আমি একবার একটা ভাতের হোটেল দিয়েছিলাম। নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে হোটেলের নাম–আহমেদিয়া হোটেল। আসুন, আপনাদের সেই হোটেলের গল্প বলি।
১৯৭১ সনের কথা। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়। রোজার মাস। থাকি মহসিন হলে ৫৬৪ নম্বর রুমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলি তখন ছাত্রদের জন্যে নিরাপদ বলে ভাবা হত। কারণ যারা এই সময়ে হলে থাকবে তারা অবশ্যই পাকিস্তান অনুরাগী। হলে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করছে। এরা সবাই শান্ত এবং সুবোধ ছেলে। মুক্তিবাহিনীতে না গিয়ে পড়াশোনা করছে। আমার তখন কোথাও থাকার জায়গা নেই। নানার বাড়ি মোহনগঞ্জে অনেক দিন লুকিয়ে ছিলাম। আর থাকা যাচ্ছে না। আমার নানাজান। দীর্ঘদিনের মুসলিম লীগ কর্মী। তখন শান্তি কমিটির সভাপতি হয়েছেন। নানাজানের শান্তি কমিটিতে যোগ দেবার ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করছি। আমি আমার নানাজনের জন্যে সাফাই গাইছি না। আমার সাফাইয়ের তাঁর প্রয়োজন নেই। তবু সুযোগ যখন পাওয়া গেল বলি। চারদিকে তখন ভয়ংকর দুঃসময়। আমার বাবাকে পাকিস্তানী মিলিটারী গুলি করে হত্যা করেছে। নানাজান আমাদের সুদূর বরিশালের গ্রাম থেকে উদ্ধার করে নিজের কাছে নিয়ে এসেছেন। তাও এক দফায় পারেননি। কাজটি করতে হয়েছে দু’বারে। তাঁর অনুপস্থিতিতেই তাকে শান্তি কমিটির সভাপতি করা হল। তিনি না বলতে পারলেন না। না বলা মানেই আমাদের দু ভাইয়ের জীবন সংশয়। আমাদের আশ্রয় সুরক্ষিত করার জন্যেই মিলিটারীদের সঙ্গে ভাব রাখা তিনি প্রয়োজন মনে করেছিলেন। তার পরেও আমার মা এবং আমার মামারা নানাজানের এই ব্যাপারটি সমর্থন করতে পারেননি। যদিও নানাজানকে পরামর্শ দিতে কেউ এগিয়ে আসেননি। সেই সাহস তাদের ছিল না। তারা নিজেদের সমর্পণ করেছিলেন নিয়তির হাতে। শান্তি কমিটিতে থাকার কারণে মিলিটারীদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কত মানুষের জীবন তিনি রক্ষা করেছেন সেই ইতিহাস আমি জানি এবং যারা আজ বেঁচে আছেন তাঁরা জানেন। গুলির মুখ থেকে নানাজানের কারণে ফিরে-আসা কিছু মানুষই পরবর্তী সময়ে তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁকে মরতে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। তাঁর মত অসাধারণ একজন মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মারা গেলেন, এই দুঃখ আমার রাখার জায়গা। নেই!
