পরদিন রাতের লঞ্চে ছাপানো অপূর্ণ প্রিন্টগুলি ঢাকার বর্ণমিছিল প্রেসে পাঠিয়ে দেয়া হল। প্রেসের মালিক তাজুল ইসলাম সাহেব অধ্যাপক শরফুদ্দিন রেজা হাই এবং আমার বিশিষ্ট শুভাকাংখী এবং হৃদয়বান বন্ধু। আমাদের সুবাদে বইয়ের বাকী অংশগুলো ছেপে বাঁধাইয়ের বন্দোবস্ত করে দিলেন।

আরজ আলী মাতুব্বর সাহেব চল্লিশখানা বাঁধাই করা বই নিয়ে বরিশালগামী একটি বৃহদাকার লঞ্চে উঠলেন। দোতলার পাটাতনে একজন প্রবীণ ভদ্রলোক ঘুমোবার আয়োজন করছে। তখন ভরদুপুর। মাতুব্বর সাহেব বইগুলো তাঁর হাওলায় রেখে খাওয়ার জন্যে নীচে গেলেন। হোটেল থেকে ফিরে এসে দেখেন বইয়ের বোঁচকাটি নেই। রসিক চোর মনে করেছিল দামী কাপড়ের বান্ডিল। মাতুব্বর সাহেব আবার ফিরে গেলেন এবং কোনমতে পনের কপি বই বাঁধিয়ে সঙ্গে নিয়ে বরিশাল ফিরলেন।

প্রথমে আমার বাসায় এসে এক কপি বই আমাকে উপহার দিলেন। পরে আমরা দু’জন কাজী সাহেবের বাসায় গেলাম। কাজী সাহেব বই হাতে পেয়ে বেজায় খুশি হলেন, মাতুব্বর সাহেবকে অকুন্ঠ অভিনন্দন জানালেন। আদর করে আমার কাঁধে হাত বুলিয়ে দিলেন। সময়টা উনিশশ’ তিয়াত্তরের দোসরা ডিসেম্বর।

আরজ আলী সাহেবকে আমরা দু’জন প্রস্তাব দিলাম-ঢাকায় কাকে কাকে বই উপহার দিতে হবে। এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বনেরও পরামর্শ দেয়া হল।

চুয়াত্তরের কোন এক সময় মাতুব্বর সাহেবকে স্থানীয় একটি মাদ্রাসার কিছু ছাত্র জোর করে রিক্সায় তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। তারা কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার ছলে মাতুব্বর সাহেবের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানোর মতলব আঁটছিলো। অন্তত মাতুব্বর সাহেবের তাই ধারণা হয়েছিল। এমন সময় কাজী সাহেবের ছোট ভাই কাজী শামসুল হুদা দূর থেকে দেখতে পেয়ে বাঁশের লাঠি যোগাড় করে  জোব্বাধারীদের ভাগিয়ে দিলেন, আর বলতে লাগলেন, একাত্তরে একবার জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেশ ছারখার করেছিস, এখন আবার বেড়িয়েছিস!

কাজী শামসুল হুদা এবং আমরাও লক্ষ্য করিনি যে, ধর্ম নিরপেক্ষ দেশে হিন্দু-মুসলমান কে কত জোরেশোরে ধর্মকর্ম করতে পারে তারই প্রতিযোগিতায় নেমে গেছি। দুর্গাপূজা-সরস্বতীপূজার ধুমধারাক্কার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাস্তার মাঝখানে ঘোড়ার লাদি ও গোবর পরিষ্কার করে শামিয়ানা টাঙ্গিয়ে মহাধুমধামের সঙ্গে সিরাত ও কিরাত মাহফিল অনুষ্ঠান শুরু করে দিয়েছি। সরকারী উদ্যোগে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ইসলামী সম্মেলন সংস্থায় জাতীয় নেতার সগৌরব উপস্থিতি আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতায় নতুন মাত্রা যোগ করে বুকের ভেতরটায় কাঁপুনি ধরিয়ে দিল।

মাতুব্বর সাহেবকে বিপজ্জনক এলাকাগুলো পার করে দেয়ার জন্যে কামাল নামক যে ছেলেটিকে মোতায়েন করেছিলাম, সেই ছেলেটি একদিন সটকে পড়লো। ছেলেটিকে প্রথম যখন অনুরোধ করেছিলাম তখন সে বলেছিল, স্যার, চিন্তা করবেন না। ওনাকে আমার বাপ-চাচা সবাই চেনেন। আপনার আর কাজী স্যারের বন্ধু। কার বাপের সাধ্য তাঁর গায়ে হাত তোলে। বলেই সে যে-অস্ত্র বের করে দেখালো, তাতে আমি আঁতকে উঠলাম। বেশ কিছুদিন পর তাঁর সাথে দেখা হলে বলল, স্যার, তাঁর মতবাদের সাথে আমাদের ধর্মীয় মতবাদের মিল নেই। তাছাড়া বাড়ির সবাই তাঁর সাথে মেলামেশা করতে বারণ করেছে।

