(এক)
আমরা হচ্ছি গরিব জনগণ, সাধারণ মূর্খ মানুষ; আমরা রাজা বাদশা রাজনীতি প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি এইসব জিনিশের কী বুঝি!
তবে আমাদেরও দুটি চোখ আছে, তাতে কিছু কিছু দেখি; আমাদেরও দুটি কান আছে, তাতে কিছু কিছু শুনি; আর দেখেশুনে মনে হয় দুনিয়াটা নানা রকম মালে ভরে গেছে, আর যে-সব মাল উত্তর থেকে দক্ষিণ পুব থেকে পশ্চিমে সবচেয়ে বেশি চলছে, তার মধ্যে এক নম্বর মাল হচ্ছে গণতন্ত্র; এর মতো আর কোনো মাল নেই; ধর্মকর্ম, হ্যাঁমবার্গার, প্রেম, ফিশ অ্যান্ড চিপস্, কাম, কোকাকোলা, বিয়ার, প্রিন্সেস ডায়না, আর রাবারও এতো জনপ্রিয় নয়। গণতন্ত্র এখন আমাদের পাগলি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মাল, এর জন্যে পৃথিবীখান অস্থির; উকুনশোভিত ভিখিরি আর শীততাপনিয়ন্ত্রিত কোটিপতি আর তারকাখচিত সেনাপতি সবাই দিনরাত মিছিল করে এখন গণতন্ত্র চান; তাই দিন নেই রাত নেই রাস্তা ঘাট পানশালা পতিতালয় ইস্কুল কলেজ মন্দির মসজিদ মুদির দোকান বিশতলা দালান, এবং আর যতো জায়গা আছে, সবখানেই চলছে গণতন্ত্রের বিষ্যুদ শুক্রবারহীন উৎপাদন। চারদিকে আমরা শুনছি গণতন্ত্র উৎপাদনের ঘটর ঘটর ঝকর ঝকর ভঝর ভঝর ভাঙর ভাঙর শব্দ। বদমাশ রাজাবাদশারা ছিলো এক কালে, বিংশ শতাব্দীর এই সভ্য সময়টা রাজাবাদশাদের নয়; তবে রাজাবাদশাদের ছাইপাঁশ আর পচাগলা মাংস থেকে উৎপন্ন হয়েছেন অসংখ্য অভিনব রাজা; তাদের আর রাজা বলি না আমরা, বিশেষ সম্মানের সাথে বলি রাজনীতিবিদ; তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার মহামান্য, মহামাননীয়, এবং তাদের স্ত্রীলিঙ্গরূপও পাওয়া যায়। তারা প্রেমময়, আমাদের অর্থাৎ জনগণের জন্যে তাঁদের প্রেম অনন্ত অসীম; জনগণের অর্থাৎ আমাদের জন্যে তাঁদের চোখে ঘুম নেই, তারা দুই চক্ষু বুজাইতে পারেন না; জনগণের কল্যাণের জন্যে এমন কাজকাম নেই (ইফতার, হজ, পাঁচতারা হোটেলে পার্টি, উমরা, মিছিল, যুক্তরাষ্ট্রভ্রমণ, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, হরতাল, নামাজ, রোজা, মদ্যপান, ঘুষ, হেলিকপ্টারে চড়ে বন্যার দৃশ্য দেখা, নির্বাচনের আগে ভিখিরির বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খাওয়া তাদের জনকল্যাণমূলক ব্যাপক কর্মকাণ্ডের কয়েকটি মাত্র মনে এলো), যা তারা করেন না। সব ব্যবসার সেরা এই মহৎ দেশপ্রেম আর জনগণপ্রেমের ব্যবসা, যার নাম রাজনীতি; একটিমাত্র ব্যবসাই রয়েছে, যা শিখতে হয় না; জনগণের নামে রাস্তায় বেরিয়ে গেলেই হয়। রাজারা চলে গেলেও, তাদের বিদায় করে দেয়া হলেও তারা চলে যায় নি বলেই আমাদের, গরিব জনগণের, মনে হয়; মরা রাজাগুলো ভুতের মতো চেপে আছে।
আগে রাজবংশ ছিলো, কিন্তু এখন কি নেই? রাজবংশের এখন দরকার নেই? থাকবে না কেনো? থাকতে হবেই; গণতন্ত্রের জন্যেও রাজবংশ চাই আমাদের। আমরা, গরিব মানুষরা, আহাম্মকরা, যাদের কাজ নানান রঙের শ্লোগান দেয়া (শ্লোগান না দিলে বাচন কঠিন, শ্লোগান দিতে দিতে আমাদের গলা ফুলে ঢোল হয়ে গেছে), দেখতে পাই হঠাৎ কোনো আবদুল করিম মোল্লা বা কুদরত ব্যাপারী একটা রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। আমরাও প্রথম বুঝতে পারি না, আর তারাও বুঝতে পারেন না যে তাঁরা একটা রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। যখন বুঝতে পারি তখন আমাদের খুশির কোনো শেষ থাকে না, শুধু শ্লোগান দিতে থাকি।
আমরা যদি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হইতাম (হই নাই তাতে ভালই হইছে), তাহলে নিশ্চয়ই কতকগুলো সূত্র বের করে ফেলতাম; আর গণতান্ত্রিক রাজবংশ প্রতিষ্ঠার সূত্রগুলো হইতো এমন সরল :
প্রথম সূত্র
পিতা দীর্ঘকাল বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করিবেন, স্বাধীনতার পর তিনি বহু বছর শাসন করিবেন, অন্য কোনো ব্যক্তি, দল বা রাজবংশকে দাঁড়াতে দেবেন না; তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর কন্যা বসিবেন গণতান্ত্রিক সিংহাসনে (পুত্রের বদলে কন্যা থাকলেই ভালো হয়)।
দ্বিতীয় সূত্র।
কোনো এক সেনাপতি এক ভোরবেলা দেশ দখল করে ফেলিবেন, তিনি একটি বিচারপতিকে ডাকবেন, বোকা বিচারপতিটি ভাববেন তিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন; তারপর সেনাপতি দেশকে দিতে থাকবেন বুট সানগ্লাস লেফরাইট গণতন্ত্র, দেশের প্রখ্যাত সুবিধাবাদীরা (এই শব্দটি এখন প্রশংসা বোঝায়) জড়ো হতে থাকবেন তার বুট ঘিরে; একদিন তিনি অমর হয়ে যাবেন; তার গণতান্ত্রিক সিংহাসনে বসিবেন তার স্ত্রী (রূপসী হইলেই ভালো হয়)।
তৃতীয় সূত্র
দীর্ঘকাল রাজনীতি করে কেউ একজন মহান নেতা হয়ে উঠিবেন, জনগণ তাঁর কথায় উঠবে বসবে, জনগণের ৯৯%জন তার নামে পাগল থাকবে, ক্ষমতায় এসে তিনি ১০১টি বিশেষণ পরবেন তাঁর গণতান্ত্রিক মুকুটে, নতুন নতুন বিশেষণ আবিষ্কার করতে থাকবেন তাঁর ভক্তরা, এবং জনগণের ১০%জনও তাকে আর সমর্থন করবে না, তিনিও একদিন অমর হয়ে যাবেন; তাঁর কন্যা দেশে দেশে উদ্বাস্তুর মতো ঘুরে একদিন দেশে ফিরে আসবেন, বসিবেন পিতার সিংহাসনে (একটু সময় লাগিবে)।
আমরা, সাধারণ মানুষরা, দেখতে পাই প্রত্যেক রাজবংশে থাকেন অজস্র। রাজনীতিবিদ; এঁরা গণতন্ত্রের রাজপুত্র। পুরোনো রাজবংশগুলোর উত্থানপতনের মতো গণতান্ত্রিক রাজবংশগুলোরও ঘটে উত্থানপতন; পড়ার ও ওঠার আর্তনাদ ও উল্লাস রয়েছে গণতন্ত্রেও। আমরা, জনগণরা (আমরা সংখ্যায় এতো বেশি যে দুইটি বহুবচন ছাড়া চলে না), এটা খুব উপভোগ করে থাকি। আমরা কারো পড়ে যাওয়া দেখতে যেমন সুখ পাই আবার কারো ওঠা দেখতেও তেমন সুখ পাই। রাজাদের পড়া আর ওঠা দেখা ছাড়া গরিবের আর কী সুখ?
