কালীচরণ মুর্মু জগমাঝি। এই  নামের পরিচিত গুণীন কালীচরণ। ‘জগমাঝি’ কালীচরণের উপাধি নয়। ‘জগমাঝি’ সাঁওতাল সমাজের নৈতিকতার রক্ষক ও সমাজের অন্যতম প্রধান। গুণীনের অভ্রান্ত গণনার কথা শুনে প্রতিদিন অনেকেই আসেন। কেউ আসেন হারানো গরু, চুরি যাওয়া জিনিস-পত্তরের খোঁজে, কেউ বা আসেন নিখোঁজ আপনজনের হদিশ জানতে। গুণীনের টানে আসা মানুষজন সাধারণত নদীয়া ও তার আশেপাশের জেলার মানুষ। ট্রেনে এলে নামতে হয় মদনপুর-এ। ছোট স্টেশন। স্টেশনের বাইরে মিলবে রিক্সা ভ্যান। ভ্যানে পনের মিনিটের পথ জঙ্গল গ্রামের মোড়। সেখানে নেমে জিজ্ঞেস করলেই লোকে দেখিয়ে দেবে কালীচরণের বাড়ি। মাটির দেওয়াল, খড়ের ছাউনি। কালীচরণের বয়স ষাটের ধারে কাছে। বয়সের ঠাওর মেলবে না শরীরে। কাজ করতেন কল্যাণীর স্পিনিং মিলে। অবসর নেওয়ার পর পুরো সময়ের গুণীন। ওর তুক-তাক, ঝাড়ফুঁক, গোনার ক্ষমতায় বিশটা গাঁয়ের লোকের তরাস লাগে।

তরাসের হাওয়া লাগেনি সম্ভবত মদনপুরের কিছু এঁচোড়ে পাকা দামাল ছেলে-মেয়েদের। এঁদের জাতপাতের বালাই নেই, ঈশ্বর-আল্লা না মেনেও এরা বুক ঠুকে বলে, আমার সাচ্চা-ধার্মিক। এমনি দুটি ছেলে ভানু হোর রায় আর রেজাউল হক গিয়েছিল গুণীনকে কিঞ্চিৎ বাজিয়ে বাবু মশাইরা কদিন আগেও বড়ই ব্যস্ত ছিলেন দুর্গাপুজো, কালীপুজো নিয়ে। কালীঠাকুরকে জলে ডুবিয়েই বাবুদের ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে ধর্ম-উন্মাদনার হাত থেকে দেশ উদ্ধারে। জঙ্গলগ্রাম অবশ্য এসব নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না। ‘রাম-বাবরি’র বিষের হলক্যা নানা বাঁক ঘুরে এখানে পৌঁছোবার আগেই ঝিমিয়ে পড়েছে।

চির, রেজাউল, কালীচরণ, মুর্মু ও ভানু

গুণীন কালীচরণ গুণে-গেঁথে রেজাউল আর ভানুর আসার উদ্দেশ্য বের করে ফেলেছিলেন। বললেন, ‘তোমরা এসেছ কেন, জানি। তোমাদের গ্রামে একটা গণ্ডগোল বেঁধেছে তাই…’

‘উঁহু, সে জন্যে তো আসিনি। আর আমাদের গ্রামে গণ্ডগোলও কিছু বাধেনি।‘

গুনীণ ওদের এমন বেখাপ্পা কথায় চটলেন,

বললেন, ‘আমার ক্ষমতায় সন্দো? তোমাদের ভাল হবে না। আমি যদি তোমার চারপাশে গণ্ডি কেটে দিই, সে গণ্ডি আমি না কাটান দিলে পেরোতে পারবে? পিঁড়িতে বসিয়ে মন্ত্র পড়ে দিলে পিঁড়ি পাছায় এমন সেঁটে যাবে, তখন বুঝবে সন্দো করার মজাটা।‘

