অশ্বিনী দত্ত রোড, ক্লকাতা-২৮-এ গড়ে উঠেছে ‘আনন্দধাম’, ভগবান শ্রীসদানন্দ দেবঠাকুরের আশ্রম। ভক্ত শিষ্য-শিষ্যারা বাবাকে অবতার জ্ঞানে নয়, দেব জ্ঞানেই পুজো করেন। সদানন্দের কথায়- “আমি ব্রক্ষ্ম, আমি শক্তি। নাম কর, নাম কর, আমায় পাবি। তোরা যেখানেই যাকে পূজা করিস না কেন জানবি তা- আমাতেই অর্পণ হয়।“

ভক্তদের প্রতি সদানন্দের বরাভয়- “তুই আমার নাম নে, -তোর সকল পাপ ধ্বংস করব আমি … তোর বাঞ্ছা পূরণ করব আমি। আমাকে ডাক্তে থাক। ডাকতে ডাকতে সুগন্ধ হয়ে তোর মনকে দেব মজিয়ে, জ্যোতিঃ রূপে হবে প্রকাশ, রূপ হয়ে দর্শন, ভাব হয়ে করব আলিঙ্গন, বিভোর হয়ে ঢলে পড়বি আমারই কোলে। তখন শুধু আনন্দ-আনন্দ-সদানন্দ।

পত্র-পত্রিকায় ছবিসহ শ্রীসদানন্দের বরাভয় –“তুই আমার নাম নে, -তোর সকল পাপ ধ্বংস করব আমি… তোর বাঞ্ছা পূরণ করব আমি। আমাকে ডাকতে থাক। ডাকতে ডাকতে সুগন্ধ হয়ে তোর মনকে দেব মজিয়ে, জ্যোতিঃ রূপে হবে প্রকাশ, রূপ হয়ে দর্শন, ভাব হয়ে করব আলিঙ্গন, বিভোর হয়ে ঢলে পড়বি আমারই কোলে। তখন শুধু আনন্দ-আনন্দ-সদানন্দ।

পত্র-পত্রিকায় ছবিসহ শ্রীসদানন্দের বিজ্ঞাপন কিছুদিন ধরেই চোখে পড়ছিল। বিজ্ঞাপনগুলোতে ‘অলৌকিক সিদ্ধপুরুষ’, ‘প্রিয়দর্শন দেবপুরুষ’ ইত্যাদি বিশেষণ শ্রীসদানন্দের উপর বর্ষিত হয়েছে। বিজ্ঞাপনগুলোতে বলা হয়েছে –শ্রীসদানন্দ কৃপা করলে রোগমুক্তি, সৌভাগ্যলাভ ও অসাধ্যসাধন হয়।

দেবপুরুষটির দর্শনে হাজির হলাম ‘আনন্দধামে’। সময় ১৯৮৭-র ২৮ জুলাইয়ের সন্ধ্যা। প্রতীক্ষাকক্ষে আরও অনেকের মতো আমাকে নাম পাঠিয়ে কিছুক্ষণ বসতে হল। দেওয়ালের নানা লেখা পড়ে ও ‘পরমপুরুষ শ্রীসদানন্দ লীলা মাহাত্ম্যঃ (প্রথম খন্ড)’র পাতা উল্টে সময় কাটালাম। দেওয়ালে উন্মাদ রোগ, হিস্টিরিয়া-সহ বহু রোগ ভাল করে দেওয়ার গ্যারান্টির কথা বড় বড় রঙ্গিন হরফে লিপিবদ্ধ। যে লেখাটা আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করল সেটা হল, বন্ধারমণীকে মাতৃত্ব দানের গ্যারান্টি। লীলা মাহাত্ম্যও খুব আকর্ষণীয় বই। বইটিতে জনৈকা শ্রীমতী লক্ষ্মী ঘোষ জানিয়েছেন, এক হিস্টিরিয়া রোগীকে শুধু একটি তাগা বেঁধে বাবাঠাকুর দু-দিনে তাকে ভাল করেছিলেন।

লক্ষ্মীদেবীর এক আত্মীয় বহু বছর ধরে প্যারালাইসিস রোগে ভুগছিলেন। সর্বাঙ্গ অসাড়। হাসপাতালে যখন মৃত্যুর দিন গুনছেন সেই সময় লক্ষ্মীদেবী রোগীর স্ত্রীকে পরামর্শ দেন বাবাঠাকুরের শরণাপন্ন হতে। বাবাঠাকুর দিলেন আশীর্বাদী ফুল-বেলপাতা। বলে দিলেন, এই ফুল-বেলপাতা রোগীর শরীর বুলিয়ে দিও। অবাক কান্ড, কয়েক দিনের মধ্যেই রোগমুক্ত হলেন।

