শ্লোকঃ ৪
অধিভূতং ক্ষরো ভাবঃ পুরুষশ্চাধিদৈবতম।
অধিযজ্ঞোহহমেবাত্র দেহে দেহভৃতাং বর ॥ ৪ ॥
অধিভূতম্—অধিভুত; ক্ষরঃ — নিয়ত পরিবর্তনশীল; ভাবঃ – ভাব; পুরুষঃ সূর্য, চন্দ্ৰ আদি সমস্ত দেবতাদের সমষ্টিরূপ বিরাট পুরুষ; চ–এবং অধিদৈবতম্ — অধিদৈব বলা হয়, অধিযজ্ঞঃ—পরমাত্মা; অহম্ — আমি (শ্রীকৃষ্ণ); এর—অবশ্যই; অত্র— এই; দেহে—শরীরে; দেহভৃতাম্ – দেহধারীদের মধ্যে, বর– শ্রেষ্ঠ।
গীতার গান
পদার্থ যে অধিভূত ক্ষর ভাব নাম ।
বিরাট পুরুষ সেই অধিদৈব নাম ॥
অন্তর্যামী আমি সেই অধিযজ্ঞ নাম ৷
যত দেহী আছে তার হৃদে মোর ধাম ।।
অনুবাদঃ হে দেহধারীশ্রেষ্ঠ! নশ্বর জড়া প্রকৃতি অধিভূত। সূর্য, চন্দ্ৰ আদি সমস্ত দেবতাদের সমষ্টিরূপ বিরাট পুরুষকে অধিদৈব বলা হয়। আর দেহীদের দেহান্তর্গত অন্তর্যামী রূপে আমিই অধিযজ্ঞ ।
তাৎপর্যঃ প্রতিনিয়তই প্রকৃতির পরিবর্তন হচ্ছে। জড় শরীর সাধারণত ছয়টি অবস্থা প্রাপ্ত হয়— তার জন্ম হয়, বৃদ্ধি হয়, কিছুকালের জন্য স্থায়ী হয়, প্রজনন করে, ক্ষীণ হয় এবং অবশেষে বিনাশ প্রাপ্ত হয়। এই জড়া প্রকৃতিকে বলা হয় অধিভূত। এক সময় এর সৃষ্টি হয় এবং কোন এক সময় এর বিনাশ হয়। ভগবানের বিশ্বরূপ, যাতে সমস্ত দেব-দেবীরা ও তাঁদের নিজস্ব লোকসমূহ অবস্থিত, তাকে বলা হয় অধিদৈবত। শ্রীকৃষ্ণের আংশিক প্রকাশ পরমাত্মা, যিনি অন্তর্যামীরূপে প্রতিটি জীবের হৃদয়ে বিরাজ করেন, তাঁকে বলা হয় অধিযজ্ঞ। এই শ্লোকের এর শব্দটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই শব্দটির দ্বারা ভগবান এখানে দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করছেন যে, এই পরমাত্মা তাঁর থেকে অভিন্ন। পরমাত্মারূপে ভগবান প্রতিটি জীবের সঙ্গে থেকে তাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে চলেন এবং তিনি হচ্ছেন তাদের বিবিধ চেতনার উৎস। পরমাত্মা জীবকে স্বাধীনভাবে কর্ম করার সুযোগ দেন এবং তার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করেন। ভগবানের এই সমস্ত বিভিন্ন প্রকারের তত্ত্ব কৃষ্ণভাবনাময় ভগবৎ-সেবা পরায়ণ শুদ্ধ ভক্তের কাছে আপনা থেকেই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভগবদ্ভক্তির প্রাথমিক স্তরে কনিষ্ঠ ভক্ত অধিদৈবত নামক ভগবানের সুমহান বিশ্বরূপের ধান করে, কারণ তখন সে ভগবানের পরমাত্মা রূপকে উপলব্ধি করতে পারে না। তাই, কনিষ্ঠ ভক্তকে ভগবানের বিশ্বরূপের অথবা বিরাট পুরুষের ধ্যান করতে উপদেশ দেওয়া হয়, যাঁর পদদ্বয় হচ্ছে পাতাললোক, যার চক্ষুদ্বয় হচ্ছে সূর্য ও চন্দ্র এবং যাঁর মস্তক হচ্ছে ঊর্ধ্বলোক।
শ্লোকঃ ৫
অন্তকালে চ মামেব স্মরন্মুক্তা কলেবরম্ ।
যঃ প্রয়াতি স মদ্ভাবং যাতি নাস্ত্যত্র সংশয়ঃ ।। ৫ ।।
অন্তকালে —অন্তিম সময়ে: চ–ও; মাম্― আমাকে; এর— অবশ্যই; স্মরণ – স্মরণ করে; মুক্তা ত্যাগ করে; কলেবরম্ — দেহ; যঃ – যিনি; প্রয়াতি – প্রয়াণ করেন; সঃ—তিনি; মদ্ভাবম্—আমার স্বভাব, যাতি – লাভ করেন, নাস্তি— নেই; অত্র— এখানে; সংশয়ঃসন্দেহ।
গীতার গান
অতএব অন্তকালে আমারে স্মরিয়া ।
যেবা চলি যায় এই শরীর ছাড়িয়া ॥
সে পায় আমার ভাব অমর সে হয় ৷
নিশ্চয়ই কহিনু এই নাহিত সংশয় ॥