ভানুও ঝপাং করে তেতে গেল। বলল, ‘বেশ তো গণ্ডি কেটে আমাকে বন্দী করুন তো! আজই করে দেখাতে পারলে পাঁচ’শ টাকা দেব। আর যদি কয়েকটা দিন পরে দেখান- পঞ্চাশ হাজার দেব।‘

‘তোমাদের দেখছি বড় চ্যাটাং-চ্যাটাং কথা, বড় টাকার গরম! পুঁইচচ্চরি চিবোন চেহারা আর মুখে পঞ্চাশ হাজারের গপ্পো। বোঙ্গা ক্ষেপলে ও সব বুকনি ঠান্ডা মেরে যাবে।‘

রেজাউল সামাল দিল, ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির নাম শুনেছেন, আমরা সেই সমিতিরই ছেলে। যারা আপনার মত ক্ষমতার দাবি করে, তাদের দাবি সত্যি কি মিথ্যে, পরীক্ষা করি আমরা। কি সব যুগ পড়েছে, ‘ঠগ বাছতে গাঁ-উজাড়’। পরীক্ষা না করে কারও দাবি মান্য কি উচিৎ? আপনিই বলুন না?’

কালীচরণ জুলজুল করে রেজাউলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর সুর নামিয়ে বললেন, ‘আসল কথা কি জান, গণ্ডি দিতে অনেক হ্যাঁপা। অনেক জিনিস-পত্তর যোগাড় করতে হয়। এই বয়সে তোমাদের জন্যে এতো হ্যাঁপা তুলতে পারব না।‘

ভানু, রেজাউল অত সহজে ছাড়ার পাত্র নয়। ভানুর নাছোড়বান্দা আবদার, ‘তাহলে মন্ত্রে পিঁড়ি সাঁটাটা অন্তত দেখান। এত নাম-ডাক আপনার, শুনেছি বোঙ্গার কৃপায় আপনি তুক-তাক, রোগ চালান, ঝাড়-ফুঁকে অনেক অসম্ভব সম্ভব করেন। আমাদের ওই পিঁড়ির ব্যাপারটা দেখাতেই হবে।‘

কালীচরণ নরম হলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে, আক্ল সকালে এসো।‘

সকালে দুজনের বদলে সমিতির আটজন হাজির হল কালীচরণের আস্তানায়- তবে নানা দলে ভাগ হয়ে আলাদা আলাদা ভাবে। তারপর কি ঘটেছিল, শোনা যাক মদনপুর শাখার সম্পাদক চিররঞ্জন পালের কাছ থেকেই। ‘আমার সঙ্গী ছিল অসীম। সাহসী, বেপরোয়া অসীম আমারই মত তরুণ এবং সমিতির পুরো সময়ের কর্মী। মুখে যতদূর সম্ভব চিন্তার ভাব ফুটিয়ে কালীচরণকে বললাম, ‘বড় একটা সমস্যা নিয়ে এসেছি, আপনাকে সমাধান করে দিতেই হবে।‘

জগমাঝি কালীচরণ আমাদের অপেক্ষা করতে বলে উঠে গিয়ে নিয়ে এলো দশ-বারোটা সবুজ কাঁঠাল পাতা। হাঁক পাড়তেই একটি ছোট মেয়ে একটা তেলের শিশি দিয়ে গেল, সঙ্গে কিছু কাঠি। জগমাঝি বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছিল আর একটা করে কাঁঠাল পাতা তুলে নিয়ে তাতে দু-ফোঁটা তেল ছিটিয়ে পাতাটা ভাঁজ করে একটা করে কাঠি গুঁজে দিচ্ছিল এ-ফোঁড়, ও-ফোঁড় করে।

