আমার এক বন্ধু আছেন–পশু-প্রেমিক। রাস্তায় কুকুর কাঁদছে কুঁ-কুঁ করে, তিনি হয়ত যাচ্ছেন রিকশায়; রিকশা থামিয়ে ছুটে যাবেন। চোখ কপালে তুলে বলবেন, হল কি তোর? এই আয়, তু তু তু। তাঁর পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রমহিলা বিড়ালের গায়ে গরম মাড় ফেলে দিয়েছিলেন। তিনি সেই বিড়াল নিয়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছুটে গেলেন। ইন্টার্নী ডাক্তার বললেন, এখানে কেন এনেছেন? পশু হাসপাতালে নিয়ে যান।

তিনি বললেন, পশু হাসপাতাল কোথায় আমি চিনি না। প্লীজ ফার্স্ট এইড দিন, আমি পরে পশু হাসপাতাল খুঁজে বের করব।

ডাক্তার ফার্স্ট এইড দিতে রাজি নন।

আমার বন্ধু ফার্স্ট এইড না নিয়ে যাবেন না। চিৎকার, চেঁচামেচি, হৈচৈ। চারদিকে লোক জমে গেল। আমার বন্ধু শার্টের হাতা গুটিয়ে ডাক্তারকে মারতে গেলেন। কেলেঙ্কারি অবস্থা।

মানুষের দুঃখ-কষ্টের প্রতি আমার এই বন্ধু চরম উদাসীন। একবার এক পকেটমার ধরা পড়েছে। কিল-ঘুসি-লাথি মেরে তার অবস্থা এমন যে এখন যায় তখন যায় অবস্থা। সে ক্ষীণ স্বরে বলছে–আমারে একটু পানি দেন। এক ফোঁটা পানি।

আমার বন্ধু কঠিন গলায় বললেন, হারামজাদার মুখে কেউ প্রস্রাব করে দিন তো।

তার বাসায় ভিক্ষা চাইতে এসে ভিখিরি প্রচণ্ড লাথি খেয়েছিল। তার ক্লাস টেনে পড়া মেয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির ছেলের সঙ্গে গল্প করছিল। এটা জানার পর তিনি মেয়েকে নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন। আধ ঘণ্টা পর মেয়ে যখন কাঁদতে কাঁদতে বের হল তখন দেখা গেল তার মাথার সব চুল কেটে ফেলা হয়েছে। অল্প কিছু চুল কোট ব্রাশের মত খাড়া হয়ে আছে। আমার এই বন্ধুর ভালবাসা পশু সমাজের জন্য।

আমি আমার বন্ধুর মত নই। কুকুরের প্রভুভক্তির অসংখ্য গল্প জানা থাকা সত্ত্বেও কুকুর দেখলে ভয় ছাড়া অন্য কোন মানবিক আবেগ আমি বোধ করি না। বিড়াল প্রাণী হিসেবে খুব সুন্দর। সেই বিড়ালকে একবার দেখলাম রক্তাক্ত ইঁদুর মুখে নিয়ে ঘুরছে। বিড়ালের ধবধবে শাদা মুখে লাল রক্তের ধারা। আমি সেই থেকে বিড়াল পছন্দ করি না।

আমার পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে বিড়ালের কোন মাথাব্যথা থাকার কথা না। তারা যখন-তখন আমার শহীদুল্লাহ হলের বাসায় আসে। খাবার টেবিল থেকে মাছ নিয়ে পালিয়ে যায়। আদর্শ বিড়ালের মত মাছের কাটায় তারা সন্তুষ্ট নয়। আমি বিড়াল দেখলেই দূর-দূর করি। ওরা নানান ভাবে আমার সঙ্গে খাতির করার চেষ্টা করে। হয়ত বই পড়ছি–চুপি চুপি এসে পায়ের সঙ্গে গা ঘসে গেল। লাথি মারবার আগেই পালিয়ে গেল।

স্ত্রীরা স্বামীদের অধিকাংশ অভ্যাস গ্রহণ করে ফেলে (যদিও তারা কখনো তা স্বীকার করে না)। গুলতেকিনও সেই ফমূলায় বিড়াল অপছন্দ করে। আমাদের যৌথ প্রচেষ্টায় বিড়ালের জন্য এই বাড়ি মোটামুটি নিষিদ্ধ হয়ে গেল। এরা তবু আশা ছাড়ে না। মাঝে-মধ্যে আসে। দুঃখিত চোখে আমাদের দেখে চলে যায়।

