যুক্তি চারঃ জাতকের ভবিষ্যৎ বিচারে অনেক সময় জ্যোতিষীদের ভুল হয় বই কী । কারণ পুরুষকার দ্বারা নিজের ভাগ্যকে পাল্টে দিতে পারে মানুষ। প্রাচীন ঋষিরাও ভাগ্য পরিবর্তনে পুরুষকারের ভূমিকার কথা স্বীকার করেছেন। মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন, “যেমন একটি চাকার সাহায্যে রথের গতি ক্রিয়াশীল হয় না, দুটি চাকাই অপরিহার্য তেমনি পুরুষকার ছাড়া কেবলমাত্র ভাগ্য সহায়ে সব সময় সিদ্ধিলাভ হয় না।”
বিরুদ্ধ যুক্তিঃ জ্যোতিষশাস্ত্রকার ও জ্যোতিষীরা বলেন—ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত। অর্থাৎ একজন জাতকের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত প্রতিটি ঘটনাই পূর্বনির্ধারিত। আগে থেকে ঠিক করাই আছে, এর পরিবর্তন কোনওভাবেই সম্ভব নয়। কারণ, পরিবর্তন সম্ভব হলে ‘পূর্বনির্ধারিত’ কথাটিই অর্থহীন হয়ে পড়ে। একজনও যদি নিজ চেষ্টায় পুরুষকারের দ্বারা নিজ ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষমই হন, তবে তো জ্যোতিষশাস্ত্রের ‘ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত’ তত্ত্বই ভেঙে পড়ে। আর এই তত্ত্বের উপর নির্ভর করেই তো জ্যোতিষশাস্ত্র দাঁড়িয়ে আছে। এই তত্ত্বের ওপর নির্ভর করেই অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ গণনা করা হয় ।
ধরা গেল, রামবাবু দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান। ভাগ্যে নির্ধাতির হয়ে রয়েছে—বিদ্যোর দৌড় পাঠশালার গণ্ডি পার হয়ে আর এগুবে না। প্রায় রুটিনমাফিক জীবনযাত্রা। সকাল থেকে সন্ধে হাড়ভাঙা খাটুনি ; পরের জমিতে হাল চালান, ফসল বোনা, মজুর খাটা, ঘর হাওয়া, বিনিময়ে জোটে আধপেটা খাওয়া। অল্পবয়সে বিয়ে। বিপুল সংখ্যক রুগ্ন সস্তান । কিছু সন্তানের অকালমৃত্যু । জীবিত সন্তানদের ভাগ্যে রয়েছে শিশু-শ্রমিক হওয়া । স্ত্রীর ভাগ্যে রক্ত-স্বল্পতা। পরিবারের প্রত্যেকের ভাগ্যেই আছে রোগ-ভোগ, বিনা চিকিৎসায় রোগকে ভোগ।
রামবাবু পুরুষকারের দ্বারা, প্রয়াস দ্বারা বিদ্যায়, বুদ্ধিতে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন। দেশবাসীর কাছে হয়ে উঠলেন পরম শ্রদ্ধেয়। বিয়ে করলেন সহকর্মী অধ্যাপিকাকে । সন্তান সংখ্যা দু’য়ে সীমাবব্ধ। অসুখ হলে ওষুধ আসে, চিকিৎসক আসেন, সংসারে বৈভব না থাকলেও স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব নেই। স্বাস্থ্যজ্বল সুন্দর ছেলে উজ্জ্বল ডাক্তারী পড়বার পাশাপাশি ক্রিকেট খেলে সুন্দর। মেয়ে জয়া গানের তালিম নেয় প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞের কাছে । ক্লাস টেনে পড়ে। ইতিমধ্যেই সঙ্গীত জগতের বিরল প্রতিভা হিসেবে সাড়া জাগিয়েছে।
এ-ক্ষেত্রে আমরা কী দেখলাম ? রামবাবু তাঁর পুরুষকার দ্বারা শুধুমাত্র নিজের ভাগ্যের পূর্বনির্ধারিত ঘটনাগুলোকেই বদলে দেননি; বদলে গেছে তাঁর স্ত্রীর রক্তস্বল্পতায় ভোগা হাড়ভাঙা খাটুনির জীবন। সন্তানদের ভাগ্যে রুগ্নতা থাবা বসাতে ব্যর্থ হয়েছে। থাবা বসাতে ব্যর্থ হয়েছে মৃত্যুও। সন্তানরা শিশু-শ্রমিক না হওয়ায় গোল পাকিয়েছে আরো জায়গায় । জয়ার ভাগ্যে ছিল শ্যামবাবুর বাড়ি ঝি খাটবে। খাটতে হয় না। শ্যামবাবুর ভাগ্যও তারই সঙ্গে গেল পান্টে। শ্যামবাবুর