২য় সংস্করণের ভুমিকা

 

বিশ্বাসের ভাইরাসের ২য় সংস্করণ বেরিয়ে গেল। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির বইমেলায় যখন বইটির প্রথম সংস্করণ বেরিয়েছিল তখন ভাবতেই পারিনি এতো দ্রুত— মানে কয়েক মাসের মধ্যেই বইটির ২য় সংস্করণের ভূমিকা লিখতে হবে। কিন্তু লিখতে হল। নতুন সংস্করণের জন্য ভূমিকা লেখার পেছনে যেমন আনন্দের ছোঁয়া আছে, তেমনি পাশাপাশি আছে কিছুটা বেদনার ছোঁয়াও। সাধারণত কোন বইয়ের পুনঃপ্রকাশের সময় ভূমিকা লিখতে গিয়ে লেখকেরা বেদনার্ত হন না। মনঃক্ষুণ্ণ হন না। বরং খুশিতে হন আপ্লুত। সেটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? খুশি আমি যথেষ্টই, কিন্তু পাশাপাশি একটা জায়গায় আছে বেদনাও। নতুন বইয়ের ভূমিকা লিখতে গিয়ে আমি খুশির পাশাপাশি বেদনার্ত হচ্ছি— এ কথা শুনে হয়তো অনেকে অবাক হবেন। কিন্তু সেটাই হচ্ছি। কারণ আছে অবশ্য। বইটি ২০১৪ সালের একুশে বইমেলায় অন্যতম সফল বিক্রিত বই হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। বহু পাঠক লাইন দিয়ে বইটি কিনেছেন। অনেকেই বইটি নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। অনেকেই পড়ে মুগ্ধ হয়ে অন্যদেরও পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছেন। শুধু তাই নয়, বইমেলা শেষ হতে না হতেই বইটির বেশ কিছু ভাল রিভিউ অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছিল। তারমধ্যে এই মুহূর্তে মনে পড়ছে মুক্তমনা ব্লগার দেব প্রসাদ দেবুর ‘বিশ্বাসের ভাইরাস: মেনে নয়, মনে নিন’ শিরোনামের চমৎকার রিভিউটির কথা। সেটি একাধিক সাইটে প্রকাশিত হয়েছিল[১]। এ ছাড়াও বহু জায়গায় বইটি নিয়ে লেখালিখি হয়েছে। এ পর্যন্ত অখুশি হবার কোন কারণ ছিল না।

কিন্তু খুশির সেই স্রোতে যেন খানিকটা ভাটা পড়ে গেল এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে শাফিউর রহমান ফারাবী নামের এক উগ্র জিহাদি ব্যক্তির কর্মকাণ্ডে। ফারাবী নামক চরিত্রটিকে যারা চেনেন, তারা জানেন– ফেসবুকে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, লুচ্চামি লোফারি করা, অজানা-অচেনা মেয়েদের হঠাৎ করে ম্যাসেজ করে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া, নিজের মোবাইলে ফ্লেক্সিলোডের জন্য টাকা পয়সা চাওয়া সহ বহু ফাতরামির জন্য ফারাবী ইতোমধ্যেই কুখ্যাত (যারা ফারাবী এ কাজগুলোর সাথে সম্যকভাবে পরিচিত নন, তারা মুক্তমনায় অনন্ত বিজয় দাশের লেখা ‘ফারাবীর ফাতরামি’ লেখাটা পড়ে নিতে পারেন[২])। কিন্তু সেটাই ফারাবীর একমাত্র পরিচয় নয়। নারী লোলুপ ফারাবী একদিকে যেমন মেয়েদের সাথে ‘লুলামি’তে মহা-ওস্তাদ, ঠিক একই ধারায় আবার ধর্ম রক্ষার সাচ্চা সৈনিকও বটে। নারী অবমাননার পাশাপাশি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে পাওয়া যায় ইসলাম ধর্ম প্রচারণার তাগুদি পোস্ট। ধর্মপ্রচারণা আর নারী অবমাননা যে একসূত্রে বাঁধা, তা ফারাবীকে না দেখলে ভাল করে বোঝা যাবে না। মানুষিকতা’ গ্রন্থের লেখক এবং ব্লগার রায়হান আবীর বিডিনিউজ পত্রিকায় তার একটি কলামে ফারাবীকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যে কথাগুলো বলেছেন, তা খুবই তাৎপর্যমন্ডিত[৩]–

‘নিজেকে কখনও নিষিদ্ধ ঘোষিত ‘হিজবুত তাহরির’ কখনও ‘শিবিরের অনুসারী বলে প্রচার করা ফারাবীর ব্লগে আগমন ঘটেছিলো মূলত সহব্লগার মেয়েদের বিরক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে, তার প্রথম পোস্টও ছিলো অজানা অচেনা মেয়েদের বিয়ে করার অনুরোধ জানিয়ে’। মূলত বিভিন্ন ভুয়া আইডি খুলে ফেসবুক এবং ব্লগে মেয়েদের অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাব দেওয়াই ছিলো তার কাজ। ফেসবুকে আপনারা যারা নিয়মিত, তারা খেয়াল করে দেখবেন, বাংলা ভাষায় ফেসবুকে যে সকল নারীবিদ্বেষী, অশ্লীল, যৌন সুড়সুড়ি যোগানো পাতা রয়েছে তাদের মধ্যে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। এরা ইন্টারনেট থেকে নারীদের বিভিন্ন ছবি সংগ্রহ করে সেটা তাদের অনুসারীদের সামনে উপস্থাপন করে এবং একই সাথে আরও একটা বিষয়ে তারা সমান কম্পাঙ্কে পোষ্ট করে। কী সেই বিষয়টা? ধর্ম এবং যেহেতু বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ইসলাম, তাই এই অশ্লীল পাতাগুলোর কাছেও ধর্ম বলতে কেবল ইসলাম ফারাবী যেন এই মানুষগুলোরই প্রতিনিধি। যার একমাত্র কাজ হলো নারীদের উত্যক্ত করা এবং ইসলাম ধর্ম নিয়ে পোষ্ট দেওয়া।