এক রাতের ঘটনা। বসে বসে লিখছি। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হওয়ায় শীত শীত লাগছে। আমি গুলতেকিনকে বললাম একটা চাদর দিতে। সে চাদরের জন্যে কাবার্ড খুলে চেঁচিয়ে উঠল। এক অতি রুগণ বিড়াল কাবার্ডের ভেতর বাচ্চা দিয়ে বসে আছে। এতটুকু টুকুন চার বাচ্চা কুঁ কুঁ শব্দ করছে। কাবার্ডের সমস্ত কাপড় নোংরা। বিশ্রী অবস্থা!

গুলতেকিন বলল, এখন কি করব? আমি বললাম, রাতটা কাটুক। ভোরে ফেলে দেয়া যাবে। খুব পাষাণহৃদয় মানুষের পক্ষেও বাচ্চাসহ একটা বিড়াল ফেলে দেয়া কঠিন। আমাদের এই অপ্রিয় দায়িত্ব পালন করতে হল না।

আমার ছোট মেয়ের বান্ধবী পাশের ফ্ল্যাটের জেনিফার ভোর বেলাতেই একটা জুতার বাক্স নিয়ে উপস্থিত। সে গম্ভীর গলায় আমাকে বলল, চাচা, আমাদের বিড়ালটা না-কি আপনাদের বাসায় বাচ্চা দিয়েছে?

একটা বিড়াল বাচ্চা দিয়েছে জানি। তোমাদের বিড়াল কি-না তাতো জানি না। তোমাদের বিড়াল চেনার উপায় কি?

ওর নাম লুসিয়া।

নামে তো মা ঠিক চিনতে পারছি না।

ওর খুব স্লীম ফিগার।

স্লীম ফিগার হলে তোমাদেরই বিড়াল। তুমি পরীক্ষা করে দেখ। কাবার্ডের ভেতর আছে।

কাবার্ড খোলা হল। লুসিয়াকে পাওয়া গেল না। বাচ্চা চারটা আছে। এখনো চোখ ফুটে নি।

জেনিফার বলল, চাচা, আমি এদের আমাদের বাসায় নিয়ে যাব।

আমি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বললাম, অবশ্যই নিয়ে যাবে মা, অবশ্যই নিয়ে যাবে। তোমাদের বিড়াল অন্যের বাসায় বাচ্চা মানুষ করবে এটা কোন কাজের কথা না। সম্মান হানি হবার মত কথা।

জেনিফার জুতার বাক্সে বিড়ালের বাচ্চা তুলে নিয়ে গেল। আমি নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলাম, বাঁচা গেল।

সে রাতের ঘটনা। বারান্দায় বাতি জ্বালিয়ে আমি পরীক্ষার খাতা দেখছি। অনেক খাতা জমে আছে। প্রতিজ্ঞা করে বসেছি ত্রিশটা খাতা না দেখে ঘুমুতে যাব না। খাতাগুলি দেখতে খুব সময় লাগছে। রাত একটার মত বেজে গেল। পুরো বাড়ি ঘুমে অচেতন। আমি জেগে আছি। ফ্লাক্স ভর্তি চা আমার সামনে রেখে দেয়া।

হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে লুসিয়া লাফিয়ে আমার টেবিলে উঠে এল। আমার দিকে তাকিয়ে রাগী ভঙ্গিতে ম্যাঁ ম্যাঁ করে কিসব বলল। বিড়ালের ভাষা আমার বোঝার কোনই কারণ নেই। তবু তার ভঙ্গি, তার চিৎকার শুনে মনে হল, সে বলতে চাচ্ছে–আমি আমার অবোধ শিশুগুলিকে তোমাদের ঘরে রেখে খাবারের সন্ধানে গিয়েছিলাম। তোমরা এদের সরিয়ে দিয়েছ। যে কাজটা করেছ, তা অন্যায়। আমি তোমার কাছে কৈফিয়ত দাবী করছি। তোমাকে জবাবদিহি করতেই হবে।

আমার কি যে হল–বিড়ালকে বললাম, যা, তুই তোর বাচ্চাগুলিকে নিয়ে আয়। আমি আর কিছু বলব না। বিড়াল খানিকক্ষণ চুপ থেকে নরম স্বরে বলল,

ম্যাঁও ম্যাঁও ম্যাঁও (সত্যি কি আনতে বলছেন?)

