অষ্টম অধ্যায়

অক্ষরব্রহ্ম যোগ

শ্লোকঃ ১

অর্জুন উবাচ

কিং তদ্ ব্রহ্ম কিমধ্যাত্মং কিং কর্ম পুরুষোত্তম ।

অধিভূতং চ কিং প্রোক্তমধিদৈবং কিমুচ্যতে ॥ ১॥

অর্জুনঃ উবাচ—অর্জুন বললেন; কিম্—কি; তৎ- সেই; ব্রহ্ম — ব্রহ্ম; কিম্‌ কিং অধ্যাত্মম্—আত্মা; কিম্ – কি; কর্ম-কর্ম, পুরুষোত্তম – হে পুরুষোত্তম, অধিভূতম্ — জড়-জাগতিক প্রকাশ; চ—এবং কি — কি. প্রোক্তম্—বলা হয়; অধিদৈবম্—দেবতাগণ; কিম্ — কি; উচ্যতে—বলা হয়।

গীতার গান

অর্জুন কহিলেনঃ

ব্রহ্ম কিংবা অধ্যাত্ম কি কর্ম পুরুষোত্তম ।

অধিভূত অধিদৈব কহ তার ক্রম ৷।

অনুবাদঃ অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন- হে পুরুষোত্তম ! ব্রহ্ম কি? অধ্যাত্ম কি? কর্ম কি? অধিভূত ও অধিদৈবই বা কাকে বলে? অনুগ্রহপূর্বক আমাকে স্পষ্ট করে বল।

তাৎপর্যঃ এই অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মতত্ত্ব থেকে শুরু করে অর্জুনের বিবিধ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তিনি এখানে কর্ম, সকাম কর্ম, ভক্তিযোগ, যোগের পন্থা ও শুদ্ধ ভক্তির ব্যাখ্যা করেছেন। শ্রীমদ্ভাগবতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, পরমতত্ত্ব ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবান, এই নামে অভিহিত হন। তা ছাড়া, স্বতন্ত্র জীবাত্মাকেও ব্রহ্ম বলা হয়। অর্জুন ভগবানের কাছে আত্মা সম্বন্ধেও প্রশ্ন করেন। আত্মা বলতে দেহ, আত্মা ও মনকে বোঝায়। বৈদিক অভিধান অনুসারে আত্মা বলতে মন, আত্মা, দেহ ও ইন্দ্রিয়গুলিকে বোঝায়।

অর্জুন এখানে ভগবানকে পুরুষোত্তম বলে সম্বোধন করেছেন, অর্থাৎ এই প্রশ্নগুলি তিনি শুধু মাত্র এক বন্ধুকে করছেন তা নয়, তাঁকে পরমেশ্বর ভগবান জেনে তিনি এই প্রশ্নগুলি করেছেন, যিনি সেই প্রশ্নগুলির যথাযথ উত্তর দানে পরম অধিকর্তা।

শ্লোকঃ ২

অধিযজ্ঞঃ কথং কোহত্র দেহেহস্মিন্মধুসূদন ।

প্রয়াণকালে চ কথং জ্ঞেয়োহসি নিয়তাত্মভিঃ ॥ ২॥

অধিযজ্ঞঃ—যজ্ঞের অধিষ্ঠাতা; কথম্ — কিভাবে; কঃ-কে; অত্র — এখানে; দেহে—শরীরে, অস্মিন্ এই মধুসূদন – হে মধুসূদন; প্রয়াণকালে মৃত্যুর সময়: চ―এবং কথম—কিভাবে; জ্ঞেয়ঃ— জ্ঞাত; অসি হও, নিয়তাত্মভিঃ- আত্ম- সংযমীর দ্বারা।

গীতার গান

অধিযজ্ঞ কিবা সেই হে মধুসূদন ।

কিভাবে তোমাকে পায় প্রয়াণ যখন ॥

অনুবাদঃ হে মধুসূদন। এই দেহে অধিযজ্ঞ কে, এবং এই দেহের মধ্যে তিনি কিরূপে অবস্থিত? মৃত্যুকালে জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিরা কিভাবে তোমাকে জানতে পারেন ?

