৩১ আগস্ট, ৮৬,রবিবারের সকাল। আর পাঁচটা রবিবারের সকালের মতোই বৈঠকখানায় তখন গাদা-গাদা চায়ের কাপ আর রাশি রাশি সিগারেটের ধোঁয়ার মাঝে আড্ডা জমে উঠেছে। এমন সময় আমার ভায়রা সুশোভন রায়চৌধুরী এসে কোনও ভণিতা না করেই একটা দারুণ উত্তেজক খবর দিল- অতি সম্প্রতি ম্যানিলা থেকে একজন অলৌকিক ক্ষমতাবান ডাক্তার এসেছেন কলকাতায়; রোগীকে অজ্ঞান না করে, স্রেফ খালি হাতেম ব্যথাহীন অস্ত্রোপচার করে রোগ সারিয়ে দিচ্ছেন। ওর পরিচিত একজন অস্ত্রোপচার করিয়ে ভাল হয়ে গেছেন। অস্ত্রোপচারের দাগটি পর্যন্ত নেই। খরচ পড়েছে পাঁচ হাজার টাকা। সুশোভনের আমাকে খবরটা দেওয়ার কারণ, যদি এই অলৌকিক রহস্য উন্মোচন করতে পারি।
আমার কাছে কলকাতার ম্যানিলার অলৌকিক চিকিৎসকের উপস্থিতির খবরটা অবিশ্বাস্য ও অভাবনীয়। সুশোভন যাকে অলৌকিক ক্ষমতাবান ডাক্তার বলে অভিহিত করল তিনি এবং তাঁর মত ক্ষমতাবান চিকিৎসকরা নিজেদের পরিচয় দেন ‘ফেইথ হিলার’ বলে। যে ফেইথ হিলারদের নিয়ে পৃথিবী জুড়ে হৈ-চৈ, তাঁদেরই একজন এই মুহূর্তে কলকাতার বুকে প্রতিদিন বহু রোগীর ওপর অলৌকিক (?) অস্ত্রোপচার করা চলেছেন- কথাগুলো আমি ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি। গোটা ব্যাপারটাই ব্যান্ডেজ ভূতের মতোই গুজব নয়তো? খবরটা আমার কাছে অভাবনীয় এই জন্যে, মাত্র সপ্তাহ তিনেক আগে আমার কিছু বন্ধুর কাছে বলেছিলাম, “ফেইথ হিলারদের হিলিং ব্যাপারটা এখনও কিছুটা রহস্যময় রয়ে গেছে। তাঁদের অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে কৌশলটা ঠিক কি ধরনের এটা এখনো বিজ্ঞানীদের কাছে পরিষ্কার নয়। যদিও James Randi তাঁর ‘Flim-Flam’ বইতে এই বিষয়ে কিছু আলোচনা করেছেন, তবু তাঁর লেখাতে দুটি দুর্বল দিক রয়েছে। একঃ তিনি নিজে ফেইথ হিলারদের মুখোমুখি হননি, দুইঃ তাঁর বর্ণিত কৌশলের সাহায্যে একজন ফেইথ হিলারের পক্ষে একটা অপারেশন টেবিলে দাঁড়িয়ে অন্যের চোখের সামনে পরপর একাধিক অপারেশন অসম্ভব।
অথচ আমি ম্যানিলা থেকে অস্ত্রোপচার করিয়ে আসা তিনজনের সঙ্গে কথা বলে যা জেনেছি, তাতে ফেইথ হিলাররা স্থান ত্যাগ না করে অপারেশন টেবিলে এক নাগাড়ে দশ থেকে কুড়ি জনের ওপর অস্ত্রোপচার করেন। যদি কিছু টাকা যোগার করতে পারতাম, ফেইথ হিলিং রহস্য ভেদের একটা চেষ্টা করতাম, ম্যানিলায় গিয়ে নিজের ওপর ফেইথ হিলিং করিয়ে।”
সেখানে উপস্থিত এক বন্ধু তখনই জানায়, সে আমার ম্যানিলায় যাতায়াতের খরচ বহন করতে রাজি আছে। বাঁকি ছিল কয়েকদিন হোটেলে থাকা ও ফেইথ হিলিং-এর খরচ বহন করার ব্যাপার। গত তিন সপ্তাহ ধরে টাকা যোগাড় করা এবং ফিলিপিন-এ যাওয়ার প্রাথমিক প্রস্তুতি চলছিল। ঠিক এই সময় কলকাতায় ফেইথ ফিলারের উপস্থিতি- এ যেন ‘মেঘ না চাইতেই জল’। খবরটা আমার কাছে অভাবনীয়, অপ্রত্যাশিত এবং উল্লসিত হবার মত।
সুশোভনকে অনুরোধ করলাম ব্যথাহীন অস্ত্রোপচারে ভাল হওয়া ওর পরিচিত লোকটির কাছ থেকে অলৌকিক ডাক্তারের ঠিকানাটা অবশ্যই এক দিনের মধ্যে যোগাড় করে দিতে।
সুশোভন অবশ্য শেষ পর্যন্ত ঠিকানা দেয়নি, তবে আমারই এক বন্ধু দেবু দাস-এর কাছে ২ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার খবর পেলাম, ওর পরিচিত এক তরুণ তমনাশ দাস ফেইথ হিলারের রিসেপশনিস্ট-এর কাজ করছে।
দেবুর কাছ থেকে ঠিকানা ও একটা পরিচয়পত্র নিয়ে সেই রাতেই তমনাশের বাড়ি গিয়ে দেখা করলাম। স্মার্ট, ফর্সা, সুদর্শন তরুণ। হোটেল ম্যানেজমেন্টের পরীক্ষা দিয়ে বসে আছে।
আমি দেবু’র বন্ধু, লেখালেখি করি এবং অলৌকিক বিষয়ে খুবই আগ্রহী জেনে আমার প্রতি যথেষ্ট উৎসাহ দেখালেন তমনাশ। জানালাম, “গলব্লাডার, হার্ট আর ফ্যারেনজাইটিস নিয়ে জেরবার হয়ে আছি। ফেইথ হিলারের সাহায্য চাই। সেই সঙ্গে এই অলৌকিক চিকিৎসা বিষয়ে পত্রিকায় কিছু লিখতে চাই।”
তমনাশ জানালেন, “কয়েকজন সাংবাদিক বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার তরফ থেকে ইতিমধ্যে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তাঁদের প্রত্যেককেই হাতজোড় করে জানিয়েছি ক্ষমা করবেন। আমরা প্রচার চাই না। প্রচার ছাড়াই যে বিপুল সংখ্যক রোগী আসছেন, তার ভিড় সামাল দিতেই হিমশিম খাচ্ছি, অতএব মাপ করবেন। তবে আপনার চিকিৎসার বিষয়ে নিশ্চয়ই সাহায্য করব। এ জন্য আপনাকে দিতে হবে পাঁচ হাজার টাকা ক্যাশ।”
“যারা চিকিৎসা করাতে আসছেন তাঁরা কেমন ফল পাচ্ছেন?” – জিজ্ঞেস করলাম।
“মিরাকল রেজাল্ট।” কয়েকজন রোগীর নাম ও তাদের আরোগ্য লাভের গল্প বলতে বলতে আমার মত একজন উৎসাহী শ্রোতাকে দেখাবার জন্য ঘরের ভিতরে গিয়ে নিয়ে এলেন কয়েকটা রঙ্গিন ফটোগ্রাফ। তমনাশের উপর ফেইথ হিলিং চলাকালীন তোলা ছবি।
বললাম, “আপনার ছবি দিয়ে আপনার ফেইথ হিলিং-এর অভিজ্ঞতার কথাই পাঠকদের কাছে তুলে ধরতে চাই।”
আমার কথায় চিঁড়ে ভিজল মনে হল। খাতা কলম বের করে তমনাশের অভিজ্ঞতার কথা জেনে টুকে নিতে শুরু করলাম।
ফিলিপিন থেকে আসা এই ফেইথ হিলারের নাম Mr. Romeo P. Gallardo। সহকারী হিসেবে সঙ্গে এসেছেন Mr. Rosita J. Gallarado। উঠেছেন কলকাতার লিটল হোটেলে। এঁদের ভারতে নিয়ে আসার আর্থিক দায়-দায়িত্ব নিয়েছেন গৌহাটির কোটিপতি ব্যবসায়ী রামচন্দ্র আগরওয়াল। কলকাতার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়েছেন রামচন্দ্র আগরওয়ালের শ্যালক অলোক খৈতান। শারীরিক ও মানসিক ভাবে আরও বেশী রকম সুস্থ ও চনমনে হতে গ্যালার্ডোর ফেইথ হিলিং-এর সাহায্য নিয়েছিলেন তমনাশ। দারুণ কাজ হয়েছে। তমনাশকে এজন্য কোন টাকা দিতে হয়নি। মিস্টার গ্যালার্ডোর সঙ্গে তমনাশের খুব ভালো ভাব হয়ে গেছে। ভিড় ভালোই হচ্ছে। দিনে রোগী আসছেন একশো থেকে দেড়শো।
তমনাশের ছবিগুলো থেকে দুটো ছবি নিয়ে বললাম, “এই ছবি দুটি সহ লেখাটা ছাপতে চাই। লেখাটা আরো ভাল হতো যদি গ্যালার্ডোর একটা সাক্ষাৎকার সঙ্গে ছাপতে পারতাম।”
তমনাশ বললেন, “কাল রাতে একবার আসুন। আমি গ্যালার্ডোর সঙ্গে কথা বলে দেখি কিছু করা যায় কি না।”
তিন তারিখ রাতে খবর পেলাম, মিস্টার গ্যালার্ডো জানিয়েছেন মিস্টার আগরওয়ালের অনুমতি ছাড়া তাঁর পক্ষে কোনও সাক্ষাৎকার দেওয়া সম্ভব নয়। তমনাশ মিস্টার আগরওয়ালের সঙ্গেো কথা বলেছিলেন। আগরওয়াল আমার বিষয়ে অনেক কিছুই জানতে চেয়েছিলেন। কাজ উদ্ধার করতে সত্যি-মিথ্যে কল্পনা সব মিশিয়ে যা হোক উত্তর খাড়া করে দিয়েছেন তমনাশ। মিস্টার আগরওয়াল কাল তাঁর মতামত জানাবেন বলেছেন।
চার তারিখ রাতে আবার গেলাম। খবর পেলাম, গ্যালার্ডোর সাক্ষাৎকার পাওয়ার অনুমতি মিলেছে। ছয় সেপ্টেম্বর শনিবার ২-৩০ মিনিটে লিটল হোটেলের ৪৬ নম্বর রুমে দেখা করতে বললেন তমনাশ। ওই রুমেই আপাততঃ আগরওয়াল, খৈতান ও তমনাশের আস্তানা। সেদিনই সাক্ষাৎকারের পরে আমার চিকিৎসাো করা হবে।
৮৫-র এপ্রিলে ইংলন্ডের গ্রানেডা টেলিভিশন প্রোডাকশনের একটা তথ্যচিত্রের ভিডিও দেখি। নাম ছিল World in action”। ছবিটি ফিলিপিনের অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাবান চিকিৎসক ফেইথ হিলারদের নিয়ে তোলা। ফেইথ হিলাররা যে কোন রোগেরই চিকিৎসা করেন তাঁদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার দ্বারা। চিকিৎসা পদ্ধতিও বিচিত্র। রোগীকে অপারেশন টেবিলে শুইয়ে দেওয়া হয়। ফেইথ হিলার বিড়বিড় করে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করেন। তারপর শরীরের যে অংশে অস্ত্রোপচার করবেন, সেখানে দু’হাতে সামান্য জল ও এক ধরনের তৈলাক্ত পদার্থ ছিটিয়ে সামান্য মালিশ করেন। এবার শুরু হয় অস্ত্রহীন অস্ত্রোপচার। ফেইথ হিলার নিজের হাতের আঙ্গুলগুলো রোগীর শরীরের যে অংশে অস্ত্রোপচার করা হবে সেই অংশে ঢুকিয়ে দিতে থাকেন। বেড়িয়ে আসতে থাকে তাজা লালা রক্ত। ফিলিপিনো ফেইথ হিলারদের ভাষায় এগুলো “Devil Blood” বা ‘শয়তানের রক্ত’।