ফারাবীর মত মানুষকে নিয়ে লিখতে কারো ভাল লাগে না, ফারাবী নামটা কোন মননশীল বইপত্রে স্থান পাওয়ার যোগ্য নয়। “বিশ্বাসের ভাইরাস বইটির ভূমিকায় ফারাবীর মত লোককে নিয়ে সময় এবং শক্তি ব্যয় করতে হচ্ছে— ব্যাপারটা সত্যই বেদনার। কিন্তু তারপরেও একটা জায়গায় গুরুত্ব আছে। আসলে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ ধারণাটির সাথে সাথে ফারাবীর সম্পর্ক গভীর। বিশ্বাসের ভাইরাস মস্তিষ্ক অধিকার করে ফেললে কী হয়— তার সহজ সরল এবং জলজ্যান্ত উদাহরণ হচ্ছে এই ফারাবী। ফারাবীর মত “বিশ্বাসের ভাইরাস আক্রান্ত’ মননেরা মনে করে যে লেখকেরা ধর্মকে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখেন, এ নিয়ে যুক্তিবাদী লেখা লেখেন, তাদের ধরে ধরে হত্যা করা জায়েজ। ফেসবুকে ফারাবীর খুব সহজ স্বীকারোক্তি— ‘ইসলাম অর্থ শান্তি নয়, ইসলাম অর্থ আত্মসমর্পন। ইসলামের ভিতরে জিহাদ, কিতাল সবই আছে। আল্লাহর রসূলকে যারা ঠাণ্ডা মাথায় গালিগালাজ করবে, আমরা তাদের হত্যা করব, এতে লুকোচুরির কিছু নেই। আমি ইসলাম বা আল্লাহ রসুলকে গালিগালাজ করে কোন লেখা বা বই প্রকাশ করিনি। যারা আমার লেখালিখির সাথে পরিচিত তারা জানেন, আমার সবগুলো বই-ই আসলে প্রান্তিক বিজ্ঞান এবং দর্শনের অন্তিম সমস্যা নিয়ে আবর্তিত। কোন বিশেষ ধর্ম বা ধর্মগুরুর প্রতি লক্ষ্য স্থির করে কোন বই-ই লিখিত হয়নি। তারপরেও দেখছি আমার বই এবং লেখালিখি ফারাবীর মত বিশ্বাসের ভাইরাসাক্রান্ত মননের গায়ে জ্বালা ধরানোর জন্য ছিল যথেষ্ট। আসলে বিজ্ঞান এবং দর্শনের নির্মম সত্যগুলো সব সময়ই ধর্মবাদীদের বুকে শেলের মত বেঁধে। ধর্মরক্ষার জন্য তারা হয়ে উঠে মরিয়া। বছরের শুরুতেই আমাকে হত্যার হুমকি দিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিল এই উগ্র জঙ্গি। স্ট্যাটাসে বলেছিল, আমাকে হত্যা করা নাকি মুসলমানদের জন্য এখন ‘ফরজ’ হয়ে গেছে। পরে আরো বেশ কয়েকবার হত্যার হুমকি দিয়েছিল। ফেসবুক মন্তব্যে আমাকে শেষবার যে হত্যার হুমকি দিয়েছিল তাতে সে বলেছিল– অভিজিৎ রায় আমেরিকা থাকে। তাই তাকে এখন হত্যা করা সম্ভব না। তবে সে যখন দেশে আসবে তখন তাকে হত্যা করা হবে। জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক বিডিনিউজ পত্রিকার একটি রিপোর্টে রীতিমত স্ক্রিনশট উল্লেখ করে ফারাবীর বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছিল সে সময়[৪]।

অবশ্য ফারাবীর হত্যার ফতোয়া নতুন কিছু নয়। এই ফারাবী ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাইম লাইটে এসেছিল রাজীব হায়দার শোভন ওরফে থাবা বাবার জনাজা পড়ার জন্য নিয়োজিত ইমামকে হত্যার উস্কানি দিয়ে। প্রকাশ্যেই বলেছিল, যে ইমাম থাবা বাবার জানাজা পড়বে তাকেও হত্যা করা হবে। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিল সে সময়[৫]। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফারাবীকে জামিনে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল দিন কয়েক পরেই। অনেকেই বলেছেন, এরপর থেকেই তার ডিজিটাল ফতোয়ার দাপট বেড়ে গিয়েছে মাত্রাতিরিক্তভাবে। সে অতীতে ঢাকা জজ কোর্টের জেলা জজ জহুরুল হককেও হত্যার হুমকি দিয়েছিল। খ্যাতনামা ব্লগার এবং অ্যাক্টিভিস্ট আসিফ মহিউদ্দীনকেও হত্যার হুমকি দিয়েছিল ফারাবী একাধিকবার। মজার ব্যাপার হচ্ছে যাকে সে হত্যার হুমকি দেয়, দুই দিন পরে আবার তার কাছেই টাকা চায়। হত্যার হুমকি দেয়ার মতো টাকা চাওয়াটাও ওর বাতিক, কিংবা হয়তো ফ্যাশন (আমি যখন ফেসবুকে নতুন, আমার কাছেও বেশ কয়েকবার ম্যাসেজ দিয়েছিল ফেসবুকে টাকা পয়সা চেয়ে; একবার তো ১০,০০০ টাকা চেয়ে বসল স্মার্টফোন কিনবে বলে; আরেকবার ম্যাসেজ দিয়েছিল পয়সাওয়ালা সুন্দরী মেয়ে আছে কিনা যাতে কিনা সে বিয়ে করতে পারে)। অনেকের কাছে এও শোনা যায়, ফারাবীর টাকা চেয়ে ভিক্ষাবৃত্তির ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে পোঁছিয়ে গিয়েছিল যে, মেয়েদের সাথে যৌনালাপ করতে করতেই সে নাকি তাদের কাছে টাকা চাইতে থাকতো। পাশাপাশি নাস্তিক, মুরতাদ এবং বিধর্মীদের হত্যার ফতোয়া তো আছেই। এর মধ্যে একবার দেখলাম, নাট্যব্যক্তিত্ব পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখেছিল— এফডিসির এই পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় যদি দেশের আলেম উলামাদের কাছে ক্ষমা না চায় তাইলে এই পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়কেও থাবা বাবার মত করুন পরিণতি বরন করতে হবে[৬]। কিছুদিন আগে মুক্তচিন্তার লেখক পারভেজ আলমকে হত্যার ফতোয়া দিয়েছিল এই ডিজিটাল জিহাদি। তার নোটে খুব পরিষ্কারভাবেই লিখেছিল—

‘.. এই পারভেজ আলমের বাসা হচ্ছে শনির আখড়ায়। এই পারভেজ আলম প্রতিদিন বিকালবেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবির হাটে আড্ডা দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা কে চরমভাবে কটাক্ষ করে status লেখার কারণে এই পারভেজ আলম কে হত্যা করা বাংলার মুসলমানদের জন্য এখন ফরজ হয়ে দাড়িয়েছে[৭]। হত্যার উস্কানির পাশাপাশি আবার অন্য ধরণের উস্কানিও আছে। কিছুদিন আগে সেনাবাহিনী এবং পুলিশকে উস্কানি দিয়েছিল দেশের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে অস্ত্র তুলে নিতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ড্রাকুলা মানবী হিসেবে চিহ্নিত করে দেশে ‘আরেকটি রক্তাক্ত ১৫ই আগাস্ট’ ঘটানোর উদাত্ত আহবান জানিয়েছিল এই উগ্রপন্থী ব্যক্তিটি। তার স্ট্যাটাসে ফারাবী বলেছিল[৮]—

