চৈনিক মত
প্রাচীন চীনাদের বিশ্বাস, তাহারা চীন দেশেরই আদিম অধিবাসী। তাহারা যে অন্য কোনো দেশ হইতে সেখানে যাইয়া উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছে, তাহাদের কোনো পুরাণ-গ্রন্থাদিতে এই কথা নেই। চীন দেশে ঈশ্বর প্রথম যে মনুষ্যটি সৃষ্টি করিয়াছিলেন, তাহার নাম ‘পাং-কু’। পাং-কুর উৎপত্তি দশ লক্ষ বৎসর পরে চীনে দশটি রাজবংশ রাজত্ব করিয়াছিল। প্রথম দেবগণের রাজত্ব, দ্বিতীয় উপদেবগণের রাজত্ব, তৃতীয় নরগণের রাজত্ব, চতুর্থ জুচানগণের রাজত্ব, পঞ্চম সুইজন বা অগ্ন্যুৎপাদকগণের রাজত্ব ইত্যাদি। ইতিহাসে চীনের প্রথম রাজার নাম ‘ফু-হিয়া’। ইঁহার রাজত্বকাল (পাশ্চাত্য মতে) ২৮৩২-২৩৩৮ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে। ইহাই চীনের সৃষ্টি প্রকরণের প্রাচীন বিবরণ।
মিশরীয় মত
মিশরের কোনো কোনো প্রদেশের প্রাচীন অধিবাসীগণের বিশ্বাস, সৃষ্টিকর্তা ‘ক্ষুণুম’ প্রথমে ডিম্বাকার পৃথিবী এবং পরে মনুষ্য সৃষ্টি করেন। অন্যত্র আবার প্রচার, শিল্পনিপুণ ঈশ্বর ‘টা’ নামক হাতুড়ি দ্বারা পূর্বোক্ত ডিম্ব ভাঙ্গিয়া ফেলেন, সেই ডিমের মধ্য হইতে পৃথিবী ও প্রাণীগণের উৎপত্তি হয়। কাহারও কাহারও মতে ‘থোথ’ বা চন্দ্রদেবতার আদেশক্রমে পৃথিবী উত্থিত হয়। অনেকের মতে ‘রা’ বা ‘রে’ (সূর্যদেবতা) পৃথিব্যাদি সকলের সৃষ্টিকর্তা।
অন্যমতে—মিশরের প্রথম রাজার নাম ‘রা’ বা ‘রে’। মনুষ্যগণ তাঁহার সম্মান করে নাই বলিয়ে বৃদ্ধবয়সে তিনি বড়ই রুষ্ট হন। প্রথমে তিনি মনুষ্য সমাজকে ধ্বংস করিতে বদ্ধপরিপক হইয়াছিলেন। পরিশেষে স্বর্গীয় গাড়িতে আরোহণ করিয়া এক নুতন পৃথিবী সৃষ্টি করেন। তাঁহার সেই পৃথিবীর নামই ‘স্বর্গ’।
ফিনিসীয় মত
ফিনিসিয়ার অধিবাসীদিগের বিশ্বাস, ক্রন্স্ নামক দেবতা ফিনিসিয়া ও তাহার অধিবাসীদিগকে সৃষ্টি করিয়াছিলেন। সৃষ্টিকর্তা ক্রন্স্-এর পশ্চাতে ও সম্মুখে দুইদিকেই চক্ষু ছিল। তাহার ছয়টি পক্ষ, তন্মধ্যে কয়েকটি বিস্তারিত ও কয়েকটি সঙ্কুচিত। প্রাচীন ফিনিসীয়দের মতে ক্রন্স্ই এই বিশ্বসংসারের সৃষ্টিকর্তা।
ব্যাবিলনীয় মত
প্রাচীন ব্যাবিলনীয়দের মত এই—প্রথমে সংসার জলময় ছিল। ‘অপসু’ ও ‘তিয়ামত’ দেবতাগণ উৎপন্ন হন। সেই সকল দেবতা তিয়ামতের সন্তান-সন্ততির মধ্যে পরিগণিত। এক সময় তিয়ামতের সহিত দেবগণের বিরোধ উপস্থিত হয়। তখন ‘মার্দক’ বা ‘মেরোডাক’ (ঈশ্বর) দেবতাগণের অধিপতি ছিলেন। তিনি তিয়ামতের সংহার সাধন করেন। তিয়ামত আপনার সহায়তার জন্য যে দৈত্যসমূহ সৃষ্টি করিয়াছিলেন, মার্দক তাহাদিগকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া রাখেন। অবশেষে মার্দক কর্তৃক তিয়ামতের দেহ দ্বিখণ্ডিত হয়। সেই দেহের একাংশে পৃথিবী এবং অপর অংশে স্বর্গ সৃষ্ট হইয়াছিল।