আরজ আলী মাতুব্বরকে আবার আড়াল করতে সচেষ্ট হলাম, স্যারের কাছে একটু লজ্জাও পেলাম। মনে হল সব কিছুর জন্য আমিই দায়ী। আল আমিন প্রেসের মালিকের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি বললেন, প্রেসের টাকার চিন্তা করবেন না-শুধু আপনারা সাবধান থাকবেন।

মাতুব্বর সাহেব শহরে আসা-যাওয়া কমিয়ে দিলেন। মানুষের কাছে আরজ আলী মাতুব্বর আর ‘ঘোড়ার লাদি ও গোবর’ পরিষ্কার করার চেয়ে খাদ্যবস্তু অধিকতর আকর্ষণীয় হয়ে উঠছিলো। মাতুব্বর এ যাত্রা রক্ষা পেলেন।

এম. এ. নূর সাহেব যে কারণে বরিশাল গিয়েছিলেন, আমিও সেই একই কারণে বরিশাল গিয়েছিলাম – অর্থাৎ কারণটা বৈষয়িক। তবে পার্থক্য এখানে, আমি চাকুরী করতে গিয়েছিলাম, তিনি চাকুরী না করতে গিয়েছিলেন। তিনি আয়কর বিভাগে ডাক সাইটে উকিল- স্বাধীন ব্যবসা। এখানে থেমে থাকলে জগত সংসারের পক্ষে তাঁর আরো কিছু ‘দোষ’ ছিল। সেই ‘দোষ’ গুলো তাঁকে সাধারণ একজন আইনজ্ঞ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছে। তিনি অক্লান্ত পাঠক, সংস্কৃতিসেবী, হৃদয়বান, বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্ব। ঢাকা থেকে যে কোন বড় শিল্পী বরিশাল গেলে তাঁর আতিথিয়েতা গ্রহণ করতেন বলে আমাদের কাছে খবর আসত- মায় আমানত আলী-ফতেহ আলী, নাজাকাত আলী- সালামত আলী তাঁর বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। সকল শিল্পের গভীরে পৌঁছে অনুধাবন করার তাঁর আশ্চর্যজনক ক্ষমতা আছে। নূর ভাইয়ের বন্ধুত্ব কামনা করতাম আন্তরিকভাবে।

একদা সেই সুযোগ ঘটে গেলো। শাহেদা নূর ভাবী বাংলা বিভাগে এম. এ. প্রথম পর্বে ভর্তি হয়ে গেলেন। তাঁকে আমরা সবাই বয়োজৈষ্ঠের কারণে সাধারণ ছাত্রী ভাবতাম না- বরং শ্রদ্ধা করতাম। অন্যান্য ছাত্রছাত্রী এবং বয়োকনিষ্ঠ শিক্ষকরা তাঁকে তমিজ করতেন।

তিনি এসে বললেন, আপনার বন্ধু নূর সাহেবের বসন্ত হয়েছে। মনে মনে ভাবলাম, তৌবা, এই বয়সে বসন্ত! তা মনের হোক আর দেহের হোক, বসন্তমাত্রই রোগ এবং ছোঁয়াচে।

অসুস্থ নূর ভাইয়ের পাশে বসে বললাম, যার মনে এবং দেহে চিরবসন্ত বিরাজমান, তাঁর আবার বিজ্ঞাপ্তি দেয়া বসন্ত কেন! তাঁকে ভরসা দিয়ে বললাম- হাম, বসন্ত, হোস্টেলের সুপার এবং কলেজের অধ্যক্ষ একবার হয়ে গেলে ভবিষ্যতের জন্য আর ভয় থাকে না। তিনি বললেন, মশারির তলে শুয়ে, নিমপাতার ডাল দিয়ে বাতাস করে আর সময় কাটে না। বইটই কিছু থাকলে দিয়ে যাবেন।

অত্যন্ত সঙ্কোচ বোধ করে এবং কয়েকবার ইতস্তত করে ‘সত্যের সন্ধান’ বইখানা লুকিয়ে নিয়ে তাঁর হাতে দিলাম। বললাম, বইখানা যাতে কেউ না দেখে – সাবধানে রাখবেন। কালকে এসে আপনার মতামত শুনবো।

পরদিন শাহেদা নূর ভাবী এসে বললেন, আপনার বন্ধুকে কি একটা বই দিয়ে এসেছেন-সারারাত ঘুমায়নি। কয়েকবার পড়েছে, আর আপন মনে বিড়বিড় করে কি কি বলেছে। আপনাকে আজ যেতে বলেছে।

আমি বিকেলে যাওয়ার পর নূর ভাই উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, আমি অনেক দিন এতো ভালো বই পড়িনি। এই লেখককে আমি দেখতে চাই-তাকে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই হবে। আরজ আলী মাতুব্বরের পরিচয় প্রকাশ করার পর, তাঁর বই প্রকাশ নিয়ে যে বিপদ ঘটেছিল তা বর্ণনা করে বললাম- তাঁর সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেয়া কঠিন। তিনি এখন শহরে কম আসেন এবং এলেও তাঁকে আড়াল করে রাখি।

রুগ্ন মানুষের মনে কষ্ট দিতে নেই। বললাম-নূরভাই, কথা দিচ্ছি না, তবে যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।

