যুক্তি তিনঃ বিজ্ঞান কি প্রমাণ করতে পারবে- জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান নয় ?
বিরুদ্ধ যুক্তিঃ দাবির যথার্থতা প্রমাণের দায়িত্ব সব সময়েই দাবিদাবের, জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিজ্ঞান বলে প্রমাণ করার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব জ্যোতিষীদেব ।
এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ না কর পারলাম না। ২৩শে জানুয়ারী ‘১০ কৃষ্ণনগর টাউন হলের মাঠে ‘বিবর্তন’ পত্রিকা গোষ্ঠির আমন্ত্রেণে গিয়েছিলাম ‘জ্যোতিষ বনাম বিজ্ঞান শিরোনামের এক বিতর্ক সভায় বা আলোচনা সভায়। সেই সভায় এক জ্যোতিষী আমাকে বলেছিলেন, “আপনি প্রমাণ করতে পারবেন-জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান নয় ?”
জ্যোতিষীটির এই চ্যালেঞ্জ শ্রোতাদের যে যথেষ্টই নাড়া দিয়েছিল, সেটুকু বুঝতে কোনই অসুবিধে হয়নি আমার। উত্তরে আমি বলেছিলাম, “জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান, কী বিজ্ঞান নয়, এই প্রসঙ্গটা মুলতুবি রেখে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটিয়ে দেখাব। না, ঘটনাটা অলৌকিক বলছি না, তবে এর কার্য-কারণ সম্পর্কটি এখনও আমার অজানা। আপনার আমার জীবনে কখনও হয়তো এমন ঘটনা ঘটলো, যার ব্যাখ্যা, কার্য-কারণ সম্পর্ক আপনার আমার অজানা। এই সময় যদি আমি ভেবে বসি, এর ব্যাখ্যা শুধু আমাদের পক্ষেই নয়, কারো পক্ষেই দেওয়া অসম্ভব, তখন ঘটনাটিকে লৌকিক-কারণবর্জিত অর্থাৎ অলৌকিক বলে বিশ্বাস করে ফেলি । যুক্তিবাদীরা অবশ্য মনে করেন, প্রতিটি ঘটনার পিছনেই রযেছে যুক্তিগ্রাহ্য কারণ। কারণটি তাঁর কাছে অজানা হলেও কারো হয় তো জানা। কারণটি বর্তমানে কারো জানা না থাকার অর্থ এই নয় যে কারণ ছাড়াই ঘটনাটি ঘটেছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অনেক অজানা রহস্যের ঘেরাটোপ প্রতিটি দিনই দূরে সরে যাচ্ছে। আজ যে কারণটি অজানা, ভবিষ্যতে সে কারণটিও এক সময় হয়তো জানা হয়ে যাবে। আর না জানা গেলে বড় জোর এ- কথাই প্রমাণিত হবে কারণটি এখনও আমাদের অজানা, কিন্তু কারণ নেই—এমনটা হয় না । এখন যে ঘটনা আপনাদের সামনে ঘটিয়ে দেখাব, তার কারণটি আমার অজানা। হয়তো আপনাদের কারো জানাও থাকতে পারে। জানা থাকলে অনুগ্রহ করে কারণটি জানাবেন । “আমি দেখেছি তিন বার জোড়া পায়ে লাফালে অনেক সময়ই আমার উচ্চতা তিন ইঞ্চি বেড়ে যায়।”
আমি সেই জ্যোতিষীটিকেই মঞ্চে ডেকে নিয়েছিলাম, যিনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।
মঞ্চের পাশে একটি স্তপ্ত। স্তম্ভের সামনে দাঁড়ালাম। আমার অনুরোধে জ্যোতিষী আমার উচ্চতা চিহ্নিত করে স্তম্ভে দাগ দিলেন। জনতা অধীর আগ্রহ আর উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। আমি জোড়া পায়ে তিনবার লাফালাম। জ্যোতিষীকে বললাম, “এ-বার মাপলেই দেখতে পাবেন তিন ইঞ্চি বেড়ে গেছি।”
কিছু দর্শকের কথা কানে আসছিল—“ওই তো বেড়ে গেছেন, ” “বেড়েছেন, এখান থেকেই বোঝা যাচ্ছে” ইত্যাদি ইত্যাদি ।
জ্যোতিষীটি আমার উচ্চতা মাপলেন। মাপতে গিয়ে বোধহয় কিছু গণ্ডগোলে পড়লেন। আবার মাপলেন। আবারও। তারপর অবাক গলায় বললেন, “আপনার উচ্চতা তো একটুও বাড়েনি ?”
