(৭)
শ্যামলী ফোন করেছে, অনেক দিন তোমাকে দেখি না, কাছে পাই না, খুব শূন্য হয়ে আছি, আমি বেঁচে নেই।
শ্যামলীর কণ্ঠস্বরটাকে একটি ছোট্ট বালিকার স্বর মনে হয়। হাসানের, অনেক দিন পর তাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে, মনে হয়। ওই স্বর তাকে অন্ধকার থেকে উদ্ধার করছে, তাকে নিশ্বাস ফিরিয়ে দিচ্ছে।
হাসান বলে, আমিও তোমার অভাব খুব বোধ করছি, তুমি কি আসতে পারো?
শ্যামলী বলে, আসার জন্যেই তো পাগল হয়ে আছি, তুমি তো ডাকো না।
হাসান বলে, এসো, আমি অন্ধকারে আছি, আমাকে উদ্ধার করো, আলো জ্বলো, নিশ্বাস ফিরিয়ে দাও আমাকে।
শ্যামলী জিজ্ঞেস করে, কেনো, কী হয়েছে?
হাসান বলে, তুমি কি দেশ জুড়ে একদলের অন্ধকার দেখতে পাচ্ছো না?
শ্যামলী বলে, চুপ, চুপ, কেউ শুনতে পাবে, তোমার বিপদ হবে।
হাসান বিছানা থেকে ওঠে না, গড়াতে থাকে, উঠতে তার ইচ্ছে করছে না; আজি সে অফিসে যাবে না, জানিয়ে দিলেই চলবে। অন্ধকার কাটানোর জন্যে শুয়ে শুয়ে সে নিজের নগ্নতা উপভোগ করতে থাকে; ঘণ্টাখানেকের মধ্যে শ্যামলী এসে ঘণ্টা বাজালে সে নগ্নদেহেই গিয়ে দরোজা খুলে দেয়।
শ্যামলী তাকে দেখে মধুর চিৎকার ক’রে ওঠে, হায়, তুমি যে উস্থুর ন্যাংটা।
হাসান বলে, আমার ইচ্ছে হয় প্রত্যেক ভোরে তুমি আমাকে এভাবে দেখো।
শ্যামলী বলে, আর তুমিও আমাকে প্রতিভোরে এভাবে দেখতে চাও?
হাসান বলে, হুঁ, চাই; শুধু ভোরে নয়, দুপুরে, বিকেলেও, সন্ধ্যায়ও রাতেও।
শ্যামলী হোসে, হাসানের একটি প্রত্যঙ্গ ছয়ে বলে, তোমাকে এভাবে দেখতে আমার ভালোই লাগছে, চমৎকার শরীর তোমার। একটু দাড়াও দেখি।
হাসান বলে, তোমাকে এভাবে দেখতেও আমার ভালো লাগবে; তোমার শরীরও চমৎকার।
শ্যামলী হেসে সুখে বলে, জানো তো আমি তোমার ছ-বছরের বড়ো?
হাসান বলে, কিন্তু তুমি এখনো বিশ বছরের মতো দেখতে, আমার সাথে তোমাকে বেশ মানায়।
শ্যামলী বলে, তুমি বোধহয় একটি বউ চাও।
হাসান বলে, তা জানি না, হয়তো চাই, হয়তো চাই না।
শ্যামলী বলে, আমাকে তুমি তোমার বউ হিশেবে চাও?
হাসান বলে, তাও জানি না, হয়তো চাই, হয়তো চাই না। শ্যা
মলী বলে, তোমার বউ হতে পারলে বেশ হতো।
হাসান গড়াতে থাকে; দেখে অবাক হয় যে শ্যামলী তার পাশে বসছে না, খুঁজে খুঁজে পাউরুটি, ডিম, মাখন, জ্যাম বের করছে টোস্টারে পাউরুটি সেঁকছে, মাখন লাগাচ্ছে, কেটলিতে পানি গরম ক’রে চা বানাচ্ছে।
শ্যামলী দূর থেকে চিৎকার ক’রে বলে, মুখ ধুয়ে নাও, শেভ ক’রে নাও, তোমার ব্রেকফাস্ট প্রায় তৈরি।
হাসান বলে, আজ মুখ ধুবো না, শেভ করবো না, আজ নতুন জীবন শুরু।
হাসান, তুমি এই চাও শ্যামলীর সাথে? এই জীবন তোমার কাছে অপূর্ব লাগে?
এক নারীর হাতে ব্রেকফাস্টে, যে-নারী তোমার স্ত্রী? স্ত্রী কি অপূর্ব?
হাসান এটুকু ভাবতে না ভাবতে শ্যামলী ব্রেকফাস্ট এনে রাখে বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিলে।
শ্যামলী হোসে, হাসানের মুখের কাছে তার টলটলে মুখটি এনে, বলে, মনে করো আমি তোমার বউ।
হাসান ব্রেকফাস্টে হাত লাগায় না, হাত লাগায় শ্যামলীর শরীরে; তাকে টেনে এনে চুমো খায়, বলে, আজ আমি মেল শভিনিস্ট পিগ, পুংগবী শুয়োর, আজ নারী, আমার রমণী, আজ তুমিই আমার ব্রেকফাস্ট, তুমিই আমার মাখনমাখা পাউরুটি, তুমিই আমার কাঁচা ওমলেট।
শ্যামলী বলে, না, না, এখন নয়, আগে খেয়ে নাও।
হাসান বলে, না, আগে আমি বউ খাবো। যখন তারা সুখকরভাবে ক্লান্ত হয়, বন্যার ধীর জলে ভেসে যাওয়া খড়ের ঘরের মতো সুন্দরী কাঠের কোশানৌকোর মতো কলাগাছের ভেলার মতো এদিক সেদিক ভাসতে থাকে, তখন দুপুর।
হাসান শ্যামলীর তলপেটে আঙুল বোলাতে বোলাতে বলে, আমি চাই আজি এখানে একটি ভ্রণ জন্ম নিক।
শ্যামলী অন্য জগত থেকে জেগে উঠে। জিজ্ঞেস করে, কী চাও, তুমি কী চাও?
হাসান বলে, আমি চাই এখানে একটি ভ্রণ জন্ম নিক।
শ্যামলী বলে, না, না, আমি আর সন্তান চাই না।
হাসান বলে, আমি দেখতে চাই কীভাবে তোমার ভেতরে বেড়ে ওঠে তোমার আমার সন্তান।
শ্যামলী বলে, তোমার সন্তান তো আমি নিতে পারি না।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কেনো পারো না? আমার সন্তান কি চণ্ডাল?
শ্যামলী বলে, আমার হাজব্যান্ড আছে; তোমার আমার সন্তান হ’লে তা হবে। অবৈধ, লোকে বলবে জারজ।
হাসান বলে, সন্তান হচ্ছে সন্তান, সন্তানের আবার বৈধ অবৈধ কি?
শ্যামলী বলে, বিয়ের বাইরে সন্তান অবৈধ।
হাসান বলে, ক্লান্তিকর অপ্রেমের বিয়ের সন্তান বৈধ, আর সুখকর সুন্দর প্রেমের সন্তান অবৈধ? এটা কী ক’রে হয়?
শ্যামলী বলে, হ্যাঁ, প্রেম সমাজে স্বীকৃত নয়, বিয়ে স্বীকৃত।
হাসান বলে, তাহলে চলো, আমরা বিয়ে করি; আজই করি।
শ্যামলী বলে, কী ক’রে করবো? আমি তো বিবাহিত, বিয়ে তো আমার একটা হয়েছে, আমার হাজব্যান্ড আছে।
হাসান বলে, তাহলে তাকে ছেড়ে দাও, তাকে তো তুমি ভালোবাসো না।
শ্যামলী বলে, হ্যাঁ, তাকে ভালোবাসি না; তবে তাকে ছেড়ে দিলে স্ক্যান্ডাল হবে, আমার ছেলেমেয়েদের জীবন কষ্টে ভরে যাবে, তারা আমাকে ঘেন্না করবে।
হাসান বলে, তাহলে সে তোমার স্বামী থাক, আর আমিও তোমাকে বিয়ে করি, আমিও স্বামী হই; তুমি দুজনের স্ত্রী হও।
হো হো ক’রে হেসে ওঠে শ্যামলী, তুমি কি পাগল হ’লে? মেয়েদের একসঙ্গে দুটি স্বামী থাকতে পারে না; মেয়েদের জরায়ু একজনের জন্যে।
হাসান বলে, আমরা শুরু করলেই থাকতে পারে। শ্যামলী বলে, তুমি তো পাগলা আউল-বাউল কবি ছিলে না, কিন্তু এখন তো তোমারও পাগলামো দেখা দিচ্ছে।
হাসান বলে, আমি তো তাকে বেশ ছাড়ই দিচ্ছি, তুমি কয়েক দিন তার সাথে থাকবে কয়েক দিন আমার সাথে থাকবে।
শ্যামলী বলে, আমার হাজব্যান্ড তাতে রাজি হবে কেনো? জেনেশুনে তার জমিতে সে অন্যকে চাষ করতে দেবে কেনো?
হাসান বলে, রাজি না হ’লে তাকে ছেড়ে দাও, তুমি তো তাকে ভালোবাসো না, তার সাথে শুতে তো তোমার ঘেন্না লাগে। জমি চিরকাল একজনের থাকে না।
শ্যামলী বলে, বিয়েতে ভালোবাসা লাগে না, গাড়িবাড়ি সন্তানেই চলে।
হাসান বলে, তাহলে তুমি আমাকে ছেড়ে দাও।
কেঁদে ওঠে শ্যামলী, না, তোমাকে ছাড়তে আমাকে বোলো না, আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকে ছাড়া আমি শূন্য হয়ে যাবো।
হাসান বলে, তাহলে আমিই শুধু শূন্য থাকবো?
শ্যামলী হাসানকে আদর করতে করতে বলে, মনে করো আমি তোমার বউ, তুমি আমাকে বউ ব’লেই ডেকো।
হাসান বলে, আর আমি তোমার?
শ্যামলী একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়, তারপর বলে, ঠিক আছে তোমাকে আমি আমার হাজব্যান্ডই মনে করবো, তুমি আমার হাজব্যান্ড।
হাসান বলে, বাইরে এ-পরিচয়টা তুমি দিতে পারবে?
শ্যামলী কেঁপে ওঠে, বাইরে এটা বলতে হবে কেনো? এ-পরিচয়টা শুধু তোমার আমার মধ্যে।
হাসান বলে, বিয়ে, স্বামী, স্ত্রী, সংসার এসব হাস্যকর আমার কাছে, কিন্তু আমি তোমাকে কাছেই চাই, সব সময় পেতে চাই।
শ্যামলী বলে, আমিও চাই, আমি যে কী করি।
হাসানের ওপর একটি চাপ এসেছে, কবিলেখকদের একটা জরুরি অবধারিত সভায় যেতে হবে, সেখানে একটা শক্তিমান ছোকরা লেখককবিদের জ্ঞান দেবে, বোঝাবে কেনো একদল করতে হলো, কেনো তাদের অবশ্যই ওই দলে যোগ দিতে হবে; হাসানকেও একদলে যোগ দিতে হবে। হাসান ওই পেশল মূর্খ ছোকরাকে চেনে, সে খুনটুন করতে দ্বিধা করে না, ছোকরা শিঘ্রি মন্ত্রীটন্ত্রী হবে, মহানায়কের একান্ত পেশি সে, এবং খুবই শক্তিমান, তার আদেশ মেনে চলতে হবে কবিলেখকদের।
হাসান ফোন করে কবি কামর আবদিনকে, আপনি কি শহিদালি সাহেবের সভায় যাচ্ছেন?