তাৎপর্যঃ শ্রীবিষ্ণু ও ইন্দ্র উভয়কেই যজ্ঞের অধীশ্বররূপে গণ্য করা হয়। শ্রীবিষ্ণু হচ্ছেন সমস্ত মুখ্য দেবতাদের, এমন কি ব্রহ্মা ও শিবেরও অধীশ্বর এবং যে সমস্ত দেব-দেবী প্রকৃতির পরিচালনা কার্যে সহায়তা করেন, ইন্দ্র তাঁদের মধ্যে প্রধান দেবতা। যজ্ঞ অনুষ্ঠানে শ্রীবিষ্ণু ও ইন্দ্র উভয়েরই উপাসনা করা হয়। কিন্তু এখানে অর্জুন জিজ্ঞাসা করছেন যে, যজ্ঞের প্রকৃত অধীশ্বর কে এবং কিভাবে তিনি জীবের দেহে অবস্থান করেন।

অর্জুন এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে মধুসূদন নামে সম্বোধন করেছেন, কারণ শ্রীকৃষ্ণ একদা মধু নামক এক অসুরকে সংহার করেছিলেন। অর্জুন কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্ত, তাই তার মনে এই সমস্ত সংশয়জনক প্রশ্নের উদয় হওয়া উচিত নয় । সুতরাং অর্জুনের মনের এই সংশয়গুলি অসুরের মতো; আর শ্রীকৃষ্ণ যেহেতু অসুর সংহার করার ব্যাপারে অত্যন্ত পারদর্শী, তাই অর্জুন তাঁকে মধুসূদন নামে সম্বোধন করেছেন, যাতে তিনি তাঁর মনের সমস্ত আসুরিক সন্দেহগুলি সমুলে বিনাশ করেন।

এই শ্লোকে প্রয়াণকালে কথাটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, আমাদের সারা জীবনে আমরা যা কিছুই করি, তার পরীক্ষা হয় আমাদের মৃত্যুর সময়। অর্জুনের মনে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে, মৃত্যুর সময় কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্তেরা ভগবানের কথা স্মরণ করতে পারেন কি না, কারণ মৃত্যুর সময় দেহের সমস্ত ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় এবং মন তখন স্বাভাবিক অবস্থায় নাও থাকতে পারে। এভাবেই দেহের অস্বাভাবিক অবস্থায় বিচলিত হয়ে, তখন পরমেশ্বরকে স্মরণ করা সম্ভব না-ও হতে পারে। তাই, মহাভাগবত মহারাজ কুলশেখর ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছেন, “হে ভগবান! আমার শরীর এখন সুস্থ এবং এখনই যেন আমার মৃত্যু হয়, যাতে আমার মনরূপী রাজহংস তোমার শ্রীচরণকমল লতার আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে।” এখানে এই উপমার অবতারণা করা হয়েছে, কারণ রাজহংস যেমন কমল-কর্ণিকায় প্রবেশ করে আনন্দিত হয়, তেমনই শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তের মনরূপী রাজহংস ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় লাভ করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। মহারাজ কুলশেখর পরমেশ্বরকে জানাচ্ছেন, “এখন আমার মন অবিচলিত রয়েছে, আর আমি সম্পূর্ণ সুস্থ রয়েছি। যদি আমি এখনই তোমার চরণপদ্ম স্মরণ করে মৃত্যু বরণ করি, তা হলে আমি নিশ্চিত হব যে, তোমার প্রতি আমার প্রেমভক্তি সার্থকতা লাভ করবে। কিন্তু যদি আমার স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হয়, তা হলে কি যে ঘটবে তা আমি জানি না, কারণ সেই সময়ে আমার শারীরিক ক্রিয়াকলাপ বিঘ্নিত হবে, আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যাবে, আর তাই, আমি জানি না, আমি তোমার নাম জপ করতে পারব কি না। তাই, এখনই এই মুহূর্তে আমার মৃত্যু হোক।” অর্জুন তাই প্রশ্ন করছেন— মৃত্যুর সময় কিভাবে মনকে শ্রীকৃষ্ণের চরণকমলে একাগ্র রাখা যায়।