মিলিটারীরা নানাজানকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনি। হঠাৎ হঠাৎ অদ্ভুত সময়ে তার বাড়িতে উপস্থিত হয়। বাড়ি ঘুরেফিরে দেখে। একদিন তারা আমাদের দেখে ফেলল। ভুরু কুঁচকে বলল, এরা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র? দেখে তো সে রকমই মনে হয়। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ে না গিয়ে ঘরে বসে আছে কেন? নানাজান কোন সদুত্তর দিতে পারলেন না। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ঢাকায় পাঠাতে ভরসা পাচ্ছি না বলে আটকে রেখেছি। তবে শিগগিরই ঢাকা পাঠাব।
আমি নিজেও এক জায়গায় বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করে একটি চিঠি পাঠিয়েছি ৬ নম্বর সেক্টরের সালেহ চৌধুরীকে (দৈনিক বাংলার সালেহ চৌধুরী)। তিনি তখন ভাটি অঞ্চলে প্রবল। প্রতাপে মুক্তিবাহিনী নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তিনি আমার চিঠির জবাব দিলেন না। এটা অবশ্যি আমার জন্যে ভালই হয়েছে। মনের দিক থেকে আমি চাচ্ছি না জবাব আসুক। জবাব এলেই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে হবে, এবং অবধারিতভাবে মিলিটারীর গুলি। খেয়ে মরতে হবে। এত তাড়াতাড়ি মৃত্যুকে স্বীকার করে নেবার মত মানসিক প্রস্তুতি আমার ছিল না। আমি ভীতু হয়ে জন্মেছি।
কাজেই চলে এলাম ঢাকায়, উঠলাম হলে। বলা চলে, হাঁপ ছেড়ে বাচলাম। আমার অতি প্রিয়জন–আনিস ভাইও দেখি হলেই আছেন। আমার পাশের ঘরে থাকেন। ফিজিক্সে পড়াশোনা বাদ দিয়ে তিনি তখন সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা করেন, একটা চিত্রনাট্যও তৈরি করেছেন। তার একটা দামী ট্রানজিস্টার রেডিও আছে। সেই ট্রানজিস্টার রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা শোনা হয়। রাত যখন গম্ভীর হয় তখন আমরা চলে যাই ছ’তলায়। সেখানে দুটি ছেলে আছে (দু’ভাই)। তারা প্ল্যানচেটের বিষয়ে না-কি বিশেষজ্ঞ। তারা প্ল্যানচেটে ভূত নামায়। ভূতের মারফতে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। কবে দেশ স্বাধীন হবে, এইসব। প্ল্যানচেটে দেশী বিদেশী সবধরনের ভূত আসে। দেশী ভূতদের মধ্যে সবাই আবার ভুবন বিখ্যাত। তাদের ভূত না বলে আত্মা বলা উচিত। নয়ত তাদের অসম্মান হবে। যেমন রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী, শেরে বাংলা। এঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ খুবই মিশুক প্রকৃতির, ডাকলেই চলে আসেন। দেশ কবে স্বাধীন হবে জানতে চাইলে বলেন–ধৈর্য ধর। ধৈর্য ধরতে শেখ। দু থেকে তিন বছরের মধ্যেই স্বাধীনতা পাবে।
রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার উপর আমাদের আস্থা কম ছিল বলেই বোধহয় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকেও এক রাতে আনা হয়। তিনি এসেই আমাদের স্টুপিড, ননসেন্স বলে গালাগালি করতে থাকেন।
মোটের উপর আমাদের সময়টা ভাল কাটে। ভূত বিশেষজ্ঞ দুই ভাই পরকাল, আত্মা, সৃষ্টিকর্তা বিষয়ে নানান জ্ঞান দেয়, শুনতে মন্দ লাগে না। সবচে’ বড় কথা–মিলিটারী এসে ধরে নিয়ে মেরে ফেলবে, এই সার্বক্ষণিক ভয়ের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছি যার আনন্দ কম নয়। কষ্ট একটাই, খাওয়ার কষ্ট। রোজার সময় বলেই সব দোকান বন্ধ। হোটেল তো বন্ধই, চায়ের দোকানও বন্ধ। হলের মেসও বন্ধ। ধর্মীয় কারণে নয়, নিতান্ত বাধ্য হয়েই হলের অনেকেই রোজা রাখছে। সেখানেও বিপদ আছে। বিকেলে ইফতারী কিনতে নিউমার্কেট গিয়ে একজন মিলিশিয়ার হাতে বেধড়ক মার খেল। মিলিশিয়ার বক্তব্য–রোজার দিনে এই ছাত্র নাকি ‘ছোলা ভাজা খাচ্ছিল।