কামর আবদিন তোতলাতে থাকেন, তিনি খুব ভয় পেয়ে গেছেন, বলেন, আআমি বুবুঝতে পারছি না, কিকিন্তু না গিয়ে উউপায় নেই, আমি বেঁচে থাথাকতে চাই, শুনেছি না গিয়ে উডউপায় নেই। আআমি বেঁচে থাকতে চাই ককাকবিতা লিখতে চাই।
হাসান জিজ্ঞেস করে, আপনি কি একদলে যোগ দিচ্ছেন?
কামর বলেন, দলটিল তো আমি বুঝি না, কিন্তু যোগ দিতে বললে যোগ তো দিতেই হবে; এটা প্রতিবাদ করার সময় নয়, বেঁচে থাকার সময়, কবিদের জীবনে একটা সময় আসে যখন বেঁচে থাকাই কবিতা।
হাসান বলে, একাত্তরেও তো আপনি বেঁচে ছিলেন।
কামর কাঁপতে কাঁপতে বলেন, আমি কবিতা লিখতে চাই, কবিতা লেখার জন্যে বেঁচে থাকা দরকার, আমি প্রেমের ভাষা জানি প্রতিবাদের ভাষা জানি না, আমি কবি, পলিটিশিয়ান নাই, বীর নই, বিপ্লবী নই।
খুব সুখে আছে মনে হচ্ছে রাকিব সুলতান; হাসানকে সে ফোন করেছে, দোস্ত, শ্ৰদ্ধেয় শ্যাক শহিদালি সাব যে কবিল্যাখকগো ডাকছেন, চিঠি দিছেন, তুমি তার চিঠি পাইছো নি? তোমারে বাদ দেয় নাই তো?
হাসানের বলতে ইচ্ছে করে সে কোনো চিঠি পায় নি, পাওয়ার সে যোগ্য নয়, কিন্তু ভুল বাঙলায় ধমকের পর ধমকের ভাষায় লেখা চিঠিটি তার সামনে পড়ে আছে, এবং তাকে ধমকাচ্ছে।
সে বলে, পেয়েছি।
রাকিব জিজ্ঞেস করে, তুমি নিশ্চয়ই যাইবা?
হাসান বলে, আমি জানি না।
রাকিব বলে, কও কি, দোস্ত, তুমি জানো না? আমাগো যাইতেই হইবো, সব কবিল্যাখ্যকরাই যাইবো, তোমারেও যাইতে হইবো। রাজাবাদশারা ডাকলে যাইতে হয়, কবিগো কাম ত তাগো বন্দনা করা।
হাসান বলে, হয়তো আমি যাবো না।
রাকিব বলে, কও কি দোস্ত? তোমারে যাইতেই হইবো, দ্যাশে, নতুন দিন আসছে, আমরা কবিরাও নতুন দিন রচনা করবো। কবিগো খালি কবিতা ল্যাখলে চলবো না, দ্যাশে নতুন সোসাইটিও ইস্টাবলিশ করতে হইবো। মহানায়কের প্রত্যেকটি কথা কবিগো মাইন্যা চলতে হইবো, তিনি ত সম্রাট।
হাসান বলে, তুমি যেয়ো।
আলাউদ্দিন রেহমান উদ্বিগ্ন হয়ে চ’লে এসেছে, বলছে, দোস্ত, তুমি নিশ্চয়ই শ্যাক শহিদালির চিঠি পাইছো?
হাসান বলে, হ্যাঁ পেয়েছি।
আলাউদ্দিন বলে, দোস্ত, এখন কী করব? দ্যাশে ত ফ্যাশিবাদ শুরু হইয়া গ্যাছে, তোমারে ত বাইচ্যা থাকতে হইবো।
হাসান বলে, আমি বেঁচে থাকতে চাই, কিন্তু ওই সভায় আমি যাচ্ছি না।
আলাউদ্দিন বলে, দোস্ত, কবিল্যাখকরা সবাই যাইতেছে, দুই চাইরজন মহানায়করে লইয়া পইদ্যও লেইখ্যা ফ্যালছে, আরও হাজার হাজার পইদ্য লিখবো; অরা কায়দে আজম কায়দে মিল্লাতরে বাবা বাবা ডাইক্যা পদ্য লেইখ্যা বাঙলা ভাষার পাছা ফাটাইছে। অয়া আইউব খাঁয় বুনিয়াদি গণতন্ত্ৰ লইয়া পাগল হইছে, দাউদ আদ-মজি পাইছে; আইউব খাঁর দিকে চাইয়া ক্রীতদাসের মতন হাইস্যা প্রাইজ লাইছে। তার রেভোলেশন টেরেনে ওঠছে, আইজ আবার বিপ্লবের নাওয়ে ওঠাবো। তুমি না গ্যালে বিপদে পড়বা, সময় ভাল মনে হইতেছে না, সব সলিউশন কইরা ফ্যালবো।
হাসান চুপ ক’রে থাকে; যদি সে বোবা হয়ে যেতে পারতো!
আলাউদ্দিন বলে, দোস্ত, লাও, বিয়ার খাইয়া আসি, বিয়ারই তোমারে বইল্যা দিবো। তুমি বাচতে চাও না মরতে চাও।
হাসান ওই সভায় যায় না; কিন্তু রাতেই শুনতে পায় শহিদালি কবিলেখকদের ধমকে, দাঁড় করিয়ে, মহানায়কের নামে শ্লোগান দিয়ে, বুঝিয়ে দিয়েছে তাদের একদলে যোগ দেয়া ছাড়া কোনো পথ নেই; কবিতা উপন্যাস নাটক কিছু না, এখন সবই হচ্ছে মহানায়ক, এবং একদল। যারা গিয়েছিলো, তারা সবাই একদলে যোগ দিয়ে এসেছে; অনেকে মঞ্চে উঠে একদল ও মহানায়কের জয়গানও গেয়ে এসেছে, বলেছে মহানায়কই দেশ, রাষ্ট্র, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, তিনিই মহাকাল।
শ্যামলী ফোন করেছে, হাসান, তোমাকে অনেক দিন দেখি না; তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে, শুতে ইচ্ছে করছে।
হাসান বলে, তুমি কিছু মনে কোরো না, আমার কাউকে দেখতে ইচ্ছে করছে না, আমার অন্ধ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।
শ্যামলী বলে, শুতেও ইচ্ছে করছে না?
হাসান বলে, আমার নপুংসক হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে, হয়তো হয়ে গেছি।
শ্যামলী বলে, তা তুমি কখনো হবে না, হাসান, তোমার ওটি কেটে ফেলে দিলেও তুমি পুংসক থাকবে; তোমার একটা না, বারোটা।
হাসান বলে, তোমার এমন কেনো মনে হয়?
শ্যামলী বলে, আমি তোমাকে জানি বলে; তোমার বারোটা আছে, তোমার বারোটাই আমার ভালো লাগে।
হাসান বলে, আমি চাই একটিও না থাক।
শ্যামলী বলে, সত্যিই কি আমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে না?
হাসান বলে, মাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
শ্যামলী বলে, আমি জানতে চেয়েছি আমাকে কি দেখতে ইচ্ছে করছে না?
হাসান বলে, মাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
শ্যামলী জিজ্ঞেস করে, তোমারও একজন মা আছে?
হাসান বলে, তোমার সন্দেহ হচ্ছে কেনো?
শ্যামলী বলে, তুমি তো কোনোদিন মাবাবার কথা বলো নি। আমার বুড়ো হাজব্যান্ডটাও মা বাবার কথা ব’লে কাইন্দা জারে জার হইয়া যায়, বারবার ডান হাতে বা হাতে চোখ মোছে, তার কান্দন দেখে মনে হয় তার মা তারে দুই দিন আগে বিইয়েছে, কিন্তু তুমি তো কখনো বলো নি।
হাসান বলে, আমি তো তোমার হাজব্যান্ড নই।
শ্যামলী বলে, কেনো, আমি তো তোমাকে বলেছি তোমাকে আমি আমার হাজব্যান্ডই মনে করি।
হাসান বলে, তোমাকে ধন্যবাদ যে অন্তত তুমি ওটা মনে করো।
শ্যামলী বলে, সত্যিই বিশ্বাস করো তোমাকে আমি হাজব্যান্ডই মনে করি।
হাসান বলে, আমার খুব ভালো লাগে যে সারাদেশে শুধু আমারই একটি অবিবাহিত স্ত্রী আছে, যে অন্যের স্ত্রী কিন্তু আমাকে হাজব্যান্ড মনে করে।
শ্যামলী বলে, আমি নিজেকে সত্যিই তোমার স্ত্রী মনে করি।
হাসান বলে, সারাদেশে একমাত্র আমার স্ত্রীই অন্য পুরুষের সাথে ঘুমোয়, অন্য পুরুষের সন্তানের জননী হয়।
শ্যামলী বলে, আমার সমস্যা তো তুমি বোঝে।
হাসান বলে, তা বুঝি।
শ্যামলী বলে, তাহলে আমাকে এমন কষ্ট দাও কেনো?
হাসান বলে, আমি খুব খারাপ মানুষ ব’লে।
শ্যামলী বলে, আমার আসতে ইচ্ছে করছে, আমি কি আজি দুপুরে আসবো?
হাসান বলে, এসে কী হবে?
শ্যামলী বলে, হাজব্যান্ডকে কি আমার দেখতে ইচ্ছে করে না, তার সাথে শুতে ইচ্ছে করে না?
হাসান বলে, তারচেয়ে বরং আমিই আসি।
শ্যামলী আঁতকে উঠে বলে, না, না, ফরহাদ সাহেব এসে পড়লে বিশ্রী ঘটনা ঘটবে, জানো তো সে তোমাকে সহ্য করতে পারে না।
হাসান বলে, তাহলে তুমি এসে পড়ো, সারারাত আমার সাথে থাকবে।
শ্যামলী বলে, তুমি তো আমার সমস্যা জানো।
হাসান বলে, সমস্যা সহজেই সমাধান করা যায়।
শ্যামলী বলে, অতো সহজ নয় জীবন, খুবই জটিল।
হাসান বলে, আমি জটিল কবিতা আর সহজ সরল জীবন পছন্দ করি।
শ্যামলী বলে, জানো, গতকাল কী হয়েছে?
হাসান জিজ্ঞেস করে, কী?
