যুক্তি পনেরঃ জ্যোতিষশাস্ত্রে চন্দ্র সূর্যকে গ্রহ আখ্যা দেওয়ায় অনেকে জ্যোতিষশাস্ত্রকে উপহাস করতে এগিয়ে আসেন। তাঁদের বক্তব্য, যেহেতু জ্যোতিষশাস্ত্র প্রণেতাদের গ্রহ, নক্ষত্র ও উপগ্রহের পার্থক্যের জ্ঞান ছিল না, তাই এই শাস্ত্র গুরুত্ব পেতে পারে না।
এই সমস্ত তথাকথিক যুক্তিবাদী ও তার্কিকদের জানা প্রয়োজন, জ্যোতিষশাস্ত্রে তাদেরই গ্রহ আখ্যা দেওয়া হয়েছে, যারা পৃথিবীর মানুষের শুভাশুভ কারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। কে সূর্যকে আবর্তন করল বা কে গ্রহকে আবর্তন করল তা বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য কার প্রভাব রয়েছে মানুষের ওপর। আর যাদের প্রভাব আছে, তাদেরই গ্রহ নাম দেওয়া ত্রুটির পরিচয় নয়।
এই যুক্তি জ্যোতিষসম্রাট ডঃ অসিতকুমার চক্রবর্তীসহ অন্তত ডজন-খানেক নামী জ্যোতিষীর। আর এই যুক্তিটা জ্যোতিষ-বিরোধীদের আক্রমণ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তারই প্রমাণ অন্তত একগণ্ডা ‘জ্যোতিষ বনাম বিজ্ঞান’ শিরোনামের আলোচনাচক্রে জ্যোতিষরা এই বক্তব্য রেখে আক্রমণ চালিয়েছেন।
বিরূদ্ধ যুক্তিঃ আমার কাছে সম্প্রতি একটি যুবককে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর মা। যুবকটির বয়স বছর পঁয়তিরিশ। সুন্দর চেহারা, ফর্সা রঙ। যুবকটির মা’র ধারণা তাঁর ছেলেটি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। আর, ছেলেটির ধারণা, সে অতি মাত্রায় সুস্থ। ছেলেটির নাম প্রকাশে অসুবিধে থাকায় আমরা ধরে নিলাম ওর নাম অটল। অটল চাকরি করেন একটি আধা- সরকারী প্রতিষ্ঠানে। প্রায়ই অফিসে যান না। না যাওয়ার কারণ, অটলের পিছনে সহকর্মীরা বড় বেশি লাগেন। বলতে গেলে দস্তুর মত র্যাগিং করেন। র্যাগিংটা আজ পর্যন্ত শরীরীক পর্যায়ে না গেলেও মানসিক অবশ্যই। অটলের কথায়, “ওইসব তথাকথিত শিক্ষিত সহকর্মীরা এক একটি অশিক্ষিতের ধাড়ি। ‘যা উড়ে তাই পাখি’, এই সত্যটা বুঝতে না পেরে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে। আসলে ওদের জানা উচিত, শাস্ত্রে আছে পাখিরা আকাশে ওড়ে। শাস্ত্রে তাদেরই পাখি আখ্যা দেওয়া হয়েছে, যা ওড়ে।”
অটলের মা বললেন, “ওই হয়েছে অসুবিধে। ঘুড়িকে বলবে পাখি, মেঘকে বলবে পাখি, এরোপ্লেনকে বলবে পাখি। ওকে বোঝালেও বোঝে না। তাইতেই অনেকে এই নিয়ে ওর পেছনে লাগে।”
অটল রাগলেন। মা’কে বললেন, “তুমিও ওদের মতই বড় ফালতু বকো । কে কাগজের তৈরি, কে জলকণা দিয়ে তৈরি বা কে ধাতু দিয়ে তৈরি, তা শাস্ত্রের বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য, সেটা ওড়ে কি না ? যদি ওড়ে, তবে অবশ্যই সেটা পাখি।”
জ্যোতিষীদের যুক্তির সঙ্গে অটলের যুক্তির যে দারুণ রকম মিল আছে, এটা নিশ্চয়ই পাঠক-পাঠিকারা লক্ষ্য করেছেন। অটলকে ঠিক করতে পেরেছিলাম। কারণ তিনি ছিলেন বাস্তবিকই মানসিক রোগী। কিন্তু জ্যোতিষীদের ঠিক করা বেজায় মুশকিল। কারণ তারা সাজা মানসিক রোগী। এমন পাগলমার্কা যুক্তি না দিলে লোক ঠকিয়ে রোজগারের পথটাই যে বন্ধ হয়ে যাবে, এটা ওঁরা খুব ভালমতই বোঝেন।
জ্যোতিষীদের আর একটি দাবিও দারুণই মজার। তাঁদের মতে- “মানুষের ওপব যাদেব প্রভাব আছে তারাই জ্যোতিষশাস্ত্র মতে গ্রহ।” তর্ক না করে এই দাবি মেনে নিলেও একগাদা বিপদ হুড়মুড় কবে এসে পড়ছে জ্যোতিষশাস্ত্রের ঘাড়ের ওপর। জ্যোতিষশাস্ত্রে দেখতে পাচ্ছি ২৭টি নক্ষত্রের প্রভাবের কথাও আবার বলা হচ্ছে। প্রভাব বিস্তাব করার কথা স্বীকার করেও এই ২৭টি নক্ষত্রকে গ্রহ বলা হচ্ছে না কেন ? কেন এই স্ববিরোধীতা ? কেন জ্যোতিষশাস্ত্রের সর্বত্র এই ধরনের গোঁজামিল ও স্ববিরোধীতা ?
জ্যোতিষীদের এই দাবিটির যুক্তিহীনতার কিন্তু এখানেই শেষ নয়। জ্যোতিষীদের মতে- “মানুষের ওপর যাদের প্রভাব আছে তাদের গ্রহ নাম দেওয়াটা কোনও ত্রুটির পরিচয় নয়।” তার মানে জ্যোতিষ মতে দূষিত বায়ু, দূষিত জল, বন্যা, খরা, নদী, নালা, পাহাড়, সমুদ্র ইত্যাদি প্রকৃতির সব কিছুই গ্রহ— কারণ এ-সবেরই প্রভাব আছে মানুষের ওপর। এই প্রাকৃতিক পরিবেশ ছাড়াও আর্থসামাজিক ও সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছুই তবে গ্রহ, যেহেতু মানুষের ওপর এদের প্রভাব বিদ্যমান। তার মানে ভাষা, সংগীত, নৃত্য, নাটক, শিল্পকলা, চোরাচালান ইত্যাদি সব কিছুই গ্রহ? বাঃ, ভারি মজা তো? এ-যে দেখি নির্ভেজাল ‘অটল কেস’ ।