পিতৃতন্ত্র সৃষ্টি করেছে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, সভ্যতা; তৈরি করেছে ধর্ম, দর্শন, আইন, সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্পকলা; এবং পৃথিবী ভ’রে জন্ম দিয়েছে তার প্রাতঃস্মরণীয় পুরুষ প্রতিভাদের। ওই প্রতিভারা মনীষী, মানুষপ্ৰজাতির গৌরব; অমর তাঁরা। তাঁদের স্তবে মুখর মানুষ; পুরুষেরা মুখর, পুরুষের কাছে শুনে শিখে নারীরাও মুখর। পুরুষ নারীদের এমনভাবে ছাঁচে ফেলে নিজেদের উপযুক্ত ক’রে নিয়েছে যে নারীরা স্তব করে নিজেদের শত্ৰুদেরও। পুরুষ প্রতিভারা বিকাশ ঘটিয়েছেন সভ্যতার, মানুষপ্ৰজাতির অনন্ত সম্ভাবনার প্রতিমূর্তি তারা; তাদের ছাড়া মানুষের কয়েক হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস অন্ধকার। মহাকালের আলোকশিখা তারা; বাল্মীকি, ব্যাস, হোমার, সফোক্লিস, প্লাতো, আরিস্তাতল, দান্তে, শেক্সপিয়র, কনফুসিয়াস, রুশো, রবীন্দ্রনাথের মতো অজস্র শিখায় উজ্জ্বল সৌরলোক। ওই শিখার পুরুষের শিখা, ওই প্রতিভার পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি, ওই মনীষীরা সবাই পুরুষতন্ত্রের পুরোহিত। তারা, প্রায়-সবাই, মানুষ বলতে বুঝেছেন নিজেদের লিঙ্গকে অর্থাৎ পুরুষকে; নারীকে মনে করেছেন। শুধুই নারী, মানুষ নয় বা বিকলাঙ্গ মানুষ। পুব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণে জন্মেছেন যতো মহাপুরুষ, তারা সবাই মগজ চূৰ্ণবিচূর্ণ ক’রে ভেবেছেন পুরুষের বিকাশ, প্রতিষ্ঠা ও মহিমার কথা, নারীকে করেছেন উপেক্ষা; আর যখন নারীর কথা ভেবেছেন, তখন তাৰে- দেখেছেন অবিকশিত মানুষরূপে, যার কোনো স্বায়ত্ত্বশাসিত অস্তিত্ব নেই। তাঁদের কাছে নারী হচ্ছে পুরুষের পাদটীকা। তাঁরা রচনা করে গেছেন বহু বাণী, ওই বাণী পৃথিবীকে এগিয়ে দিয়েছে এবং পেছনের দিকে টেনে ধরেছে; তাদের উদঘাটিত অনেক সত্য আলো দিয়েছে, আবার তাদের অজস্র মিথ্যা অন্ধকার ক’রে রেখেছে মানুষের চারপাশ। ওই অন্ধকার কেটে নতুন আলো সৃষ্টি করতে লাগছে দীর্ঘ সময়, ওই অন্ধকার রখনো কাটে নি। নারী সম্পর্কে তারা ছড়িয়েছেন অন্ধকার, রচনা করেছেন অভিনব অনন্ত কুসংস্কার; আর পুরুষতন্ত্র তাদের অন্ধকার ও কুসংস্কারে ঢেকে রেখেছে নারীকে। প্রাচীন থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত পুরুষতন্ত্রের মনীষীদের নারীবিষয়ক সমস্ত সিদ্ধান্ত ভুল ও প্রতিক্রিয়াশীল, এবং নারীদের জন্যে অশেষ ক্ষতিকর। নারীদের সম্পর্কে পুরুষরা বইয়ের পর বই লেখে, বিধানের পর বিধান দেয়। ভার্জিনিয়া উলফ (১৯২৯, ৪০-৪১) নারীদের সম্বোধন ক’রে বলেছেন :

‘আপনাদের কি ধারণা আছে প্ৰত্যেক বছর নারীদের নিয়ে কতো বই লেখা হয়? আপনাদের কোনো ধারণা আছে তার কতোগুলো পুরুষের লেখা? আপনারা কি অবগত যে আপনারা, সম্ভবত, মহাজগতের সবচেয়ে আলোচিত প্ৰাণী?… নারী আকর্ষণ ক’রে সাধারণ প্রাবন্ধিকদের, লঘু ঔপন্যাসিকদের, এমএ ডিগ্রিপ্রাপ্ত তরুণদের; এবং সে-সব পুরুষদের যাদের কোনো ডিগ্রি নেই; যাদের একমাত্ৰ যোগ্যতা হচ্ছে তারা নারী নয়।‘

পুরুষতন্ত্রের প্রতিভাদের চোখে পুরুষ সূর্য ওই পুরুষ-সৌরলোকে নারী তুচ্ছ অবজ্ঞেয় গ্রহের মতো, যে জীবন পেয়েছে পুরুষসূর্যকে ঘিরে আবর্তিত হওয়ার জন্যে। তারা কখনো মুখর হয়েছেন নারীনিন্দায়, নারীর মুখে মেখে দিয়েছেন সবচেয়ে কালো কলঙ্ক, এমন কোনো অপবিশেষণ নেই যাতে তারা নারীকে তিরষ্কার করেন নি। তারা তৈরি করেছেন নারীকে বেঁধে রাখার শক্ত শেকল; আর যারা একটু নারী ও আবেগকাতর, নৃশংস হ’তে যারা কুষ্ঠা বোধ করেছেন, তাঁরা নারীকে পরিণত করেছেন। পোষা আদুরে বেড়ালে। তাঁদের কাছে নারী বিশেষ উপযোগী প্ৰাণী, যাকে সম্ভোগ করা যায়, যে সন্তান জন্ম দিয়ে টিকিয়ে রাখে পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রকে; এ ছাড়া নারীর আর কোনো উপযোগিতা নেই তাদের কাছে। নারী যে মানুষ, পুরুষের মতোই মানুষ বা পুরুষ তারই মতো মানুষ, পুরুষের মতোই যে নারী সম্ভাবনাময়, এটা মনে হয় নি তাদের : নারীকে তাঁরা ক’রে রাখতে চেয়েছেন। পুরুষের দাসী, ভোগ্যপণ্য, তৃষ্ণার শান্তি। এ-লক্ষ্য থেকে তারা যা-কিছু লিখেছেন, সে-সবকে বলা হয় দর্শন, কাব্য, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা! ওই প্ৰতিভারা সবাই নারীর শত্ৰু, কেউ হিংস্রভাবে, মনোরমভাবে কেউ কেউ নারীর দিকে পাথর ছুঁড়েছেন, কেউ আলিঙ্গন করতে গিয়ে পিশে মেরেছেন নারীকে। নারীর শক্রতে ভ’রে আছে সময় ও সভ্যতা; নারীর মিত্র বেশি নেই, উনিশ শতকের আগে মিত্ররা দেখা দেন নি। পুরুষতন্ত্রের প্রতিভারা নারীদের বিরুদ্ধে ও বশে রাখার জন্যে লিখেছেন হাজারহাজার পৃষ্ঠা, খণ্ডখণ্ড রচনাবলি, পেয়েছেন অমরতা; তারা নারী সম্পর্কে সৃষ্টি করেছেন সম্পূর্ণ ভ্ৰান্ত ধারণা, যদিও ওগুলোকে পরম সত্য বলে পুজো করা হয়েছে শতকের পর শতক। এখনো করা হয়। তাদের সবার মত বিচার করা অসম্ভব ও নিরর্থক; খুব পুরোনো মনীষীদেব মতও বিচার করার দরকার নেই। আধুনিক সময়ের পুরুষতন্ত্রের প্রতিভাদের কয়েকজনের মত বিচার করলেই আধুনিক পিতৃতন্ত্রের নারীদর্শনের রূপটি স্পষ্ট ধরা পড়ে। আমি বেছে নিচ্ছি চারজনকে : রুশো। [১৭১২-১৭৭৮], রাসকিন (১৮১৯-১৯০০), রবীন্দ্ৰনাথ (১৮৬১–১৯৪১), যারা পড়েন নারীদের শক্রগোত্রে; এবং মিলকে (১৮০৬—১৮৭৩), যিনি নারীদের মহান মিত্ৰ।

এ-চারজনকে অকারণে নিচ্ছি না, নিচ্ছি বিশেষ কারণে। মানবমুক্তি ও সাম্যের রোম্যানটিক দার্শনিক জ্যাঁ-জাক রুশোর প্রভাব পড়েছে পৃথিবী জুড়ে, তার চোখেই তথাকথিত আলোকপ্ৰাপ্তরা নারীর মুখ দেখছে দু-শো বছর ধরে। রুশো সম্বন্ধে ভুল ধারণা রয়েছে অধিকাংশের:- যেহেতু তিনি চেয়েছিলেন মানুষের মুক্তি, তাই অনেকেরই ধারণা যে তিনি চেয়েছিলেন নারীরাও মুক্তি, কেননা নারী মানুষেরই অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বিস্ময়কর ও শোকাবহ সত্য হচ্ছে যে মানুষের সাম্যমুক্তির এ-দার্শনিক চেয়েছিলেন পুরুষের সাম্যমুক্তি। নারীকে তিনি প্ৰবল উৎসাহে ধার্মিকের মতো বলি দিয়েছিলেন পুরুষের যুপকাঠে। নারীর বেলায় রুশো পাড় প্রতিক্রিয়াশীল, নারীর তিনি অদ্বিতীয় শত্ৰু। জন রাসকিন ছিলেন ভিক্টোরীয় কপট নৈতিকতার এক বড়ো প্ৰবক্তা; নারীকে ‘রানী’ বলে ডেকেডেকে বেঁধে রাখার কৌশল বের করেছিলেন তিনি। তার প্রতিক্রিয়াশীল নারীবিষয়ক বক্তব্য নারীমুক্তির বাধারূপে কাজ করেছিলো পশ্চিমে; এবং তার প্রভাব পড়েছিলো। উনিশ শতকের শেষভাগের শিক্ষিত বাঙালির ওপরও। তারা নারীকে দেখেছিলেন কপট রাসকিনের চোখে। রবীন্দ্রনাথের প্রভাব আধুনিক বাঙালির ওপর অশেষ। রোম্যানটিক এ-মহাকবিকেও মনে করা হয় মানুষের মুক্তির মহাপুরুষ ব’লে, কিন্তু তিনিও পুরুষেরই মহাপুরুষ। তিনিও নারীকে সম্পূর্ণ মানুষরূপে গণ্য করেন নি; নারীকে তিনি ধারাবাহিকভাবে বিসর্জন দিয়েছেন নারী নামক এক ভুল ধারণার পায়ে। রবীন্দ্রনাথ রুশো ও রাসকিনের মিশ্রণ, আবার তাতে লাগিয়েছেন ভারতীয় ভেজাল; এবং হয়ে উঠেছেন নারীর মুক্তির এক বড়ো প্রতিপক্ষ। পশ্চিমে প্রথম নারীদের পক্ষে যে-পুরুষ যুদ্ধে নেমেছিলেন, পুরুষতন্ত্রের সমস্ত কপটতা ও মিথ্যাচার উদঘাটন ক’রে নারীমুক্তির পথটিকে প্রশস্ত করেছিলেন, তিনি জন স্টুয়ার্ট মিল। স্টুয়ার্ট মিলের পথ ধ’রেই দেড় দশক পরে এসেছিলেন এঙ্গেলস, যিনি সম্পূর্ণ প্রগতিশীল, এবং যাঁর পিতৃতন্ত্রের ভাষ্যের পরিচয় আমি আগেই দিয়েছি। এ-চারজনের পরিচয়েই ধরা পড়ে নারীর সাথে আধুনিক পিতৃতন্ত্রের শত্রুমিত্রতার রূপটি।

 

জাঁ-জাক রুশো

মার্ক্স-পূর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক জাঁ-জাক রুশো, যাঁর রচনা অন্তত একটি বিপ্লব সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলো। সাম্যবাদী মার্ক্সের রচনায় যেমন শ্রেণীসংগ্রাম, রোম্যানটিক রুশোর রচনায় তেমনি প্রকৃতি; এবং প্রকৃতি নামক মিথ্যার শেকলে রুশো বন্দী করেছেন নারীকে। রুশো বিভিন্ন রচনায় বিচার করেছেন নারীর প্রকৃতি বা স্বভাব, শিক্ষা, ও সামাজিক-রাজনীতিক ক্ষেত্রে নারীর স্থান। নারী সম্পর্কে তাঁর আবেগতাড়িত মত পশ্চিমকে বন্যার মতো ভাসিয়ে নিয়েছিলো, পশ্চিমের দেশেদেশে তাঁর মতকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করা হয়েছিলো উগ্রভাবে, কেননা পশ্চিম রুশোর মধ্যে পেয়েছিলো এক নতুন বিধানকর্তাকে। রুশো, ফরাশি বিপ্লবের দার্শনিক, বিরোধী ছিলেন সমস্ত শৃঙ্খলের, ভাঙতে চেয়েছিলেন সমস্ত শেকল ও মূর্তি; কিন্তু নারীর জন্যে তিনি তৈরি করেছিলেন অনেকগুলো শক্ত শেকল, এবং অবিনশ্বর করে রাখতে চেয়েছিলেন পিতৃতন্ত্রেব তৈরি নারীমূর্তিটি। তাঁর বিখ্যাততম উক্তি : ‘মানুষ জন্মে স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত’–সব মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, প্রযোজ্য শুধু পুরুষ-মানুষের ক্ষেত্রে। ‘মানুষ’ বলতে তিনি বুঝিয়েছিলেন ‘পুরুষ’, নারী রুশোর কাছে মানুষ ছিলো না। নারী পরাধীনভাবে জন্ম নিলেও তাঁর কোনো আপত্তি থাকতো না, খুবই সুখী বোধ করতেন। তিনি, কেননা তাহলে নারীকে সুচারুরূপে পুরুষাধীন করার জন্যে এতোগুলো বই তাকে লিখতে হতো না। নারী সম্পর্কে রুশোর দর্শনের সম্পূর্ণটাই ভ্ৰান্ত, যার সারকথা হচ্ছে: ‘নারী জন্মে পুরুষাধীন, এবং তাকে চিরকাল পুরুষাধীন রাখতে হবে’ বা ‘নারী জন্মে পুরুষাধীন, তবে কোনো নারী যদি স্বাধীনভাবে জন্ম নেয়, তবে পুরুষের কাজ হচ্ছে তাকে পুরুষাধীন করা।’ মানুষ ও রুশোর জন্যে বিশেষ মর্মান্তিক যে সাম্যমুক্তির এ-দার্শনিক রচনা করেছিলেন নারীকে বন্দী করার দর্শন, যা বাতিল ক’রে দেয় তাঁর মূল দার্শনিক প্রতিপাদ্যকে। রুশো ছিলেন পিতৃতন্ত্রের এক বড়ো পুরোহিত। পিতৃতন্ত্র সৃষ্টি করেছে নারীপুরুষের যে-বিভেদ ও চালিয়েছে যে-পীড়ন, রুশো তাকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। নারী ও পুরুষের জন্যে তিনি নির্দেশ করেন। সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন ও বিপরীত স্থান ও ভূমিকা। তবে তিনি নারীপুরুষের ভিন্ন স্থান ও ভূমিকাকে দাবি করেছেন ধ্রুব সত্যরূপে; তাঁর মতে, নারীপুরুষের প্রথাগত স্থান ও ভূমিকা কোনো প্রথা বা সামাজিক ব্যাপার নয়, তা প্রাকৃতিক। তবে তাঁর কাছে পুরুষের জন্যে যা প্রাকৃতিক নারীর জন্যে তা প্রাকৃতিক নয়, নারীপুরুষ রুশোর দর্শনে দুই প্রকৃতির অন্তর্গত। তাই প্রকৃতির এ-দার্শনিক সম্পূর্ণ ভিন্ন যুক্তিতে প্রতিষ্ঠা করেন কী প্রাকৃতিক নারীর জন্যে, আর কী প্রাকৃতিক পুরুষের জন্যে। নারীর প্রকৃতি রুশো নির্দেশ করেন নারীর ভূমিকা বা উপযোগিতা অনুসারে, অর্থাৎ নারীর যৌন ও সন্তান জন্ম দানের উদ্দেশ্য দিয়ে; আর পুরুষের প্রকৃতি নির্দেশ করেন পুরুষের চিন্তাশক্তি ও সৃষ্টিশীলতার অশেষ সম্ভাবনা দিয়ে। রুশোর নারী জৈবিক, পুরুষ অজৈবিক; নারী মাংস, পুরুষ দেবদূত। রুশোর নারী শারীরিক ও ইন্দ্রিয়গত; আর পুরুষ সৃষ্টিশীল ও মননশীল। এসব ধারণা রুশো পেয়েছেন প্রথা থেকে; এবং প্রথা থেকে পেয়েছেন নারী সম্পর্কে আরো অনেক অশীল ধারণা। পশ্চিমের পিতৃতন্ত্র যেমন নারীকে মনে করে সমস্ত অশুভর উৎস, রুশোর চোখেও নারী পৃথিবীর সমস্ত অশুভর প্রধান উৎস। নারী সম্পর্কে রুশোর সমগ্র দর্শনই ভ্ৰান্ত; তিনি তার চারপাশে যা দেখেছেন, তাকেই ধ্রুবসত্য ব’লে গণ্য করে চর্চা করেছেন দর্শনের।

রুশোর দর্শনে নারী হচ্ছে পুরুষের কামসামগ্ৰী, এবং তার স্থান পুরুষের অধীনে। নারী পুরুষের কামের তৃপ্তি যোগাবে, কিন্তু নিজে থাকবে কামবাসনাহীন। রুশোর মতে পুরুষের কাম অত্যন্ত মূল্যবান; নারীর কাজ হচ্ছে পুরুষের মূল্যবান কামকে চূড়ান্তরূপে পরিতৃপ্ত করা। রুশোর দর্শন হচ্ছে পুরুষ তার প্রবল কামবেগ ও প্রমোদের জন্যে চায় যে নাস্ত্রী হবে পরম কামবেদনময়ী ও চরম কামোত্তেজক; এবং একই সাথে পুরুষ আরো চায় যে নারী নিয়ন্ত্রণে রাখবে পুরুষের অনন্ত কামাবেগকে; তাই নারী হবে অযৌন ও শীতল সতী; নারীকে, একই সাথে ও শরীরে, হতে হবে তীব্ৰ কামজাগানো অগ্নিগিরি ও তুষারের মতো পরিশুদ্ধ; অতিকামময়ী ও নিষ্কাম। নারীর কাছে রুশো চান যে নারী একই সাথে পরিপূর্ণ থাকবে লােজনম সতীত্বে ও চিত্ৰতারকার প্রচণ্ড যৌনাবেদনে; নারী হবে মর্মরের মতো শুদ্ধ, আবার তীব্রতম সুরার মতো কামোদীপক, সবার জন্যে নয় শুধু স্বামীর জন্যে। একই শরীরে একই সাথে নারী হবে শুদ্ধতমা কুমারী ও বিলোল বেশ্যা। রুশো নিজে ছিলেন কামার্ত লম্পট, অনেক অবৈধ সস্তানের দায়িত্বহীন জনক, যিনি অনুরাগিণীদের গর্ভবতী ক’রে ফেলে যেতে দ্বিধা করেন নি, কিন্তু তিনিই আবার দর্শনচর্চার সময় খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন সঠিক পিতৃত্বের ব্যাপারে। বারবার তিনি বলেছেন যে স্বামীদের নিশ্চিত হতে হবে তাদের স্ত্রীদের সতীত্বে, যাতে তাদের সন্তানেরা আসলেই হয় তাদের নিজেদের সন্তান। সাবধান থাকতে হবে যাতে তাদের পুকুরে মাছ না ধরে অন্য কেউ। রুশো নারী ও পুরুষের জন্যে প্রস্তাব করেছেন ভিন্ন নৈতিকতা। নারীদের সতী রাখার জন্যে আবদ্ধ ক’রে রাখতে চেয়েছেন বাড়িতে, যাতে নারীরা অন্য পুরুষের সংসর্গে এসে হারিয়ে না ফেলে তাদের সতীত্বের হীরের টুকরোটি। রুশোর কাছে সতীই শ্রেষ্ঠ নারী; সতীত্ব ছাড়া নারীর আর কোনো গুণ থাকতে পারে না। সাম্য ও মুক্তির এ-দার্শনিক নারীপুরুষকে এক মানদণ্ডে বিচার করেন নি, এটা বিস্ময়কর ও বেদনাদায়ক। রুশো বিখ্যাত মূর্তিভগ্নকারীরূপে, কিন্তু নারীর ব্যাপারে তিনি প্রতিক্রিয়াশীলদের চূড়ামণি।