 ‘শেখ হাসিনা বর্তমানে একটি ড্রাকুলায় পরিণত হয়ে গেছে। ড্রাকুলা তো সেই যে মানুষের রক্ত খায়। শেখ হাসিনা শুধু ড্রাকুলার ন্যায় বাংলার নিরীহ মানুষের রক্তই খাচ্ছেন না শেখ হাসিনার ভাত খাওয়ার জন্য, শেখ হাসিনার গোসল করার জন্য আরো অনেক বাংলার নিরীহ মানুষের রক্ত দরকার। শেখ হাসিনা বর্তমানে বাংলার নিরীহ মানুষের রক্ত খেয়ে বেঁচে আছে। রক্ত রক্ত আমি তৃষ্ণার্ত এটাই এখন ড্রাকুলা মানবী শেখ হাসিনার নীতি। … আমাদের দরকার এখন আরেকটি ১৫ আগস্ট, ৭ নভেম্বর যার মাধ্যমে আমরা সিকিমের পরিণতি থেকে রেহাই পাব। তাই দেশ প্রেমিক সেনাবাহিনী কে আমি অনুরোধ করছি আজ রাতেই আপনারা একটা রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থান করে আমাদের কে ড্রাকুলা মানবী রক্ত পিপাসু শেখ হাসিনার হাত থেকে উদ্ধার করেন।

এধরণের বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল। এ ধরণের বক্তব্য দিয়েও ফারাবী কিভাবে আইনের উর্ধে থাকে সেটা রীতিমত বিস্ময়কর। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. মো আনোয়ার হোসেন বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে দেশের একটি প্রখ্যাত দৈনিক পত্রিকার একটি কলামে ফারাবীর ব্যাপারে এমনকি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকেও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন[৯]। অথচ দেশের আইনরক্ষকেরা এ ব্যাপারে ছিলেন বরাবরই নির্বিকার।

তাদের নির্বিকার থাকার একটি কারণ হয়তো যে ফারাবীর মৃত্যু হুমকিকে কেউ গুরুত্ব দিয়ে নেয়নি। ফারাবী প্রতিদিনই ফেসবুকে কাউকে না কাউকে মৃত্যু হুমকি দিয়ে বেড়াতো। ফারাবীর মৃত্যু-হুমকির ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু হলে ফেসবুকের প্রায় সকল মননশীল লেখক সাহিত্যিকেরা এতদিনে পরপারে সুখনিদ্রা যাপন করতেন। সত্যি বলতে কি ফারাবীর মতো লুম্পেনের দেয়া মৃত্যু ফতোয়া আমরা কেউই ‘সিরিয়াসলি নেইনি। কিন্তু আমরা না নিলেও একটি প্রতিষ্ঠান নিল। রকমারি-ডট-কম নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে অনলাইনে বই বিক্রি করে। ফারাবী বাংলাদেশের অনলাইন বই কেনার সাইট ‘রকমারি ডট কমের অফিসের ঠিকানা প্রদান করে পোষ্ট দেয় মার্চ মাসের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়। বাংলাদেশে নাস্তিকতা ছড়ানোর অপরাধে সে তার তাগুদি অনুসারীদের রকমারির অফিস আক্রমণের আহ্বান জানায় সে। একই সাথে স্ট্যাটাসে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্তাধিকারীর প্রোফাইল উল্লেখ করে তাকে হত্যা করার হুমকি দেওয়া হয়। যেখানে ফারাবীকে সাথে সাথেই আইনের হাতে সোপর্দ করার দরকার ছিল, বাংলাদেশের শুভবুদ্ধির সব মানুষকে ভীষণ রকম অবাক করে দিয়ে ‘রকমারি ডট কমের সত্ত্বাধিকারী মাহমুদুল হাসান সোহাগ ফারাবীর হুমকির পর তার স্ট্যাটাসে এসে আমি (অভিজিৎ রায়) সহ অন্যান্য লেখকদের বিজ্ঞান ও মুক্তচিন্তার বই বিক্রি করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। কিন্তু তারপরও ফারাবী সন্তুষ্ট না হওয়ায় রকমারি ডট কম তার দেওয়া লিস্ট ধরে নিমেষেই সকল বই তাদের ওয়েবসাইট থেকে প্রত্যাহার করে বিক্রি বন্ধের ঘোষণা দেয়। অনেকেই এই ঘটনার সময় রকমারি ডট কমের সংশ্লিষ্টদের ফারাবীর ভয়ে ভীত হওয়ার বদলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অনুরোধ করলেও সবার অনুরোধকে উপেক্ষা করে রকমারি ডট কম মৌলবাদী তোষণকেই তাদের নীতি হিসেবে গ্রহণ করে এবং নাস্তিকদের বই (পড়ুন বিজ্ঞান, যুক্তিবাদী এবং প্রগতিশীল বই) বিক্রি চিরতরে বন্ধ করে দেয়। অথচ সকল অপকর্মের হোতা ফারাবীর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি তারা (রকমারির এই মেরুদণ্ডহীণতার ফলাফল যে মোটেই ভাল হয়নি পরবর্তীকালের ঘটনাপ্রবাহ ছিল তার প্রমাণ। ফারাবীর পদতলে রকমারির সত্ত্বাধিকারী মাহমুদুল হাসান সোহাগের অহেতুক ক্ষমাপ্রার্থনায় নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে এই কুখ্যাত ফারাবী এবং সেই সাথে শুরু হয় তার নিত্য-নৈমন্তিক হত্যা-হুমকি প্রদান। আমি যখন এ বইয়ের ভূমিকা লিখছি, তখন ফারাবীর আরেকটি হুমকি এবং আক্রমণের শিকার হয়ে কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন চট্টগ্রামের মুক্তচিন্তার দুই তরুণ– মাহমুদুর রহমান রায়হান (রায়হান রাহী) এবং উল্লাস দাশ[১০])। তারা নিদেনপক্ষে ফারাবীকে বলতে পারতেন যে, বইয়ের যে অংশে আপত্তিজনক অংশ আছে তা তাদের দেখাতে, এবং সেই মোতাবেক ব্যবস্থা নিবেন তারা। কিংবা বলতে পারতেন, যে বই রাষ্ট্র এবং সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ নয়, সে বই কারো মুখের কথায় আমরা সাইট থেকে সরিয়ে দিতে পারি না। কিন্তু কোন অনুসন্ধান ছাড়াই, কোন যুক্তিনিষ্ঠ প্ল্যান-প্রোগ্রাম এবং পলিসি ছাড়াই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে বই উঠিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিলেন। এটা কোন ধরণের ভাল ব্যাবসায়িক নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ব্যবসা করতে হলে নিজস্ব বিশ্বাসকে সিস্টেমের বাইরে রাখাই বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত বিপণন প্রতিষ্ঠান আমাজন ডট কম এর মতো একটি ভাল উদাহরণ তো ছিলই তাদের সামনে। আমাজন থেকে চাইলে যেমন ধর্মীয় বইপত্র কেনা যায়, তেমনি কেউ চাইলে রিচার্ড ডকিন্স, স্যাম হ্যারিস, ক্রিস্টোফার হিচেন্সদের মতো নাস্তিকদের বইপত্রও কিনতে পারেন বিনা বাধায়। কেউ হুমকি দিলেই আমাজন রিচার্ড ডিকিন্সের বই সরিয়ে নেয় না। রকমারির এ ধরণের একটি স্ট্যাণ্ড-এ অবিচল থাকা উচিৎ ছিল। আর উচিৎ ছিল ফারাবীর মতো মৃত্যু-হুমকি দাতার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের। কিন্তু তারা সেটা না করে ভাইরাসকে জিইয়ে রেখে সাইটকে পবিত্র পানি দিয়ে পাক-গোছল’ দিতে মনস্থ করলেন। কিন্তু এ ভাবে তো সমস্যার সমাধান হয় না। কোন রোগ সারাতে হলে রোগের উৎসটা নির্ধারণ করা জরুরী।