কাজী গোলাম কাদির সাহেবের কাছে কথাটা পাড়লে তিনি প্রথমে বিতৃষ্ণ নয়নে তাকালেন। পরে বললেন, নূর সাহেব অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর বাসায় বৈষয়িক-অবৈষয়িক কারণে নানা রকমের মানুষ ওঠাবসা করেন। তাঁদের কারো চোখে পড়লে শেষ পর্যন্ত। দিতে পারবেন তো? ধর্মান্ধদের কুযুক্তির অর্থ খোঁজা যায়; কিন্তু শিক্ষিত লোকেরা যখন যুক্তিহীন হয়ে পড়ে, তখন আচরণ করে ম্যাজিস্ট্রেট ফজলুল করিমের মতো। আপনি তো সবই জানেন। একবার বই ছাপতে গিয়ে কি বিপত্তি না ঘটেছিল।

আমি স্যারকে অনুনয় করে বললাম, এ কাজটিও আমার ওপর ছেড়ে দিন। কোন অসুবিধা হবে না আশা করি।

সেই ব্রক্ষ্ম মুহূর্তটি এলো। মাতুব্বর সাহেবকে এক দিন ঘুরপথে নূর ভাইয়ের বাসায় নিয়ে হাজির হলাম। সময়টা দেখা করার জন্য অসময়। পরিচয় করিয়ে দেয়ার দরকার হল না। নূর ভাই বিস্ময়বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, আপনার বইটি পড়ে আমি এতোই মুগ্ধ হয়েছি যে, আমি আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করেছি।

যে প্রশ্ন আমি নিজে জিজ্ঞেস করিনি, অন্যসূত্রে জেনেছি, তা-ই নূর ভাই করে বসলেন-মাতুব্বর সাহেব, আপনার জীবনে এমন কি ঘটনা ঘটেছে যা আপনাকে এ ধরণের চিন্তা- দর্শনে টেনে এনেছে?

মাতুব্বর সাহেব কিছুক্ষন চুপ থেকে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। আমি আর নূর ভাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অপলক তাকিয়ে রইলাম। শক্ত মানুষটির চোখে দ্বিতীয়বারের মতো আবারও চোখের পানি দেখলাম। মাতুব্বর ন্সাহেব তাঁর মৃত মায়ের ছবি তোলার ঘটনা আনুপূর্বিক বর্ণনা করলেন। এর বিস্তৃত বিবরণ আইয়ুব হোসেনের লেখা জীবনীগ্রন্থে পাওয়া যাবে।

নূর ভাইয়ের হৃদয়ের দ্রবীভুত হল। শিল্পীমনা মানুষ। সহজে আকুল হন। তিনি সেই সকল লোকদের একজন যারা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকেন – মানুষের গুণের কদর করেন, অথচ নিজেরা খ্যাতির কাঙ্গাল নন বিন্দুমাত্রও। বনফুলের মতো। আপনাতে আপনি ফুটে নিঃশেষ হয়ে যান।

মাতুব্বর সাহেবকে তিনি বললেন, মাতুব্বর সাহেব, শামসুল হক সাহেবের মতো আমিও আপনার বন্ধু। আপনার যখন খুশী আপনি নিঃসঙ্কোচে আমার এখানে আসবেন। আজ থেকে আমরা পরস্পরের আপনজন। আপনার অন্য কোন বই থাকলে, তাঁর প্রকাশনার দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমার ওপর ছেড়ে দিন। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

আমি বললাম, তাঁর ‘সৃষ্টি-রহস্য’ নামে আরেকটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি আমার হাতের কাছে। আপনাকে পড়তে দেবো। এটি আকারে ‘সত্যের সন্ধান’ থেকে একটু বড় হবে।

নূর ভাই ‘সৃষ্টি-রহস্য’ প্রকাশনার খরচ অর্থাৎ সাড়ে দশ হাজার টাকার সবটাই বহন করেন। এরই মধ্যে নূর ভাই ঢাকার লালমাটিয়ায় তাঁর নবনির্মিত বাড়ীতে-বরিশাল ছেড়ে চলে আসেন। একদিন মাতুব্বর সাহেব গল্পচ্ছলে বলেছিলেন, লালমাটিয়ার বাসায় দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর পকেটে হাত দিয়ে বইয়ের বিক্রয়লব্ধ তিন হাজার টাকা নূর ভাইকে দিতে গেলেন, অমনি নূর ভাই বলে উঠলেন-মাতুব্বর সাহেব, ওটা পকেটে রেখে দিন। আমি ফেরত নেয়ার জন্য ও টাকা দেইনি। আপনার মতো চিন্তাশীল ব্যক্তির কাজে ক’টি টাকা লেগেছে-এটাই সার্থকতা। বইটির উৎসর্গ করা হয়েছে এই বলে – ‘আমার পরম সুহৃদ মোহাম্মদ আলী নূর সাহেবকে’। দু’জনের মহৎ হৃদয়ের পরিচয়।

‘অনুমান’ নামক চটি বইটির প্রকাশনায় নূর ভাইয়ের বড় এক হাজার টাকা খরচ দিয়েছিলেন। তিনি ধর্মভীরূ আলহাজ্ব ছিলেন – কিন্তু জ্ঞানতপস্বী মাতুব্বরের ভক্তও ছিলেন।