শ্যামলী বলে, ফরহাদ সাহেব আমার ওপর উপগত হ’তে চেয়েছিলো।
হাসান বলে, তাহলে নিশ্চয়ই একটি জমজমাট রাত কাটিয়েছো।
শ্যামলী বলে, না, না, আমি রাজি হই নি; তাকে ঢুকতে দিই নি।
হাসান বলে, দিলেও পারতে, তার দাবি আছে, সে তোমার বিবাহিত হাজব্যান্ড, তার কাবিন আছে, ফেরেশতারা ওই ময়লা কাবিন হাতে সারারাত তোমাকে অভিশাপ দিয়েছে।
শ্যামলী বলে, আমি দিতে পারি না; আমি তোমার প্রতি ফেইথফুল থাকতে চাই, অনেস্ট থাকতে চাই।
হাসান বলে, তোমার সতীত্বে প্রাচীন দেবতারা মুগ্ধ হবেন, সতী হিশেবে তোমার নাম দ্যুলোকে ভূলোকে কীর্তিত হবে; স্বৰ্গলোকে তোমার নাম হবে সতী শ্যামলী, বিশশতকের একমাত্র সতী।
শ্যামলী বলে, আমার সমস্যা তুমি বুঝতে চাও না।
হাসান বলে, আমি মাকে দেখতে যেতে চাই।
শ্যামলী জিজ্ঞেস করে, এখনি?
হাসান বলে, তা জানি না।
শ্যামলী জিজ্ঞেস করে, মায়ের মুখ তোমার মনে আছে তো, তাকে চিনতে পারবে তো?
হাসান বলে, আমার মুখ মা নিশ্চয়ই চিনতে পারবে।
শ্যামলী বলে, আমার তা মনে হয় না।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কেনো?
শ্যামলী বলে, আমার মনে হচ্ছে এখন আমিই হয়তো তোমার মুখ চিনতে পারবো না।
হাসান মায়ের মুখটি মনে করতে চেষ্টা করে, কিছুতেই মনে করতে পারে না; মায়ের মুখটি দেখতে ইচ্ছে করলেই ঘুরেফিরে নানা মুখ আসতে থাকে, শ্যামলীর মুখ আসে, অ্যাডের কয়েকটি মডেলের মুখ আসে, অনেক আগে মরো-যাওয়া পাশের বাড়ির এক মহিলার মুখ মনে আসে, যে একবার তার গাছ থেকে বরই পাড়ার জন্যে তাকে ‘চোরা দারোগার পো’ বলে বকেছিলো; কিন্তু মায়ের মুখটি আসে না। মায়ের মুখটি কেমন? মায়ের মুখটি কেমন? মায়ের মুখটি কেমন? সে কল্পনা করার চেষ্টা করে মা তাকে ভাত বেড়ে দিচ্ছে, কিন্তু মায়ের মুখ আসে না; সে কল্পনা করে মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরছে, কিন্তু মায়ের মুখ সে দেখতে পায় না; সে কল্পনা করে ইস্কুল থেকে দেরি ক’রে ফিরছে সে, আর তার মা আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে পথের দিকে তাকিয়ে আছে তাকে দেখবে ব’লে, কিন্তু সে মায়ের মুখটি দেখতে পায় না। আমার মায়ের মুখটি কেমন ছিলো? তার গালে কি কোনো দাগ ছিলো? মারা কি জোড়া ভ্রু ছিলো? মা হাসলে কি গালে টোল পড়তো? মার চোখ দুটি কি তাদের পুকুরের মতো ছিলো? মায়ের মুখে কি একটা অমোচনীয় বিষন্নতা ছিলো? কপালে একটা দুঃখের দাগ ছিলো? তাঁর ঠোঁট কি শুকনো ছিলো, যাতে কখনো চুম্বনের ছোঁয়া লাগে নি?
হাসান জিজ্ঞেস করে, শ্যামলী, তুমি কি বলতে পারো?
শ্যামলী জিজ্ঞেস করে, কী, বলো?
হাসান বলে, আমার মার মুখটি দেখতে কেমন?
শ্যামলী বলে, আমি তো তাকে দেখি নি।
হাসান জিজ্ঞেস করে, আমার মার চোখ কেমন?
শ্যামলী বলে, আমি তো তাকে দেখি নি।
হাসান জিজ্ঞেস করে, আমার মার ঠোঁট কেমন? শ্যা
মলী বলে, আমি তো তাকে দেখি নি।
হাসান জিজ্ঞেস করে, আমার মারা ভ্রু কেমন?
শ্যামলী বলে, আমি তো তাকে দেখি নি।
হাসান বলে, তুমি দেখো নি কেনো? তুমি দেখো নি কেনো? দেখো নি কেনো?
কয়েক দিন পর চারজন শক্তিমান জিন্স ট্রাউজার পাজামা পাঞ্জাবি কৃষক-শ্রমিক আসে হাসানের অফিসে; তাদের চেনে হাসান, তারাও ভালো ক’রেই চেনে হাসানকে। তারা অফিসে ঢোকার পর কলরাবিত বর্ণাঢ্য অফিসটি প্রাচীন অরণ্যের মতো নীরব নিঝুম হয়ে ওঠে, বিবর্ণ হয়ে ওঠে; মনে হয় সবাই গঙ্গার তীরে পদ্মাসনে ব’সে সমাধিমগ্ন ধ্যান করতে শুরু করেছে, চঞ্চল বালিকাদের মতো মুখর বাচাল টেলিফোনগুলোও বটগাছের নিচে সমাধিমগ্ন, দেয়ালের রূপসী মডেলটি হঠাৎ হাসি বন্ধ ক’রে টানটান দেয়াল হয়ে গেছে।
একজন বলে, আপনে শ্ৰদ্ধেয় শ্যাক শহিদালি সাহেবের সভায় যান নাই।
হাসান বলে, হ্যাঁ, আমি সাধারণত নিমন্ত্রণে যাই না।
আরেকজন বলে, ওইটা নিমন্ত্রণ ছিল? বোঝাতে পারেন নাই ওইটা অর্ডার?
হাসান বলে, না, আমি বুঝতে পারি নি।
একজন বলে, দলের অর্ডার অমান্য কইর্যা আপনে অপরাধ করছেন।
হাসান বলে, আদেশ আমার ভালো লাগে না।
আরেকজন বলে, বাচতে হইলে অক্ষরে অক্ষরে অর্ডার মানতে হইবো।
হাসান কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থেকে বলে, বাঁচা সম্ভবত আমার হবে না।
একজন বলে, বেশি সময় আমাগো নাই, একদলে যোগ দ্যাওনের ফর্ম আমরা লাইয়া আসছি, একটা সাইন কইর্যা দ্যান সে আপনে একদলে যোগ দিলেন।
হাসান বলে, আমি তো রাজনীতি করি না, তাই আমার দলে যোগ দেয়ার তো কোনো দরকার নেই।
আরেকজন বলে, রাজনীতি আপনের করতে হইবো না, পলিটিক্স আমরাই করবো, আপনেগো কাম আমাগো সাপোর্ট করা, আমাগো নামে শ্লোগান দেওয়া।
হাসান বলে, আমি কী ক’রে স্বৈরাচারকে সমর্থনা করি?
একজন বলে, সাবধান হইয়া কথা কইয়েন, এইটা স্বৈরাচার না, এইটা গণতন্ত্র এইটা সমাজতন্ত্র, দ্যাশের জইন্যে এইটা দরকার।
আরেকজন বলে, আপনের কোনো ফিউচার নাই মনে হইতেছে, এমন করলে খরচ হইয়া যাইবেন।
একজন বলে, আমাগো টাইম নাই, তরাতিরি একটা সাইন দ্যান।
হাসান বলে, এখন সম্ভবত আমি সাইন দিতে পারবো না।
আরেকজন জিজ্ঞেস করে, কখন পারবেন?
হাসান বলে, একদিন নিশ্চয়ই পারবো, তখন আমি না করবো না, যেখানে সাইন দিতে বলবেন সেখানেই দেবো, তবে তখন হয়তো আমি থাকবো না।
তারা ওঠে, তার চেয়ারেটেবিলে লাথি মারে, বলে, মনে করেন আপনে নাই।
একটি কবিতা কয়েক দিন ধ’রে তার ভেতরে ঘুরছে, ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে যাচ্ছে প্রজাপতির মতো, ফিরে আসছে ডানায় পরাগ মেখে, আবার হারিয়ে যাচ্ছে; আজ তার ইচ্ছে করছে প্রজাপতিটি ধরতে কবিতাটি লিখে ফেলতে, নইলে হয়তো চিরকালের জন্যে হারিয়ে যাবে; সন্ধ্যায় সে বসে কবিতাটি লিখে ফেলতে; অবাক হয় যে সে ঠিকমতো বলপেন ধরতে পারছে না। আমি কীভাবে ধরি বলপয়েন্ট, নিজেকে সে জিজ্ঞেস করে, কীভাবে ধরি? আজি ধরতে পারছি না কেনো? এতো দিন কি আমি বলপয়েন্ট ধ’রে লিখি নি? কলম ধরা কি ভুলে গেছি আমি? হাসান বলপয়েন্টের ঢাকনা খুলে পাশে রেখে বলপয়েন্ট ধরতে চেষ্টা করে, কিন্তু ঠিকমতো ধরতে পারে না। আমি কি লেখার সময় ঢাকনাটা পেছনের দিকে লাগিয়ে নিই? তাতে সুবিধা হয়? পেছনের দিকে লাগিয়ে না নিলে কি আমি লিখতে পারি না? হাসান ঢাকনাটি তুলে বলপয়েন্টের পেছনে লাগিয়ে বলপয়েন্টটি ধরতে চেষ্টা করে; কিন্তু ঠিকমতো ধরতে পারে না। আমি প্রথম কীভাবে লিখতে শিখেছিলাম? একটি মাটির পেন্সিল, তার মনে পড়ে, একটি মাটির শ্লেট, চারদিকে সোনালি কাঠের ঘের, তার মনে পড়ে; বাবা তাকে পেন্সিল ধরতে শিখিয়েছিলেন, বাবার হাত কাঁপছিলো, কিন্তু তার হাত কাঁপছিলো না। সে তো শুরুতেই ঠিকমতো পেন্সিল ধরেছিলো; আজ কেনো পারছে না? আচ্ছা, বলপয়েন্টটাকে যদি আমি মাটির পেন্সিল আর ডায়েরিটাকে স্লেট মনে করি, তাহলে কি ধরতে পারবো? গোড়া থেকে শুরু করবো আবার? হাসান পারে না, তার মনে হয় কলম সে আর ধরতে পারবে না; বলপয়েন্টটিকে তার অচেনা মনে হয়। এরকম কোনো বস্তু আমি আগে কখনো ধরি নি, ধরার অভ্যাস নেই আমার, হাসানের মনে হয়, আমি লেখনি ধরতে জানি না, আমার আদিম পূর্বপুরুষ যেমন এটা ধরতে জানতো না তার মতো আমিও এটা ধরতে জানি না। এটা ভেবে তার ভালো লাগে; হাসান তাকিয়ে থাকে বলপয়েন্টটার দিকে, বলপয়েন্টটিকে তার অচেনা থেকে অচেনোতর মনে হয়, বলপয়েন্টটি একটি লিকলিকে সরীসৃপ হয়ে তার আঙুলে জড়িয়ে যেতে থাকে, তার শরীর কেঁপে ওঠে, ঝাঁকুনি দিয়ে হাসান সেটিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
আলাউদ্দিন রেহমান হুইস্কির গেলাসে চুমুক দিতে দিতে বলে, দোস্ত, তুমি মাসখানেক ঢাকার বাইরে চুপচাপ বেড়াই আসো।
আলাউদ্দিন বলে, ক্লাইমেইট একটু সফ্ট্ হইবো এইর মইধ্যে।
হাসান বলে, আমার মনে হয় কিছুই কোমল হবে না, আমরা ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্কর দুৰ্ঘটনার দিকে যাচ্ছি।
আলাউদ্দিন বলে, দোস্ত, আমারও সেই রকমই মনে হইতাছে।
হাসান বলে, আমি দিকে দিকে রাইফেলের নল দেখতে পাচ্ছি, লেফরাইট লেফরাইট শুনতে পাচ্ছি।
আলাউদ্দিন বলে, দোস্ত, লও, আমিও তোমার লগে বেড়াই আসি।
হাসান কি মাকে দেখতে যাবে আলাউদ্দিনকে নিয়ে? কিন্তু মায়ের মুখই তো মনে পড়ছে না। যদি সে মাকে চিনতে না পারে? মা যদি তাকে চিনতে না পারে?