হার্ট, লাংস, কিডনি, অ্যাপেনডিক্স, টিউমার, গলব্লাডার প্রভৃতি বড় বড় অপারেশনও ফেইথ হিলাররা করে থাকেন। এইসব অপারেশনও করা হয় একইভাবে, রোগীকে অজ্ঞান না করে কোনও অস্ত্রের সাহায্য ছাড়া এবং অবশ্যই ব্যথাহীন ভাবে। পাঠকদের মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে, তবে কি ওঁরা হাতের নখের সাহায্য নেন? না, তাও নয়, নিখুঁত ছাঁটা। স্রেফ দু’হাতের বা এক হাতের আঙ্গুলের সাহায্যেই ওঁরা রোগীর কাটা ছেঁড়ার কাজ করেন। হাত তুললেই শুধু রক্ত। ফেইথ হিলারের সহকারী তুলো দিয়ে রক্ত মুছে নিতেই দেখা যায়। অস্ত্রোপচারের কোনও চিহ্ন নেই, আপনা থেকেই কাটা জায়গা জোড়া লেগে গেছে। যত বড়ই অস্ত্রোপচার হোক না কেন, রোগীকে একটুও ব্যথায় কাতর হতে দেখা যায় না। ফেইথ হিলিং চিকিৎসার সাহায্য নেওয়ার পর অনেকেরই বক্তব্য- তাঁরা ভাল আছেন।
‘ওয়ার্ল্ড ইন অ্যাকশন’ ছবিতে গ্রানাডা টিভি প্রোডাকশনের ভাষ্যকার বা narrator ছিলেন মাইক স্কট। টিভির সামনে একজন ফেইথ হিলার একটি বালিকার গলা থেকে একটা ‘গ্রোথ’ (growth) অস্ত্রোপচার করলেন স্রেফ খালি হাতে। এক্ষেত্রেও অজ্ঞান না করে ব্যথাহীন অস্ত্রোপচার। অস্ত্রোপচার শেষ হতেই মাইক স্কটের সহকর্মীরা ওই গ্রোথটি এবং রক্তাক্ত তুলো সংগ্রহ করেছিলেন।
![](https://bdlibrary.net/wp-content/uploads/2024/03/Capture-5.png)
![](https://bdlibrary.net/wp-content/uploads/2024/03/Capture2-1.png)
ফেইথ হিলার Jose Mercado এবার যার উপর অস্ত্রোপচার করলেন তিনি বেশ মোটাসোটা মানুষ। পেটে নাকি টিউমার। কিছুটা তেল আর জল পেটে ছড়িয়ে কিছুক্ষণ ধরে মালিশ ও প্রার্থনা চলল। একসময় “এক সময় রোগীর পেটের উপর মার্কাডো নিজের হাত দুটো পাশাপাশি রাখলেন। তারপর মুহূর্তে বাঁ হাত দিয়ে পেটে চাপ দিয়ে ডান হাতটা ঢুকিয়ে দিলেন রোগীর পেটে। বেড়িয়ে এল রক্ত। সহকারী তুলো দিয়ে রক্তগুলো মুছতে লাগলেন। মার্কাডো পেট থেকে হাত বের করলেন। হাতে ধরা রয়েছে টিউমার। সহকারী রক্তধারা মুছিয়ে দিতেই কোন জাদুবলে অস্ত্রোপচারের চিহ্ন অদৃশ্য হল। পেট দেখলে বোঝার উপায় নেই কখনো এখানে অস্ত্রোপচার হয়েছিল।”
দূরদর্শনের ভাষ্যকার স্কট অতি তৎপরতার সঙ্গে টিউমারটি মার্কাডোর হাত থেকে তুলে নিলেন, সেই সঙ্গে কিছুটা রক্তাক্ত তুলো।
মেয়েটির গ্রোথ এবং রক্তাক্ত তুলো পরীক্ষার জন্য পাঠান হয় Guy’s Hospital London-এর ডিপার্টমেন্ট অফ ফরেনসিক মেডিসিনে। মেয়েটির গলার গ্রোথ বায়পসি করে জানা যায় দেহাংশটি একটি পূর্ণবয়স্ক যুবতীর স্তনের অংশ এবং রক্তের নমুনা মানুষের নয়।
পুরুষ মানুষটির টিউমার ও রক্তাক্ত তুলো পরীক্ষার জন্য পাঠান হয়েছিল লন্ডন হসপিটাল মেডিকেল কলেজের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার P. J. Lincoln-এর কাছে। পরীক্ষার পর লিংকন মত দেন তথাকথিত টিউমারটি আসলে মুরগীর দেহাংশ এবং রক্তের নমুনা গরুর।
দেহাংশ এবং রক্ত নমুনার পরীক্ষার ফল স্পষ্টতই বুঝিয়ে দেয় এগুলো রোগিনী ও রোগীর দেহাংশ বা রক্ত আদৌ নয়। অর্থাৎ রোগীর দেহে কোন অস্ত্রপচারই করা হয়নি এবং অস্ত্রপচার করে বার করে আনা হয়নি কোনও দেহাংশ। তবে এতগুলো অনুসন্ধিৎসু চোখ ও টি ভি ক্যামেরা যা দেখল সেটা কি? রোগীরা যা অনুভব করলেন তার কি কোনই গুরুত্ব নেই?
এক্ষেত্রে অবশ্য নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় না- ফেইথ হিলার প্রতারক। কারণ, পরীক্ষা গ্রহণকারীদের পক্ষে দেহাংশ ও রক্তের নমুনা পাল্টে দেবার সুযোগ ছিল। যেহেতু সরকারীভাবে কোনও ফরেনসিক বিভাগ অস্ত্রোপচারের সঙ্গে সঙ্গে দেহাংশ ও রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে তা সিল করে পরীক্ষার দায়িত্বগ্রহণ করেননি, তাই সুনিশ্চিতভাবে কোনও কিছুই প্রমাণিত হয় না।
ফেইথ হিলারদের কাছে যেসব রোগী চিকিৎসা করিয়েছেন তাঁদের কিছু ঠিকানা যোগাড় করেন গ্রানেডা টিভি প্রোডাকশন। ফেইথ হিলিং-এর পরে বর্তমানে তাঁরা কেমন আছেন, এই তথ্য সংগ্রহই ছিল গ্রানেডার উদ্দেশ্য। ঠিকানা পরিবর্তনের জন্য অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। যাদের মতামত সংগ্রহ করা গিয়েছিল তাঁদের বেশির ভাগই জানান ফেইথ হিলিং-এর পর অনেকটা সুস্থ অনুভব করেছিলেন, কিন্তু বর্তমানে আবার উপসর্গগুলো ফিরে এসেছে। বাঁকি রোগীরা জানান- এখন সামান্য ভাল অনুভব করছেন (“felt a littile better”)।
দুই ফেইথ হিলার David Elizalde এবং Helen Elizalde -এর অলৌকিক অস্ত্রোপচারের উপর B.B.C একটা অনুষ্ঠান প্রচার করে। অনুষ্ঠানটির পরিচালক ডেভিড ও হেলেনকে জালিয়াত, ধোঁকাবাজ এবং প্রতারক বলে বর্ণনা করেন। কারণ, মানুষের দেহে অস্ত্রোপচার করে তাঁরা যা বের করেছিলেন, পরীক্ষার ফলে তা শুয়োরের দেহাংশ বলে B.B.C জানান। এই ক্ষেত্রেও রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে জানা যায়- মানুষের রক্ত নয়। এক্ষেত্রেও নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়নি সংগৃহীত নমুনাই পরীক্ষিত হয়েছিল। কারণ এটাও আগের মতই সরকারি পরীক্ষা ছিল না। ছিল সম্পূর্ণ বে-সরকারী উদ্যোগে পরীক্ষা।
ফেইথ হিলিং ব্যাপারটার মধ্যে একটা ধোঁকাবাজি আছে এ কথা একাধিকবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি প্রমাণ করার চেষ্টা করলেও ওঁরা কি কৌশলে নিজেদের হাতের আঙ্গুলগুলো রোগীর শরীরে ঢুকিয়ে দেন এবং কি কৌশলেই বা তৎক্ষণাৎ রক্তের আমদানী করেন, কেমন করেই বা আসে অস্ত্রোপচারে বিচ্ছিন্ন করা দেহাংশ, এসব প্রশ্নের উত্তর কিন্তু কেউই যুক্তিপূর্ণভাবে হাজির করতে পারেননি।
ফেইথ হিলারদের ফেইথ হিলিং-এর কৌশলগত দিক নিয়ে আলোচনা করে যিনি যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছেন তিনি আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তিবাদী বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব James Randi। তিনি তাঁর ‘FLIM FLAM’ বইতে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন ফেইথ হিলাররা অস্ত্রোপচারের আগে নিজের বুড়ো আঙ্গুলে একটি নকল বুড়ো আঙ্গুলের খাপ পরে নেয়। নকল আঙ্গুলের খাপে লুকানো থাকে রক্ত এবং ফেইথ হিলারের সহকারীর তুলোয় জড়ানো থাকে মাংস।
র্যান্ডির লেখাটা পড়ে আমার মনে হয়েছিল ফেইথ হিলিং -এর গোপন কৌশল বলে তিনি যা বর্ণনা করেছেন তাতে কিছু ফাঁক-ফোকর রয়েছে। একঃ এভাবে দর্শকদের সামনে পরপর একাধিক রোগীর ওপর অস্ত্রোপচার করা অসম্ভব। কারণ বুড়ো আঙ্গুলের খাপে লুকিয়ে রাখা রক্তের পরিমাণ অতি সীমিত হতে বাধ্য। দুইঃ টিভি ক্যামেরার ক্লোজ-আপ এবং হাত দুয়েক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পরীক্ষক বা দর্শকদের নকল আঙ্গুলের সাহায্যে ঠকান খুব একটা সহজসাধ্য বলে মনে হয় না।