বাড়িতে ঝি খাটে কমলা। অথচ কমলার ভাগ্যে শ্যামবাবুর বাড়ি ঝি খাটার কথা লেখা ছিলই না। উজ্জ্বলের যে ইটখোলায় মাটি কাটার কথা, সেখানে যে-সব ইটখোলা শ্রমিকদের উজ্জ্বলকে বন্ধু হিসেবে পাওয়ার কথা, সে সব পূর্ব নির্ধারিত কথাই বানের জলে ভেসে গেছে এক রামবাবুর পুরুষকারের ধাক্কায়। আর, একটু বেশি তলিয়ে ভাবতে গেলে দেখতে পাব দৈনন্দিন বহু শত মানুষের ভাগ্যই রামবাবু দিয়েছেন পাল্টে । রামবাবু মজুর না খাটায়, ঘর না ছাওয়ায় রামবাবুকে যারা প্রায়শই শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করবে বলে ভাগ্য নির্ধারিত ছিল, তাদের ভাগ্য কেন পাল্টে গেল ? তারা তো বাড়তি কোনও পুরুষকার প্রয়োগ করেনি ? তবে ? রামবাবুর মৃত সন্তানদের নিয়ে যে সব গ্রামবাসীদের শ্মশানযাত্রী হওয়ার কথা ছিল, রামবাবুর সন্তানরা না মরায় গ্রামবাসীদের শ্মশানযাত্রী হওয়ার নির্ধারিত ঘটনাই গেল পাল্টে। প্রতি বছর বহু ছাত্র-ছাত্রী রামবাবুর কাছে পাঠ নিচ্ছে, যে সব ছাত্র-ছাত্রীদের ভাগ্যে আদৌ রামবাবুর কাছে শিক্ষালাভের কথা লেখা ছিল না । এমন করে বিচারে বসলে অবশ্যই দেখব এক রামবাবুর একার পুরষকারই হাজার হাজার মানুষের জীবনের লক্ষ-কোটি পূর্বনির্ধারিত ঘটনা দিয়েছে পাল্টে। আর লক্ষ লক্ষ মানুষ যখন প্রতিনিয়ত প্রয়াসী হয়, তখন তো সহস্র কোটি মানুষের পূর্বনির্ধারিত জীবনের মুহূর্তগুলো প্রতিনিয়ত পাল্টে যেতেই থাকে। এরপরও কী করে বেজায় আহাম্মকের মত জ্যোতিষীরা দাবি করে মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে রয়েছে? নাকি এইসব জ্যোতিষীরা সাজা আহাম্মক আসলে জ্ঞানপাপী, এক একটি রাম-ধরিবাজ ?
এইপর সাধারণ যুক্তিতে আর একটি প্রশ্ন অবশ্যই বিশালভাবে নাড়া দেয়, তা হলো, জ্যোতিষীরা একই সঙ্গে বলছেন মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত নির্ধারিত হয়েই রয়েছে, অর্থাৎ অলঙ্ঘনীয় . অর্থাৎ কোনভাবেই পরিবর্তন ঘঠান সম্ভব নয়। জ্যোতিষশাস্ত্রের সাহায্যে এই পূর্ব নির্ধারিত ঘটনার হদিশই গণনা করে বের করা হয়। জীবনের কোনও একটি ঘটনার পরিবর্তন ঘটান সম্ভব হলে ভাগ্য ‘নির্ধারিত’, ‘অলঙ্ঘনীয়’ ইত্যাদি দাবিগুলোই চূড়ান্ত মিথ্যে হয়ে যায়। পুরুষকার দ্বারা যদি ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটানই যায়, তবে ভাগ্যকে অপরিবর্তনীয় বলা যায় কোন যুক্তিতে ? যে-সব জ্যোতিষী এমন উদ্ভট, যুক্তিহীন, স্ববিরোধী বক্তব্য রাখেন, তাঁরা হয় আকাট মূর্খ, নয় ধুরন্ধর বদমাইস।
পুরুষকার বিষয়টি নিয়ে দু-একটি কথা বললে নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না। পুরুষকার কথার অর্থ ‘উদ্যোগ’ ‘কর্মপ্রচেষ্টা’। প্রাকৃতিক, আর্থসামাজিক, সমাজ-সাংস্কৃতিক সু- পরিবেশযুক্ত সমাজে, উন্নত সমাজে মানুষের উদ্যোগ বা কর্মপ্রচেষ্টা সার্থকতা খুঁজে পায় । কিন্তু অনুন্নত পিছিয়ে পড়া সমাজে যেখানে জীবনযুদ্ধে পদে পদে অনিশ্চয়তা, ন্যায়নীতির অভাব, সেখানে পুরুষকার বা কর্মপ্রচেষ্টা বহুক্ষেত্রেই ঐকান্তিকতা সত্ত্বেও ব্যর্থ হয় বারবার। উদাহরণ হিসেবে আমরা নিশ্চয়ই ভাবতে পারি, যে দেশে বারো কোটি বেকার, সে দেশের বারো লক্ষ মানুষের কর্ম-সংস্থানের ব্যবস্থা যদি হয় তবে, শতকরা মাত্র একজনের বেকারত্ব ঘুচবে। শতকরা নিরানব্বইজনই থেকে যাবে বেকার। শতকরা দশজন বেকার যদি কর্মপ্রচেষ্টার দ্বারা, পুরুষকার দ্বারা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাকরি খুঁজে পেতে বিভিন্নভাবে নিজেকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার উপযুক্ত করে গড়েও তোলে তবুও প্রতি দশজনের মধ্যে ন’জনের পুরুষকারই জীবনযুদ্ধে বয়ে নিয়ে আসবে কেবলমাত্র ক্লান্তি ও ব্যর্থতা।