কিছু দিন আগে পড়ে গেছেন একটি বিখ্যাত বড়ো রাজবংশ; অর্থাৎ আমরাই ফেলে দিয়েছি। আমরা, জঘন্য জনগণরা, রাস্তায় রাস্তায় মেতে উঠি তাদের ফেলে দেয়ার জন্যে, আর আমরা নিজেরা রাস্তায় লাশের পর লাশ হয়ে পড়তে থাকি, তবু ফেলবোই রাজবংশটিকে–লাশ হওয়া জনগণের, আমাদের, বিশেষ আনন্দ, এবং ফেলে দিই খালি হাতে আমরা, জনগণ, রাস্তা থেকে ঘরে ফিরি না; তবে আরেকটি রাজবংশ। সরাসরি ক্ষমতায় আসেন না, আসার নিয়ম নেই। কোন্ রাজবংশ ক্ষমতায় বসবেন, তা ঠিক করি আমরাই, রাজারা যাদের বলেন জনগণ; গণতান্ত্রিক রাজবংশগুলো জনগণকে, আমাদের, এই ক্ষমতাটুকু দিতে বাধ্য হয়েছেন। এটুকু ক্ষমতা না দিয়ে উপায় নেই, নিজেদের জন্যেই আমাদের ক্ষমতা দিয়েছেন, পড়ে যাওয়ার পর আমাদের দিয়েই তারা আবার উঠতে পারেন। আমরা না থাকলে তাদের ফেলতো কে, আমরা না থাকলে তাদের তুলতো কে? আমরা, জনগণ, হচ্ছি রাজার রাজা–রাজানিৰ্মাতা; যেমন রাজমিস্ত্রিরা প্রাসাদনির্মাতা।
সব রাজবংশের রাজনীতিবিদরাই বলেন, জনগণ আমাগো সম্পদ, জনগণ আমাগো অ্যাসেট, আমাগো সম্পত্তি।
এই জন্যে অর্থাৎ আমাদের ক্ষমতা বুঝে আমাদের প্রশংসা করার জন্যে আমরা, জনগণরা, খুবই কৃতজ্ঞ আমাদের রাজাদের কাছে; তাদের মহত্ত্বের কোনো শেষ নেই। আমাদেরও তাহলে দাম আছে। আমাদের রাজারা আমাদের মূল্য বোঝেন; এই জন্য আমাদের সুখের শেষ নেই। আমরা শুনেছি এটা হচ্ছে প্রশংসা করার কাল, এই কালে কেউ নিন্দা করে না; দরকার হলে খুন করে।
আমরা, জনগণরা (সম্মানার্থে বা অবজ্ঞার্থে দুই বহুবচন) চমৎকার জিনিশ, বিস্ময়কর ও আদরণীয়ভাবে আহাম্মক; একবার যাকে আমরা নামাই, নামিয়ে বিলের খলশে মাছের মতো ছড়ছড় করে সুখ পাই, কিছু দিন পর তাঁকেই আবার উঠোই, উঠিয়ে গাধার মতো সুখ পাই; আমরা নামাই এবং উঠোই। উঠোনো আর নামানোই আমাদের, আমাগো, মোগো, জনগণের, প্রধান রাজনীতিক কাজ, সবচেয়ে বড়ো বা একমাত্র অধিকার। এ ছাড়া আমাদের আর অধিকার কী? আমরা কি রাজাদের সামনে যেতে পারি? আমরা কি তাদের প্রাসাদে ঢুকতে পারি? ওই সব আমাদের না। তাঁরা মাঝেমাঝে সময় হলে আমাদের কাছে আসেন, তাঁদের দেখে আমাদের বুক ভরে ওঠে। রাজনীতিবিদগণ রাজারা জানেন আমরা, জনগণরা, একেকটি দেখতে মানুষের মতো, মায়ের পেট থেকেই বের হয়েছি, আমাদের মাথা চোখ নাক কান হাত ঠ্যাং সবই আছে, কিন্তু আমাদের মাথার ভেতরে কিছু নেই; আমরা মানুষের সমষ্টি নই, আমরা জনগণ, পত্রিকায় যে লেখে ‘লাখ লাখ জনতা’, হচ্ছি বস্তু, আমাদের ভেতরে নিহিত রয়েছে শক্তি-আগুন, ঝড়, ভূমিকম্প, ঢল, ঠাডা; তাদের জানতে হয় আমাদের ভেতর থেকে ওই শক্তি বের করে কাজে লাগানোর বুদ্ধি। তারা কখনো আমাদের ভেতর থেকে আগুন বের করেন, কখনো ঝড় বের করেন, কখনো ভূমিকম্প বের করেন; আরো কতো কী বের করেন। রাজারা জানেন আমরা জনগণরা পছন্দ করি ঠকতে, যাদের ঠগবাজিতে আমরা সবচেয়ে গদগদ হই, মনে করি এইভাবেই আমরা ঠকতে চাই, এইভাবে ঠকলেই আমরা সুখ পাবো, তাঁদেরই উঠোই আমরা।
এখন আমাদের দেশে চলছে নানা রাজবংশের ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতার পর্ব। প্রতিযোগিতা খুব জমে উঠেছে, আমরা খুব মজা পাইতেছি।
এই পর্বে দেশের রাজা হইতেছেন মহান স্বর্গীয় দেবদূতগণ।
শুনতে পাই এক কবি নাকি বলে গেছেন এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, কবিটা সত্য কথাই বলেছেন বলে মনে হয় (কবিগুলির কাজ কি সত্য কথা আগে আগেই বলে ফেলা?); আমাদের দেশটাই একমাত্র দেশ, যেখানে আছেন একদল মহান দেবদূত, অ্যাঞ্জেল, ফ্যারেশতা, যারা কখনো ভুল করেন না, পাপ করেন না, কাম করেন না অর্থাৎ নিষ্কাম, এ-পক্ষে থাকেন না, ও-পক্ষে থাকেন না, সে-পক্ষে থাকেন না, চুপচাপ থাকেন শুধু নিজেদের পক্ষে, তারাই দেবদূত, অ্যাঞ্জেল, ফ্যারেশতা। আমরা জনগণ বচ্ছরের পর বচ্ছর আমাদের চারপাশে কোনো দেবদূত দেখতে পাই না, আমাদের চোখ নেই বলে; কিন্তু যখন একটা রাজবংশ পইড়া যায়, আমরা ফালাই দেই, তখন দেখতে পাই সোনালি রুপালি পাখা মেলে স্বর্গ থেকে নামছেন দেবদূতরা। তাই দেশে অনেকেই দেবদূত হওয়ার সাধনা করছেন। কীভাবে বস্তায় বস্তায় বিশুদ্ধ দেবদূত পয়দা করা যায়, তা নিয়েও নানা চিন্তাভাবনা চলছে, কেননা চারপাঁচ বছর পর পর বহু দেবদূতের দরকার হয়, তাই দেশে দেবদূতের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা প্রয়োজন। আমরা জনগণরা শুনেছি একটি প্রস্তাব খুবই গুরুত্ব পাচ্ছে যে একটি জাপানি বা মার্কিন ডিপফ্রিজের মধ্যে পাঁচ বছরের জন্যে বেছে বেছে কিছু লোককে রেখে দিতে হবে, ওই ফ্রিজের নাম হবে ‘দেবদূত ডিপফ্রিজ’, গভীর নিরপেক্ষ ঠাণ্ডায় তারা নিরপেক্ষ ইলিশ মাছের মতো থাকবেন, হয়ে উঠবেন নিরপেক্ষ দেবদূত। খুবই সুন্দর প্রস্তাব বলে মনে হয়। যখন সময় আসবে ডিপফ্রিজ থেকে বের করে তাদের হাতে দেয়া হবে দেশের রাজত্ব; কয়েক মাস ধরে রাজত্ব করবেন দেবদূতরা। স্বর্গীয় দেবদূতদের যেমন মগজ নেই, এ-দেবদূতদেরও তেমনি হয়তো মগজ নেই (এ নিয়ে তর্কাতর্কি বা বিতর্ক রয়েছে, একদল মনে করেন উন্মাদ ও শিশুদের মগজই শুধু তাদের মগজের সাথে তুলনীয়, তাই তাঁরা নিষ্পাপ); স্বর্গীয় দেবদূতদের যেমন ক্ষমতা নেই, এ-দেবদূতদেরও তেমনি কোনো ক্ষমতা নেই। তাদের একটিই কাজ : কোনো একটি রাজবংশকে নিরপেক্ষভাবে ক্ষমতায় বসিয়ে আবার নিরপেক্ষ সোনালি রুপালি ডানা মেলে স্বর্গে ফিরে যাওয়া; এবং দেবদূত হওয়ার গৌরব উপভোগ করা (আমরা জনগণরা দেখতে পাইতেছি যে দেবদূতরাও গভীর প্রবল প্রত্যাশায় থাকেন যে-রাজবংশটি ক্ষমতায় আসবেন, সেটি তাঁদের কোনো একটা পরিচারকের, আমরা চলতি ভাষায় বলি চাকরের, কাজ দেবেন, যাতে তারা কবরে কবরে ফুলের তোড়া দিতে পারেন, হোটেলে হোটেলে বক্তৃতা দিতে পারেন, মাসে মাসে মিলাদশরিফ পড়তে পারেন; একটি রাজবংশ তাঁদের একজনকে একটা পরিচারকের কাজ দিয়ে ধন্য করেছেন; তাঁহার স্বাস্থ্য ভাল হইতেছে, চেহারা সুন্দর দেখাইতেছে)। আমরা বুঝতে পারি রাজনীতি খুবই কঠিন, আর শয়তানদের, কাজ; দেবদূত হওয়া–আমাদের মনে হয়–সহজ, তাঁদের কাজও সহজ; রাজনীতি করলে যাদের মুখ আর দেহ হাত আর পা নানা রকম ঘায়ে আর ছুলিতে ছেয়ে যেতো, রেলইস্টিশনের কুষ্ঠরোগীর মতো দেখাতে যাঁদের, দেবদূত হয়ে তাঁরা শরীরকে রাখেন পবিত্র নির্মল, মনে হয় সারাক্ষণ পবিত্র পানিতে গোশল করছেন।
আমরা, জনগণরা, খেলতে পছন্দ করি; আর গণতন্ত্র হচ্ছে খুবই মজার খেলা, বাইল্যকালেও এতো মজার খেলা আমরা খেলি নাই, ডাংগুটি হাডুডু গোল্লাছুটের থেকে অনেক মজার এই গণতন্ত্র। এ-খেলারও আছে কতকগুলো সুন্দর সুন্দর নিয়ম; হাডুডু খেলায় যেমন হাডুডু কুকুৎ করতে হয়, গণতন্ত্র খেলায়ও নির্বাচন করতে হয়, কুকুৎ করতে হয়, হাডুডু করতে হয়, নির্বাচনের জন্যে প্রার্থী মনোনীত করতে হয়। এবার যখন প্রার্থী মনোনয়নের সময় আসে আমাদের ডোবার মতো দেশটি জুড়ে সাড়া পড়ে যায়, ঢেউ উঠতে থাকে; আমরা জনগণরা আমোদে আত্মহারা হয়ে যাই, কোনো রকমে বেঁচে থাকি শুধু রাজবংশগুলোকে ভোট দেয়ার জন্যে। রাজবংশগুলো তাদের প্রার্থী ঠিক করতে অর্থাৎ কারা কারা মাঠে খেলবেন অর্থাৎ প্রার্থী মনোনীত করতে শুরু করেন, আমরা চোখ বড়ো করে তাকিয়ে থাকি। তারা জিতলে রাজপুত্র হবেন, বড়ো বড়ো দালানে ঢুকবেন আর বের হবেন, বড়ো বড়ো গাড়িতে উঠবেন আর নামবেন, গাড়ির যেই দিকে বসবেন সেই দিকে পতাকা উড়াইবেন; আর তাঁদের রাজবংশ বা দল যদি জেতে, তাহলে তাদের রাজবংশ বা দলই রাজত্ব করবেন, তাদের দল থেকেই হবেন রাজা (অর্থাৎ রানী); আর তারা হবেন মন্ত্রী, অমাত্য ও কতো কিছু, যা আমরা জনগণরা জানি না। আমরা, জনগণরা, আর কতোটা জানতে পারি? আমরা তো দেশের ভেতরে নাই, আছি বাইরে। তখন তারা যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারবেন, আর আমরা তাদের লাখ রকমের করাকরি দেখে সুখে আহ্লাদে ভরে উঠবো।