শ্লোকঃ ৩

শ্রীভগবানুবাচ

অক্ষরং ব্রহ্ম পরমং স্বভাবোহধ্যাত্মমুচ্যতে ।

ভূতভাবোদ্ভবকরো বিসর্গঃ কর্মসংজ্ঞিতঃ ॥ ৩ ॥

শ্রীভগবান্ উবাচ— পরমেশ্বর ভগবান বললেন; অক্ষরম্– বিনাশ-রহিত, ব্রহ্ম ণ; পরমম্ — পরম; স্বভাবঃ— নিতা স্বভাব, অধ্যাত্মম্ – অধ্যায়, উচ্যতে – বলা হয়; ভুতভাবোদ্ভবকরঃ-জীবের জড় দেহের উৎপত্তিকর; বিসর্গঃ – সৃষ্টি; কর্ম-কর্ম, সংজ্ঞিতঃ–কথিত হয়।

গীতার গান

শ্রীভগবান কহিলেনঃ

অক্ষয় বিনাশ নাই অতএব ব্ৰহ্ম ।

আমি ভগবান সেজন্য পরম ব্রহ্ম ।।

পরমাত্মা আর যে ভগবান ।

সেই যে পরমতত্ত্ব সেই ব্ৰহ্মজ্ঞান ৷।

কর্ম সে কারণ জড় শরীর বিসর্গ ।

ভূতোদ্ভব যার নাম শুন তার বর্গ ৷৷

অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন — নিত্য বিনাশ-রহিত জীবকে বলা হয় ব্রহ্ম এবং তার নিত্য স্বভাবকে অধ্যাত্ম বলে। ভূতগণের উৎপত্তি ও বৃদ্ধিকর সংসারই কর্ম।

তাৎপর্যঃ ব্রহ্মা অবিনশ্বর, নিতা শাশ্বত ও অপরিবর্তনীয়। কিন্তু এই ব্রহ্ম্যেরও অতীত হচ্ছে পরব্রহ্মা। ব্রহ্ম বলতে জীবকে বোঝায় এবং পরবনা বলতে পরম পুরুষোত্তম শ্রীভগবানকে বোঝায়। জীবের স্বরূপ জড় জগতে তার যে স্থিতি তার থেকে ভিন্ন। জড় চেতনায় জীব জড় জগতের উপর আধিপত্য করতে চায়। কিন্তু পারমার্থিক কৃষ্ণভাবনায় তার স্থিতি হচ্ছে নিরন্তর ভগবানের সেবা করা। জীব যখন জড় চেতনায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে, তখন তাকে জড় জগতে নানা রকম দেহ ধারণ করতে হয়। তাকে বলা হয় কর্ম, অর্থাৎ জড় চেতনার প্রভাবে উৎপন্ন নানাবিধ সৃষ্টি।

