শ্লোকঃ ৬৮

তস্মাদ যস্য মহাবাহো নিগৃহীতানি সর্বশঃ।

ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা ।। ৬৮ ।।

তস্মাৎ- অতএব; যস্য- যার; মহাবাহো- হে মহাবীর; নিগৃহীতানি- নিবৃত্ত হওয়ার ফলে; সর্বশঃ- সর্ব প্রকারে; ইন্দ্রিয়াণি- ইন্দ্রিয়সমূহ; ইন্দ্রিয়ার্থেভ্যঃ- ইন্দ্রিয়ের বিষয় থেকে; তস্য- তাঁর; প্রজ্ঞা- প্রজ্ঞা; প্রতিষ্ঠিতা- স্থির।

গীতার গান

অতএব মহাবাহো শুন মন দিয়া।

নিগৃহীত মন যার আমারে সপিয়া।।

তাঁহার ইন্দ্রিয় বশ মোরে সমর্পিত।

তাঁহারই প্রজ্ঞা হয় পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত।।

অনুবাদঃ সুতরাং, হে মহাবাহো। যার ইন্দ্রিয়গুলি ইন্দ্রিয়ের বিষয় থেকে সর্বপ্রকারে নিবৃত্ত হয়েছে, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ।

তাৎপর্যঃ কেবলমাত্র কৃষ্ণভাবনা অথবা ভগবানের অপ্রাকৃত প্রেমময়ী সেবায় সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়োজিত করার মাধ্যমে ইন্দ্রিয়-তর্পণের বেগগুলিকে দমন করা যায়। যেমন উচ্চতর শক্তি প্রয়োগ করে শত্রুদের দমন করা যায়, ইন্দ্রিয়গুলিকে তেমনই উপায়ে দমন করতে হয়- কোনও মানবিক প্রচেষ্টায় তা হয় না। সেগুলিকে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত রাখার মাধ্যমেই তা সম্ভব। এই সত্য যিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, কৃষ্ণভাবনাই মানুষকে পরিশুদ্ধ বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা এনে দেয় এবং কোন সদগুরুর পথনির্দেশ মতোই সেই পদ্ধতির অনুশীলন করতে হয়, তাঁকেই বলা হয় সাধক, অর্থাৎ তিনি জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হবার যোগ্য পাত্র।

শ্লোকঃ ৬৯

যা নিশা সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্তি সংযমী।

যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশ্যতো মুনেঃ ।। ৬৯ ।।

যা- যা; নিশা- রাত্রি; সর্ব- সমস্ত; ভূতানাম- জীবদের; তস্যাম- তাতে; জাগর্তি- জাগ্রত থাকেন; সংযমী- আত্মসংযমী; যস্যাম- যাতে; জাগ্রতি- জাগ্রত থাকেন; ভূতানি- সমস্ত জীব; সা- তা; নিশা- রাত্রি; পশ্যতঃ- তত্ত্বদর্শী; মুনে- মননশীল ব্যক্তির পক্ষে।

গীতার গান

বিষয়ী বিষয়ে নিষ্ঠা করে সে প্রচুর।

সর্বদা জাগ্রত সেই সদা ভরপুর।।

সংযমীর সেই চেষ্টা নিশার সমান।

সংযমী জাগ্রত থাকে আত্মবিষয়ান।।

বিষয়ীর সেই আত্মা রাত্রির সমান।

উভয়ের কার্য হয় বহু ব্যবধান।।

অনুবাদঃ সমস্ত জীবের পক্ষে যা রাত্রিস্বরূপ, স্থিতপ্রজ্ঞ সেই রাত্রিতে জাগরিত থেকে আত্ম-বুদ্ধিনিষ্ঠ আনন্দকে সাক্ষাৎ অনুভব করেন। আর যখন সমস্ত জীবেরা জেগে থাকে, তখন তত্ত্বদর্শী মুনির নিকট তা রাত্রিস্বরূপ।

তাৎপর্যঃ এই জগতে দুই রকমের বুদ্ধিমান লোক আছে। এই ধরনের বুদ্ধিমান লোক ইন্দ্রিয় ভোগতৃপ্তির উদ্দেশ্যে বৈষয়িক ব্যাপারে খুব উন্নতি লাভ করে, আর অন্য ধরনের বুদ্ধিমানেরা আত্মানুসন্ধানী সাধু বা চিন্তাশীল মানুষের কাজকর্ম জড়-জাগতিক ভাবে আচ্ছন্ন মানুষদের কাছে যেন রাত্রির অন্ধকার বলে মনে হয়। আত্ম-উপলব্ধি সম্পর্কে অজ্ঞতার জন্যই জড়- জাগতিক মানুষেরা তেমন রাত্রির অন্ধকারে ঘুমিয়ে থাকেন। সেই সময় সাধুজন আধ্যাত্মিক চর্চায় ক্রমশ অগ্রগতির পথে অপ্রাকৃত আনন্দ উপলব্ধি করেন, আর তখন সংসারী লোক রাত্রিতে ঘুমিয়ে থেকে নানা রকম ইন্দ্রিয় উপভোগের স্বপ্ন দেখে এবং সেই স্বপ্নে সে কখনো নিজেকে সুখী মনে করে, কখনো ঘুমের ঘোরে দুঃখীও মনে করে। এই সমস্ত জড়-জাগতিক সুখ-দুঃখের প্রতি আত্মানুসন্ধানী ব্যক্তি সর্বদাই উদাসীন থাকেন। তিনি জড়-জাগতিক প্রতিক্রিয়ায় সম্পূর্ণ নিস্পৃহ থেকে আত্ম-উপলব্ধির কাজে সচেষ্ট থাকেন।