আমাদের প্রতিটি রাজবংশ বা দলের আছে একটি করে বিরাট সিন্দুক; ওই সিন্দুকগুলো পরিপূর্ণ হয়ে আছে অজস্র নীতি ও আদর্শে। দুনিয়ায় যতো নীতি আর আদর্শ আছে, তার সব পাওয়া যায় ওই সিন্দুকগুলোতে। আমাদের গণতান্ত্রিক রাজবংশগুলো নীতি আর আদর্শ ছাড়া আর কিছু জানেন না; তাই আমাদের মতো নীতি ও আদর্শে বোঝাই জাতি আর নেই। আমাদের প্রতিটি ছিদ্রের ভেতরে ঢোকোনো আছে অজস্র আদর্শ।
আমাদের গণতান্ত্রিক রাজবংশগুলো নীতি-আদর্শ ও অন্যান্য মহৎ ব্যাপার বোঝানো খুবই কঠিন ব্যাপার; তারা নিজেরাও তা ভালোভাবে বোঝেন না; তাগো কাছে জানতে চাইলে বলেন, বুইঝ্যা লইয়েন। আমরা, মূর্খ জনগণরা গরিব মানুষ, কীভাবে তা বুঝি? আমাদের কয়েকটি গণতান্ত্রিক রাজবংশের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিলে তাদের নীতি আর আদর্শ জ্ঞানী মানুষরা বুঝতে পারবেন।
আমাদের একখানা রাজবংশের নাম ‘শক্তির উৎসবাদী গণতান্ত্রিক রাজবংশ বা দল’ : দেশে গণতান্ত্রিক রাজবংশ প্রতিষ্ঠার যে-সূত্রগুলো আমরা আগেই বলেছি, তার দ্বিতীয় সূত্রানুসারে এই সম্ভ্রান্ত দল বা রাজবংশটি প্রতিষ্ঠিত। আমাদের রাজবংশগুলোর নাম হয় ইংরেজিতে, উর্দুতে, আরবিতে, ফার্সিতে, হিব্রুতে, হটেনটটে, বুরুশাস্কিতে; এই বংশের নামটা ইংরেজিতে; বাঙলায় বললে নামটা বোঝা যায় না; মনে হয় মঙ্গোলিয়ার বা আজারবাইজানের কোনো রাজবংশের নাম বলছি। এ-রাজবংশখানি মনে করেন জনগণ হচ্ছে শক্তির উৎস, আর তারা হচ্ছেন শক্তির পরিণতি। তাঁদের এই তত্ত্বটা আমরা খুবই পছন্দ করি; উৎস হচ্ছে মূল, আর মূলই হচ্ছে আসল ব্যাপার; তাই আমরা জনগণরা হচ্ছি আসল ব্যাপার, আর ওই পরিণতিরা হচ্ছেন মেকি ব্যাপার। আমাদের এক অমর (এই শব্দটার অর্থ গত বিশ বছরে বদলে গেছে, হঠাৎ কেউ খুন হয়ে গেলে এখন তাকে আমরা অমর বলি; তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামের বুড়ো ভদ্রলোক আর অমর নন, তিনি মৃত, তাঁর খুন হওয়া উচিত ছিলো) সেনাপতি এটি প্রতিষ্ঠা করে দেশে গণতন্ত্রের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন; আমরা, জনগণরা, শুনতে পাই তিনি নাকি রাজনীতিবিদদের জন্যে রাজনীতি কঠিন, আর সুবিধাবাদীদের জন্যে সহজ করে তুলতে চেয়েছিলেন; এবং সফল হয়েছিলেন।
আমরা মূর্খরা অবশ্য রাজনীতিবিদ আর সুবিধাবাদীর মধ্যে কোনো পার্থক্য বুঝতে পারি না; এইটা আমাদের দোষ, আমাদের কাছে দুইটি শব্দই সুন্দর, দুটিরই আওয়াজ মিষ্টি। তাঁর অনেক চকচকে বুট ছিলো আর ঝকঝকে কালো সানগ্লাশ ছিলো; আর যা ছিলো সেই সম্পর্কে আমরা কী জানি? আমরা মূর্খ মানুষ। তিনি মাটি কাটতে খুব পছন্দ করতেন, মাটি দেখলেই কোপাতেন; তাই সঙ্গে সব সময় একটি কোদাল রাখতেন; এক মন্ত্রী এইজন্য তাকে একখানা সোনার কোদাল উপহার দিয়েছিলেন (আমাগো দেশে সোনা ছাড়া আর কিছু নেই)। এই রাজবংশে তার সুন্দর বুট ঘিরে জড়ো হয়েছিলেন দেশের যতো প্রসিদ্ধ রাজাকার (আল্লায় তাগো ভেস্তে নসিব করুন), অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল (আমরা গরিবরা বলি অবজেনারেল), মেজর ও অন্যান্য, অধ্যাপক (কোনো দিন পড়ান নাই), আমলা (ছিএছপি, ডিএছপি, ইএছপি, এফএছপি), ডাক্তার (মানুষমারা কবিরাজ), উকিল, ব্যাংকডাকাত (ডাকাতি করে তারা নিজেরাই ব্যাংক দিছেন), মাস্টার (কোনো দিন পড়েন নাই), ব্যারিস্টার, ইঞ্জিনিয়ার, দোকানদার, কালোবাজারি, শাদাবাজারি, আর বিভিন্ন বাম ও ডান রাজবংশ থেকে ময়লার মতো গড়িয়ে আসা স্ট্যালিন লেনিন কসিগিন মাওজেদুং ও বোচকামারাগণ। রাজবংশটির জন্ম হয়েছিলো ক্ষমতার প্রসবঘরে, তাই ক্ষমতায় থাকা তাঁদের প্রথম স্বভাব; তারা বিশ্বাস করেন তারা ক্ষমতায় থাকলেই জনগণ ক্ষমতায় আছে। তাঁরা দিনরাত গলা ভেঙেচুরে দাবি করেন তাদের অমর নেতা স্বাধীনতার ঘোষক, তিনি ঘোষণা না করলে দেশে স্বাধীনতা আসতো না, তার ডাক শুনেই স্বাধীনতা পোষা বেড়ালের মতো আসে এই দেশে; আর আমরাও না করতে পারি না। বিসমিল্লাহ এই বংশের প্রধান আদর্শ, সাফারি জ্যাকেট দ্বিতীয় আদর্শ। এই বংশখানি সব সময় ভয়ে থাকেন কখন অন্য বংশ দেশটিকে পাশের দেশের হিন্দুগো কাছে বিক্রি করে দেন। এই দলের প্রধানকে আমরা বলি মহাদেশনেত্রী।
আমাদের আরেকখানা রাজবংশের নাম হলো ‘জনগণমন গণতান্ত্রিক রাজবংশ বা দল’ : গণতান্ত্রিক রাজবংশ প্রতিষ্ঠার তৃতীয় সূত্রানুসারে এটি প্রতিষ্ঠিত। এই দলখানি বাঙালি, বাঙলা, বাঙলাদেশের নামে পাগল বলে এর নামখানি রাখা হয়েছে উর্দু ও ইংরেজি ভাষার বিবাহ ও বিবাহোত্তর কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে। এই রাজবংশখানি বিশ্বাস করেন তারাই এনেছেন দেশের স্বাধীনতা, তাই দেশ তখনই স্বাধীন যখন তারা ক্ষমতায় আছেন। এই রাজবংশ মনে করেন তারা যখন স্বৈরাচার করেন, তখন তা হচ্ছে গণতন্ত্র; আর অন্যরা যখন গণতন্ত্র করেন (অবশ্য করেন না), তখন তা হচ্ছে স্বৈরাচার। এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মনে করতেন দেশটা তার; আর এ-বংশের অনেকেই মনে করেন দেশটা তাদের। এই রাজবংশ যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তাদের পায়ের নিচে আমরা মাথা দিয়ে রাখতাম; এই রাজবংশের তিনচারজন মহান রাজপুত্র ছিলেন, তাঁরা আমাদের যা করতে বলতেন আমরা তা-ই করতাম; ভাইয়ের মাথা এনে দিতে বললে ভাইয়ের মাথা এনে দিতাম। একরাতে কতকগুলো খুনি, একটা রাজা যাদের বলতেন সূর্যসন্তান, এই বংশটিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। মজার কথা হচ্ছে এই বংশেরই একজন নতুন রাজা হন, আর মন্ত্রী হন এ-বংশেরই অনেকে, যারা একদিন প্রতিষ্ঠাতার পায়ের ধুলো পেলে ধন্য হতেন। আমরা গরিব জনগণ কিছু বুঝতে না পেরে চুপ থাকি। এ-বংশ অনেক বছর ক্ষমতার বাইরে ছিলেন, তাই এ-বংশ থেকে অনেক রাজপরুষই শক্তির উৎসবাদী গণতান্ত্রিক রাজবংশে ও খোজাগণতান্ত্রিক রাজবংশে চলে গেছেন; অনেকে চলে গিয়ে আবার ফিরে এসেছেন; এখন এ-বংশ নানা বংশ আর অবংশ থেকে রাজপুরুষ সংগ্রহ করছেন। এ-বংশের অন্যতম প্রধান সম্পদ দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীরা, মঞ্চ আর টেলিভিশন যাদের খুব ভালো লাগে। এ-বংশ আগে ধর্মনিরপেক্ষতা নামে এক অদ্ভুত কথা বলতেন (আরো একটি অদ্ভুত কথা বলতেন, যে-কথাটির অর্থ তাঁরা জানতেন না, আমরাও জানি না, কথাটি হচ্ছে সমাজতন্ত্র), তবে মিলাদ পড়তে গিয়ে বলতেন ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়; এবং এখন এ-বংশের রাজপুরুষেরা খুবই ধার্মিক হয়ে উঠেছেন, দাড়ি ও টুপির চর্চায় মন দিয়েছেন, তসবি টিপছেন, মাসে মাসে ওমরা করছেন। এতে আমরা জনগণরা খুব খুশি হচ্ছি, দেশে আর ইসলামের অভাব থাকবে না। এই দলের প্রধানকে আমরা বলি মহাজননেত্রী।