আমি নিজে ক্ষুধা সহ্য করতে পারি না। খিদে পেলেই চোখে অন্ধকার দেখি। অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরা প্রথম এবং শেষ রোজা রেখে রোজা বেঁধে ফেলার যে প্রক্রিয়া করে, আমি তা-ও পারি না। প্রথম রোজাটা রাখি–শেষটা রাখি না, সম্ভব হয় না।
আমি মহাবিপদে পড়লাম। দুপুরে চিনি দিয়ে পাউরুটি খাই–খিদে যায় না। সারাক্ষণ খিদে লেগে থাকে। একদিন দোকান থেকে একটা হিটার কিনে আনলাম, টিনের বাটিতে কিছু চাল ফুটিয়ে নিলাম। ডিম ভাজলাম। লবণ কেনা হয়নি–লবণহীন ডিম ভাজা দিয়ে ভাত খেলাম। অমৃতের মত লাগল। আনিস ভাই এসে আমার সঙ্গে যোগ দিলেন। পরের দিন ভূত বিশেষজ্ঞ দুই ভাই এসে উপস্থিত। তারা জানতে চায়, তাদের কাছে এলুমিনিয়ামের একটা বড় সসপ্যান আছে, আমরা সেটা চাই কি-না।
আমি বললাম, অবশ্যই চাই।
তখন দুই ভাই মাথা চুলকে বলল, তারা কি আমার সঙ্গে খেতে পারবে? খরচ যা লাগবে দেবে। তারাও নাকি দুপুরে পাউরুটি খেয়ে আছে।
আমি বললাম–অবশ্যই খেতে পারবে।
চতুর্থ দিনে আমাদের সদস্য সংখ্যা হল দশ। অতি সস্তায় দুপুরের খাওয়া। ভাত ডাল এবং ডিম ভাজি। সবাই খুব মজা পেয়ে গেল। আসলে কারোরই তখন কিছু করার নেই। বিশ্ববিদ্যালয় নামে মাত্র খোলা, কেউ সেখানে যায় না। সবাইকে হলে বন্দী থাকবে হয়। বন্দি জীবনে বৈচিত্র্য হল এই রান্নাবান্না খেলা। আমরা একদিন একটা বড়
ফুলস্কেপ কাগজে লিখলাম–
আহমেদিয়া ভাতের
হোটেল ভাত এক টাকা। ডাল আট আনা। ডিম এক টাকা।
হোটেলের নিয়মাবলী :
১. যাহারা খাদ্য গ্রহণ করিবেন, তাঁহারা সকাল দশটার মধ্যে নাম এন্ট্রি করাইবেন।
২ খাওয়ার সময় ভাত নরম না শক্ত এই বিষয়ে কোন মতামত দিতে পারিবেন না।
ফুলস্কেপ কাগজে আমার ঘরের দরজায় আঠা দিয়ে সেঁটে দেয়া হল।
এক রোববারে ইমপ্রুভ ডায়েটের ব্যবস্থা হল। ভূনা খিচুড়ি এবং ডিম ভাজা। ভূনা খিচুড়ি কি করে রাখতে হয় তখন জানি না। ভূত বিশেষজ্ঞ দুই ভাই বলল, তারা জানে–খিচুড়ি তারা বঁধবে। এই বিষয়ে কাউকে কোন চিন্তা করতে হবে না। শুধু খিচুড়ি না–তারা নাকি ‘কলিজিও ব্রাধবে।
সকাল থেকে রান্নার আয়োজন শুরু হল। সদস্যদের আগ্রহের সীমা নেই। রান্না শেষ হতে হতে দুটো বেজে গেল। আমরা খেতে বসব, তখন হঠাৎ একজন ছুটে এসে বলল, মিলিটারী হল ঘেরাও করে ফেলেছে। আমরা হতভম্ব। হল কেন ঘেরাও করবে? হল তো খুব নিরাপদ হবার কথা। দেখতে দেখতে হলে মিলিটারী ঢুকে পড়ল। ভেড়ার পালের মত আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে গেল নিচে। সবাইকে লাইন বেঁধে দাঁড় করালো। আমরা আতংকে জমে গেলাম। কি হচ্ছে এসব? সব মিলে চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ জন ছাত্র। হলের কিছু কর্মচারী। হলের সামনে সাক্ষাত মৃত্যুদূতের মত একটি মিলিটারি জীপ, একটি ট্রাক এবং মুড়ির টিন জাতীয় গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। মুড়ির টিন গাড়িটির দরজা-জানালা সব বন্ধ। তবে ভেতরে লোক আছে। কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। গাড়ির একটি ছোট্ট জানালা আধখোলা। জানালার ওপাশে কেউ একজন বসে আছে। বাইরে থেকে আমরা তাকে দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের বলা হল লাইন বেঁধে সেই জানালার সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে। জানালার সামনে দিয়ে যাবার সময়–গাড়ির ভেতরে বসা কেউ একজন হঠাৎ বলে বসে–একে আলাদা কর। তাকে আলাদা করা হয়। এইভাবে চারজনকে আলাদা করা হল। তিন জন ছাত্র। একজন হলের কর্মচারী। তিনজন ছাত্রের মধ্যে একজন আমি।
কি সর্বনাশ! এখন কি করি। মিলিটারী ধরে নিয়ে যাওয়ার নাম তো নিশ্চিত মৃত্যু। এত তাড়াতাড়ি মরে যাব?