শ্লোকঃ ৭০

আপূর্যমাণচলপ্রতিষ্ঠং

সমুদ্রমাপঃ প্রবিশন্তি যদ্বৎ।

তদ্বৎ কামা যং প্রবিশন্তি সর্বে

স শান্তিমাপ্নোতি ন কামকামী ।। ৭০ ।।

আপূর্যমাণম- সর্বদা পূর্ণ; অচলপ্রতিষ্ঠম- স্থির; সমুদ্রম- সমুদ্রে; আপঃ- জলরাশি; প্রবিশন্তি- প্রবেশ করে; যদ্বৎ- যেমন; তদ্বৎ- তেমন; কামাঃ- কামনাসমূহ; যম- যার মধ্যে; প্রবিশন্তি- প্রবেশ করে; সর্বে- সমস্ত; সঃ- সেই ব্যক্তি; শান্তিম- শান্তি; আপ্নোতি- লাভ করেন; ন- না; কামকামী- বিষয়কামী ব্যক্তি।

গীতার গান

সমুদ্রে নদীর জল যেমন প্রবেশ।

বিচলিত নহে সেই সদা নির্বিশেষ।।

সেইভাবে মনে যার কামের চালনা।

সে শান্তি পাইবে ফল শান্তির সাধনা।।

অনুবাদঃ বিষয়কামী ব্যক্তি কখনো শান্তি লাভ করে না। জলরাশি যেমন সদা পরিপূর্ণ এবং স্থির সমুদ্রে প্রবেশ করেও তাকে ক্ষোভিত করতে পারে না, কামসমূহও তেমন স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তিতে প্রবিষ্ট হয়েও তাঁকে বিক্ষুদ্ধ করতে পারে না, অতএব তিনিই শান্তি লাভ করেন।

তাৎপর্যঃ যদিও মহাসমুদ্র সব সময় জলে পূর্ণ থাকে এবং বর্ষার সময় নদীবাহিত হয়ে আরও জল সমুদ্রে প্রবেশ করে, কিন্তু সমুদ্রের কোন পরিবর্তন হয় না- স্থির থাকে; সমুদ্র তখনো বিক্ষুব্ধ হয় না, এমনকি বেলাভূমি অতিক্রম করে প্লাবিত হয় না। কৃষ্ণভাবনায় মগ্ন কৃষ্ণভক্তও সর্ব অবস্থাতেই তেমনই অবিচল থাকেন। যতক্ষন মানুষ জড় দেহ নিয়ে আছে, ততক্ষণ ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্য দেহের চাহিদাও থাকবেই। কিন্তু ভগবানের ভক্ত তাঁর পূর্ণতার জন্য এই সমস্ত কামনা-বাসনার দ্বারা কখনোই বিচলিত হন না। কারণ, কৃষ্ণভক্তের কোন কিছুরই অভাব নেই, ভগবান তাঁর সমস্ত অভাব মোচন করেছেন। তাই তিনি সমুদ্রের মতো- নিজের মধ্যেই সর্বদা পরিপূর্ণ। ইন্দ্রিয়ের নদী বেয়ে কামনা-বাসনার যত জলই তাঁর হৃদয়ে প্রবেশ করুক, তাঁর হৃদয় সমুদ্রের মতোই অবিচলভাবে পরিপূর্ণ থাকে। এটিই হচ্ছে ভগবদ্ভক্তের লক্ষণ- জড় জগতের ভোগ বাসনার প্রতি তিনি সম্পূর্ণ উদাসীন, যদিও বাসনাগুলি তাঁর মধ্যে রয়েছে। ভগবানের সেবায় গভীর ভাবে মগ্ন থাকার ফলে তিনি যে শান্তি লাভ করেছেন, তা সমুদ্রের মতোই অতলস্পর্শী। কোন কিছুই তাঁকে আর বিচলিত করতে পারে না। পক্ষান্তরে, অন্যেরা, এমনকি যারা মুক্তির আকাঙ্ক্ষী- জাগতিক সাফল্যের আকাঙ্ক্ষীদের কি আর কথা, তারাও সর্বদাই অশান্ত। সকাম কর্মী, মুক্তিকামী ও সিদ্ধিকামী যোগী- সকলেই অশান্ত, যেহেতু তাদের অপূর্ণ বাসনা। কিন্তু কৃষ্ণভক্ত ভগবানের সেবায় সর্বতোভাবে পরম শান্তি লাভ করে থাকেন, তাঁর কোন বাসনাই অপূর্ণ থাকে না। বাস্তবিকপক্ষে, তিনি এমনকি জড় জগতের তথাকথিত বন্ধন থেকে মুক্তির কামনাও করেন না। কৃষ্ণভক্তদের কোন জড় কামনা থাকে না, তাই তাঁরা সম্পূর্ণরূপে শান্ত।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x