আমাদের আরেকখানি রাজবংশের নাম হচ্ছে ‘খোজাগণতান্ত্রিক রাজবংশ বা দল’ : এটি একখানি অসামান্য বংশ, গণতান্ত্রিক রাজবংশ প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় সূত্রানুসারে এটি প্রতিষ্ঠিত; তবে এর জনক অমর না হওয়ায় তাঁর স্ত্রী মহাগণনেত্রী হয়ে উঠতে পারেন নি; হওয়ার তার সাধ ছিলো, কিন্তু সাধ পূরণ হয় নি; একদিন হয়তো হবে। আমরা মূর্খরা মনে করি ভাঁড় হওয়ার যার কথা ছিলো, ভাঁড়ামো করলে যিনি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আর গোপাল ভাঁড়কে ছাড়িয়ে যেতেন, আমাদের কালচার সমৃদ্ধ হতো, তিনি হয়েছিলেন সেনাপতি; আর তিনি অন্য কিছু জন্ম দিতে না পেরে জন্ম দিয়েছিলেন এই রাজবংশটিকে। শক্তির উৎসবাদী গণতান্ত্রিক রাজবংশের মতো এটিরও জন্ম হয়েছিলো ক্ষমতার প্রসবঘরে, এবং দেশের যতো রাজাকার (আল্লা তাদের ভেস্তে নসিব করুন), অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল, মেজর, সুবাদার ও দফাদার, আমলা, কামলা, অধ্যাপক, অধ্যক্ষ, ডাক্তার, কবিরাজ, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকডাকাত, চোর, দোকানদার, চোরাকারবারি, শাদাবাজারি, কালোবাজারি, বাম ও ডান রাজবংশ থেকে গড়িয়ে আসা ইতর মেথর এটিকে পরিপূর্ণ করে তোলেন। বন্ধনির ভেতর এঁদের বিশেষ পরিচয় আর দিলাম না, এককথা বারবার বলতে মুখ ব্যথা হয়ে যায়; শক্তির উৎসবাদী গণতান্ত্রিক রাজবংশে এদের পরিচয় দেয়া হয়েছে। এ-রাজবংশটি মুঘলদের মতো দীর্ঘকাল ধরে রাজত্ব করেন, এবং দেশকে ধর্মকর্ম পির মুর্শেদ দশরশি শাহেদাবাদী অকথ্যবাদী মিথ্যাবাদী ভাঁড়ে ভ’রে দেন। এ-রজবংশের মহাজননেতাকে আমরা ফেলে দিই, এবং তিনি অমর না হয়ে কয়েক বছর কারাগারে অবসর যাপন করেন। এ-বংশের মহাজননেতার আদর্শ প্রেমপিরিতি, আর দলের আদর্শ ইসলাম।
আমাদের আরেকখানি রাজবংশের নাম ‘রাজাকারতান্ত্রিক রাজবংশ বা দল’ : ইসলামের নামে দেশের প্রধান খুনিদের রাজবংশ এটি। এই বংশটি দিনরাত ছুরি শান দেন বলে এটিকে ছুরিশানদার রাজবংশও বলি আমরা। ১৯৭১-এ আল্লার নামে এ-রাজবংশ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিলেন, আল্লার নামে তারা কাজ করেন পাকিস্থানের জল্লাদবংশরূপে, হাজার মানুষের গলা কাটেন, লাখ নারীকে ধর্ষণ করেন; এবং এখনো তাদের পেটের ভেতরে পাকিস্থান। হাতপায়ের রগ কাটতে তারা দক্ষ, আল্লা তাদের এ-অধিকার দিয়েছেন বলে তারা বিশ্বাস করেন ও বাস্তবায়ন করেন। গণতন্ত্র আর নির্বাচনে তারা বিশ্বাস করেন না, ইসলামে এইসব নেই, তারা বিশ্বাস করেন আল্লায় (এটা তাঁদের ছদ্মবেশ) ও খুনে; তবে উপায় না দেখে তারাও গণতন্ত্র ও নির্বাচনে অংশ নেন। টুপি ও দাড়ি তাদের ব্যবসায়ের প্রতীক। তারা লেখাপড়া জানেন না, আর পড়লে একখানা বই ছাড়া পড়েন না। এই রাজবংশের রাজপুত্ররা এখনো মনে করেন সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, আর যদি না ঘোরে তাহলে সূর্যকে পৃথিবীর চারদিকে তারা ঘুরিয়ে ছাড়বেন, সূর্যের হাতপায়ের রগ কেটে দিয়ে।
আমাদের দেশে আছে আরো নানা গণতান্ত্রিক রাজবংশ।
আমাদের গণতান্ত্রিক রাজবংশগুলো যখন প্রার্থী (তাঁরা বলেন ক্যান্ডিডেট) ঠিক করতে শুরু করেন, আমরা, আহাম্মক জনগণরা, মনে করেছিলাম এবার দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে সত্যযুগ; কেননা রাজবংশগুলো ন্যায়, নীতি, আদর্শ, সততা, কল্যাণ প্রভৃতি ও আরো অনেক ভালো ভালো কথায় মেতে ওঠেন; তাদের মুখ থেকে শ্রাবণের ধারার মতো (অনেকে বলেন থুতুর মতো) ন্যায়, নীতি, সততা ঝরতে থাকে; জনগণ জনগণ ধ্বনিতে তারা দেশ মুখর করে তোলেন। তারা যতো নীতির কথা বলতে থাকেন, আকাশের মেঘে ততো জলও নেই। তারা বলতে থাকেন রাজনীতিকে উদ্ধার করতে হবে সুবিধাবাদী আর অসৎদের হাত থেকে; নির্বাচিত করতে হবে সৎ ও নীতিপরায়ণ মানুষদের (এই জীবটি কতো দিন ধরে আমরা দেখি না), চোরবদমাশদের বের করে দিতে হবে রাজনীতি থেকে (আমরা বলাবলি করতে থাকি তাহলে দেশে কি রাজনীতি থাকবে না, এটা কি দেশ থেকে রাজনীতি উঠিয়ে দেয়ার চক্রান্ত?); কিন্তু, হায়, আমরা বোকারা দেখতে পাই গণতান্ত্রিক রাজবংশগুলো প্রার্থী মনোনয়নের সময় নীতি ও সতোর কোনো বালাই রাখেন না। তা-ই বা কেমন করে বলি? তারা নীতি ও সততা বলতে যা বোঝেন আমরা বোকারা হয়তো তা বুঝতে পারি না; আমরা, জনগণ, নীতি আর সততার কী বুঝি? আমরা বোকারা শুধু বুঝতে পারি মুখে ভালো ভালো কথা বলা আর কাজে তার উল্টোটা করাই হচ্ছে রাজনীতি। রাজাদের নীতি আর বোকাদের নীতি কখনোই এক হতে পারে না।
এবার বাতাস এমনভাবে বইতে থাকলো যে আমাদের রাজনীতিবিদরা বুঝতে পারলেন, এবং এমনকি আমরাও বুঝতে পারলাম, ক্ষমতায় যাবেন দুই বড়ো রাজবংশের এক রাজবংশ–জনগণমন গণতান্ত্রিক রাজবংশ, নইলে শক্তির উৎসবাদী গণতান্ত্রিক রাজবংশ। তাদের ক্ষমতায় যাওয়া খুবই দরকার; আর সারা দেশের রাজনীতিবিদরা দুই দলে গিয়ে ভেঙে পড়লেন, অনেক নতুন নতুন রাজনীতিবিদেরও উদ্ভব হলো। আমরা মনে করেছিলাম যেই দলের যেই নীতি সেই নীতির লোকেরা যাবেন সেই দলে; কিন্তু যা দেখতে পাই তাতে আমাদের সুখের কোনো শেষ থাকে না। আমরা তো আর সব দেখতে আর শুনতে পাই না, গরিব মানুষ, জনগণ আমরা, দূর থেকে যা দেখতে পাই আর শুনতে পাই সেই কথাই বলছি।
শুনতে পাই জনগণমন গণতান্ত্রিক রাজবংশের বৈঠক বসেছে।
তাঁদের বৈঠক যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা আমরা বুঝতে পারি। এইবার তাদের ক্ষমতায় যেতেই হবে, অনেক বছর তারা রাজপথে আছেন। তাদের মুখের দিকে তাকালে আমাদের মায়া হয়, মুখ তাদের দরদভরা; মানুষ ক্ষমতার বাইরে থাকলে মানুষ হয়ে ওঠে, এটা আমরা গরিবরা বুঝতে পারি তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে। তাঁরা যখন, অনেক আগে, ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তাদের চোখেমুখে এই দরদটা ছিলো না, তখন তাদের দিকে তাকানোই যেতো না; যেমন কয়েক মাস আগেও শক্তির উৎসবাদী রাজবংশের কারো মুখের দিকে আমরা গরিবরা তাকাতে পারতাম না, তাঁদের মুখ থেকে ক্ষমতা ঝিলিক দিয়ে এসে আমাদের মুখ পুড়িয়ে দিতো।
মহাজননেত্রী বললেন, বলেন আপনেরা, এইবার কী নীতি লইতে হবে, কাদের ক্যান্ডিডেট করতে হবে।
আমাগো এইবার ক্ষমতায় যাইতেই হইবো, বললেন রাজবংশের এক বড়ো জনগণমন গণতান্ত্রিক রাজপুরুষ মোহাম্মদ আবদুর রহমান, ক্ষমতার বাইরে আর থাকন যায় না, বাইরে থেকে থেকে পইচ্যা যাইতেছি। এইবার এমন নীতি আর কৌশল লইতে হবে, যাতে ক্ষমতায় যাইতে পারি।
আবদুর রহমান সাহেবের বয়স হয়েছে, অনেক বিপদের মধ্যেও তিনি এ-বংশ ছেড়ে অন্য বংশে যান নি, গেলে দু-তিনবার মন্ত্রী হতে পারতেন; এখন দাড়ি আর টুপি নিয়েছেন; তাঁর আর সময় নেই।
