যুক্তি ষোলঃ আমরা পৃথিবীর ক’জন দেখেছি নিজের প্রপিতামহকে ? দেখিনি । তবু আমরা প্রপিতামহের নামটি তো বলি। এ কি বিশ্বাসের উদাহরণ নয় ? আমাদের পিতার নাম জিজ্ঞেস করলে মায়ের বিবাহিত স্বামীর নামই উল্লেখ করি। তিনিই যে আমাদের জন্মদাতা, তার প্রমাণ কী? এখানেও তো আমরা বিশ্বাসকেই আঁকড়ে ধরি। আমরা বায়ু চোখে দেখি না, তারের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত বিদ্যুৎ দেখতে পাই না, দেখতে পাই না শব্দতরঙ্গ, তবু এ-সবের অস্তিত্বে বিশ্বাসী। আমরা আকবরকে দেখিনি, গৌতমবুদ্ধকে দেখিনি। কোনও চাক্ষুস প্রমাণ ছাড়া এমনই হাজারো বিষয়কে আমরা যখন মেনে নিচ্ছি শুধুমাত্র বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে, তখন জ্যোতিষশাস্ত্রের ক্ষেত্রে কোন যুক্তিতে আমরা বিশ্বাসের ওপর নির্ভরতার বিরোধীতা করে প্রমাণ হাজির করতে বলব ?

বিরূদ্ধ যুক্তিঃ যুক্তিগুলো আপাত জোরাল মনে হলেও, বাস্তবিকপক্ষে এগুলো কোনও যুক্তি নয়। কেন নয়? এই প্রশ্নের আলোচনাতেই এবার ঢুকছি।

প্রাচীন যুগ থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি পণ্ডিত মহল প্রত্যক্ষ প্রমাণকে শ্রেষ্ঠ বললেও প্রত্যক্ষ অনুগামী প্রমাণকে অবশ্যই স্বীকার করে নিয়েছেন। ‘চরক সংহিতা’য় প্রত্যক্ষ অনুগামী তিন প্রকারের অনুমানের কথা বলা হয়েছে (১) বর্তমান ধূম দেখে বর্তমান অগ্নির অনুমান । (২) বর্তমান গর্ভবতী মহিলা দেখে তার অতীত মৈথুনের অনুমান। (৩) বর্তমান সুপুষ্ট বীজ দেখে ভবিষ্যৎ বৃক্ষ ও ফলের অনুমান।

এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি আগের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন অনুমানের কথা বলা হয়েছে; অনুমানগুলো বর্তমান দেখে বর্তমান, বর্তমান দেখে অতীত এবং বর্তমান দেখে ভবিষ্যৎ বিষয়ক। এই নিয়মে এখনও আমরা পূর্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে বর্তমান, অতীত এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ে অনুমান ও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি। আমার অস্তিত্ব থেকেই অনুমান করতে পারি, সিদ্ধান্ত নিতে পারি, আমার প্রপিতামহের অস্তিত্ব অবশ্যই ছিল। প্রপিতামহের অস্তিত্ব ছাড়া আমার অস্তিত্বই সম্ভব নয, একই ভাবে পিতার অস্তিত্ব ছাড়া আমার অস্তিত্ব সম্ভব নয়। আমার জন্মদাতাই যে মায়ের স্বামী, এমনটা হতে পারে, নাও হতে পারে। প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই এই সম্ভাবনা অবশ্যই আছে। কিন্তু বর্তমান সমাজের প্রচলিত রীতি অনুসারে আমরা সাধারণভাবে মা’য়ের বিবাহিত স্বামীকেই ‘পিতা’ বলে পরিচয় দিয়ে থাকি। এটা রীতির প্রশ্ন, প্রমাণের প্রশ্ন নয় ।

আমরা বায়ুকে চোখে না দেখলেও অনুভব করতে পারি, ওজন নিতে পারি, বায়ুর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে উইন্ড মিল চালাতে পারি। আরও বহু ভাবেই আমরা বায়ুর অস্তিত্বের প্রমাণ পাই। আমরা জল, কলা, ডিজেল, ব্যাটারী, পরমাণু শক্তি ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর সেই বিদ্যুৎ তারের মাধ্যমে পাঠাবার সময় নিশ্চয় দেখা যায় না, কিন্তু বিদ্যুৎচালিত আলো বা যন্ত্র থেকেই অনুমান করতে পারি বিদ্যুৎশক্তির। আমরা কোনও বিদ্যুৎশক্তির সঙ্গে যোগাযোগ না রেখে কিন্তু একটি পাঁচ ওয়াটের বাল্বও জ্বালতে সক্ষম হবো না। এই বাল্বই জ্বলে প্রমাণ করে দেয় তারের মধ্য দিয়ে বাহিত বিদুৎশক্তিই তাকে জ্বলতে সাহায্য করছে। একইভাবে বিজ্ঞান শব্দতরঙ্গের অস্তিত্বও প্রমাণ করেছে। বুদ্ধের মূর্তি, শিলালিপি, আকবরের বিভিন্ন দলিলের বর্তমান অস্তিত্বের ওপর নির্ভর করেই আমরা তাঁদের অতীত অস্তিত্ব অনুমান করতে পারি। কিন্তু এমন ধবনের কোনও প্রমাণই আমাদের সামনে জ্যোতিষীরা হাজির করতে পারেন নি, যার দ্বারা আমরা অনুমান করতে পারি বা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি -মানুষের ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত এবং গ্রহ-নক্ষত্রই মানুষের ভাগ্যকে পূর্বনির্ধারিত করেছে এবং জ্যোতিষ-শাস্ত্রের সাহায্যে সেই পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যকে জানা সম্ভব ।

error: Content is protected !!