আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরীর ষষ্ঠ বার্ষিক অনুষ্ঠান সম্পাদকের ভাষণ ও কার্যবিবরণী

মাননীয় সভাপতি সাহেব, ও শ্রদ্ধেয় সদস্যবৃন্দ ও অতিথিবৃন্দ! আজ আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরীর ষষ্ঠ বার্ষিক অধিবেশন এবং আমার ছিয়াশিতম জন্মদিন। স্বয়ং ছিয়াশিতম জন্মদিন উদযাপনকারী লোকের সংখ্যা খুব অল্প। তাই আমি সেই অল্প সংখ্যার দলে আছি বলে নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান মনে করছি।

আজকের এই অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে দুইটি অনুষ্ঠানের সমবায়ে। বিগত ১৯৮০ সাল থেকে ৮৪ সাল পর্যন্ত লাইব্রেরীর পাঁচটি বার্ষিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এই দিনটি আমার জন্মদিন হওয়া স্বত্বেও কোনো অধিবেশনেই আমার জীবন আখ্যান সম্বন্ধে কোনো আলোচনাই করিনি এবং অন্য কেউও করেন নি। আমি মনে করি যে, আজকের এই অধিবেশনটি আমার জীবনের অন্তিম অধিবেশন। তাই আজ লাইব্রেরী প্রসঙ্গের পূর্বে আমার জীবন আখ্যান সম্বন্ধে আপনাদের কাছে কিছু নিবেদন করতে চাই এবং সেজন্য মাননীয় সভাপতি সাহেবের অনুমতি প্রার্থনা করছি।

জন্ম আমার ৩রা পোষ, ১৩০৭ সালে, লামচরি গ্রামের এই বাড়িতেই। শৈশবে আমার বাবা মারা যান। তখন স্বামীহারা ও বিত্তহারা মা আমাকে নিয়ে ভাসতে থাকেন অকূল দুঃখের সাগরে।

তখন এই গ্রামে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিলো না। এ গ্রামের এক মুন্সি সাহেবের নিকট স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ ও বানান-ফলা শিক্ষা করি ১৩২০ থেকে ২১ সাল পর্যন্ত, এতিম ছেলে বলে অবৈতনিকভাবে। অতঃপর মুন্সি সাহেব মক্তবটি বন্ধ করে দিলে পয়সা ও পাঠশালার অভাবে কোথাও পড়ালেখার সুযোগ না পেয়ে কৃষিকাজ শুরু করি ১৩২৬ সালে।

লেখাপড়ার প্রতি আমার অত্যন্ত আগ্রহ ছিলো। কিন্তু কোনো উপায় ছিল না। তাই পড়ালেখার চর্চা করতে থাকি গ্রাম্য পুঁথিপাঠকদের সাথে পুঁথি পড়ে পড়ে। এভাবে পুঁথি পড়ে বাংলা পড়ার কিছুটা যোগ্যতা জন্মালো। এ সময়ে আমাদের গ্রামের দুইজন যুবক বরিশাল টাউন ও জিলা স্কুলে পড়তেন, যাদের একজন, ফজলুর রহমান, এখানেই আছেন। তাদের ঘরে ফেলে রাখা পাঠ্যপুস্তকগুলো পড়ার সুযোগ পাই ১৩৪৩ সন পর্যন্ত। ইতোমধ্যে ১৩৩৯ সালে আমার মা মারা গেলে একটি মর্মান্তিক ঘটনার জন্য লেখাপড়ার আগ্রহ বৃদ্ধি পায় ও মানসিক বৃত্তির আমূল পরিবর্তন হয়। আর এ কারণেই বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরীর সদস্য হয়ে সেখানকার ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি পুস্তক অধ্যয়ন করতে থাকি ১৩৪৪ সাল থেকে। লাইব্রেরীর সদস্য হতে হয়েছে আমাকে বেনামিতে। কেননা পৌরসভার বাইরের কোনো লোককে সদস্য করার নিয়ম তখন ছিলো না। জানিনা আজও সে নিয়ম বহাল আছে কিনা। এ ছাড়া হিন্দু ধর্মতত্ত্ব জানার আগ্রহ নিয়ে বরিশাল শঙ্কর লাইব্রেরীর পুস্তকাদি এবং ইহুদী ও খৃস্টান ধর্ম জানার আগ্রহ নিয়ে পড়তে থাকি ব্যাপ্টিস্ট মিশন লাইব্রেরীর বই। আরও সোভাগ্য হয়েছিল বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ লাইব্রেরীর পুস্তকাদি অধ্যয়নের, শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির সাহেবের মাধ্যমে।