জেমস র্যান্ডির অবশ্য এই বিষয়ে কিছু ভ্রান্তি হতেই পারে, কারণ তিনি নিজে ফেইথ হিলারদের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ পাননি। র্যান্ডি ফিলিপাইনে গিয়ে ফেইথ হিলারদের উপর অনুসন্ধান চালাতে চেয়ে ফিলিপাইন সরকারের কাছে ভিসা প্রার্থনা করেন। ফেইথ হিলারদের উপর অনুসন্ধানের নামে তাঁদের কোন রকম অসম্মান জানালে ফিলিপিনবাসীদের কাছে তা ধর্মীয় আঘাত বলে বিবেচিত হতে পারে, এই অযুহাতে ফিলিপাইন সরকার জেমস র্যান্ডিকে ভিসা দেননি বলে র্যান্ডি স্বয়ং অভিযোগ তুলেছেন।
ফেইথ হিলারদের অলৌকিক ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে যে সব বই আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে বিশ্বের জনপ্রিয়তম বইটি সম্ভবত “Arigo: Surgeon of the Rusty Kniff”। লেখক John Fuiler। Arigo ছদ্মনামের আড়ালে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাবান ফেইথ হিলারটির নাম Jose Pedro de Feitas।
অ্যারিগো আর দশজন ফেইথ হিলারের মতই সাদা পোশাক পরে গ্লাভস ছাড়াই রোগীদের উপর খালি হাতে দ্রুত অস্ত্রোপচার করেন, তবে অস্ত্রোপচারের আগে একটা ছুড়ির বাঁট দিয়ে রোগীর চামড়াটাকে একটু ঘষে নেন। অস্ত্রোপচার শেষে সেলাই না করেই একটু হাত ঘষে কাটাটা আবার জুড়ে দেন। তারপর অতি-জড়ান হাতের লেখায় যে প্রেসক্রিপশন লেখেন, সেটি নাকি তিনি তাঁর নিজের বিবেচনামাফিক লেখেন না। এক মৃত জার্মান ডাক্তার -এর আত্মা নাকি অ্যারিগোর বাঁ কানে ফিসফিস করে যে ওষুধের কথা বলেন অ্যারিগো তাই লেখেন।
অ্যারিগোর প্রেসক্রিপশনের লেখা এতই জড়ানো যে শহরের একটি মাত্র ফার্মেসিই সেই লেখা পাঠোদ্ধার করতে পারে। ফার্মেসির মালিক এ্যারিগোর ভাই।
জন ফাউলার তাঁর বইটির তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ধনকুবের বিজ্ঞানী ও অলৌকিকবাদের ধারক-বাহক ডঃ আন্ড্রুজা পুহারিক প্রযোজিত অ্যারিগোর ওপর তোলা একটি ফিল্ম দেখে।
অ্যারিগোর ফেইথ হিলিং ছাড়া আর যে “impossibilities” দেখে ডঃ পুহারিক বিহ্বল হয়েছিলেন তা হল অ্যারিগোর একটি মুদ্রাদোষ। অ্যারিগো কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝেই নিজের চোখে ছুড়ি ঢুকিয়ে দেন, যেটা ডঃ পুহারিকের মতে কোনও মানুষের পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব। এ এক অলৌকিক ক্ষমতারই প্রকাশ।
ডঃ পুহারিকের এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ইতালির Piero Angela এক পদ্ধতিতে বারবার চোখে ছুড়ি ঢুকিয়ে প্রমাণ করেছেন, এই ধরণের কোনও কিছু ঘটলে সেটা অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার সাক্ষ্য বহন করে না। এটা একটা কষ্টসাধ্য অনুশীলনের ফল মাত্র।
আর যাই হোক, এটা কিন্তু স্বীকার করতেই হবে ‘ফেইথ হিলার’ নামক অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাবান (?) কিছু চিকিৎসক তাঁদের অদ্ভুত চিকিৎসা পদ্ধতির দ্বারা পৃথিবীর প্রতিটি উন্নত দেশে প্রচণ্ড রকমের হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছেন। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষা-ভাষী
![](https://bdlibrary.net/wp-content/uploads/2024/03/Capture3.png)
পত্রিকায় এঁদের নিয়ে লেখা হয়েছে এবং হচ্ছে। আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন ও ইতালীর মানুষ তাঁদের দেশের টিভিতে ফেইথ হিলারদের অলৌকিক কার্যকলাপ দেখে শিহরিত হয়েছেন, এই তথ্যাদি আমার জানা। জানি না আরও কতগুলো দেশ ফেইথ হিলারকে টিভি ক্যামেরায় বন্দি করেছেন
সম্পূর্ণ কষ্টহীন ও ঝুঁকিহীন ভাবে আরোগ্য লাভের আশায় প্রতিবছর আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান এবং ইউরোপ ও আরবের বিভিন্ন দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ নানা রকম দুরারোগ্য রোগ সারাতে ম্যানিলায় যান। এইসব দেশের মত এত বিশাল সংখ্যায় না হলেও ভারতবর্ষ থেকে, এমনকি আমাদের কলকাতা শহর থেকেই প্রতি বছর কিছু লোক চিকিৎসিত হতে ম্যানিলায় যান। এই লক্ষ লক্ষ আরোগ্যগামী বিদেশীদের কল্যাণে ম্যানিলায় গড়ে উঠেছে জমজমাট হোটেল ব্যবসা। আমদানি হচ্ছে মূল্যবান বিদেশী মুদ্রা।
চিকিৎসার জন্য কোন অর্থ গ্রহণ করেন না ফেইথ হিলাররা। শুধু নাম তালিকা ভুক্ত করার সময় ৮৬-তে ভারতীয় টাকায় আড়াইশো টাকার মত জমা দিতে হতো। সাধারণভাবে চিকিৎসা হলে রোগের গুরুত্ব অনুসারে তিন থেকে সাত দিন। প্রতিদিনই রোগীর দূষিত রক্ত শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে বের করে দেন ফেইথ হিলার। চিকিৎসা শেষে রোগীর কাছে দেশের গরীবদের সাহায্যার্থে সাধারণত ৫০০ ডলার সাহায্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
ফিলিপিনসঃ ফেইথ হিলারদের লীলাক্ষেত্র হলেও, এরা মাঝে-মধ্যে অন্য কোনও দেশের ধনকুবেরের সঙ্গে আর্থিক চুক্তি করে সেই দেশে দু-এক মাসের জন্য পাড়ি দেন অলৌকিক চিকিৎসার পসরা নিয়ে।
তেমন রমরমা প্রতিষ্ঠা না পেলেও, ব্রাজিল এবং পেরুর কয়েকজন আধ্যাত্মিক নেতা অলৌকিক ক্ষমতা পেয়ে ফেইথ হিলিং শুরু করেছেন।
পাঁচ সেপ্টেম্বর সকাল থেকেই ‘ভারতীয় যুক্তিবাদী সমিতি’র (বর্তমান নাম ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি) কয়েকজন সদস্য পালা করে হোটেল লিটলের উপর নজর রাখতে লাগলেন। সন্ধ্যের মধ্যে খবর পেলাম ওই ৪৬ নম্বর ঘরে অসম, অ.গ.প. -র জনৈক নেতাও নাকি প্রায় পুরো সময়ই ছিলেন। মিস্টার ও মিসেস গ্যালার্ডো আছেন ৪৪ নম্বর ঘরে। এছাড়া আর এমন কিছু খবর পেলাম যার ফলে এটুকু বুঝতে অসুবিধে হল না যে আমাকে অস্ত্রোপচার করার পর সেই রক্তের নমুনা সংগ্রহ করার চেষ্টা করাটা অত্যধিক ঝুঁকির ব্যাপার হবে। কথাটা বোধহয় ভুল বললাম। বরং সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে আমরা বিশ্বাস করেছিলাম ওদের বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে হোটেল লিটলের বাইরে আমাদের জীবিত দেহ আর কোনদিনই বের হবে না।
ছয় তারিখ বারোটা থেকে আমি লিটল থেকে না বের হওয়া পর্যন্ত আর কয়েকজন অতিরিক্ত যুক্তিবাদী সদস্যকে লিটলে নজর রাখার জন্য নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। এঁরা কেউই বিপদে ঘাবড়ে যাওয়ার মত নন।
সেদিন দুপুর সাড়ে এগারোটার সময় ফোন করলাম কলকাতা পুলিশের তৎকালীন যুগ্ম-কমিশনার সুবিমল দাশগুপ্তকে। ফেইথ হিলারদের রহস্যময় চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে সংক্ষেপে বলে জানালাম, বর্তমানে আমাদের এই শহরের লিটন হোটেলে বিশ্বখ্যাত এক ফেইথ হিলার অবস্থান করছেন। আজ আড়াইটের সময় আমি তাঁর একটা সাক্ষাৎকার নেব, তারপর আমার উপর অপারেশন করাবো। ইনিই সম্ভবত প্রথম ফিলিপিনো ফেইথ হিলার যিনি ভারতে এলেন।
সুবিমলবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “এই বিষয়ে তোমার মত কি? সত্যিই কি ওঁরা খালি হাতে অপারেশন করেন?”
বললাম, “আমার ধারণা পুরোটাই একটা বিশাল ধাপ্পা। আমি আশা রাখই ওদের কৌশলটা ধরতে পারব। এই বিষয়ে আপনার একটু সাহায্য চাই বলেই ফোন করা। আমাকে অপারেশন করার পর আমার শরীর থেকে যে রক্ত বের হবে তার নমুনা আপনি ফরেনসিক টেস্টের জন্য সংগ্রহ করলে বাধিত হবো। কারণ এই রিপোর্টই পারে ওই দীর্ঘদিনের এক সন্দেহের ও বিতর্কের অবসান ঘটাতে।”
ও প্রান্ত থেকে উত্তর এল, “মোস্ট ইন্টারেস্টিং। নিশ্চয়ই যাবো। ক’টায় তোমার এ্যাপোয়েন্টমেন্ট?”