জনৈক পঙ্কজ হাজরা জানিয়েছেন, একরাতে আসন্ন প্রসবা স্ত্রীকে নিয়ে যাচ্ছিলেন হাসপাতালে। সঙ্গী করেছিলেন শুধু ‘তাঁর নাম’। পথ চলছেন আর ব্যাকুল হয়ে ডাকছেন, ‘গুরু তুমি দৃষ্টি রাখো।‘ হঠাৎ পথের মাঝেই দর্শন পেলেন ইষ্টদেব সদানন্দের।

রেণুকা সমাজদার জানিয়েছেন, এক ফাল্গুনী গভীর রাতে হঠাৎ সমস্ত ঘর আলোকিত হয়ে গেল। রেণুকা দেখতে পেলেন সেই আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন শ্রীসদানন্দ। প্রাণ-মন আনন্দে ভরে উঠল। বিস্ময়ের আরও কিছু বাঁকি ছিল। শ্রীসদানন্দ হঠাৎ রূপ পরিবর্তন করলেন। হয়ে গেলেন মা কালী। এরপরও বহুদিন সময়ে-অসময়ে অপার করুণা বর্ষণ করে দেখা দিয়েছেন কখনো কৃষ্ণ, কখনো গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু রূপে, কখনো বা কালী রূপে।

একই ভাবে লক্ষ্মী ঘোষ তীব্র আকুতি নিয়ে যখনই ঠাকুরের দর্শন চেয়েছেন, তখনই শ্রীসদানন্দ আবির্ভূত হয়েছেন। এই সদানন্দই কখনো দর্শন দিয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ হয়ে, কখনো বিষ্ণু রূপে, কখনো বা গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর রূপ নিয়ে।

জনৈক পার্থ কুন্ডু চৌধুরী একদিন ঘরে বসে তারকেশ্বরের বিগ্রহকে মনেমনে স্মরণ করে কল্পনায় রূপ গড়ে প্রণাম জানাচ্ছেন। পরম বিস্ময়ে দেখলেন, তারকেশ্বর বিগ্রহের ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন ঠাকুর শ্রীসদানন্দ স্বয়ং। এমনতর আরও অনেক অত্যাশ্চর্য অলৌকিক ঘটনা আরও অনেকের জবানিতেই প্রকাশিত হয়েছে।

এক সময়ে ভিতরে যাওয়ার ডাক পেলাম। শ্রীসদানন্দ একটা খাটে বসে। বয়স পয়তাল্লিশের কাছাকাছি। উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির মধ্যে। মেদহীন চেহারা। গায়ের রং সাধারণ বাঙ্গালিদের তুলনায় কিছুটা ফর্সা। চুল প্রায় ঘাড়ে এসে পড়েছে।

বাবাঠাকুরকে পরিচয় দিলাম ‘আজকাল’ পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে। নাম বললাম, পুলক ঘোষ। সদানন্দ আমার সম্বন্ধে খুঁটিনাটি অনেক প্রশ্ন করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের পত্রিকায় তো প্রবীর ঘোষও লেখেন, ওকে চেনেন? উত্তর দিলাম, প্রবীরবাবুর লেখার সঙ্গে সামান্য পরিচয় আছে, কিন্তু প্রবীরবাবুর সঙ্গে নয়। বাবাঠাকুর বললেন, আপনার ছবি-টবি কোনও বই বা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে? আপনাকে খুব চেনা চেনা-লাগছে। বললাম, না, আমার ছবি প্রকাশিত হওয়ার মতো নামী-দামী মানুষ এখনও হয়ে উঠতে পারিনি। তবে বহু জায়গায় ঘুরতে হয়, কোথাও দেখে থাকতেই পারেন।

না, সাক্ষাৎকার নেবার চেষ্টা করিনি। নিজের সমস্যা নিয়ে এসেছি- জানিয়েছিলাম। তবে জানিয়েছিলাম শ্রীসদানন্দের বিষয়ে পত্রিকার পাতায় সুন্দর একটা প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছে আছে। এই ইচ্ছের কথা বলা সত্ত্বেও সদানন্দ তেমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন না। বরং জানতে চাইলেন, আপনি যে সমস্যা সমাধানের জন্য আমার কাছে এসেছেন, আপনার কি অলৌকিক বিষয়ে বিশ্বাস আছে?