অনুবাদঃ মৃত্যুর সময়ে যিনি আমাকে স্মরণ করে দেহত্যাগ করেন, ভাবই প্রাপ্ত হন। এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে কৃষ্ণভাবনামৃতের গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে দেহত্যাগ করলে তৎক্ষণাৎ ভগবৎ-ধামে প্রবেশ করা যায়। পরমেশ্বর ভগবান সকল শুদ্ধ সত্তার মধ্যে শুদ্ধতম। সুতরাং, নিরন্তর কৃষ্ণভাবনায় মগ্ন থাকলে শুদ্ধ সত্তার মধ্যে শুদ্ধতম হয়ে ওঠা যায়। এখানে স্মরণ শব্দটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে সমস্ত জীবেরা অশুদ্ধ, যারা কখনও ভগবদ্ভক্তি সাধন করেনি, তাদের পক্ষে ভগবানকে স্মরণ করা সম্ভব নয়। তাই, জীবনের সূচনা থেকেই কৃষ্ণভাবনার অনুশীলন করা উচিত। জীবনের শেষে সার্থকতা অর্জন করতে হলে শ্রীকৃষ্ণের স্মরণ অপরিহার্য। সেই জন্য শ্রীকৃষ্ণকে মনে রাখতে হলে সর্বক্ষণ অবিরামভাবে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে / হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে কীর্তন করতে হয়। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু উপদেশ দিয়েছেন। যে, প্রত্যেকের তরুর মতো সহিষ্ণু হওয়া উচিত (তরোরিব সহিষ্ণুনা)। যে ব্যক্তি হরে কৃষ্ণ কীর্তন করবেন, তাঁর অনেক রকম বাধাবিঘ্ন আসতে পারে। তা সত্ত্বেও, এই সমস্ত বাধা-বিঘ্নগুলিকে সহ্য করে তাঁকে অনবরত হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে—কীর্তন করে যেতে হবে, যাতে জীবনের অন্তিমকালে তিনি কৃষ্ণভাবনামৃতের পূর্ণ ফল লাভ করতে পারেন।
শ্লোকঃ ৬
যং যং বাপি স্মরন্ ভাবং ত্যজত্যন্তে কলেবরম্ ।
তং তমেবৈতি কৌন্তেয় সদা তদ্ভাবভাবিতঃ ॥ ৬॥
যম্ যম্ — যেমন যেমন; বাবা; অপি—ও; স্মরন— স্মরণ করে; ভাবা+ভাব; তাজতি — ত্যাগ করেন; অস্তে – অন্তিমকালে কলেবরম্ — দেহ; তম্ ভম্—সেই সেই; এব— অবশ্যই; এতি — প্রাপ্ত হন; কৌন্তেয় – হে কুত্তীপুত্র, সদা সর্বদা; তৎ—সেই; ভাব—ভাব; ভাবিতঃ – তন্ময়চিত্র।
গীতার গান
যে যেই স্মরণ করে জীব অন্তকালে ৷
যেভাবে সে ত্যাজে নিজ জড় কলেবরে ॥
সেই সেই ভাবযুক্ত তত্ত্ব লাভ করে ।
হে কৌন্তেয় থাকি সদা সেই ভাব ঘরে ৷।
অনুবাদঃ অন্তিমকালে যিনি যে ভাব স্মরণ করে দেহত্যাগ করেন, তিনি সেই ভাবে ভাবিত তত্ত্বকেই লাভ করেন।
তাৎপর্যঃ মৃত্যুর সংকটময় মুহূর্তে কিভাবে জীবের প্রকৃতির পরিবর্তন হয়, সেই কথা এখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যে মানুষ দেহত্যাগ করবার সময়ে কৃষ্ণচিন্তা করে, সে পরমেশ্বর ভগবানের পরা প্রকৃতি অর্জন করে। কিন্তু এই কথা ঠিক নয় যে, শ্রীকৃষ্ণ বিহীন অন্য কিছু চিন্তা করলেও সেই পরা প্রকৃতি অর্জন করা যায় । এই বিষয়টি আমাদের বিশেষ যত্ন সহকারে অনুধাবন করতে হবে। কিভাবে উপযুক্ত মনোভাবে আবিষ্ট হয়ে দেহত্যাগ করা যায়? এক মহান ব্যক্তি হয়েও মৃত্যুর সময় মহারাজ ভরত হরিণের কথা চিন্তা করেছিলেন, তাই তাঁর পরবর্তী জীবনে তিনি হরিণ-শরীর প্রাপ্ত হন। হরিণরূপে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও মহারাজ ভরত তাঁর পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করতে পেরেছিলেন, কিন্তু তাঁকে পশুর শরীর গ্রহণ করতে হয়েছিল। স্বভাবতই, জীবিত অবস্থায় আমরা যে সমস্ত চিন্তা করে থাকি, সেই অনুযায়ী আমাদের মৃত্যুকালীন চিন্তার উদয় হয়। সুতরাং, এই জীবনই সৃষ্টি করে আমাদের পরবর্তী জীবন। কেউ যদি সর্বক্ষণ শুদ্ধ সাত্ত্বিকভাবে জীবন যাপন করেন এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত সেবায় ও চিন্তায় মগ্ন থাকেন, তা হলে তাঁর পক্ষে জীবনের অন্তিমকালে কৃষ্ণচিন্তা করা সম্ভব। সেটিই তাঁকে শ্রীকৃষ্ণের পরা প্রকৃতিতে স্থানান্তরিত করতে সাহায্য করবে। শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত সেবায় মগ্ন হয়ে থাকলে, পরবর্তী জীবনে অপ্রাকৃত শরীর ধারণের সৌভাগ্য অর্জিত হয়। তাকে আর জড় দেহ ধারণ করতে হয় না। তাই, হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে—এই মহামন্ত্র কীর্তন করাই হচ্ছে জীবনের অন্তিমকালে ভাব পরিবর্তনের সফলতম শ্রেষ্ঠ উপায়।