আফ্রিকার অসভ্য জাতিদের মত
আফ্রিকা মহাদেশের বন্য জাতিদিগের মধ্যে সৃষ্টি সম্বন্ধে একটা সাধারণ উপাখ্যান প্রচলিত আছে। এক সম্প্রদায়ের লোকের বিশ্বাস, ‘মাণ্টিস’ জাতীয় পতঙ্গই সৃষ্টির আদিভূত। মাণ্টিস জাতীয় পতঙ্গের মধ্যে ‘ফাগন’ বা ‘ইকাগন’ পতঙ্গ পরম উপকারী বলিয়া পূজিত হইয়া থাকে (দেব-দেবীর সহচর বলিয়া এদেশের হিন্দুদের নিকট সর্প, বৃষ, পেঁচক, মূষিক ইত্যাদিও সম্মানার্হ বা পূজনীয়)। তাহাদের বিশ্বাস—মণ্টিসের স্ত্রী, কন্যা ও দৌহিত্র আছে। মাণ্টিস আপন জামাতার পাদুকা হইতে দ্বীপের সৃষ্টি করিয়াছিলেন। তাহার নিজের পাদুকা হইতে চন্দ্র উৎপন্ন হয়। চন্দ্রের বর্ণ রক্তিমাভ দেখিয়া উক্ত বন্য জাতিরা সিদ্ধান্ত করে, মাণ্টিসের পাদুকায় রক্তবর্ণ ধূলা ছিল বলিয়া চন্দ্রের এইরূপ বর্ণ হইয়া থাকিবে। একটি বিড়ালের সহিত যুদ্ধে একবার মাণ্টিস পরাজিত হয়। যাহা হউক, ঐ সকল জাতি মাণ্টিসকেই ঈশ্বর বলিয়া বিশ্বাস করে।
দক্ষিণ আফ্রিকার হটেনটট জাতির মতে, সৃষ্টিকর্তা নাম ‘সুনিগোয়ান’। তাহার উপাসনগণ বলিয়া থাকেন, তিনিই অবিদ্যমান শূন্য হইতে বিশ্বের সৃষ্টি করিয়াছিলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার জুলু জাতি প্রধানত পিতৃপুরুষের উপাসক। তাহাদের মতে, পিতৃপুরুষগণের এক আদিপুরুষই এই সসাগরা ধরিত্রীর সৃষ্টিকর্তা। জুলুরা বলে, সেই আদিপুরুষ বা সৃষ্টিকর্তাই পৃথিবীর আদিমানুষ। তাহার নাম ‘উনকুলুলু’। তাহা হইতেই অন্যান্য সবকিছুর সৃষ্টি হইয়াছে।
অস্ট্রেলিয়ার আদিম জাতির মত
অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের অন্তর্গত ভিক্টোরিয়া প্রদেশের উত্তরাংশে যে সকল আদিম অধিবাসী বাস করে, তাহারা বলে, পণ্ডজিল নামক পক্ষীই এই বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। সেই পক্ষীই পৃথিবীকে খণ্ড খণ্ড অংশে বিভক্ত করিয়াছে।
অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য অংশের আদিম অধিবাসীদিগের বিশ্বাস, ‘নুরালি’ অর্থাৎ অতি প্রাচীনকালের মনুষ্যগণই এই পৃথিবী সৃষ্টি করিয়া গিয়াছেন।
আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের মত
আমেরিকার ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের সৃষ্টিবর্ণনায় অস্ট্রেলিয়ান মতেরই ছায়াপাত হইয়াছে। কোথায়ও পক্ষী হইতে, কোথায়ও বা বিশেষ বিশেষ জন্তু হইতে এই পৃথিবী ও প্রাণীসমূহের সৃষ্টি হইয়াছে বলিয়া প্রচারিত রহিয়াছে।