রুশো নারীর বিরুদ্ধে পিতৃতন্ত্রের সমস্ত চক্রান্তকে, নারীর অধীন অবস্থা ও পীড়নকে, শুধু প্রথা হিশেবেই মানেন নি, একেই তিনি মনে করেছেন সত্য বা ধ্রুব। রুশো অবশ্য পিতৃতন্ত্র, পরিবার ও রাষ্ট্রের উদ্ভবের প্রক্রিয়া ঠিকমতো বোঝেন নি; রোম্যানটিক হিশেবে তিনি যা কল্পনা করেছেন, যা তাঁর আবেগকে তৃপ্ত করেছে, তাকেই তিনি ধ্রুব বা প্রাকৃতিক বলে মনে করেছেন। তাঁর মতে পুরুষাধিপত্য ও নারীর অধীনতা একান্তভাবেই প্রাকৃতিক। তিনি বিশ্বাস করেন পিতৃতান্ত্রিক প্রথা ও আইনে নারীপুরুষের যে-অসাম্য, তা মানুষের সৃষ্টি নয়; তা শাশ্বত, প্রাকৃতিক, এবং যুক্তিসঙ্গত। রুশো মনে করেন প্রকৃতিই নারীপুরুষকে ভিন্ন ক’রে সৃষ্টি করেছে, পুরুষকে দিয়েছে যুক্তি ও শক্তি, নারীকে দিয়েছে রূপ; পুরুষ যে কামে সাহসী আর নারী লাজনাম, তা স্থির ক’রে দিয়েছে প্রকৃতিই। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক শব্দ দুটি পুরোনো কাল থেকেই বারবার ব্যবস্তৃত হয়েছে নারীর অধীন অবস্থাকে শোভন ও গ্রহণযোগ্য, এবং নারীকে বশীভূত করার জন্যে। রুশো, রোম্যানটিকতার পুরোধা, পুরোধা ছিলেন প্রকৃতিতত্ত্বের। নারী অক্রিয়, অধীন, সতী, যুক্তিরহিত, স্পর্শকাতর, লাজুক, ছলনাময়ী, ও আরো বহু কিছু; একথা পুরুষতন্ত্র রটাচ্ছে অনেক শতাব্দী ধ’রে; আর রুশো এগুলোকে ক’রে তোলেন তাঁর দার্শনিকতার ভিত্তি। নারীর এ-বৈশিষ্ট্যগুলো যে বিশেষ সামাজিক, আর্থনীতিক, সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার সৃষ্টি, তা না মেনে বা না বুঝে রুশো। ধ’রে নিয়েছেন যে প্রকৃতিই নারীকে নির্ভুলভাবে সাজিয়ে দিয়েছে এসব প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে। রুশো প্রকৃতিকে ব্যবহার করে চিরস্থায়ী করতে চেয়েছেন নারীর পুরুষাধীন শেকলপারা অবস্থা। তাঁর লেখায় পাওয়া যায় ‘প্রকৃতি, প্রকৃতি, এবং প্রকৃতি’, এবং ‘প্রকৃতি কখনো মিথ্যা বলে না’র মতো ধ্রুবপদ। যা কিছু রুশো যুক্তি ও তথ্যের সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে পারেন নি বা চান নি, তাতেই সহায়তা নিয়েছেন তিনি প্রকৃতি নামক অবৈজ্ঞানিকতার। প্রকৃতি রুশোর ও রোম্যানটিকদের একটি বড়ো কুসংস্কার; ওই কুসংস্কারের মন্দিরে রুশো বলি দিয়েছেন নারীদের। নারী সম্পর্কে রুশোর ধারণা দু-শো বছর আগেই বাতিল করে দিয়েছিলেন নারীবাদের প্রথম পুরোহিত, ফরাশি বিপ্লবের থেকেও বিপ্লবাত্মক, মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্‌ট্‌, তাঁর ‘এ ভিনডিকেশন অফ দি রাইটস অফ ওম্যান’ (১৭৯২, পঞ্চম পরিচ্ছেদ) গ্রন্থে।

নারীর প্রকৃতি, ভূমিকা, অবস্থা, শিক্ষা প্রভৃতি নির্দেশ ও ব্যাখ্যা করার জন্যে রুশো লিখেছেন একটি উপন্যাস : জুলি বা ল্য নোভেল এলোইজ (১৭৬১) ও একটি উপন্যাসসন্দর্ভ এমিল বা শিক্ষা (১৭৬২) , এবং নানা সন্দর্ভ। রুশো সভ্যতাবিরোধী, কেননা সভ্যতা নষ্ট করে মানুষকে। এমিল-এর (খণ্ড ১, ৫) শুরুতেই রুশো বলেছেন, ‘বিধাতা সব কিছু সৃষ্টি করে শুভরূপে; মানুষ তাতে হাত দেয়। আর সে-সব হয়ে ওঠে অশুভ।’ তার কাছে শুভ হচ্ছে প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক থাকা; রুশো প্রকৃতির দোহাই দিয়েছেন মানুষ, ক্রীতদাস, এমনকি কুকুর, আর ঘোড়ার মুক্তির জন্যে, শুধু নারীকে ছাড়া। তিনি নারীর অধীন অবস্থাকে স্থায়ী করার জন্যে এসব রচনা জুড়ে ব্যবহার করেছেন প্রকৃতিকে। তিনি নারীকে ক’রে তুলতে চেয়েছেন প্রাকৃতিক নারী, আর পুরুষকে প্রাকৃতিক পুরুষ; কিন্তু পুরুষকে প্রাকৃতিক করার জন্যে যে-রীতি অবলম্বন করেছেন নারীকে প্রাকৃতিক করার জন্যে অবলম্বন করেছেন তার বিপরীত রীতি। নারীকে প্রাকৃতিক করার নামে তিনি করেছেন পুরুষের দাসী। তাঁর এমিল উপন্যাসসন্দর্ভের নায়ক এমিল, আর নায়িকা সোফি, যাদের তিনি দূষিত পৃথিবীর ছোঁয়াচ থেকে বাঁচিয়ে ক’রে তুলতে চেয়েছের প্রাকৃতিক নরনারী। কিন্তু তাদের তিনি দিয়েছেন সম্পূর্ণ বিপরীত শিক্ষা। এ-উপন্যাসে মানুষরূপে বিকশিত করা হয়েছে এমিলকে, যে হবে স্বামী; আর নারীরূপে তৈরি করা হয়েছে সোফিকে, যে হবে প্রাকৃতিক পুরুষের অধীনস্থ প্রাকৃতিক স্ত্রী। এমিলকে শেখানো হয়েছে যে ‘পিতৃতান্ত্রিক পল্পীজীবনই মানুষের আসল জীবন, যা সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ আর সবচেয়ে প্রাকৃতিক’; আর সোফিকে দীক্ষা দেয়া হয়েছে : ‘যখন এমিল তোমার স্বামী হবে, তখন সে হবে তোমার প্রভু; প্রকৃতির অভিলাষ হচ্ছে যে তুমি অনুগত থাকবে তার’ [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১১৪)]। রুশোর কাছে নারীর অধীনতা প্রাকৃতিক ও ধ্রুব (এমিল, ৫:৩২৪) :

‘নারীপুরুষের আপেক্ষিক দায়িত্ব এক নয়, ও এক হতে পারে না। যখন নারী তার ওপর পুরুষের চাপিয়ে দেয়া অন্যায় অসাম্য সম্পর্কে অভিযোগ করে, তখন নারী ভুল কবে; এ-অসাম্য কোনো মানবিক প্ৰথা নয়, অন্তত এটা কোনো কুসংস্কারের ক্রিয়া নয়, বরং যুক্তিরই ক্রিয়া : যে-লিঙ্গের ওপর প্রকৃতি ভার দিয়েছে সন্তান ধারণের, সে-লিঙ্গ অবশ্যই সে-জন্যে জবাবদিহি করবে। অন্য লিঙ্গের কাছে।‘

স্ত্রীকে হ’তে হবে নিখুঁত সতী, কেননা সে স্বামীর সন্তান ধারণ করে গর্ভে; তবে, রুশোর মতে, স্বামীকে সৎ হওয়ার বিশেষ দরকার নেই। পুরুষকে একশো ভাগ নিশ্চিত হতে হবে তার নারীর গর্ভে জন্মেছে যে-সন্তান, যে হবে তার উত্তরাধিকারী, সে আর কারো নয়, তার। রুশো কাকের বাসায় কোকিলের বাচ্চা সহ্য করেন না। এ-কারণে রুশো নারী ও পুরুষের জন্যে স্থির করেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন নৈতিকতা ও নৈতিক শিক্ষা।

রুশো তাঁর প্রাকৃতিক নারী শনাক্ত করার জন্যে জোর দিয়েছেন লিঙ্গ বা কামের ওপর। এমিল-এ (৫,৩২১) সোফির শিক্ষা সম্পর্কে রুশো বলেছেন, ‘তার লিঙ্গ ছাড়া, নারী হচ্ছে পুরুষ; তার আছে একই প্রত্যঙ্গ, একই প্রয়োজন, একই গুণ’; এবং একটু পরেই রুশো বলেছেন, ‘তবে যেখানে কাম বা লিঙ্গ জড়িত, সেখানে পুরুষ ও নারী ভিন্ন; তারা পরস্পরের পরিপূরক।’ রুশোর কাছে নারী হচ্ছে নিজের লিঙ্গনিয়ন্ত্রিত; এবং তাঁর মতে, ‘একটি খাটি নারী ও একটি খাটি পুরুষের মধ্যে মুখে যতোখানি মিল রয়েছে মনেও তার চেয়ে একটুকুও বেশি মিল নেই।’ (এমিল ৫:৩২২)। রুশো প্রথম দিকে, অসাম্য সম্পর্কে প্রবন্ধ-এ (১৭৫৫), মনে করেছেন যে সঙ্গম একটি সহজাত দরকারি ক্রিয়া, যাতে নারীপুরুষ অংশ নেয় স্বাধীনভাবে; কিন্তু পরে কাম উপভোগ রাখেন তিনি পুরুষের জন্যে, নারীকে দেন পুরুষের কাম পরিতৃপ্ত করার দায়িত্ব। পুরুষ হয়ে ওঠে আক্রমণকারী, নারী আক্রান্ত। তবে নারীর কাজ হচ্ছে পুরুষের কাম জাগিয়ে তোলা, তাকে আক্রমণকারী ক’রে তোলা; তাই নারীকে হতে হবে পুরুষের কাছে আবেদনময়ী; নারীকে হ’তে হবে লাজনম্র সতী, কিন্তু তার থাকতে হবে সুখকর ছেনালিপনা। কারণ পুরুষ সতী চায়, আবার নারীর ছলাকলা না থাকলে পুরুষ উদ্দীপ্ত হয় না। রুশো প্রকৃতির দোহাই দিয়েছেন, কিন্তু আসলে তিনি প্রকৃতিকে বিদায় জানিয়ে প্রাকৃতিক ব’লে মনে করেছেন তাঁর সময়ের ফরাশিদের কামাচরণকে। নারীকে সতী হতে হবে, তবে তা নারীর নিজের জন্যে নয়; পুরুষের কাম জাগানোর জন্যে, কেননা নারীর ‘সতীত্ব প্রজ্জ্বলিত করে পুরুষদের’। রুশোর মতে নারীকে তৃপ্ত করা পুরুষের কাজ নয়, তবে ‘নারীকে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে পুরুষের প্রমোদের জন্যে’ (এমিল, ৫:৩২২)। রুশো প্রকৃতিকে পরিণত করেছেন ছেনাল পতিতায়। নারী পুরুষের কাম জাগাবে, পুরুষের কামকে পরমভাবে পরিতৃপ্ত করবে, আবার নারীকে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে অতিকামে পুরুষ ধ্বংস হয়ে না যায়। কেননা তাতে- ‘ধ্বংস হয়ে যাবে উভয়েই, আর মানবজাতি লুপ্ত হয়ে যাবে সে-প্রক্রিয়ায় যে-প্রক্রিয়ায় তার টিকে থাকার কথা’ (এমিল, ৫:৩২২)। নারীকে দিয়েছেন রুশো দুটি বিপরীত দায়িত্ব : নারী হবে উর্বশী ও সীতা; নারী প্রলুব্ধ করবে পুরুষকে, আবার নিবৃত্ত করবে তাকে; নারী হবে কামোদীপক, রূপসী, সংরাগপূর্ণ, আবার হবে সুচারু সতী–এক দেহে মেরি ও মেরেলিন মনরো।

রুশোর মতে পুরুষের জীবনে তার লিঙ্গের প্রভাব কম, আর নারীর সম্পূর্ণ জীবনই তার লিঙ্গের পরিণতি; অর্থাৎ পুরুষ হচ্ছে মানুষ, কিন্তু নারী সব সময়ই নারী। রুশো বলেছেন (এমিল, ৫:৩২৪): ‘পুরুষ কখনো কখনো পুরুষ, নারী সব সময়ই নারী, অন্তত তার যৌবনকাল ভ’রেই নারী; তার সব কিছুই মনে করিয়ে দেয় তার লিঙ্গকে।’ তার মতে সন্তানধারণই হচ্ছে নারীর ‘প্রকৃত কর্তব্য’। তাই নারীকে শিক্ষা দিতে হবে। এমনভাবে, যাতে ‘নারী পরিতৃপ্ত করতে পারে পুরুষকে ও অধীনে থাকতে পারে পুরুষের’; কেননা ‘প্রকৃতির অভিলাষ হচ্ছে নারী অনুগত থাকবে পুরুষের।‘ রুশো প্রকৃতির কথা বলেছেন, কিন্তু তিনি প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছেন প্রতারণারূপে; তাঁর নারদর্শনে প্রাকৃতিক কিছু নেই. এর সবটাই পিতৃতান্ত্রিক। রুশো পিতৃতন্ত্রকেই মনে করেছিলেন প্রকৃতি, যদিও তা একটি সুপরিকল্পিত শোষণমূলক ব্যবস্থা। রুশোর অনেক আগে প্লাতো নারীপুরুষকে দিতে চেয়েছিলেন একই শিক্ষা; রুশো তার প্রতিবাদ করেছেন। নায়িকা জুলিকে দিয়ে রুশো বলিয়েছেন [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১১৮)]; ‘আক্রমণ ও প্রতিরোধ, পুরুষের সাহস আর নারীর লাজনম্রতা, তোমাদের দার্শনিকেরা যেমন ভাবেন তেমন প্রথা নয়, এগুলো প্রাকৃতিক ব্যাপার। এগুলোকে ব্যাখ্যা করা যায় সহজেই, এবং এগুলো থেকে বের করা যায় আর সমস্ত নৈতিক ভিন্নতা।’ তাই রুশো এমিল-এর নায়ক এমিলের জন্যে উদ্ভাবন করেছেন এক রকম প্রাকৃতিক শিক্ষা, আর নায়িকা সোফির জন্যে আরেক রকম প্রাকৃতিক শিক্ষা। সোফিকে তৈরি করেছেন তিনি পুরুষের কামসামগ্ৰী, পতির অনুগত সতী স্ত্রী ও সন্তানবৎসল মাতারূপে। এমিলকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে স্বাধীন পুরুষরূপে বিকশিত হওয়ার, সোফিকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে এমিলের নারী হওয়ার : এ হচ্ছে রুশোর প্রকৃতির নির্দেশ। রুশো পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাঁর ‘প্রাকৃতিক নারী’র অবস্থান নির্দেশ করেছেন। পুরুষের পদতলে (এমিল, ৫:৩২৮) :

‘নারীপুরুষ সৃষ্টি হয়েছে পরস্পরের জন্যে, তবে তাদের পারস্পরিক নির্ভরতা সমান নয় : পুরুষ নারীর ওপব নির্ভরশীল তার কামনার জন্যে; নারী পুরুষের ওপর নির্ভরশীল তার কামনা ও প্রয়োজন দুয়েরই জন্যে; পুরুষ নারী ছাড়া চমৎকার চলতে পারে। কিন্তু নারী পুরুষ ছাড়া চলতে পারে না। পুরুষের সাহায্য, সদিচ্ছা, শ্রদ্ধা ছাড়া নারী তার জীবনের লক্ষ্য পূর্ণ করতে পারে না; তারা আমাদের অনুভূতির ওপর নির্ভরশীল, তা নির্ভর করে আমাদের কাছে তাদের যোগ্যতা, তাদের রূপ আর সতীত্ব কতোটা মূল্যবান বলে মনে হয়, তার ওপর। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে নারীরা, তাদের নিজেদের ও তাদের সন্তানদের জন্যে, পুরুষের বিচারবিবেচনার ওপর নির্ভরশীল।‘

রুশো শোষণমূলক পিতৃতান্ত্রিক পরিবারকে প্রাকৃতিক মনে ক’রে নারীর জন্যে এমন দর্শন ও ব্যবস্থা রচনা করেছিলেন, যা মানুষ সম্পর্কে তাঁর দর্শনের সম্পূর্ণ বিরোধী। রুশো ঘেন্না করতেন তাঁর সময়ের পুরুষদের, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন তাদের সহজাত অনন্ত শক্তিতে; মনে করতেন প্রতিবেশ ও শিক্ষার দোষেই বিকাশ ঘটতে পারছে না তাদের শক্তির। তিনি বিশ্বাস করতেন নারীও রয়েছে পুরুষের নষ্টের মূলে; নারী কাম দিয়ে নষ্ট করছে পুরুষদের। নারীকে সন্তুষ্ট করতে গিয়েই পুরুষ ব্যর্থ হচ্ছে মহান সব অর্জনে, হারাচ্ছে জ্যোতির্ময় পৌরুষ ও প্রতিভা!

রুশো নারীর বৈশিষ্ট্যের একটি তালিকা তৈরি করেছেন এমিল-এ (৫:৩৩২-৩৪৫), এবং দাবি করেছেন নারীর ওই সব বৈশিষ্ট্য সহজাত। লজ্জা, নমতা, সাজসজ্জা ও অলঙ্কারপ্রিয়তা, অন্যদের খুশি করার স্বভাব, বিনয়, চতুরতা রুশোর মতে নারীর সহজাত; এমনকি অন্যায় সহ্য করারও নারীর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। রুশো মনে করেন দাসীত্ব নারীর জন্যে প্রাকৃতিক; এবং এসব থাকলেই নারী হয়ে ওঠে খাঁটি নারী! রুশোর মতে, নারীকে যেহেতু পুরুষের অনুগত থাকতে হবে, এমনকি অবিচার সহ্য ক’রে বাঁচতে হবে, তাই নারীর থাকা দরকার সহজাত মাধুর্য। নারীর যে রয়েছে মেধা, রুশো তা স্বীকারই করেন না। তিনি বলেন [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১২৯)], ‘নারী সাধারণত কোনো শিল্পকলা পছন্দ করে না, সেগুলোর কিছু জানে না, এবং তাদের কোনো প্রতিভা নেই। যে-সমস্ত তুচ্ছ কাজে লাগে ত্বরিৎ বোধ, রুচি, শোভা, কখনো কখনো লাগে সামান্য দর্শন ও যুক্তি, সেগুলো তারা পারে। কিন্তু তাদের নেই প্ৰতিভার অলৌকিক শিখা’। রুশোর নারীর কোনো মেধা নেই, সে কামসামগ্ৰী; নারী হবে স্ত্রী ও মা, তাই তার থাকতে হবে মেধা ছাড়া সমস্ত মেয়েলি গুণ। নারীর মেধাহীনতা সম্পর্কে রুশোর প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্য পুরোপুরি উদ্ধৃত ক’রে, একবার ‘কী ছাইপাশ’ ব’লে, রুশোকে বাতিল ক’রে দিয়েছিলেন মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্‌ট্‌ (১৭৯২, ১২৪, ও পঞ্চম পরিচ্ছেদ)। নারীর মেধাশূন্যতা সম্পর্কে রুশোর সারকথা (এমিল, ৫: ৩৪৯-৩৫০) :

‘বিমূর্ত ও প্রকল্পনিক সত্য অনুসন্ধান, বিজ্ঞানের নীতি ও সূত্র উদঘাটন, যা কিছুতে দরকার পড়ে চিন্তার সাধারণীকরণ, তা নারীর আয়ত্তের বাইরে; তাদের বিদ্যা হবে ব্যবহারিক, তাদের কাজ হচ্ছে পুরুষের আবিষ্কৃত সুত্র প্রয়োগ করা, এবং তাদের দায়িত্ব হচ্ছে সে-সব পর্যবেক্ষণ করা, যা ভিত্তি ক’রে পুরুষ রচনা করবে সাধারণ সূত্র। নারীর সমস্ত ভাবনা চলবে পুরুষকে ঘিরে, এবং তারা আয়ত্ত করার করার চেষ্টা করবে সে-সব সুখকর সাফল্য, যা সুন্দর; কেননা প্ৰতিভার কাজ তাদের আয়ত্তের বাইরে। তাদের নেই বিজ্ঞানে সফল হওয়ার মতো যথেষ্ট যথাযথতা বা মনোযোগশক্তি, আর পদার্থবিদ্যায় সফল হতে পাবে তারাই, যারা সক্রিয়তম, চবম অনুসন্ধিৎসু, যারা অনুধাবন করতে পারে বিচিত্র ধরনের বস্তু, এটা তাদের এলাকা, যাদের রয়েছে। তীব্ৰতম শক্তি, যারা ইন্দ্ৰিয়গ্রাহ্য সত্তা ও প্রকৃতির নিয়মের সম্পর্ক বিচাবের জন্যে চরমভাবে প্রয়োগ করে তাদের শক্তি। নারী প্রাকৃতিকভাবেই দুর্বল,এবং নিজের চিন্তাভাবনা নিয়ে বেশি দূর এগোতে পারে না।… নারীর আছে বোধশক্তি, পুরুষের আছে প্রতিভা; নারী পর্যবেক্ষণ করে, পুরুষ প্রয়োগ করে যুক্তি।’

রুশোর মতে, ‘চিন্তার ব্যাপারটি নারীদের অচেনা নয়, তবে তাদের উচিত যুক্তির ওপরে শুধু চোখ বুলিয়ে যাওয়া’; তাই রুশোর কাছে নারীর মানসিক শক্তির কোনো মূল্য নেই। রুশোর বিধান হচ্ছে নারীকে শরীর-মনে হ’তে হবে তাই, পুরুষ তাকে যা হওয়াতে চায় : নারী হবে পুরুষের সহচরী বা সহকারী বা রক্ষিতা। গবেষণাগারে পুরুষ হবে বৈজ্ঞানিক, আর নারী, বড়োজোর, হবে তার গবেষণা সহকারী।