হ্যাঁ।

ম্যায়াও মি ম্যায়াও (আনলে তাড়িয়ে দেবেন না তো?)

 না।

বিড়াল নেমে গেল। কিছুক্ষণ পর একটা বাচ্চা মুখে নিয়ে টেবিলের উপর লাফিয়ে উঠল। সে যে আমার কথা বুঝে এই কাণ্ড করেছে এটা মনে করার কোনই কারণ নেই। তবু আমার কেন জানি মনে হল বিড়াল বাচ্চাটা মুখে করে এনে লাফিয়ে আমার টেবিলে উঠেছে একটি কারণে। আমার চূড়ান্ত অনুমতি চাচ্ছে।

ম্যাঁও ম্যাঁও। (কি, রাখব আমার সোনামণিদের?]

হ্যাঁ, রাখ।

ম্যাঁয়াও ম্যাঁয়াও [তোমার স্ত্রী আবার আপত্তি করবে না তো?]

না। তাকে আমি বুঝিয়ে বলব।

ম্যাঁয়াও ধন্যবাদ স্যার।]

বিড়াল বাচ্চা নিয়ে কাবার্ডের ভেতর ঢুকে গেল। অন্য বাচ্চাগুলিকেও একে একে নিয়ে এল। আমি তাকে বললাম, একটা শর্ত মনে রাখবে। এরা একটু বড় হলেই তুমি আমার বাসা ছেড়ে চলে যাবে। আমি বিড়াল পছন্দ করি না।

ম্যাঁয়াও (আচ্ছা।)।

ভোরবেলা আমি গুলতেকিনকে ঘটনাটা বললাম। তার ধারণা হল পুরো ব্যাপারটি আমার বানানো। ধারণা করাই স্বাভাবিক। তার সঙ্গে আমার কথাবার্তার সতুর ভাগই থাকে বানানো। আমি খুব গুছিয়ে সত্যের মত করে মিথ্যা বলতে পারি।

আমি গুলতেকিনকে বললাম, বিড়ালটা কথা দিয়েছে তার বাচ্চাগুলি একটু বড় হলেই সে চলে যাবে।

 তোমাকে সে কথা দিয়েছে?

হ্যাঁ। মানুষ কথা দিয়ে কথা রাখে না কিন্তু পশুরা একবার কথা দিলে কথা রাখে।

তুমি তো মনে হচ্ছে অবতারের পর্যায়ে পৌঁছে গেছ। পশুদের ভাষা বুঝতে পার।

তোমার সঙ্গে এক হাজার টাকা বাজি–বাচ্চাগুলি একটু বড় হলেই সে চলে যাবে।

বেশ যাও, হাজার টাকা বাজি।

গুলতেকিন বিড়ালটার জন্য দৈনিক এক পোয়া দুধ বরাদ্দ করে দিল। উচ্ছিষ্ট মাছ মাংস তাকে প্লেটে করে দেয়া হতে লাগল। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। যে রাজকীয় হালে তাকে রাখা হচ্ছে সে তো আর এই বাড়ি ছেড়ে যাবে না। আমাকে বাজিতে হারতে হবে

কিম আশ্চর্যম! বাচ্চা চারটি একটু বড় হতেই বিড়াল এদের নিয়ে চলে গেল।

আমি অবশ্যি বাজির টাকা পেলাম না। কারণ গুলতেকিন তখন যুক্তি দেখাল, তোমাকে কথা দিয়েছে বলে তো আর সে যায় নি। বাচ্চারা বড় হয়েছে–পৃথিবীতে বাস করার ট্রেনিং দেবার জন্যে সে এদের নিয়ে চলে গেছে। তার কথা যে সত্যি তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এর পর মজার ঘটনা ঘটতে লাগল। আশেপাশের যত বিড়াল আছে তারা গর্ভবতী হলেই আমাদের বাসায় চলে আসে। বাচ্চা দেয়। বাচ্চাগুলি একটু বড় হলে এদের নিয়ে চলে যায়। কালো বিড়াল, ধলা বিড়াল, হলুদ বিড়াল। এর মধ্যে একটা ছিল ডাকাতের মত দেখতে।