কোথায় যেতে পারি আমি? আমি কি পরিচিত প্রিয়দের মুখ দেখতে চাই? আমার পরিচিত কারা? প্রিয় কারা? আমার কি কোনো পরিচিত আছে, প্রিয় আছে? মায়ের মুখ দেখলে কি সুখী হবো? মায়ের মুখটি কেমন? আমার যেতে ইচ্ছে করছে এমন কোথাও যেখানে আমাকে কেউ চেনে না, আমি কাউকে চিনি না; সেটা যদি হতো কোনো প্রাচীন আদিম অরণ্য নির্জন দ্বীপ ধুধু চর, সুখী হতাম। সুখী? আমি কি সুখী হ’তে চাই? কোথায় পাবো প্রাচীন অরণ্য? কোথায় নির্জন দ্বীপ? ধুধু চর? কেমন হয়। হাতিয়া? সন্দ্বীপ? মহেশখালি? পদ্মার চর? সেখানে কি নির্জনতা আছে? সেখানে কি মানুষহীনতা আছে? মানুষের মুখ দেখতে ইচ্ছে করছে না; আমি দেখতে চাই পাহাড়, বন, কুঁড়েঘর, নদীর বিষন্ন তীর, কাশবন, পালে পালে গাভীর মুখ, সবুজ ঘাসের প্রান্তর।
পদ্মার একটি চরে একটা উঁচু কুঁড়েঘরে যখন তারা সারাজীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টি কাটাচ্ছিলো, এপাশে ওপাশে কাশবন দেখছিলো, হারিয়ে যাচ্ছিলো কাশফুলের শাদা মেঘের মধ্যে, কাশ ভেঙে চিবোচ্ছিলো, মোটা ভাত আর ইলিশের গানগনে ঝোল ডিম খেয়ে জিভের স্বাদ ফিরে পাচ্ছিলো, এক সন্ধ্যায় একটা ছোটো ডিঙ্গিতে দুই মাঝির সাথে ইলিশ ধরতে গিয়ে ইলিশের ধবধবে শাদা নাচ আর মৃত্যু দেখে সুখী ও কাতর হয়ে উঠছিলো, তখন তারা সংবাদটি পায়। তারা তখন সভ্যতা থেকে বহু দূরে, সভ্যতাকে তারা পায়ের ময়লার মতো ধুয়ে এসেছে; সংবাদ, অ্যাড, রাজনীতি থেকে দূরে থেকে সুস্থ হয়ে উঠছে, তখন সংবাদটি তারা পায়।
এক মাঝি তার ছোটো ট্রানজিস্টরে প্রথম সংবাদটি পায়।
মাঝি ছুটে এসে সংবাদ দেয়, ছার, দ্যাশে খুনখুনি শুরু অইয়া গেছে, সবতেরে মাইর্যা ফ্যালাইছে, সবতেরে মাইর্যা ফ্যালাইছে।
হাসানের মাথার ভেতরে তীব্ৰ অন্ধকারের ঝাকঝাক ছুরি ঢুকে যায়; সে নদী জুড়ে কলকল খলখল অন্ধকার বয়ে যেতে দেখে।
আলাউদ্দিন বলে, না, এইটা হইতে পারে না, এইটা সম্ভব না।
মাঝি বলে, না, ছার, হইছে, অন্যরা দ্যাশ দখল করছে।
আলাউদ্দিন বারবার ঘোষণা শোনে, আর বলে, না, এইটা হইতে পারে না, এইটা সম্ভব না।
হাসান অন্ধকারের কলকল খলখল শুনতে পায়, কলকল খলখল দেখতে পায়।
হাসান বলে হয়তো অসম্ভবই ঘটে গেছে কিছুই অসম্ভব নয়।
আলাউদ্দিন বলে, তাইলে এখন দ্যাশের কি হইবো?
বুটের শব্দ পাচ্ছি, দশকজোড়া বুট।
আলাউদ্দিন আর মাঝিটি ভয় পায়; হাসান বলে, আমি একটু একা থাকতে চাই, নদীর পারে একা হাঁটতে চাই।
আলাউদ্দিন বলে, সাবধানে হাইটো।
হাসান হাঁটতে থাকে, যেনো সে চোখে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু একটি বিশাল লাশ দেখতে পায়; লাশটি একবার নদী হয়ে ওঠে নদীটি একবার লাশ হয়ে ওঠে, চারটি একবার লাশ হয়ে ওঠে। লাশটি একবার চর হয়ে ওঠে।
হাসান নদীকে জিজ্ঞেস করতে থাকে, এরকম কি কথা ছিলো?
হাসান চরকে জিজ্ঞেস করতে থাকে, এরকম কি কথা ছিলো?
নদী আর চর শুধু তার দিকে একটি বিশাল লাশ তুলে ধরে।
অনেক দিন কবিতা লেখি নি হাসান; তার ভেতর গুঞ্জন করে নি কোনো পংক্তি, কোনো চিত্রকল্প জ্ব’লে ওঠে নি স্থির বিদ্যুতের মতো, ঝিলিক দেয় নি কোনো নাচ; মগজটাকে তার মনে হচ্ছে ঝামাপাথর, যেখানে কোনো গুলা জন্মে না, যার ভেতর দিয়ে কোনো নদী বয় না, যার ভেতরে কোনো মেঘ নেই। কিন্তু কবিতা তো লিখতে হবে তাকে–আমাকে কবিতা লিখতে হবে, আমি কবিতা লেখার জন্যে দণ্ডিত, কবিতা লেখাই আমার দণ্ড, আমি যদি এই দণ্ডকে অস্বীকার করি তাহলে অস্বীকার করি নিজেকেই, নিজের জীবনকেই। সব কিছু অস্বীকার করতে পারি। আমি, কিন্তু জীবনকে পারি না, তাই কবিতা লেখাকে অস্বীকার করতে পারি না, হয়তো জীবনকেও পারি অস্বীকার করতে, কিন্তু কবিতা লেখাকে পারি না–জানি আমি জানি এটা সিসিফাসের শ্ৰম, যে-পাথর গড়িয়ে পড়ে যাবে তাকে গড়িয়ে গড়িয়ে পাহাড়ের শিখরে নেয়া; স্বেচ্ছায় আমি, আমার রক্তধারা, এই দণ্ডকে বেছে নিয়েছি, এই দণ্ডের প্রতি সৎ থাকতে হবে আমাকে। আমি জীবনের প্রতি সৎ থাকতে না পারি, জীবনকে আমি শুয়োরের খাদ্যে পরিণত করতে পারি, ঢেলে দিতে পারি নর্দমায়; কিন্তু সৎ থাকতে হবে আমার দণ্ডের প্রতি, কবিতার প্রতি, আর প্রতিটি পংক্তি, ধ্বনি, রূপক, প্রতীক, চিত্রকল্পের প্রতি। কবিতার প্রতি সৎ থাকাই আমার সততা। মানুষের প্রতি মানুষের সৎ থাকা সম্ভব নয়, আমি হয়তো সৎ থাকতে পারি নি মানুষের প্রতি, আমি সৎ নই শ্যামলীর প্রতি, শ্যামলী সৎ নয় আমার প্রতি, অসততাই জীবনের দণ্ড; কিন্তু শিল্পের দণ্ড সততা, তার প্রতি আমাকে সৎ থাকতে হবে, আমাকে সৃষ্টি ক’রে যেতে হবে।
আমি কেনো সৃষ্টি করতে পারছি না? নিষ্ফলা সময় আমার এতো শীঘ্ৰ এসে গেছে? এখনো তো কোনো অনশ্বর মুক্তো ফলাতে পারি নি, ভেতরে তো অনেক রোগ জন্মালো ময়লা ঢুকলো, কিন্তু সেগুলো ঘিরে তো সৃষ্টি হলো না সেই সৌন্দর্য, যা অক্ষয় হয়ে জ্বলজ্বল করবে। ভবিষ্যতের অন্ধকার ভ’রে। আমি কি জীবন দ্বারা আক্রান্ত, জীবন দিয়ে পর্যুদস্ত? মাছি পোকা পশু বেড়াল মানুষের জীবন দিয়ে? ওটা আমি কাউকে বকশিশ দিয়ে দিতে পারি? শিল্পকলার প্রতিপক্ষ কি জীবন? তাহ মনে হচ্ছে আমার- মাছির জীবন আছে, শিল্পকলা নেই; ওই কুকুরগণের জীবন আছে, শিল্পকলা নেই; আর মানুষও সামান্যই দাম দেয় শিল্পকলাকে, তারা চায় ভাত, জল, বিছানা, সঙ্গমের পর সঙ্গম এবং আরো সঙ্গম। আমি, এই আমি, যখনই জীবনের জন্যে বেশি ব্যাকুল হয়েছি, দূরে স’রে গেছে শিল্পকলা; কিন্তু জীবন ছাড়া কার গর্ভে জন্ম নেবে শিল্পকলার ভ্ৰাণ, বাড়বে কার জরায়ুতে, প্রসাবিত হবে কার যোনিদ্বার দিয়ে? এখন যে আমি সৃষ্টি করতে পারছি না, তার অর্থ কি এই নয় যে জীবন আমাকে আলোড়িত করছে না, জীবন আমাকে ক্ষুধার্তা করছে না? ক্ষুধা বোধ করছি না ব’লেই লিখতে পারছি না। কবিতা? আমি চমৎকার ঘুম যাচ্ছি? আমার ঘুমের ক্ষুধা নেই? আমি নিয়মিত পান করছি? আমার পানের ক্ষুধা নেই? আমি মানুষের সঙ্গ পাচ্ছি? আমার সঙ্গলাভের ক্ষুধা নেই? আমি সুস্থ আছি? আমার সুস্থ হওয়ার ক্ষুধা নেই? আমি সঙ্গম করছি? আমার সঙ্গমের ক্ষুধা নেই? কিন্তু কয়েক মাস তো হলো আমি নারী ছুঁই নি ওষ্ঠ ছুঁই নি অভ্যন্তর ছুঁই নি? তবু আমার কেনো ক্ষুধা নেই? তাই কি আমার ভেতর কবিতা নেই?
ভোরে ঘুম ভেঙে হাসান বিছানায় গড়াচ্ছে, মনে মনে বলছে, আজি আটত্রিশ পূর্ণ হলো, কিন্তু কী করতে পেরেছি আমি?