কোনও দেশে উচ্চ শিক্ষাদানের ব্যবস্থা যদি থাকে পঞ্চাশ হাজার মানুষের জন্য, তবে পাঁচ লক্ষ মানুষ পুরুষকার দ্বারা, প্রচেষ্টার দ্বারা নিজেদের উচ্চশিক্ষা লাভের উপযুক্ত করে গড়ে তুললেও চার লক্ষ পঞ্চাশ হাজার মানুষের পুরুষকারই চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হতে বাধ্য
একজন মানুষের উদ্যোগ, কর্মপ্রচেষ্টা বা পুরুষকার কতটা সাফল্য পাবে, সেটা পরিপূর্ণভাবে নির্ভর করে সেই মানুষটি কোন সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ তার ওপর। অতএব ভাগ্য পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে পুরুষকারের ভূমিকার জ্যোতিষতত্ত্ব শুধুমাত্র পরস্পরবিরোধীই নয়, সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে অজ্ঞাতারও ফসল।
প্রাচীনকালের জ্যোতিষীরা পুরুষকারকে স্বীকার করেছিলেন বাধ্য হয়ে। কারণ প্রাচীন ও মধ্যযুগের বহু সম্রাট ও রাজারা জ্যোতিষীদের কথায় আস্থা রেখেও যুদ্ধে পরাজ্য এড়াতে পারেন নি, প্রাণ দিয়েছেন গুপ্ত-ঘাতকদের হাতে। জয়ী হয়েছেন জ্যোতিষবিচারে পরাজিতরা, গুপ্ত হত্যার পর সিংহাসনে বসেছেন চক্রান্তকারী। জ্যোতিষীরা জ্যোতিষশাস্ত্রের অক্ষমতা ঢাকতে জয়ী ও চক্রান্তকারীদের পুরুষকারকে জ্যোতিষগণনা উল্টে দেওযার জন্য দায়ী করেছেন বারবার।
এখনও সেই একই উদ্দেশ্যে জ্যোতিষীরা মানুষদের ভাগ্য বিচারের পাশাপাশি পুরুষকারের অস্তিত্ব এবং প্রভাবের কথাও বলছেন। রাশিচক্র বিচার করে জাতক সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার দাবি রাখার অর্থ একটাই, তা হলো প্রত্যেকটি মানুষের ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত। কারণ ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত না হলে ভবিষ্যদ্বাণী করা যাবে কী করে? পূর্বনির্ধরিত হলে পুরুষকার কেন, কোনও কিছুর দ্বারাই কোনও মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটান অসম্ভব। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজের বহু মানুষের জীবনের ঘটনার সঙ্গে তার জীবনের ঘটনাও জড়িয়ে আছে, জড়িয়ে থাকবে। প্রতিটি মানুষ সমাজ ও পরিবেশের নিয়ম ও শৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত। একটি মানুষও যদি পুরুষকার দ্বারা তার পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যকে পরিবর্তন করে তবে সামগ্রিক নিয়ম শৃঙ্খলাই ভেঙে পড়বে। জাতকটির জীবনের সঙ্গে প্রতক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত মানুষের জীবনের অনেক ঘটনাই বদলে যেতে বাধ্য। তখন দেখা যাবে পুরুষকারকে প্রয়োগ না করা সত্ত্বেও বহু মানুষের পূর্বনির্ধাতিব ভাগ্য পাল্টে গেছে। অর্থাৎ ভাগ্য পরিবর্তনশীল। অর্থাৎ ভাগ্য পূর্বনির্ধারিতই নয়। অর্থাৎ রাশিচক্র বিচার করে ভবিষ্যদ্বাণী করা অসম্ভব এবং অবাস্তব একটি দাবি মাত্র।