বৈদিক সাহিত্যে জীবকে বলা হয় জীবাত্মা ও ব্রহ্ম, কিন্তু কখনই তাকে পরব্রহ্ম বলা হয় না। জীবাত্মা বিভিন্ন অবস্থায় পতিত হয়—কখনও সে অন্ধকারাচ্ছন্ন জড়া প্রকৃতিতে পতিত হয়ে নিজেকে সে জড় পদার্থ বলে মনে করে, আবার কখনও সে নিজেকে উৎকৃষ্ট, পরা প্রকৃতির অন্তর্গত বলে মনে করে। তাই, তাকে ভগবানের তটস্থা শক্তি বলে বর্ণনা করা হয়। অপরা ও পরা প্রকৃতিতে তার স্থিতি অনুসারে সে পঞ্চভৌতিক জড় দেহ অথবা চিন্ময় দেহ প্রাপ্ত হয়। সে যখন নিজেকে জড় পদার্থ বলে মনে করে জড়া প্রকৃতিতে আবদ্ধ থাকে, তখন সে চুরাশি লক্ষ বিভিন্ন শরীরের কোনও একটি প্রাপ্ত হয়। কিন্তু পরা প্রকৃতিতে তার রূপ একটি। জড়া প্রকৃতিতে সে তার কর্ম অনুসারে মানুষ, দেবতা, পশু, পাখি আদির শরীর প্রাপ্ত হয়। স্বর্গলোকে নানা রকম সুখস্বাচ্ছন্দা ভোগ করার জন্য সে কখনও কখনও যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করে, কিন্তু তার সেই পুণ্য-কর্মফলগুলি যখন শেষ হয়ে যায়, তখন সে এই পৃথিবীতে পতিত হয়ে আবার মনুষ্যদেহ ধারণ করে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় কর্ম ।

ছান্দোগ্য উপনিষদে বৈদিক যাগযজ্ঞের পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। যজ্ঞের বেদিতে পাঁচ রকমের অগ্নিকুণ্ডে পাঁচ রকমের অর্ধা দান করা হয়। পঞ্চবিধ অগ্নিকুণ্ডকে বিভিন্ন স্বর্গলোক, মেঘ, পৃথিবী, নর ও নারীরূপে ধারণা করা হয় এবং পঞ্চবিধ যাজ্ঞিক অর্ঘ্যগুলি হচ্ছে বিশ্বাস, চন্দ্রলোকের ভোক্তা, বৃষ্টি, শস্য ও বীর্য ।

বিভিন্ন যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে ক্রমে ক্রমে জীবাত্মা বিভিন্ন স্বৰ্গলোকে গমন করতে পারে। তারপর সেই যজ্ঞের ফলে অর্জিত পুণ্য কর্মফল যখন শেষ হয়ে যায়, তখন সে বৃষ্টির মাধ্যমে এই পৃথিবীতে পতিত হয়, তারপর সে শস্যকণায় পরিণত হয়। মানুষ সেই শস্য আহার করে এবং তা বীর্যে পরিণত হয়, তারপর সেই বীর্য স্ত্রীযোনিতে সঞ্চারিত হয়ে গর্ভবতী করে। এভাবেই জীবাত্মা আবার মনুষ্য-শরীর প্রাপ্ত হয়ে যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করে। এভাবেই জীব প্রতিনিয়ত এই জড় জগতে গমনাগমন করতে থাকে। কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্ত অবশ্য এই ধরনের যজ্ঞ অনুষ্ঠান পরিহার করেন। তিনি সরাসরিভাবে কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্তির পন্থা অবলম্বন করেন এবং ভগবানের কাছে ফিরে যাওয়ার আয়োজন করেন।

নির্বিশেষবাদীরা অযৌক্তিকভাবে গীতার ব্যাখ্যা করে অনুমান করে যে, ব্রহ্ম জড় জগতে জীবরূপ ধারণ করে এবং তার প্রমাণস্বরূপ তারা গীতার পঞ্চদশ অধ্যায়ের সপ্তম শ্লোকের অবতারণা করে। কিন্তু এই শ্লোকে জীবাত্মা সম্পর্কে পরমেশ্বর এই কথাও বলেছেন যে, “আমারই নিত্য ভিন্ন অংশ”। ভগবানের অণুসদৃশ অংশ জীবাত্মা জড় জগতে পতিত হতে পারে, কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান (অচ্যুত) কখনও পতিত হন না। তাই পরমব্রহ্ম জীবে পরিণত হন এই অনুমান গ্রহণযোগ্য নয়। বৈদিক সাহিত্যে ব্রহ্মা (জীবাত্মা ও পরম ব্রহ্মকে (পরমেশ্বরকে কখনই এক বলে বর্ণনা করা হয়নি, সেই কথা আমাদের মনে রাখা উচিত।

error: Content is protected !!