আজ যদি মরে যাই, কী থাকবে? কটি পংক্তি, কটি চিত্রকল্প, কটি রূপক, কটি উপমা? কটি দীর্ঘশ্বাস? কটি চন্দ্রোদয়? কটি সূর্যাস্ত কটি কবিতা?
কিছুই থাকবে না। কিছুই ক’রে উঠতে পারি নি। ব্যর্থতা, শুধু ব্যর্থতা।
মাত্র চারটি কাব্য, দেড় শোর মতো কবিতা। ওগুলার কটি কবিতা?
একজন কবির পক্ষে লেখা সম্ভব কটি কবিতা? দশটি? একশোটি? পাঁচশো?
ব্যর্থতায় কাটিয়ে দিলাম একটি সম্পূর্ণ জীবন?
আমার জীবন সম্পূর্ণ হয়ে গেছে? হ্যাঁ, আজ যদি ম’রে যাই, তাহলে এটাই আমার সম্পূর্ণ জীবন, যার অর্থ শূন্যতা।
কিন্তু আমি সত্যিই বেঁচে থাকতে চাই, কবিতা লিখতে চাই, আরো, আরো।
কিন্তু কবিতা কি আবার আসবে আমার কাছে?
হ’তে হবে সুচারুরূপে দণ্ডিত, বদমাশ? তাহলেই আসবে কবিতা?
কবিতা এখন বদমাশের জঘনেই আটকে থাকতে পছন্দ করে?
কখন আমি হবো বিশুদ্ধ দণ্ডিত, এবং কবি?
বারান্দায় কাজের মেয়েটি পড়ে গেছে, হয়তো ইচ্ছে ক’রেই হয়তো অনিচ্ছায়, এবং গোঙাচ্ছে, তার শব্দ শুনতে পায় হাসান। শব্দটি বেশ ভারিই হয়েছে, চমকে বিছানা থেকে লাফিয়ে ওঠে। সে; গিয়ে দেখে মেয়েটি বসার চেষ্টা করছে, গোঙাচ্ছে, এবং কাঁদছে। মেয়েটিকে কি সে ধ’রে তুলবে? না; মানুষের মাঝেমঝে পতন দরকার, পতন থেকে ওঠা দরকার। হাসানকে দেখে মেয়েটি ভালোভাবে বসার চেষ্টা করছে, পারছে না। মেয়েটি মাথা নিচু ক’রে কাঁদতে থাকে। মাথা নিচু ক’রে কাঁদা হাসান পছন্দ করে না; এভাবে যারা কাঁদে তারা কাঁদতে কাঁদতে জানায় যেনো তারা পুণ্যে পরিপূর্ণ, একটুও পাপ জানে না, পাপী শুধু অন্যরা, অন্যদের জন্যেই তাদের জীবনটা শেষ হয়ে গেলো।
হাসানের ইচ্ছে হয় বলে, গেট আউট, গেট আউট, এসব কান্দাকান্দি আমার ভালো লাগে না, বেরিয়ে যাও; তবে সে তা বলতে পারে না।
মেয়েটি কোনো কথা বলে না; হাসান মেয়েটির মুখ দেখতে পায় না, কিন্তু সে বোঝে কাদঁছে মেয়েটি।
নিষ্পাপ, আহা নিষ্পাপ, পবিত্র মেরি–ঘেন্না লাগে হাসানের।
এই মেয়েটির কান্না কি গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে? কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়; অজস্র মেয়ে কাঁদছে পৃথিবীতে, সে তাদের সবাইকে কান্না থেকে মুক্তি দিতে পারে না; যার কাঁদার সময় এসেছে, সে কাঁদুক; প্রত্যেককে নিজের জন্যে নিজেকেই কাঁদতে হয়। মেয়েটি কাঁদুক, এটা তার জীবন, সে-ই যাপন করুক।
হাসান বাথরুমে ঢুকে সকালের বিরক্তিকর ক্লান্তিকর কাজগুলো করে, মেয়েটির কান্নার কথা তার মনে থাকে না, বেরিয়ে খাবার খায়, জন্মদিন উপলক্ষে টেলিফোনে তিন চারটি শুভেচ্ছা গ্ৰহণ করে, নিজেকে পরিহাস করে বুড়ো আর ব্যর্থ হওয়ার জন্যে, বেরোনোর জন্যে প্রস্তুত হয়, কিন্তু মেয়েটি তখনও বসে আছে বারান্দায়; এবং কাঁদছেও। কান্নাটি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না, মেয়েটি যে যায় নি, সেটাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
হাসান জিজ্ঞেস করে, তুমি এখনো যাও নি?
মেয়েটি আবার কেঁদে ওঠে। হাসান কান্নার দর্শক, সে কান্নার অন্তর্ভুক্ত নয়, তার কাছে মেয়েটির কান্নাকে শিল্পিত ও অ্যাড সম্মত মনে হয় না।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে বলো।
মেয়েটি বলে, আমার মরতে হইবো, ভাইজান।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কেনো?
মেয়েটি বলে, আমার আর ইজ্জত নাই, আমার প্যাট হইছে।
হাসান বলে, পেটে জিনিশ ঢুকলে তো পেট হবেই। কিন্তু কাঁদছো কেনো, তাতে তো আনন্দ করার কথা। বাসায় গিয়ে লালপোড়ে শাড়ি পরে হাসো।
মেয়েটি বলে, আমার ত বিয়া অয় নাই।
হাসান বলে, পেট হ’তে বিয়ে লাগে না, জিনিশ ঢুকলেই পেট হয়।
মেয়েটি কেঁদে বলে, আমার জাইত গ্যাছে, ভাইজান।
হাসান জিজ্ঞেস করে, লোকটি কে?
মেয়েটি বলে, তা বোজতে পারি নাই, তিন চাইর খালুই তা করছে, খালুগো দুই পোলারাও করছে।
হাসানের প্রচণ্ড ঘেন্না লাগে; মেয়েটিকে কি সে লাথি মেরে বের ক’রে দেবে?
হাসান, ঘেন্নায় সে ভরে গেছে, জিজ্ঞেস করে, তখন তো খুব সুখ পেয়েছিলে, তখন তো কাঁদো নি।
মেয়েটি কথা বলে না; দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
হাসান জিজ্ঞেস করে, বলো, সুখ পেয়েছিলে কি না?
মেয়েটি বলে, না, ভাইজান, পাই নাই।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কেনো পাও নি? মে
য়েটি বলে, আমারে টাইন্যা ফেইল্যা কি করছে আমি বোজতে পারি নাই, খালি কষ্ট পাইছি, ব্যাদনায় প্যাট ফাইট্যা পরছে।
মেয়েটিকে আর পীড়ন করতে ইচ্ছে করে না হাসানের। সে জিজ্ঞেস করে, তুমি তাদের বলো নি?
মেয়েটি বলে, কইছি, তারা আমারে মাইর্যা খেদাই দিছে।
হাসান জিজ্ঞেস করে, এখন কী করবে?
মেয়েটি কেঁদে ওঠে, মরুম, ভাইজান।
হাসান জিজ্ঞেস করে, মরতে হবে কেনো?
মেয়েটি বলে, আমারে অহন, কে জায়গা দিবো?
হাসান জিজ্ঞেস করে, তুমি কি পেটের জিনিশটা ফেলে দিতে চাও?
মেয়েটি বলে, হ, ভাইজান, তয় কই ট্যাকা পামু, কোনহানে গিয়া ফালামু?
হাসান বলে, একটি মানুষ আসবে, তাকে তুমি ফেলে দিতে চাও?
মেয়েটি বলে, অইটা ত মানুষ হইব না, ভাইজান, অইটা জাউরা হইব; অইটারে আমি কোনহানে গিয়া ফালামু?
হাসান কি নিজেই জানে কোথায় গিয়ে ফেলতে হয়? এটা না ফেললে মরতে হবে মেয়েটিকে? পেটের ভেতর এমন ভয়ঙ্কর বস্তু ঘনীভূত হয়? জন্ম নেয় সাপ? সে কি মেয়েটিকে বাঁচাবে? কীভাবে বাঁচাবে? ওর বাঁচার কী দরকার?
হাসান বলে, তুমি একটি কাজ করতে পারো।
মেয়েটি বলে, কি কাম, ভাইজান?
হাসান বলে, রেল ইস্টেশনে গিয়ে গাড়ির নিচে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারো।
মেয়েটি বলে, ভাইজান, আমার বাইচা থাকতে মন লয়।
হাসান বলে, তুমি কাল এসো, দেখি আমি কিছু করতে পারি কি না।
হাসান দুপুরে অফিস থেকে বেরোয়; তার মনে পড়ে আজ তার জন্মদিন, সে বেরোচ্ছে একটি জন্মকে প্রতিহত করার জন্যে, তার বেশ ভালো লাগে, জন্মে জন্মে জন্মে জন্মে দুঃখে দুঃখে দুঃখে দুঃখে পৃথিবী ভ’রে গেছে, আর জন্মের দরকার নেই, নিজেকে তার বুদ্ধ মনে হয়, সে জন্মচক্র থেকে একটি আত্মার নির্বাণ লাভের উপায় খুঁজতে বেরিয়েছে, কোনো অরণ্যে নয় মহাশহরে, উপায় তাকে বের করতেই হবে, নির্বাণ, অন্তত একজনের মহানির্বাণ, যে আসে নি তার নির্বাণ, সমস্ত দুঃখ কামনা বাসনা ক্ষুধা তৃষ্ণাহীন অপাপবিদ্ধ নির্বাণ। জন্ম এমন কি মহান ব্যাপার? জন্মই তো একমাত্র বিশুদ্ধ দুর্ঘটনা। মানুষ, করুণ মানুষ, দুর্ঘটনা ও দুঃখের সন্তান, তুমি কি জানো না সব কিছুর শ্রেষ্ঠ হচ্ছে জন্ম না নেয়া, কখনো ভ্ৰাণ না হওয়া, কিছুই না হওয়া; আর দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ হচ্ছে জন্মের পরপরই ম’রে যাওয়া? রিকশা নিয়ে মগবাজার হাতিরপুল মোহাম্মদপুর গুলিস্থান আজিমপুর লালমাটিয়ার পথে পথে সে জন্ম প্রতিহত করার অ্যাড দেখতে পায়, একেকবার রিকশা থেকে নেমে পড়তে চায়, কিন্তু নেমে পড়তে পড়তে নামে না: অ্যাডগুলো সে মুগ্ধ হয়ে পড়তে থাকে, এমন অ্যাড সে কখনো লেখে নি, এমন উপকারী অ্যাড, নির্বাণলাভের অ্যাড, বুদ্ধের সক্রিয়তা দেখে সে মুগ্ধ হয়, শেষে সে একটি ক্লিনিকের সামনে নেমে পড়ে।
রিসিপশনিস্ট মেয়েটি তার দিকে গোলগোল চোখে তাকায়।
হাসান বলে, এখানে কি নির্বাণলাভের উপায় আছে?
মেয়েটি তার কথা বুঝতে পারে না, জিজ্ঞেস করে, কিসের উপায় আছে?
হাসান বলে, এমআর, এখানে কি এমআর করানো সম্ভব?
মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, কবে করাইবেন? আইজই করাইতে চান?