আমাদের খোলা ট্রাকে তোলা হল। মিলিটারীরা আমাদের নিয়ে রওনা হল। আমি হলের দিকে তাকালাম, আমার বন্ধুদের দিকে তাকালাম–আমি জানি–এই হল, বন্ধুদের প্রিয় মুখ আমি আর কখনো দেখতে পাব না।
আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হল আণবিক শক্তি কমিশন ভবনে। ঐ ভবনটি তখন মিলিটারীদের অস্থায়ী ঘাটির একটি। সেখানে পৌঁছে জানতে পারলাম–আমাদের সবার বিরুদ্ধেই সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, আমরা দেশদ্রোহী। ঢাকায় গেরিলা বাহিনীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে–কি ভয়ানক অবস্থা। সেখান থেকে জীপে করে
আমাদের পাঠানো হল বন্দি শিবিরে। বিরাট একটা হলঘরের মত জায়গায় আমাদের। রাখা হল। আরো অনেকেই সেখানে আছেন। সবার চোখেই অদ্ভুত এক ধরনের ছায়া। সম্ভবত মৃত্যুর ছায়া। তারা তাকাচ্ছে, কিন্তু মনে হচ্ছে কিছু দেখছে না। মানুষের প্রধান যে বৈশিষ্ট্য–কৌতূহল–সেই কৌতূহলের কিছুই তাদের চোখে নেই। এখান থেকে একজন একজন করে নিয়ে যাচ্ছে পাশের ঘরে–তারপরই বীভৎস চিৎকার শুনতে পাচ্ছি। সে চিৎকার মানুষের চিৎকার নয়–পশুর চিৎকার। এক সময় চিৎকারের শব্দ কমে আসে। শুধু গোঙানির শব্দ কানে আসে। সেই শব্দও যখন কমে আসে তখন শুধু ক্লান্ত কাতরধ্বনি কানে আসে, পানি, পানি …।
আমি আমার পাশে বসা এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম–এরা কি সবাইকে এ রকম শাস্তি দেয়?
ভদ্রলোক আমার প্রশ্নে বিস্মিত হয়ে তাকালেন, জবাব দিলেন না। সম্ভবত এ রকম ছেলেমানুষী প্রশ্নের জবাব দিয়ে তিনি সময় নষ্ট করতে চান না।
অনেককেই দেখলাম নামাজ পড়ছেন। নামাজের সময় নয় তবু পড়ছেন, নিশ্চয়ই নফল নামাজ। কি ভয়াবহ আতংক তাদের চোখে-মুখে!
জিজ্ঞাসাবাদ এবং শাস্তির জন্যে আমার ডাক পড়ল রাত এগারোটার দিকে। ছোট্ট একটা ঘরে নিয়ে আমাকে ঢোকানো হল। সেই ঘরের মেঝেতে তখন একজন শুয়ে আছে। লোকটা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। শুধু মৃদু গোঙানির শব্দ আসছে। মৃত্যুর আগে মানুষ হয়ত এরকম শব্দ করে। মানুষটার গায়ে একটি গেঞ্জী–গেঞ্জীতে চাপ চাপ রক্ত। এ ছাড়াও ঘরে আরো দু’জন মানুষ? আছে। একজনের মুখে শ্বেতীর দাগ। সে গোশত এবং পরোটা খাচ্ছে। অন্য একজনের হাতে এক কাপ চা। সে পিরিচে ঢেলে ঢেলে চা খাচ্ছে। দু’জনের মুখই হাসি হাসি। মেঝেতে একজন মানুষ মারা যাচ্ছে, তা নিয়ে তাদের কোন রকম মাথাব্যথা নেই। মৃত্যু তখন এতই সহজ। আমি ঘরে ঢুকতেই মুখে শ্বেতীর দাগওয়ালা মানুষটা বলল (উর্দুতে), আমি খাওয়া শেষ করে নেই–তারপর তোমার সাথে খোশ গল্প করব। আপাতত বিশ্রাম কর। হা হা হা।
লোকটার খাওয়া দেখে এই প্রথম মনে হল–আজ সারাদিন আমি কিছু খাইনি। হোটেল আহমেদিয়ায় আজ ইমপ্রুভ ডায়েট রান্না হয়েছে। আমার বন্ধুরা কি কিছু খেতে পেয়েছে?