উপরোক্ত বিভিন্ন লাইব্রেরীর পুস্তকাদি অধ্যয়নে কিঞ্চিৎ ক্ষমতা অর্জিত হলে ‘সত্যের সন্ধান’ নামক একখানা ক্ষুদ্র পুস্তক রচনা করি ১৩৫৮ সালে আমার মৃত মায়ের জন্য শোকসন্তপ্ত হৃদয় নিয়ে। এর পরে আমার লিখিত পুস্তক ‘সৃষ্টি রহস্য’, ‘স্মরণিকা’ ও ‘অনুমান’। আমার লিখিত পুস্তকাদি পাঠ করলে সুধীসমাজ বিশেষভাবে আমার আত্মিক ও সাত্ত্বিক পরিচয় পাবেন বলে মনে করি। এছাড়া আমার কার্যাবলী বিশ্লেষন করলেও আপনারা আমার কিছু পরিচয় পাবেন। এদেশে আমি কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ। নিজে কিছুই না বুঝে অন্যের দেখাদেখি কাজ করা পছন্দ করি না। সত্যের সন্ধান করা আমার জীবনের সাধনা, মানবকল্যাণ আমার ব্রত। অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারকে ঘৃণা করি পুরীষের মতো, আদর করি মানবতার। আমি ঘাটে বাঁধা নৌকায় ঘুমোতে চাই না, চাই সজাগ থেকে চলতি নৌকায় ভ্রমণ করতে। অভিনবত্বের প্রশংসা করি, নিন্দা করি স্থবিরতার। কৃষিকাজে জীবন কাটিয়েছি। তাই কৃষকরা আমার বন্ধু। কিন্তু গম, গোল আলু ও ধান চাষীরা আমার বন্ধু বটে, গাঁজার চাষীরা নয়।

মাননীয় সভাপতি সাহেব ও উপস্থিত সুধীবৃন্দ! আমার মূল্যহীন ব্যক্তিগত আলোচনার দ্বারা আপনাদের অধিক কষ্ট দিতে চাই না। এখন আমি লাইব্রেরী সম্বন্ধে সামান্য কিছু আলোচনা করবো। এ বছর লাইব্রেরীর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো বিষয় নেই। তবে সাধারণ ভাবে যেটুকু আছে তা সংক্ষেপে বলছি।

ক. আয় ও ব্যয়ের হিসাব

ক্রমিক আয়ের উৎস টাকা
১. গত বছরে মজুত ১,০১৮.০০ টাকা
২. অনুদানপ্রাপ্তি ৩,২০০.০০ টাকা
৩. চাঁদা আদায় ১৯.০০ টাকা
৪. আমানত জমা ১,১৩৫.০০ টাকা
৫. ব্যাংক থেকে আদায় ৪,৭৫০.০০ টাকা
মোট = ১০,১২২.০০ টাকা