উত্তর আমেরিকার আলাস্কা প্রদেশে সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার অভিব্যক্তিমূলক একটি প্রতিমূর্তি দৃষ্ট হয়। ঐ মূর্তিটি এক্ষণে পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তভূর্ত যাদুঘরে রক্ষিত আছে। ঐ অঙ্কিত প্রতিচিত্রে একটি কৃষ্ণবর্ণ কাক মানুষের মুখোশের উপর বসিয়া আছে। বোধ হইতেছে যেন কাকটি তা দিয়া তা দিয়া ডিম্ব হইতে মনুষ্য সৃষ্টি করিতেছে। এই চিত্রটি দর্শনে ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ গবেষণা দ্বারা স্থির করিয়াছেন যে, ডিম্ব হইতেই জীবসমাকুল পৃথিবীর সৃষ্টি হইয়াছে, ইহাই আলাস্কাবাসীদের মত।
সৃষ্টি সম্বন্ধে আমেরিকান রেড ইণ্ডিয়ান জাতিদিগেরও ঐরূপ বিশ্বাস। উত্তর-পশ্চিম তীরের থিলিঙ্কিট ইণ্ডিয়ান নামক অধিবাসীগণ কতকাংশে উক্ত মতেরই পোষকতা করিয়া থাকে। তাহাদের মতে, ‘জেল’ বা ‘জেল্চ্’ অর্থাৎ দাঁড়কাক আপনিই উদ্ভূত হয়। সেই দাঁড়কাকই পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা। ঐ দাঁড়কাক একটি বাক্স হইতে চন্দ্র, সূর্য এবং নক্ষত্রসমূহকে বাহির করিয়া অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীতে আলোকরশ্মি আনয়ন করিয়াছিল।
উত্তর আমেরিকার আল্গকিন জাতির মধ্যে সৃষ্টিবিষয়ক প্রচলিত মত—‘মিকাবো’ অর্থাৎ এক বৃহৎ খরগোশ কর্তৃক পৃথিবী সৃষ্ট হইয়াছিল। সেই খরগোশ ভেলার সাহায্যে অন্যান্য জন্তুকে রক্ষা করিয়াছিল। ভেলায় অবস্থিত জন্তুর মধ্যে তিনটিকে খরগোশরাজ একে একে সমুদ্রের তলদেশে মাটি আনিবার জন্য প্ররণ করে। সমুদ্রতল হইতে তাহারা অল্প বালুকণা লইয়া আসে। সেই বালুকণা হইতে খরগোশরাজ একটি দ্বীপের সৃষ্টি করে। সেই দ্বীপটিই এই পৃথিবী। মৃত জন্তুসমূহের অস্থি-কঙ্কাল লইয়া খরগোশরাজ মনুষ্যের সৃষ্টি করিল। ঐ জাতির মধ্যে জলপ্লাবন, প্রলয়, পুনঃ সৃষ্টি প্রভৃতির বিষয়ও বর্ণিত আছে।
উত্তর আমেরিকার ইরোকো নামক সম্প্রদায় আবার অন্য মত পোষণ করে। তাহারা বলে, উপরে স্বর্গ ও নিম্নে অনন্ত বারিধি ভিন্ন আর কিছুই ছিল না। স্বর্গের একটি ছিদ্রের মধ্য দিয়া একটা আতোয়ান্ত্রিসিক নাম্নী এক রমণী জলমধ্যে নিপতিত হয়। সেই স্থানে একটি কচ্ছপ ছিল। কোনো একটি জলজন্তু কর্তৃক কচ্ছপের পৃষ্ঠদেশে কিঞ্চিৎ মৃত্তিকা রক্ষিত হইয়াছিল। রমণী স্বর্গ হইতে সেই কচ্ছপের পৃষ্ঠে পতিত হয় (আতোয়ান্ত্রিসিক ও বিবি হাওয়ার ভূপতনের আখ্যানে কিছুটা সাদৃশ্য আছে)। রমণী ঐ সময় গর্ভবতী ছিল। তাহার গর্ভ হইতে একটি কন্যা জন্মগ্রহণ করে। সেই কন্যা হইতে যমজ পুত্রদ্বয় উৎপন্ন হয়। তাহাদের নাম জোস্কেহা ও টাওয়াস্কারা। জোস্কেহার সহিত বিরোধ হওয়ায় টাওয়াস্কারা আবার মাতাকে নিহত করে। তাহাদের মাতার কঙ্কাল হইতে উদ্ভিদাদি উৎপন্ন হয়। জোস্কেহা মানুষ ও পশু সৃষ্টি করে।