অনেক বচ্ছর ধইর্যা আমরা রোডে আর রাস্তায় আছি, শ্লোগান দিতাছি মিছিল করতাছি, মাইর খাইতাছি, ভাঙচুর করতাছি, আমাগো কোনো পাওয়ার নাই, অনেক বচ্ছর ধইর্যা আমরা বঙ্গভবনে নাই, গণভবনে নাই, এইবার আমাদের অই ভবনগুলিতে ঢুকতে হইবো, বললেন আরেক রাজপুরুষ কলিমউদ্দিন মৃধা।
তাঁরও বয়স হয়েছে, অনেক ধৈর্যে তিনি টিকে আছেন এ-রাজবংশে; অনেক প্রলোভন পেয়েছেন অন্য রাজবংশ থেকে, দু-একবার যাওয়ার উপক্রম করেছিলেন; কিন্তু সুবিধা হবে না বুঝে যান নি, তার অনেক সঙ্গীই চলে গেছেন।
বলেন আপনেরা, কী নীতি মাইন্যা আপনেরা ক্যান্ডিডেট দিবেন? জিজ্ঞেস করলেন মহাজননেত্রী।
নীতি একটাই–যে জিতবো বইল্যা মনে করুম, তারেই ক্যান্ডিডেট করুম, যে জিতবো না তারে ক্যান্ডিডেট করুম না, বললেন আরেক রাজপুরুষ নিজামউদ্দিন আহমদ চৌধুরী, এইবার ক্ষমতায় না গেলে আমাগো ভবিষ্যৎ নাই।
তার অনেক বয়স হয়েছে, চলে যাওয়ার আগে একবার অন্তত মন্ত্রী হয়ে যেতে চান; কয়েকবার হজ করেছেন, আজকাল সব সময় মাথায় টুপি পরেন, রোজা নামাজও করেন, এবং মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।
ঠিক কথা বলতাছেন, চাচা, যে জিতবো না তারে আমরা নিব না, এইবার আমাদের ইলেকশনে উইন করতেই হবে, বললেন মহাজননেত্রী, আমরা স্বাধীনতা আনলাম আর ফলটা খাইলো অরা। যেভাবেই হোক আমাদের জিততে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর আসন বা সিংহাসনটি একবার ঝলমল করে ওঠে চোখের সামনে।
কয়টা জিনিশ আমাগো দ্যাখতে হইবো, বললেন এক রাজপুরুষ মোহাম্মদ রজ্জব আলি, ওইগুলিন না দ্যাখলে ক্ষমতায় যাইতে পারুম না।
বলেন চাচা, কী কী জিনিশ আমাগো দেখতে হইবো? জিজ্ঞেস করেন মহাজননেত্রী।
তার চোখের সামনে থেকে দূরে মিশে যেতে থাকে সিংহাসনটি।
আমি বোঝতে পারতাছি আমাগো ক্যান্ডিডেট খালি আমাগো দল হইতে লইলে চলবো না, চাচা বলেন, আমাগো কিছু আর্মির লোক দরকার, কয়টা রিটায়ার্ড জেনারেল ব্রিগেডিয়ার কর্নেল মেজর দরকার, অই পাড়াটা যাতে আমাদের লগে থাকে, জনগণরা যাতে বোঝে অই পাড়াটার লগে আমাদের গোলমাল নাই; আমাগো কয়টা আমলা দরকার, অরা আমাগো এইবার অনেক সাহায্য করছে আর অরাই কলকাঠি ঘুরায়; আমাগো কয়টা ব্যাংক ডিফল্টার দরকার–ট্যাকা তো লাগবো, আর কয়টা রাজাকার দরকার, অরা ইসলাম দেখবো; আর পারলে অন্য দল থেকে কয়টারে ভাগাইয়া আনন দরকার। আর মহাজননেত্রীর আত্মীয়স্বজনরাও থাকবেন। তাইলেই খালি আমরা ক্ষমতার মুখ দ্যাখতে পারুম।
ঠিক কথা বলতাছেন, চাচা, ঠিক কথা বলতাছেন, চাচা, বলেন মহাজননেত্রী, এবং সবাই। তাদের মনে হয় ক্ষমতায় যাওয়ার মূলসূত্র তারা পেয়ে গেছেন।
তবু তারা একবার কেঁপে ওঠে, তবু তারা সবাই উদ্বিগ্ন, তবু তাঁরা সবাই চিন্তিত; তাদের চোখেমুখে তা ধরা পড়ে। এর আগেও একবার তাদের মনে হয়েছিলো ক্ষমতা হাতের মুঠোয় এসে গেছে, দেশটা তাঁদের হয়ে গেছে; তারা সবাই ক্ষমতাসীন রাজবংশের মতো আচরণ করতে শুরু করেছিলেন; কিন্তু ভোটের পর দেখা যায় তারা নেই। জনগণের বিশ্বাসঘাতকতার কোনো শেষ নেই। তাই এবার সাবধান হতে হবে, সবগুলো প্যাঁচ ঠিকঠাক মতো দিতে হবে।
খালি নীতি লইয়া থাকলে হইবো না, বলেন এক রাজপুরুষ মোহাম্মদ আবদুল হাই, খালি স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ আর বাঙালি লইয়া থাকলে আমরা ক্ষমতায় যাইতে পারুম না। এইগুলির কথা আমাগো বলতে হবে কম কম, আর ইসলামের কথা বেশি বলতে হবে, এমনভাবে বলতে হবে যেনো আমরা মক্কা জয় করে এইমাত্র মদিনা থেকে ফিরলাম; ইসলাম ছাড়া আইজকাইল রাজনীতি নাই।
খোজারাজবংশ আর রাজাকার রাজবংশের লগেও আমাগো গোপন সম্পর্ক দরকার, নাইলে শক্তির উৎসওলারা তাগো ভাগাইয়া লইয়া যাইবো, বলেন কলিমউদ্দিন মৃধা, আর অগো লইয়া তো অনেক বচ্ছর আমরা আন্দোলন করছি, অগো আমাদের সঙ্গে রাখতে হবে। অগো আর রাজাকার স্বৈরাচার বইল্যা দূরে রাখন যাইবো না।
ধর্মনিরপেক্ষতা আর সমাজতন্ত্রের নাম কেহ মোখেও আনবা না, বলেন মোহাম্মদ আবদুর রহমান, অইগুলিনই আমাগো ডুবাইছে; আমরা আর ডুইব্যা থাকতে চাই না।
এইবার আমাগো ধর্মেকর্মে মন দিতে হইবো, বলেন মোহাম্মদ রজ্জব আলি, মহাজননেত্রী আর কয়জনের ওমরা কইরা আসতে হইবো, অগো মতন বকতিতায় বকতিতায় আল্লা আর ইসলামের কথা বলতে হইবো, রাস্তায় রাস্তায় নমাজ পড়তে হইবো, মইধ্যে মইধ্যে জনগণের লিগা কানতে হইবো।
জনগণের জন্যে কাঁদতে গিয়ে মোহাম্মদ রজ্জব আলির নিজের জন্যে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। মোহাম্মদ রজ্জব আলি আরো বলেন, আল্লার নাম লইলে আল্লা আমাগো দিকে মোখ ফিরা চাইবো।
তারা সবাই একবার মনে মনে মোনাজাত পাঠ করেন। তারা জানেন আল্লা ছাড়া রাজনীতিতে কোনো ভরসা নেই।
এই ছাড়া আর আমাগো উপায় নাই, বলেন মোহাম্মদ আবদুর রহমান, অগো মতন ইসলামের নাম ভাঙ্গাইতেই হইবো, দ্যাশটা আসলে মুসলমানের এই কথা মনে রাখতে হইবো; অগো দেশনেত্রী কোনো দিন পশ্চিমে মাথা ঠ্যাকায় না, ব্যাংকক থেকে আইন্যা পাঁচটা বিউটিশিয়ান রাখে, কিন্তু দাঁড়াইলেই কয় ইসলাম; অগো জেনারেল আর আমলাগুলি দিনরাইত মদে ডুইব্যা থাকে, কিন্তু খাকারি দিলেই কয় ইসলাম; আমাগোও তাই করতে হইবো।
এভাবে ক্রমশ কয়েক ঘণ্টায় তাদের নীতি স্থির হয়ে যায়।
শক্তির উৎসবাদী গণতান্ত্রিক রাজবংশের বৈঠক বসতে একটু দেরি হয়, কেননা মহাদেশনেত্রীর ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়; আমরা গরিবরা শুনতে পাই তিনি দুপুরের আগে ঘুম থেকে জাগতে পারেন না। সুখী মানুষ, সুখ বেশি, ঘুমও বেশি; আর তাতে শরিলটাও ভালো থাকে। এটা আমাদের জাতীয় গর্ব, একধরনের জাতীয়তাবাদ; আমরা যখন পাখপাখালির ডাকের আগে ঘুম থেকে উঠে মাঠে ময়দানে যেতে থাকি, আর ঘুমোতে পারি না, ঘুমোলে আমাদের পেট খালি থাকে, সেখানে মহাদেশনেত্রী একটা পর্যন্ত ঘুমোন, আমরা গরিবরা শুনি, আর গর্বে আমাদের পেট ভরে ওঠে। ঘুমে তিনি হয়তো আমাদেরই স্বপ্নে দেখেন, আমরা ফুলের মালা নিয়ে এসেছি, কাঁধে করে সিংহাসন নিয়ে আসছি, ঘুম থেকে উঠে তিনি তাতে বসবেন। মহাদেশনেত্রী সম্রাজ্ঞীর মোন, গরিবরা শুনতে পাই তার রাজবংশের কেউ তার সামনে বসারও সাহস করেন না, দাঁড়ানোরও সাহস করেন না; আমরা গরিব জনগণরা বুঝতে পারি না কীভাবে। তাহলে তারা মহাদেশনেত্রীর সাথে কথা বলেন। প্রাইমারি ইস্কুলে আমরা যেমন নিলডাউন হতাম, সেই কথাটি শুধু আমাদের মনে পড়ে।
মহাদেশনেত্রী হচ্ছেন ওই রাজবংশের মূর্ত রূপ।
দেরি হলেও ওই রাজবংশেরও সভা বসে; না বসে উপায় নেই; সকালে জাগার থেকে ঘুম বড়ো, আর ঘুমের থেকে সিংহাসন বড়ো।
মহাদেশনেত্রী তার আসনে বসে একবার হাসেন, কোনো কথা বলেন না।
তিনি চোখের সামনে একটা সিংহাসনের ছায়া দেখতে পান; এখন তিনি সিংহাসনে নেই ভেবে তার চোখ ঘোলা হয়ে আসে।
তার হাসিটি ম্লান হয়ে আসে; সভাকক্ষের বাতিগুলো যেনো নিভে আসে।
মহাদেশনেত্রীর মুখের হাসি ফিরিয়ে আনার জন্যে শক্তির উৎসবাদী এক গণতান্ত্রিক রাজপুরুষ অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু বলেন, আমরা আবার ক্ষমতায় যাইতাছি, ম্যাডাম; ক্ষমতায় যাওনের আমাদের দেরি নাই, দুই তিন মাসের মধ্যেই আমরা আবার ক্ষমতায় যামু।
মহাদেশনেত্রী জিজ্ঞেস করেন, কীভাবে যাবেন?