ক. আয় ও ব্যয়ের হিসাব

ক্রমিক ব্যয়ের উৎস টাকা
১. বৃত্তি প্রদান (১৯৮৪) ৮০০.০০ টাকা
২. অনুষ্ঠান ও অতিথিসেবা ১,৯৮২.৩৫ টাকা
৩. সেরেস্তা খরচ ২৮.০০ টাকা
৪. বই খরিদ ৩৯.০০ টাকা
৫. পুস্তক প্রকাশ ৪১০.০০ টাকা
৬. লাইব্রেরীর ফুলবাগান পরিচর্যা ১৫০.০০ টাকা
৭. লাইব্রেরী উন্নয়ন ৬৪৫.০০ টাকা
৮. যাতায়াত ৫৬২.৭০ টাকা
৯. আমানত শেষ ১,১৩৫.০০ টাকা
১০. ব্যাংক মজুত ৩,২০০.০০ টাকা
১১. ভিক্ষাদান (১৯৮৫) ১০০.০০ টাকা
১২. বিবিধ ৬০০.০০ টাকা
১৩. পরিচালক ও পরিচারক ভাতা (১৯৮৫) ৪৫০.০০ টাকা
মোট ব্যয় = ১০,১০২.০৫ টাকা
মোট আয় = ১০,১২২.০০ টাকা
মজুত টাকা = ১৯.৯৫ টাকা

খ. পুস্তকাদির সংখ্যা

ক্রমিক বইয়ের ধরণ সংখ্যা
১. বিজ্ঞান ৮৮
২. দর্শন ২৪
৩. ধর্ম ৪৩
৪. গণিত ১৩
৫. ভূগোল ১২
৬. ইতিহাস ৪৫
৭. গল্প ৩৭
৮. উপন্যাস ১৩২
৯. নাটক ১১
১০. জীবনী ৩৫
১১. ভ্রমণ ১৩
১২. প্রবন্ধ ২৩
১৩. অভিধান
১৪. ব্যাকরণ
১৫. সাহিত্য ৫৩
১৬. আইন ১৪
১৭. চিকিৎসা
১৮. ইংরেজি ৬৮
১৯. রাজনীতি ৮২
২০. কৃষি ৪৮
২১. বিবিধ ২৯০
বইয়ের মোট সংখ্যা = ১০৫২।

গ.পাঠকবৃন্দ

এ লাইব্রেরীটির সাধারণ পাঠকের সংখ্যা নগণ্য। লাইব্রেরীর নিয়মমতে কোনো ছাত্র-ছাত্রী পাঠকের নিকট হতে চাঁদা আদায় করা হয় না। বয়স্ক পাঠকদের নিকট হতে মাসিক চাঁদা আদায় করা হয়। তবে বর্তমানে বয়স্ক পাঠক নেই বললেই চলে। নিয়মিত ছাত্র-ছাত্রী পাঠকের সংখ্যা ২৫ জন এবং এ বছর তাদের পঠিত বইয়ের সংখ্যা ২৬০।

ঘ. লাইব্রেরীর উন্নয়ন

এ বছর লাইব্রেরীর উন্নয়ন খাতে ব্যয় হয়েছে ৬৪৫ টাকা। কিন্তু উন্নয়ন কাজ হয় নি মোটেই। ১৯৭৯ সালে যখন লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেছি, তখন আমাকে অর্থের সংস্থান করতে হয়েছে ৩ কানি চাষের জমি বিক্রি করে। তাই অর্থাভাবে তখনকার পরিকল্পনা মোতাবেক লাইব্রেরীটি নির্মাণ করতে পারিনি। নিরক্ষর বয়স্কদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে লাইব্রেরী সংলগ্ন একটি নৈশ বিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা ছিলো আমার প্রথম থেকেই। সে কথাটি আমার সম্পাদিত ট্রাস্টনামা ও ‘স্ম্রণিকা’-য় উল্লিখিত আছে। কিন্তু অর্থাভাবে তা আজও কার্যকর করতে পারি নি, এবং জানিনা আমার মুমূর্ষু জীবনে স্বচক্ষে দেখে যেতে পারবো কিনা। তাই যে আশাটি পুরণের জন্য ভরসা রেখেছিলাম সরকারি অনুদানের উপর এবং সেজন্য প্রথম আবেদন জানিয়েছিলাম স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মাননীয় সভাপতি সাহেবের নিকট। উক্ত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সভাপতি সাহেব লাইব্রেরীর বৃদ্ধি ও বারান্দা নির্মাণের জন্য ২০,০০০.০০ টাকা মঞ্জুর করেন এবং তা বরিশাল সদর উপজেলা কর্তৃপক্ষ অনুমোদন করেন। উক্ত অনুমোদনের বিষয়টি মাননীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে জানতে পেয়ে ও তাঁর আদেশমতে লাইব্রেরীর বর্ধিত ভিত্তি প্রস্তুত করি ও প্রয়োজনীয় বালিউ খরিদ করি। এতে প্রায় ১,০০০.০০ টাকা খরচ হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, উক্ত বিশ হাজার টাকা আজও পাচ্ছি না বলে লাইব্রেরীর বৃদ্ধির কাজ করা সম্ভব হয়নি। পক্ষান্তরে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১,০০০.০০ টাকা।