নারী স্বায়ত্তশাসিত নয়, নারীর কোনো দরকার ছিলো না, পুরুষ আছে বলেই নারী দরকার। বাইবেলের বিধাতা ও রুশোর মধ্যে রয়েছে সুন্দর মিল; বিধাতা স্বর্গে একটি পুরুষ সৃষ্টির পর তার সহচরী বা পত্নীরূপে সৃষ্টি করে একটি নারী। রুশোও এমিলকে সৃষ্টি করার পর, বইয়ের চারখণ্ড জুড়ে তাকে বিকশিত ক’রে, পঞ্চম খণ্ডে এসে এমিলের জন্যে সৃষ্টি করেন একটি নারী, যার নাম সোফি। এমিল-এর পঞ্চম খণ্ডের নাম ‘সোফি, বা নারী’। এ-খণ্ডের (৫:৩২১) শুরুতেই বিধাতার স্বরে রুশো বলেন, ‘পুরুষের একলা থাকা ভালো নয়। এমিল এখন পুরুষ, এবং তাকে আমাদের দিতে হবে তার প্রতিশ্রুত পত্নী [হেল্‌প্‌মিট : সহচরী]। সে-পত্নী হচ্ছে সোফি।’ রুশো নারীকে দেখেছেন। পুরুষের পত্নী বা সহকারী-সহচরীরূপে, নারীকে হতে হবে এই অন্য কিছু হওয়া নারীর জন্যে অশুভ। রুশো তাঁর জুলি বা ল্য নভেল এলোইজ-এর নায়িকা জুলিকে করেছেন নিজের কণ্ঠস্বর; ওই নারী তার প্রেমিককে উচ্চকণ্ঠে জানায় যে নারীপুরুষের সমশিক্ষা সম্বন্ধে প্লাতো যা বলে গেছেন, তা ভুল; কারণ প্রকৃতির উদ্দেশ্য” ও ‘স্রষ্টার অভিলাষ’ থেকে স্পষ্ট যে নারীপুরুষ একধরনের নয় [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১৩২)]। প্রকৃতি আর স্রষ্টা নারীর নিয়তিই করেছে মাতৃত্ব, সন্তানলালন ও ঘরকন্ন; পুরুষের জন্যে রেখেছে বাইরের জগতের সাফল্য; তাই ‘এক লিঙ্গের আরেক লিঙ্গকে অনুকরণ করা চরম নির্বুদ্ধিতা’। রুশোর কোনো উৎসাহ ছিলো না নারীর শক্তি ও সম্ভাবনা সম্পর্কে; তিনি চেয়েছেন নারীকে পুরুষের অধীনে পুরুষের পরিপূরক ক’রে গড়ে তুলতে। বালিকাদের মধ্যে তিনি মাঝেমাঝে পরিচয় পেয়েছেন বুদ্ধির, কিন্তু তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে বালিকাদের ওই বুদ্ধিটুকু বিধাতা দিয়েছেন তাদের সতীত্বের দামি রত্নটিকে রক্ষা করার জন্যে। জুলি বলেছে, নারীর রয়েছে একটি ভয়ঙ্কর সম্পদ, যার নাম সতীত্ব, আর তাদের বুদ্ধি দরকার শুধু ওই সম্পদটিকে রক্ষার জন্যে। রুশোর কাছে নারীপুরুষ, নৈতিক ও মননগতভাবে, পরস্পরের পরিপূরক; একা তারা অসম্পূর্ণ, কিন্তু একত্রে তারা গড়ে তোলে এক সম্পূর্ণ সুষম সত্তা। নারীর আছে সামান্য স্ত্রীবুদ্ধি, পুরুষের আছে প্রতিভা; নারী শুধু দেখে, পুরুষ রচনা করে আভ্যন্তর সূত্র। রুশোর মতে, নারীপুরুষ পরস্পরের পরিপূরক না হ’লে বিয়ে ব্যাপারটি হবে বিপদসঙ্কুল, এবং বিপদগ্ৰস্ত হবে সামাজিক স্থায়িত্ব। পরিপূরক শব্দটি বেশ প্রতারক; নারী ও পুরুষ ঠিক তেমন পরিপূরক পরস্পরের যেমন পরিপূরক প্ৰভু ও দাস, ব্ৰাহ্মণ ও শূদ্ৰ।

রুশো নারী ও পুরুষের জন্যে দু-রকম শিক্ষার প্রস্তাব করেছেন। পুরুষকে দিয়েছেন তিনি এমন শিক্ষা, যাতে সে হয়ে ওঠে নাগরিক বা স্বাধীন-প্ৰাকৃতিক মানুষ, আর নারীকে দিয়েছেন এমন শিক্ষা, যাতে নারী স্বাধীন বা প্রাকৃতিক হওয়ার বদলে হয়ে ওঠে পুরুষের অনুগত স্ত্রী। তাকে শেখাতে হবে লােজনম্রতা, গৃহপালন, আর প্রথার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। রুশোর প্রাকৃতিক পুরুষ বেড়ে ওঠে মুক্ত মানুষরূপে, নারী বেড়ে ওঠে নিয়ন্ত্রিতভাবে, তার জীবনের উদেশ্য অনুসারে। তাই এমিল বেড়ে উঠেছে তার মাতারূপে। রুশো নারীর জন্যে প্রস্তাব করেছেন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত উপযোগিতামূলক শিক্ষা, যা আসলে কোনো শিক্ষাই নয় (এমিল : ৫ ) :

‘নারীর সমস্ত শিক্ষা হবে পুরুষের আপেক্ষিক। তাদের খুশি করা, তাদের কাছে উপকারী হওয়া, তাদের কাছে প্রিয় ও সম্মানিত হওয়া, শিশুকালে তাদের লালন করা, বয়স্ককালে তাদের যত্ন করা, তাদের পরামর্শ ও সান্ত্বনা দেয়া, তাদের জীবনকে মধুর ও সুন্দর করা হচ্ছে নারীর সব সময়ের দায়িত্ব, এবং শিশুকালেই তাদের এসব শেখাতে হবে। এ-নীতি আমরা যতোটা অমান্য করবো, ততোটা বিচ্যুত হবো। আমাদেব লক্ষ্য থেকে, এবং এছাড়া আর যে-শিক্ষাই নারীদের দেয়া হোক-না-কেনো, তা তাদের বা আমাদের জন্যে সুখের হবে না।’

তাই নারীকে কোনো মননগত শিক্ষা দেয়া যাবে না, তাদের দিতে হবে নারীশিক্ষা। নারী মেনে চলবে স্বামীর অধীনতা, লালন করবে সন্তানদের। সতী নারী থাকবে কোথায়? রুশোর উত্তর হচ্ছে, নারী জীবন কাটাবে অবরোধের মধ্যে। রুশোর মতে, ‘সম্পূর্ণ অবরোধ ও গৃহিণীপনার মধ্যে জীবন কাটানোই নারীর জন্যে প্রকৃতি ও যুক্তির বিধান’। পেরিক্লেসের আদর্শে তিনি আস্থা পোষণ করেন যে সেই উৎকৃষ্ট নারী, যার সম্পর্কে কেউ কখনো কোনো কথা বলে না। রুশো শিক্ষা দিয়ে নারীকে অভ্যস্ত ক’রে তুলতে চেয়েছেন অধীনতার মধ্যে বাস করতে। এ-উদ্দেশ্যে তিনি রচনা করেছেন মর্মান্তিক প্রতিক্রিয়াশীল বিধান (এমিল, ৫:৩৩৩) :

‘নিয়মিত নিয়ন্ত্রণ নারীর মধ্যে সৃষ্টি করে একরকম বশমানা ভাব, যা নারীর দরকার সারা জীবনভর, কেননা সে সারা জীবন থাকবে পুরুষের অধীনে, বা পুরুষের বিচারবিবেচনার অধীনে, এবং সে কখনো পুরুষের মতের ওপর প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না নিজের মত। নারীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দরকার ভদ্রতা; নারী তৈরি হয়েছে পুরুষ নামক এমন এক ক্রুটিপূর্ণ, এমন এক দুশ্চরিত্র ও ভ্ৰান্তিপূর্ণ প্রাণীর কাছে অনুগত থাকার জন্যে যে নারীকে শিশুকালেই শিখতে হবে অন্যায়ের কাছে আত্মসমৰ্পণ করতে এবং বিনাপ্রতিবাদে স্বামীর সমস্ত অন্যায় সহ্য করতে।‘

অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে মন্ত্রণামূলক দর্শন রচনা করেছেন যে-দার্শনিক, তিনি নারীর জন্যে বিধান তৈরি করেছেন। পুরুষের অধীনে থাকার, অন্যায়ে অভ্যস্ত হওয়ার। তবে রুশো বিপদে পড়েছেন তার নারী নিয়ে। নারীকে তিনি একই দেহে করতে চেয়েছেন কামোদ্দীপক যৌনসামগ্ৰী ও পরম সতী; কিন্তু দেখেছেন এমন নারী তাঁর প্রাকৃতিক পুরুষের প্রাত্যহিক সাথী হ’তে পারে না। রুশোর প্রাকৃতিক পুরুষ ও আবেদনময়ী সতীর নিয়তি হচ্ছে অধিকাংশ সময় পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা!

রুশোর প্রাকৃতিক নারী প্রাকৃতিক নয়, বানানো; রুশোর নারী পুরুষতন্ত্রের কলে উৎপাদিত সবচেয়ে আকর্ষণীয় সামগ্ৰী। রুশো প্ৰবক্তা সাম্যমুক্তির; তবে তাঁর দর্শনে সাম্যমুক্তির মতো মানবিক ব্যাপারগুলো পুরুষের জন্যে, নারীর জন্যে নয়। মানুষের অসাম্যে ক্ষুব্ধ রুশো উদ্ভাবন করতে চেয়েছেন এমন সামাজিক-রাজনীতিক পদ্ধতি, যাতে দূর হবে মানুষের অসাম্য। রুশো অবশ্য বৈজ্ঞানিকের বস্তুনিষ্ঠ চোখে, মার্ক্সের মতো, অসাম্যকে দেখেন নি, দেখেছেন ব্যক্তিগত মন্ময় দৃষ্টিতে; অসাম্য সম্পর্কে তাঁর ঘৃণা জন্মেছে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে। রুশো অসামাবিষয়ক প্রবন্ধ-এ (১৭৫৫) দেখিয়েছেন কীভাবে আদিম স্বাধীন পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে ক্রমশ ধনীদের দ্বারা গরিবদের শোষণের ফলে সমাজে উৎপত্তি ঘটে অসাম্যের। রুশো বলেছেন [ দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১৪২)] :

‘অগণন মানুষ বলি হবে মুষ্টিমেয়র কাছে, আর সাধারণের সুবিধা বলি হবে ব্যক্তিগত সুবিধার কাছে। সুবিচার ও অধীনতার মতো আপাতসুন্দর শব্দগুলো সবসময় কাজ করবে সন্ত্রাসের উপকরণ ওঅবিচারের অন্ত্ররূপে; এভাবে উচ্চশ্রেণীগুলো, যারা নিজেদের পাবি করে অন্যদের জন্যে উপকারী ব’লে, আসলে অন্যদের শুষে সেবা করছে নিজেদের।‘

রুশোর মতে বেশি শক্তি বা সম্পদ কাউকে বৈধ অধিকার দিতে পারে না। তাঁর বিশ্বাস প্রকৃতি একজনকে দেয় নি অন্যের ওপর প্রভুত্বের অধিকার, এবং কেউই বলপ্রয়োগে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। রাজনীতিক আধিপত্যের সমস্যাটির বৈধ সমাধান হতে পারে শুধু সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে, যাতে মানুষের অভিলাষ হয়ে ওঠে। সার্বভৌম। এমন চুক্তি ছাড়া রাজনীতিক ব্যবস্থা হয় ‘উদ্ভট, স্বৈরাচারী’। রুশো পুরুষের জন্যে চান সার্বভৌম অভিলাষ, কিন্তু নারীকে রাখেন পুরুষের উদ্ভট স্বৈরাচারের অধীনে।

রুশো বিশ্বাস করেন সব পুরুষের অসীম সম্ভাবনায়; তিনি মনে করেন সুযোগ পেলে ভূমিদাসও ভূষিত হতে পারে জমিদারের সমস্ত গুণে। রুশোর কাছে ক্রীতদাসত্ব সম্পূর্ণ অবৈধ; কেননা ক্রীতদাসত্ব মনুষ্যত্বের অবমাননা; এতে একটি মানুষ নিজের জীবন, স্বাধীনতা, অধিকার সমর্পণ করে আরেকটি মানুষের কাছে। প্রকৃতি মানুষের এমন স্বায়ত্তশাসন খর্ব করার বিরোধী। কিন্তু সাম্যমুক্তির এ-প্রচণ্ড প্রবক্তা নারীর ক্ষেত্রে ভুলে যান সাম্যমুক্তির কথা; তিনি সাম্যমুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান নারীকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে। তিনি নারীর ক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ করেন অসাম্য ও অধীনতা। রুশোর মতে, নারী অধীনে থাকবে পুরুষের, আর পুরুষকে বশে রাখার জন্যে ব্যবহার করে যাবে তার রূপ, বুদ্ধি, বোধি; এর সাহায্যেই নারী ক্ষতিপূরণ করে নেবে নিজের অসাম্য ও অধীনতার। রুশোর কাছে পুরুষ শক্তিমান আর নারী পুরুষের অধীন, এ হচ্ছে ধ্রুব সত্য; নারী জীবনযাপন করবে। এ-সত্য মেনে নিয়ে রুশোর চিন্তায় নারীর রাজনীতিক অধিকারের কথাই ওঠে নি; নারীর ভোটাধিকারের কথা তিনি ভাবেন নি। ‘জেনেভার মধুর ও সতী নারীদের’ তিনি বলেছেন যে তাদের নিয়তি হচ্ছে পুরুষদের শাসন করা, অর্থাৎ তারা প্রভাব বিস্তার করবে স্বামীদের মাধ্যমে। রুশোর রাজ্যে পুরুষ রাজা শাসন করবে, আর রাজাকে নিজের ‘সতীত্বের শক্তি’তে শাসন করবে নারী! নারী সতী আর অনুগত হয়ে পুরুষের ওপর বিস্তার করবে। ‘আনুগত্যমূলক আধিপত্য’! এই হচ্ছে নারীর রাজনীতিক অধিকার। শুধু রাষ্ট্রে নয়, রুশোর বিধানে পরিবারের মধ্যেও নারীর কোনো কর্তৃত্ব নেই, স্বামীই পরিবারের প্রভু। রুশোর কাছে পরিবার একটি প্রাকৃতিক সংস্থা, তার প্রাকৃতিক প্ৰভু স্বামী। রুশো বলেছেন [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১৪৬), ‘প্রকৃতির বিধান হচ্ছে নারী অনুগত থাকবে পুরুষের’; আর ‘জীবন ধারণ করবে তার স্বামীর নিরঙ্কুশ আইনের অধীনে।’ পরিবারে স্ত্রী স্বামীকে ছলেবলে খুশি রেখে অর্জন করবে সামান্য ক্ষমতা। রুশো যে-পরিবার প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা মোটেই প্রাকৃতিক নয়; তা একটি সুশৃঙ্খল, সম্পদভিত্তিক, পিতৃতান্ত্রিক পরিবার। রুশোর মতে, পরিবারে কর্তৃত্ব স্বামী ও স্ত্রী উভয়েবই থাকতে পারে না, কেননা পরিবারে থাকা দরকার একজন প্রধান, যে নোবে সমস্ত সিদ্ধান্ত। সাধারণ অভিলাষের এ-প্রবক্তা পরিবারের মতো একটি সংস্থায়ও সাধারণ অভিলাষের মূল্য দেন নি। রুশো নারীকে পুরুষের অধীনে রাখতে চেয়েছেন নারীর গর্ভধারণের জন্যেও, কারণ তখন নারী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে; রুশোর মতে, ‘নারীকে কর্তৃত্ব না দেয়ার এ-ই যথেষ্ট কারণ।’ আরেকটি কারণেও পুরুষের অধীনে রেখেছেন তিনি নারীকে, তা হচ্ছে নিশ্চিত পিতৃত্বের পরিচয়; পুরুষকে ঠিকমতো বুঝে নিতে হবে তার নারীর গর্ভে যারা জন্মাচ্ছে তারা তার কিনা? নারীপুরুষের সাম্য স্বীকার না করার পেছেনে ছিলো রুশোর একটি গোপন ভীতি। রুশোর ভয় হচ্ছে যদি পুরুষের অধীনে না রাখা হয় নারীকে, তাহলে নারী পুরুষের ওপর স্থাপন করবে নিরঙ্কুশ আধিপত্য। রুশোর বিশ্বাস ছিলো যে নারীকে প্রকৃতি দিয়েছে এমন কামক্ষমতা, যা দিয়ে নারী বশীভূত পরাভূত ক’রে রাখতে পারে পুরুষকে; নারী পুরুষকে ক’রে তুলতে পারে অসহায়। অর্থাৎ জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নারী নিয়ন্ত্রক। রুশো নারীভীতি পেয়েছেন ঐতিহ্য থেকে; নারীকে দেখেছেন তিনি কামদানবী অশুভ শক্তিরূপে। একটি কবিতায় নারীকে সম্বোধন ক’রে রুশো লিখেছিলেন, ‘সম্মোহিনী ও ভয়ঙ্করী, যাকে আমি পুজো আর ঘৃণা করি,… পুরুষকে যে পরিণত করে ক্রীতদাসে।’

রুশোর দর্শনে সাম্যের মতোই মূল্যবান মুক্তি বা স্বাধীনতা; তবে সাম্য যেমন পুরুষের ব্যাপার, মুক্তিও পুরুষেরই ব্যাপার, নারীর নয়। নারীর মুক্তি খুঁজেছেন রুশো পুরুষের পায়ে; মুক্তি নারীর জন্যে নয়, নারীকে তিনি সুপরিকল্পিতভাবে বিন্যস্ত করেছেন পুরুষের অধীনে। রাজনীতিক অর্থনীতিবিষয়ক প্রবন্ধ-এ (১৭৫৫) রুশো [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১৫৪)] বলেছেন, ‘শুধু স্বাধীন মানুষের মধ্যেই মনুষ্যত্ব স্পষ্ট; স্বাধীনতা মানুষের গুণাবলির মধ্যে মহত্তম’; এবং ‘স্বাধীনতা অস্বীকার করা মনুষ্যত্ব অস্বীকার করা, মনুষ্যত্বের অধিকার, এমনকি তার দায়িত্ব, বর্জন করা। এমন অস্বীকার অসামঞ্জস মানুষের প্রকৃতির সাথে, এবং তার স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে তার নৈতিকতা হরণ করা।’ তবে রুশো হরণ করেছেন নারীর স্বাধীনতা ও নৈতিকতা দু-ই, কেননা রুশোর চোখে নারী মানুষ নয়, মেয়েমানুষ। রুশো বলেছেন (এমিল, ৫:৩২২), ‘দু-লিঙ্গের মিলনে প্রত্যেকে কাজ করে একই উদ্দেশ্যে, তবে ভিন্ন উপায়ে। তারা ‘ভিন্ন উপায়ে’ কাজ করে, কেননা তারা ভিন্ন; একজন প্ৰভু, আরেকজন তার দাসী। ‘ভিন্নতা’ ধারণাটিও প্রতারক, নারীকে পুরুষের থেকে ভিন্ন বলার অর্থ হচ্ছে নারী ‘নিকৃষ্ট’। রুশোর কাছে পুরুষ হচ্ছে শক্তিমান ও সক্রিয়, নারী দুর্বল ও অক্ৰিয়। তাই নারী থাকবে পুরুষের অধীনে, কেননা পুরুষ শক্তিমান; রুশোর কাছে শক্তিমানের অধীনে থাকাই প্রকৃতির বিধান। কিন্তু ফরাশি বিপ্লবেও নারী পালন করেছিলো অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা, যদিও ওই বিপ্লবের দার্শনিক বলেছেন নারী দুর্বল ও অক্রিয়! নারী রুশোর দর্শনের জন্যে শোচনীয় এলাকা, এ-এলাকায়ই রুশো এমনভাবে পদস্থলিত হয়েছেন যে তার অজ্ঞাতে তার দর্শনের মূল বক্তব্য বাতিল হয়ে গেছে। রুশো নারীর স্বাধীনতা পুরোপুরি অস্বীকার ক’রে নারীকে করেছেন। পুরুষের ক্রীতদাসী, যার কাজ পুরুষের বিনোদ যোগানো ও সেবা করা। রুশোর নারী প্রাকৃতিক নয়, স্বাধীন নয়, তা পুরুষতন্ত্রের ছাঁচে বানানো পুরুষভোগ্য সামগ্ৰী। রুশো নারী সম্পর্কে যা বলেছেন, তার সামান্যও অভিনব নয়; পিতৃতন্ত্রের সমস্ত পুরোনো গ্রন্থে এসব বিধিবিধান অনেক আগেই প্রণীত হয়েছিলো; রুশো শুধু সেগুলোকে রোম্যানটিক রীতিতে প্ৰকাশ ক’রে আঠারো-উনিশ শতকের মানুষের কাছে আকর্ষণীয় ক’যে তুলেছিলেন, এবং নারীকে বেঁধেছিলেন নতুন শক্ত শোকলে।

 

