এবার যে ঘটনাটার কথা বলছি, সেটা ঘটেছিল খড়্গপুর স্টেশনে। তখন আমি নেহাতই বালক। ইন্দার কৃষ্ণলাল শিক্ষানিকেতনে পড়ি। রাম নবমীতে ট্রাফিক সেটেলমেন্টের লাগোয়া ‘বড়া লাইট কা নীচে’ জি.ভি. রাওয়ের ম্যাজিক দেখি। ক্লাসে টিচার শুভেন্দু রায়ের কাছে গল্প শুনি, শোষক আর শোষিতদের। পাঁচ ভাই-বোনের সংসারে বেড়ে উঠছি আগাছার মতোই। খেলা বলতে ছিল সুশীল রায়চৌধুরীর ওখানে বক্সিং শেখা, আর নেশা বলতে অলৌকিক শক্তির খোঁজে সাধুসন্ত-পীরদের পেছনে দৌড়নো। তখন এই সব অলৌকিক-বাবাদের ভিড়ও থাকত বটে খড়্গপুরে। জানি না এখন কেমন। গুরুজি বাবাজি আর পীরদের রমরমা এবং অন্ধ সংস্কারে পাকখাওয়া মানুষের ভিড়ে বহু জাতি, বহু ভাষা-ভাষীদের শহর খড়্গপুর সব-সময় যেন ভাবাবেগে ভেসে যেত। কখনো শুনতাম কাকে না কি মা শীতলা ভর করেছে, কখনো শুনতাম পাড়ার কোন মহিলা মা মনসার আশীর্বাদ পেয়ে স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ দিচ্ছে। কখনো বা কারও বাড়ির গুরুদেব শূন্যে হাত ঘুরিয়ে পেঁড়া এনে আমাকে খাইয়েছেন। ওই বয়েসেই আমিও শূন্যে হাত ঘুরিয়ে পেঁড়া এনে বন্ধুদের খাওয়াতাম। পনেরোই আগস্ট বন্ধুরা মিলে ত্রিপল টাঙ্গিয়ে মঞ্চে ম্যাজিক দেখাতাম। ম্যাজিক দেখে কেউ কেউ মেডেল দেওয়ার মিথ্যে প্রতিশ্রুতিও ঘোষণা করতেন স্টেজে। এমনি একটা সময় হঠাৎই এক পীরের অলৌকিক ঘটনা গোটা খড়্গপুর নাড়িয়ে দিল। ঘটনাটা নিজের চোখে দেখিনি, শুনেছিলাম।
এক পীর ট্রেনে উঠেছিলেন টিকিট ছাড়াই। পরনে বহু রঙ্গিন তালিতে রঙ্গমঞ্চে আলখাল্লা আর গলায় নানা ধরনের পাথর ও পুঁতির মালা। মাথা ভর্তি বড় বড় চুল আর মুখ ভর্তি কাঁচা-পাকা দাড়ি-গোঁফ। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান টিকিট চেকার বিনা-টিকিটের ফকিরটিকে পাকড়াও করে নামিয়ে দিলেন। ফকির রাগে ফুঁসতে লাগলেন। বিড়বিড় করে কি সব বলে শূন্যে হাত দুলে ট্রেনের ইঞ্জিন লক্ষ্য করে অদৃশ্য কিছু একটা ছুঁড়ে মারতে লাগলেন।
খড়্গপুর খুবই বড় জংশন স্টেশন। ট্রেন এলে প্লাটফর্মের ভিড় যেন উপচে পড়ে। ভিড়ের একাংশ ফকিরের অদ্ভুত কান্ড-কারখানা দেখে তাঁকে ঘিরে দাঁড়াল।
ট্রেন ছাড়ার ঘণ্টি পড়ল, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান গার্ড সবুজ ফ্ল্যাগ নাড়াতে নাড়াতে হুইসিল বাজাল। ইঞ্জিন সিটি দিল, কিন্তু আশ্চর্য, ট্রেন নড়ল না। ইঞ্জিন ঘন ঘন সিটি বাজায় কিন্তু ট্রেন আর এগোয় না। গার্ড সাহেব ব্যাপার দেখতে নিজেই এগিয়ে এলেন ড্রাইভারের কাছে। দেখলেন, ড্রাইভার খুটখাট করে ইঞ্জিনের মেশিন-পত্তর নাড়াচাড়া করছে, সাহায্য করছে খালাসি। গার্ড সাহেব হিন্দিতেই প্রশ্ন করলেন, “কি হল? ইঞ্জিন বিগড়েছে?”
খড়্গপুরের দক্ষিণ ভারতীয় ড্রাইভার উত্তর দিলেন, “ইঞ্জিন তো ঠিকই আছে, কিন্তু গাড়ি চলছে না।“
লোকো-শেড থেকে মিস্ত্রী এলেন, কিন্তু কিছুতেই ইঞ্জিন থামার রহস্য খুঁজে পাওয়া গেল না।
কয়েক মুহূর্তে গোটা স্টেশন চত্বরে রটে গেল ফকির সাহেব ট্রেন আটকে দিয়েছেন। অন্য প্লাটফর্ম থেকেও লোক আসছে এই অলৌকিক ঘটনা ও ফকিরকে দেখতে। খবরটা ড্রাইভার ও খালাসির কানেও গেছে। তাঁরাই শেষ পর্যন্ত ফকিরের শেষ পর্যন্ত ফকিরের কাছে নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইলেন। ফকির একটি শর্তে রাজি হলেন। তাঁর ইচ্ছাশক্তিতে তুলে নিতে, সেই টিকিট-চেকারকে এসে ক্ষমা চাইতে হবে।
জনতার চাপে এবং ফকিরের অলৌকিক ক্ষমতা দেখে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান টিকিট-চেকার সুড়সুড় করে এসে ক্ষমা চেয়ে কফিরকে ট্রেনে বসিয়ে দিলেন। ফকির প্রসন্ন হলেন। এবার গাড়ি চলল। ঘটনাটি জনপ্রিয়তা পেল। কিছুদিন সর্বত্রই ওই আলোচনা। আমি কিন্তু অন্য কথা ভেবেছিলাম সেদিন। ড্রাইভার ফকিরের চেনা লোক নন তো? সেই সঙ্গে লোকো-শেডের মিস্ত্রি! যেমনটি ম্যাজিক দেখাবার সময় আমার বন্ধুরাও দর্শক সেজে বসে থাকে।