নূর ভাইকে ঠাট্টা করে কিছুদিন আগে জিজ্ঞেস করেছিলাম। যে সময় মাতুব্বর সাহেবকে বই প্রকাশের জন্য সাড়ে দশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন, এ টাকায় তখন মীরপুরে পাঁচ কাঠা জায়গা কিনতে পারতেন। নূর ভাই উত্তর দেননি। যে মানুষটির মন-মানসিকতা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের চেয়েও অনেক বড়, তার মন জয় করতে নূর ভাই না হয় কয়টি টাকা ব্যয় করলেনইবা। কাজেই আমার কথার উত্তর দেয়ার তিনি প্রয়োজনবোধ করেনি।

আমি বরিশাল থাকতে এঁরা দুটো ঘটনা মাতুব্বর সাহেবকে নাড়া দেয়। রোজার ঈদের পর একদিন কাজী সাহেব আমার জন্য জরুরী খবর পাঠালেন। বিকেল চারটা। গিয়ে দেখি মাতুব্বর সাহেব বসে আছেন। চিরাচরিত নিয়মে তিন ইঞ্চি লম্বা পাইপের ভেতর সিগারেট ঢুকিয়ে দিয়ে সুখটান দিচ্ছেন। আমাকে দেখে প্রসন্নতায় উজ্জ্বল হয় মুখ। পকেটে হাত দিয়ে একখানা ঈদ-সংখ্যা ইত্তেফাক বের করে মুচকি মুচকি হাঁসতে লাগলেন। দেখি আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি লেখা – আরজ আলী মাতুব্বরের জীবন-জিজ্ঞাসা’। জোরে জোরে পড়ে আমাদের দু’জনকে শোনাতে লাগলেন। দু’বার তাঁর চোখে পানি দেখেছি। এবার দেখলাম আনন্দের উদ্ভাস। একটি লেখা একজন গ্রন্থকারকে কতটুকু উদ্বুদ্ধ করতে পারে তা প্রত্যক্ষ করলাম। প্রবন্ধটি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী’র ‘আরণ্যক দৃশ্যাবলী’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

আরেকদিন কাজী সাহেবের বাসায় গিয়ে দেখি মাতুব্বর সাহেব বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন। যে ফজলুল করিম সাহেবের ওয়ারেন্টে কমিউনিস্ট আখ্যায়িত হয়ে মাতুব্বর সাহেব যৌবনের প্রথমদিকে ‘পবিত্র হাজতবাস’ করেছেন, সেই ফজলুল করিমের নাতি জনৈক শফিকুর রহমান এক লম্বা এবং উচ্ছ্বসিত চিঠি লিখে মাতুব্বর সাহেবকে ঢাকা গেলে তাঁর বাসাবোর বাসায় দেখা করতে বলেছেন। আরো লিখেছেন, শফিকুর রহমান ‘সত্যের সন্ধান’ বইখানি ফুটপাত থেকে উচ্চমূল্যে ক্রয় করেছেন।

আমরা বললাম, চুপচাপ থাকুন। ফাঁদও হতে পারে।

একমাস পর আরেক চিঠি, বেশ লম্বা। অনেক অনুনয়-বিনয়, ভক্তি-শ্রদ্ধা নিবেদনান্তে লেখা হয়েছে, আপনার ঠিকানা পেলে আমি দেখা করবো। আপনার মতো আমিও মুক্তবুদ্ধিতে বিশ্বাস করি। মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তিবাদের ওপর আমার প্রচুর বই আছে। আমি আমার নানার মতো নই।

আমরা শফিকুর রহমানের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিলাম এবং বললাম, সঙ্গে যাতে মাতুব্বর সাহেব তাঁর ডি.আই.টি-তে কর্মরত মেঝো ছেলেকে নিয়ে যান।

মাতুব্বর সাহেব একদিন বাসাবোতে সকালের দিকে গেলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। জগন্নাথ কলেজে বই. এস. সি. ক্লাসে পড়ে, একটি বাচ্চা ছেলে। দাঁড়ি-গোঁফ গজায়নি। অসম্ভব রকমের বুদ্ধিদীপ্ত মেধাবী ছেলে। তাঁর বইয়ের সংগ্রহ এবং অধ্যয়নের গভীরতা দেখে মাতুব্বর সাহেব খুবই মুগ্ধ হলেন। পরবর্তীতে ঢাকায় শফিকের সঙ্গে আমারও পরিচয় দিয়েছিলেন মাতুব্বর সাহেব। তাঁকে আমার খুবি ভালো লেগেছিলো। জানি না শফিকুর এখন কোথায় আছে! এক সময় সে মাতুব্বর সাহেবের আলোচনা প্রসঙ্গে ইংরেজিতে মানবতাবাদের ওপর একটি বড় প্রবন্ধ লিখে আমেরিকার আইকনোক্লাস্ট পত্রিকায় ছাপিয়েছিল। শফিক একজন শিল্পীকে দিয়ে মাতুব্বর সাহেবের এক আবক্ষ মূর্তি গড়েছিল। মাতুব্বর সাহেবের বন্ধুভাগ্য ভালোই বলতে হয়।