উই নিড ইসলাম, মানি, অ্যান্ড মাসেল, ম্যাডাম, বলেন অবজেনারেল (তিন দশকের রাজনীতির বিকাশের ফলে এই মূল্যবান শব্দটি ঢুকেছে রাষ্ট্রভাষায়, সমৃদ্ধ হয়েছে রাষ্ট্রভাষা) কেরামতউদ্দিন, টু উইন দিস ইলেকশন, অ্যান্ড ইলেশনে আমাদের জিততেই হবে। দে আর রাসকেলস, উই ক্যানট অ্যালাও দেম টু রুল দি কান্ট্রি। দে বিলং টু দি স্ট্রিট, দে আর শ্লোগানমংগারস।
আমাদের আবার ক্ষমতায় আসতে হবেই, বলেন অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু। (‘যেতে’র বদলে তিনি আসতে বলেন, তাঁর মনে হয় তারা এখনো ক্ষমতায় আছেন), পিপল আমাগো পক্ষে, আমরা ক্ষমতার বাইরে থাকতে পারি না, আমরা অই হারামজাদাগো হাতে দ্যাশ ছাইড়া দিতে পারি না। আমাদের ঠিক মতন ক্যান্ডিডেট দিতে হইবে, ঠিক মতন কাজ করতে হবে, আর মাননীয় প্রেসিডেন্ট সাহেবকেও দরকার হইলে কাজে লাগাতে হবে।
মহাদেশনেত্রী জিজ্ঞেস করেন, ক্যান্ডিডেট করবেন কাদের?
তিনি একবার একটি সিংহাসন দেখতে পান; তাঁর চোখ একবার ঝিলিক দিয়ে উঠে আবার অন্ধকার যায়।
যারা জিতবো, যাদের ট্যাকা আছে, মাসেল আছে, যারা মুসলমান বলে প্রাউড ফিল করে, তাদের ক্যান্ডিডেট করতে হবে, বলেন রাজপুরুষ মোহাম্মদ সোলায়মান হাওলাদার, এককালের মাওপন্থি ছাত্রনেতা, আর আমাদের বংশের নীতি ত ঠিকই করা আছে। মাসেল আর ট্যাকা দরকার, ড্যামক্র্যাসিতে এই দুইটা ছাড়া হয় না।
মহাদেশনেত্রী বলেন, এইটা ভালো করে দেখবেন।
কেরামতউদ্দিন বলেন, ড্যামক্র্যাসি মিস্ মাসল প্লাস মানি, এটা ভুললে আমাদের চলবে না; ড্যামক্র্যাসিতে শুধু মানি ইজ নট ইনাফ।
আমাগো ক্যাডারগো রেডি রাখতে হইবো, বলেন লিয়াকত আলি মিয়া, সারা দেশে ছড়াই দিতে হইবো।
আমাদের ক্যান্ডিডেটদের মধ্যে মাননীয় জেনারেলরা থাকবেন, ব্রিডেডিয়ার, কর্নেল, মেজর থাকবেন, তাঁরাই আমাদের বংশের মূলশক্তি, বলেন অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু, আর থাকবেন কয়েকজন মাননীয় বুরোক্র্যাট, ব্যারিস্টার; থাকবেন আমাদের সেই শ্রদ্ধেয় ভাইরা যারা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেন নাই, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিলেন, আর ক্যাডারগো কয়জনরেও লইতে হইবো। আর মাননীয় মহাদেশনেত্রীর রিলেটিভরা তো আছেনই। খালি আমাদের পার্টি থেকে ক্যান্ডিডেট দিলে হইবে না, অন্য পার্টি থেকেও ভাগাইতে হবে।
দ্যাখতে হবে তাদের টাকা আছে কিনা, মাসেল আছে কিনা, বলেন ছয়ফুর চাকলাদার, দ্যাখতে হবে কয়টা ক্যান্দ্র দখলের শক্তি আছে তাগো। দ্যাখতে হইবে তারা হিন্দুগো বাড়িতে আটকাইয়া রাখতে পারে কিনা।
ক্যাডার আর মানি আমাগো প্রব্লেম না, বলেন রুস্তম আলি পন্টু, এই কয় বচ্ছরে এই দুইটা আমাদের হয়ে গেছে।
ইট উইল বি এ ফ্যানাটিকেলি রিলিজিয়াস ইলেকশন, এ হোলি ওয়ার, এ ক্রুসেড, বলেন রাজপুরুষ ব্যারিস্টার কুদরতে খুদা, সবার উপরে থাকবে আমাদের রাষ্ট্রধর্ম। মাননীয় ম্যাডাম প্রথম আমাদের কয়েকজনকে লয়ে ওমরা করবেন, জনগণের উপর ওমরার ইনফ্লুয়েন্স অত্যান্ত বেশি, আমরা মক্কায়ও আলোচনা করবো।
রাজাকার রাজবংশের সঙ্গে আমাদের একটা আতাত দরকার, খোজাগুলির সঙ্গেও বোঝাঁপড়া দরকার, বলেন মোহাম্মদ সোলায়মান হাওলাদার, অইবার রাজাকার রাজবংশ আমাদের হেল্প করছে।
তাদের রাজাকার বলা ঠিক না, বলেন ছয়ফুর চাকলাদার, তারা আমাদের দোস্ত; তাগো অবদান তোলন ঠিক না। তাছাড়া আমাদের মহান নেতা তাগো ভালোবাসতেন, তাগো অনেক পোস্ট দিয়াছিলেন।
কিন্তু অরা কি আমাগো সঙ্গে আসবো?, বলেন অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টু, অরা তো আমাগো বিরুদ্ধে তিন বছর আন্দোলন করছে। অগো এতোগুলি সিট দিলাম, এতোগুলি মাইয়ালোক মেম্বার দিলাম; তারপরও অরা বিট্রে করলো।
মহদেশনেত্রী বলেন, পলিটিক্সে শেষ কথা বলে কিছু নেই।
আমরা সেইবার রাজাকারদের জন্যে পঞ্চাশটা আসন ছেড়ে দিয়েছিলাম, বলেন ব্যারিস্টার কুদরতে খুদা, অদের বলতে হবে এইবার ষাইটটা ছেড়ে দিবো যদি অরা পার্টনার হয়; আর খোজাবংশকে বলতে হবে আমাদের সাপোর্ট করলে অদের নেতাকে। জেল থেকে বের করে আনবো, সব মামলা খারিজ করে দিবো।
মহাদেশনেত্রী বলেন, কিন্তু আমি অকে জেলেই রাখতে চাই, অইটাকে আমি বাইরে দেখতে চাই না; আই হেইট হিম, হি ইজ এ কিলার।
মহাদেশনেত্রীর চোখের সামনে আবার সিংহাসন ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
তাইলে একটা উপায় আছে, বলেন রুস্তম আলি পন্টু, অর স্ত্রীর লগে আমরা মিট করতে পারি।
সবাই বলেন, অবশ্যই মিট করতে হবে, শি ইজ ভেরি পাওয়ারফুল ইন দি পার্টি।
রুস্তম আলি পন্টু বলেন, অর স্ত্রী খুবই অ্যামবিশাস, আর অর স্ত্রীও চায় না ও জেল থেকে বের হউক, তার কারণ আপনারা জানেন, অই মিস্ট্রেসগুলিন, আমরা অর স্ত্রীকে বুঝাইতে পারি যে তিনিই হবেন দলের নেত্রী। আমাগো লগে আসলে তাঁকে একদিন আমরা প্রধানমন্ত্রী করবো।
মহাদেশনেত্রী একবার রুস্তম আলি পন্টুর মুখের দিকে স্থিরভাবে তাকান।
রুস্তম আলি পন্টু কেঁপে উঠে বলেন, অইটা টোপ, ম্যাডাম, অইটা পলিটিক্স।
মহাদেশনেত্রী স্মিত হাসেন, যদিও তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদটি দিয়ে পলিটিক্স পছন্দ করেন না; রক্তচাপ স্বাভাবিক হয়ে আসে রুস্তম আলি পন্টুর।
আমরা জনগণরা শুনতে পাই এমন আরো অনেক নীতি আর আদর্শের আলোচনা হয় ওই সভায়; স্থির হয় ক্ষমতায় যেতেই হবে। ওই হারামজাদাদের হাতে ক্ষমতা। ছাড়ার থেকে সেই তাদের হাতে ছাড়া ভালো।
খোজাগণতান্ত্রিক রাজবংশের বৈঠক বসতেও কয়েক ঘণ্টা দেরি হয়।
কারণ এ-রাজবংশের বাবর, দলের প্রতিষ্ঠাতা, মহাজননেতা কারাগারে আছেন, এখন বের হওয়ার সম্ভাবনা নেই, আর তাদের কয়েকজন রাজপুরুষও পলাতক, এবং কয়েকজন জনগণমন গণতান্ত্রিক ও শক্তির উৎসবাদী গণতান্ত্রিক রাজবংশে যাওয়ার জন্যে নানা পথ খুঁজছেন; তাই দলের রাজপুরুষেরা ঠিক করে উঠতে পারেন না কে তাঁদের দলের সভায় সভাপতিত্ব করবেন–মহাজননেতার পত্নী না উপপত্নী? তাঁর পত্নীকে যদি তাঁরা মহাগণনেত্রী করে তোলেন, তাহলে তাদের অনেক অসুবিধা রয়েছে; ওই মহিলার ক্ষমতা ও টাকার লোভের কোনো শেষ নেই, তাঁদের মহাজননেতাকে তিনি কতোদিন নিজের পায়ের নিচে ফেলে রেখেছেন এটা তাঁরা সবাই দেখেও দেখেন নি; আর যদি মহাজননেতার উপপত্নীদের কাউকে তারা মহাগণনেত্রী করতে চান, তাহলে প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে কোন জনকে করতে হবে, মহাজননেতার প্রতিদ্বন্দ্বী উপপত্নীর সংখ্যা কম নয়। (একত্রে রাখলে একটি তুর্কি হারেম হয়ে যেতো), আর দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে দেশের বর্তমান খাঁটি ইসলামি আবহাওয়ায় তা গ্রহণযোগ্য হবে কিনা? উমাইয়া ও আব্বাসিয়া রাজাবাদশাদের বড়ো বড়ো হারেম ছিলো; কিন্তু খোজাবংশে হারেম থাকতে পারে কিনা?