“দুটো তিরিশে, হোটেল লিটনে। একটি অনুরোধ, প্লেন ড্রেসে যাবেন।”
“তুমি ঠিক দুটোয় লালবাজারে চলে এসো।”
আড়াইটার আগেই হোটেল লিটনে পৌঁছলাম। সুবিমলবাবুর সকারী এ্যাম্বাসেডার আর দেহরক্ষীদের আমরা ত্যাগ করলাম। গ্লোব সিনেমা হলের কাছে। হোটেলে ঢুকলাম আমরা পাঁচজন। আমি, সুবিমল দাশগুপ্ত, ভারতীয় যুক্তিবাদী সমিতির দুই সভ্য প্রাক্তন টেবিল টেনিস খেলোয়ার জ্ঞান মল্লিক, চিত্র-সাংবাদিক সৌগত রায় বর্মণ এবং দর্শক হিসেবে আমার অফিসের এক সহকর্মী।
প্রথমে হানা দিলাম ৪৪ নম্বর ঘরে। নক করতেই দরজা খুললেন মিস্টার গ্যালার্ডো। পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলাম ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরিজিতে মিস্টার গ্যালার্ডো জানালেন, “আপনার কথা মিস্টার তমনাশের কাছে শুনেছি। আপনি আশায় খুশি হয়েছি, দয়া করে ৪৬ নম্বর রুমে মিস্টার আগরওয়ালের সঙ্গে দেখা করুন। একটু পরেই আমি আসছি। মিস্টার আগরওয়ালের সামনে ছাড়া আমি কোন ইন্টারভিউ দিতে অক্ষম।”
৪৬ নম্বর রুমে অনেককেই পেলাম। রামচন্দ্র আগরওয়াল, অলোক খৈতান, তমনাশ দাস এবং অসম অ.গ.প. নেতা বলে পরিচয় দেওয়া জনৈক বসন্ত শর্মাকে। তমনাশই ওঁদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
আমার চার সঙ্গীর সঙ্গে ওঁদের পরিচয় করিয়ে দিলাম। শুধু সুবিমল দাশগুপ্তের বেলায় মিথ্যে বললাম, “মিস্টার দাশগুপ্ত, আমার কাজিন ব্রাদার।”
আমরা সকলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে খুব দ্রুত খোলামেলা আলোচনায় মেতে উঠলাম। আগরওয়াল এবং অলৌক খৈতান দুজনেই ভালই বাংলা বলেন।
এক সময় আমার প্রশ্নের উত্তরে মিস্টার আগরওয়াল জানালেন, “আমার এক আত্মীয়ের একটা চোখ অন্ধ হয়ে যায়। ম্যানিলায় গিয়ে ফেইথ হিলিং করিয়ে সে আবার দৃষ্টি ফিরে পেয়েছে। তখনই আমার মাথায় একটা চিন্তা ঢোকে। বড়লোকেরা
![](https://bdlibrary.net/wp-content/uploads/2024/03/Capture4.png)
না হয় রোগ সারাতে ম্যানিলায় যেতে পারে, কিন্তু গরীবদের কঠিন অসুখ হলে তারা কি করবে? ভাবলাম দেশের সাধারণ মানুষদের জন্য না হয় কিছু খরচা করলামই। আমার আত্মীয়ের কাছ থেকে ডাক্তারের ঠিকানা নিয়ে ‘ফেইথ হিলিং করতে যাচ্ছি’ জানিয়ে ভিসা করে ম্যানিলায় চলে গেলাম। ওখানে মিস্টার গ্যালার্ডোর সঙ্গে দেখা করে আমার পরিকল্পনার কথা জানাই। উনি খুবই ভাল লোক, আধ্যাত্মিক জগতের লোক তো। আমার কথায় ভারতে আসতে রাজি হলেন।
“৭ আগস্ট মিস্টার অ্যান্ড মিসেস গ্যালার্ডো কলকাতায় আসেন। এই হোটেলেই ওঠেন। আমাদের চেনা-শুনাও পরিচিতদের মধ্যে অনেকেই ফেইথ হিলিং এর সুযোগ নিয়ে শুরু করেন। এখানে বারো দিন থাকার পর ২৯ আগস্ট আমি আর অশোক ওঁদের নিয়ে গৌহাটি যাই। ওখানে ওঁরা পাঁচ দিন ছিলেন। এত ভিড় হচ্ছিল যে, নাওয়া-খাওয়ার সময় পর্যন্ত পাচ্ছিলাম না। একদিন তো ২০০ রোগী নাম লিখিয়েছিলেন। টাকা রোজগারের ধান্দা থাকলে নিশ্চয়ই খুশি হতাম। তা যখন নয় তখন নিজেদের জান বাঁচাতে পালিয়ে এলাম। ২৭ তারিখ থেকে আবার কলকাতায়। ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এখানে থাকার পরিকল্পনা রয়েছে। তারপর হয়তো ওঁদের নিয়ে দিল্লি যেতে পারি।”
আগরওয়াল এই কথার মধ্য দিয়ে বোঝাতে চাইলেন, মিস্টার গ্যালার্ডোকে এদেশে নিয়ে আসার উদ্দেশ্য টাকা রোজগার নয়, নেহাৎই সেবা। তাই আমাদের বিশাল টাকার হাতছানিও তিনি আক্লেশে ছেড়ে আসতে পেরেছেন। ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে মিস্টার অ্যান্ড মিসেস গ্যালার্ডোকে ১৮/৮/৮৬ -তে ইস্যু করা পারমিটের একটি প্রতিলিপি আমার হাতে এসেছে যাতে দেখেছি তাঁদের ২০ আগস্ট ৮৬ থেকে ২৭ আগস্ট ৮৬ পর্যন্ত আসামে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অতএব রোজগারের ধান্দা থাকলেও ২৭ আগস্টের পর মিস্টার ও মিসেস গ্যালার্ডোর আসামে থাকা সম্ভব ছিল না।
আগরওয়ালকে প্রশ্ন করলাম, “আপনি একটু আগে বলছিলেন দেশের গরীব মানুষদের সেবার জন্য মিস্টার গ্যালার্ডোকে নিয়ে এসেছেন। তবে রোগীদের কাছ থেকে পাঁচ হাজার করে টাকা নিচ্ছেন কেন?”
আমার প্রশ্ন শুনে প্রথমটায় আগরওয়াল সামান্য গুটিয়ে গিয়ে পরে সামলে নিয়ে বললেন, “যে বিশাল খরচ করে এঁদের এনেছি তাতে খরচের কিছুটা অংশ না তুলতে পারলে তো মরে যাব দাদা। হোটেল খরচই মেটাচ্ছি রোজ আট-হাজার টাকা। তার উপর এই হোটেলের মালিকের পাঠান দুজন করে রোগী প্রতিদিন বিনে পয়সায় দেখে দিচ্ছি।”
হাসলাম, বললাম, “আপনি তো প্রত্যেক রোগীকে দিয়েই একটা ডিক্লিয়ারেশন ফর্ম দিল-আপ করাচ্ছেন। আমাকে ফর্মের ফাইলটা একটু দেবেন। কিছু রোগীর ঠিকানা নেব। একটা সার্ভে করে দেখতে চাই তাঁরা ফেইথ হিলিং করিয়ে কেমন ফল পেয়েছেন।”
অলোক দু-কাঁধ ঝাঁকিয়ে জানালেন, “ফাইলটা কালই হারিয়ে গেছে।”
কথায় কথায় মিনিট কুড়ি মনে হয় পার হয়েছে, একজন তরুণ ভেজান দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে তমনাশকে ইশারায় ডেকে বেড়িয়ে গেলেন। তমনাশও বেরোলেন। মিনিট দুয়েক পরেই তমনাশ ডাকলেন আগরওয়ালকে। তার মিনিট দুয়েক পরেই আগরওয়াল আমাকে বাইরে ডাকলেন। বাইরে এসে দেখি করিডোরে তমনাশ, আগরওয়াল ও যে ছেলেটি নক করেছিল সে দাঁড়িয়ে। প্রত্যকেই যেন কিছুটা অস্বস্তি ও চিন্তার মধ্যে রয়েছেন।
আগরওয়াল আমাকে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার সঙ্গে কি সাদা পোশাকে পুলিশ কমিশনার বা জয়েন্ট কমিশনার রয়েছেন?”
“কেন বলুন তো?”
“না, খবর পেলাম কি, গ্লোব হলের কাছে ওই জাতীয় পদের কারো একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ইউনিফর্ম পরা বডিগার্ড গাড়িতেই রয়েছে। কমিশনার বা জয়েন্ট কমিশনার যিনিই এসে থাকুন তিনি যখন বডিগার্ড সঙ্গে নেননি তখন প্লেন ড্রেসেই কাছাকাছি কোথাও আছেন। আমাদের মনে হচ্ছে তিনি আপনার সঙ্গে আছেন।”
“হ্যাঁ, মিস্টার দাশগুপ্তের সঙ্গে যে আলাপ করিয়ে দিলাম, তিনিই জয়েন্ট কমিশনার। তবে আপনার কোনও চিন্তার কারণ নেই। উনিও আমার মতই ফেইথ হিলারদের অলৌকিক ক্ষমতার বিষয়ে জানতে ও দেখতে উৎসাহী। আমি আজ ইন্টারভিউ নেব এবং অপারেশন করাব শুনে সঙ্গী হয়েছেন।”
ইনফরমার ছেলেটি বিদায় নিল। আমি, আগরওয়াল ও তমনাশ ঘরে ঢুকলাম। যে ঘটনাটা একটু আগে ঘটল সেটা সবার সামনে বলে পরিবেশটাকে হালকা করতে চাইলাম।
সুবিমলবাবুও হাঁসতে হাঁসতে আগরওয়ালকে বললেন, “আমি কিন্তু এখানে এসেছি পৃথিবী বিখ্যাত ফেইথ হিলিং নিজের চোখে দেখব বলে। পুলিশের তকমা এঁটে কারো মনে অস্বস্তি সৃষ্টি করতে চাই না বলেই এই পোশাকে আসা। সুযোগ পেলে আমার কপালের একটা ব্যথা আপনাদের হিলিং-এ সারে কিনা একটি পরীক্ষা করে দেখতে পারি।”
এরপর আমাদের আগের মত খোলামেলা কথাবার্তা আর জমল না। মিনিট দশেক পরে দরজা খুলে মিস্টার ও মিসেস গ্যালার্ডো আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন, “আসুন।”
আমরা হোটেলের কনফারেন্স রুমে এলাম। রুমের একপাশে একটা লম্বা টেবিলে প্লাস্টিকের নীল চাদর বিছানো। টেবিলের কাছে দাঁড়ালেন মিস্টার গ্যালার্ডো, পাশে মিসেস। করমর্দন করে দু’জনকে শুভাচ্ছে জানালাম। দেখলাম মিস্টার গ্যালার্ডোর প্রতিটি আঙ্গুলের নখই নিখুঁত কাটা।
আমার প্রথম প্রশ্নটা ছিল, “ফেইথ হিলিং-এর সাহায্যে যে কোনও রোগীকে কি রোগমুক্ত করা সম্ভব?”