উনিশশ’ পচাত্তরের কোন এক সময় ঢাকা থেকে ফিরে মাতুব্বর সাহেব খুবই খুশিমনে বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. নূরূল ইসলামের উদ্যোগে দর্শন ক্লাসে আত্মা ও প্রাণের ওপর একটি মনোজ্ঞ বক্তৃতার বন্দবস্ত করেন। এই বক্তৃতা শুনে ছাত্র-ছাত্রীরা খুবই মুগ্ধ হন এবং নানা রকম কঠিন প্রশ্ন করেন। মাতুব্বর সাহেব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেসব প্রশ্নের উত্তর দেন। ক্লাসের পর ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁকে অভিনন্দনে অভিভূত করেন।

ড. নূরুল ইসলামের নিকট আরেক কারণে আমরা কৃতজ্ঞ। তিনিই মাতুব্বর সাহেবের ‘সত্যের সন্ধান’ বইটি প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে পড়তে দিয়েছিলেন। ফলে তাঁর হাত দিয়ে বইটির ওপর একটি অপূর্ব সুন্দর প্রবন্ধ বের হয়।

কুখ্যাত ‘পি. ও. নয় নম্বর’ ধারাবলে পচাত্তর সালে পদোন্নতি পাইনি। সারাজীবন বোর্ডের একখানা সিলেকশন এবং ব্যাকরণের ‘কৃৎ’ ও ‘ঘঞ’ প্রত্যয় মুখস্ত করে অধ্যাপনা জীবন সার্থক করেছেন, তাঁদের কেউ কেউ পদোন্নতি পেয়ে বিভাগীয় প্রধানের চেয়ার অলংকৃত করলেন, যেখানে অনার্স এবং এম. এ. কোর্স একসঙ্গে পড়ানো হয়। ডোবার মাছ সমুদ্রে পড়লে যে দশা হয়। নিজের অক্ষমতা ঢাকার জন্য চতুর্দিকে চোখ পাকিয়ে কথা বলা দেখে বুঝলাম-সরকারী কলেজের ভাত শেষ হয়ে এসেছে। আমার চার বছরের জুনিয়রগণও পদোন্নতি পেল।

আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক প্রফেসর রফিকুল ইসলাম এবং প্রফেসর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান সাহেব মৌখিক পরীক্ষা নিতে গিয়ে বললেন, তোমার কি এখনো শিক্ষা হয়নি? এখান থেকে সুযোগ পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাও।

কাজেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় উনিশশ’ ছিয়াত্তর সালের জুলাই মাসে যোগদান করি। পেছনে প্রায় চৌদ্দ বছরের কলেজ জীবন, অগণিত বন্ধু-বান্ধব, ছাত্র-ছাত্রী এবং শুভানুধ্যায়ী ফেলে আসি। কিন্তু আমার স্ত্রী থেকে যান বি. এম. কলেজে ইসলামের ইতিহাস বিভাগে। তাঁকে তো সঙ্গে সঙ্গে বদলী করানো যায়নি। সুতরাং বরিশালের সঙ্গে সম্পর্ক তাৎক্ষনিক চুকে যায়নি। ছুটি হলেই বরিশাল ছুটতাম। কাজী সাহেব এবং মাতুব্বর সাহেবের সঙ্গে আগের মতোই দেখা-সাক্ষাৎ গল্প-সল্প হতো। মনে হতোনা। মনে হতোনা-বরিশাল ছেড়েছি।

ইতিমধ্যে আমার বিশিষ্ট বন্ধু অধ্যাপক আব্দুল হালিম এবং তাঁর স্ত্রী অধ্যাপিকা নুরন্নাহার বেগমের সঙ্গে মাতুব্বর সাহেবের পরিচয় করে দিয়েছি। তাঁরা তাঁকে সব সময় সাদরে গ্রহণ করতেন এবং মাতুব্বর সাহেবের আগমন তাঁদের কাছে সর্বদা আনন্দদায়ক ছিল।

উনিশশ’ উনাশি সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমরা বরিশালের পাঠ চুকিয়ে চলে আসি। বিদায় দিনে একটু একটু বৃষ্টি ছিল, সকাল আট টায় স্টীমার ছাড়বে। আমার এবং স্ত্রীর লটবহর স্টীমারে তোলা হয়ে গেছে। সহকর্মী এবং ছাত্ররা অনেকে বিদায় দিতে স্টীমার ঘাটে এসেছেন। একপাশে কাজী গোলাম কাদির সাহেব বিমর্ষ নয়নে দাঁড়িয়ে আছেন। বিদায় নিতে গিয়ে খুবই ভাবালু হয়ে পড়লাম। দোতলায় উঠে রেলিং ধরে সবার দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে রইলাম। হঠাত দেখি সুবর্ণকান্তি কাজী সাহেবের পাশে একটি কালো মানুষ কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি দ্রুত ছুটে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরলাম। এবার বোধহয় চোখের পানি বাধ মানলো না। আবার দ্রুত ফিরে এসে দেখি সিঁড়ির আর একটা তক্তা সরাতে বাকী।