পৃথিবীতে বই পুড়িয়ে, বইকে নিষিদ্ধ করে মুক্তচিন্তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা অবশ্য নতুন নয়। সেই প্রাচীন যুগ থেকেই শাসকে নিজদের চিন্তার বিপরীতে যাওয়া মতবাদ কিংবা ধ্যান ধারনাকে রুদ্ধ করতে চেয়েছে। কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, ব্রুনোদের বাইবেলবিরোধী সৌরকেন্দ্রিক মতবাদকে নিষিদ্ধ করে ক্যাথলিক চার্চ একসময় সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর ঘোরা থামাতে চেয়েছিল। যখন তা সম্ভব হয়নি বিপরীত ধারার বইপত্র জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তাড়িয়ে নাশ করে দিতে চেয়েছে। এ ধরণের গ্রন্থহন্তারক কাজ ব্যাবিলনীয় শাসকেরা করেছে, এথেনীয়রা করেছে, রোমানরা করেছে। খ্রিষ্টান এবং মুসলিম শাসকদের হাতে একটা সময় ধ্বংস হয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়ার সুবিখ্যাত প্রাচীন পাঠাগার। কথিত আছে আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের বই-পত্তর ধ্বংস করতে গিয়ে খলিফা ওমর নাকি বলেছিলেন– ‘বইপত্রগুলো যদি কোরআনের শিক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হয় তবে সেগুলো আমাদের দৃষ্টিতে নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। কাজেই ওগুলোর ধ্বংস অনিবার্য; আর বই-পত্তরগুলোতে যদি কোরানের শিক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কোন কথাবার্তা আদৌ থেকেও থাকে তবে সেগুলো হবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত। কাজেই সে দিক দিয়েও ওগুলো ধ্বংস করা জায়েজ। তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি এবং তার অনুগত সৈনিকেরা ভারতবর্ষ আক্রমণের পর জ্ঞানবিজ্ঞানের সূতিকাগার নালন্দা বিদ্যানিকেতনও একই কায়দায় ধ্বংস করেছিলেন। এমনকি গত শতকে নাৎসী জার্মানির শাসকেরা রীতিমত বই পোড়ানোর বহ্নিউৎসব পালন করেছে ঘটা করে। অবশ্য মিত্র বাহিনীও পিছিয়ে ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাদের বোমারু বিমানগুলো নাকি টার্গেট হিসেবে প্রায়ই খুঁজে নিতো জার্মানির লাইব্রেরিগুলোকে। রাশিয়ার স্ট্যালিনীয় জামানায় যেমন বিপরীত চিন্তাকে নাশ করার তাগিদে অসংখ্য বই পোড়ানো হয়েছে, তেমনি আবার পঞ্চাশের অন্ধকার দশকে ম্যাকার্থিজমের বিশুদ্ধি অভিযানে আমেরিকান মননকে কমিউনিজমের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যও বই পুড়তে আমরা দেখেছি। বই পোড়ানো ছাড়াও বইয়ের উপর নানা ধরণের সেন্সরশিপ আরোপ এবং নিষিদ্ধকরণের বহু আলামতের সাথেই আমরা পরিচিত। ভারতবর্ষে সালমান রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’, কিংবা বাংলাদেশে তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ আমরা নিষিদ্ধ হতে দেখেছি চোখের সামনেই। বছর কয়েক আগে মামলা করে হুমায়ুন আজাদের ‘নারী গ্রন্থটিকে নিষিদ্ধ করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল। বিশ্বাসের ভাইরাস’কে নিষিদ্ধ করার প্রেচেষ্টাও এই তালিকায় নতুন সংযোজন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ফারাবী নামক মুখচেনা লম্পট এবং ফতোয়াবাজের মুখের কথায় রকমারি কোন কিছু আগাপাশতলা বিচার বিবেচনা না করে যে সময়টিতে বিজ্ঞানমনস্ক বইপত্র উঠিয়ে নিয়েছে, ঠিক একই সময় তাদের সাইটে দর্পভরে শোভা পাচ্ছিল গোলাম আজম, মওদুদী, দেলওয়ার হোসেন সাইদীদের বই। শুধু তাই নয়, এই একবিংশ শতাব্দীতে বসে রকমারি ডট কম অনলাইনে বিক্রি করে চলেছে, পৃথিবী নয় সূর্য ঘোরের মত অবৈজ্ঞানিক বই, কিংবা ‘আদি ও আসল সোলেমানী তাবিজের কিতাব জাতীয় গ্রন্থ[১১]। অথচ আধুনিক বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকদের গবেষোনা পত্র, জার্নাল,আর বইয়ের রেফারেন্স দেয়া শত কষ্টের ফসল ‘বিশ্বাসের ভাইরাস কিংবা ‘অবিশ্বাসের দর্শন’–এর মতো বইগুলো তাদের জন্য তৈরি করেছে একেবারে জীবন-মরণ সমস্যা। তারা স্টোর থেকে উঠিয়ে নিয়েছে আমার সব বই। মিথ্যা লেবেল এঁটে দিয়েছে ‘আউট অব প্রিন্ট বলে। রকমারির এই হঠকারী সিদ্ধান্তের পর আমি আমার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলাম[১২]–

‘আমি সামান্য লেখক। কিন্তু যা লিখি সততার সাথে লিখি। কাউকে হুমকি ধামকি দেই না। আশা করব রকমারি এবং তাদের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা বিষয়টি মাথায় রাখবেন। দয়া করে ব্যবসার সাথে ব্যক্তিগত বিশ্বাস জরাবেন না। ফারাবী হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যু হুমকি দিয়েছে। তার হুমকি সত্য হলে আমরা কেউ আজ বেঁচে থাকতাম না। রকমারির উচিৎ লেখকের স্বাধীনতার প্রতি অবিচল থাকা। আমার বই রাষ্ট্র থেকে ব্যান করা হয়নি, আদালতে যায়নি। ফারাবীই বরং আদালতে চার্জশিটপ্রাপ্ত ফেরারী আসামী। তার কথায় আমার বইকে তালিকা থেকে সরানোর কারণটা হাস্যকর। আমরা তো কোন ধর্মীয় বই তালিকা থেকে সরাতে বলছি না। শুধু ধর্মীয় বই কেন, বহু জিহাদি বানী সমৃদ্ধ উগ্র বইপত্র থেকে শুরু করে বড় বড় রাজাকারদের লেখা বই রকমারিতে পাওয়া যায়। সব ছেড়ে আপনাদের চোখ পড়ল এমন এক লেখকের যিনি হুমকি ধামকি দেন না, কেবল যিনি বিজ্ঞান নিয়ে লেখেন? আসলে ভয়টা কার? স্মরণ করি মিখাইল বুলগাকভের উপন্যাস মাস্টার এণ্ড মার্গারিটার’ বিখ্যাত উদ্ধৃতি—’পাণ্ডুলিপি পোড়ে না। মুক্তচিন্তককে আক্রমণ করা যায়, কিন্তু তার চিন্তাকে নাশ করা যায় না।