“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই,” গ্যালার্ডো উত্তর দিলেন।
“প্রতিটি ফেইথ হিলিং-এর ক্ষেত্রেই কি অপারেশন করার প্রয়োজন হয়?”
“না, না। শরীরের ভিতর থেকে কোন দেহাংশ বিচ্ছিন্ন করে বের করতে হলেই শুধু “ওপন” করার প্রয়োজন হয়। অবশ্য হিলিং করার সময় যে কোনও রোগের ক্ষেত্রেই রোগীর শরীর থেকে ‘ডেভিল ব্লাড’ বের করে দিই। সেটাকেও যদি অপারেশন বলতে চান, তো বলতে পারেন।”
“একজন রোগীকে হিলিং করতে কত সময় লাগে?”
“দেড় থেকে তিন মিনিট।”
“আপনি এই ফেইথ হিলিং কোথা থেকে শিখলেন?”
আমার প্রশ্ন শুনে হাসলেন মিস্টার গ্যালার্ডো। বললেন, “এ তো শেখা যায় না। আর আমিও তো চিকিৎসা করি না। ‘গড’ই রোগীদের চিকিৎসা করেন। আমি গডের হাতের যন্ত্র মাত্র। ঈশ্বর যাদের মাধ্যমে রোগীদের নিরাময় করান তাঁদের নির্বাচন করেন তিনি নিজেই।”
“যারা আপনার কাছে আরোগ্যের আশায় আসেন, তাঁরা সকলেই কি রোগ মুক্ত হন?”
“সারবেই, এমন গ্যারান্টি আমি কাউকেই দিচ্ছি না। আরোগ্য নির্ভর করে রোগীদের ওপর। রোগীর যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস থাকে, যদি ফেইথ হিলিং-এ বিশ্বাস থাকে এবং এক মনে ঈশ্বরের কাছে নিজের আরোগ্য কামনা করে তবে নিশ্চয়ই সারবে। তবে এটা কয়েকদিনে সারবে, কি কয়েক সপ্তাহে অথবা কয়েক মাসে, তা সম্পূর্ণই নির্ভর করে রোগীর বিশ্বাস ও প্রার্থনার ওপর।”
মিসেস গ্যালার্ডোকে এবার প্রশ্ন করলাম, আপনিও ফেইথ হিলার?”
মিসেস গ্যালার্ডো দু’পাশে মাথা ঝাঁকালেন, “না, না, আমি ঈশ্বরের সেই কৃপা পাইনি। স্বামীকে সাহায্য করি মাত্র।”
মিস্টার গ্যালার্ডোকে এবার প্রশ্ন করলাম, “আপনি নিশ্চয়ই পৃথিবীর অনেক দেশ ঘুরেছেন?”
“হ্যাঁ।”
“বিদেশে কোথাও কি কোনও বিজ্ঞান-সংস্থা, বিজ্ঞানী বা চিকিৎসক আপনার চিকিৎসা পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা চেয়েছেন? অথবা ফেইথ হিলিংকে বুজরুকী বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন?”
“Psychic (অতীন্দ্রিয়) কোনও কিছুরই ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। ফেইথ হিলিং-এর বিষয়ে আমাকে কয়েক জায়গায় এই ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। যারাই এই ধরনের প্রশ্ন করেছেন বলেছি, ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। তাঁদের অনুরোধ করেছি ব্যাখ্যা করে আমার মেডিটেশন ও কনসেনট্রেশনে বিঘ্ন সৃষ্টি করবেন না।
“আরও একটা কথা কি জানেন মিস্টার ঘোষ, বিজ্ঞান এগিয়েছে বলে ঈশ্বর মিথ্যে হয়ে যায়নি। পৃথিবীর বহু দেশের টেলিভিশন কোম্পানী ফেইথ হিলিং-এর উপর ছবি তুলেছে। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ অনেক্ল উল্টোপাল্টা অভিযোগও তুলেছে। ওঁদের অভিযোগ, অস্ত্রোপচারের সময় যে রক্ত ও দেহাংশ ওঁরা সংগ্রহ করেছিল সেগুলো পরীক্ষা করিয়ে নাকি দেখেছে ওসব মানুষের দেহাংশ বা রক্ত নয়। কিন্তু পৃথিবীর কোন যুক্তিবাদী মানুষের কাছেই অভিযোগগুলো গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেনি। কারণ পরীক্ষার আগে সংগৃহীত নমুনা পাল্টে দেওয়ার সব রকম সুযোগই পরীক্ষকদের ছিল। এই সুযোগ যে তাঁরা গ্রহণ করেননি, তার গ্যারান্টি কে দেবে?
“একটু সহজ করে বোঝাবার চেষ্টা করছি। আপনার ওপর অস্ত্রোপচার করলাম। আপনি সেই অস্ত্রোপচারের ছবি তুলে রাখলেন। আমাকে দিয়ে আজই যে অস্ত্রোপচার করিয়েছেন, তার স্বপক্ষে আরও কিছু প্রমাণ সংগ্রহ করে রাখলেন। ধরুন, আপনি ফেইথ হিলিং-এ বিশ্বাস করেন না। যেহেতু আপনি বিশ্বাস করেন না, তাই আপনি চান অন্যরাও যাতে আমার হিলিংকে অবিশ্বাস করে, আমাকে প্রতারক ভাবে। আমাকে প্রতারক প্রমাণ করতে আপনি এক টুকরো তুলোয় মাছের রক্ত মাখিয়ে কোনও হাসপাতাল বা ল্যাবে পরীক্ষা করতে দিলেন। তাঁরা পরীক্ষা করে লিখিত ভাবে জানিয়ে দিলেন তুলোয় সংগৃহীত রক্ত মাছের। আপনি এরপর যদি কোন নামী-দামী পত্রিকায় ঢাউস প্রবন্ধ লিখে আমাকে প্রতারক আখ্যা দেন এবং প্রমাণ হিসেবে আপনার শরীরে আমি অস্ত্রোপচার করেছি এমন ছবি ছাপেন, রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টও ছাপেন, তাতে কিছু যুক্তিহীন মানুষ হয়তো বিভ্রান্ত হতে পারেন, কিন্তু কোনও যুক্তিবাদী মানুষই আপনার কথাকে চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে মেনে নেবেন না। কারণ এক্ষেত্রে নমুনা পাল্টাবার সুযোগ আপনার ছিল, এবং আপনার সততার বিষয়টি একেবারেই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে থাকে।
“প্রতিটি যুক্তিবাদী মানুষ আপনার প্রমাণকে চূড়ান্ত বলে মেনে নিতেন, আপনার কথায় আস্থা রাখতেন,যদি রক্তের নমুনা পুলিশ দপ্তর থেকে সংগৃহীত ও সরকারি ফরেনসিক দপ্তর থেকে পরীক্ষিত হতো। যে সব টিভি কোম্পানী বা ওই জাতীয় প্রতিষ্ঠান আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন, আসলে তাঁরাই মিথ্যাচারী, সস্তায় বাজিমাতৎ করতে চেয়েছেন। তাই সংগৃহীত নমুনা পাল্টে দেওয়ার সুযোগও নিজেদের হাতে রেখেছিলেন।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তিবাদী বলে বিজ্ঞাপিত জাদুকর জেমস র্যান্ডি তাঁর লেখা একটা বইতে এক অদ্ভুত তথ্য সরবরাহ করেছেন। বলেছেন- ফেইথ হিলাররা নাকি নিজেদের বুড়ো আঙ্গুলে একটি নকল বুড়ো আঙ্গুলের খাপ পরে থাকে। ওই খাপের মধ্যে লুকোনো থাকে রক্ত। তারপর তিনি আমাদের ঠগ, জালিয়াত ইত্যাদি বলে চেঁচিয়েছেন। আপনি আমার দু’হাত দেখুন। কোথাও বুড়ো আঙ্গুলের খাপ দেখতে পাচ্ছেন?” হাত দুটো এগিয়ে দিলেন মিস্টার গ্যালার্ডো।
“এই মুহূর্তে আপনি শুয়ে পড়ুন, আপনার শরীর থেকে এখনই ডেভিল ব্লাড বার করে দিচ্ছি, দেখতে পাবেন কোনও কৌশল নেই।” বললেন মিস্টার গ্যালার্ডো।
আমি আশ্বস্ত করলাম, “আপনাকে অবিশ্বাস করার মত কোনও কিছুই ঘটেনি। কিন্তু একটা প্রশ্ন, আপনারা সাংবাদিকদের এড়াতে চাইছেন কেন? এতে ফেইথ হিলিং-এর সত্যতা সম্বন্ধে সংবাদপত্রগুলোর সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক নয় কি?”
“এই বিষয়ে বলতে পারবেন মিস্টার আগরওয়াল।”
আগরওয়ালকে প্রশ্নটা করতে বললেন, “যারা সন্দেহ করতে চান করুন, তাঁদের মিথ্যে সন্দেহে আমাদের কিছুই আসে যায় না।”
“আমাকে কেন তবে সাক্ষাৎকার নেওয়ার অনুমতি দিলেন?”
“আপনার কথা স্বতন্ত্র। আপনার ফেইথ হিলিং-এ বিশ্বাস আছে, নিজেরও চিকিৎসা করাবেন, তমনাশের রেফারেন্সের লোক, তাই আপনার অনুরোধ ঠেলতে পারিনি। সত্যি বলতে কি, আপনি যদি খবরের কাগজে আমাদের সম্বন্ধে একলাইনও না লেখেন তো খুবই উপকার হয়। খবর পড়ে যখন ভিড় বাড়বে তখন ভিড় সামলাবে কে? সবারই উপকার করতে ইচ্ছে ত হয়, কিন্তু আমাদের খাটার ক্ষমতারও একটা সীমা আছে।” বললেন মিস্টার আগরওয়াল।
“পেশেন্টদের মধ্যে বাঙ্গালী কেমন আসছেন?”
আগরওয়াল বললেন, “খুব কম। দিনে দু-একজন। কিছু মনে করবেন না, পাঁচ হাজার টাকা খরচ করার মত বাঙ্গালী খুব কমই আছেন।”
মিস্টার গ্যালার্ডোকে এবার জিজ্ঞেস করলাম “আপনার বয়েস কত?”
“আমি তেতাল্লিশ, মিসেস ঊনচল্লিশ।”
“ফিলিপিনস-এ কতজন ফেইথ হিলার আছেন?”