জাহাজের প্রথম শ্রেণীর সামনে ডেকচেয়ারে বসে লামচরির দিকে নিষ্পল চোখে তাকিয়ে রইলাম। এক সময়ে বাতাসের পরশে চোখের পানি শুকিয়ে গেল। লামচরির মোড়  ঘোরা সময় জাহাজের শেষ ভোঁ বেজে উঠল। দীর্ঘদিনের স্মৃতিময় কর্মক্ষেত্র বরিশাল একসময় চোখের আড়ালে চলে গেলো।

বরিশাল থেকে বৈষয়িক দিক দিয়ে খালি হাতে ফিরলাম। পদোন্নতি এবং অর্থ কোনটাই হল না। কিন্তু অজস্র মানুষের ভালোবাসাও ছেড়ে এলাম। কীর্তনখোলা নদী, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, চারদিকের সবুজ রূপ কোনটাই আর  মনকে সান্তনা দিল না। হঠাত অন্নদাশঙ্কর রায়ের পথে-প্রবাসের কথা মনে পড়ল। ‘ল্যুভ’ মিউজিয়ামে কত অপূর্ব সুন্দর ছবি দেখলেন, ‘মোনালিসা’কে হার মানায়। কিন্তু ট্রেনে ইটালীর দিকে আসার সময় লেখকের মন থেকে সব ছবি অপসৃত হয়ে শুধু ‘মোনালিসা’ চিরভাস্বর হয়ে রইল।

আমার মন থেকে সব ব্যথা দূর হয়ে গেলো। আমি কি পাইনি? একজন সুবর্ণকান্তি রূপবান মানুষ আর তাঁর পাশে দাঁড়ানো, বৃষ্টি-বাদলায় ছুটে আসা-কালো পাথরে খোদাই করা শালপ্রাংশু দেহ, মাইকেলাঞ্জেলোর ‘মোজেস’। মনে হল, জীবনের সবচেয়ে বড় সঞ্চয় কাজী গোলাম কাদির আর তাঁর হাত বেয়ে পাওয়া আরজ আলী মাতুব্বর।

কাজী গোলাম কাদির সাহেবদের মতো বন্ধুদের প্রতিষ্ঠানে পাওয়া যায়। কিন্তু মাতুব্বরের মতো বন্ধু-বাংলার ফসল প্রান্তরের ফসল।

বেশ ক’দিন থেকে মন খারাপ। কাজী সাহেব, মাতুব্বর সাহেবকে ছেড়ে আসার বেদনা-নতুন কর্মক্ষেত্রে মনের উড়-উড় ভাব। এর মধ্যে হঠাত একদিন বিভাগ থেকে টেলিফোন পেলাম বরিশাল থেকে আমার একজন আত্মীয় এসেছেন। গিয়ে দেখি মাতুব্বর সাহেব। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি করে এলেন? বললেন, বাসের হাতল ধরে ঝুলতে ঝুলতে। বাসায় নিয়ে এলাম। বিভাগের সহকর্মীরা আদর-আপ্যায়ণ করেছিলেন। তাঁদের ধারণা হয়েছিল, এই বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমার পিতৃদেব। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর কিছুতেই ঘুম পাড়াতে পারলাম না। তিনি দিনে ঘুমোন না। শ্রমিক মানুষ। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পাঁচ-ছ ঘণ্টা ঘুমোন। কথা আর ফুরোয় না।

ঢাকা শহরে এলে, অন্তত তিন দিনের জন্য এলে- একদিন আমার এখানে কাটান। এলে আমার ইজি চেয়ারে জোর করে বসিয়ে দিয়ে পাখা ছেড়ে দেই। প্রথম চা-নাস্তা, পরে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা – নদীর গতি পরিবর্তন, আবহাওয়ার ওপর তার প্রভাব, বন্যার পরিণাম, কেন বন্যার পর পলি পড়লে ফসল ভালো হয়, পলিতে কি গুণ থাকে, প্রতি বছর একই সময় ঝড়-বৃষ্টি-বন্যা হয় না কেন, গ্রহ-নক্ষত্রের গতিধারার বৈলক্ষণ্য কোন প্রভাব ফেলে কি না, এক এক এলাকার মাটির গুণের তারতম্য কেন- তিনি বিষদভাবে সরল ভাষায় বুঝিয়ে দিতেন। মাঝে মাঝে বলতেন- আমি যেসব কথা বলছি, তা সব আমার কথা নয়। অমুক অমুক বইয়ে পাবেন। আব্দুল জব্বারের ‘খ-গোল পরিচয়’ থেকে শুরু করে, আল মুতীর লেখা, আব্দুর হালিমের বৈজ্ঞানিক রচনাবলী, এমনকি শাহজাহান তপনের প্রবন্ধবলীও মাতুব্বর সাহেবের জ্ঞানসীমানায় বিরাজ করতো। দুরূহ বিষয়গুলোকে অপূর্ব সহজ ভঙ্গিমায় অবলীলাক্রমে বর্ণনা করতেন, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। মাঝে মাঝে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীদের ডেকে আনতাম। তাঁদের অনেকেই  মাতুব্বর সাহেবের ভক্ত হয়ে ওঠেন। এঁদের অনেককে মাতুব্বর সাহেব বই উপহার দেন। তাঁরাও বাংলা লেখায় বিজ্ঞানের বা ধর্ম-দর্শনের বই তাঁকে উপহার হিসাবে তাঁকে প্রদান করেন। এবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি বক্তা হিসাবে আগত অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়ের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ আলাপ হয়। অধ্যাপক রায় তাঁর সঙ্গে আলাপ করে মুগ্ধ হন। তাঁরা পরস্পরকে নিজেদের লেখা বই উপহার দেন।