জন রাসকিন

পুরুষাধিপত্যের প্রতিক্রিয়াশীল রোম্যানটিক রূপটি পাওয়া যায় রুশোর রচনায়; চাটুকারিতাপূর্ণ ভিক্টোরীয় ভণ্ডামোর রূপটি পাওয়া যায় জন রাসকিনের ‘সিসেম অ্যান্ড লিলিজ’ (১৮৬৫) গ্রন্থের ‘লিলিজ : অফ কুইন্স গার্ডেনস্’ (১৮৬৪) নামের বক্তৃতাপ্রবন্ধে। রাসকিনের বক্তব্যে মৌলিক কিছুই নেই, তিনি নারী সম্পর্কে সব কিছু পেয়েছেন প্রথা, সাহিত্য, ও চারপাশ থেকে; তবে তিনি নারী সম্পর্কে ভিক্টোরীয় পর্বের কপট, প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গিটি প্রকাশ করেছিলেন খুবই বীরত্বের সাথে। ভিক্টোরীয়রা তার কাছে যা শুনতে চেয়েছিলো, তিনি তাদের তা শুনিয়েছিলেন উদ্দীপনার সাথে, এবং অর্জন করেছিলেন অশেষ জনপ্রিয়তা। সব জনপ্রিয় বস্তুই এক সময় হাস্যকর হয়ে ওঠে, রাসকিনের বক্তৃতাটিও তাই; কিন্তু দুঃখ লাগে রাসকিনের আবর্জনা প্রভাব বিস্তার করেছিলো বিপুলভাবে; তিনি প্রভাবিত করেছিলেন এমনকি উনিশশতকের শেষাংশের শিক্ষিত বাঙালিদেরও, যাঁরা রাসকিনের পরামর্শে নিজেদের নারীদের ডাকতে শুরু করেছিলেন ‘ভদ্রমহিলা’ বা ‘লেডি’। রাসকিনের ‘পদ্ম : রানীর বাগানের’-এর প্রকাশের চার বছর পর বেরিয়েছিলো জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘দি সাবজেকশন অফ উইমেন’ (১৮৬৯); কিন্তু ওই সত্যনিষ্ঠ বইয়ের ভাগ্যে জুটেছিলো তিরষ্কার। মিলেট (১৯৬৯, ৮৯) বলেছেন, ‘মিলে পাওয়া যায় লৈঙ্গিক রাজনীতির বাস্তবতা, আর রাসকিনে পাওয়া যায় রোমান্স ও রূপকথা।’ রাসকিন বাস্তবতার থেকে বাগিতায়, সত্যের থেকে রূপকথায় বেশি আগ্রহী; তোষামোদে তিনি নির্লজ্জ, পুরুষাধিপত্যে একনিষ্ঠ। নারীদের ডেকেছেন তিনি ‘লিলি’ বা ‘পদ্ম’। ব’লে, ‘রানী’ ব’লে, কিন্তু বন্দী করতে চেয়েছেন গৃহকূপে। ‘পদ্ম’ বা ‘রানী’ ডাকে রয়েছে বেশখানিকটা কাম; ‘পদ্ম’ স্মরণ করিয়ে দেয় অক্ষত শুভ্র সতীত্বের ব্যাপারটিকে, ‘রানী’ও আশ্লেষজাগানো ডাক। রাসকিনকে অনেকখানি নষ্ট করেছে সাহিত্য : তিনি দান্তে, শেক্সপিয়র, ও রোম্যানটিক কবিতার নারীদের ভেবেছেন বাস্তব, কিন্তু ওই নারীরা যে বাস্তব নারী থেকে সুদূরে, তা বোঝেন নি। রোম্যানটিক কবিতা নারীকে দেবী ক’রে শেষ পর্যন্ত পরিণত করে পুরুষের সেবিকায়, তার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে; এখানে দুটি কবিতা উল্লেখযোগ্য, কেননা কবিতা দুটি রাসকিন ও ভিক্টোরীয়দের মনে বদ্ধমূল করেছিলো নারীর বিশেষ রূপ। ওয়ার্ডসওয়ার্থের একটি কবিতার নাম ‘শি ওয়াজ এ ফ্যান্টম অফ ডেলাইট’। কবি বলছেন : যখন সে প্রথম আমার চোখে পড়লো, সে ছিলো আনন্দের মায়ামূর্তি। আবেগের তীব্র মুহূর্তে সে দেবী; কিন্তু আবেগ কেটে গেলে কবি দেখতে পান : সে দেবী, কিন্তু নারীও বটে! তাই আনন্দের মায়ামূর্তি হয়ে ওঠে পুরুষের গৃহিণী, যার কাজ সংসার দেখাশোনা, মানসসুন্দরী শুরু করে মাছ কোটা। কভেন্ট্রি প্যাটমোরের ‘দি অ্যাঞ্জেল ইন দি হাউজ’ বা ‘গৃহলক্ষ্মী’ কবিতায় বিয়ে ও নারীত্ব সম্পর্কে ভিক্টোরীয় মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে ভালোভাবে। রাসকিনের বক্তৃতায় প্রকাশ পায় ওই ‘দেবী, কিন্তু নারীও বটে’ এবং ‘গৃহলক্ষ্মী’র ধারণা।

রাসকিন ১৮৬৪ অব্দে ম্যানচেস্টার শহরের টাউন হলো মধ্যবিত্ত নরনারীদের সামনে দিয়েছিলেন বক্তৃতাটি। বক্তৃতাটিতে পাওয়া যায় এমন এক ব্যক্তিকে, যিনি পরিপূর্ণ মধ্যযুগীয় শিভালরি ও প্রতিক্রিয়াশীলতায়; যার চোখে নারীমাত্ৰই নাবালিকা। চাটুবাক্যে শুরু করেছেন তিনি বক্তৃতাটি; শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের বসিয়েছেন ‘বিপথগামী ও অশিক্ষিতদের রাজার আসনে, এবং নারীদের বসিয়েছেন ‘রানী’র অসার সিংহাসনে। পরোক্ষভাবে সমালোচনা করেছেন তিনি সে-সময়ের নারীবাদীদের, যারা বলছিলেন নারীর অধিকারের কথা; কেননা রাসকিন নারীর অধিকারে বিশ্বাস করেন না। সে-সময় জনপ্রিয় ছিলো স্যাপারেট স্ক্যোরিস বা পৃথক এলাকা, অর্থাৎ ঘরে-বাইরে তত্ত্ব, যা তখন সুচতুরভাবে ব্যবহার করা হচ্ছিলো নারীদের পোষমানানোর জন্যে। রাজকবি টেনিসন ‘প্রিন্সেস’ (১৮৪৭, ১৮৫৩) কাব্যে বলেছিলেন : ‘নারী অসম্পূর্ণ পুরুষ নয়/ তবে ভিন্ন… অভিন্নরূপে এক নয়, তবে বিভিন্নরূপে এক’, ‘প্রতিটি লিঙ্গ একলা/ অর্ধেক, আর খাঁটি বিয়েতে কেউ/ সমান বা অসমান নয়, প্রতিটি পূরণ করে/ অন্যটির ক্রটি।’ টেনিসনের এ-কাব্যিক ভিন্নতার মধ্যে অভিন্নতা বা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এমন এক শোভন কৌশল, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে শোষণকে সুখকর ক’রে তোলা। রাসকিন ঘরেবাইরে ও পরিপূরক তত্ত্ব নানাভাবে পেশ করে নারীকে তার অধিকারের কথা ভুলিয়ে চেয়েছেন। পুরুষের সেবিকা ক’রে রাখতে। নারীদের ‘রানী’ ব’লে কপট সম্বোধনের পর রাসকিনের কাজ হচ্ছে ওই রানীরা কোথায় থাকবে, কী করবে, কী শিখবে তার বিধান রচনা। তিনি নতুন কিছু বলেন নি, পুরুষতন্ত্র যা ব’লে এসেছে কয়েক হাজার বছর ধরে, আর তাঁর একশো বছর আগে রুশো, এবং রোম্যানটিক কবিরা যা বলেছেন, তিনি তাই বলেছেন ভিক্টোরীয় নাইটের ভঙ্গিতে।

নারীরা রাসকিনের চোখে রানী, কী ক্ষমতা ওই রানীদের, এবং কীভাবে প্রয়োগ করবে তারা তাদের রানীসুলভ ক্ষমতা? কিন্তু রাসকিন ক্ষমতার কথা বলতে গিয়েই দ’মে গেছেন, তার মনে পড়ে গেছে নারীরা রানী, তবে আসলে তো তারা নারী! তাই আগে ঠিক করতে হবে কী হবে তাদের ক্ষমতা নারী হিশেবে? রাসকিন (১৮৬৫, ৬১) এখন দেখা দেন মুখোশ খুলে; বলেন, ‘নারীদের রানীসুলভ ক্ষমতা কী হবে তা স্থির করতে পারি না, যদি না আমরা একমত হই তাদের সাধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে।’ বিপত্তি ঘটে এখানেই, কেননা রাসকিনের বিধানে নারীদের সাধারণ ক্ষমতা খুবই তুচ্ছ, নারীর ক্ষমতা হচ্ছে নারীর ভূমিকা পালন করা। নারী পুরুষের সমান হবে না, নারী হবে পুরুষের সহায়ক। উনিশ শতকে পুরুষতন্ত্রীরা বের করেছিলেন পৃথক এলাকার ধারণা, রাসকিন তা নিজের ক’রে নিয়েছিলেন, এবং একেই ঘোষণা করেছিলেন প্রাকৃতিক ব’লে। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক পুরুষ ও শোষকতন্ত্রের বড়ো প্রতারণা; রুশো প্রতারণা করেছেন প্রকৃতি দিয়ে, রাসকিনও প্রতারণা করেছেন প্রকৃতি দিয়ে। উনিশশতকে প্রকৃতি শুধু আবেগাতুর শব্দ ছিলো না, শোষকতন্ত্র এ-শব্দটিতে পেয়েছিলো সমস্ত সমস্যার সমাধান। তারা যা কিছু বুঝতে পারতো না, বা যা কিছু নিজেদের সুবিধার জন্যে তারা বিধিবদ্ধ করতে চাইতো, তাকেই বলতো তারা ‘প্রাকৃতিক’ : শ্রেণী, স্বৈরাচার, শোষণ সব কিছুই প্রাকৃতিক! রাসকিন যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন কোনো ভদ্রলোকের পক্ষে পুরুষকে উৎকৃষ্ট নারীকে নিকৃষ্ট বলা শোভন ছিলো না, তাই তাদের সুভাষণ বের করতে হয়েছিলো। টেনিসনের প্রন্সেস-এ মেলে নারীপুরুষের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও পরিপূরকতত্ত্ব :

For Woman is not underdevelopt man
But diverse:..
Not like to like, but like in difference…
either sex alone
Is half itself, and in true marriage lies
Nor equal, nor unequal each fulfills
Defect in each

নারী নয় অবিকশিত পুরুষমানুষ
তবে ভিন্ন…
একজন নয় অপরজনের মতো, কিন্তু ভিন্নতার মধ্যে একরূপ…
দু-লিঙ্গের মধ্যে একটি একলা
শুধুই অর্ধেক, আর প্রকৃত বিবাহে
কেউ সমান বা অসমান নয়; প্রত্যেকে পূরণ করে
অপরের ত্রুটি

ভিক্টোরীয় রাজকবির মতে নারী অবিকশিত মানুষ বা পুরুষ নয়, ভিন্ন ধরনের মানুষ; শুনতে এটা ভালো শোনালেও কবি আর ভিক্টোরীয়রা নারীকে অসম্পূর্ণ মানুষই মনে করতো। এ-কবিতার বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও পরিপূরকতত্ত্বের প্রতিধ্বনি ক’রে রাসকিন (১৮৬৫, ৭২) বলেন :

‘আমরা নির্বোধি, ক্ষমাহীনভাবে নির্বোধ, যখন আমরা এক লিঙ্গের ওপর আরেক লিঙ্গের শ্ৰেষ্ঠতার কথা বলি, যেন তাদের তুলনা করা সম্ভব অভিন্ন বিষয়ে। একটির যা আছে অন্যটির তা নেই; একটি পূর্ণতা দেয় অন্যটিকে, এবং পূর্ণতা পায় অন্যটি দিয়ে : তারা কোনো কিছুতেই একরকম নয়, উভয়ের সুখ ও উৎকর্ষ নির্ভর করে অন্যের যা আছে তা চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে, যা শুধু দিতে পারে অন্যটি।‘

রাসকিনের এ-নাইটপনা হচ্ছে নারীপুরুষের সামাজিক ও মেজাজগত পার্থক্যকে জৈবিক যুক্তির সাহায়ে বৈধ করার কূটকৌশল। তিনি উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্টতে না গিয়ে গেছেন টেনিসনি ভিন্নতায় ও পরিপূরকতায়, শয্যা থেকে সাম্রাজ্য পর্যন্ত যার সুফল পাবে পুরুষ আর দুর্ভোগ পোহাবে নারী। পুরুষ : নারী ভিন্ন ও পরিপূরক, যেমন ভিন্ন ও পরিপূরক ব্ৰাহ্মণ; শূদ্ৰ, শোষক : শোষিত, যারা সৃষ্টি করে সামাজিক বৈচিত্র্যের সঙ্গীত! নারীপুরুষের কোনো মৌল পার্থক্য নেই; যোনিলিঙ্গস্তন প্রভৃতি পার্থক্যের নেই কোনো সামাজিক-রাজনীতিক মূল্য, কিন্তু রাসকিনেরা এসবের জন্যেই পুরুষকে প্ৰভু আর নারীকে দাসী ক’রে রাখার কৌশল বের করেছেন চিরকাল।

রাসকিন নারীপুরুষের দ্বিমেরুত্ব ও পরিপূরকত্ব প্রস্তাব ক’রেই ধ’রে নিয়েছেন যে তা প্রমাণ হয়ে গেছে; এবং সাথেসাথেই তিনি আঁকা শুরু করেছেন নারীপুরুষের ভিন্ন ও পরিপূরক জগতের মানচিত্র। তিনি পুরুষকে দিয়েছেন মুক্ত পৃথিবী, নারীকে ঢুকিয়েছেন বদ্ধ ঘরে; সৃষ্টি করেছেন ঘরে-বাইরের ভিন্ন ও বিপরীত পরিপূরক বিশ্ব। রাসকিনের রাজারা পুরুষ, তাই তারা দায়িত্ব পেয়েছে সমস্ত মানবিক কাজের, আরা রাসকিনের রানীরা নারী, তাই তারা পেয়েছে গৃহপরিচারিকার দায়িত্ব : এই হচ্ছে রাজারানীর পরিপূরকতা! নারীপরুষের ভিন্নতা সম্পর্কে আবহমান পুরুষতন্ত্র যা বলেছে, রুশো যা বলেছেন, যা বলেছে ভিক্টোরীয়রা, তাই বলেছেন রাসকিন (১৮৬৫, ৭২-৭৩) :

‘তাদের চাবিত্রিক ভিন্নতা সংক্ষেপে এগুলো। পুরুষের শক্তি সক্রিয়, প্রগতিশীল, প্রতিরোধাত্মক। সে প্রধানত কর্তা, স্রষ্টা, আবিষ্কারক, রক্ষক। তার মেধা প্ৰকল্পনার ও আবিষ্কারের; তার শক্তি অভিযাত্রার, যুদ্ধের, বিজয়ের, যেখানে যুদ্ধ ন্যায়সঙ্গত, যেখানে বিজয় দরকার। কিন্তু নারীর শক্তি শৃঙ্খলার, যুদ্ধের নয়; আব্ব তার মেধা আবিষ্কার বা সৃষ্টির নয়, তা মধুর শৃঙ্খলার, বিন্যাসের, এবং সিদ্ধান্তের। তার কাজ প্রশংসার : সে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় না, কিন্তু কার শিরে মুকুট পরানো হবে সে তার রায় দেয; তার কাজ ও স্থান দিয়ে সে সব রকম বিপদ ও প্রলোভন থেকে সুরক্ষিত। পুরুষ, মুক্ত পৃথিবীতে বিভিন্ন কর্কশ। কাজে, মুখোমুখি হয় বিপদ ও বিচারেব্য;–তাই পুরুষেবই জন্যে রয়েছে ব্যর্থতা, অপরাধ, অনিবাৰ্য ভুল: মাঝেমাঝেই সে আহত বা পরাভূত হবে, বিপথে যাবে, এবং সব সময় কঠিনতর হবে। কিন্তু সে নারীকে রক্ষা করে এসব থেকে; তার গৃহের মধ্যে, যা শাসন করে নারী, যদি নারী নিজে না চায়, তবে নারীকে ঢুকতে হবে না কোনো বিপদ, প্রলোড়ন, ভুল বা অপরাধের মধ্যে। এ হচ্ছে গৃহের আসল প্রকৃতি–এটা শান্তির এলাকা।‘

রাসকিনের বুলির সারকথা : পুরুষ প্ৰভু, নারী তার সেবিকা। গৃহে থাকা, সংসার শাসন করা, পুরুষের সেবা করাই রাসকিনের মতে ‘নারীর প্রকৃত স্থান ও শক্তি’। নারীকে হ’তে হবে গৃহের উপযুক্ত, ওই বদ্ধকূপে থেকেই সে সফল ক’রে তুলবে তার জীবন। নারী হবে। আপাদমস্তকআত্মা এমন নারী যে সে যেখানেই রাখবে তার পা দুখানি, তাই হয়ে উঠবে গৃহ। তাঁর, ও তাঁর পুরুষাধিপত্যবাদী গোত্রের, কাছে এই প্রাকৃতিক। রাসকিনের ও ভিক্টোরীয়দের কাছে প্ৰথাই প্রাকৃতিক; যা চলে এসেছে, তা যতোই নিষ্ঠুর অমানবিক অস্বাভাবিক হোক-না-কেনো, তাদের কাছে তাই প্রাকৃতিক শাশ্বত। নারীকে তার জীবন সফল করার জন্যে আয়ত্ত করতে হবে নানা রমনীয় গুণ। রাসকিন (১৮৬৫,৭৩-৭৪) তাঁর রানীদের ভূষিত দেখতে চেয়েছে আত্মবিনাশী গুণে :

‘সে হবে স্থায়ীভাবে, অটলভাবে ভালো; সহজাতভাবে, অভ্রান্তভাবে জ্ঞানী-জ্ঞানী, আত্মবিকাশের জন্যে নয়, বরং আত্মোৎসর্গের জন্যে : জ্ঞানী, এজন্যে নয় যে সে নিজেবে প্রতিষ্ঠা করবে স্বামীর ওপরে, ববং এজন্যে যাতে সে ব্যর্থ না হয় স্বামীর পাশে থাকতে।‘

রাসকিন পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছেন নারীদের অস্তিত্ব, কেননা নারীর কিছুই নারীর নিজের জন্যে নয়। নারীকে ভালো হতে হবে স্থায়ীভাবে, অটলভাবে; জ্ঞানীও হতে হবে সহজাতভাবে, অভ্রান্তভাবে; কিন্তু সে আত্মবিকাশ ঘটাতে পারবে না, সে নিজেকে তৈরি করবে। পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রের পায়ে আত্মোৎসর্গের জন্যে। এ হচ্ছে একধরনের সতীদাহ। রাসকিন নারীদের পরিণত করেছেন শোচনীয় প্রাণীতে, অথচ ভিক্টোরীয় কপটতায় তাদের ডেকেছেন ‘রানী’ বলে।

পুরুষতন্ত্র শুধু পীড়ন ক’রে নারীদের নারী ক’রে তোলে নি, তাদের দীক্ষিত করেছে ইতিহাসের সবচেয়ে বিষাক্ত মন্ত্রে, যার নাম নারীমন্ত্র। নারীমন্ত্রে দীক্ষণ দেয়ার জন্যে পুরুষতন্ত্র উদ্ভাবন করেছে বিশেষ ধরনের নারীশিক্ষা, যা প্রকৃতপক্ষে কোনো শিক্ষাই নয়। রুশোর এমিল-এর বিকল্প নাম শিক্ষা, কিন্তু ওই শিক্ষা নারীদের জন্যে অশিক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়। রাসকিনও ওই শিক্ষায় শিক্ষিত অর্থাৎ অশিক্ষায় অশিক্ষিত করতে চেয়েছেন নারীদের। রাসকিন নারীদের জন্যে রেখেছেন স্বামী ও সংসার, তাই তাদের দিতে চেয়েছেন সে-শিক্ষা যাতে নারীরা সম্পূর্ণরূপে খাপ খায় স্বামী ও সংসারের অন্ধকূপে। রাসকিন বলেছেন, ‘আমি নারীদের স্থান ও শক্তি দেখিয়েছি’; তারপর প্রশ্ন করেছেন নারীদের শিক্ষা সম্পর্কে, ‘এর সাথে খাপ খাবে কী ধরনের শিক্ষা’ নারীদের জন্যে তিনি বিধিবদ্ধ করেছেন খাপ-খাওয়ানোর শিক্ষা, যার লক্ষ্য নারীদের পুরুষাধীনতায় অভ্যস্ত করে তোলা। রাসকিন (১৮৬৫,৭৬) বলেন, ‘প্রথমে নারীর দেহখানিকে ছাচে ফেলে ঢালাই করতে হবে’; তারপর ওই নমনীয় ভঙ্গুর দেহখানির ভেতর যে-মনটি থাকবে, সেটিকে বদলে দিতে হবে ও ভ’রে তুলতে হবে।’ আত্মোৎসর্গ্র শিক্ষায়। রাসকিনের মতে নারীর জ্ঞান যেমন আত্মবিকাশের জন্যে নয়,  তেমনি শিক্ষাও আত্মবিকাশের জন্যে নয়;–নারীর শিক্ষা পুরুষের সেবা করার জন্যে, পুরুষের সহচরী হয়ে ওঠার জন্যে। এ-শিক্ষায় নারী বড়েজোর হয়ে উঠবে সখি, সচিব ও প্রিয়শিষ্যা, যা তাকে ক’রে তুলবে পুরুষের কাছে আকর্ষণীয়, কিন্তু সে কখনো স্বাধীন ব্যক্তি হয়ে উঠবে না।