আমিও কম অবাক হলাম না। “সে কী ? আমি বাড়িনি ? ঠিক মেপেছেন তো “হ্যাঁ, ঠিকই মেপেছি। যে কেউ এসে দেখতে পারেন।”
“না না, আপনাকে অবিশ্বাস করছি না। যাই হোক, আজ আমি আপনাদের অবাক করতে পারলাম না। যে কোনও কারণে ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু আমি ব্যর্থ হয়েছি মানে এই নয় যে আমি পারি না। আমি পারি। কেন আমি তিন লাফে তিন ইঞ্চি লম্বা হই, এটা আজও আমার কাছে রহস্য। এই রহস্যের কারণ আপনারা কেউ বলতে পারবেন ?”
আমার কথায় দর্শকদের মধ্যে গুঞ্জন শোনা গেল। অনেকেই বোধহয় আমার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেন নি । প্রথম জোরালো প্রতিবাদ জানলেন জ্যোতিষীটিই, “আপনি যে বাড়েন, সে কথাই প্রমাণ করতে পারলেন না, সুতরাং বাড়ার ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রসঙ্গ আসছে কোথা থেকে ?”
বললাম, “ভাই, আজ তিন লাফে তিন ইঞ্চি লম্বা হতে ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি সত্যিই এমনটা ঘটাতে পারি। অনেক বার ঘটিয়েছি। এখন নিশ্চয়ই আপনারা আমার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করতে পারছেন।”
“স্যরি, আমি অন্ততঃ আপনার কথায় বিশ্বাস করতে পারছি না। এবং আশা করি কোনও যুক্তিবাদী মানুষই আপনার দাবিকে শুধুমাত্র আপনার মুখের কথার উপর নির্ভর করে মেনে নেবেন না।” জ্যোতিষীটি বললেন।
এবার আমার রাগ হওয়ারই কথা। একটু চড়া গলাতেই বলে ফেললাম, “অর্থাৎ আপনি আমাকে অবিশ্বাস করছেন। কিন্তু আমার এই ব্যর্থতার দ্বারা আদৌ প্রমাণ হয় না যে আমি মিথ্যেবাদী। আপনি প্রমাণ করতে পারবেন—আমি কোনও দিনই তিন লাফে তিন ইঞ্চি লম্বা হইনি?”
জ্যোতিষীটি এবার আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না। চড়া গলায় বললেন, “আমার প্রমাণ করার কথা আসছে কোথা থেকে ? আপনি ভালোভাবেই জানেন, এমনটা প্রমাণ করা আমার কেন, কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। দাবি করেছেন আপনি। সুতরাং দাবির যাথার্থতা প্রমাণের দায়িত্বও আপনারই।”
হেসে ফেললাম, বললাম, “সত্যিই সুন্দর যুক্তি দিয়েছেন। এই যুক্তিটা আপনার মুখ থেকে বের করতেই লাফিয়ে বাড়ার গল্পটি ফেঁদেছিলাম। আমার কোনো দিনই লাফিয়ে বাড়ার ক্ষমতা ছিল না, থাকা সম্ভবও নয়। কিন্তু তা সত্বেও এমন উদ্ভট দাবি করলে আপনাদের কারো পক্ষেই প্রমাণ করা সম্ভব নয়–আমি কোনও দিনই তিন লাফে তিন ইঞ্চি বাড়িনি । বাস্তবিকই দাবির সমর্থনে প্রমাণ করার দায়িত্ব দাবিদারের। আর এই কারণেই জ্যোতিষশাস্ত্র যে বিজ্ঞান এটা প্রমাণ করার সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব জ্যোতিষীদের।”
উপস্থিত শ্রোতারা তুমুল হাসি আর হাততালিতে বুঝিয়ে দিলেন, আমার যুক্তি তাঁদের খুবই মনের মত ও উপভোগ্য হয়েছে ।
না। জ্যোতিষীটি এর পর আর কোনও বিরুদ্ধ যুক্তি হাজির করতে চেষ্টা না করে ফিরে গিয়েছিলেন দর্শকদের মাঝে ।