দর্শনের যে কোন বিষয় সম্পর্কে সহজ-সরল ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আমার একটি ঘটনা মনে পড়ে। আমাদের বরিশাল ছাড়ার মাস চারেক আগে রামকৃষ্ণ মিশনের সচিব, আমার প্রিয় ছাত্র মানিকলাল চ্যাটার্জী গোটা বিশেক বই সহ একখানা আমন্ত্রণলিপি আমার নামে বাসায় রেখে যান। স্বামী বিবেকানন্দের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমাকে প্রধান বক্তা করা হয়েছে। সম্ভবত প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাবীণ এবং অবসরপ্রাপ্ত স্বামী অক্ষরানন্দ। বিশেষ অতিথি কলকাতা বেলুর মাঠের তরুণ স্বামী প্রেমানন্দ। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। উপনিষদ, বেদান্ত বা চার্বাক দর্শনের কিছুই জানি না। ভরসা মানিক লালের দেয়া বই আর কাজী গোলাম কাদির সাহেব। স্যারের কাছে সব খোলাসা করে বলাতে তিনি বললেন, এ আর এমন কি? এক মাস সময় হাতে আছে। বই পড় আর সন্ধ্যার সময় হোস্টেল সুপারের অফিসে আসুন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বুঝিয়ে দেবোখন।

কাজী সাহেব আমাকে সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধৃত করে বোঝাতে লাগলেন। স্যার যত বোঝান, আমি তত অবুঝ হয়ে পড়ি। কতগুলো ভারী ভারী দার্শনিক শব্দ এবং উপমা আমার মস্তিষ্কের ভেতর কৈ মাছের মতো অবাধে বিচরণ করতে লাগল। তিনি মাঝে মাঝে পরীক্ষা নিলে আমি অবধারিতভাবে ফেল মারতে শুরু করলাম। পরে লজ্জা শরমের তাড়নায় স্যারের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। এর মধ্যে একদিন দুপুরে মাতুব্বর সাহেব এসে হাজির খাওয়া- দাওয়ার পর নানা কথার ঝুলি খুলে দিলাম। কথায় কথায় আমার দার্শনিক সঙ্কটের কথা বললাম। তিনি অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় দ্বৈতাদ্বৈত দর্শন, কালী দর্শন, উপনিষদ কি, বেদান্ত দর্শনের সঙ্গে বিবেকানন্দের জীবন দর্শনের সম্পর্ক কি, তিনি পরমপুরুষ রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের শিষ্যত্ব কেন গ্রহণ করলেন অত্যাদি বোঝাতে লাগলেন। শঙ্কর রামানুজের বেদান্ত দর্শনের ব্যাখ্যার সঙ্গে বিবেকানন্দের ব্যাখ্যার পার্থক্য কোথায়-এটাও সংক্ষেপে সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন। আমি তাঁর কথা শুনতে শুনতে কাগজে নোট নিতে লাগলাম।

সেই সময়ের জন্যে আমি আমার প্রয়োজনমাফিক উপাদান পেয়ে গেলাম। কাজী সাহেব মাঝে  মাঝে প্রশ্ন করলে আমি ‘গুডবয়ের’ মতো উত্তর দিতে লাগলাম। কাজী সাহেব খুশি হয়ে বলতেন, বাহ এই তো পরিষ্কার বুঝতে পারছেন। আসল গোমর কি ফাঁক করা যায়?

বক্তৃতা দেয়ার শুভক্ষণটি এলো। মঞ্চের মাঝখানে বসলাম। ডানদিকে বৃদ্ধ স্বামী, বামদিকে তরুণ স্বামী। আমার পোশাক এবং চেহারার জন্য স্বামীদ্বয় বিরসবদন । তাঁদের গেরুয়া বসন। মাঝখানে আমার অবস্থা যৌতুক বিহীন পাত্রীর মতো। একজন স্বামী পরলোকগত। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এসে জীবিত স্বামীদ্বয়কে নিয়ে মনে হয় সংকটে পড়লাম।

সে যাক, অবশেষে সভাপতি শ্রদ্ধাভাজন জয়ন্ত দাশগুপ্ত আমাকে বক্তৃতা দেয়ার জন্য মাইকের সামনে আহ্বান করলেন। সভাপতিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্বোধন করে বললাম, আমার প্রিয় সন্ন্যাসী বিবেকানন্দকে আজকে মঠে বন্দি করা হয়েছে- তিনি তো মঠের সন্ন্যাসী নন, তিনি মাঠের সন্ন্যাসী। বলেই তাঁর জীবনদর্শন, বিশ্বমানবতার প্রতি আহ্বান, শিকাগোর বক্তৃতার উদ্ধৃতি ইত্যাদি বর্ণনা করে প্রায় একঘণ্টা বক্তৃতা করলাম। স্বামী দু’জন আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। একজন বেলুর মঠে আমন্ত্রণ জানালেন। আমার যৌতুক দেয়া হয়ে গেলো বুঝি!