হাসান বলে, না, আজ না।
মেয়েটি একটি ফর্ম বের করে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, এইটা ফিলাপ কইর্যা দ্যান।
কী নাম লিখবে সে মেয়েটির? সে কি তার নাম জানে? কী নাম মেয়েটির? কী নাম মেয়েটির? সে মেয়েটির নাম মনে করতে পারে না; সে কি মেয়েটির নাম কখনো শুনেছে? কিন্তু একটা নাম তো লাগবে, নাম ছাড়া তো ফর্ম পূরণ হবে না; হাসান ধীরেধীরে লেখে— শ্যামলী ফরহাদ।
হাসান অবাক হয়, এ-নামটি অনেক দিন তার মনে পড়ে নি, এইমাত্র মনে পড়লো, এবং অবলীলায় লিখে ফেললো।
স্বামী? হাসান ধীরে ধীরে লেখে–মোহাম্মদ ফরহাদ আলি।
এটা কি শ্যামলীর হাজব্যান্ডের নাম? তার কি ঠিক মনে পড়ছে না, না কি সে ইচ্ছে ক’রেই ভুলে যাচ্ছে?
ফর্মটি পূরণ ক’রে সে রিসিপশনিস্টের হাতে দেয়।
মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, আপনের ওয়াইফ?
হাসান বলে, হ্যাঁ।
মেয়েটি ফর্মে একরাশ লেখা লেখে, শেষ হ’লে একটা অংশ ছিঁড়ে তার হাতে দিয়ে বলে, আইজ পাঁচশ ট্যাকা লাগবো, করনের দিন তিন হাজার ট্যাকা লাগবো।
হাসান পকেট থেকে বের করে তার হাতে টাকাটা দেয়।
মেয়েটি বলে, পাঁচ দিন পর ডেট দিলাম, আপনের ওয়াইফের প্র্যাগনেন্সি রিপোর্ট লইয়া আসবেন।
পাঁচটি দিন খুব চমৎকার লাগতে থাকে হাসানের; দুটি শব্দ তার মাথার ভেতরে ঘুরে ঘুরে তাকে সুখে ভরিয়ে রাখে : বুদ্ধ, নির্বাণ। আমি বুদ্ধ, আমি নির্বাণদাতা; যেজন্মে নি, তাকে নির্বাণের উপায় বের ক’রে দিচ্ছি। আমি, তার কোনো দুঃখ থাকবে না, তাকে ঘুরতে হবে না জীবনচক্ৰে, বন্দী হবে না, সে, বন্দী হবে না। তার আত্মা, থাকবে। চিরমুক্ত; তার নির্বাণের উপায় বের করেছি। আমি, লোভ কামনা বাসনা তাকে পীড়িত করবে না, সে হবে নির্লোেভ নিষ্কাম, তাকে জন্ম দিতে হচ্ছে না, তাকে দিচ্ছি। আমি পরিনির্বাণ, জন্মের আগেই সে অর্জন করবে বুদ্ধত্ব, অর্জন করবে। শূন্যতা; সে জানবে না। ক্লান্তি জ্বর যন্ত্রণা, তাকে কোনো ব্যাধি দহন করবে না; চিরশান্তির শূন্যতায় সে থাকবে চিরপরিপূর্ণ। সে জন্ম নেবে না, সব কিছুর শ্রেষ্ঠ যা, সে তা অর্জন করবে। আমি কি এমন নির্বাণ লাভ করতে পারি, পেতে পারি চিরশূন্যতা, মহাশূন্যতা? পারি না? আমার জন্যে নির্বাণ নয়? অনির্বাণ? অনির্বাণ জন্মচক্র? দুঃখচক্র? সব কিছুর শ্ৰেষ্ঠ আমার জন্যে নয়? এমনকি দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ও নয়। আমার জন্যে?
পাঁচদিন পর সন্ধ্যায় সে কাজের মেয়েটিকে নিয়ে ক্লিনিকে উপস্থিত হয়।
ডাক্তার মেয়েটি বেশ স্বাস্থ্যবতী, তাকে দেখেই বিশ্বাস হয় সে পারবে, সে নির্বাণ দিতে পারবে; তার হাত টেনে বের ক’রে ফেলতে পারবে সব কিছু।
ডাক্তার মেয়েটি বলে, আপনে চিন্তা করবেন না, ওয়েটিং রুমে ওয়েট করেন, পাঁচ মিনিটের ব্যাপার।
নার্সটি বলে, আপনে বইস্যা থাকেন, আপনের ওয়াইফের হইয়া গেলেই আপনেরে ডাকুম।
ওরা মেয়েটিকে নিয়ে ও-টিতে ঢুকে যায়; হাসান ওয়েটিং রুমে বসে থাকে। বেরিয়ে পড়ি, হাসানের মনে হয়, বেরিয়ে পড়ি, প্রতিটি মিনিটকে আমার একেকটি জন্ম মনে হচ্ছে, আমি জন্মচক্রে আটকে গেছি, আমি মুক্তি পাচ্ছি না, আমার নির্বাণ দরকার, বেরিয়ে পড়ি আমি।
পনেরো মিনিটে হাসান পনেরো হাজার পনেরো লক্ষ পনেরো কোটি জন্মচক্র অতিবাহিত করে; তারপরও তার জন্মচক্র থামে না।
নার্সটি দৌড়ে এসে বলে, হইয়া গ্যাছে, আপনের ওয়াইফের পাশে আসেন।
নির্বাণ, নির্বাণ। পনেরো মিনিটেই নির্বাণ লাভ হয়ে গেছে?
একটি ছোটো ঘরে হাসানকে নিয়ে যায় নার্স, দেখে মেয়েটি একটি বেডের ওপর শুয়ে থারথার ক’রে কাঁপছে, গোঙাচ্ছে।
নির্বাণ, নির্বাণ। নির্বাণদানের একটু যন্ত্রণা তো থাকবেই।
নার্স বলে, আমি যাই, আধঘণ্টার মইধ্যেই সব ঠিক হইয়া যাইবো। আপনে আপনের ওয়াইফের শরিলটা টিপ্পা দ্যান।
নির্বাণ, নির্বাণ। আমি কি নির্বাণ, পেতে পারি?
মেয়েটি গোঙাচ্ছে, থারথার ক’রে কাঁপছে, ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে।
সে কি কখনো কারো শরীর টিপেছে? সে কি টিপতে পারবে? তার হাতের ছোঁয়ায় মেয়েটি যদি লাফিয়ে ওঠে? মেয়েটির শরীরের ছোঁয়ায় তার হাত যদি বমি করতে শুরু করে? হাসান মেয়েটিকে টিপতে শুরু করে–বেশ মসৃণ মেয়েটি; তার পায়ের পাতা থেকে শুরু ক’রে ওপর থেকে ওপরের দিকে টিপতে থাকে, মেয়েটির শরীর থেকে একটা থারথার কম্পন্ন ঢুকতে থাকে তার চামড়ার ভেতরে; হাসান তার পা, উরু, বুক, মুখ, হাত, পিঠ, কাঁধ ধীরেধীরে টেপে, মেয়েটি আরো থারথার কাঁপতে থাকে।
কাঁপতে কাঁপতে মেয়েটি বলে, আমারে জোরে জরাইয়া ধরেন।
জোরে ধরতে হবে মেয়েটিকে? হাসানের মনে পড়তে থাকে খালু, খালু, খালু, খালুর পোলারা। তারাও হয়তো জোরে ধ’রেই চিৎ করেছিলো তাকে, তারপর হয়তো একমিনিট দুই মিনিট। না কি ঘন্টার পর ঘণ্টা? রান্নাঘরে? বাথরুমে? বারান্দায়? বেডরুমে? মেয়েটি তখন চিৎকার ক’রে ওঠে নি কেনো? সুখ লাগছিলো? তীব্ৰ সুখ? পরম সুখ? চরম সুখ? শীৎকারে চিৎকারে অন্য রকমে থরথর করছিলো সে? চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিলো? খালুদের, খালুদের পোলাদের সে জড়িয়ে ধরেছিলো? এখন তাকে জড়িয়ে ধরতে হবে হাসানকে? হাসানের ইচ্ছে হয় মেয়েটিকে ঠেলে ফেলে বেরিয়ে যেতে; কিন্তু সে পারে না, মেয়েটিকে জোরে জড়িয়ে ধ’রে বসে থাকে, তার হাত দুটি যেনো মাংসের নয়, জংধরা লোহার, ডাইনামোর মতো কাঁপছে মেয়েটি। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই মেয়েটি উঠে বসে; হাসানের ইচ্ছে হচ্ছিলো মেয়েটি অনন্তকাল ধ’রে কাপুক এভাবে, তার সমস্ত সুখ অনন্তকাল ধ’রে কাঁপাক তাকে; কিন্তু যন্ত্রণাও চিরস্থায়ী নয়। নির্বাণলাভের উপায়ের খুবই উন্নতি ঘটেছে–বুদ্ধ এটা খুবই পছন্দ করতেন; জন্মজন্মান্তর লাগে না, গরু মেষ কুকুর হয়ে জন্মাতে হয় না, এক জন্মেই পরিনির্বাণ। একটু পরেই মেয়েটি স্বাভাবিকভাবে হেঁটে বেরোয় ক্লিনিক থেকে।
হাসানের ইচ্ছে হয়, মেয়েটিকে নিয়ে সে বারে গিয়ে বিয়ার খায়, মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করে, জিজ্ঞেস করে তার এখনো কষ্ট হচ্ছে কি না, ইচ্ছে হয় তার সাথে কবিতা নিয়ে কথা বলে, মেয়েটিকে একটির পর একটি কবিতা শোনায়, বদলেয়রের কবিতা মেয়েটির কেমন লাগে জিজ্ঞেস করে; কিন্তু হাসান এসব করে না, সে মেয়েটির হাতে একটি একশো টাকার নোট দিয়ে বলে, তুমি যাও, কাল থেকে আর এসো না।
মেয়েটি একবার পথে বসে পড়ে; কোনো কথা বলে না।
