্বপ্রথমে জানতে হবে যে, ভগবান হচ্ছেন ‘পুরুষ’ বা একজন ব্যক্তি- আমরা পুরুষ রাম ও পুরুষ কৃষ্ণের চিন্তা করি। তাঁকে শ্রীরাম অথবা শ্রীকৃষ্ণ যেভাবেই চিন্তা করি, তাঁর রূপ কেমন, ভগবদ্গীতার এই শ্লোকটিতে তারই বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে ভগবানকে কবি বলা হয়েছে, তার মানে তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সব কিছুই জানেন। তিনি হচ্ছেন আদিপুরুষ, কারণ তিনি হচ্ছেন সব কিছুর উৎস, সব কিছুই তাঁর থেকে উদ্ভূত হয়েছে। তিনি সমস্ত জগতের পরম নিয়ন্তা, পালনকর্তা এবং সমগ্র মানব সমাজের উপদেষ্টা। তিনি সূক্ষ্ম থেকে সুন্নতর। জীবাত্মার আয়তন হচ্ছে কেশের অগ্রভাগের দশ হাজার ভাগের এক ভাগ, কিন্তু ভগবান এমনই সূক্ষ্ম যে, তিনি সেই জীবাত্মারও অন্তরে প্রবেশ করেন। তাই, তাকে সুন্নতম থেকেও সূক্ষ্মতর বলা হয়। পরমেশ্বর ভগবান রূপে তিনি পরমাণুর মধ্যে প্রবেশ করেন, অণুসদৃশ জীবের অন্তরে প্রবেশ করেন এবং পরমাত্মারূপে তাদের পরিচালিত করেন। যদিও তিনি মৃদু, তবুও তিনি সর্বব্যাপ্ত এবং তিনিই সব কিছুর পালনকর্তা। তাঁরই পরিচালনায় জড় জগতের অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্রগুলি পরিচালিত হচ্ছে। আমরা প্রায়ই অবাক হয়ে ভাবি যে, কিভাবে এই বিরাট বিরাট গ্রহ-নক্ষত্রগুলি আকাশে ভেসে আছে। এখানে বলা হচ্ছে যে, পরমেশ্বর ভগবান তাঁর অচিন্ত্য শক্তির প্রভাবে এই সমস্ত বিশাল বিপুলাকৃতি গ্রহ-নক্ষত্রমণ্ডলীকে ধরে রেখেছেন। এই প্রসঙ্গে অচিন্ত শব্দটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ভগবানের শক্তি আমাদের কল্পনার এবং চিন্তারও অতীত, তাই তা অচিন্তা। এই কথা কে অস্বীকার করতে পারে? তিনি সমগ্র জড় জগতে পরিব্যাপ্ত, কিন্তু তবুও তিনি এই জড় জগতের অতীত। এই জড় জগৎ সম্বন্ধেই আমাদের কোন ধারণা নেই এবং অপ্রাকৃত জগতের তুলনায় এই জড় জগৎ অত্যন্ত নগণ্য। তা হলে এই জগতের অতীত সেই অপ্রাকৃত জগতের কথা আমরা কিভাবে চিন্তা করব? অচিন্ত মানে হচ্ছে, যা এই জড় জগতের অতীত, যা দার্শনিক অনুমান, তর্ক, যুক্তি আদির দ্বারা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। তাই যে বুদ্ধিমান তাঁর কর্তব্য হচ্ছে, সব রকমের যুক্তি- তর্ক, জল্পনা-কল্পনা বাদ দিয়ে বেদ, ভগবদ্গীতা, শ্রীমদ্ভাগবত আদি শাস্ত্রে যা বলা হয়েছে, তাকে সত্য বলে মেনে নিয়ে তার অনুসরণ করা। তা হলেই সেই অপ্রাকৃত তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারা যায়।