রাসকিন (১৮৬৫, ৭৬-৭৯) নারীকে দিতে চেয়েছেন পুরুষের সহচরী হয়ে ওঠার শিক্ষা। নারীকে দিতে হবে সে-সব জ্ঞান, যা নারীকে সাহায্য করবে। ‘পুরুষের কাজ বুঝতে, এমনকি সহায়তা করতে’। অর্থাৎ পুরুষ হবে ঔপন্যাসিক, আর তাঁর স্ত্রী হবে পাণ্ডুলিপি।প্রস্তুতকারক ও গ্রুফসংশোধক, পুরুষ বিশ্ববিখ্যাত হবে। আর নারী স্বামীর খ্যাতিতে ধন্য বোধ করবে! এ-প্রসঙ্গে টলষ্টয় ও তার স্ত্রী সোফিয়া স্মরণীয়। টলষ্টয় পুরুষতন্ত্রের মহাপুরুষের স্থান পেয়েছেন, আর নিন্দিত হয়ে আছেন সোফিয়া, যদিও ওই নারী সহচরীরূপে তাঁর সম্পূর্ণ জীবন উৎসর্গ করেছেন টলষ্টয়ের বিখ্যাত নিষ্ঠুর পায়ে। টলস্টয় দুশ্চরিত্র ছিলেন, নিজের অবৈধ পুত্রদের লাগিয়েছিলেন ভূমিদাসের কাজে, পরিচারিকদের গর্ভবতী করেছেন, আর শেষ জীবনে যখন ধর্ম ও নিষ্কামতা প্রচার করছিলেন তখনও জড়িত ছিলেন চেরট্‌কভের সাথে সমকামে; এবং নিয়মিতভাবে গৰ্ভবতী ক’রে চলছিলেন সোফিয়াকে, আর সোফিয়া ক’রে চলছিলেন স্বামীর সহকারীর কাজ। টলষ্টয় তাকে তেরোবার গর্ভবতী করেন, ওই নারী নটি জীবিত সন্তান লালনপালন করেন, জমিদারি দেখাশোনা করেন, প্ৰকাশ করেন স্বামীর রচনাবলি, এবং বারবার অনুলিপি প্রস্তুত করেন স্বামীর পাণ্ডুলিপির। টলষ্টয়ের অপাঠ্য হস্তাক্ষরে লেখা যুদ্ধ ও শান্তি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপির অনুলিপি তৈরি করেন তিনি সাতবার, রাত জেগেজেগে বিবর্ধক কাচ দিয়ে দেখে, এবং নষ্ট করেন নিজের জীবন [দ্র ফিজেস (১৯৭০, ১৬৩-১৬৪)]। রাসকিন এভাবেই নষ্ট করতে চান নারীকে। রাসকিন বলেন, নারীকে ‘জ্ঞান দেয়া যাবে না জ্ঞান হিশেবে, নারীদের জ্ঞান দিতে হবে এমনভাবে যাতে নারী শুধু ‘অনুভব ও বিচার করতে পারে’। নারীর মাথাটি নষ্ট করে দিয়ে তার বুকের ভেতরে সৃষ্টি করতে হবে স্যাঁতসেঁতে ভাবালুতা। নারীর জ্ঞান ‘নারীর গর্ব বা বিশুদ্ধির জন্যে নয়’; তা শুধু তাকে দয়াবতী ক’রে তোলার জন্যে। রাসকিনের বিধান হচ্ছে নারীকে বিজ্ঞান শেখানোর দরকার নেই, তাকে শুধু বিজ্ঞানের দু-একটি খবর জানানো যেতে পারে। নারীকে জ্ঞানের অভিধানে পরিণত করার দরকার নেই; তবে তাকে ক’রে তুলতে হবে ভাবালুতার ঝরনাধারা। নারীকে ধর্মতত্ত্বও শেখানো যাবে না, এটা বিশেষভাবেই বারণ করেছেন রাসকিন, কেননা এটা এক ভয়ঙ্কর বিজ্ঞান’, যেখানে পদষ্মলন ঘটেছে শ্রেষ্ঠ পুরুষদেরও। নারীরা ধর্ম সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না, তবে তাদের ভীরে তুলতে হবে ধর্মভাবে, যাতে তারা হয়ে ওঠে বিনীত ও করুণাময়ী।

স্ববিরোধিতা করে এক সময় রাসকিন বলেন, ‘এটা (ধর্মতত্ত্ব) বাদে, ছেলে ও মেয়ের শিক্ষা, পাঠে ও বিষয়ে, হবে প্ৰায় একই; তবে তাদের শিক্ষার লক্ষ্য হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন’। ‘প্রায় একই’ অবশ্য অভিন্নতা বোঝায় না, বোঝায় সম্পূর্ণ ভিন্নতা; আর লক্ষ্য তো ‘সম্পূর্ণ ভিন্ন’। রাসকিন চান পুরুষের জন্যে শিক্ষা, আর নারীর জন্যে অশিক্ষা :

নারীর শিক্ষা হবে স্বামীমুখি। স্বামী যা কিছু জানে স্ত্রীকে জানতে হবে সে-সব, তবে ভিন্নভাবে; ওই জ্ঞানে স্বামীর ‘অধিকার হবে মৌলিক ও অগ্রসর’; আর স্ত্রীর অধিকার হবে ‘সাধারণ, যাতে তা প্রাত্যহিক জীবনে উপকারে আসে’। রাসকিনের বিধান হচ্ছে ‘পুরুষ তার জানা ভাষা বা জ্ঞান আয়ত্ত করবে ব্যাপকভাবে, আর নারী ওই ভাষা বা জ্ঞান জানবে ততোটুকু, যতোটুকু হ’লে সে তার স্বামীর আনন্দের সঙ্গে তাল দিতে পারে’। সারকথা হচ্ছে নারীকে কোনো যথার্থ শিক্ষাই দেয়া হবে না, তাদের দিতে হবে নারী হয়ে ওঠার, স্বামীর সহচরী হয়ে ওঠার সবক। তারা হয়ে উঠবে উন্নত জাতের দাসী ও শয্যাসঙ্গিনী। রাসকিনের নারীশিক্ষা হচ্ছে পুরুষের সাথে খাপ-খাওয়ানোর শিক্ষা। তিনি বিশ্বাস করেন নারী-অধীনতায়; তার শিক্ষাও নারীকে পুরুষের অধীন করার মন্ত্র। নারীশিক্ষা পুরুষতন্ত্রের একটি বড়ো ভীতির ব্যাপার, কেননা শিক্ষা নারীকে পরিচয় করিয়ে দেয় নিজের সাথে, তাকে বুঝিয়ে দেয় তার পতনের শোচনীয়তা ও সম্ভাবনাকে।

ভিক্টোরীয় যুগে নানা চক্রান্ত হয়েছে নারীর শিক্ষা নিয়ে, যে-চক্রান্তের একটি আদর্শ রূপ পাওয়া যায় টেনিসনের ‘প্রিন্সেস’-এ (১৮৪৭, ১৮৫৩), যার দ্বারা পুরোপুরি প্রভাবিত ছিলেন রাসকিন। প্রিন্সেস একটি শিক্ষাবিতর্কমূলক কাব্য। ভিক্টোরীয় যুগে এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছিলো; এমনকি এর প্রভাব পড়েছিলো রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদার ওপরও, যার ফলে একটি বিদ্রোহী স্বায়ত্তশাসিত রাজকন্যা হয়ে ওঠে পুরুষের শোচনীয় সহচরী। প্রিন্সেস-এ বিবাহবিরোধী রাজকন্যা আইডা নারীশিক্ষার জন্যে স্থাপন করে একটি নারী-বিশ্ববিদ্যালয়; সেখানে ছাত্রীর ছদ্মবেশে ভর্তি হয় আইডার অনুরাগী মৃগীরোগগ্ৰস্ত এক রাজপুত্র ও তার বন্ধু। রাজপুত্র যখন ধরা পড়তে যাচ্ছিলো, তখন একদিন সে জলমগ্ন আইডাকে উদ্ধার ক’রে প্রাণে বাঁচায়, এবং প্ৰেম নিবেদন করে। আইডা তা প্রত্যাখ্যান করে। এক সময় যুদ্ধ বাধে আইডা ও রাজপুত্রের দলের মধ্যে, যুদ্ধে আহত হয় রাজপুত্র। আইডা আহত রাজপুত্রের সেবা ক’রে নিজেকে সমর্পণ করে তার কাছে; বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে সেখানে সে স্থাপন করে হাসপাতাল। বিশ্ববিদ্যালয়কে হাসপাতালে ও শিক্ষানুরাগী বিবাহবিরোধী রাজকন্যাকে নার্সে পরিণত করে পুরুষতন্ত্র প্ৰতিশোধ গ্রহণ করে নারীবাদ ও নারীশিক্ষার ওপর।

প্রিন্সেস-এ প্রতিশোধ নেয়া হয়েছে নারীবাদের ওপর; দেখিয়ে দেয়া হয়েছে যে নারীর স্থান হচ্ছে গৃহ, নারীর কাজ পুরুষের সেবা করা। নারীর শিক্ষা হচ্ছে বাজে কথা, আর নারীপুরুষ কখনো সমান হ’তে পারে না। প্রিন্সেস-এর নায়ক আইডাকে বিয়ে করতে চায়, তবে সে এমন কাউকে বিয়ে করতে পারে না যে তার সমকক্ষ। নারীর সমকক্ষতা দাবি দ্রোহিতা, তাই তাকে পেতে হবে উপযুক্ত শাস্তি। দ্রোহী নারীকে এমন অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে যাতে সে হয়ে ওঠে অনুগত স্বামীপরায়ণ দাসীস্বভাব স্ত্রী। নারী যদি সমান হয়ে ওঠে। পুরুষের, তাহলে কি বিয়ে টিকতে পারে, সুখের হতে পারে সংসার’ ভিক্টোরীয়রা বিশ্বাস করতো সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে; আর রমণীর শ্রেষ্ঠ গুণ হচ্ছে পুরুষের নিচে থাকা। শিক্ষা হচ্ছে সে-শক্তি যাতে নারী সমান হয়ে উঠতে পারে পুরুষের, তাই নারীকে সরিয়ে নিতে হবে শিক্ষার দরোজা থেকে। নারীকে থাকতে হবে ঘরে, তাই প্রিন্সেস-এ গানেগানে প্রচার চালানো হয়েছে ঘর আর চুলোর সপক্ষে; হিটলার যেমন প্রচার চালিয়েছে কিন্ডের, কুচে উন্ট কিরচে’র [শিশু, রান্নাঘর ও গির্জা] পক্ষে। তাদের কাছে প্ৰেম/বিবাহ ও শিক্ষা ছিলো পরস্পরবিরোধী; একটি করা যাবে, একসাথে দুটি করা যাবে না। এ-কাব্যে পুরুষাধিপত্যবাদী ভিক্টোরীয় মনোভাব প্ৰকাশ পেয়েছে প্রচণ্ডভাবে [দ্র মিলেট (১৯৬৯, ’৭৮-৭৯)];

মাঠেন্য জন্যে পুরুষ আর চুলোর জন্যে নারী;
তলোয়ারের জন্যে পুরুষ সূচের জন্যে নারী;
পুরুষেব আছে মগজ, নারীর আছে হৃদয়;
পুরুষ দেবে আদেশ, আর পালন করবে নারী;

পুরুষ শিকারী; নারীরা শিকার।
মৃগয়ার চকচকে ঝলমলে মৃগ,
আমরা শিকার করি তাদের চামড়ার সৌন্দর্যের জন্যে;
এজন্যেই তারা ভালোবাসে আমাদের
এবং আমরা অশ্ব ছুটিয়ে তাদের ভূপাতিত করি।

হিংস্র পুরুষাধিপত্যের কোমল চতুর রূপ হচ্ছে নারীপুরুষের পরিপূরক পার্থক্যের তত্ত্ব। নারীপুরুষের সাংস্কৃতিক আপাতপার্থক্যকে ভিক্টোরীয় রীতিতে জৈবিক ক’রে তুলেছেন টেনিসন ‘প্রতিটি লিঙ্গ একলা অর্ধেক’ বলে। তাঁর মতে নারীপুরুষ দুজনে মিলে গ’ড়ে তোলে ‘বিশুদ্ধ সঙ্গীত’; তবে এ-দ্বৈত সঙ্গীতে পুরুষই প্রধান সুর। টেনিসন বিশ্ববিদ্যালয়কে হাসপাতালে, জ্ঞানার্থী তরুণীকে নার্সে পরিণত ক’রে ঘরে ঢুকিয়ে সৃষ্টি করেছেন ভিক্টোরীয় বিবাহের বিশুদ্ধ সঙ্গীত; রাসকিন করেছেন একই কাজ। নারীকে শিক্ষার নামে দিয়েছেন অশিক্ষা, নবীর পুরুষাধীনতাকে ক’রে তুলেছেন মহিমানিত।

রাসকিনের রানীদের রাজ্য গৃহ, সংসারই তাদের রাজদরবার; তবে শিভালরিতে তিনি অদ্বিতীয়, তাই তিনি রাষ্ট্রের সাথে তার রানীদের/নারীদের কী সম্পর্ক হবে, তাও দেখাতে ভোলেন নি। তিনি বলেছেন (১৮৬৫, ৮৭), ‘আমাদের সাধারণ ধারণা হচ্ছে যে পুরুষের দায়িত্ব বাইরে, আর নারীর দায়িত্ব ঘরে। তবে আসলে তা নয়।’ তাঁর মতে নারীর ব্যক্তিগত দায়িত্ব রয়েছে সংসারের প্রতি, তবে বাইরের প্রতিও রয়েছে তার দায়িত্ব। নারীর বাইরের জগত, রাসকিনের মতে, তার সংসারেরই সম্প্রসারণ। পুরুষের নিজের পরিবারের প্রতি দায়িত্ব ‘ভরণপোষণ, উন্নতি ও নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করা, আর নারীর কাজ হচ্ছে সংসারকে সাজানোগোছানো, আরামপ্রদ ও মনোরম করা’। রাসকিন রাষ্ট্রের প্রতি নারীপুরুষের যে-দায়িত্ব নির্দেশ করেছেন, তাতে পুরুষ প্ৰভু, নারী তার সহায়ক অলঙ্কার। পুরুষের দায়িত্ব ‘রাষ্ট্রকে সচল রাখা, তাব উন্নতি করা, তার প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা’; আর নারীর দায়িত্ব হচ্ছে ‘রাষ্ট্রকে সাজিয়েগুছিয়ে, আরামপ্রদ ও সুন্দর ক’রে রাখা’। এরপর রাসকিন পুরুষকে ‘ভদ্রলোক’-এর বদলে ভূষিত করেন লর্ড উপাধিতে, নারীকে ‘ভদ্রমহিলা’র বদলে ‘লেডি’তে। তবে তিনি ‘লর্ড’ ও ‘লেডি’ শব্দের যে-অর্থ নির্দেশ করেন, তাতে নারীর সব মহিমা লুটিয়ে পড়ে। ‘লেডি’ শব্দের অর্থ ‘রুটিদানকারিণী’, অৰ্থাৎ যে ভিক্ষা দেয়; আর ‘লর্ড’ শব্দের অর্থ ‘আইনরক্ষণকারী’ বা ‘প্ৰভু। সমস্ত ক্ষমতা থাকছে পুরুষের হাতে, নারী শুধু পালন করবে দান বা ভিক্ষা দেয়ার কাজ। কিন্তু নারী দান করবে কার ধন? সে নিজেই তো সর্বহারা, ভিখিরি; পুরুষের ধন ছাড়া দেয়ার মতো কোনো ধন তার নেই। তাহলে কি তার কাজ প্রভুর ধন থেকে মাঝেমাঝে কিছু ভিক্ষে দিয়ে প্রভুর শোষণব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা? রাসকিনের ‘পদ্ম : রানীর বাগানের’ হচ্ছে পুরুষাধিপত্যের ভিক্টোরীয় মন্ত্র ও চক্রান্ত, যার থেকে এখনো উদ্ধার পায় নি মধ্যবিত্ত নারীরা। নিম্নবিত্ত নারীদের কথা তিনি ভাবেনই নি, তার চোখে তারা রানী নয়, নারীও নয়, সম্ভবত মানুষও নয়।

 

জন স্টুয়ার্ট মিল

রুশো-রাসকিন পুরুষতন্ত্রের মহাপুরোহিত; নারীর জন্যে তাঁরা বিধিবদ্ধ করেছেন বিনোদযোগানো দাসীর ভূমিকা। জন স্টুয়ার্ট মিল তাঁদের বিপরীত; পুরুষের মধ্যে তিনিই প্রথম নারীকে দেখেছেন মানুষরূপে, এবং নারীর জন্যে খুলে দিতে চেয়েছেন মানবিক সমস্ত এলাকা। ১৮৬৯-এ বেরোয় মিলের ‘দি সাবজেকশন অফ উইমেন’ [নারী-অধীনতা। মিল ছিলেন স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ব্যক্তির অধিকারের দার্শনিক; তিনিই প্রথম পুরুষ, যিনি একটি সম্পূর্ণ বই লেখেন নারীর অধিকারের সমর্থনে। তাঁর আগে কোনো পুরুষ নারীর দুর্দশার কথা ভাবে নি বা দুৰ্দশা থেকে উদ্ধার করতে চায় নি নারীদের, তা নয়; তাঁর আগে বাঙলায়ই আমরা পেয়েছি দুজন মানবিক নারীবাদী : রামমোহন ও বিদ্যাসাগরকে; তবে মিলই প্রথম বিস্তৃতভাবে দেখান পুরুষতন্ত্রের নারীশোষণের রূপটি। মিল রুশো বা রাসকিনের মতো ভাবালুতগ্রস্ত নন, তার মধ্যে নেই রুশোর স্ববিরোধিতা; মিল তথ্য ও যুক্তির সাহায্যে, মাঝেমাঝে ক্ষোভ মিশিয়ে, পেশ করেছেন নিজের বক্তব্য। মিল দেখান নারীর জীবনের শোচনীয় বাস্তবতা, পুরুষের অধীনে নারীর দুরবস্থা। তাঁর দেড় দশক পরে এঙ্গেলস ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’তে (১৮৮৪) উদঘাটন করেন শোষণের বিশ্বজনীন সূত্র। মিলের লেখায় পাওয়া যায় ভিক্টোরীয় পর্বের লৈঙ্গিক রাজনীতির বাস্তবতার দিকটি; ভিক্টোরীয় পুরুষ ও মহাপুরুষদের মতো নারী সম্পর্কে তিনি পরীর গল্প বলেন নি, বলেছেন নির্মম সত্য। মিলের নারী-অধীনতা প্রথাবিরোধী রচনা, তাতে প্রথার সমস্ত শেকড় তুলে ফেলা হয়েছে অকাট্য যুক্তির সাহায্যে। মানুষের অগ্ৰগতি ও স্বাধীনতার বড়ো বাধা হচ্ছে প্রথা, সুবিধাভোগীরা ওই প্রথাকেই ঐশ্বরিক, শাশ্বত, প্রাকৃতিক বলে প্রচার করে টিকিয়ে রাখতে চায় নিজেদের স্বার্থ। নারী প্রথার প্রধান শিকার। যিনি প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলেন, প্রথাবাদীরা তাঁর নিন্দা রটায়; নিন্দা রটানো হয়েছিলো মিলের বিরুদ্ধেও। মিল বইটি লিখেছিলেন ১৮৬১তে; বইটি লেখায় তাকে প্রেরণা যুগিয়েছিলেন স্ত্রী হ্যারিয়েট টেইলর, এবং সহায়তা করেছিলেন সৎকন্যা হেলেন টেইলর। হ্যারিয়েট নারীবাদী আন্দোলনকারী ছিলেন, মিল তাঁকে বিয়ে করার সময় খ্রিস্টান স্বামীর সমস্ত আইনসঙ্গত অধিকার লিখিতভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কেননা তা স্বামীস্ত্রীর সাম্যের বিরোধী। তাই মিলের নারী-অধীনতা পারিবারিক আবেগ থেকেই জন্মেছিলো, যদিও বইটিতে আবেগের কোনো চিহ্ন নেই। মিলের ‘নারী-অধীনতা’য় উপস্থাপিত হয়েছে কালকালান্তর ধ’রে নারীর শোচনীয় অবস্থার বাস্তবতা; তিনি আক্রমণ করেছেন নারীর আইনগত দাসীত্বকে, শিক্ষার নামে অশিক্ষাকে, ভিক্টোরীয় যুগের স্ত্রীসুলভ অধীনতাকে। তাঁর বক্তব্য বিপ্লবাত্মক, যখন নারীর জন্যে দাসীর দর্শন রচনা করাই ছিলো মহাপুরুষত্ব, তখন তিনি দাবি করেছিলেন নারীর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও পুরুষের সাথে বিশুদ্ধ সাম্য। মিলের মূল প্রতিপাদ্য (১৮৬৯, ১) :

‘যে-নীতি নিয়ন্ত্রণ করে দু-লিঙ্গের মধ্যে প্রচলিত সামাজিক সম্পর্ক–এক লিঙ্গের কাছে আরেক লিঙ্গের আইনগত অধীনতা–তা সম্পূর্ণ ভুল; এবং এখন মানুষের অগ্রগতির এক প্রধান বাধা; এর জায়গায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিশুদ্ধ সাম্যের নীতি, এতে একপক্ষের থাকবে না বিশেষ কোনো ক্ষমতা বা সুবিধা, অন্যপক্ষেরও থাকবে না কোনো অসুবিধা।‘

পুরুষতন্ত্রের কাছে তখন এমন বক্তব্য ছিলো পুরুষতন্ত্রের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। তিনি জানতেন তাঁর বক্তব্য কলহ বাধাবে, এবং তা বেধেছিলো প্ৰচণ্ডভাবে। তাঁর বক্তব্যে পাগল হয়ে গিয়েছিলো ভিক্টোরীয় পুরুষতন্ত্র; এবং মিলকে দিয়েছিলো উন্মাদ আর অনৈতিকের অপবাদ।