বললাম, আছে বলেই তো আসা। তবে কথা হল, আসল মানুষটি খুঁজে পাওয়াই কঠিন।

আপনি গ্রহের ফল, গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবে বিশ্বাস করেন? শ্রীসদানন্দ জিজ্ঞেস করলেন।

সদানন্দের কথায় খেয়াল হল আজ প্রচন্ড তাড়াহুড়োয় হাতে বা আঙ্গুলে তাবিক বা গ্রহরত্নের আংটি পরে আসা হয়নি। অবস্থাটা ম্যানেজ করার চেষ্টা করলাম। বললাম, একসময় গ্রহরত্নের আংটি পড়তাম। বছরখানেক হল আংটি ছেড়েছি। সেও এক দক্ষিণ ভারতীয় সাধুর আদেশে। তিনি বলেছিলেন জন্মকুন্ডলীর কেন্দ্র-বিন্দুতে অবস্থান করেন শিব-শক্তি, ভাগ্যে যা ঠিক করা আছে তা পাল্টাতে পারেন একমাত্র শিব-শক্তি, পাথর-টাথর নয়। ওঁরই নির্দেশে পাথর বিদায় দিয়ে শিব-শক্তির উপাসক হয়েছি।

মন্ত্রে নাকি গর্ভবতী করেন শ্রীসদানন্দ ঠাকুর

কি পাথরের আংটি ছিল আপনার? জিজ্ঞেস করলেন সদানন্দ।

একটা ছিল মুক্তো, একটা হিরে। বললাম আমি।

হিরে আর মুক্তো কত রতি করে ছিল? আবার প্রশ্ন করলেন সদানন্দ।

বললাম হিরে আধ রতির মতো, মুক্তো সাড়ে ন’রতি।

সেদিন আরও কিছু একটা এটা-সেটা প্রশ্ন করে আমার ঠিকানা জিজ্ঞেস করলেন। একটা ঠিকানাও বললাম। বাবাঠাকুর ঠিকানাটা ডায়রিতে টুকে নিয়ে সাতদিন পরে আসতে বললেন। জানালেন সে দিনই আমার সমস্যার কথা শুনবেন এবং সমাধানের উপায় বতলাবেন।

সাত দিন পরে আবার গেলাম। এবার আমার স্নজ্ঞীঊ চিত্র-সাংবাদিক গোপাল দেবনাথ। আজও বাবা সতর্কতার সঙ্গেই কথা শুরু করলেন। এটা-সেটা নিয়ে গল্প-গাছার পর হঠাৎই বললেন, আপনি তো এখন স্টোন-টোন-এ বিশ্বাস করেন না। স্টোনগুলো কি করলেন?

বললাম, কিছুই করিনি, লকারে আছে।

বাবাঠাকুর মৃদু হাসলেন। বললেন, এ বিষয়ে আমি আপনার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। যে জিনিস প্রয়োজনে আসে না সে জিনিস ধরে রেখে লাভ কি? তারচেয়ে বিক্রি করে দিন। আপনারও পয়সা আসবে, অন্যেরও কাজে লাগবে। আংটিটা যেন কি স্টোনের ছিল?

বললাম, একটা নয় দুটো আংটি ছিল। একটা হিরের, একটা মুক্তোর।

কেমন ওজন ছিল ওগুলোর।

হিরেটা আধ রতির মতো, মুক্তোটা সাড়ে-ন’ রতির।

আমার উত্তর শুনে ঠাকুরবাবা স্বস্থি পেলেন। তাঁর টান-টান কথাবার্তা এবার সাবলীল হল।

প্রথম দিনের সাক্ষাতে সদানন্দ আমাকে কি কি প্রশ্ন করেছিলেন এবং তার কি কি উত্তর দিয়েছিলাম প্রতিটি স্মৃতিতে ধরে রাখতে সচেষ্ট ছিলাম। আমার মনে হয়েছিল বাবাঠাকুর আমাকে প্রবীর ঘোষ বলেই সন্দেহ করছেন। তাই এমন কিছু প্রশ্ন রেখেছিলেন এবং নিশ্চিত ছিলেন, উত্তরকর্তা প্রবীর ঘোষ হলে  যেগুলোর মিথ্যে উত্তর দেব। হঠাৎ করে প্রশ্নের উত্তর দিতে মিথ্যে বলতে বাধ্য হলে, স্বাভাবিক নিয়মে উত্তরদাতা দ্রুত ভুলে যান কি কি প্রশ্নের উত্তরে কি কি মিথ্যে বলেছিলেন।