হ্যাঁ, আমি সত্যই মনে করি– মুক্তচিন্তককে আক্রমণ করা যায়, কিন্তু তার চিন্তাকে কোনভাবেই বিনাশ করা যায় না। এর প্রমাণ আমরা খুব ভালভাবেই পেয়েছি রকমারি-ফারাবী ঘটনার পরবর্তী সময়গুলোতে। রকমারি যখন কাপুরুষের মতো বিশ্বাসের ভাইরাস প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছিল, তখন ‘পড়ুয়া” এবং “নক্ষত্র বুক শপ’ সহ অন লাইনে বই বিক্রির একগাদা প্রতিষ্ঠান আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায় “বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটির বিক্রি অব্যাহত রাখতে[১৩]। তারা মুক্তচিন্তার বইপত্র বিক্রি থেকে কোনভাবেই পিছু হটবে না বলে জানায়। ফারাবী হুমকি দিয়ে বইটির বিক্রি বন্ধ করতে চেয়েছিল, অথচ ফারাবীর এই কর্মকাণ্ডে বিশ্বাসের ভাইরাস বিক্রি তো বন্ধ হলোই না, বরং বইটির বিক্রি এক মাসের মধ্যে আমাদের প্রত্যাশাকে একেবারে অতিক্রম করে গেল। বহু পাঠক আগ্রহী হয়ে বইটি কিনেছেন, এবং আমাকে ম্যাসেজ করে জানিয়েছেন। অনেকে রকমারির সিদ্ধান্তে এতোটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে তারা রকমারি বর্জন করুন’ নামে ফেসবুক ইভেন্ট খুলে এ প্রতিষ্ঠানটি বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন। আমার বইয়ের বহু পাঠক সহমর্মিতা প্রকাশ করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। যেমন, খ্যাতনামা ব্লগার এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নিঝুম মজুমদার তার একটি স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘আমি এই পর্যন্ত রকমারি থেকে ১৬,৫৮৫ টাকার বই কিনেছি দুইটি একাউন্ট থেকে। যদি ফারাবীর কথা অনুযায়ী অভিজিৎদা কিংবা নাস্তিকতা প্রচার করছে, এমন অভিযোগে বা এমন কারণে এমন বই রকমারি বাদ দিয়ে দেয়, তবে পাব্লিক-স্ট্যাটাস দিয়েই রকমারি বর্জন করব’। আরেকজন পাঠক সাজেদুল ওয়াহিদ নিটোল লিখেছিলেন, ‘আমার অর্ডার হিস্ট্রিতে গিয়ে ক্যালকুলেটরে হিসাব করে দেখলাম- রকমারি থেকে দুই বছরে প্রায় সাড়ে নয় হাজার টাকার বই আমি কিনেছি। ঢাকায় থাকি না,তাই রকমারি আমার জন্য একটু বিশাল সুযোগ হিসেবে এসেছিল। অনেক কৃতজ্ঞতা জমা ছিলো সাইটের পরিচালকদের জন্য। সাইটের এডমিনদের এমন একটা জীবের কাছে আত্মসমর্পণ দেখে খুবই মন খারাপ লাগছে। শ্রদ্ধার জায়গাগুলো ধীরে ধীরে কমে আসছে। আজাদ সাহেব ঠিকই বলে গেছেন- সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে। কিছু পাঠক আবার আগে অর্ডার করা বই গ্রহণ না করে সরাসরি ফেরত পাঠিয়েছেন রকমারির কাছে। যেমন, বিশ্বাসের ভাইরাস বইটির পাঠক দেব প্রসাদ দেবু তার মার্চ মাসের একটি স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, খুবই নগণ্য প্রতিবাদ। অনেকটা ছোটবেলায় মা’র উপর রাগ করে ভাত না খেয়ে থাকার মতো। অভিজিৎ রায়ের বই প্রত্যাহারের জের ধরে রকমারি ডট কম থেকে আসা আজকের পার্সেলটা ফেরত পাঠালাম। বাজারির কিছু যায় আসেনা। হয়তো, কিন্তু সেটি আমার বিবেচ্য নয়, আমি এই ক্ষুদ্র প্রতিবাদেই তৃপ্ত।