পুরুষতন্ত্রের কোনো যুক্তি ছিলো না, কিন্তু ছিলো প্ৰথা, আর গোঁড়ামি। মিল জানতেন, যাঁরা আক্রমণ করেন কোনো বিশ্বজনীন বিশ্বাস বা প্রথাকে, তাদের ভাগ্যে জোটে দুঃসহ দুৰ্দশা, কখনো সুপরিকল্পিত অবহেলা। মিলের নারী-অধীনতা প্রথার বিরুদ্ধে যুক্তির আক্রমণ; এতে নেই ভাবাবেগ বা মিথ্যার দোহাই, যদিও যে-সময় তিনি লিখছিলেন তখন প্রথাবদ্ধ গোড়াদের শক্তির প্রকাশ ঘটতো প্রথাগত ভাবাবেগের মধ্য দিয়ে, যেমন আজো ঘটে। মিল (১৮৬৯, ৫) বলেছেন, ‘আমি কলহ করতে চাই না তাদের সাথে, যাদের বিশ্বাস নেই যুক্তিতে, কিন্তু অতিবিশ্বাস রয়েছে প্রথায় ও সাধারণ আবেগে।’ নারী পুরুষের অধীনে, এ-সম্পর্কে মিল (১৮৬৯, ৮) বলেছেন, যারা মনে করে নারীদের থাকতে হবে পুরুষদেরই অধীনে, তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি হচ্ছে বিশেষ এক তত্ত্ব। ওই তত্ত্বটি তারা গোঁড়ামির সাথে পোষণ করে আসছে, তাই ওই তত্ত্বের বিরোধী আর কিছু কখনো পরীক্ষা ক’রে দেখতে দেয়া হয় নি। নারীপুরুষের অসাম্য, মিলের মতে, বিশেষ বিচারবিবেচনার ফল নয়; এর উদ্ভব ঘটেছে পুরুষের শারীরিক শক্তির ফলে। পুরুষ শক্তিবশত নারীকে নিজের অধীন করেছে। পরে আইন বিধিবদ্ধ করেছে তাই। মিল দেখিয়েছেন শক্তিপ্রয়োগের ফলেই সূচনা ঘটেছে সব রকম আধিপত্য ও অধীনতার, তারপর আধিপত্য ও অধীনতাকেই পরিণত করা হয়েছে বিধানে। নারীর অধীনতাকে মিল তুলনা করেছেন দাসত্বপ্রথার সাথে। মিল দেখিয়েছেন দাসত্ব শুরুতে ছিলো প্ৰভু ও দাসের মধ্যে শক্তির ব্যাপার; কিন্তু পরে তা বিধানে পরিণত করা হয়। প্রভুরা একত্র হয়ে দাসত্বকে পরিণত করে বিধানে। মিলের মতে প্ৰাচীন কালে অধিকাং নরনারীই ছিলো দাস; পরে মুক্তি লাভ করে পুরুষ দাসেরা, আর নারীকে বিন্যস্ত করা হয় একটু কোমল ধরনের অধীনতার ভেতবে। বর্তমানে নারীপুরুষের যে-অসাম্য, তার মূলে রয়েছে শক্তিমানের আইন। মিল মনে করেন শক্তিমানের আইন এখন পরিত্যক্ত হ’লেও তা রয়ে গেছে নানা এলাকায়, যেমন নারীর বেলা। শক্তিমানের বিধি অনুসারে নারী পরিণত হয়েছে গৃহদাসীতে।

পুরুষতন্ত্র প্রচার করে যে পুরুষের প্রভুত্ব ও নারীর অধীনতা প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক। কোনো কিছুকে প্রাকৃতিক/স্বাভাবিক বলার অর্থ হচ্ছে তা মানুষের তৈরি নয়, তা কোনো শাশ্বত বিধানের ফল। তাই তা প্রশ্নের ওপরে, তা অসংশোধনীয়। কিন্তু মানুষের জীবনে কোনো কিছুই শাশ্বত নয়; বিধাতা, ধর্ম, রাজা, প্ৰজা, ধনী, দরিদ্র সবই মানুষের তৈরি। সুবিধাভোগীরা চিরকালই দোহাই দেয় ঈশ্বরের, প্রকৃতির, স্বভাবের; কেননা তাতে রক্ষা পায় তাদের স্বার্থ। মিল (১৮৬৯, ২১) প্রশ্ন করেছেন, ‘এমন কি কোনো আধিপত্য রয়েছে, যা প্রাকৃতিক মনে হয় নি প্ৰভুদের কাছে?’ তিনি দেখিয়েছেন এক সময় মানবসমাজকে ভাগ করা হতো দুটি ভাগে : ছোটো ভাগটিতে পড়তো প্রভুরা আর বড়ো ভাগটিতে দাসেরা, এবং তাকেই মনে করা হতো প্রাকৃতিক; এমনকি শ্রেষ্ঠ পুরুষেরাও তাই মনে করতো। জ্ঞানী আরিস্তলের কাছেও প্ৰভু ও দাসের বিভাগকে মনে হয়েছিলো প্রাকৃতিক। তিনি মনে করতেন মানুষের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবেই রয়েছে দুটি ভাগ : একটি স্বাধীন প্রকৃতির, যেমন গ্রিকরা; আরেকটি দাসপ্রকৃতির, যেমন থ্রেসীয় ও এশীয়রা। মার্কিন দাসমালিকেরাও প্রাকৃতিক বলে মনে করতো শাদার প্রভুত্ব ও কালোর দাসত্বকে। রাজতন্ত্রবাদীরা সব সময়ই মনে করেছে যে রাজতন্ত্রই প্রাকৃতিক। এসবের মূলকথা হচ্ছে যারা জোর ক’রে ক্ষমতা দখল করেছে, যারা প্ৰভু হয়ে উঠেছে, তাদের কাছে প্ৰভুত্ব মানেই প্রাকৃতিক। চিরকাল বিজয়ীরা মনে করেছে যে প্রকৃতির নির্দেশ হচ্ছে বিজিতরা অধীনে থাকবে বিজয়ীদের। মধ্যযুগে সামন্ত প্রভুরা নিজেদের প্রভুত্বকে মনে করতো প্রাকৃতিক; নিম্নশ্রেণীর মানষেরা তাদের সমান হবে এমন ভাবনাকে তারা মনে করতো সম্পূর্ণ অপ্রাকৃতিক বা অর্থাভাবিক। তা-ই মানুষের কাছে অস্বাভাবিক/ অপ্রাকৃতিক বলে মনে হয়, যা অপ্রথাগত; যা প্রথায় পরিণত হয়েছে, তা যতোই অস্বাভাবিক উৎকট পাশবিক হোক-না-কেনো, তা-ই মানুষের কাছে স্বাভাবিক। মিল (১৮৬৯, ২২-২৩) তথাকথিত প্রাকৃতিককে নির্দেশ করেছেন প্ৰথা বলে :

‘এটা এতো সত্য যে অস্বাভাবিক বলতে সাধারণত বোঝানো হয় শুধু অপ্ৰথাগতকে, আর যা কিছু প্রথাগত তাকেই মনে করা হয় প্রাকৃতিক/স্বাভাবিক। নারীর পুরুষাধীনতা যেহেতু বিশ্বজনীন প্রথা, তাই এর থেকে সামান্য স’রে যাওয়াকে মনে হয় অস্বাভাবিক।‘

অপ্ৰথাগত ব’লে অস্বাভাবিক মনে হওয়ার নানা উদাহরণ দিয়েছেন মিল। বিলেতের শাসক একজন নারী, এটা খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে হয় পৃথিবীর নানাদেশের মানুষের কাছে; রানীর শাসন তাদের কাছে অবিশ্বাস্যরূপে অস্বাভাবিক। ইংরেজের কাছে এটা অস্বাভাবিক নয়, কেননা এতে তারা অভ্যস্ত; কিন্তু নারীদের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া বা সংসদ সদস্য হওয়া তাদের কাছে অস্বাভাবিক। চিরকালই সুবিধাবাদী শোষকেরা নিজেদের আধিপত্য নিরঙ্কুশ রাখার জন্যে দোহাই দেয় প্রকৃতির। নারীকে বশে রাখার জন্যে তারা দোহাই দিয়েছে প্রকৃতির। মিল ‘প্রাকৃতিক’ ধারণাকেই বাতিল ক’রে দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে নারীপুরুষকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা এবং তাদের সামাজিক, রাজনীতিক, আর্থনীতিক অবস্থাকে প্রাকৃতিক বলে দাবি করা একধরনের রাজনীতি। মিলের কাছে কোনো কিছুই প্রাকৃতিক নয়। পুরুষতন্ত্ৰ মনে করে পুরুষের প্রভুত্ব ও নারীর দাসীত্ব প্রাকৃতিক; মিল দেখিয়েছেন এটা সম্পূর্ণ কৃত্রিম।

পুরুষতন্ত্রের প্রবক্তারা বলে থাকে যে নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য ভিন্ন অন্যান্য আধিপত্য থেকে, কেননা এটা শক্তির আধিপত্য নয়; নারী এ-আধিপত্য মেনে নিয়েছে, গ্রহণ করেছে স্বেচ্ছায়। এর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই নারীর, নারী স্বীকৃতি দিয়েছে এ-আধিপত্যকে। আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হতে পারে; এখনকার নারীপুরুষের অবস্থা দেখে মনে হতে পারে যে পুরুষাধিপত্য নারীর কাছে আকর্ষণীয়। কিন্তু ভেতরে ঢুকলে চোখে পড়ে প্রকৃত সত্যটি যে নারী পুরুষাধীনতা মেনে নেয় নি। মিল বলেছেন, বহু নারী পুরুষাধিপত্যকে স্বীকার করে না; অনেকে লেখার মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে তাদের মনোভাব, এবং এখন নারীরা এর বিরুদ্ধে প্ৰতিবাদ জানাচ্ছে প্রকাশ্যে। নারীরা ভোটাধিকার চায়, চায় পুরুষের সাথে সমান শিক্ষা ও পেশা। মিলের সময় পর্যন্ত নারীবাদীরা স্পষ্টভাবে বলে নি যে তারা পুরুষাধিপত্য মানে না, তারা সম্পূর্ণ মুক্তি চায়; কিন্তু মিল তাদের আন্দোলনে দেখেছেন পূর্ণ মুক্তির অভিলাষ। মিল বলেছেন, কোনো পরাধীন শ্রেণীই একবারে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করে না। যারা বহুদিন প্রচলিত কোনো শক্তির অধীনে থাকে, তারা শুরুতেই ওই শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় না, প্রতিবাদ জানায় শুধু তার পীড়নের বিরুদ্ধে। অসংখ্য নারী প্রতিবাদ জানায় তাদের স্বামীদের পীড়নের বিরুদ্ধে। মিল বলেছেন, নারীরা একযোগে নানা কারণে পুরুষের ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে না। তারা অন্য সমস্ত অধীন-শ্রেণী থেকে ভিন্ন; তাদের প্রভুরা তাদের কাছে শুধু শ্ৰম চায় না, প্রভুরা তাদের কাছে শ্রমের থেকে কিছুটা বেশি চায়। পুরুষ শুধু নারীদের আনুগত্য চায় না, পুরুষ চায় নারীদের আবেগানুভূতি। শুধু বর্বর ছাড়া কোনো পুরুষই নারীকে একটি বাধ্য ক্রীতদাসী হিশেবে পেতে চায় না, চায় একটি স্বেচ্ছাদাসী; পুরুষ তার নারীর কাছে শুধু দাসী চায় না, চায় প্রিয়দাসী। তাই পুরুষ সব রকমের চেষ্টা চালায় নারীর মনকে দাসীতে পরিণত করার। অন্য ধরনের দাসদের প্রভুরা ভয় জাগিয়ে আনুগত্য আদায় করে দাসদের কাছ থেকে, আর নারীর প্রভুরা যেহেতু শুধু আনুগত্যে সুখী নয়, যেহেতু তারা নারীর কাছে চায় আবেগানুভূতি, তাই তারা নারীকে দেয় এক বিশেষ ধরনের শিক্ষা। পীড়ন ক’রে নয়, শিক্ষা দিয়ে পুরুষ নারীকে ক’রে তোলে প্রিয় ক্রীতদাসী। পুরুষতন্ত্রের উদ্ভাবিত নারীশিক্ষা হচ্ছে নারীকে পুরুষের দাসী করার শিক্ষা। শিশুকাল থেকেই নারীদের শেখানো হয় যে তাদের প্রকৃতি পুরুষের বিপরীত; নারীরা নিয়ন্ত্রণ করবে না, তারা আত্মসমৰ্পণ করবে। অন্যের নিয়ন্ত্রণের কাছে; সব ধরনের নীতিশাস্ত্র শেখায় যে পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণই তাদের কর্তব্য; আর সব ধরনের ভাবালুতা তাদের শেখায় যে নারীর প্রকৃতি হচ্ছে অন্যের জন্যে বেঁচে থাকা, নিজেদের সম্পূর্ণ বঞ্চিত করা। বঞ্চিত হওয়াই নারীত্ব! নিজের স্বার্থে নিজের অধীনে রাখার জন্যে পুরুষ নারীকে এমন শিক্ষা দিয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে, যাতে নারী হয়ে উঠেছে বিনম, বশ্যতাপরায়ণ, এবং নিজের অভিলাষ ছেড়ে দিয়েছে সে পুরুষের হাতে।

পুরুষতন্ত্রের মতে বর্তমানে নারীপুরুষের যে-অবস্থা, পুরুষের আধিপত্য ও নারীর অধীনতা, ঘটেছে নারীপুরুষের স্বভাব বা প্রকৃতি অনুসারে। মিল একে বাতিল ক’রে দিয়েছেন, কেননা তাঁর মতে নারীপুরুষের স্বভাব বিজ্ঞানসন্মতভাবে জানার মতো উপায় তখনো উদ্ধাবিত হয় নি। তাই তাদের স্বভাব বলে যা নির্দেশ করা হয়, তা বানানো জিনিশ। মিল (১৮৬৯,৩৮) বলেছেন :

‘একথা বলা যাবে না যে এ-দু-লিঙ্গের প্রকৃতি অনুসারেই তাদের বর্তমান ভূমিকা ও অবস্থান নির্ণীত হয়েছে, এবং এ-ই। তাদের জন্যে উপযুক্ত। সাধারণ বুদ্ধি ও মানবমনের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আমি একথা স্বীকার করি না যে এ-দু-লিঙ্গের প্রকৃতি কেউ জানে বা জানতে পারে, বিশেষ ক’রে যখন তাদের দেখা হয় তাদের বর্তমান পারস্পরিক সম্পর্ক অনুসারে।… এখন যাকে নারীপ্রকৃতি বলা হয়, তা সম্পূর্ণরূপে কৃত্রিম জিনিশ–একদিকে তা পীড়নের, আরেক দিকে তা অস্বাভাবিক প্ররোচনার ফল। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে আর কোনো অধীন-শ্রেণীর চরিত্র তাদের প্রভুদের সাথে সম্পর্কের ফলে এতো অস্বাভাবিকভাবে বিকৃত হয় নি।‘

পুরুষ শিক্ষা দিয়ে বদলে, বিকৃত ক’রে দিয়েছে নারীর স্বভাবকে; নারীকে ক’রে তুলেছে বশ্যতাপরায়ণ, ভীরু, ভাবালুতগ্রস্ত, এবং এর ফলে নারীকে আর যোগ্য মনে হয়। না কোনো মানবিক কাজের। নারীপুরুষের স্বাভাবিক পার্থক্য কোথায়? পুরুষতন্ত্রের প্রবক্তারা বলে যে তারা তা জেনে গেছে সম্পূর্ণরূপে; কিন্তু মিলের মতে সমাজের বর্তমান অবস্থায় তা জানা সম্পূর্ণ অসম্ভব। মিল দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন স্বভাবের ওপর প্রতিবেশের প্রভাবের দিকে। নারীপুরুষের নৈতিক ও মননগত পার্থক্য যতো ব্যাপকই মনে হোক-না-কেনো এখন, মিল তাকে কিছুতেই স্বাভানিক পার্থক্য বলে মেনে নিতে রাজি নন। কেননা শিক্ষা ও প্রতিবেশের প্রভাবে নারী তার প্রকৃত স্বভাব হারিয়ে ফেলেছে, গ্রহণ করেছে কৃত্রিম স্বভাব। মিলের মতে, পুরুষ নারীকে যা মনে করে নারী তা নয়। পুরুষ নারী সম্পর্কে যা বলে তা ঠিক নয়, নারীর কথা বলতে পারে শুধু নারী।

পুরুষ সাধারণত ধারণা করে যে নারীর ভূমিকা হচ্ছে স্ত্রী ও মাতার। মিল একে শুধু ধারণা ব’লেই মনে করেন, ধ্রুব সত্য বলে মনে করেন না, কেননা সমাজের বর্তমান অবস্থায় জানার কোনো উপায় নেই নারী নিজেকে দেখতে পছন্দ করে কোন ভূমিকায়। এমনও হতে পারে স্ত্রী ও মায়ের ভূমিকাকে ঘেন্না করে তারা; তবে নারীদের যেহেতু স্বাধীনভাবে কোনো ভূমিকা বা পেশা বেছে নিতে দেয়া হয় নি, তাদের ওপর যেহেতু চাপিয়ে দেয়া হয়েছে স্ত্রী ও মায়ের ভূমিকা, তাই তারা বাধ্য হয়ে তা পালন করে; কিন্তু একে তাদের স্বাভাবিক ভূমিকা মনে করার কোনো কারণ নেই। মিলের মতে দাসদের যেমন বাধ্য করা হতো বিশেষবিশেষ কাজ করতে, কারণ ওই কাজ সমাজের জন্যে দরকার, তেমনি নারীদের বাধ্য করা হয় বিয়েতে ও সন্তান লালনে, কেননা সমাজের তা দরকার। পুরুষ নারীর সমস্ত পথ বন্ধ করে খোলা রেখেছে। শুধু বিয়ের গলিটি, তাই ওই কানাগলিতে নারীকে ঢুকতেই হয়। মিলের মতে বিয়ে হচ্ছে নারীর সমাজনির্ধারিত নিয়তি। মিল দেখিয়েছেন এক সময় খ্রিস্টানদের মধ্যে স্বামী ছিলো স্ত্রীর জীবনমৃত্যুর অধিপতি। মিল (১৮৬৯, ৫৫) বলেছেন :

‘এখন স্ত্রী হচ্ছে তার স্বামীর দাসখত দেয়া দাসী : আইনের চোখে তারা ক্রীতদাসদের থেকে একটুও কম দাস নয়। বেদীতে সে স্বামীর প্রতি জীবনব্যাপী আনুগত্যের শপথ নেয়।… স্ত্রী নিজের জন্যে কোনো সম্পত্তি অর্জন করতে পারে না, স্বামীর জন্যে পারে; তার সম্পত্তি অবলীলায় স্বামীর সম্পত্তি হযে ওঠে। বিলেতের সাধারণ আইনে স্ত্রীর অবস্থা অনেক দেশের ক্রীতদাসের অবস্থার থেকেও খারাপ।‘

মিল অবশ্য দেখিয়েছেন যে আইনের চেয়ে মানুষ, এমনকি পুরুষও অনেক ভালো; যদি তা না হতো তবে পৃথিবীটা বেশ একটা নরক হয়ে উঠতো। আইন পুরুষকে যতোটা নিষ্ঠুরতার অধিকার দিয়েছে পুরুষ ততোটা নিষ্ঠুর নয়, বা পুরুষের পক্ষে অসম্ভব ততোটা নিষ্ঠুর হওয়া। তবে আইনে নারী পুরুষের দাসীই।

নারী পুরুষের ওপর নানা প্রভাব খাটাতে পারে, মেষ বানিয়ে রাখতে পারে পুরুষকে; কিন্তু নারীর ওই শক্তির কোনো কোনো মূল্য নেই। মিলের মতে নারীর এ-শক্তি কিছুতেই নারীর স্বাধীনতাহীনতার ক্ষতি পূরণ করতে পারে না। নারীর এ-শক্তি নারীকে অবৈধ অধিকার দিতে পারে, কিন্তু তাকে তার বৈধ অধিকার দাবি করার অধিকার দেয় না। মিল (১৮৬৯,৭০) বলেছেন, সুলতানের প্রিয় ক্রীতদাসীর অধীনেও থাকে অনেক দাসদাসী, তাদের ওপর সে উৎপীড়নও চালিয়ে থাকে; কিন্তু তাতে সে স্বাধীন মানুষ হয়ে ওঠে না, সে থাকে ক্রীতদাসীই। যা কাম্য তা হচ্ছে সে নিজেও দাসী হবে না, আর তার অধীনেও থাকবে না দাসদাসী। কোনোকোনো নারী থাকে অশেষ সুখ ও শক্তির মধ্যে, তবে তা দাসীর সুখ ও শক্তি; সে ওই সুখশক্তি পায় প্রভুকে সেবার ও প্রমোদ দেয়ার বিনিময়ে। মিল ভিক্টোরীয় সমাজের একটি ভণ্ডামোরও সমালোচনা করেছেন। ভিক্টোরীয়রা বারবার বলতো যে নারী পুরুষের থেকে অনেক উৎকৃষ্ট, আর একথা বেশি বলতো তারা, যারা নারীদের আসলেই মনে করতো দাসী। এটা কি এক পরিহাস নয় যে উৎকৃষ্টরা থাকবে নিকৃষ্টদের অধীনে? ভিক্টোরীয়রা নারীদের উৎকৃষ্টতায় বিশ্বাস করতো না, তবে তাদের বশে রাখার জন্যে করতো। এ-তোষামোদটুকু। মিল প্রশ্ন করেছেন, নারীরা উৎকৃষ্ট কিসে, এবং দেখিয়েছেন নারীরা পুরুষের থেকে উৎকৃষ্ট শুধু আত্মোৎসর্গপরায়ণতায়! কেননা পৃথিবী জুড়েই শিশুকাল থেকেই নারীদের শেখানো হয় যে তারা জন্ম নেয় আত্মোৎসর্গের জন্যে; তারা নিজেদের যতো বঞ্চিত কববে ততোই উন্নতি ঘটবে পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার! নারী বেঁচে থাকে নিজেকে বঞ্চনা করে, কেননা আত্মবঞ্চনাই পুরুষতন্ত্রের মতে নারীত্ব। মিল মনে করেন নারীপুরুষ যদি সমানাধিকার পায়, তবে লোপ পাবে নারীর এ-আত্মঘাতী প্রবণতা। ভিক্টোরীয়রা বড়াই করতো নৈতিকতায়, মিল তাদের নৈতিকতার ভেতরে লুকোনো অনৈতিকতার রূপটিও তুলে ধবেছেন। মিল মনে করেন সাম্যই নৈতিকতা, আর সে-সমাজই নৈতিক যেখানে রয়েছে সাম্য। এতোদিন ধরে যে-সমাজ চলে এসেছে, সেটা বলতান্ত্রিক সমাজ; সেখানে সমান হওয়ার অর্থই হচ্ছে শত্রু হওয়া। ওই সমাজ ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত শেকল বা মইয়ের মতো, সেখানে কেউ ওপরে কেউ নিচে; তাতে কেউ আধিপত্য করে কেউ থাকে অধীনে। তাই প্ৰচলিত নৈতিকতা হচ্ছে আধিপত্য ও অধীনতার নৈতিকতা। মিল মনে করেন আধিপত্য ও অধীনতা হচ্ছে সমাজের বিকার; সমাজের স্বাভাবিক রূপ হচ্ছে পারস্পরিক সাম্য। তিনি মনে করেন মনুষ্যত্ব নিহিত পরস্পরের সাথে সমভাবে বসবাসের মধ্যে। তিনি দেখিয়েছেন বর্তমান ব্যবস্থায় পরিবার হচ্ছে স্বৈরাচারের রাজ্য; তবে তিনি মনে করেন ঠিক মতো গড়ে উঠলে পরিবার হবে স্বাধীনতার রাজ্য। মিল আক্রমণ করেছেন পিতৃতান্ত্রিক পরিবারকে, যেখানে পুরুষ প্ৰভু নারী তার অধীন। মিল দাবি করেছেন নারীপুরুষের আইনগত সমানাধিকার, পরিবারে কেউ প্ৰভু বা দাসদাসী হবে না; স্বামীস্ত্রী হবে সমান।