মেক্সিকোর অধিবাসীগণ সৃষ্টির পাঁচটি পর্যায় স্বীকার করে। প্রথম চারিটি পর্যায়ের নাম—স্থল, অগ্নি, বায়ু ও জল (এই মতটি গ্রীক দার্শনিক এম্পিডোকল্স-এর মতের অনুরূপ; তাঁহার মতে সৃষ্টির মৌলিক উপাদান ক্ষিতি, অপ্, তেজঃ ও মরুৎ–অর্থাৎ আব, আতস, খাক, বাত)। পঞ্চমটির নাম নির্দিষ্ট হয় নাই (ভারতীয় আর্যদের মত অনুসারে অতিরিক্তটি ‘পঞ্চভূত’-এর অন্তর্গত ‘ব্যোম’ বলিয়া মনে হয়; ব্যোম অর্থ আকাশ বা শূন্য)। তাহাদের মতে, প্রথম যুগে মৃত্তিকার সৃষ্টি অগ্নি অথবা তাপ বা আলোকপুঞ্জ, তৃতীয় বায়ব পদার্থ, চতুর্থ জলীয় বা বাষ্পীয় পদার্থ। মেক্সিকোবাসীগণ জলপ্লাবনে বিশ্বাসবান।
মেক্সিকোবাসীদের সৃষ্টি প্রকরণে পাশ্চাত্যের বেশ কিছুটা ছাপ আছে।
পেরুদেশবাসীরা তিনজন সৃষ্টিকর্তার প্রাধান্য স্বীকার করিয়া থাকে। তাহাদের—১. ‘পাচা কামাক’, উনি ভূগর্ভস্থ অগ্নিদেবতা; ২. ‘ভিরা কোচা’, ইনি পৃথিবীর সৃষ্টি ও গঠনকর্তা বলিয়া পূজিত; ৩. ‘মাংকোকাপাক; বা অদ্বিতীয় মনুষ্য, তাঁহার পত্মী ও ভগ্নী ‘সৃষ্টিকারী ডিম্ব’ নামে অভিহিত। অদ্বিতীয় মনুষ্য ও ডিম্ব পরিশেষে সূর্য ও চন্দ্র রূপে প্রকাশমান হন। যুকাসদিগের পুরোহিতগণ তাঁহাদিগকে রাজা ও রাণী নামে অভিহিত করিয়া থাকেন।
ব্রাজিলের কোনো কোনো জাতি বলিয়া থাকে, জামোয়া নামক দেবতা পৃথিবীর প্রথম মনুষ্যের পিতামহ। তাহার দ্বারাই সৃষ্টিকার্য সম্পন্ন হয়। উত্তর আমেরিকার এস্কিমো জাতি বলিয়া থাকে, এই পৃথিবী অনন্তকাল বিদ্যমান আছে। কোনো দিন কেহ ইহাকে সৃষ্টি করে নাই।
আমেরিকার অধিকাংশ জাতি সূর্যদেবকে সৃষ্টিকর্তা ও পরমেশ্বর বলিয়া মান্য করে। কিন্তু এস্কিমোগণ এবং উত্তর আমেরিকার আথাবাস্কা জাতি সূর্যদেবের প্রাধান্য আদৌ স্বীকার করে না। এতদপ্রসঙ্গে জার্মান পণ্ডিত অধ্যাপক রাজেল একটি অভিনব সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন। তিনি বলেন, এস্কিমো প্রভৃতি জাতির বাসস্থান উত্তর আমেরিকায়। চির তুষারাবৃত পৃথিবীর ঐ অংশে মনুষ্যগণ মাংসাদি খাইয়াই জীবন ধারণ করে। সূর্যের সহিত তাহাদের সম্বন্ধ অতি অল্প। সুতরাং তাহারা সূর্যের প্রাধান্য স্বীকার করে না। তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর যে যে অংশে চাষাবাদ নাই, সেখানকার লোকেরা কদাচ সূর্যের উপাসনা করে না।
পলিনেশীয়দের মত
পলিনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জে বিভিন্ন জাতির মধ্যে সৃষ্টি সম্বন্ধে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে। স্যার জর্জ গ্রে পলিনেশিয়ার পৌরাণিক বৃত্তান্ত সংগ্রহ করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার এবং অন্যান্য গ্রন্থকারগণের বর্ণনায় প্রকাশ, পলিনেশিয়ার মাওয়ারী জাতির বিশ্বাস—‘রাঙ্গী’ ও ‘পাপা’ অর্থাৎ স্বর্গ ও পৃথিবী প্রথমে একত্রে সংযুক্ত ছিল। সহসা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়ায় স্বর্গ উপরে চলিয়া যায়, পৃথিবী নিম্নে পড়িয়া থাকে (‘স্বর্গ উপরদিকে’—এই মতটি ধর্মজগতের বহুক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থিত)। মাওয়ারীগণ বলে, রাঙ্গী ও পাপার পুত্রের নাম তাঙ্গালোয়া বা তারোয়া। তিনি জনদেবতা, সমুদ্রের অধিপতি। তিনি মৎস্য ও সরীসৃপকূল সৃষ্টি করেন। পলিনেশিয়ার অন্যান্য অংশের অধিবাসীরা আবার তাঙ্গালোয়াকেই অদ্বিতীয় পরমেশ্বর বলিয়া স্বীকার করে। তাহাদের মতে, তিনিই সৃষ্টিকর্তা। শ্যামোয়া দ্বীপে তাহার নাম তাঙ্গালোয়ালাঙ্গী। তাঙ্গালোয়া ও লাঙ্গী এই উভয় শব্দেই স্বর্গকে বুঝাইয়া থাকে। মেঘমণ্ডলকে তাহারা তাঙ্গালোয়ার পোত বা তরণী বলিয়া বিশ্বাস করে। কখনও কখনও তাঙ্গালোয়া শম্বুকের মধ্যে বাস করেন বলিয়া প্রবাদ আছে। সময় সময় তাঙ্গালোয়া আপনার অধিষ্ঠানভূত শম্বুকটিকে পরিত্যাগ করিতেন, তদ্বারা পৃথিবীর অবয়ব ও প্রাণীসংখ্যা বৃদ্ধি পাইত। আবার কোনো কোনো স্থানে প্রচার, তাঙ্গালোয়া ডিম্বের মধ্যে বাস করিতেন, তদ্বারা দ্বীপসমূহের উৎপত্তি হইত।
পলিনেশিয়ায় তাঙ্গালোয়া সম্বন্ধে আর একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে—অতি প্রাচীনকালে তাঙ্গালোয়া এক বৃহদকার পক্ষীরূপে সমুদ্রের উপর বিচরণ করিতেন। সেই সময় তিনি জলের উপর একটি ডিম্ব রক্ষা করেন। সেই ডিম্বই পৃথিবী ও স্বর্গ অথবা সূর্য।
নিউজিল্যাণ্ড দ্বীপের অধিবাসীরা তাঙ্গালোয়ার প্রাধান্য স্বীকার করে না। তাহাদের মতে, ‘মানি’ অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তা ও পরমেশ্বর। তিনি প্রথমে বায়ু ও বন্যা সৃষ্টি করেন। তাহা হইতে অন্যান্য পদার্থ উদ্ভূত হয়। দেবগণের উৎপত্তি সম্বন্ধে পলিনেশিয়াবাসীগণ সাধারণত বলিয়া থাকে যে ‘পো’ হইতে দেবগণের উদ্ভব হইয়াছে। ‘পো’ শব্দে অন্ধকার বুঝায়। সে হিসাবে অন্ধকারই সকলের জনয়িতা। এমনকি তাঙ্গালোয়া পর্যন্ত অন্ধকার হইতে উদ্ভূত হইয়াছিলেন।
“আরজ আলী মাতুব্বর” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