“প্রথম শ্রেণীর ফেইথ হিলারের সংখ্যা আমাকে নিয়ে দশ জন। এছাড়াও দ্বিতীয় শ্রেণীর জন্য চল্লিশ জন ফেইথ হিলার আছেন।”
বললাম, “শুনেছি প্রথম শ্রেণীর ফেইথ হিলারদের রাজনৈতিক ক্ষমতা অত্যধিক?”
“সব দেশের স্পিরিচুয়ালিস্টরাই এই ক্ষমতা পেয়ে থাকেন। আপনাদের দেশও
![](https://bdlibrary.net/wp-content/uploads/2024/03/Capture-6.png)
তার বাইরে নয়।” বললেন, মিস্টার গ্যালার্ডো।
আমাদের কথাবার্তার মাঝে ছবি তুলে যাচ্ছিল জ্ঞানও সৌগত। মিস্টার গ্যালার্ডো বললেন, “লেখাটা প্রকাশিত হওয়ার পর একটা কপি মিস্টার আগরওয়ালকে দয়া করে পাঠিয়ে দেবেন, তাহলেই আমি পেয়ে যাব।”
“নিশ্চয়ই দেব।”
“এবার আপনার শারীরিক সমস্যাটা বলুন।”
বললাম, “সমস্যা তিনটি। গলায় ফ্যারেনজাইটিস, হার্টেও কিছু অসুবিধে রয়েছে, একটা স্ট্রোক হয়েছিল, গলব্লাডারের আশেপাশে মাঝে-মধ্যে খুব ব্যথা হয়।”
গ্যালার্ডোর আহ্বানে অপারেশন টেবিলে খালি গায়ে শুয়ে পড়লাম। এখন আমার টেবিলের এক পাশে দেওয়ালের দিকে পিঠ করে মিস্টার গ্যালার্ডো। মাথার দিকে এক গাদা তুলো হাতে মিসেস গ্যালার্ডো। মিস্টার গ্যালার্ডোর বাঁ পাশে একটা টুলের উপর
![](https://bdlibrary.net/wp-content/uploads/2024/03/Capture-7.png)
রয়েছে এক বালতি জল আর একটা বড় সাদা তোয়ালে। ডানপাশে আর একটা খালি বালতি। আমার সামনে ছোট-খাট একটা ভিড়। এঁদের অনেকেই রোগী এবং তাঁদের আত্মীয়-স্বজন। আমাদের সমিতির এক নজরদার সভ্যকেও দেখতে পেলাম।
মিস্টার গ্যালার্ডো আমার পাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে হাত দুটো কিছুটা মেলে দিয়ে চোখ বুজে বিড়বিড় করে কি যেন বললেন। তারপর কিছুটা জল ও বামজাতীয় স্বচ্ছ তরল ওষুধ নিয়ে আমার পেটে, বুকে ও গলায় আধ-মিনিটের মত মালিশ করলেন। হাত দুটো এবার জলের বালতিতে ডুবিয়ে আমার গলার বাঁ পাশে গ্যালার্ডো তাঁর দু-হাতের আঙ্গুল চেপে ধরে হঠাৎ আঙ্গুলগুলো কচলাতে লাগলেন। চটচট করে একরকম আওয়াজ হচ্ছিল। অনুভব করলাম আমার গলা বেয়ে তরল কিছু নেমে যাচ্ছে। বুঝলাম রক্ত। মিস্টার গ্যালার্ডো তাঁর ডান হাতটা আমার চোখের সামনে ধরলেন। কালচে লাল থকথকে কিছু। হাতের থকথকে ময়লা ডান পাশের বালতিতে ফেলে হাতটা জলের বালতিতে ডুবিয়ে ধুয়ে নিলেন। পাশের তোয়ালেতে হাতটা মুছে নিলেন। ইতিমধ্যে গড়িয়ে পড়া রক্তধারার কিছুটা মিসেস গ্যালার্ডো পরম মমতায় তাঁর হাতের তুলো দিয়ে মুছে দিলেন।
![](https://bdlibrary.net/wp-content/uploads/2024/03/Capture-8.png)
এরপর একে একে খালি হাতে আমার গলব্লাডার ও হার্টে অস্ত্রোপচার করলেন গ্যালার্ডো। অস্ত্রোপচার শেষে একটা ঘটনা ঘটল। মিসেস গ্যালার্ডো তুলো হাতে এগিয়ে এলেন রক্ত মুছিয়ে দিতে। এটাই সঠিক মুহূর্ত। শোয়া অবস্থাতেই আমি ওঁর হাতের তুলো থেকে কিছুটা ছিঁড়ে নিয়ে পেট থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত নিলাম। দ্রুত এগিয়ে এলেন সুবিমল দাশগুপ্ত। আমার হাত থেকে তুলোটা নিয়ে একটা টেস্ট টিউবে ঢুকিয়ে মুখ বন্ধ করে টেস্ট টিউবটা পকেটে পুরলেন। সকলের দৃষ্টি যখন পুরোপুরি এই ঘটনার দিকে তখন সাধ্যমত তৎপরতার সঙ্গে প্যান্টের ডান পকেট থেকে রুমালটা বের করে পেট থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তের কিছুটা মুছে নিয়ে রুমালটা আবার পকেটেই চালান করে দিলাম।
কিছুটা থতমত গ্যালার্ডো আমার গলায়, বুকে ও পেটের সামান্য উপরে জল ও বাম-জাতীয় স্বচ্ছ তেল আধ মিনিটের মত মালিশ করে ছেড়ে দিলেন।
উঠে বসে শার্ট গায়ে গলাতেই মিস্টার গ্যালার্ডো বললেন, “এখন কেমন লাগছে?”
“ভাল, অনেকটা ভাল। এখন আমার শরীর ঘিরে বাম ঘষার মত একটা ঝাঁজালো ঝিরঝিরে ভাব।”
![](https://bdlibrary.net/wp-content/uploads/2024/03/Capture-9.png)
“কাল আর পরশু আর দুদিন আসুন। বার-তিনেক হিলিং করালে আশা করি অনেক তাড়াতাড়ি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন।” বললেন, মিস্টার গ্যালার্ডো,
আমি ঘড়ি দেখলাম। আমার উপর মোট তিনটে অস্ত্রোপচারে সময় লেগেছে পাঁচ মিনিট।
আমি ওঠার পর সুবিমলবাবু শুলেন। ওঁর কপালে ব্যথা। আরও দ্রুততর গতিতে হাত চালাতে লাগেলন বিশ্বখ্যাত ফিলিপিনো ফেইথ হিলার রোমেও পি. গ্যালার্ডো। এরপর আমরা আরও চারজন রোগীর উপর অস্ত্রোপচার দেখলাম ও ছবি তুললাম। কয়েকজন রোগী ও তাঁদের আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বুঝলাম অলৌক খৈতান সত্যিই এমন রহস্যময় চিকিৎসার যোগ্য ব্যবস্থাপক। প্রত্যেককেই ইতিমধ্যে নিখুঁত টিমওয়ার্ক মারফৎ মুখ খুলতে বারণ করে দিয়েছেন। একজন মাত্র মহিলার কাছ থেকে বহু কষ্টে তাঁর ঠিকানা যোগাড় করতে সক্ষম হয়েছিলাম। সেই ঠিকানাও সেদিন যোগাড় করেছিলাম লিটন হোটেল থেকে বেশ কিছুটা দূরে, হোটেলের চার দেওয়ালের ভিতর তিনিও কোন অজ্ঞাত কারণে আমাদের যথেষ্ট ভীতির চোখে দেখছিলেন। মহিলাটি তাঁর নাম বলেছিলেন অঞ্জলি সেন। রোগী তাঁরই ছেলে। দেখে মনে হল খুবই রুগ্ন বং কিছুটা জড়বুদ্ধিসম্পন্ন।
আমরা বিদায় নেওয়ার আগে অলোক আমাকে বললেন, “কাজটা ঠিক করলেন না। মিস্টার গ্যালার্ডো আপনাদের বলতে বলেছিলেন, শয়তানের রক্ত পকেটে নিয়ে ঘোরা ঠিক নয়, এতে অপঘাতে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ডেভিল ব্লাড মিস্টার গ্যালার্ডোর হাতে তুলে দিলেই বোধহয় ভাল করবেন।”
বুঝলাম প্রচ্ছন্ন হুমকী। হেঁসে ‘গুডবাই’ জানিয়ে বিদায় নিলাম আমরা।
পরের দিন ৭ তারিখ রবিবার বিকেল চারটের সময় আবার হোটেল লিটনে গেলাম। এই সময় সুবিমলবাবুরও থাকার কথা। গিয়ে তাঁর দেখাও পেলাম। হোটেলের উপর নজর রাখা সমিতির কিছু সভ্যদের কাছ থেকে পাওয়া কয়েকটা খবরের ভিত্তিতে বুঝেছিলাম জল অনেক দূর গড়িয়েছে। যে খবরগুলো জানান প্রয়োজনীয় মনে হল সুবিমলবাবুকে সেগুলি দিলাম। গ্যালার্ডো আমার ও সুবিমলবাবুর উপর হিলিং করলেন। আজ গ্যালার্ডো, অলোক এবং আগরওয়াল আমাকে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে একই প্রশ্ন করলেন, “ফেইথ হিলিং সম্পর্কে আপনার মতামত কি?”
বললাম, “সত্যিই বিস্ময়কর।”
তৃতীয় দিন, সোমবার ৮ সেপ্টেম্বর, সকাল থেকে পরপর কয়েকটা ঘটনা ঘতে গেল।
সকাল ৭টা ৫০। এক তরুণ আমার ফ্ল্যাটে এলেন বিশাল এক মোটর-বাইকে আরোহী হয়ে। এঁকে আমি হোটেল লিটনের কনফারেন্স রুমে দেখেছি। বসতে বলে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কোথা থেকে আসছেন ভাই?”