পুরুষতন্ত্র নারীপুরুষের বিশ্বকে দুটি পরিচ্ছন্ন ভাগে ভাগ করে; নারীর জন্যে বরাদ্দ করে ঘর, পুরুষের জন্যে বাইর। ভিক্টোরীয়রা ছিলো ঘরে বাইরে তত্ত্বের একনিষ্ঠ উপাসক। পুরুষ নারীকে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে, তাকে মা-স্ত্রী-কন্যার ভূমিকা দিয়ে কেড়ে নেয তার সমস্ত মানবিক অধিকার। মানবিক প্রায় সব পেশাই তারা নিষিদ্ধ করে নারীর জন্যে। নারী যে ওই সব পেশার অযোগ্য, তা নয়; তবে পুরুষ জোর ক’রেই নারীকে ঘোষণা করে ওইসব পেশার অযোগ্য বলে। পুরুষের সমান হয়ে ওঠার জন্যে নারীর ফিরে পাওযা দরকার সমস্ত মানবিক পেশা। নারীপুরুষের সাম্যের জন্যে মিল নারীর জন্যে চেয়েছেন সে-সব ভূমিকা ও পেশা, যা এতোদিন ধরে রয়েছে পুরুষের অধিকারে। তিনি দেখিয়েছেন নারীকে সব পেশা ও ভূমিকা থেকে দূরে রাখা হয়েছে, যাতে নারী পরিবারের মধ্যে সহজে মেনে নেয় পুরুষের আধিপত্য। তাঁর মতে অধিকাং পুরুষ সমান কারো সাথে বসবাসের কথা ভাবতেই পারে না। তাই পুরুষ নারীকে দূরে রেখেছে সমস্ত আকর্ষণীয় পেশা থেকে, যা নারীকে ক’রে তুলবে পুরুষের সমান। পুরুষ অবশ্য যুক্তি দেয় যে নারী ওই সব কাজের উপযুক্ত নয়, নারীর নেই ওই সব কাজের প্ৰতিভা বা যোগ্যতা। মিল ইতিহাস থেকে উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে নারী সম্পর্কে এ-ধারণা সত্য নয়; সত্য হচ্ছে নারী সব কাজই যোগ্যতার সাথে সম্পন্ন করতে পারে। তবে নারীকে অনেক কাজ করতেই দেয়া হয় নি, তাই তারা যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ পায় নি। তাদের যে-কাজ করতেই দেয়া হয় নি, সে-কাজে তাদের অযোগ্যতা প্রমাণিত না হওয়া সত্ত্বেও বলা হয় তারা সে-কাজের উপযুক্ত নয়। মিল বলেছেন, এখনো কোনো নারী হোমার, আরিস্তাতল বা মাইকেল অ্যাঞ্জেলো দেখা দেয় নি; তাই ব’লে মনে করা যায় না যে কোনো কালে ওই মাপের কোনো নারী দেখা দেবে না। তবে নারীরা এলিজাবেথ বা জোয়ান অফ আর্ক হয়েছে। মিল দেখিয়েছেন এখনকার আইনের এক বিস্ময়কর বিধান হচ্ছে যে-কাজে নারীরা দক্ষতা দেখিয়েছে, সে-কাজ থেকেই বহিষ্কার করা হয়েছে নারীদের। এমন কোনো আইন নেই, যাতে নারীদের শেক্সপিয়র বা মোৎসার্ট হওয়া নিষেধ, তবে নারীরা রাজ্যশাসনে দক্ষতা দেখালেও তাদের রাজনীতিক ক্ষমতা লাভ নিষিদ্ধ। এলিজাবেথ বা ভিক্টোরিয়া ক্ষমতা পেয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে, নইলে তাদের রাজনীতিক ক্ষমতা পাওয়ার কোনো পথ ছিলো না। পুরুষতান্ত্র নারীর বিরুদ্ধে তোলে যে-সব অভিযোগ, মিল সেগুলোর উত্তর দিয়েছেন এক-এক করে, এবং দেখিয়েছেন সব অভিযোগই বানানো; সেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। নারীর মেধা কম নয়, শক্তিও কম নয়; নারী কোনো কিছুতেই নিকৃষ্ট নয় পুরুষের থেকে; নারী পুরুষের সমান। তাই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার পরিপূর্ণ সাম্য। স্টুয়ার্ট মিল নারীপুরুষের সাম্য চেয়েছেন শুধু নারীর কল্যাণের জন্যে নয়, চেয়েছেন মানবজাতি ও সভ্যতার কল্যাণের জন্যে। মিলের বইটিকে সে-সময়ের নারীবাদীরা নিজেদের পবিত্র বই হিশেবে গ্রহণ করেছিলেন; এবং তাঁর বিভিন্ন যুক্তি গত একশতকের বেশি সময়ে ছড়িয়ে পড়েছে বই থেকে বইয়ে। নারীর মুক্তিতে মিল ও নারী-অধীনতার ভূমিকা অশেষ।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ, রুশো-রাসকিনের মতোই, পুরুষতন্ত্রের মহাপুরুষ; এবং প্রভাবিত ছিলেন ওই দুজন, ও আরো অনেককে, দিয়ে। রোম্যানটিক ছিলেন তিনি, এবং ছিলেন ভিক্টোরীয়; নারী, প্ৰেম, কবিতা, সমাজ, সংসার, রাজনীতি, জীবন, এবং আর সমস্ত কিছু সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিলেন তিনি পশ্চিমের রোম্যানটিকদের ও ভিক্টোরীয়দের কাছে; এবং সে-সবের সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন তিনি ভারতীয় ভাববাদ বা ভেজাল। রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় মৌলিকতা খুবই কম; তাঁর সমাজ ও রাজনীতিবিষয়ক চিন্তার সবটাই বাতিল হওয়ার যোগ্য। রুশো ও রাসকিনের নারীবিষয়ক লেখার সাথে পরিচিত ছিলেন তিনি, বোঝা যায়; নারী সম্পর্কে তাঁর অনেক উক্তিই রুশো-রাসকিনের প্রতিধ্বনি। মিলের সাথেও পরিচিত ছিলেন, যদিও মিলের সাথে তাঁর মিল ছিলো না; তাঁর মিল ছিলো টেনিসনের সাথে, এবং ‘প্রিন্সেস’-এর নারীবিষয়ক ধারণা তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন চিত্রাঙ্গদায়। তার নারীধারণা রোম্যানটিক; বাস্তব নারী তিনি দেখেছেন, তবে অনেক বেশি দেখেছেন স্বপ্নের নারী। রোম্যানটিকের চোখে নারীমাত্রই তরুণী, রূপসী, মানসসুন্দরী, দেবী; আর তারা নিজেরা দেবতা। তারা অবাস্তব নারীর উপাসক, তারা জন্মজন্মান্তর ধ’রে স্তব ক’রে যেতে পারে লোকোত্তর নারীর; তবে বাস্তবে নারী তাদের কাছে গৃহিণী, সুন্দর করে যাকে বলা হতো ‘গৃহলক্ষ্মী’। রোম্যানটিকেরা অহমিকায় ছাড়িযে যায় বিধাতাকেও, তারা মানসসুন্দরীর স্তব করলেও নিজেদের দেখে নারীর স্রষ্টারূপে। রবীন্দ্রনাথও তাই দেখেছেন। রবীন্দ্ৰনাথ অপরূপ রূপসী নারীর স্তবগান করেছেন, কিন্তু নারীর বাস্তব অস্তিত্বও অনেক সময় স্বীকার করেন নি। রবীন্দ্রনাথ নারীকে দেখতে পছন্দ করতেন। স্বপ্নে ও ঘরে, নারী স্বপ্নে থাকবে নইলে থাকবে ঘরে; বাস্তবের অন্য কোথাও থাকবে না। দুই বোন (১৩৩৯) উপন্যাসের শুরুতে তিনি মন্তব্য কবেছেন, ‘মেয়েরা দুই জাতের, কোনো কোনো পণ্ডিতের কাছে এমন কথা শুনেছি। এক জাত প্ৰধানত মা, আর-এক জাত প্রিয়া।‘ কোনো কোনো পণ্ডিতের কাছে এটা তার শোনার দরকার ছিলো না, এটা তাঁর নিজেরই কথা; একটি পুরো উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি একথা প্রমাণ করার জন্যেই। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাসী ছিলেন না নারীমুক্তিতে, যদিও তার কোনো কোনো পংক্তি নারীবাদের ইশতেহারের মতো শোনায়; তিনি বিশ্বাসী ছিলেন পুরুষতন্ত্রে ও পুরুষাধিপতো। ভিক্টোরীয় ঘরেবাইরে তত্ত্বে তাঁর আস্থা ছিলো দৃঢ়, এ-নামে একটি উপন্যাস লিখে তিনি তা দেখিয়েছেন; এবং নারীপ্রকৃতি ব’লে পুরুষতন্ত্র যে-উপকথা তৈরি করেছিলো, তিনি ছিলেন তাতে অন্ধ বিশ্বাসী। রবীন্দ্রনাথের নারীধারণা রুশো-রাসকিন-টেনিসনের নারীধারণারই বাঙালি রূপ; তাদের মতই তিনি ভিন্ন ভাষায় কিছুটা ভারতীয় ভাবাবেগ মিশিয়ে প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ মিত্র ছিলেন না নারীর, ছিলেন নারীর প্রতিপক্ষের এক বড়ো সেনাপতি । তিনি চেয়েছিলেন নারীরা কবিতা পড়বে, আর হবে তাঁর মতো কবির একান্ত অনুরাগিনী ।

নারী সম্পর্কে তিনি লিখেছেন প্রচুর; কবিতা, উপন্যাস, গল্প, প্ৰবন্ধ, ভাষণ, ভ্ৰমণকাহিনীতে বারবার তিনি কথা বলেছেন নারী সম্পর্কে–বাঙালি, ভারতি, বিদেশি, এবং সনাতনী, শাশ্বতী, চিরন্তনী, কল্যাণী সম্পর্কে। তাঁর কথা ধাধায় ভরা, অনেক সময় কথা বলার জন্যেই কথা বলা! ঘুরিয়েপেঁচিয়ে সুন্দর কথা অনেক বলেছেন, যা প্রথম মনে হয় চমৎকার; কিন্তু একটু ভাবলেই ধরা পড়ে যে নারীকে তিনি মনে করেন অসম্পূর্ণ মানুষ। রবীন্দ্রনাথের চোখে পুরুষের বিকাশ ঘটেছে, বিবর্তন ঘটেছে সব কিছুর; শুধু বিকাশবিবর্তন ঘটে নি নারীর; এবং তিনি চান নারীর কোনো বিকাশ না ঘটুক, নারী থেকে যাক আদিমতম বা চিরন্তনী। পুরুষ মহাজগত পেরিয়ে চলে যাক, কিন্তু নারী থাকুক ঘরের কোণে কল্যাণী হয়ে। পুরোনো ভারতের ঋষিদের মতো আধুনিক ভারতের এ-ঋষি কুৎসা রটান নি নারীর নামে, বরং প্রতিবাদ করেছেন ওই সব আশীল কুৎসার; তবে পুরোনো ঋষিরা নারীদের যেখানে ও যে-ভূমিকায় দেখতে পছন্দ করতো, তিনিও পছন্দ করতেন তাই। বাস্তব নারী তাঁর চোখে গৃহিণী, আর অবাস্তব নারী মানসসুন্দরী, এমনকি জীবনদেবতা। পুরোনো ঋষিদের মানসসুন্দরীর মোহ ছিলো না, তবে রোম্যানটিক রবীন্দ্রনাথের সে-মোহ ছিলো প্ৰবল; ওই মোহটুকু বাদ দিলে নারী হচ্ছে গৃহিণী : জায়া ও জননী। নারী যে খাচায় বন্দী, এটা তাঁর চোখে পড়েছে; তবে তিনি খাঁচার রূপেই মুগ্ধ হয়েছেন, মনে করেছেন নারী আছে ‘যেন সোনার খাঁচায়’। নারী যে শেকলে বন্দী, তাও তার চোখে পড়েছে; তবে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন শেকলের রূপেই, মনে করেছেন শেকলটি সোনার। নারী যখন বন্দী, রবীন্দ্রনাথের চোখে নারী তখন ‘কল্যাণী’! রবীন্দ্রনাথের নারীধারণার বিবর্তন পরে আলোচনা করবো; শুরুতে তাঁর দুটি কবিতা পড়ে নিতে চাই, কেননা ওই কবিতা দুটিতে প্ৰকাশ পেয়েছে তাঁর নারীধারণার সম্পূর্ণ রূপ : নারীর বাস্তবতা ও অবাস্তবতা। সোনার তরী (১৩০০) কাব্যে আছে একটি কবিতা, যার নাম ‘সোনার বাঁধন’ (১২৯৯) :

বন্দী হয়ে আছো তুমি সুমধুর স্নেহে
অয়ি গৃহলক্ষ্মী, এই করুণ ক্ৰন্দন
এই দুঃখদৈন্যে-ভরা মানবের গেহে।
তাই দুটি বাহু’পরে সুন্দরবন্ধন
সোনার কঙ্কন দুটি বহিতে্যুছ দেহে
শুভচিহ্ন, নিখিলের নয়নানন্দন।
পুরুষের দুই বাহু কিণাঙ্ক-কঠিন
সংসারসংগ্রামে, সদা বন্ধনবিহীন;
যুদ্ধ-দ্বন্দ্ব যত কিছু নিদারুণ কাজ
বহ্নিবাণ বীজসম সর্বত্র স্বাধীন।
তুমি বদ্ধ স্নেহ-প্ৰেম-করুণার মাঝে
শুধু শুভকর্ম, শুধু সেবা নিশিদিন।
তোমার বাহুতে তাই কে দিয়াছে টানি,
দুইটি সোনার গণ্ডি, কাঁকন দুখানি।

ভিক্টোরীয় ইংরেজ, বা উনিশশতকের দ্বিতীয়ার্ধের বাঙালি ভদ্রলোক গৃহিণীকে যেভাবে আদর্শায়িত ক’রে সুখ পেতো, এতে রূপায়িত হয়েছে সে-ছবিটিই। এর সাথে বাস্তবের মিল নেই। ভদ্রলোক বাঙালির চোখে যা ‘গৃহলক্ষ্মী’, ভিক্টোরীয়দের চোখে তা ‘অ্যাঞ্জেল ইন দি হাউজ’, দুটিই সুভাষণ। কবিতাটি বাস্তবভাবে পড়লে বোঝা যায় যে একটি স্বাধীন দেবীকে বন্দী করা হয়েছে বা বেঁধে ফেলা হয়েছে, বাঁধনটি অবশ্য সোনার। বন্দী ওই দেবীর কোনো দুঃখ আছে কিনা, তাতে কবির উৎসাহ নেই; তাকে যে বন্দী করা গেছে, এটাই বেশ স্বস্তিকর। এতে স্তব করা হচ্ছে শেকলটিরই। নারী বন্দী, বন্দীত্বই তার সুখ। পুরুষ স্বাধীন বীর, সব সময় সংগ্ৰাম ক’রে চলছে; পুরুষ এতোই বীর যে সে বন্ধনহীন দেবীকেও বেঁধে ফেলেছে। এখন দেবীর কাজ শুধু ‘শুভকর্ম, শুধু সেবা নিশিদিন’। যদি ওই শুভকর্ম ও নিশিদিন সেবার একটি তালিকা তৈরি করা যায়, তাহলে দেবী আর দেবী থাকে না, হয়ে ওঠে গৃহপরিচারিকা। ওই দেবী ঘুম থেকে উঠেই কাজে লেগে যায়, বাসন মাজে, স্বামীর খাবার তৈরি করে, শাশুড়ীর তিরষ্কার শোনে, স্বামীর জামার বোতাম শেলাই করে, বছরে বছরে নোংরা আঁতুড়ঘরে বাচ্চা বিয়োয়, বিয়োতে গিয়ে মারা যায় অনেকেই, আর যারা বেঁচে থাকে তাদের আর যা-ই থাক, রূপ নামের কিছু থাকে না, যা টানতে পারে কোনো রোম্যানটিক কবিকে বা মাংসাশী স্বামীকে। তখন পুরুষ পুরোনো দেবীকে ছেড়ে নতুন দেবী খোঁজে। রবীন্দ্রনাথ যখন গৃহিণীর দিকে তাকিয়েছেন, তখন তাকিয়েছেন রোম্যানটিকের চোখে, তাকে আদর্শায়িত করেছেন, যদিও তিনি নিজের ঘরেও আমন কোনো দেবী দেখেন নি। তবে তিনি চান বাস্তবে নারী হবে গৃহিণী। রোম্যানটিকের চোখে নারীর আরেক রূপ মানসী, তিন বছর পরে লেখা ‘মানসী’ (১৩০২) কবিতায় যার পরিচয় পাওয়া যায় :

শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী!
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দৰ্য সঞ্চারি
আপন অন্তর হতে। বসি কবিগণ
সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন।
সঁপিয়া তোমার পরে নূতন মহিমা
অমর করিছে শিল্পী তোমার প্রতিমা।
কত বর্ণ, কত গন্ধ, ভূষণ কত-না–
সিন্ধু হতে মুক্তা আসে, খনি হতে সোনা,
বসন্তের বন হতে আসে পুষ্পভার,
চরণ রাঙাতে কীট দেয় প্ৰাণ তার।
লজ্জা দিয়ে, সজ্জা দিয়ে, দিয়ে আবরণ,
তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন।
পড়েছে তোমার ‘পরে প্রদীপ্ত বাসনা–
অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা।।

এ-কবিতায় পুরুষ নারীর দ্বিতীয় বিধাতা, যে অনেক শক্তিশালী প্রথম বিধাতার থেকে। প্রথমটি নারীকে সৃষ্টি করেছে, আর দ্বিতীয়টি সৃষ্টির নামে বন্দী করেছে নারীকে। কবিতাটিতে পুরুষ সক্রিয় : পুরুষ স্রষ্টা, স্থপতি, ভাস্কর, কবি, শিল্পী; নারী নিষ্ক্রিয় : নারী পুরুষের তৈরি মূর্তি; আর সম্ভোগসামগ্ৰী। কবিতাটিতে নারীর বাস্তব অস্তিত্বকেই অনেকটা অস্বীকার করা হয়েছে; নারী ‘অর্ধেক মানবী’, বা অর্ধেক বাস্তব; তার ‘অর্ধেক কল্পনা’ বা অর্ধেক অবাস্তব। এটি নারীর রোম্যানটিক স্টেরিওটাইপ। পুরুষের চোখে যদি নারী অর্ধেক কল্পনা হয়, তবে নারীর চোখেও পুরুষ অর্ধেক কল্পনা হওয়ার কথা; এবং পুরুষও তথাকথিত একলা বিধাতার সৃষ্টি নয়, নারীরও সৃষ্টি। তবে এ-কবিতায় বলা হয়েছে যে-নারীর কথা, সে সম্পূর্ণ কল্পনা; যার বাস পুরুষের ক্ষণায়ু উন্মাদনার মধ্যে। ওই মানসী যদি কবি বা পুরুষের স্ত্রী হয়, তবে দেখা যাবে মানসসুন্দরী মাছ কুটিছে রান্নাঘরে, বোতাম শেলাই করছে, আর অস্বাস্থ্যকর আঁতুড়ঘরে প্রসব ক’রে চলেছে বাচ্চাকাচ্চা! কবিতা হিশেবে চমৎকার এটি, তবে এটিতে প্রবলভাবে প্ৰকাশ পেয়েছে পুরুষতন্ত্র ও পুরুষাধিপত্যের অহমিকা। পুরুষ নারীকে সৃষ্টি করার নামে যে বন্দী করেছে, তাকে লজ্জা-সজা-আবরণ দিয়ে যে ঘরের মাঝে আটকে ফেলেছে, এটা চোখে পড়ে নি পড়ে নি রোম্যানটিকের।