আমার ধারণা লুসিয়া সমস্ত বিড়াল সমাজের কাছে প্রচার করেছে–হুমায়ূন স্যারের বাসা মেটারনিটি ক্লিনিক হিসেবে অতি উত্তম। এরা যত্ন-আত্তি করে। দুধ খেতে দেয়। শুধু একটা শর্ত, বাচ্চারা বড় হলে বাসা ছেড়ে দিতে হবে।

আমি অতিষ্ঠ হয়ে পড়লাম। একবার তিনটা বিড়াল এক সঙ্গে বাচ্চা দিল। বাচ্চা দিয়েই এরা চুপ করে থাকে না। প্রতিদিন বাচ্চাগুলিকে জায়গা বদল করায়। এই দেখলাম খাটের নিচে, খানিকক্ষণ পরই ট্রংকের কোণায়। ক্ষিধে পেলে এরা গুলতেকিনের শাড়ির আঁচল কামড়ে ধরে টেনে রান্নাঘরের দিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। নিতান্তই অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

আমি পশু-প্রেমিক নই বলেই একদিন ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। দেড় হাজার টাকায় নেট কিনে মিস্ত্রি লাগিয়ে দরজা-জানালা, ফাঁক-ফোকর সব নেট দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে দীর্ঘ ছ বছর পর প্রথম বিড়াল মুক্ত দিবস পালন করলাম।

আমার নিয়ম হচ্ছে গভীর রাতে যখন হলের ছেলেরা বেশির ভাগ ঘুমিয়ে পড়ে তখন গুলতেকিনকে নিয়ে হলের সামনের মাঠে হাঁটাহাঁটি করা। সে রাতেও তাকে নিয়ে বের হয়েছি। চাদনি পহর রাত। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় হাঁটতে অপূর্ব লাগছে। সাধারণত হাঁটাহাঁটির সময় আমি প্রচুর বকবক করি। সে রাতে কেন জানি চুপ করে আছি–গুলতেকিন বলল, তুমি চুপ করে আছ কেন? ঘর নেট দিয়ে বন্ধ করে দেয়ায় তোমার কি মন খারাপ লাগছে?

আমি বললাম, হ্যাঁ, লাগছে।

নেট খুলে দিতে চাও?

না।

না কেন?

আমি শান্ত গলায় বললাম, আমি পশু-প্রেমিক নই গুলতেকিন। সামান্য মন খারাপকে আমি প্রশ্রয় দিতে চাই না।

মন খারাপটা অবশ্য খুব সামান্য ছিল না। সে রাতে কিছুতেই আমার ঘুম এল না।

রাত তিনটা পর্যন্ত চুপচাপ জেগে রইলাম। কিছুতেই ঘুম আসে না। ঘুম এল ফজরের আজানের পর। ঘুম ভাঙল সকাল দশটায়। বিছানা থেকে নেমে দেখি সব নেট খুলে ফেলা হয়েছে। কে খুলল, কার নির্দেশে খুলে ফেলা হল কিছুই জিজ্ঞেস করলাম না। আমি এবং গুলতেকিন দুজনই এমন ভাব করতে লাগলাম যেন এই প্রসঙ্গ আলোচনার যোগ্য কোন প্রসঙ্গ না। রাতে টিভি দেখছি। আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, আব্বু গেস্ট রুমে আরেকটা বিড়াল এসে বাচ্চা দিয়েছে। এইবারের বাচ্চাগুলি কালো রঙের। কুচকুচে কালো।

আমি মহা বিরক্ত হয়ে বললাম, এ তো বড় যন্ত্রণা হল! এরা পেয়েছেটা কি? অসহ্য। এই বাড়িতে আর থাকা যাবে না। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি গুলতেকিন জানালা দিয়ে মুখ ফিরিয়ে হাসি চাপার চেষ্টা করছে।

———– * আমাদের এই বিড়াল পরিবার নিয়ে আমি বিপদ নামে একটি উপন্যাস লিখেছি। উদ্ভট জাতীয় গল্প যারা ভালবাসেন তারা অন্যের কাছ থেকে বই ধার করে পড়ে দেখতে পারেন।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x