আমাকে নিয়ে এই মুহূর্তে আমাদের সমিতির আট জন সদস্য এখানে আছি। ভানু রেজাউলও এসেছে। সম্ভবত তথাকথিত কোনও অলৌকিক ক্ষমতা দেখিয়ে ভানু, রেজাউলকে অবাক করে দিয়ে পিঁড়ি আটকানর চ্যালেঞ্জটা এড়াতে চায় বলেই ভানুরা আমার আগে আসা সত্ত্বেও আমার সমস্যা নিয়ে গুণতে শুরু করলো কালীচরণ।

ছটা পাতায় তেল দিয়ে ভাঁজ করে কাঠি গুঁজে রেখে করলো নানা অঙ্গভঙ্গি করে বেজায় রকম মন্ত্র পড়া। এক সময় একটা পাতা তুলে নিয়ে কাঠি খুলে ফেলে পাতাটার ভাঁজ খুলে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সেদিকে। একটু পরে বললো, ‘তুমি যার জন্যে এসেছ সে মেয়ে।‘

বললাম, ‘না, সে তো মেয়ে নয়।‘

জগমাঝি এবার আর একটা পাতা তুলে নিল। পাতা খুলে তেল পড়া দেখে বললো, ‘যার জন্য এসেছো সে একটা বাচ্চা ছেলে।‘

বললাম, ‘না, সে তো বাচ্চা ছেলে নয়।‘

জগমাঝি এবার তৃতীয় পাতা তুলে নিল, ‘তার পেটে ব্যথা হয়।‘

বললাম, ‘ব্যথাটা পেটে তো নয়, বুকে।‘

জগমাঝি ওই তৃতীয় পাতাটার দিকেই আবার কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘বুকের ব্যথাটা ওই পেটের জন্যেই। ডাক্তার দেখাচ্ছো। ওষুধ খাওয়াচ্ছো, তাও ভাল হচ্ছে না। ওষুধে ভাল হবে না। খারাপ হাওয়া লেগেছে। ঝাড়তে হবে। রোগীকে নিয়ে এসো ঝেড়ে দেব।‘

ব্ললা, ‘রোগীর এত বয়শ হয়েছে, রোগে ভুগেও কাহিল, নিয়ে আসাটাই সমস্যা।‘

আবার পাতার দিকে দৃষ্টি মেলে দিয়ে একটু পরেই আমাকে বলল, ‘হ্যাঁ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি বুড়ো, খুব বুড়ো। ও তোমার কে হয়?’

বললাম, ‘ঠাকুরদা’।

‘হ্যাঁ, ঠিক ঠিক। এখন খুব কষ্ট পাচ্ছে। বুক চেপে ধরে রয়েছে। বাড়ি ফিরে ঠাকুরদাকে জিজ্ঞেস করো, ঠিক এই সময় বুকে ব্যথা উঠেছিল কি না, তাইতেই আমার ক্ষমতা বুঝতে পারবে।‘ ভানু প রেজাউলের দিকে চেয়ে বলল, ‘তোমরাও যাও না কেনে ওর সঙ্গে। গেলেই বুঝতে পারবে আমি জগমাঝি ঠগ কি গুণীন।‘

জগমাঝি কি ঠগ? সে উত্তর আমাদের পাওয়া হয়ে গিয়েছিল। ঠাকুরদা মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর। কিন্তু সে প্রসঙ্গ ওখানে তুললাম না, জগমাঝির মিথ্যাচারিতা ধরতে আমি যে অভিনয়ের আশ্রয় নিয়েছিলাম, সেটা উপস্থিত অন্ধ-বিশ্বাসী ভক্তরা কিভাবে নেবে- এই ভেবে। ওর মিথ্যাচারিতার মুখোশ অন্য ভাবে খোলাটাই এক্ষেত্রে শ্রেয়। আর সেই শ্রেয় পথটিই অবলম্বন করলো ভানু। ভানু বলল, ‘আজ কিন্তু আমাদের দুজনকে আসতে বলেছিলেন। আপনি আমাদের দুজনের যে কোনও এক জনকে পিঁড়িতে বসিয়ে মন্ত্র পড়ে পিঁড়ি পেছনে আটকে দেবেন বলেছিলেন। এখন দিন। আপনি পারলে গুণে গুণে পাঁচশো টাকা দিয়ে যাব।‘

হাঁসলো জগমাঝি, ‘কেউ টাকার লোভ দেখালেই কি ক্ষমতা দেখাবে হবে? আমি বা আমার বোঙ্গা কি তোমাদের জন-খাটার মানুষ যে, তোমরা বললেই দেখাবো?’