হাসান হাঁটতে থাকে; বেশ লাগছে তার, সে একজনকে নির্বাণ দিয়েছে, কিন্তু তাকে হাঁটতে হবে নির্বাণলাভের জন্যে। সে নির্বাণের জন্যে হাঁটছে, তখন অনেক দিন পর একটি কবিতার পংক্তি স্বপ্নের মতো আসে তার কাছে, গাছপালার অন্ধকারের ভেতর দিয়ে জোনাকির মতো আসে চিত্রকল্পের গুচ্ছ। সে হেঁটে হেঁটে মনে মনে কবিতাটি লিখতে থাকে, তাকে কয়েক মাইল হাঁটতে হবে, সে দেখতে পায় তার হাঁটার সাথে সাথে গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে শব্দ, বাক্য; পুরো কবিতাটিই লেখা হয়ে যাচ্ছে যেনো মাথার ভেতরে; এবং সে ভয় পেতে থাকে, মাথার ভেতরে লেখা এই কবিতা যখন কাগজে লিখবো, তখন এটি থাকবে তো, থাকবে তো? কবিতাটির সাথে খেলতে খেলতে সে হাঁটছে, তখন আকাশে অসংখ্য বীজ বেজে উঠতে থাকে, বিদ্যুতে ফালাফালা হয়ে যেতে থাকে আকাশের অন্ধকার, এবং আকাশ ভেঙে গ’লে উপচে বৃষ্টি নামে। এটা কী মাস? আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র? বৃষ্টির কথা মনে হ’লেই মাসের বাঙলা নামগুলো মনে পড়ে কেনো? অন্য সময় যে মনে পড়ে বিদেশি নামগুলো? পুরো শহর ভয় পেয়ে গেছে, সবাই ছুটছে, রিকশাগুলো চলছে ট্রাকের সাথে পাল্লা দিয়ে; হাসান হাঁটছে, কয়েক মিনিটেই থৈথৈ পথঘাট, বৃষ্টির কালো উজ্জ্বল আদরে সম্পূর্ণ ভিজে গেছে সে, তার মনে হয়। জ্যৈষ্ঠের জোয়ার এসেছে, শহরের পথেপথে ঢুকছে জোয়ারের জল, এখনই হয়তো সামনে লাফিয়ে উঠবে একটি বোয়াল। কবিতাটি ভিজছে তার মাথার ভেতরে, একটা গাছের ডাল ভেঙে পড়লো তার সামনে, এবং অনেক দিন পর তার মনে পড়লো গাছের পাতার রঙ সবুজ। অনেক দিন আমি সবুজ দেখি নি, সে একগুচ্ছ পাতা কুড়িয়ে নিয়ে বুকপকেটে রাখলো, মনে মনে বললো, সবুজ, আমার বুকের ভেতর ঢোকো। সারা শহর বৃষ্টিতে অন্ধকার হয়ে গেছে, সারা জগত বৃষ্টিতে আলোকিত হয়ে গেছে; অপূর্ব অন্ধকার ঢুকছে তার মগজে অপূর্ব আলো ঢুকছে তার মাংসে, ভেতরে ঢুকছে বীজ বিদ্যুৎ জল মেঘ। বৃষ্টির ভেতর দিয়ে জলের ওপর দিয়ে ভিজে ভিজে একটি কবিতা মাথায় নিয়ে এগোতে থাকে হাসান; সে জামা খুলে ছুড়ে দেয় রাস্তায়, ইচ্ছে হয় জিন্সটিও খুলে ফেলতে, সম্পূৰ্ণ নৈসর্গিক হয়ে যেতে, একবার হাত রাখে বেল্টে, হাত সরিয়ে নেয়, সরাসরি বৃষ্টি এসে অজস্র আঙুলে আদর করতে থাকে তার শরীর, তার মনে হয় বৃষ্টি প্রবল হয়ে উঠেছে তার বেল্ট ছিঁড়ে ফেড়ে জিপ টেনে তার জিন্স খুলে ফেলার জন্যে, তার সর্বাঙ্গ ধুয়ে দেয়ার জন্যে; ধুয়ে যাচ্ছে তার উধ্বাঙ্গের ময়লা, সজীব হয়ে উঠছে তার ত্বক, তার রক্তের ভেতরে বৃষ্টি, বৃষ্টি।
কয়েকটি দিনে হাসান একগুচ্ছকবিতা লিখে ওঠে; একটির পর একটি কবিতা আসতে থাকে, সে লেখে। এমন স্রোত অনেক দিন আসে নি; সে স্রোতে নিজেকে
প্রতিটি সরল পংক্তি ভ’রে আছে জটিল যন্ত্রণায়। আমি তো সরল পংক্তিতে সরল কবিতা লিখতে চাই, সুখ লিখতে চাই; কিন্তু আমি যন্ত্রণা লিখছি কেনো?
আমার উক্তি ও উপলব্ধির মধ্যে কি অভেদ ঘটছে না? তাই তো মনে হচ্ছে, সরল পংক্তিতে সরল সুখ আসছে না কেনো?
আমি সৎ হয়ে উঠতে চাই, আন্তরিক হতে চাই। আমি কি সৎ হয়ে উঠছি, আন্তরিক হয়ে উঠছি? সততা সততা আন্তরিকতা আন্তরিকতা কবিতা কবিতা।
এখন থেকে আমার কবিতা হবে সততার কবিতা, আন্তরিকতার কবিতা।
আগে কি আমি ছিলাম না সৎ, ছিলাম না আন্তরিক?
ছিলাম, কিন্তু দ্বিধা ছিলো, একটা দ্বিধা ছিলো, দ্বিধা ছিলো।
এখন আমি অনেক বেশি সৎ, অনেক বেশি আন্তরিক।
কিন্তু জীবনে কি আমি সৎ হ’তে পেরেছি, আন্তরিক হ’তে পেরেছি?
শ্যামলীর সাথে আমার সম্পর্ক কি সৎ, শ্যামলীর সাথে আমার সম্পর্ক কি আন্তরিক?
জীবন সততার স্থল নয়? আন্তরিকতার অঞ্চল নয়? জীবন শুধুই অসততা? অনান্তরিকতা?
জীবনে সৎ হ’লে বিপর্যয় ঘটে? তাই থাকতে হয় অসৎ?
শ্যামলীকে আমার দেখতে ইচ্ছে করছে, তার সাথে একটি দুপুরই তো আমার অনন্তকাল, সে-ই তো আমাকে জীবনের সম্পদ দিয়েছে, কিন্তু তার ডাকে আমি সাড়া দিচ্ছি না? কেনো? আমার ভেতর সাড়া জাগছে না কেনো? এক সময় তো আমি সাড়া দিতাম যেমন ঘাস সাড়া দেয় বৃষ্টির ছোঁয়ায়, নদী সাড়া দেয় জোয়ারে; আজ কি আমি ঘাস নই, নদী নই? শ্যামলীর সাথে কি আমি ছিন্ন হ’তে চাই? ছিন্ন হ’লে আমার কী থাকে? গুচ্ছগুচ্ছ কবিতা যে আমার ভেতরে জন্মেছে শ্যামলীর পায়ের শব্দে, জন্মেছে তার গালের আলোতে, সেগুলো কি ব্যথিত হবে না? আর আমার সেই আশ্চর্য ক্ষুধা, তার আশ্চর্য খাদ্য তো জুগিয়েছে সে-ই। তার থেকে ছিন্ন হ’লে কী থাকে আমার? থাকি আমি? কিন্তু সৎ যে আমাকে হ’তে হবে কবিতার প্রতি সৎ জীবনের প্রতি সৎ প্রেমের প্রতি সৎ।
কয়েক দিন ধ’রেই শ্যামলী একটি দুপুর চাচ্ছে, মাত্র একটি দুপুর।
হাসান বলছে, শুধু একটি দুপুর কেনো? সারাদিন নয় কেনো? সারারাত নয় কেনো? সারা বছর নয় কেনো? সারা জীবন নয় কেনো? সারা মৃত্যু নয় কেনো?
শ্যামলী বলছে, আমার সমস্যা তুমি জানো, তারপরও আমাকে বিব্রত করো। আমাকে বিব্রত ক’রে তুমি কী সুখ পাও?
হাসান বলছে তুমি তো মনে করো তুমি আমার স্ত্রী।
শ্যামলী বলছে, হ্যাঁ, তা তো মনে করিই।
হাসান বলছে, তাহলে তোমাকে সারাদিন, সারারাত, সারা জীবনের জন্য ডাকবো না কেনো?
শ্যামলী বলছে, তুমি আমাকে বিশ্বাস করো; আমি সত্যিই মনে করি আমি তোমার স্ত্রী তুমি আমার হাজব্যান্ড।
হাসান বলছে, আমি যে একটি স্ত্রীর জন্যে পাগল, তা নয়। হাজব্যান্ড হওয়ার জন্যে আমি যে ব্যগ্র, তাও নয়।
শ্যামলী বলছে, তাহলে তো সব ঠিক আছে, আমি তোমার আছি তুমি আমার আছো, কোনো সমস্যা নেই।
হাসান বলছে না, সব ঠিক নেই; আমার মনে হচ্ছে সব ঠিক নেই।
শ্যামলী বলছে, কেনো ঠিক থাকবে না? আমি তো তোমার প্রতি সৎ, তোমার প্রতি ফেইথফুল, আমি অনেস্ট।
হাসান বলছে, না, আমরা সৎ নই।
শ্যামলী বলছে, না, আমরা সৎ, আমরা দুজনেই সৎ।
হাসান বলছে, তাহলে আমরা সততা কাকে বলে জানি না।
শ্যামলী বলছে, দুপুরে আমি আসবো।
হাসান বলছে, আসার কোনো দরকার নেই।
শ্যামলী বলছে, তুমি থাকবে, তুমি না থাকলে আমি তোমার দরোজার সামনে কুকুরের মতো শুয়ে থাকবো।
হাসান বলছে, তা তুমি পারবে না।
দুপুরে কি হাসান থাকবে? থেকে কী হবে? এর চেয়ে অনেক ভালো অ্যান্ড ২০০০এ গিয়ে স্পন্সরদের সাথে কথা বলা, অধস্তনদের পরামর্শ দেয়া, দু-একটি মাংসল মডেলের সাথে নিরর্থক দার্শনিক আলাপ করা। ওই মাংসল মেয়েগুলো দর্শন খুব পছন্দ করে; ওরা অবাক হয়, ওরাও মাংসে স্তনে ঠোঁটে ক্লান্ত; আত্মহত্যার দর্শন শুনতে ওদেরও ভালো লাগে। কিন্তু হাসান বেরোতে পারে না, বেরোনোর জন্যে পোশাকটোশাক প’রে আবার খুলে ফেলে; টেলিফোনে জানিয়ে দেয় দুপুরে সে আসবে না, আসবে সন্ধ্যায়।
দুপুরে শ্যামলী আসে; তারা এক সাথে খায় এবং ঘুমোয়। ঘুম শব্দটির অর্থ বদলে গেছে, অভিধানে একদিন নতুন অর্থটি মিলবে; প্রতিমুহুর্তে প্রতিটি রক্তকণিকার জেগে থাকার নাম হচ্ছে ঘুম। ঘুমের পর তারা গড়াচ্ছে, শ্যামলীর একটি হাত প’ড়ে আছে হাসানের বুকের ওপর, হাসানের একটি পা পড়ে আছে শ্যামলীর দু-পায়ের ভেতরে।
শ্যামলী বলে, আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমার শরীর তোমার শরীরকে ভালোবাসে, আমার হৃদয় তোমার হৃদয়কে ভালোবাসে।
হাসান বলে, শরীর আর প্রেম আর হৃদয় আমাকে ক্লান্ত করছে।
শ্যামলী বলে, কেনো ক্লান্ত হবে? আমি কি সুখকর নাই?
হাসান বলে, আমি সম্ভবত শরীর থেকে মুক্তি চাই প্রেম থেকে মুক্তি চাই।
শ্যামলী বলে, কিন্তু একটু আগে আমরা যে সুখে ছিলাম, তাতে তো মনে হয় না তুমি শরীর থেকে মুক্তি চাও প্রেম থেকে মুক্তি চাও।
হাসান বলে, শ্যামলী, আমি সৎ হতে চাই।
শ্যামলী বলে, তুমি তো সৎ আছেই, তোমার থেকে সৎ কে আছে?