না, ঐদিন আমার বন্ধুরা কিছু খেতে পারেনি। আমাদের ধরে নিয়ে যাবার পর–তারা সবাই এসে বসল আমার রুমে। আনিস সাবেত বললেন, হুমায়ূনকে বাদ দিয়ে এই খাবার আমি খেতে পারব না, তোমরা খাও। অন্যরাও রাজি হল না। ঠিক করা হল–যদি আমি জীবিত অবস্থায় ফিরে আসি তাহলে আবারো ইমপ্রুভ ডায়েট রান্না হবে। হৈ চৈ করে খাওয়া হবে। আনিস সাবেত আমার দরজার সামনে থেকে আহমেদিয়া হোটেলের সাইনবোর্ড তুলে ফেললেন।
পরম করুণাময়ের অসীম কৃপায় আমি জীবিত অবস্থায় ফিরে আসি। বন্ধু বান্ধবরা তখন নানান দিকে ছড়িয়েছিটিয়ে পড়েছে।
আমি ফিরে আসি জনশূন্য ফাঁকা হলে। জীবিত ফিরে আসার উত্তেজনায় দু’রাত আমি এক ফোঁটা ঘুমুতে পারিনি। বার বার মনে হত এটা হয়ত স্বপ্ন। স্বপ্ন কেটে যাবে, আমি দেখব মুখে শ্বেতী দাগওয়ালা মানুষটা বলছে, একে নিয়ে যাও, মেরে ফেল।
দেখতে দেখতে কুড়ি বছর পার হয়ে গেল। আনিস সাবেত মারা গেল ক্যানসারে। বন্ধু-বান্ধবরা আজ কে কোথায় জানিও না। মাঝে মাঝে হলের সামনের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় মনে হয়–আবার সবাইকে খবর দেয়া যায় না? আবার কি হিটার জ্বালিয়ে ভূনা খিচুড়ি রান্না করে সবাইকে নিয়ে খাওয়া যায় না? খেতে খেতে আমরা পুরোনো দিনের গল্প করব। যে দুঃসময় পার হয়ে এসেছি সেই দুঃসময়ের কথা ভেবে ব্যথিত হব।
হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের প্রায়ই দেখতে ইচ্ছা করে। হঠাৎ হঠাৎ এক-আধজনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। খানিক আগে একজনের সঙ্গে দেখা হল। সে তার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে করে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে গাড়ি থামাল। নেমে এসে আনন্দিত গলায় বলল–আরে তুই?
হাত ধরে সে আমাকে টেনে নিয়ে গেল তার ছেলেমেয়েদের কাছে। গাঢ় গলায় বলল, পরিচয় করিয়ে দেই। এর নাম হুমায়ূন আহমেদ। আমরা একবার একটা হোটেল দিয়েছিলাম–আহমেদিয়া হোটেল। হুমায়ূন ছিল সেই হোটেলের বাবুর্চি।
বলতে বলতে তার চোখে পানি এসে গেল। সে কোটের পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছতে থাকল। তার ছেলেমেয়েরা বাবার এই কাণ্ডের কোন অর্থ বুঝতে পারল না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আজকালকার ছেলেমেয়ের কাছে আমাদের চোখের এই অশ্রুর কারণ আমরা কোনদিনও স্পষ্ট করতে পারবো না। ৭১-এর স্মৃতির যে বেদনা আমরা হৃদয়ে লালন করি–এরা তার গভীরতা কোনদিনই বুঝবে না। বোঝার প্রয়োজনও তেমন নেই। এরা সুখে থাকুক। কোনদিনও যেন আমাদের মত দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে তাদের যেতে না হয়। এরা যেন থাকে দুধে-ভাতে।
“আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই” গল্প সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