নিজের কোন পরিচয় বা আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তরুণটি সরাসরি আমাকেই প্রশ্ন করলেন, “ব্লাড টেস্টে কি পেলেন খুবই জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।”
“এই কথা জিজ্ঞেস করতে আমার কাছে এসেছেন? আপনার তৎপরতার প্রশংসা না করে পারছি না। এত তাড়াতাড়ি আমার বাড়িতে আপনাদের আশা করিনি। ব্লাড স্যাম্পেল যার কাছে, প্রশ্নটা সেই সুবিমল দাশগুপ্তকেই করা উচিৎ ছিল আপনার।”
অফিসে যেতেই আমার ঘরে দেখা করতে এলো জ্ঞান। জানাল, আজ অফিস আসতে গণেশচন্দ্র এভিনিউয়ের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় নামতেই একটা মোটর পিছন থেকে এসে ওকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। এ ধরনের ভাবার কারণ, মোটরটাকে দেখেই জ্ঞানের মনে পড়ছে সকাল থেকে বার কয়েক বাড়ির ঝুল
![](https://bdlibrary.net/wp-content/uploads/2024/03/Capture-10.png)
বাড়ান্দায় দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখার সময় এই গাড়িটাকে উল্টো ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল এবং গাড়িটা রং সাইডে ড্রাইভ করে জ্ঞানের ঠিক পিছনে নিয়ে আসা হয়। গাড়ি কোন হর্ন দেয়নি। গাড়ির শব্দ শুনে পিছনে তাকিয়েই ফুটপাতে লাফিয়ে পড়ে জ্ঞান। গাড়িটাও দ্রুত পালিয়ে যায়। নম্বর দেখারও কোন সুযোগ পায়নি।
সকালে আমার বাড়ির ঘটনা এবং জ্ঞান মল্লিকের ঘটনা ফোনে লালবাজারে সুবিমল দাশগুপ্তকে জানাই। সুবিমলবাবু আমাকে বললেন আজ যেন কোনও রকম ভাবেই ফেইথ হিলিং না করাই। দুপুরের মধ্যে হোটেলে নজর রাখার দায়িত্বে থাকা সমিতির দুই সভ্য খবর দিলেন, আজ একটা বড় রকমের অঘটন ঘটতে পারে, আমি যেন সাবধান হই।
বিকেল ঠিক পাঁচটার সময় হোটেলের বাইরে জ্ঞান আর সৌগত রায় বর্মনকে পেলাম। দুজন আমাকে দেখে স্বস্তি পেল। ওঁদের কাছে খবর পেলাম দুজনকেই নাকি আজ বিভিন্ন জায়গায় অনুসরণ করা হয়েছে। আমরা তিনজন হোটেলের কনফারেন্স রুমে ঢুকলাম। ভিতরে যথেষ্ট ভিড়। আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন মিস্টার অলোক খৈতান। বললেন, “আজ একটু দেরি হচ্ছে। আপনি আজও হিলিং করাবেন তো?”
বললাম, “সেই জন্যই তো আসা।”
অলোক বললেন, “একটু অপেক্ষা করতে হবে। মিস্টার গ্যালার্ডোর আজ মেডিটেশন ঠিকমত হচ্ছে না বলেই এই দেরি।”
ভিড়ের মধ্যে আমাদের সমিতির দু’জন সভ্যকেও দেখতে পেলাম।
আমরা তিনজন হোটেলের বাইরে এলাম। ঠিক করলাম ওয়াই এম সি এ-তে বসে কথা বলব। এখানেও আমাদের পিছনে টিকটিকি। ঝুলবারান্দায় বসে ওমলেট আর চা খেতে খেতে আমরা ঠিক করলাম আজ আর হিলিং করাব না, কারণ আজ হোটেলে যেন বড় বেশি সন্দেহজনক চরিত্রের আনাগোনা। শুধু বিদায় নিয়ে আসব ওদের কাছ থেকে। হোটেলে ঢোকার মুখেই অলোকের সঙ্গে দেখা, আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বললেন, “দাদা, আজ দুপুরে সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কের ডিরেক্টরের সঙ্গে আপনি দেখা করেছেন খবর পেলাম। ডিরেক্টর সাহেবের ব্লাড রিপোর্ট কি বলছে?”
“আমার শরীর থেকে আমারই রক্ত বের হবে। সুতরাং তার রিপোর্ট কি, এ নিয়ে আপনাদের কেন এতো মাথা ঘামাবার প্রয়োজন হল বুঝতে পারছি না। দেখা করেছি সে খবর জানতে পারলেন, আর তিনি কি বলেছেন, আর সে খবর জানতে পারলেন না?”
আমার কাছ থেকে এই ধরনের কিছু উত্তরই বোধহয় প্রত্যাশা করেছিলেন। আমার কথা শোনার পরেও বিনয়ী হাঁসি হেঁসে বললেন, “আজ মিস্টার গ্যালার্ডো কারো হিলিং করবেন না। আপনি বরং কাল আসুন।”
একটি পত্রিকা অফিস থেকে সন্ধ্যে ছ’টা নাগাদ যোগাযোগ করলাম সুবিমলবাবুর সঙ্গে। পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে তাঁকে ওয়াকিবহাল করে রাখলাম। সব শুনে সুবিমলবাবু বললেন, “ফরেনসিক রিপোর্ট পেতে একটু দেরি হবে। তোমার রুমালের দাগ দেখে ব্লাড ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর সত্যেনবাবু কি বললেন?”
“বললেন, দাগ দেখে আমার মনে হচ্ছে এটা কোনও মানুষের রক্ত নয়। এই ধরনের রুমালের সামান্য দাগ পরীক্ষা করে বলার মত আধুনিক যন্ত্রপাতি আমাদের নেই। একমাত্র ফরেনসিক টেস্টই আসল সত্য নিখুঁতভাবে উদ্ঘাটনে সক্ষম।
ফেইথ হিলার গ্যালার্ডো জলের সঙ্গে যে তেল মিশিয়ে রোগীর শরীরে মালিশ করে, তাঁরই একটা শিশি রাত এগারোটায় আমার বাড়িতে এসে পৌঁছে দিয়ে গেলেন খৈতান শিবিরেরই এক ব্যক্তি। বিনিময়ে তাঁর একটি উপকার অবশ্য আমাকে করতে হয়েছিল।
চতুর্থ দিন, ৯ তারিখ, মঙ্গলবার দুপুরের পর খবর এলো গ্যালার্ডো দম্পতি লিটন হোটেল ছেড়ে, এয়ারপোর্ট হোটেলে উঠেছেন।
সন্ধ্যায় একটি পত্রিকার অফিস থেকে ফোনে যোগাযোগ করলাম সুবিমলবাবুর সঙ্গে। ইতিমধ্যে আমার কাছে খবর এসেছে, আজই গ্যালার্ডো দম্পতি ভারত ত্যাগ করছেন। সুবিমলবাবু সেই সঙ্গে জানালেন, “প্রদীপ সরকারকে (জাদুকর) আজই ফেইথ হিলার আর তোমার কথা জানালাম। ওর ধারণা ফেইথ ফিলার সম্ভবত নিজের আঙ্গুলে সূচ বা ওই ধরনের কিছু ফুটিয়ে রক্ত বের করে রোগীর শরীরে মাখিয়ে দিচ্ছে।”
বললাম, “আপনি তো বেশ কয়েকটা অপারেশন দেখলেন। আর প্রতিটি অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রেই বেড়িয়ে আসা রক্তের পরিমাণ যথেষ্ট। একটা রোগীর ক্ষেত্রে যদিও এইভাবে রক্ত দেখান সম্ভব বলেও ধরে নেই, কিন্তু বহুজনের ক্ষেত্রে পদ্ধতি সম্পূর্ণ অসম্ভব।”
আমার যুক্তিটা সুবিমলবাবুর মনে ধরেছে মনে হল। বললেন, “তা বটে। কিন্তু রহস্যটা তুমি ধরতে পেরেছ?”
“নিশ্চয়ই। আগামী রবিবার সকালে আমার বাড়িতে চলে আসুন। ছেলের উপর একইভাবে অস্ত্রোপচার করে দেখাবো।
রবিবার ১৪ সেপ্টেম্বর সুবিমলবাবু না এলেও ভারতীয় যুক্তিবাদী সমিতির সভ্যদের সামনে ছেলে পিনাকীর উপর একই ভাবে অস্ত্রোপচার করে দেখালাম। পিনাকীর পেট ফুটো হয়ে আমার ডান হাতের আঙ্গুলগুলো ঢুকে গেল। বেরিয়ে এলো রক্ত। তারপর শরীরের ভিতর থেকে বের করে আনলাম এক টুকরো মাংস। ছবি তুললেন চিত্র-সাংবাদিক গোপাল দেবনাথ। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সমিতির সদস্য, কয়েকজন সাংবাদিক ও চিত্র-সাংবাদিক। সকলেই যদিও জানতেন আমি কৌশলের সাহায্যে অস্ত্রোপচার করছি, তবুও উপস্থিত কেউই আমার কৌশলটা কোথায়, সেটা বুঝতে না পেরে যথেষ্ট অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
সব শেষে উপস্থিত সামনে প্রকাশ করলাম কৌশলটা। অস্ত্রোপচারের পূর্ব মুহূর্তে আমার পোশাকের আড়াল থেকে খালি হাতে এসে গিয়েছিল একটা পাতলা রবারের ছোট্ট বেলুন। বেগুনী রঙ্গের ওই বেলুনে পোরা ছিল নকল রক্ত। আমার হাতের ভিতের বেলুনটা এমন কৌশলে লুকিয়ে রেখেছিলাম যে দর্শকরা মুহূর্তের জন্যেও আমার হাতে বেলুনের অস্তিত্বের কথা বুঝতে পারেননি। পিনাকীর পেটে হাতের আঙ্গুলগুলোকে এমন কৌশলে স্থাপন করেছি, সাধারণের দৃষ্টিতে মনে হয়েছে ওর পেট ফুটো করেই বুঝি আমার আঙ্গুলগুলো ঢুকে গেল। বেলুনটাকে চটকে ফাটাতেই ফাটাতেই নকল রক্ত ছড়িয়ে পড়েছে। বেলুনের ছেঁড়া কালচে-লাল রবারকেই থকথকে দেহাংশ বলে দেখিয়েছি। আর পিনাকীর পেট থেকে যে মাংসের টুকরোটা ছিঁড়ে
![](https://bdlibrary.net/wp-content/uploads/2024/03/Capture-11.png)
![](https://bdlibrary.net/wp-content/uploads/2024/03/Capture1-2.png)
![](https://bdlibrary.net/wp-content/uploads/2024/03/Capture2-2.png)
![](https://bdlibrary.net/wp-content/uploads/2024/03/Capture3-1.png)