হাসান বলে, আমার মনে হচ্ছে আমি সৎ নই।
শ্যামলী বলে, আমি জানি তুমি সৎ।
হাসান বলে, আমাদের সম্পর্ক সৎ নয়; আমরা পরস্পরের প্রতি সৎ নই।
শ্যামলী বলে, আমাদের সম্পর্ক সৎ পরস্পরের প্রতি আমরা সৎ।
হাসান বলে, না, না, আমরা সৎ নাই; পরস্পরের প্রতি আমরা সৎ নই।
হাসান একটি সিগারেট ধরায়, সিগারেটের ধুয়ো আটকে যেতে চায় তার গলায়, সিগারেট কি ছেড়ে দিতে হবে?–সে সিগারেটটি ছাইদানিতে চেপে রেখে টেলিফোন করতে শুরু করে, সিগারেট নেভে না।
শ্যামলী জিজ্ঞেস করে, তুমি কাকে ফোন করছো?
হাসান বলে, মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন খান সাহেবকে।
শ্যামলী চমকে লাফিয়ে উঠে হাসানের হাত ধ’রে ফেলে, এবং বলে, না, না, তুমি এখন ফরহাদ সাহেবকে ফোন করতে পারো না, তুমি তাকে ফোন করতে পারো না, তুমি তাকে ফোন করো না।
হাসান বলে, আমি সৎ হ’তে চাই।
শ্যামলী হাসানের হাত থেকে রিসিভার টেনে নিতে চায়, পারে না, আবার চেষ্টা করে, পারে না; সে চিৎকার করে, তুমি তাকে ফোন কোরো না; একটা বড়ো বিপর্যয় ঘটে যাবে, তুমি তাকে ফোন কোরো না।
হাসান বলে, বিপর্যয়ের মধ্যেই তো আমরা আছি।
শ্যামলী বলে, না, তুমি ফোন করলে বিপর্যয় শুরু হবে, আমি ধ্বংস হয়ে যাবো, আমি শেষ হয়ে যাবো।
হাসান বলে, তুমি এতো ভয় পাচ্ছে কেনো? ভয়ের কিছু নেই, তার সাথে কথা ব’লে আমি সৎ হ’তে চাই; আমাদের সম্পর্ককে সৎ করতে চাই।
শ্যামলী বলে, তুমি জানো না, এতে আমার বিয়ে ভেঙে যাবে, আমার বিপদের শেষ থাকবে না।
হাসান বলে, অসৎ বিয়ের থেকে সৎ ভেঙে যাওয়া অনেক ভালো, শ্যামলী; এসো আমরা সৎ হই পরস্পরের প্রতি।
শ্যামলী বলে, আমি বিয়ে ভাঙতে চাই না, অসৎ হ’লেও আমি বিয়ে টিকিয়ে রাখতে চাই।
হাসান বলে, আমি অসততায় থাকতে চাই না, আমি ম’রে যাচ্ছি।
শ্যামলী কেঁদে ওঠে, চুলে মুখ ঢেকে নগ্ন সে মেঝেতে বসে পড়ে।
ওই দিকে কে যেনো টেলিফোন ধরেছে–কর্কশ কণ্ঠে হ্যাঁলো, হ্যাঁলো বলছে।
হাসান বলে, আমি হাসান রশিদ বলছি, আমি একটু মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন খানের সাথে কথা বলতে চাই।
শ্যামলী নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে।
লোকটি বলে, বাস্টার্ড, তুই আমারে ফোন করছিছ ক্যান?
হাসান বলে, আপনার সাথে আমার একটু কথা ছিলো।
ফরহাদ খান বলেন, তুই হারামজাদা আমার লাইফটারে হেল কইর্যা দিচ্ছ, বাস্টার্ড, আই সাফার্ড এ লট ফর ইউ।
হাঁটুর ওপর মাথা রেখে নগ্ন শ্যামলী নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে।
হাসান বলে, আমি সৎ হ’তে চাই, তাই আপনাকে ফোন করেছি।
ফরহাদ খান বলেন, ইউ বাস্টার্ড, তুই চাছ সৎ হইতে, ইউ আর এ ডিজঅনেস্ট বাস্টার্ড, আই শ্যাল কিল ইউ।
হাসান বলে, আপনি জানেন আপনার স্ত্রী শ্যামলী আপনাকে ভালোবাসে না?
ফরহাদ হাসান বলেন, বাস্টার্ড, সেইটা তর লগে আমি আলাপ করুম ক্যান?
হাসান বলে, আপনি জানেন শ্যামলী আমাকে ভালোবাসে?
ফরহাদ খান বলেন, ইউ বাস্টার্ড, আই শ্যাল টিচ ইউ এ গুড লেসন।
শ্যামলী স্তব্ধ হয়ে বসে আছে; সে কিছু দেখছে না। সে কিছু শুনছে না।
হাসান বলে, দশ বছর আগেই আমার উচিত ছিলো আপনার সাথে কথা বলা, কিন্তু তখন আমি সৎ ছিলাম না, এখন আমি সৎ হ’তে চাই।
ফরহাদ খান বলেন, তর সৎ হওয়া আমি তর পাছা দিয়ে ঢুকাই দিমু।
হাসান বলে, শ্যামলী আমার সাথেই থাকবে।
ফরহাদ খান বলেন, শ্যামলী আমার ওয়াইফ, সে তার লগে থাকবো ক্যানরে হারামজাদা?
ফরহাদ খান ফোন রেখে দেন; কিন্তু হাসান বলতে থাকে, আপনি কিছু মনে করবেন না, আমি সৎ হতে চাই, আমি সৎ হতে চাই; তাই আপনাকে ফোন করেছি, আপনাকে কষ্ট দিতে চাই নি।
শ্যামলী উঠে দাঁড়ায়, নিঃশব্দে কাপড় পরে।
হাসান বলে, এখন আমরা সৎ, আমাদের সম্পর্ক সৎ।
শ্যামলী বলে, তুমি একটা শয়তান।
হাসান বলে, আমি শয়তান ছিলাম, শ্যামলী, এখন আমি সৎ, দেবতাদের থেকেও সৎ। তুমি একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবে।
শ্যামলী বলে, তুমি আমার সংসারটা নষ্ট ক’রে দিলে।
হাসান বলে, তুমি এখানে থাকো, আমরা সৎভাবে ভালোবাসবো।
শ্যামলী বলে, তোমার সাথে আমি থাকতে পারি না, তোমার ভালোবাসা আমার লাগবে না।
হাসান জিজ্ঞেস করে, কেনো?
শ্যামলী বলে, আমার সংসার আছে, ছেলেমেয়ে আছে।
হাসান বলে, আমরা আজ অসততা থেকে মুক্ত হলাম। আমার ভালো লাগছে আমি আর অসৎ নাই, আমি সৎ হ’তে পেরেছি।
শ্যামলী একদলা থুতু ছুড়ে দেয় হাসানের দিকে; হাসান বিস্মিত হয়।
শ্যামলী বলে, তোমার এই প্রাপ্য।
হাসান বলে, সততার জন্যে আমি যে-কোনো দণ্ড মেনে নিতে পারি, শ্যামলী; সততার জন্যে শাস্তি অবধারিত।
শ্যামলী একটি চায়ের কাপ তুলে ছুঁড়ে মারে হাসানের দিকে, লাগে না; কাপটি দেয়ালে লেগে চুরমার হয়ে যায়। শ্যামলী টেলিফোন সেটটি তুলে ছুঁড়ে মারে, শেল্ফ থেকে কয়েকটি কবিতার বই নিয়ে টেনে টেনে ছেঁড়ে, ঠেলে টেলিভিশনটি ফেলে দেয়, এবং ক্লান্ত হয়ে মেঝেতে ব’সে পড়ে।
হাসান বলে, এই ফরাশি কাপ আর টেলিভিশন ভাঙা কিছু নয়, আমরা এসবের থেকে আরো বড়ো কিছু ভাঙছি।
শ্যামলী উঠে হাসানের দিকে না তাকিয়ে ধীরেধীরে বের হয়ে যায়।
হাসান কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে; তার নিজেকে শূন্য লাগে না পূর্ণ লাগে না, সুখী লাগে না, অসুখী লাগে না, জীবিত মনে হয় না মৃত মনে হয় না।
আমি কি সত্যিই সৎ হলাম? না কি আরো অসৎ হয়ে উঠলাম। আমি?
মানুষের পক্ষে কি সৎ হওয়া সম্ভব? সততা কাকে বলে?
মোহাম্মদ ফরহাদ খানকে আমাদের সম্পর্ক জানিয়ে দেয়া কি সততা?
তিনি কি জানতেন না। আমাদের সম্পর্ক? তিনি জানতেন, কিন্তু কোনোদিন আমাকে জানতে দেন নি। তিনি জানতেন। তিনি তাঁর ধরনে সৎ ছিলেন।
তার সততা আর আমার সততা বিপরীত; আজ আমাদের বিপরীত সততার মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে গেলো, ভেঙে পড়লো সব কিছু।
প্ৰত্যেককে তার নিজের ধরনের সততা নিয়ে বাঁচা উচিত? একজনের সততা চাপিয়ে দেয়া উচিত নয় আরেকজনের সততার ওপর?
আমি অপরাধ করেছি? শ্যামলীর কাছে? ফরহাদ হোসেনের কাছে?
আমি কি অপরাধ করেছি আমার কাছে?
আমি কি সৎ হয়েছি? আমি কি সুখী হয়েছি? আমি কি শান্তি পাচ্ছি?
হাসান, এর পরও কি তুমি কবিতা লিখতে পারবে? কবিতা আমাকে লিখতে হবে। সব ধ্বংস হয়ে গেলেও কবিতা লিখতে হবে; কবিতা লেখার জন্যে আমি দণ্ডিত।
সততার দণ্ডও তোমাকে পেতে হবে, হাসান।
গভীর রাতে হাসানের টেলিফোন বেজে ওঠে, হাসান ধ’রেই শোনে, এই শালা বাস্টার্ড, খানকির পো, তরে সাবধান কইর্যা দিতেছি, আমার ওয়াইফের লগে তুই মিশবি না; তার মার লগে গিয়া শো।
হাসান কিছু বলার আগেই ওপাশে একটি প্রচণ্ড চিৎকার ওঠে, মনে হয় লাথি মেরে ফরহাদ হোসেন শ্যামলীকে মেঝেতে বা খাটের কোনায় ফেলে দিয়েছেন।
হাসান বলে, আপনি শ্যামলীকে মারবেন না।
ফরহাদ খান বলেন, ওই খানকিরে আমি মারুম তর কি? পাইলে তরও হাড্ডি গুরা কইর্যা ফেলুম।
হাসান বলে, শ্যামলীকে দিন, আমি তার সাথে কথা বলবো।
ফরহাদ খান বলেন, তুই আর শ্যামলীর লগে মিশবি না। দুইটারেই খুন কইর্যা ফেলুম।
হাসান বলে, শ্যামলী চাইলে তাকে আমি নিয়ে আসবো, খুনকে ভয় করবো না।
ফরহাদ খান বলেন, ওই খানকি আর তর লগে মিশবো না।
হাসান ওই পাশে শ্যামলীর চিৎকার শুনতে পায়। ফরহাদ খান টেলিফোন রেখে দেন; হাসান বারবার ফোন করে, ফোন বাজে না।
“কবি অথবা দন্ডিত অপুরুষ” প্রবন্ধ বা উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