অক্ষমতা এড়াবার কু-যুক্তিটা ভালই রপ্ত করেছে জগমাঝি ওরফে ঠগমাজি।

প্রসন্ন হাঁসিতে মুখ ভরিয়ে জগমাঝি উপস্থিত দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘পরীক্ষা নেওয়ারও নিয়ম-কানুন থাকে। এই যে ছেলেটির ঠাকুরদার বুকে ব্যথার কথা গুণে বলে দিলাম, সত্যিই কি মিথ্যে খোঁজ নিয়ে এসে না ক্যানে। হারানো জিনিসের খোঁজ চাইতে, গুণে বলে দিতাম।‘

কথাটা শেষ করতেই ভানু বলল, ‘আমার একটা কলম হারিয়েছে, দামী কলম, মনে হয় চুরি করেছে আমারই কোনও বন্ধু। গুণে বের করে দিলে প্রণামী দেব।‘

আবার কাঁঠাল পাতা এলো, তেল ছিটিয়ে আগের মতই মন্ত্র পড়ে পাতা খুলে তেল পড়া দেখে জগমাঝি বলল, ‘হুঁ চিনের কলম।‘

ভানু বলল, ‘না, জাপানের।‘

‘ওই হল। আচ্ছা, তুমি কি পেনটা নিয়ে বাজারে বা দোকানে গিয়েছিলে?’

‘হ্যাঁ, তা গিয়েছিলাম। এখন মনে পড়ছে দোকানে কমলটা দিয়ে লিখেছি, পকেটে পুরেছি কি না, মনে পড়ছে না।‘

জগমাঝি আর একটা পাতার তেলপড়া দেখে বলল, ‘ওই দোকানের মালিকের কাছেই আছে।‘

‘পেনটা ফেরৎ যাতে পাই, তার ব্যবস্থা করে দেন।‘

‘কলমটা কার আছে, বলে দিয়েছি। দোকানদারকে চাপ দিলে ফেরৎ পেতে পার। কিন্তু সে যদি ফেরৎ না দেয়, অস্বীকার করে, তা আমি কি করবো? প্রণামী তিনটে টাকা আর তেল পড়ার জন্য যা খুশি দিয়ে যাও।‘ এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমিও প্রণামী তিনটে টাকা আর তেল পড়ার জন্য যা খুশি নামিয়ে রাখ।‘

বললাম, ‘ঠিক উত্তর দিলে নিশ্চয়ই প্রণামী দিতাম। কিন্তু প্রথম থেকেই তো দেখচি, আপনি সব উল্টোপাল্টা বলে যাচ্ছেন। না আমারটা বলতে পেরেছেন, না বলতে পেরেছেন ওঁর কলমের ব্যাপারে কিছু।‘

জগমাঝি কালীচরণ বোধহয় নিজের বর্তমান অবস্থা ও আমাদের উপস্থিতির মধ্যে কোনও পরিকল্পনা সম্ভাবনা অনুমান করে হঠাৎ কেমন চুপ মেরে গেল। তার চোখ দুটোতে একবারের জন্যেও জ্বলে উঠলো না চুয়াড় বিদ্রোহের আগুন, বরং চোখ দুটোয় আমানির ছলছল নেশা।

আমার ঠাকুরদার বুকে ব্যথার মতোই কলম হারানোর ব্যাপারটাও ছিল পুরোপুরি কাল্পনিক।

error: Content is protected !!