স্বনামধন্য লেখক এবং ব্লগারেরাও এগিয়ে এসেছিলেন বাক-স্বাধীনতা রক্ষার এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে। তাদের অনেকেই নিজদের বইগুলো রকমারি থেকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। চরম উদাস, যার ‘লাইনে আসুন’ বইটি বইমেলায় মুড়ি-মুড়কির মত বিক্রি হয়েছে, তিনি তার মার্চ মাসের ১৫ তারিখে দেয়া স্ট্যাটসে লিখেছিলেন— “কোন বই রাখবে আর কোন বই সরাবে সেটা রকমারির নিজস্ব সিদ্ধান্ত। মেয়েদেরকে আজেবাজে মেসেজ দিয়ে উত্যক্তকারী সেক্স ফ্রিক যদি হয় এই দেশের হাই প্রিস্ট এবং তার ধর্মকে যদি রকমারির কর্ণধাররা প্যান্ট ভিজিয়ে করজোড়ে মাফ চায়, তবে সেই মাফ চাওয়া ও প্যান্ট ভিজানোর অধিকার রকমারির আছে। আমার শুধু অধিকার আছে রকমারি বর্জন করার। আমি তাই করলাম। মাত্র দুদিন আগে আপনাদের কাছ থেকে কেনা আট হাজার টাকার বই হাতে পেয়েছি। এটাই হোক আমার শেষ বই এর অর্ডার। সেইসাথে যদি রায়হান আবির, অভিজিৎ রায়দের বই রকমারি থেকে সরিয়ে ফেলা হয় তবে আমি অনুরোধ জানাবো আমার লাইনে আসুন’ বইটিও যেন তারা নিজেদের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলে। আপনাদের প্যান্ট আপনারা ভিজান, যখন খুশী তখন ভিজান। শুধু সেই ভিজা প্যান্টের ভেতর আমাকে রাখবেন না। জাগরণের পূর্বাপর’ গ্রন্থের লেখক কবির আহমেদ তার ১৭ই মার্চের দেয়া স্ট্যাটাসে বলেছিলেন, ‘অনলাইন সন্ত্রাসবাদের প্রচারক ফারাবীর হুমকিতে রকমারি ডট কম তাদের সাইট থেকে অভিজিৎ রায়’র ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটি প্রত্যাহার করে নিয়েছে এটা একটা সংবাদ হলেও আদতে রকমারি ডট কম যদি সত্যিকার অর্থে ব্যবসা অথবা অসাম্প্রদায়িকতা ধারণ করতো তাহলে ফারাবীর মতো লোকদের হুমকিতে কী বই প্রত্যাহার করতে পারতো? এটা স্পষ্টত তাদের সাম্প্রদায়িকতা লালনের শামিল। একই সাথে ন্যাক্কারজনকও। রকমারি সম্পর্কে আমি অনেক উচ্চ ধারণা পোষণ করে আসছিলাম দীর্ঘদিন থেকে। নিয়মিতভাবে সেখান থেকে আমি বই সংগ্রহও করেছি। ফারাবীর হুমকিতে অথবা এমন কোন কিছুর অপেক্ষার পালা শেষ হবার পর তাদের আসল চেহারা বেরিয়ে আসার পর এখন থেকে আর কোন বই রকমারি থেকে সংগ্রহ করব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এবং একই সাথে বইমেলা ২০১৪তে প্রকাশিত গণজাগরণ আন্দোলন এবং তার পরের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে লিখিত আমার ‘জাগরণের পূর্বাপর’ বইটিও রকমারি থেকে প্রত্যাহার করে নিলাম। সুলেখক রণদীপম বসু তার স্ট্যাটাসে বলেছিলেন, ‘রকমারি.কম-এর তাকে আমার গবেষণামূলক প্রবন্ধ সংকলন ‘অবমুক্ত গদ্যরেখা বইটা এখনো শোভা পেলে এখন নিজেকে অপমানিতই বোধ করবো। কেননা বইটা সম্পূর্ণই মুক্তমনা পাঠকদের জন্য লেখা। এখানে বলা দরকার, চরম উদাস, কবির আহমদের মতো অনেকেই জীবনে প্রথমবারের মতো বই প্রকাশ করেছিলেন। প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি যে কতটা বড় সেটা লেখক মাত্রই জানেন। তারপরেও তারা সে অনুভূতিকে দূরে সরিয়ে রেখে আমার পাশে এসে দাড়িয়েছিলেন লেখকের স্বাধীনতাকে সম্মান করে। আমি জানিনা রকমারি তাদের সাইট থেকে বইগুলো তুলে নিয়েছেন কিনা, কিন্তু তারা যে আমার মতো লেখকের জন্য এই ত্যাগ স্বীকারটুকু করতে চেয়েছেন, তাতে মুগ্ধ হয়েছি আমি। দেশের মধ্যে তো বটেই দেশের বাইরের কিছু পত্রপত্রিকাতেও ব্যাপারটি ফিচার করা হয়েছিল[১৪]। সামান্য লেখক আমি। আমার সামান্য লেখা কাউকে কাউকে হয়তো অনুপ্রাণিত করে, কিন্তু তার ব্যাপকতা যে এতো বেশি তা আমি কখনোই অনুধাবন করিনি। সুব্রত শুভ, তারিক আজিজ (অনিকেত), অনন্ত বিজয় দাশ, রায়হান আবীর, মারুফ রসূল, রায়হান রশীদ সহ অনেকেই মুক্তমনা, সচলায়তন, মুক্তাঙ্গনব্লগে কিংবা পত্রিকায় যেভাবে লিখেছেন, তাতে আমি সত্যই আপ্লুত[১৫]। ওমর ফারুক লুক্স, ফারজানা কবীর স্নিগ্ধা, আসিফ মহিউদ্দীন, বিপ্লব রহমান, মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার, অঞ্জন আচার্য সহ অনেকেই এ নিয়ে ফেসবুক সহ বহু জায়গায় লিখেছেন। তাদের এ ঋণ বহন কিংবা শোধ কোনটাই করার সামর্থ্য আমার নেই। কেবল মনে মনে উচ্চারণ করেছি রবিঠাকুরের অমোঘ বাণী– ‘আমায় তুমি অশেষ করেছ!’ বস্তুতঃ তাঁদের মতো অগণিত লেখক, পাঠক এবং শুভানুধ্যায়ীরা আছেন বলেই বহু হুমকি ধামকির পরেও ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটি অস্তিত্বের অতলান্তে হারিয়ে যায়নি, বরং নতুন শক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে, আরো পরিশীলিত হয়ে আলোর মুখ দেখছে। বইটির প্রচার, প্রসার এবং সাফল্যের সবটুকু কৃতিত্ব আসলে তাদেরই।

নতুন এ সংস্করণে বইটির বেশ কিছু অংশ ঢেলে সাজানো হয়েছে। বইটির অনেক অংশই আগের চেয়ে পরিবর্ধিত। বিশেষ করে রাজীব হায়দার শোভন (থাবা বাবা) হত্যার প্রেক্ষাপটে ধর্মের প্যারাসাইটিক ধারণাই কি দায়ী নয়? অংশটি বিবর্ধিত করা হয়েছে নতুন কিছু তথ্যের আলোকে ইসলামের সুচনাকালে যেসব সহিংস পন্থা ব্যবহৃত হয়েছিল, গুপ্তহত্যা ছিল তার অন্যতম। আবু আফাক, কাব ইবনে আশরাফ, আসমা বিন্তে মারওয়ান এর পাশাপাশি আবু রাফেকে হত্যার বিবরণ হাজির করা হয়েছে। আবু রাফের ঘটনাটি আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। প্রায় চৌদ্দশ বছর আগে আবু রাফেকে হত্যার জন্য মহানবীর নির্দেশে যেভাবে পাঁচজন সাহাবীর একটি দল গুপ্তহত্যায় অংশ নিয়েছিল, একই কায়দায় মুফতি জসিমের নির্দেশে সাতজনের দল গঠন করে থাবা বাবাকে পল্লবী থানার সামনে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল ২০১৩ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের বাণী এবং ধর্মগুরুদের দিকনির্দেশনা কীভাবে আজও জিহাদি প্রেরণা হিসেবে কাজ করে যায় ভাইরাস-আক্রান্ত মননের মাঝে তার সাযুজ্য আর সংশ্লিষ্টতা আরো পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে বইয়ে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত বোখারী শরীফ থেকে এ সংক্রান্ত সঠিক হাদিসগুলো খুঁজে তথ্যসম্ভার নিখুঁত করে তুলতে সাহায্য করেছেন খ্যাতনামা গবেষক আবুল কাশেম। তাঁর পরিশ্রমলব্ধ অবদান নিঃসন্দেহে বইটিকে ঋদ্ধ করেছে। চট্টগ্রামনিবাসী মুক্তচিন্তক দুই তরুণ উল্লাস এবং রাহীর উপর শারীরিক আক্রমণ এবং গ্রেপ্তারের পর তাদের মর্মস্পর্শী ঘটনাটি বইয়ে যোগ করা হয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে, দেশের নতুন কালাকানুন’ হিসেবে চিহ্নিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধনী ২০১৩)-এর ৫৭ ধারা নিয়েও কিছু নির্মোহ বিশ্লেষণ হাজির করতে হয়েছে। আর বইমেলার সময় বইটির প্রথম সংস্করণ খুব দ্রুতগতিতে বের করার খেসারত হিসেবে বইটিতে অল্প-বিস্তর মুদ্রণ এবং বানানপ্রমাদ রয়ে গিয়েছিল। কিছু কিছু জায়গায় ছিল অহেতুক পুনরুক্তিও। আমার আটলান্টানিবাসী লেখক-বন্ধু রাজর্ষি দেবনাথ বইটি পড়ে সেগুলো বের করে দিয়ে বইটিকে ত্রুটিমুক্ত করে তুলতে সহায়তা করেছেন। তাঁর অবদান ছাড়া এই বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ কোনভাবেই পূর্ণতা পেত না। আর আমার সকল কাজের সবচেয়ে কঠোর সমালোচক আমার জীবনসঙ্গিনী বন্যা আহমেদের প্রেরণা সবসময়ই আমাকে অবাক করে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি বলাই বাহুল্য।