এছাড়াও গভীরতর কারণ রয়েছে। রাজবংশটি এখন যিনি দেখছেন, যার ওপর মহাজননেতা ভার দিয়েছেন রাজবংশটির, সেই রাজপুরুষ মনোয়ার হোসেন মোল্লা তার বাসায় দশটি ডিজিটাল ও সেলুলার নিয়ে অপরিসীম ব্যস্ত রয়েছেন। একটির পর একটি টেলিফোন পাচ্ছেন তিনি; তাঁর স্ত্রী ধরছেন, তাঁকে দিচ্ছেন, তিনি ধরছেন, রাখছেন, কথা বলছেন, রাখছেন, আবার ধরছেন। তিনি এখন খুবই ব্যস্ত, তার বেয়ে এবং বাতাসে ভেসে তাঁর কাছে প্লাবনের মতো পলিটিক্স আসছে; তিনি নিপুণভাবে পলিটিক্স করে চলছেন।
মনোয়ার হোসেন এখন সেলুলার পলিটিক্স করছেন জনগণমন গণতান্ত্রিক রাজবংশের অন্যতম প্রধান চাচা নিজামউদ্দিন আহমদের সাথে।
নিজামউদ্দিন আহমদ বলেন, বাবা মোয়ার, আমি তোমার আব্বারে মিয়াভাই বলতাম, তোমার আব্বা আমারে স্নেহ করতেন, তুমি আমার ছেলের মতন। কত দিন তুমি আমার কান্ধে উঠছে।
মনোয়ার হোসেন বলেন, সেইজন্যই তো আপনারে চাচা কই, চাচা; সেই জন্যেই তো আপনার লগে আমার একটা রিলেশন আছে।
নিজামউদ্দিন আহমদ বলেন, তুমি আমারে চাচা কও এটা আমার গৌরব, আরো গৌরব যে তুমিই এখন তোমাগো দলের নেতা, এইজন্যে আমার সুখের শ্যাষ নাই।
মনোয়ার হোসেন বলেন, কিন্তু চাচা কয়টা বুড়া শয়তান গোলমাল করতেছে, দলটা ভাঙতে চায়; ন্যাতার স্ত্রীও গোলমাল করতেছে।
নিজামউদ্দিন আহমদ বলেন, তা আমরা জানি, তয় তুমিই নেতা থাকবা; তোমার জননেতা তোমারে বিশ্বাস করেন।
মনোয়ার হোসেন বলেন, সেইটাই আমার পাওয়ার চাচা।
নিজামউদ্দিন আহমদ বলেন, এইবার তোমরা আমাদের লগে থাকবা, তুমি আমাদের লগে থাকলেই তোমার দলও আমাগো লগে থাকবো।
মনোয়ার হোসেন বলেন, চাচা, আপনাগো লগেই তো আছি; অই ম্যাডামের দলও ফোন করছিলো, আমি থাকতে রাজি হই নাই।
নিজামউদ্দিন আহমদ বলেন, ঠিক করছো, বাবা, ঠিক করছো; গ্রেট পলিটিশিয়ানের কাজ করছে।
মনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের মহাজননেতা আমারে এককথা বলে দিয়েছেন কিছুতেই আমরা ম্যাডামের সঙ্গে পার্টনারশিপে যাবো না। মহান জননেতাকে সে অনেক ট্রাবল দিয়েছে।
নিজামউদ্দিন আহমদ বলেন, তিনি খাঁটি পলিটিশিয়ানের মতই কথা বলছেন। তারে যারা জ্যালে রাখলো তাগো লগে তিনি যাইতে পারেন না। তিনি ড্যামোক্র্যাসিতে বিশ্বাস করেন।
মনোয়ার হোসেন বলেন, কিন্তু চাচা, এই বিষয়ে একটা ফাইনাল কথা হইতে হইবো, আমারে বড়ো কিছু দিতে হবে।
নিজামউদ্দিন আহমদ বলেন, ফাইনাল কথা তো হইবোই, তুমিও বড়ো কিছু পাইবা, মহাজননেত্রী তোমার লগে একটা গোপন বৈঠকে বসতে চাইছেন, তোমারে একটা বড়ো কিছু দিতে পারলে তিনি সুখী হইবেন।
মনোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, আমিও তাই চাই, আমার যা স্ট্যাটাস তাতে ছোটো কিছুতে আমারে মানায় না। আপনাদের জননেত্রীর সঙ্গে কয়েকটা কথা আমার ক্লিয়ার হওয়া দরকার।
নিজামউদ্দিন আহমদ বলেন, সব কথা ক্লিয়ার কইরাই হবে, বাবা, কথায় কোনো জট থাকবো না। আমরা পরিষ্কার দিলের মানুষ। আমরা ক্ষমতায় আসলে তোমারটা। তুমি সঙ্গে সঙ্গে পাইবা, বঙ্গভবনেই পাইবা, একদিনও দেরি হইব না, তুমি আমাগো হইয়া যাইবা।
মনোয়ার হোসেন টেলিফোন রেখে কফির পেয়ালায় চুমুক দেন।
মনোয়ার মোল্লার স্ত্রী বলেন, পলিটিক্স খুবই ইন্টারেস্টিং, ভেরি অ্যামিউজিং অ্যান্ড হাইলি অ্যাবজর্বিং, মাচ বেটার দ্যান মেকিং লাভ, আমিও পলিটিক্সে জয়েন করতে চাই, মনোয়ার।
মনোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, তোমাকে এবার পার্লামেন্টের মেম্বার কইর্যা ছাড়বো, স্বামীস্ত্রীর দুইজনেরই পার্লামেন্টে থাকন দরকার।
অন্য দিকে মহাজননেতার মহীয়সী স্ত্রী গুলবদন বেগমও ব্যস্ত আছেন সেলুলার। পলিটিক্সে। তিনি এখন কথা বলছেন শক্তির উৎসবাদী রাজবংশের অধ্যক্ষ রুস্তম আলি পন্টুর সাথে।
রুস্তম আলি পন্টু বলেন, আছোলামালেইকুম, ম্যাডাম, আপনার শরিলটা ভালো তো, ম্যাডাম?
গুলবদন বেগম বলেন, শরিলটা ভালো, তবে মনটা ভালো নাই।
রুস্তম আলি পন্টু বলেন, পলিটিক্সে শরিল ভালো থাকে, তাও থাকতে চায় না, ম্যাডাম; কিন্তু মন ভালো রাখন যায় না। আমার মনও ভালো না। অনেক মাস ধইর্যাই মনটা ভালো নাই।
গুলবদন বেগম বলেন, আপনাদের কী প্রপোজাল বলেন ভাই, পষ্টাপষ্টি কইর্যা বলেন, রাখঢাকা করবেন না।
রুস্তম আলি পন্টু বলেন, ম্যাডাম, আপনাগো লগে আমরা থাকতে চাই; আমরা এক লগে থাকলেই দ্যাশের মঙ্গল।
গুলবদন বেগম বলেন, শোনছেন বোধয় দলে নানা প্যাঁচ লাগছে, আমি সেই দলেই থাকবো যেই দলে সুবিধা পাবো, আই মিন পাওয়ার অ্যান্ড মানি। খালি কথা দিয়ে কেউ আমার মন ভিজাইতে পারবে না।
রুস্তম আলি পন্টু বলেন, আমরা আপনেরে পাওয়ারও দিবো মানিও দিবো, ম্যাডাম, খালি দয়া কইর্যা আমাগো লগে থাকবেন।
গুলবদন বেগম বলেন, এই সম্বন্ধে একটা ক্লিয়ার আর ফাইনাল কথা হওন দরকার, আপনেরা কী কী দিবেন।
রুস্তম আলি বলেন, ফাইনাল কথা বলার জন্যে আমরা কয়জন আপনের কাছে আসতে চাই, ম্যাডাম।
গুলবদন বেগম বলেন, আসেন, আমি আপনাদের জন্যে ওয়েট কইর্যা রইলাম।
গুলবদন বেগম টেলিফোন রাখার সাথে সাথে আবার বেজে ওঠে। তবু তিনি না ধরে বিয়ারের গ্লাসে একবার চুমুক দেন।
এবার ফোন করেছেন জনগণমন দলের মোহাম্মদ আবদুল হাই। মোহাম্মদ আবদুল হাইয়ের সাথে গুলবদন বেগমের সম্পর্কটি অনেক বছর ধরে বেশ ভালো; নিয়মিতভাবে তিনি গুলবদন বেগমকে ফোন করেন।
মোহাম্মদ আবদুল হাই বলেন, আসোলামুআলাইকুম, ম্যাডাম। অনেক সময় ধইরা চ্যাষ্টা করছি, লাইন অ্যানগেজড আছিল।
গুলবদন বেগম বলেন, এখন তো লাইন অ্যানগেজড় থাকনেরই সময়, ভাই।
মোহাম্মদ আবদুল হাই বলেন, লাইনে আপনারে না পাইয়া অস্থির হইয়া উঠছিলাম, ম্যাডাম।
গুলবদন বেগম বলেন, আমিও মনে মনে আপনার কথা ভাবতেছিলাম, ফাইনাল ক্লিয়ার কথার জইন্যে কখন বসবেন?
মোহাম্মদ আবদুল হাই বলেন, আপনে সময় দিলে আজই বসতে চাই, ম্যাডাম; আপনেরে সন্তুষ্ট করার কথা বলেছেন আমাদের মহাজননেত্রী।
গুলবদন বেগম বলেন, কিন্তু শুনতে পাই আপনেরা মনোয়ার মোল্লার সঙ্গে দ্যানদরবার করছেন, সে তো আমাদের সার্ভেন্ট মাত্র।
আবদুল হাই বলেন, পলিটিক্স হইছে গুজবের ব্যবসা, ম্যাডাম, এইখানে সত্যমিথ্যার মধ্যে তফাৎ করন যায় না। আপনি, ম্যাডাম, গুজবে কান দিবেন না; আমাগো দল আর আপনের দল মিলেমিশেই কাজ করবো। অই মাইয়ালোকটার হাত থেকে ক্ষমতা বাইর করতেই হবে, নাইলে আপনার প্রাণপ্রিয় স্বামী মহাগণনেতাকে জ্যাল থেকে বাইর করন যাইবো না।
গুলবদন বেগম জিজ্ঞেস করেন, আপনেরা কি অই লোকটারে জ্যালের বাইরে আনবেন?