সদানন্দের কাছে আমার সমস্যাগুলো মেলে ধরলাম। পাশাপাশি শুনছিলাম তাঁর কথা। স্নাতক। ম্যাজিক শিখেছেন। মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করেছেন। অভিনয় করেছেন। সদানন্দের কথায়, যাদের ভগবান বলি, তাঁরা আমাদেরই মত রক্ত-মাংসের শরীর নিয়ে এসেছিলেন। নিজের শক্তিকে জানতে পেরে তাঁরা ভগবান হয়ে গেছেন। সদানন্দও একইভাবে ভগবান। ভক্তদের লেখাগুলো প্রসঙ্গে জানালেন, কোন অতিরঞ্জন নেই। দু-পাতা বিজ্ঞান পড়া মানুষদের বেশির ভাগই পাশ্চাত্য সভ্যতার মোহে ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ভুলতে বসেছে। অথচ তারা জানে না পাশ্চাত্য দেশগুলোই প্রাচীন ভারতের মুনি-ঋষিদের পুঁথি-পত্র ঘেঁটে আবার নতুন করে উদ্ধার করছে পৃথিবী কাঁপানো অনেক বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে। ভারত অলৌকিক, অবতার ও ঋষিদের পুণ্য-ক্ষেত্র।

আলোচনার প্রসঙ্গকে টেনে আনলাম সদানন্দের একটি বিশেষ দিকে। বললাম, আপনি জানিয়েছেন মন্ত্র শক্তিতে ইচ্ছুক রমণীকে আপনি মাতৃত্ব দানে সক্ষম। এই মন্ত্র আপনি কোথা থেকে পেলেন?

আমার প্রশ্নের উত্তরে সদানন্দ আবার ঋষিদেরই টেনে আনলেন। জানালেন, আড়াই-তিন হাজার বছরের প্রাচীন এই মন্ত্রের স্রষ্টা ভারতের প্রাচীন ঋষি। তাঁদের কাছ থেকেই শিষ্য পরম্পরায় এই মন্ত্র এসেছে আমার কাছে।

পুলক ঘোষ পরিচয়ের আমি সদানন্দের কাছে আমার সমস্যার কথা বলতে গিয়ে ফুলবাবার কাছে যে গল্প ফেঁদেছিলাম, সেটাই ফাঁদলাম – আজ পর্যন্ত ঘরণী না জোটার গল্প। ভগবান সদানন্দ আমার কাহিনীকে সত্য বলে ধরে নিয়ে আবারও প্রমাণ করলেন তিনি সাধারণ মানুষ মাত্র।

ভরসা দিলেন এ-বার শিগগির বিয়ে হবে। বাবাকে নিয়ে সমস্যার কথা বললাম। বললাম, এমন কাজ করি, যখন-তখন যেখানে-সেখানে দৌড়তে হয়। বাড়িতে থাকেন তখন বৃদ্ধ মা ও বৃদ্ধ বাবা। বাবা হাঁপানি রোগী। মাঝে-মাঝে রাত-দুপুরে এখন-তখন অবস্থা হয়। ডাক্তার, অক্সিজেন-বৃদ্ধা মায়ের পক্ষে চাপ সামলানো মাঝে-মাঝে অসম্ভব হয়ে পড়বে। বাবাকে কি সুস্থ করা সম্ভব নয়?

সদানন্দ শান্ত গলায় বললেন, এই ধরণের অবস্থাই চলবে। ৯০ সাল পর্যন্ত বাঁচবেন।

ছন্দ-পরিচয়ের আমি তখনই জানাতে পারলাম না আমার বাবা বছর দুয়েক আগে মারা গেছেন। আর, হাঁপানি কেন, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত কোন দিনই তেমন অসুখ-বিসুখে ভোগেননি। বরং বলা চলে খুবই নীরোগ স্বাস্থ্যের, প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা মানুষ ছিলেন।

সদানন্দের দাবী প্রামণের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ২৬ ডিসেম্বর ১৯৮৯ একটি চিঠি লিই। চিঠিটি এখানে তুলে দিলাম।