বইটি প্রকাশের পেছনে আমার বর্তমান এবং পূর্ববর্তী প্রকাশকদের অবদান আলাদাভাবে না বললে নিতান্তই অন্যায় করা হবে। শত হুমকি ধামকি সত্ত্বেও তারা ভয়ে পিছু হটেননি। আমার মত নাফরমান লেখকের পাশে দৃঢ় পায়ে এসে পঁড়িয়েছেন, ভবিষ্যতেও এ ধরণের নাফরমানি বই প্রকাশের অঙ্গীকার করে গেছেন। যেমন, শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল তার একটি স্ট্যাটাসে খুব সোজাসাপ্টাভাবেই বলেন,– ‘শুদ্ধস্বর মুক্তমনের, মুক্তবুদ্ধির বই প্রকাশ থেকে কখনোই পিছু হটবে না। যত হুমকিই আসুক, যত ধমকিই দিক। আর এই বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটির বর্তমান প্রকাশক জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সাল আরেফিন দীপনও একটি পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎকারে বলে দিয়েছেন, “সমাজে ধর্মান্ধ মানুষ থাকবেই। এর জন্য ভীত হওয়ার কিছু নেই। আমরা মুক্তচিন্তার, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী”[১৬]। লেখক হিসেবে আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বোধ হয় এখানেই। তাঁদের মতো সাহসী প্রকাশকেরা থাকলে বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধি এবং মুক্তচিন্তার আন্দোলন শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আর সেই সাথে ক্রমশঃ প্রশস্ত হবে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস বিহীন সমাজ নির্মাণের বন্ধুর পথ।

–ড.অভিজিৎ রায়
মে ১৮, ২০১৪

 

১ম সংস্করণের ভুমিকা

আমার এ বইটি বিশ্বাস নিয়ে। সমাজে বিশ্বাসের প্রভাব নিয়ে। বিশ্বাসের প্রভাব সবসময়ই সমাজে ছিল, আছে। বিশ্বাস ব্যাপারটাকে এমনিতে শান্ত, সুন্দর, নিরীহ আর গোবেচারা গোছের বলে সাধারণভাবে ধরে নেয়া হলেও সময় এবং সুযোগ পেলে কীভাবে নখদন্ত বের করে তার রক্তলোলুপ চেহারাটা প্রকাশ করে দেয়, তা আমরা সবাই কমবেশি জানি। দেখেছি। বিশ্বাসের প্রভাবে বলীয়ান হয়ে মানুষ সেই প্রাচীন কাল থেকেই কুমারী এবং শিশু হত্যা করে দেবতাকে তুষ্ট করেছে, কখনো জীবন্ত কবর দিয়েছে, সতীদাহের নামে শত সহস্র নারীকে পুড়িয়ে মেরেছে, নাস্তিক, মুরতাদ কিংবা বিধর্মীদের হত্যা করেছে, চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছে, ক্রুসেড করেছে, ধর্মযুদ্ধ করেছে, ডাইনি সাব্যস্ত করে নিরপরাধ মেয়েদের পুড়িয়ে মেরেছে, কখনো বা সারা পৃথিবী জুড়ে চলছে জিহাদের নামে চলেছে রক্তের হোলি খেলা। বলতে দ্বিধা নেই, বিশ্বাস আমাদের জন্য উপকারের চেয়ে অপকারই করেছে বেশি।

তারপরেও প্রশ্ন আসে, আমাদের কি বিশ্বাসের আদৌ দরকার নেই? বিজ্ঞান, সমাজ, সভ্যতা, নৈতিকতা এই সব কি বিশ্বাস ছাড়া কি একেবারেই অচল নয়? আমরা কি বিশ্বাসের উপর নির্ভর করা ছাড়াই প্রযুক্তির উন্নয়ন করতে পারব? ভবিষ্যতের গতি প্রকৃতি বুঝতে পারব? সত্য মিথ্যা, পাপ পুণ্য যাচাই করতে পারব? এই বইটিতে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর পাবেন কৌতূহলী পাঠকেরা।

আমি ২০১১ সালে আমার সহলেখক রায়হান আবীরের সাথে মিলে একটা বই লিখেছিলাম অবিশ্বাসের দর্শন’ নামে। বেরুনোর এক বছরের মধ্যেই বইটির সবগুলো কপি নিঃশেষিত হয়ে যায়। ২০১২ সালে বের হয় বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ। শেষ খবর যা জানি, সেই সংস্করণও নিঃশেষ। সেই বইয়ের একটি অধ্যায়ের নাম ছিল বিশ্বাসের ভাইরাস’। কেন আমি বিশ্বাসকে ভাইরাস মনে করি তার একটা ছোট আনুষঙ্গিক পর্যালোচনা ছিল সেখানে। বইটি বেরুনোর পর থেকেই পাঠকদের থেকে অভিমত পেয়েছিলাম– ধারণাটিকে বিস্তৃত করার। আমারও ইচ্ছে ছিল সেটা নিয়ে কাজ করার, কিন্তু হয়ে উঠেনি। এর মধ্যে গত বছর (২০১৩) ঘটা বেশ কিছু ঘটনা আমাকে এ বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিস নামের একুশ বছরের এক যুবক যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে গ্রেফতার হয়ে বিশ্বব্যাপী পত্র-পত্রিকার আলোচিত খবর হয়েছিলেন। নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ভবন বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ ও এফবিআই। সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে আমেরিকায় থাকার কারণে তার ঘটনাপ্রবাহ আমি খুব কাছ থেকে। দেখি। নাফিস আমেরিকায় পড়তে এসে জিহাদ করাকে নিজের কর্তব্য মনে করেছেন, আমেরিকাকে দার আল-হারব’ হিসেবে দেখেছেন, এবং আমেরিকার মুসলিমদের বলেছেন তালাফি। তিনি কীভাবে বিন লাদেনকে প্রাণপ্রিয় নেতা মনে করেছেন, ইয়েমেনে নিহত আলকায়েদা নেতা আনোয়ার আল আওলাকির ভিডিও লেকচারগুলো তাকে উদ্বুদ্ধ করেছে– এ সবকিছু আমাকে ব্যথিত এবং উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। নাফিসের মত বিশ্বাস-নির্ভর যুবকেরা যেন একেকটি টাইম-বোমা। বিশ্বাসের একেকটি বিধ্বংসী জৈবা যেন। তারা মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তৈরি করতে পারে নাশকতা। জলজ্যান্ত ভাইরাস যেন এরা। আমি এ নিয়ে বাংলা ব্লগে একটি লেখা লিখি একজন নাফিস এবং বিশ্বাসের ভাইরাস’ শিরোনামে। কিন্তু তখনো আমার বই লেখার চিন্তাটা মাথায় আসেনি।