এনেছিলাম আসলে সেটা ছিল তুলোর ভাঁজে লুকোন। গ্যালার্ডো অবশ্যই আমারই কায়দায় প্রতিবারই অস্ত্রোপচারের আগে কখনো পোশাকের আড়াল থেকে কখনো বা পাশের তোয়ালের ভাঁজ থেকে নকল রক্ত ঠাসা বেলুন তুলে নিয়েছেন এবং জাদুর পরিভাষায় যাকে বলে ‘পামিং’ সেই ‘পামিং করেই বলুন লুকিয়ে রেখেছেন দর্শকদের এবং ক্যামেরার চোখ এড়িয়ে তারপর যা করেছেন তার বর্ণনাতো আমার করা অস্ত্রোপচারের পদ্ধতিতেই দিয়েছি।
পোশাকের আড়ালে বিশেষ কৌশলে অনেক জাদুকরেরা অনেক কিছুই লুকিয়ে রাখেন। একে ম্যাজিকের পরিভাষায় বলে ‘লোড নেওয়া’। পোশাকের আড়ালে এ-ভাবেই জাদুকরেরা লুকিয়ে রাখেন পায়রা, খরগোশ, এমনি আরও কর না জিনিস-পত্তর।
ঘটনাটা এখানেই শেষ করা যেত, কিন্তু এরপর আরও দু-একটা ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না। প্রথম ঘটনাটি ঘটল ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬ রবিবার দুপুর ২-১৫ মিনিটে। অলোক খৈতান আমার বাড়িতে এলেন। জানতে চাইলেন, ফেইথ হিলিং বিষয়ে আমার অভিমত কি।
বললাম, পুরো ব্যাপারটাই ধাপ্পা। পিনাকীর ওপর আমার খালি হাতে অস্ত্রোপচারের (ফেইথ হিলিং-এর) ছবিও দেখালাম অলোককে, ধাপ্পাটা কেমনভাবে দেওয়া হয় সেটাও বোঝালাম।
সব শোনার পরে অলোক আমাকে জানালেন, এবার আমি গোলমাল পাকিয়ে দেওয়ায় পুরোপুরি পরিকল্পনা মাফিক চলতে না পারায় ওঁদের অনেক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। আমি সহযোগিতা করলে অলোক খৈতান ও রামচন্দ্র আগরওয়াল পরবর্তী পর্যায়ে ম্যানিলা থেকে দু-জন ফেইথ হিলার নিয়ে আসবেন এবং কলকাতায় এক মাস ধরে দু-জনকে দিয়ে ফেইথ হিলিং করাবেন। আমি সহযোগিতা করলে প্রতিদিন তিনজন রোগীর দেওয়া ফিস আমি পাব। অর্থাৎ প্রতিদিন ১৫ হাজার টাকা। এক মাসে ৪,৫০,০০০ টাকা। এছাড়া আমাকে ম্যানিলায় নিয়েও যাবেন যখন অলোক বা রামচন্দ্র ম্যানিলায় ফেইথ হিলারের সঙ্গে চুক্তি করতে যাবেন। আলোচনা চালিয়ে গেলাম- প্রস্তাবটা আর কত দূর পর্যন্ত ওঠে জানতে। শেষ পর্যন্ত অলোক আমাকে প্রতিদিন দশ জন রোগীর দেওয়া টাকা দেবেন বলে সর্বচ্চ প্রস্তাব দিলেন, অর্থাৎ প্রতিদিন ৫০,০০০ টাকা। তিরিশ দিনে ১৫,০০,০০০ টাকা। আমার কথায়-বার্তায় অলোক যথেষ্ট উৎসাহিত হয়েই অনেক খোলামেলা কথা বললেন, তিনি জানতেন না তাঁর ও আমার কথাগুলো টেপ রেকর্ডারে টেপ হয়ে যাচ্ছে।
২৯ তারিখ অলোক আমার অফিরে ফোন করেন আমার মতামত জানতে। তাঁকে জানাই, পৃথিবীতে চিরকালই কিছু বোকা লোক থাকে যারা অর্থের কাছে নিজেদের বিক্রি করেন না। আমিও এই ধরনেরই একজন বোকা লোক বলেই ধরে নিন। আমি পত্রিকায় আপনাদের ফেইথ হিলিং নিয়ে লিখছি। আমাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করবেন না। গতকাল আপনার সঙ্গে আমার যা কথা হয়েছিল তা সবই টেপ করেছি। ইতিমধ্যে ক্যাসেটের কয়েকটা কপি কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তির হাতে চলে গেছে। আমার কোনও বিপদ হলে তাঁরা ক্যাসেটগুলো হাজির করবেন। টাকার জোরে এদের সকলকেই আপনি কিনে নেবেন ভেবে থাকলে ভুল করবেন, কারণ এঁদের পরিচয়
![](https://bdlibrary.net/wp-content/uploads/2024/03/Capture4-1.png)
রক্ত-ভরা বেলুন অস্ত্রোপচারের মুহূর্তে আঙ্গুলের ফাঁকে যে-ভাবে লুকিয়ে রেখেছিলেন লেখক আপনি কোনও দিনই পাবেন না, আমি ছাড়া আর কেউই জানেন না কার কার কাছে ক্যাসেটের কপি আছে।“
অলোক আমার উপর একটা চ্যালেঞ্জই ছুঁড়ে দিলেন। বললেন, “আপনি কোন পত্রিকায় ছাপবেন? দেখুন আপনার লেখা ছাপান আমি বন্ধ করতে পারি কিনা।“
এর কয়েক দিন পরেই সৌগতের তোলা ফেইথ হিলিং-এর কিছু নেগেটিভ ‘পরিবর্তন’ পত্রিকা অফিসের নেগেটিভ লাইব্রেরী থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে গেল।
১৪ নভেম্বর মহাজাতি সদনের দোতলায় ‘বর্তমান ফিলিপাইন’ বিষয়ক এক আলোচনা চক্রে এবং ২৪ নভেম্বর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফোরাম অফ সাইন্টিফিক ভ্যালুজ’ আয়োজিত এক অলৌকিক-বিরোধী আলোচনা চক্রে ফিলিপিনো ফেইথ হিলারের রহস্য নেগেটিভ-এর রহস্যময় অন্তর্ধান বিষয়ে স্রোতাদের অবগত করি। ১৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে অলোক খৈতানের সহযোগিতা প্রার্থনার ঘটনা উপস্থিত শ্রোতাদের জানিয়ে এই সংগ্রামে প্রয়োজনে আমার ও আমাদের সমিতির পাশে তাঁদের দাঁড়াতে আহ্বান জানাই।
২৪ ডিসেম্বর ৮৬, বুধবার আমার শরীরে অস্ত্রোপচারের সময় সংগ্রহ করা রক্তের ফরেনসিক রিপোর্ট দেখতে পেলাম। তাতে পরিবার বলা আছে, রক্তের নমুনাটি পশুর। রিপোর্টটার কিছুটা অংশ তলায় দিলাম-
Result of Examination
Ruminant animals blood was detected in the stains on ‘A’ (cotton) (Vide the enclosed original report No 2053/MLR dt. 16.12.86 of the Serologist Govt. of India).
Sd/- S. K. Basu
22.12.86
“অলৌকিক নয়,লৌকিক- ২য় খন্ড ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
♦ কিছু কথাঃ যুক্তিবাদ প্রসঙ্গে
একঃ ভূতের ভর
♦ ভূতের ভরঃ বিভিন্ন ধরন ও ব্যাখ্যা
♦ গুরুর আত্মার খপ্পরে জনৈকা শিক্ষিকা
♦ প্রেমিকের আত্মা ও এক অধ্যাপিকা
ভূতে পাওয়া যখন ম্যানিয়াস ডিপ্রেসিভ
♦ সবার সামনে ভূত শাড়ি করে ফালা
♦ গ্রামে ফিরলেই ফিরে আসে ভূতটা
♦ একটি আত্মার অভিশাপ ও ক্যারেটে মাস্টার
দুইঃ পত্র পত্রিকার খবরে ভূত
♦ ট্যাক্সিতে ভূতের একটি সত্যি কাহিনী ও এক সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক
♦ এক সত্যি ভূতের কাহিনী ও এক বিজ্ঞানী
♦ বেলঘরিয়ার গ্রীন পার্কে ভূতুরে বাড়িতে ঘড়ি ভেসে বেড়ায় শূন্যে
♦ দমদমের কাচ-ভাঙ্গা হল্লাবাজ-ভূত
তিনঃ যে ভূতুরে চ্যালেঞ্জের মুখে বিপদে পড়েছিলাম
চারঃ ভূতুরে চিকিৎসা
♦ ফিলিপিনো ফেইথ হিলার ও ভূতুরে অস্ত্রোপচার
♦ ফেইথ হিলার ও জাদুকর পি.সি. সরকার (জুনিয়র)
♦ পরকাল থেকে আসা বিদেহী ডাক্তার
♦ বিদেহী ডাক্তার দ্বারা আরোগ্য লাভ
♦ ডাইনী সম্রাজ্ঞী ঈপ্সিতার ভূতুরে চিকিৎসা
পাঁচঃ ভূতুরে তান্ত্রিক
♦ গৌতম ভারতী ও তাঁর ভূতুরে ফটোসম্মোহন
♦ ভূতুরে সম্মোহনে মনের মত বিয়েঃ কাজী সিদ্দীকির চ্যালেঞ্জ
ছয়ঃ ডাইনি ও আদিবাসী সমাজ
বাঁকুড়া জেলা হ্যান্ডবুক, ১৯৫১ থেকে
♦ ডাইনি, জানগুরু প্রথার বিরুদ্ধে কি করা উচিৎ
♦ ডাইনি হত্যা বন্ধে যে সব পরিকল্পনা এখুনি সরকারের গ্রহণ করা উচিৎ
♦ জানগুরুদের অলৌকিক ক্ষমতার রহস্য সন্ধানে
সাতঃ আদিবাসী সমাজের তুক-তাক, ঝাড়- ফুঁক
♦ ‘বিষ-পাথর’ ও ‘হাত চালান’এ বিষ নামান
আটঃ ঈশ্বরের ভর
♦ ঈশ্বরের ভর কখনো মানসিক রোগ, কখনো অভিনয়
♦ কল্যাণী ঘোষপাড়ায় সতীমা’ইয়ের মেলায় ভর
♦ হাড়োয়ার উমা সতীমার মন্দিরে গণ-ভর
♦ আর একটি হিস্টিরিয়া ভরের দৃষ্টান্ত
♦ একই অঙ্গে সোম-শুক্কুর ‘বাবা’ ও মা’য়ের ভর
♦ অবাক মেয়ে মৌসুমী’র মধ্যে সরস্বতীর অধিষ্ঠান (?) ও প্রডিজি প্রসঙ্গঃ
♦ প্রডিজি কি? ও কিছু বিস্ময়কর শিশু প্রতিভা
♦ বংশগতি বা জিন প্রসঙ্গে কিছু কথা
♦ বিস্ময়কর স্মৃতি নিয়ে দু-চার কথা
♦ দুর্বল স্মৃতি বলে কিছু নেই, ঘাটতি শুধু স্মরণে
♦ মানবগুণ বিকাশে বংশগতি ও পরিবেশের প্রভাব
♦ মানবগুণ বিকাশে পরিবেশের প্রভাব
♦ মানব-জীবনে প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব
♦ মানব-জীবনে আর্থ-সামাজিক পরিবেশের প্রভাব
♦ মানব জীবনে সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রভাব
♦ অবাক মেয়ে মৌসুমীর রহস্য সন্ধানে
♦ বক্সিংয়ের কিংবদন্তী মহম্মদ আলি শূন্যে ভাসেন আল্লা-বিশ্বাসে!