শ্রীসদানন্দ দেবাঠাকুর

“”আনন্দধারা”                         ২৬.১২.৮৯

৭ অশ্বিনী দত্ত রোড,

কলকাতা- ৭০০ ০২৮

মহাশয়,

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আপনার ভক্তদের দেওয়া কিছু বিজ্ঞাপন আমার চোখে পড়েছে। বিজ্ঞাপনগুলোতে আপনাকে ‘অলৌকিক সিদ্ধ-পুরুষ’, ‘দেবপুরুষ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বছর দু-আড়াই আগে একাধিক সন্ধ্যায় আপনার আশ্রম থেকে প্রকাশিত দু-একটি বই আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। তারই একটি- ‘পরমপুরুষ শ্রীশ্রীসদানন্দ লীলা মাহাত্ম্য’ পড়ে জানলাম আপনার ভক্তরা অনেকেই আপনাকে শ্রীকৃষ্ণ, কালী, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু, বিষ্ণু, তারকেশ্বর ইত্যাদি হতে দেখেছেন। বইটিতে আপনি জানিয়েছেন, “তোরা যেখানেই যাকে পূজা করিস না কেন জানবি তা- আমাতেই অর্পণ হয়।“

আপনার একটি কথায় বড়ই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি। আপনি আমাকে জানিয়েছিলেন, মা হতে ইচ্ছুক রমণীকে আপনি মন্ত্র বলে মাতৃত্ব দিতে পারেন। এও জানিয়েছেন, আড়াই তিন হাজার বছরের প্রাচীন এই মন্ত্রের স্রষ্টা ভারতের প্রাচীন ঋষিরা। তাঁদের কাছ থেকেই শিষ্য পরম্পরায় এই মন্ত্র এসেছে আপনার কাছে।

আমার বিভ্রান্তির কারণ, আপনিই যখন ঈশ্বর তখন যা কিছু করার ক্ষমতা তো আপনারই হাতে। ইচ্ছুক রমণীকে গর্ভবতী করতে আপনার আবার মন্ত্রের প্রয়োজন কি?

অলৌকিক কোন কিছুর অস্তিত্ব আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানের দরবারে প্রমাণিত হয়নি, অথচ, অলৌকিক ক্ষমতার দাবীদার বহু। আমি একজন সত্যানুসন্ধানী। দীর্ঘদিন ধরে বহু অনুসন্ধান চালিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখেছি, অলৌকিক ক্ষমতার দাবীগুলি ছিল একান্তই অসার। আমার সত্যানুসন্ধানের প্রয়াসকে প্রতিটি সৎ মানুষের মতো আপনিও স্বাগত জানাবেন আশা রাখি। সেই সঙ্গে এও আশা রাখি, আপনার অলৌকিক ক্ষমতার বিষয়ে অনুসন্ধানে আপনি আমার সঙ্গে সমস্ত রকমের সহযোগিতা করবেন।

আপনার কাছে হাজির করতে চাই পাঁচজন রোগী ও তিনজন মা হতে ইচ্ছুক অথচ অক্ষম রমণীকে। রোগীদের এক বছরের মধ্যে রোগ মুক্ত করে ও ইচ্ছুক রমণীদের মাতৃত্ব দান করে আপনার ক্ষমতার প্রমাণ দিতে পারলে আমি এবং ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’ আপনার অলৌকিক ক্ষমতা স্বীকার করে নেব এবং আপনাকে প্রণামী হিসেবে দেব পঞ্চাশ হাজার টাকা। সেই সঙ্গে আমাদের সমিতি ভবিষ্যতে সমস্ত রকম অলৌকিক বিরোধী কাক-কর্ম থেকে বিরত থাকবে।

আগামী দশ দিনের মধ্যে আমাদের সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যোগাযোগ করে অনুসন্ধান বিষয়ে সহযোগিতা না করলে অবশ্যই ধরে নেব আপনার সম্বন্ধে প্রচলিত প্রতিটি কাহিনী এবং আপনার দাবী পুরোপুরি মিথ্যা।

আশা রাখি ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির পক্ষে আমার এই চ্যালেঞ্জ আপনি গ্রহণ করবেন।

শুভেচ্ছা সহ

প্রবীর ঘোষ

সুনিশ্চিতভাবে জানি, ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের ধৃষ্টতা দেখালে সদানন্দ দেবাঠাকুরের দেবত্বের গ্যাস বেলুন ফেঁসে যাবেই।

১২ জানুয়ারী ১৯৯০। চিঠিটা ফেরত দিয়ে গেল ডাক বিভাগ। শ্রীসদানন্দ চিঠিটা নিতে রাজি হননি। হায় জীবন্ত ভগবান, স্বর্গের দেবতা, মর্তের তুচ্ছ এক মানুষকে এত ভয়!

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x