সেই একই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সূচিত হয়েছিল অবিস্মরণীয় শাহবাগ আন্দোলন। কাদের মোল্লার সঠিক বিচারের দাবীতে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগারদের গড়ে তোলা এ আন্দোলন কাঁপয়ে দিয়েছিল সারা বাংলাকে, এবং কিছুটা সময়ের জন্য হলেও বিশ্বকে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে সংগঠিত শাহবাগ গণআন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন ব্লগার রাজীব হায়দার শোভন। রাজীবকে শাহবাগ আন্দোলনের একেবারে শীর্ষসময়ে তার বাড়ির অদূরে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। রাজীবের হত্যার অভিযোগে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ছাত্রকে যখন গ্রেপ্তার করা হল, তারা নিজ মুখেই স্বীকার করল, ঈমানী দায়িত্ব পালনের জন্য তারা রাজীবকে হত্যা করেছে। নর্থ সাউথের সামগ্রিক ঘটনা এবং রাজীবের উপর আক্রমণকে বিশ্বাসের ভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত করে আমি একটি প্রবন্ধ লিখি অনলাইন পত্রিকায় এবং মুক্তমনা ব্লগে–বিশ্বাসের ভাইরাস: নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় কি জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে? শিরোনামে। রাজীবকে হত্যার বিবরণ পড়লে হতবাক হতে হয়, কীভাবে তাদের মস্তিষ্ক ‘ব্রেন ওয়াশড’ হয়েছে প্যারাসাইটিক জিহাদি ধারণা দিয়ে। নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ভবন বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনার অভিযোগে নর্থ সাউথের কামেল প্রাক্তন ছাত্র কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান কিংবা রাজীব হত্যায় জড়িত নর্থ সাউথের ছাত্রদের মুখগুলোর দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ কত প্রকটভাবে মস্তিষ্ককে অধিকার করে ফেলতে পারে, যার ফলে একজনকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে খুন করতেও তাদের বাধেনি, বরং এটাকে তারা ঈমানী দায়িত্ব বলে মনে করেছে।

বিশ্বাসের ভাইরাসের প্রভাবে রাজীব হত্যার মতো ভয়ঙ্কর আলামতগুলো যখন দিনের আলোর মত উদ্ভাসিত, আশা করা হচ্ছিল যে, সরকার এ ব্যাপারে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবেন। খুঁজে দেখবেন বিশ্বাসের ভাইরাসের উদ্ভব এবং সংক্রমণের মূল উৎসগুলো। কিন্তু তা না করে আওয়ামী সরকার চড়াও হল প্রগতিশীল এবং মুক্তমনা ব্লগারদের ওপর। ২০১৩ সালের পয়লা এপ্রিল বাংলা ব্লগের চারজন স্বনামখ্যাত মুক্তমনা ব্লগারকে গ্রেফতার করল ‘সেকুলার বলে কথিত আওয়ামী সরকার। বুঝলাম হেফাজতি মওলানা আর আমার দেশ এর মত প্রোপাগান্ডা মেশিনের চাপে বিশ্বাসের ভাইরাসের ব্যাপারটা আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোতেও। কিন্তু ভাইরাসের এহেন মহামারী দেখে তো আমরা চোখ বুজে থাকতে পারি না। আমার অনলাইন বন্ধুদের সাথে মিলে ব্লগারদের মুক্ত করার আন্দোলনে সামিল হলাম। শুরু হল পত্র-পত্রিকা, ফেসবুক এবং ব্লগে লেখালিখি। শুরু করলাম Worldwide Protests for Free Expression in Bangladesh’ ক্যাম্পেইন। সারা পৃথিবীর মুক্তচিন্তার সংগঠনগুলো এগিয়ে এলো আমাদের ডাকে। একটা সময় পর সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হল ব্লগারদের।

তখন থেকেই মনে হচ্ছিল, এই ইতিহাসগুলো সংকলিত করে রাখা দরকার। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই। আমরা বড় বিস্মৃতি-পরায়ণ জাতি। দু’দিনেই ভুলে বসে থাকি আমাদের অর্জনগুলো, কখনোবা বিকৃতই করে ফেলি নিজেদের অজান্তে, কিংবা মিথ্যে প্ররোচনার শিকার হয়ে।

এ নিয়ে বইয়ের কথা মাথায় আসলেও সেটা যে এ বছরের মধ্যেই ঘটবে ঘুণাক্ষরেও মাথায় ছিল না। বইমেলা শুরুর দুমাস আগে কেউ বইয়ের কাজ শুরু করে সেটা আবার শেষও করতে পারে নাকি? কিন্তু সেই অসম্ভব কাজই সম্ভব করে সবাইকে দেখিয়ে দিলেন জাগৃতি প্রকাশনীর তরুণ প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন। তিনি যেভাবে তাগাদা দিয়ে আমার কাছ থেকে লেখা আদায় করে নিলেন, বই আকারে পাঠকদের সামনে তুলে ধরলেন, সেটাও ভাইরাসের চেয়ে কম আশ্চর্যজনক ব্যাপার নয়। তিনি এতো কম সময়ের মধ্যে শুধু বইয়ের লেখা আদায়ই করেননি, মনোরম একটি প্রচ্ছদ করে মেলা শুরুর বহু আগেই ফেসবুকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তার এহেন অবদান এবং নিরন্তর চাপাচাপি ছাড়া বইটি আলোর মুখ দেখতো না, তা হলফ করেই বলা যায়।

আর বইটি রচনার ব্যাপারে আর কারো কথা যদি নাও বলি, অন্তত একজনের কথা বলতেই হবে; সে আমার স্ত্রী বন্যা। এতো কম সময়ের মধ্যে এভাবে পাণ্ডুলিপি লিখে দিতে হবে জানতে পেরে পুরো সংসারের সবটুকু দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে আমাকে নিবিষ্ট মনে লেখার জন্য সময় করে দিয়েছে সে। নিজে অফিস করেছে, বাসায় এসে রান্না করেছে, মেয়ের কলেজের ভর্তির ব্যাপারে দেখভাল করেছে, এবং সর্বোপরি বাসার সমস্ত কাজ গুছিয়ে আবার আমার পাণ্ডুলিপির ব্যাপারেও অনেক পরামর্শ দিয়েছে। বন্যা নিজেও একজন শক্তিমান লেখক, এবং সবসময়ই আমার লেখার সবচেয়ে বড় সমালোচক। তার সমালোচনা এবং পরামর্শ সবসময়ই আমাকে ঋদ্ধ করে। এই বইটিও তার ব্যতিক্রম নয়।

বইটি এতো কম সময়ে পাঠকদের হাতে তুলে দিতে পেরে আনন্দিত বোধ করছি।

জীবন দীপান্বিত হোক, সমাজ হোক বিশ্বাসের ভাইরাস মুক্ত।

–ড.অভিজিৎ রায়
ফেব্রুয়ারি, ২০১৪

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x