কথারও ঋণ আছে
দিনের কর্মব্যবস্ততার শেষে যখন সোসাল মিডিয়ায় একটু ঘুরাঘুরি করি, তখন নানা জনের নানা রকম পোস্ট আর স্টেটাসে বিস্মিত হয়ে যাই প্রায়ই। সোসাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেসবুক যেন মনের ভাবকে সুন্দর রূপে উপস্থাপন করার একটা বিশেষ প্লাটফর্ম। এখানে শেয়ার হয়, মনের রং বেরঙ্গের সুখ-দুঃখের কথা, মজার কথা, জীবন সম্পর্কিত অভিজ্ঞতার কথা, চলে আলোচনা-সমালোচনা। সবচেয়ে বিস্মিত হই তখন, যখন দেখি কেউ একজন জীবন সম্পর্কিত অনেক জটিল ও বিরাট বিষয়কে খুব সুন্দর ভাবে এক কথায় প্রকাশ করে। ঠিক এমনি একটি কথা সেদিন হঠাৎ চোখে পড়েছিল ফেসবুকে। পোস্ট দাতার নাম মনে নেই, কথাটি ঠিক এরকম “জিহ্বা কোন ধারালো অস্ত্র নয়, তথাপি একজন মানুষের মনকে টুকরো টুকরো করতে নরম ও কোমল এই জিহ্বাই যথেষ্ট।“
কথাটি অত্যন্ত সাধারণ মনে হলেও, অসাধারণ। এই জিহ্বার দ্বারা উচ্চারিত শব্দের আঘাতেই একজন সুখী মানুষকে চিরদুখী করে দেওয়া সম্ভব। আবার দুখী মানুষকে করে তোলা সম্ভব সুখী। অসহায় মানুষ ফিরে পেতে পারে তাঁর হারানো আত্মবিশ্বাস, কুপথে চালিত ব্যক্তি ফিরে আসতে পারে সুপথে। কথায় সম্মোহিত হয়ে মানুষ যাচ্ছে তাই করতে পারে, এমনকি কি পাশের লোকে কি বলবে, এই ভয়েই মানুষ আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটাতেও দ্বিধা করে না। সত্যি। জিহ্বা দ্বারা উচ্চারিত শব্দের কি অসাধারণ ক্ষমতা।
হয়তো জ্ঞানী মানুষেরা এজন্যই একটি কথা বলতে অন্তত কয়েক বার চিন্তা করেন সেই কথার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কি হতে পারে। অর্থাৎ আমি যে কথাগুলি বলছি, সে কথাগুলো শ্রোতার মনে কেমন প্রভাব ফেলবে, তারপরে কথা বলে, নয়তো চুপ থাকে। আপনি নিজেও খেয়াল করে দেখবেন, জ্ঞানী ব্যক্তি কথা বলে কম, কিন্তু অজ্ঞ লোকেরাই হয় বাচাল।
কথা দ্বারা তৈরি হয় দ্বন্দ্বের, যার পরিণতি খারাপ থেকে অতি ভয়ঙ্কর পর্যন্ত হতে পারে। সংসার জীবনের অধিকাংশ সংসার ভেঙ্গে যায় শুধুমাত্র মুখের কথার দ্বারাই। অর্থাৎ জিহ্বা দ্বারা উচ্চারিত শব্দে। আর আপনি কষ্ট পান এমন বিষয় যদি বারংবার আপনার কানে ঘৃণাভরে উচ্চারিত হতে থাকে, সেক্ষেত্রে আপনার মানসিক পরিস্থিতি যে কেমন হতে পারে, তা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানে।
রাগের মাথায় বেশির ভাগ মানুষই তার হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে নিজের রাগ মেটাতে যাচ্ছেতাই ভাবে কথা শুনিয়ে দেয়। যে শুনিয়ে দিল, তার মন তো হালকা হয়ে গেল বটে, কিন্তু যে শুনলো তার মন হালকা হবে কিভাবে? মুহূর্তেই ভাল লাগার সম্পর্কে তৈরি হতে থাকে ঘৃণার উদ্রেক। আর ঘৃণাটা জমতে জমতে একটা সময় অনেক বড় শত্রুতার জন্ম হতেই পারে। এহেন পরিস্থিতিতে আপনি হয়তো “সরি” বলে ক্ষমা চাইতেই পারেন, শ্রোতা হয়তো আপনাকে ক্ষমা করতেও পারে। সেক্ষত্রে আপনার উপর জমে থাকা অভিমান দূর হতে পারে, কিন্তু মনের ভেতরে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, তা ১০০% ভালো হতেই পারে না। ক্ষতের পরিমাণটা হয়তো অনেকাংশে হ্রাস পেতে পারে মাত্র। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যদি না ঘটে, সেক্ষেত্রে ক্ষতের ছোট্ট অংশটুকুও একটা সময় বিলীন হয়ে যায়, কিন্তু যদি পুনরাবৃত্তি ঘটে, তাহলে এই ক্ষতের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতেই থাকবে।
হয়তো এজন্যই গ্রামাঞ্চলের মুরুব্বীরা বলতেন, কথা সাবধানে বল, কেননা কথারও ঋণ আছে। টাকা পয়সা। ধন-সম্পদের ঋণ পরিশোধ করা গেলেও কথার ঋণ কখনো শোধ করা যায় না।