গত শতকের তিনের দশকে কলকাতায় একটি বাঙ্গালী মেয়েকে নিয়ে দস্তুরমত হইচই পড়ে গিয়েছিল। মেয়েটি নাকি জাতিস্মর। পত্র-পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হল। মেয়েটি জানিয়েছিল, পূর্বজন্মে সে কলকাতা থেকে বহুদূরে একটি অখ্যাত পল্লীগ্রামে থাকত। মৃত্যু হয়েছিল জলে ডুবে। মেয়েটি তার পূর্বজন্মের নাম, বাবার নাম, ও গ্রামের নাম জানিয়েছিল। জলে ডুবে যাওয়ার ঘটনাটির একটা মোটামুটি বিশদ বিবরণ দিয়েছিল। মেয়েটির বাবা-মা স্পষ্টতই জানিয়েছিলেন, তাঁরা কেউ কোনও দিনই ওই গ্রামে যাননি। এমনকি ওই গ্রামের নাম পর্যন্ত শোনেননি। না, মেয়েটি তার পূর্বজন্মের বাবার যে নাম বলেছে তাঁর সঙ্গে কোনও রকম পরিচয় বা যোগাযোগ মেয়েটির পরিবারে সঙ্গে ছিল না। সত্যিই আশ্চর্য ব্যাপার! ওইটুকু মেয়ে কিভাবে বানিয়ে বানিয়ে বলেছে?
সত্য যাচাই করতে কলকাতা থেকে উৎসাহী সাংবাদিক গেলেন গ্রামটির সন্ধানে। আরও অনেক বিস্ময় সাংবাদিকটির জন্য অপেক্ষা করছিল। সত্যিই ওই নামের গ্রাম খুঁজে পেলেন। জানতে পারলেন, মেয়েটি পূর্বজন্মের যে নামটি জানিয়েছিল সেই নামের একটি লোক ওই গ্রামেই থাকত এবং পনেরো বছর আগে মারা যায় জলে ডুবেই। মৃতের বাবার নামও – মেয়েটি যা বলেছিল তাই।
মেয়েটির ক্ষেত্রে এমন ঘটনা কেন ঘটল? যতদূর জানা যায় তাতে প্রায় নিশ্চিতভাবেই সাংবাদিকেরা একথা বলতেই পারেন, বালিকাটির বিষয়ে মৃত মানুষটির বিষয়ে এত কিছু জানার সম্ভাবনা ও সুযোগ ছিল না। আর ঘটনাটাও এমন টাটকা নয় যে, পত্রিকায় মৃত্যুর খবরটা পড়ে ছিল।
মনোবিজ্ঞানী বা মনোরোগ চিকিৎসকরা জন্মান্তরকে অস্বীকার করার তাগিদে অবশ্য জোর করে একটা তথ্য হাজির করার চেষ্টা করতে পারেন – মেয়েটি জলে-ডোবা মানুষটির বিষয়ে শুনেছিল এবং দুর্ঘটনার খবরটি তাকে আকর্ষণ করেছিল, ফলে মেয়েটির চিন্তায় ঐ মৃত মানুষটি বারবার হানা দিত। বালিকার কল্পনাপ্রবণ, আবেগপ্রবণ মনে স্থিতিস্থাপকতা ও সহনশীলতা কম থাকার দরুন কল্পনাবিলাসী মন এক সময় ভাবতে শুরু করে আমিই সেই মৃত মানুষটি। এই ভাবনাই কোন এক সময় বিশ্বাসে রূপান্তরিত হয়। মনোবিজ্ঞানীদের এমন ব্যাখ্যার পেছনে জানার সুযোগ চাই। এক্ষেত্রে সে সুযোগ তো অনুপস্থিত। অতএব?
এই জাতিস্মর রহস্য সন্ধানের জন্য ডাঃ গিরীন্দ্রশেখর বসু-কে অনুরোধ করেন একটি সংবাদপত্র। ডাঃ গিরীন্দ্রশেখর বসু ভারতে মনোরোগ চিকিৎসা এবং মনোসমীক্ষণের অন্যতম পথিকৃৎ। ডাঃ বসু ঘটনাটির কারণ বিশ্লেষণের জন্য বালিকাটিকে পর পর ক’দিন পরীক্ষা ও মনঃসমীক্ষা করেন।
একদিনের ঘটনা ডাঃ বসু মেয়েটিদের বৈঠকখানায় বসে আছেন। হঠাৎই চোখে পড়লৈ ঘরের আলমারিতে কতকগুলো পুরোনো বাঁধানো সাময়িকী ও পত্রিকার ওপর। আলমারি খোলা। সময় কাটাতে, নিছকই খেয়ালের বশে বাঁধানো সাময়িকীগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগলেন, পাতা উল্টাতে লাগলেন। একটা সাময়িকীর একটা পৃষ্ঠায় এসে ডাঃ বসু উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। ঐ পৃষ্ঠাতেই জনৈক গ্রামীণ সংবাদদাতা একটি জলে ডোবার কাহিনী জানিয়েছেন। গ্রামের নাম, মৃতের নাম ও তার বাবার নাম ও বিস্তৃত ঘটনাটি পাঠ করতে করতে পনের বছরের পুরনো। মেয়েটি যে ডাঃ বসুর মতোই কোনও এক অবসর সময়ে বাঁধানো বইগুলো টেনে নিয়ে পড়তে পড়তে এই ঘটনাও পড়ে ফেলেছিল এতে আর কোনও সন্দেহ নেই। তারপর ঐ ঘটনা নিয়ে ক্রমাগত ভাবতে ভাবতে অবচেতন মনে সেই জলে ডোবা মানুষটির সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে নিয়েছিল।
ডাঃ বসু মেয়েটিকে ঐ পৃষ্ঠাটি দেখানোর পর মেয়েটির স্মৃতি ধীরে ধীরে ফিরে আসে। ও জানায় লেখাটি আগে পড়েছিল। তবে লেখাটি পড়ার কথা ভুলে গিয়েছিল মনে ছিল শুধু ঘটনাটি। তাই এতোদিন অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুল বলেছিল – জলে ডোবার ঘটনাটি শোনেনি। মেয়েটি ডাঃ বসুর আকস্মিকভাবে পাওয়া যোগসূত্রের কল্যাণে ‘জাতিস্মর’ নামক মানসিক রোগী হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যায়।
তবে স্বভাবতই সব সময় এমন আকস্মিক যোগাযোগ অনুসন্ধানীদের নাও জুটতে পারে। এই না জোটার অর্থ এই নয় যে, জাতিস্মরের বাস্তব অস্তিত্ব সম্ভব।
(জাতিস্মর নিয়ে আরও বহু ‘কেস-হিস্ট্রি’ ও সেসব নিয়ে বিস্তৃত অনুসন্ধান পাবেন ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ গ্রন্থের ৪র্থ খন্ডে।)