আবদুল হাই বলেন, অবশ্যই আনবো, ম্যাডাম, আপনে দেইখ্যেন।
গুলবদন বেগম বলেন, তবে অই লোকটা আমার বেশি চিন্তার বিষয় না; সে জ্যালের ভেতরে থাকলেই ভাল। কথা হচ্ছে আপনেরা আমারে কী দিবেন?
আবদুল হাই বলেন, আপনে যা চাইবেন তাই পাইবেন।
গুলবদন বেগম বলেন, অরা আমারে প্রধানমন্ত্রী করতে চায়, এইরকমই ইঙ্গিত দিছে।
আবদুল হাই একটু থমকে যান, কথা বলতে একটু সময় নেন, এবং বলেন, আমরাও সেই কথাই ভাবতেছি।
গুলবদন বেগম বলেন, কোন সময় আসবেন বলেন।
গুলবদন বেগম আবদুল হাইকে বিকেলে সময় দেন; আবদুল হাই টেলিফোন রেখে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে চিৎকার করে ওঠেন, এই মাইয়ালোকটা একটা বুড়ী বিচ।
খোজারাজবংশের বৈঠক বসলে দেখা যায় অনেক রাজপুরুষই অনুপস্থিত; কিন্তু মনোয়ার হোসেন মোল্লা বৈঠক শুরু করেন। মহাজননেতার স্ত্রী গুলবদন বেগমও বৈঠকে আসেন নি, মহাজননেতা মনোয়ার হোসেনকে নিষেধ করেছেন তাঁকে বৈঠকে ডাকতে। তার বদলে উপস্থিত আছেন মহাজননেতার প্রিয়তমা উপপত্নী বেগম মর্জিনা আবদুল্লা।
মনোয়ার হোসেন প্রথম মহাজননেতার সাথে তাঁর সাক্ষাৎকারের বিবরণ দেন।
মনোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, আমাদের লিডার খুবই কষ্টে আছেন, তিনি শীঘ্র বাইরে আসতে চান।
বেগম মর্জিনা আবদুল্লা বলেন, আমাকেও মহাজননেতা তাই বলেছেন। তার কষ্ট দেখে অশ্রু সংবরণ করা যায় না। হি ওয়াজ এ কিং আর এখন তিনি একটা চোরের মতন আছেন। তারে তাড়াতাড়ি বাইর করতেই হইবো।
বুড়ো শাহ আলম চৌধুরী জিজ্ঞেস করেন, লিডার কীভাবে মুক্তি পাইতে চান? লিডাররে আমরা কেমনে বাইরে আনতে পারি?
বুড়ো একটু ক্ষুণ্ণ, কেননা তার বদলে লিডার দলের ভার দিয়েছেন মনোয়ার হোসেন মোল্লার ওপর, যে তার পোলা হতে পারতো।
মনোয়ার হোসেন বলেন, লিডার বোঝেন এইবার আমরা ক্ষমতায় যাইতে পারবো না, যারা পাওয়ারে যাবে তাদের লগে গোপনে অ্যালায়েন্স করতে হবে। চুক্তি হবে লিডারকে ইমমেডিয়েটলি রিলিজ করতে হবে, আর আমাগো দলরে সুবিধা দিতে হবে।
বেগম মর্জিনা আবদুল্লা বলেন, মহাজননেতাকে রিলিজ করাই আমাদের প্রধান পলিটিক্স। তাইলেই আমাগো দল আবার দাঁড়াইবো। যে ছিলো দেশের রাজা, যার জইন্য জনগণ পাগল তারে অরা জ্যালে বাইন্ধা রাখছে। দিন আসলে এইটা দেখাইয়া দিব, জ্যাল খাটাইয়া ছাড়বো।
মোহাম্মদ ইমাজউদ্দিন ঝন্টু জিজ্ঞেস করেন, আমাগো দল হতে মন্ত্রী করা হইবো না?
শাহ আলম চৌধুরী বলেন, তা অবশ্যই করতে হইবো; আমাগো কয়জনরে মন্ত্রী করতে হইবো। যারা আমাগো মন্ত্রী করবো আমরা তাগো লগেই থাকুম; কিছু ট্যাকাপয়সাও দিতে হইবো।
মনোয়ার হোসেন বলেন, তা ডিপেন্ড করে আমরা কয়জন পাশ করি তার উপর, আমাগো কমপক্ষে পঞ্চাশটা সিট পাইতে হবে।
ব্যারিস্টার শাহেদ মিয়া জিজ্ঞেস করেন, আমরা কি এতগুলা সিট পাবো, আমাদের দলের কি অই অবস্থা আছে।
ব্যারিস্টার শাহেদ মিয়ার আজকের বৈঠকে আসার ইচ্ছে ছিলো না, তিনি আগে ছিলেন শক্তির উৎসবাদী রাজবংশে; আবার সে-রাজবংশে ফিরে যাওয়ার জন্যে তিনি গোপনে প্রাণপণে চেষ্টা করে চলছেন।
মনোয়ার হোসেন বলেন, আমাগো চ্যাষ্টা করতে হবে, উই মাস্ট ট্রাই আওয়ার বেস্ট; লিডার বাইরে থাকলে আমরাই ক্ষমতায় যাইতাম, পিপল তার জইন্যে পাগল; জ্যালে থিকাও একশোটা সিটে দাঁড়াইলে তিনি একশোটা সিটেই পাশ করবেন। কিন্তু আমাগো পঞ্চাশটা সিট পেতে হবে।
সভায় ঠিক হয় মনোয়ার হোসেন মোল্লা মহাজননেতার সঙ্গে আলাপ করে ব্যবস্থা নেবেন।
রাজাকার রাজবংশের এক বড়ো নেতা মওলানা রহমত আলি ভিস্তিও খুবই ব্যস্ত। রয়েছেন সেলুরার (আল্লা পরম দয়ালু, যিনি মানুষরে দিয়াছেন এই পবিত্র জিনিশটি, যা নিয়ে এখন, আমরা দেখতে পাই, আমাদের গার্মেন্টস্ আর পলিটিক্সরা খুবই ব্যস্ত) পলিটিক্সে; আল্লাতাআলার রহমতে তাঁর কাছে বাতাসে ভেসে আসছে থরেথরে দলে দলে পলিটিক্স। তৃতীয় বিবি মাঝেমাঝে পান আর শরবত দিয়ে যাচ্ছেন, গিয়ে দরোজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকছেন, আর পলিটিক্স করে চলছেন মওলানা রহমত আলি ভিত্তি। ওই যে আমাদের একটি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো, যার কথা আমরা ভুলেই গেছি, খুব না ঠেকলে যার কথা বলতে আমরা বিব্রত হই, যার কথা বললে অন্যরা কেমন চোখে তাকায়, যাতে পাকিস্থানিরা আমাদের খুনের পর খুন করেছিলো, মাবোনকন্যাদের ঘর থেকে টেনে নিয়ে ধর্ষণ করেছিলো, কিন্তু আমরা জয়ী হয়েছিলাম যে-যুদ্ধে, ভিস্তি সাহেব সেই সময় ছিলেন এক মস্ত বড়ো রাজাকার। শুনতে পাই তিনি ছিলেন খুন আর ধর্ষণের এক বড়ো সিপাহিসালার, ইখতেয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি, আঠারো নম্বর গাধাটিতে তিনি ছিলেন, মাথার ওপর তলোয়ার লড়াইতে লড়াইতে তিনি বঙ্গদেশে। এসেছিলেন; তবে খুন হয়ে আর ধর্ষিত হয়ে আমরা মাথা নিচু করি নি (এটা কেমনে হয়েছিলো আজ আর আমরা বুঝতে পারি না, এখন তো আমরা সব সময় মাথা নিচু করেই থাকি); আমরা জয়ী হয়েছিলাম। জয়! আমাদের জীবনের একমাত্র জয়। জয়ের পর স্বাধীন হই আমরা, আর বছরের পর বছর পরাজিত হতে থাকি; এবং ভিস্তি সাহেবরা পরাজয়ের পর বছরের পর বছর জয়ী হতে থাকেন। একাত্তরের সেই বছরটিতে দেশে এতো রাজাকার ছিলো না, আর এখন আমরা চারপাশে তো দেখতে পাই রাজাকার। এখন আমরা, মূর্খ লোকেরা, দেখি আমাদের পরাজয় আর ভিস্তি সাহেবদের জয়। আমরা এখন ভয়ে ভয়ে কথা বলি, কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছি; আর ভিস্তি সাহেবরা গলা ফুলিয়ে আমাদের খুন করে ফেলার ভয় দেখান; আমরা চোখ বুজে থাকি। আল্লা তাদের খুন করার তওফিক দিয়েছেন।
রাজাকারদের নেতা হয়ে ইমানআমান তিনি প্রথমেই পরীক্ষা করেন বাসার কাজের মেয়েটির ওপর। পাকিস্থানে যার বিশ্বাস আছে, তার আবার ভয় কী, তার আবার খুন জখম জেনা করার দ্বিধা কী। শ্বশুরবাড়ি থেকে মাসখানেক আগে তিনি সালেহা নামের কাজের মেয়েটিকে এনেছিলেন; তাঁর স্ত্রী গর্ভবতী, কাজকাম করতে পারে না, শুধু চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে। আনার পর তিনি মেয়েটিকে মন দিয়ে ধর্মকর্ম শেখান, এবং শেখানোর সময় মাঝেমাঝে মেয়েটির বুকের কাপড়ের নিচে হাত দিয়ে শিক্ষার উচ্চতা পরীক্ষা করেন। মেয়েটি ভিস্তি সাহেবের হাত সরিয়ে দিয়ে একটু দূরে গিয়ে ভিস্তি সাহেবের সাথে সাথে শ্লোক আবৃত্তি করতে থাকে।
একদিন তাঁর স্ত্রী গোসলখানায় ঢুকলে ভিস্তি সাহেব তাকে রান্না ঘরে চিৎ করে শোয়ানোর চেষ্টা করেন।
“রাজনীতিবিদগণ” উপন্যাস বা কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