বাসায় সারারাত ঘুমের মধ্যেও চোখে ভেসে উঠল আরজ আলী মাতুব্বরের চেহারা। কাজী সাহেব অত্যন্ত উচ্চমার্গ থেকে বলতেন বলে মানসিক প্রস্তুতি না থাকার কারণে তাঁকে বুঝে উঠতাম না। আর মাতুব্বর সাহেব কঠিন বিষয়কে সহজ করে বলার অসাধারণ ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। তাঁর বলার ভঙ্গি, চলার ভঙ্গি এবং লেখার ভঙ্গি তাঁর জীবনাচরণের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ।

আরজ আলী মাতুব্বর সাহেব মৃত্যুর দু’মাস আগেও আমার বাসায় এসেছিলেন। তাঁর শরীর এবং চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, মাতুব্বর সাহেব, আপনাকে বড্ড দুর্বল দেখাচ্ছে। একা চলাফেরা না করে সঙ্গে কাউকে নিবেন।

উত্তরে তিনি বললেন, একটু দুর্বলতা বোধ করছি, কিন্তু মনোবল হারাইনি।

অনেকের মতো আমি নিজেও নিজেকে বার বার প্রশ্ন করেছি। দীর্ঘ বিশ বছর যাবত তিনি আমার কাছেও আসতে সমান আকর্ষণ বোধ করেছেন। দু’জনের বয়সের পার্থক্য দুস্তর। তবু পরস্পরের কাছে মনের ভাব প্রকাশে অসুবিধা হয়নি। আমরা দু’জনেই বয়স এবং শিক্ষা-দীক্ষার অভিমান ভুলে গিয়েছিলাম।

তিনি দশটি সন্তানের জনক ছিলেন। তবুও মনে হয় আরেকটি সন্তানের ক্ষুধা তাঁর অন্তরের অন্তস্থলে লুকিয়ে ছিল। সে সন্তানের কাছে তিনি তাঁর অপরিসীম বৈদগ্ধকে উন্মোচিত করতে পারেন।

আমি মাতুব্বর সাহেবের একাদশ সন্তান ছিলাম।

উনিশশ’বিরাশি সালে আমার মায়ের মৃত্যুর পর আমার বাবা আমার সঙ্গে থাকতেন। বাবার জীবন সংগ্রামমুখর। তাঁর বাবার মৃত্যু হয় তাঁর দাদার বর্তমানে। সুতরাং ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক বাবা এবং দুই নাবালক ভাই ‘লা-মো’রম’ অর্থাৎ দাদার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন। সুতরাং সর্বহারা বিধবা মা এবং দু’টি ভাইকে বাঁচানোর জন্যে বাবা দূর সম্পর্কের এক সারেং আত্মীয়ের হাত ধরে কলকাতার খিদিরপুরে গিয়ে জাহাজে চাকুরীর নলী (লফফহ) করেন। নলী এক রকমের ‘সার্ভিস বুক’। তখন তাঁর বয়স আঠার বছর। স্থানীয় স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিলেন। প্রথম মহাযুদ্ধ তখন মন্থরগতি হয়ে এসেছিল। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টীম নেভিগেশন কোম্পানীতে অনেক লোকের দরকার। সুতরাং বাবার চাকুরী তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো। বেতন মাসে সতের টাকা, খাওয়া-দাওয়া, জামা-কাপড় সবই বিনি পয়সায়। এত বড় সফলতায় বাবার শুভাকাংখীরা সুখী, বাকীরা বেজার। বাবা এসব গল্প রসিয়ে রসিয়ে বলতেন। দীর্ঘ চল্লিশ বছর বাবা বিদেশী জাহাজে চাকুরী করেছেন। সারা পৃথিবীর সবগুলো সমুদ্র বন্দর স্পর্শ করেছেন। সঙ্গে থাকতো একখানা বিশ্ব ইতিহাস, মোটা একখানা ভূগোল, আর বড় আকারের একখানা ভূচিতাবলী। সারা পৃথিবীর মানচিত্র বাবার নখদর্পণে। বাবা ছোটবেলায় আমাকে বলশেভিক বিপ্লবের ইতিহাস শোনাতেন। কিভাবে একটি দেশ পুরনো ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলে শ্রমিকরাজ কায়েম করে কত কম সময়ে উন্নতির উচ্চশিখরে আরোহণ করেছে। বাবা ইস্টিমারে ব্লাডিবোস্টক পর্যন্ত গিয়েছিলেন। বলেছেন, সারা বছর বন্দরটি বরফে ঢাকা থাকে। বরফ কাটা জাহাজে কত কত বন্দরে তাঁদের জাহাজ নিয়ে প্রবেশ করতে হয়েছে। মানব জাতির জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির প্রত্যক্ষ ফসল নিজের চোখে দেখে এসে স্বদেশবাসীর কুসংস্কারাচ্ছন্ন মূঢ়তা নিয়ে আফসোস করতেন। বলতেন, এদেশকে জাগাতে হলে দেশের মানুষকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে গণশিক্ষা দিতে হবে এবং ব্যাপকভাবে বিজ্ঞানচর্চা করতে হবে। বাবার কাছে দেশ-বিদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানের কাহিনী শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে যেতাম।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x