মাননীয় সভাপতি সাহেব ইউ.এন.ও সাহেব ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে সবিনয় নিবেদন এই যে, লাইব্রেরীটির বৃদ্ধির আবশ্যকতা স্বচক্ষে দেখে ও তার গুরুত্ব অনুধাবনপূর্বক উক্ত কাজটি সমাধা করার প্রতি শুভদৃষ্টি কামনা করছি।

মাননীয় সভাপতি সাহেব, সদস্যবৃন্দ ও সুধী অতিথিবৃন্দ! লামচরির মতো গণ্ডগ্রামে অবস্থিত এ ক্ষুদ্র লাইব্রেরীটির বার্ষিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে আপনারা যে মূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন, সেজন্য লাইব্রেরী ও লামচরিবাসীদের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি। উপস্থিত কাঙ্গাল-কাঙ্গালীদের ভিক্ষা প্রদানের জন্য মাননীয় সভাপতি সাহেবকে সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি।

ধন্যবাদ, শুভ হোক।

৩.৯.১৩৯২

১. মানুষের পক্ষে

২. নিবেদন

৩. সৃষ্টি রহস্য

৪. ম্যাকগ্লেসান চুলা

অপ্রকাশিত

৫. কৃষকের ভাগ্য গ্রহ

৬. সীজের ফুল

৭. সংক্ষিপ্ত জীবন বাণী

৮. ভাষণ সংকলন

৮.১ মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ভাষণ

৮.২ বাংলাদেশ সোসিও-ফিলসফিক হিউম্যানিস্ট গিল্ড সেমিনারে ভাষণ

৮.৩ আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ

৮.৪ নজরুল জয়ন্তী অনুষ্ঠানে ভাষণ

৮.৫ গুণী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ভাষণ

৮.৬ বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর অনুষ্ঠানে ভাষণ

৮.৭ আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীর বার্ষিক বিবরণী ভাষণ

৮.৮ মানবিক উন্নয়নে যুব সমাজের ভূমিকা সেমিনারে ভাষণ

৮.৯ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সভায় ভাষণ

৮.১০ আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীর বার্ষিক অধিবেশনে ভাষণ

৮.১১ বার্ষিক বৃত্তিপ্রদান উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ

৮.১২ বাংলাদেশ কুটির শিল্প সংস্থায় ভাষণ

৮.১৩ আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীর বার্ষিক বিবরণী ভাষণ

৮.১৪ বাংলাদেশ দর্শন সমিতিতে ভাষণ

৮.১৫ বার্ষিক বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে ভাষণ

৮.১৬ আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীতে ভাষণ

৮.১৭ বাংলা একাডেমীর সংবর্ধনা ভাষণ

৮.১৮ আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীর ষষ্ঠ বার্ষিক অনুষ্ঠানে ভাষণ

৯. নির্ঘণ্ট

১০. বিভিন্ন আলোকচিত্র

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x