যার বাড়িতে চুরি হয়, সাধারণত তাঁদের পরিবারের কোনও শিশু, কিশোর বা মহিলাকে দেখান হয় নখ-দর্পণ বা নখের আয়না। সেই দর্পণে ফুটে ওঠে চোরের ছবি। এমনকি অনেক সময় নাকি, কেমনভাবে চুরি হয়েছিল, কিভাবে চোর এলো, কিভাবে চোর পালাল, সমস্ত ব্যাপারটাই চলচ্চিত্রের মতই একের পর এক নখের উপর ফুটে ওঠে। পুরো ঘটনাটাই ঘটানো হয় অপ্রাকৃতিক উপায়ে, গুণীন বা ওঝার ‘অলৌকিক’ ক্ষমতায়।

বহু ওঝার নখ-দর্পণ  ক্ষমতার খবর পেয়েছি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই খবর দাতাদের বলেছি, আমি একটা জিনিস লুকিয়ে রাখবো। নখ-দর্পণে ওঝা লুকোন জিনিস বের করে দিতে পারলেই দেবো পঞ্চাশ হাজার টাকা। খবরদাতারা প্রায়শই প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করেছেন। সেই ওঝাকে পরীক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দেবেন কথা দিয়েও কেউ রাখেনি। এখনও আমি সেই একই ভাবে নখ-দর্পণ করতে পারা ওঝার খোঁজে আছি। যে কেউ এমন ওঝা এনে নখ-দর্পণের বাস্তব অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে পারলে ওঝার হাতে তুলে দেব প্রণামীর পঞ্চাশ হাজার টাকা। এটা অতি স্পষ্ট এবং সত্য যে প্রতিটি অলৌকিক ঘটনার মতই নখ-দর্পণের অস্তিত্বও রয়েছে শুধুই গাল-গল্পে ও মিথ্যাভাষণে। এদিকে এখন একটু তাকাই – নখ-দর্পণ ব্যাপারটা কি? সত্যিই কি তাহলে কিছুই দেখা যায় না? নখ-দর্পণ যেভাবে করা হয় তা হল এইঃ যাঁদের বাড়ি চুরি হয়েছে তাঁদের পরিবারের একটি শিশু, কিশোরী একান্ত অভাবে একজন আবেগপ্রবণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন মহিলাকে বেছে নেওয়া হয় মিডিয়াম হিসেবে। মিডিয়ামকে পাশে বসিয়ে ওঝা বাড়ির লোকেদের সঙ্গে কথা বলে সন্দেহভাজন মানুষদের নামগুলো জেনে নিতে থাকে। মিডিয়ামও নিজের অজ্ঞাতে সন্দেহভাজন মানুষগুলো বিষয়ে জেনে নেয়। স্বাভাবিক কারণে সন্দেহভাজন এইসব মানুষগুলোও মিডিয়ামের পরিচিত ব্যক্তিই হয়। কিভাবে চুরি হতে পারে এসব বিষয়েও ওঝা কিছু কথাবার্তা চালিয়ে যায়। তারপর মিডিয়ামের বুড়ো আঙ্গুলে তেল (সাধারণত সরষের তেল) সিঁদুর বা তেল-কাজল লাগিয়ে দেওয়া হয়। চকচকে বুড়ো আঙ্গুলটায় মন্ত্র পড়ে দেওয়া হয়। ওঝা বলতে থাকে, ‘বুড়ো আঙ্গুলে এবার চোরের ছবি ভেসে উঠবে, চোরের ছবি ভেসে উঠবে। একমনে দেখতে থাক, দেখতে পাবে চোরের ছবি। ‘সম্মোহনের মত করেই

নখদর্পণ করা হচ্ছে

মিডিয়ামের মস্তিষ্ককোষে ধারণা সঞ্চার করা হতে থাকে যে চোরের ছবি ভেসে উঠবে। সম্মোহিত করে ধারণা সঞ্চারের মাধ্যমে যে অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটান যায় বা দেখান যায় এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছি ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ -এর প্রথম খন্ডে। তাই আবার এবিষয়ে বিস্তৃত আলোচনায় গেলাম না।

এক সময় সম্মোহনী ধারণা সঞ্চারের ফলে মিডিয়াম বিশ্বাস করতে শুরু করে বাস্তবিকই চোরের ছবি ফুটে উঠবে তার নখে। আবেগপ্রবণতা, বিশ্বাস ও সংস্কারের ফলে এক সময় মিডিয়াম সঞ্চারিত ধারণার ফলে দেখার আকুতিতে অলীক কিছু দেখতে থাকে। এটা মনোবিজ্ঞানের ভাষায় Visual hallucination। মিডিয়াম মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে সন্দেহ ভাজন কোন একজনের অস্পষ্ট একটা ছবি স্পষ্টতরও হয় মস্তিষ্ককোষে ধারণা সঞ্চারের গভীরতার জন্য। কখনো হাতের নখে মিডিয়ামে দেখতে পায় চোরের আসা, চুরি করা এবং পালান পর্যন্ত।

কখনো কখনো নখ-দর্পণের ক্ষেত্রে Visual illusion -হ্যাঁ, ভ্রান্ত দর্শনের ঘটনাও ঘটে। তেল-সিঁদুর নখে মাখিয়ে দেওয়ায় নখটি চকচকে হয়ে ওঠে। অনেক সময় আশেপাশের মানুষজন, গাছপালা ইত্যাদির ছবি অস্পষ্টভাবে চকচকে নখে প্রতিফলিত হয়।

অস্পষ্টতার দরুন দড়িকে সাপ ভাবার মতই প্রতিফলিত অস্পষ্ট ছবিকেই চোরের ছবি বা চুরির ঘটনার ছবি বলে মিডিয়াম বিশ্বাস করে নেয়।

যেহেতু সন্দেহভাজন একজনের কথাই মিডিয়াম বলে, তাই তার ঘোষিত মানুষটি চোর হতেও পারে। চোর না হলেও চুরি করেছে এমন স্বীকারোক্তিও প্রহার থেকে বাঁচতে যে দিতেই পারেন, সে বিষয়ে আগেই যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে।

error: Content is protected !!