রবীন্দ্ৰনাথ নারী সম্পর্কে গদ্যে প্রথম কথা বলেন বিলেতে গিয়ে [১৮৭৮-১৮৮০] ‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র’-এ (১৮৮১)। একটি বদ্ধ সমাজ থেকে মুক্ত সমাজে গিয়ে সতেরো-আঠারো বছরের এক নারীসঙ্গকাতর রোম্যানটিক তরুণ উচ্ছসিত হয়ে পড়েন তরুণীদের দেখে, তাদের সংস্পর্শে এসে, তাদের সাথে হাতে হাত ধ’রে গালে গাল লাগিয়ে নেচে। য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র ছেয়ে আছে নারী আর নাচের বিবরণে। তাঁর বিবরণে পাওয়া যায় উচ্চবিত্ত বিলেতি সমাজের যে-নারীদের, তারা ‘রাসকিনের মেয়ে’ বা ‘রানীর বাগানের পদ্ম’, যারা আপাদমস্তক অপদাৰ্থ : তারা নাচ, গান, ফ্লার্ট করা ছাড়া আর কিছু জানে না। বিলেতে গিয়েই তিনি তাদের সাথে মিশে যেতে পারেন নি, তাদের দেখেছেন দূর থেকে, এবং খুঁত খুঁজেছেন তাদের; তবে তাদের কাছাকাছি আসার পর উচ্ছসিত হয়েছেন। তাদের অন্তঃসারশূন্যতা তাঁর চোখে পড়েছে বিলেতে যাওয়ার সাথে সাথেই; ‘মেয়েরা বেশভূষায় লিপ্ত, পুরুষেরা কাজকর্ম করছে…মেয়েরা জিজ্ঞাসা করে থাকে, তুমি নাচে গিয়েছিলে কি না, কনসার্ট কেমন লাগল, থিয়েটারে একজন নূতন অ্যাকটর এসেছে, কাল অমুকু জায়গায় ব্যাণ্ড হবে ইত্যাদি (রবীন্দ্র-রচনাবলী:১, ৫৪২)। এ-বৰ্ণনায় রয়েছে উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগের জন্যে গৌরবজনক নারীবিদ্বেষ, যখন নারীবিদ্বেষই ছিলো অনেকটা বুদ্ধিজীবিতার লক্ষণ। সতেরো-আঠারো বছরের তুলনায় একটু বেশি পাকাই ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তবে তিনি ধ’রে নিয়েছিলেন যে নারীমাত্রই লঘু, যারা বেশভূষা, নাচ, অ্যাকটর প্রভৃতির ওপরে উঠতে পারে না। ভিক্টোরীয় সমাজ যে নারীদের তৈরি করেছে ওভাবেই, সেটা তার চোখে পড়ে নি। ওই নারীদের প্রাত্যহিক জীবন কর্মহীন প্রমোদের : ‘এ দেশের মেয়েরা পিয়ানো বাজায়, গান গায়, আগুনের ধারে আগুন পোহায়, সোফায় ঠেসান দিয়ে নভেল পড়ে, ভিজিটরদের সঙ্গে আলাপচারি করে ও আবশ্যক বা অনাবশ্যক মতে যুবকদের সঙ্গে ফ্লার্ট করে’ (রর : ১, ৫৪২)। রবীন্দ্ৰনাথ ‘এ দেশের মেয়ে’ যাদের বলেছেন, তারা উচ্চবিত্ত অপদাৰ্থ নারী, সাধারণ নারীদের সাথে তাদের কোনো মিল নেই। এ-অকর্মী নারীদের তিনি সমালোচনা করেছেন, এমনকি যে-মেয়েরা বিয়ে না করে কিছু একটা করছে, তাদের কাজেরও বিদ্রুপ করেছেন : ‘এ দেশের চির-আইবুড়ো মেয়েরা কাজের লোক। টেমপারেন্স মীটিং, ওয়ার্কি মেনস সোসাইটি প্রভৃতি যতপ্রকার অনুষ্ঠানের কোলাহল আছে, সমুদয়ের মধ্যে তাদের কণ্ঠ আছে’ (রর : ১. ৫৪২)। ওই উচ্চবিত্ত নারীরা ওই সব ছাড়া আর কী করতে পারে, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি অবশ্য বিপদে পড়তেন; এবং ওই সব ছাড়া তারা অন্য কিছু করলেও তিনি হয়তো তাদের সমালোচনা করতেন। তিনি ক্রমশ ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন পিয়ানোবাজানো মেয়েদের সাথে, দেখেছেন ‘এক-একটা মেয়ের নাচের বিরাম নেই, দু-তিন ঘণ্টা ধরে ক্রমাগত তার পা চলছে’ , সুখ পেয়েছেন ‘শত রমণীর রূপের আলোকে গ্যাসের আলো ম্রিয়মাণ’ (রর : ১, ৫৪৪-৫৪৫) দেখে। তখনি তার মনে পড়েছে ‘আমাদের দেশের স্ত্রীলোকদের সঙ্গে মুক্তভাবে মিশতে পাই নে’ (রর : ১, ৫৫৫)। নারীদের সাথে মুক্তভাবে মিশতে পাওয়াটা তার নিজের জন্যে, নারীর জন্যে নয়; নারীর সাথে মুক্তভাবে মিশতে পাওয়ার বেশি স্বাধীনতা তিনি নারীর জন্যে চান না।

ভিক্টোরীয় সমাজে মেয়েদের জীবনের লক্ষ্য যে বিয়ে, সেখানে পুরুষই যে সর্বময়, ওই সমাজের সাথে বাঙালি সমাজের পার্থক্য যে গুণের নয় মাত্রার তা চোখে পড়েছে। তাঁর (রর : ১, ৫৭০) :

‘আমাদের দেশে যেমন ছেলেবেলা থেকে মেয়েদের বিয়ের জন্যে প্রস্তুত করে, যথেষ্ট লেখাপড়া শেখায় না, কেননা মেয়েদের আপিসে যেতে হবে না; এখানেও তেমনি মাগ্‌গি দরে বিকোবার জন্যে মেয়েদের পালিশ করতে থাকে, বিয়ের জন্যে যতটুকু লেখাপড়া দরকার ততটুকু যথেষ্ট। একটু গান গাওয়া, একটু পিয়ানো বাজানো, ভালো করে নাচা, খানিকটা ফরাশি ভাষা বিকৃত উচ্চারণ, একটু বোনা ও সেলাই করা জানলে একটি মেয়েকে বিয়ের দোকানের জানলায় সাজিয়ে রাখবার উপযুক্ত রঙচঙে পুতুল গড়ে তোলা যায়। এ-বিষয়ে একটা দিশি পুতুল ও একটা বিলিতি পুতুলের যতটুকু তফাত, আমাদের ও এ-দেশের মেয়েদের মধ্যে ততটুকু তফাত মাত্র।…আমাদের দিশি মেয়েদের পিয়ানো ও অন্যান্য টুকিটাকি শেখাবার দরকার করে না, বিলিতি মেয়েদেরও অল্পসল্প লেখাপড়া শিখতে হয়, কিন্তু দুই-ই দোকানে বিক্রি হবার জন্যে তৈরি। এখানেও পুরুষেরাই হৰ্তাকর্তা, স্ত্রীরা তাদের অনুগতা; স্ত্রীকে আদেশ করা, স্ত্রীর মনে লাগাম লাগিয়ে নিজের ইচ্ছেমত চালিয়ে বেড়ানো স্বামীরা ঈশ্বর নির্দিষ্ট অধিকার মনে করেন।‘

তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য সমাজ ও নারী দু-ই, তবে মেয়েদের ওপরই আক্রমণটা একটু বেশি; তিনি মনে করেছেন যেনো মেয়েরা নিজেরাই পুতুল হওয়ার জন্যে পাগল। অন্য ধরনের নারীও তিনি দেখেছেন ওই সমাজে; ফ্যাশনী মেয়ে ছাড়া বিলেতে আরো অনেকরকম মেয়ে আছে, নইলে সংসার চলত না। মধ্যবিত্ত গৃহস্থ মেয়েদের অনেকটা মেহনত করতে হয়, বাবুয়ানা করলে চলে না।…এখানকার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গিন্নিরা সাদাসিদে। যদিও তারা ভালো করে লেখাপড়া শেখেন নি, তবু তারা অনেক বিষয় জানেন, এবং তাদের বুদ্ধি যথেষ্ট পরিষ্কার’ (রর : ১, ৫৭০-৫৭১)। তিনি কিছুটা শ্ৰদ্ধাশীল সে-নারীদের প্রতি, যারা ফ্যাশনমত্ত নয়, যারা কমী, মধ্যবিত্ত, যারা আছে ব’লে ‘সংসার চলে’। তবে ওই ফ্যাশনমত্তরাই কিছুদিনের জন্যে তাঁকে ক’রে তুলেছিলো সীমিত নারীস্বাধীনতাবাদী, কেননা ওই স্বাধীনতাটুকু ছাড়া মেয়েদের নাচের আসরে পাওয়া অসম্ভব। মেয়েরা অবাধে নাচের আসরে আসতে না পারলে মেয়েদের থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার মতো তরুণেরা, যারা গালে গাল ঘষে নাচতে চায়। য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্রে তিনি নারীস্বাধীনতার অর্থাৎ নারীপুরুষের মেলামেশার পক্ষে কিছু মত প্রকাশ করেছিলেন, বাঙালি নারীকে ঘরে আটকে রাখার অপরাধে অভিযুক্ত করেছিলেন পুরুষদের। বলেছিলেন, ‘একজন বুদ্ধি ও হৃদয়বিশিষ্ট মানুষকে জন্তুর মতো, এমন কি তার চেয়ে অধম, একটা জড়পদার্থের মতো সম্পূর্ণরূপে নিজের প্রয়োজনের জিনিষ করে তোলা… এ-সকল যদি পাপ না হয় তবে নরহত্যা করাও পাপ নয়’ [য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র থেকে বর্জিত, উদ্ধৃত অনন্যা (১৩৯৪, ২০)]। এমন কয়েকটি স্ত্রীস্বাধীনতাবাদী অংশ বইটি থেকে বর্জনের সাথে সাথে রবীন্দ্ৰনাথ বর্জন করেছিলেন স্ত্রীস্বাধীনতার ধারণাটিও। রবীন্দ্ৰনাথের ওই স্ত্রীস্বাধীনতায় বিশ্বাস ছিলো বিলেতি তরুণীদের সাথে মেশার ফলে তরুণ রক্তমাংসের ভেতর থেকে বেরোনো অস্থায়ী উচ্ছাস, যা মিলিয়ে যেতে বেশি সময় লাগে নি। বাঙালি নারীকে অন্তঃপুর থেকে মুক্তি দেয়া সম্পর্কে যে-কয়েক পংক্তি লিখেছিলেন তিনি আঠারো-উনিশ বছর বয়সে, প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় তা বই থেকে মুছে ফেলে তারুণ্যের অশিষ্ট উচ্ছ্বাসের প্রায়শ্চিত্ত করতে তিনি দ্বিধা করেন নি।

এর পর দু-বছরের মধ্যেই রবীন্দ্ৰনাথ নিজে হন স্বামী (৯ ডিসেম্বর ১৮৮৩), এবং এক দশক কাটার আগেই হয়ে ওঠেন নারীমুক্তিবিরোধী, সম্ভবত তখন তার তরুণীদের সাথে মেলামেশার প্রয়োজন ফুরিয়েছে বলে। পাঁচ-ছ বছরের মধ্যে তিনি আয়ত্ত করে ফেলেন নারী সম্পর্কে ভিক্টোরীয় ও ভারতীয় দর্শন : প্ৰবক্তা হয়ে ওঠেন ‘ঘরেবাইরেতত্ত্বের’, ‘প্রকৃতিতত্ত্বের’, ‘নারীপুরুষের অসাম্যতত্ত্বের’, ‘পরিপূরকতত্ত্বের’ এবং আপন ক’রে নেন পুরুষতন্ত্রের সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলতা। এর পরিচয় প্রথম ধরা পড়ে ‘রমাবাইয়ের বক্তৃতা উপলক্ষে’ (১২৯৬, রব : ১২, ৪৫০-৪৫৫) নামের পত্রপ্রবন্ধে। মহারাষ্ট্র নারীবাদী রমাবাই নারীমুক্তি সম্পর্কে একটি বক্তৃতা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন পুনায় (জ্যৈষ্ঠ ১২৯৬), তবে শেষ করতে পারেন নি বক্তৃতাটি; পুরুষাধিপত্যবাদীদের প্রচণ্ড উৎপাতে তিনি স্থগিত করতে বাধ্য হন তাঁর বক্তৃতা। আটাশ বছর বয়স্ক রবীন্দ্রনাথ নিজে কোনো উৎপাত করেন নি, তবে ওই বক্তৃতা সম্পর্কে তিনি যে-মত দিয়েছেন তাতে তাঁর পুরুষাধিপত্যবাদিতা প্ৰকাশ পেয়েছে প্রবলভাবে। তিনি রুশো-রাসকিন, ভিক্টোরীয় ও সমগ্র পুরুষতন্ত্রের মতো বিশ্বাস করেন যে নারীপুরুষ সমকক্ষ নয়, নারী প্রাকৃতিকভাবেই পুরুষের থেকে নিকৃষ্ট। একজন চমৎকার ভিক্টোরীয় হিশেবে তিনি নারীদের মধ্যে দেখেছেন শুধু রূপ আর আবেগ, দেখেছেন নারীদের শক্তিহীনতা, প্রতিভাহীনতা, আর এ-সবই তাঁর মতে প্রাকৃতিক। তিনি বলেন, ‘মেয়েরা সকল বিষয়েই যদি পুরুষের সমকক্ষ, তাহলে পুরুষের প্রতি বিধাতার নিতান্ত অন্যায় অবিচার বলতে হয়।’ তার চোখে নারীপুরুষের অসাম্যই ন্যায়সঙ্গত, আর সাম্য অন্যায়; প্রকৃতি বা বিধাতা এমন অন্যায় করতে পারে না। ভিক্টোরীয়দের মতো তিনি নারীপুরুষকে প্রাকৃতিকভাবেই দুটি বিপরীত ও পরিপূরক জাতির সদস্য ব’লে মনে করেন :

‘আমরা যেমন বলে শ্ৰেষ্ঠ, মেয়েবা তেমনই রূপে শ্রেষ্ঠ; অন্তঃকরণের বিষয়ে আমরা যেমন বুদ্ধিতে শ্ৰেষ্ঠ, মেয়েরা তেমনই হৃদয়ে শ্ৰেষ্ঠ; তাই স্ত্রী পুরুষ দুই জাতি পরস্পর পরস্পরকে অবলম্বন করতে পারছে। স্ত্রীলোকের বুদ্ধি পুরুষের চেয়ে অপেক্ষাকৃত অল্প বলে…স্ত্রীশিক্ষা অত্যাবশ্যক এটা প্রমাণ করবার সময় স্ত্রীলোকোব বুদ্ধি পুরুষের ঠিক সমান এ কথা গায়েব জোরে তোলাবার কোনো দরকার নেই।‘

রুশো-রাসকিন-টেনিসন ও সমগ্র পুরুষতন্ত্র এখানে কথা বলছে রবীন্দ্রনাথের মুখে। তাঁর কিছু বিশ্বাস বেশ ভয়ঙ্কর, যেমন বিশ্বাস করেন তিনি প্রাকৃতিক ও সামাজিক অসাম্যে। তিনি বিশ্বাস করেন পরস্পরকে অবলম্বন করতে হ’লে সমান হ’লে চলে না, হতে হয় অসম; এটা শুধু পারিবারিকভাবেই ভয়ঙ্কর তত্ত্ব নয়, সামাজিকভাবেও ভয়ঙ্কর। পুরুষের বুদ্ধিতে শ্রেষ্ঠতা সম্পর্কে তিনি এতো নিশ্চিত যে সে-সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন তুললে তিনি রুষ্ট হন। তিনি বিশ্বাস করেন একটি বানানো উপকথায় যে নারী বুদ্ধিতে পুরুষের থেকে নিকৃষ্ট: এবং ঘোষণা করেন ‘মেয়েরা কখনোই পুরুষদের সঙ্গে (কেবল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে) বুদ্ধিতে সমকক্ষ হবে না।’ পুরুষাধিপত্যবাদীরা বারবার যুক্তি দেয় নারীর প্রতিভা নেই, পৃথিবীতে কোনো বড়ো নারীপ্রতিভা জন্মে নি, মিল যা খণ্ডন করেছেন নারী-অধীনতায় (১৮৬৯); কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ১৮৮৯-এ পেশ করেছেন পুরুষাধিপত্যবাদীদের পুরোনো যুক্তি আর উদাহরণ :

‘মেয়েব এতদিন যেরকম শিক্ষা পেয়েছে তাই যথেষ্ট ছিল …শ্ৰীজাতির মধ্যে প্রথম শ্রেণীর কবির আবির্ভাব এখনো হয় নি। মনে ক’রে দেখো, বহুদিন থেকে যত বেশি মেয়ে সংগীতবিদ্যা শিখছে এত পুরুষ শেখে নি। য়ুরোপে অনেক মেয়েই সকাল থেকে রাত্তির পর্যন্ত পিয়ানো ঠং ঠাং এবং ডোরেমিফা চেঁচিয়ে মরছে, কিন্তু তাদের মধ্যে ক’টা, Mozart কিংবা Beethoven জন্মাল।‘

পুরুষতন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছেন ব’লেই তিনি বলতে পেরেছেন মেয়ের যে-শিক্ষা পেয়েছে, তাই যথেষ্ট। মেয়েদের যে-শিক্ষা দেয়া হয়েছে এতোদিন, তা কোনো শিক্ষাই নয়; তা পুরোপুরি অশিক্ষা। ওই অশিক্ষার মধ্যে থেকে যে কারো পক্ষে ভিঞ্চি, দান্তে বা বিটোফেন হওয়া সম্ভব নয়, তা রবীন্দ্রনাথ, একজন প্রবল পুরুষাধিপত্যবাদী, মানেন নি; এও তাঁর মনে পড়ে নি যে পৃথিবীতে মোৎসার্ট-বিটোফেন দুটির বেশি জন্মে নি—পুরুষমাত্ৰই একেকটি সম্ভাব্য মোৎসার্ট বা নিউটন বা রবীন্দ্রনাথ নয়; এবং রুশোর মতো বলেছেন, ‘প্ৰতিভা একটা শক্তি (ঋভণবথহ), তাতে অনেক বল আবশ্যক, তাতে শরীর ক্ষয় করে। তাই মেয়েদের একরকম গ্ৰহণশক্তি ধারণাশক্তি আছে, কিন্তু সৃজনশক্তির বল নেই’, বা ‘মেয়েদের একরকম চটপটে বুদ্ধি আছে, কিন্তু সাধারণত পুরুষদের মতো বলিষ্ঠ বুদ্ধি নেই।’ উগ্র পুরুষাধিপত্যবাদী রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করেছেন, ‘মেয়েরা হাজার পড়াশুনো করুক, এই কার্যক্ষেত্রে কখনোই পুরুষদের সঙ্গে সমানভাবে নাবতে পারবে না।’ মেয়েদের পড়াশুনোয় তাঁর বিশেষ আপত্তি নেই, বা তিনি মনে করেন মেয়েদের পড়াশুনো বিশেষ কাজে লাগে না; তবে তার আপত্তি ‘কার্যক্ষেত্ৰ’ দখলে। পুরুষ যে-সমস্ত পেশা দখল ক’রে রেখেছে, সেগুলোতে নারী ঢুকুক তা তিনি চান না; নারী যদি নিষেধ না শুনে সেখানে ঢুকে পড়ে তাহলে তিনি চান তার ব্যর্থতা।

নারীপুরুষের অসাম্যকে শাশ্বত করার জন্যে এর পর তিনি সাহায্য নিয়েছেন। রুশো-রাসকিন ও ভিক্টোরীয়দের প্রকৃতিতত্ত্বে। সুবিধা ও আধিপত্যবাদীরা, এবং পুরুষতন্ত্র প্রকৃতিকে চিরকাল ব্যবহার করেছে নিজেদের স্বার্থে। রবীন্দ্রনাথও নারীদের ঘরে আটকে রাখার জন্যে দোহাই দিয়েছেন প্রকৃতির, যদিও প্রকৃতি নয় সমাজের চক্রান্তেই নারীরা বন্দী হয়ে আছে ঘরে। প্রকৃতির কণ্ঠস্বর শুনে তিনি তা বাঙলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন এভাবে :

‘যেমন করেই দেখ প্রকৃতি বলে দিচ্ছে যে, বাহিরের কাজ মেয়েরা করতে পারবে না। যদি প্রকৃতির সে-রকম অভিপ্ৰায় না হত তা হলে মেয়েরা বলিষ্ঠ হয়ে জন্মাত। যদি বল, পুরুষদের অত্যাচারে মেয়েদের এই দুর্বল অবস্থা হয়েছে, সে কোনো কাজেরই কথা নয়।‘

প্রকৃতির স্বর শোনা প্রথাবাদীদের স্বভাব, কেননা তাতে যুক্তি ও সত্যের বদলে উপস্থিত করা যায় অলৌকিক শক্তিকে, এবং সব কিছু চাপিয়ে দেয়া যায় শোষিতদের ওপর। প্রকৃতি স্থির ক’রে দিয়েছে যে মানুষ স্বামীস্ত্রী হবে, সংসার করবে, সমাজ বানাবে, রাষ্ট্র তৈরি করবে, একদল শোষণ করবে। আরেকদল শোষিত হবে, এটা খুবই হাস্যকর ও সুবিধাবাদী বিশ্বাস; রবীন্দ্রনাথ প্রথা-ও সুবিধা-বাদীদের মতো দোহাই দিয়েছেন প্রকৃতিরই। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করেন নারীদের থাকতে হবে ঘরে, আর জীবনধারণের জন্যে নির্ভর করতে হবে পুরুষের ওপর : ‘যখন শারীরিক দুর্বলতা এবং অলঙঘনীয় অবস্থাভেদে মেয়েদের সেই গৃহের মধ্যে থাকতেই হবে তখন কাজে- কাজেই প্রাণধারণের জন্যে পুরুষদের প্রতি তাদের নির্ভর করতেই হবে।’ মেয়েরা যে ঘরের ভেতরে থাকে, এটাও এক উপকথা। সুবিধাভোগী শ্রেণীর নারীরাই ঘরে বন্দী থাকে, পুরুষকে সেবা ও দেহ দিয়ে ব্যবস্থা করে নিজেদের জীবিকার; কিন্তু অধিকাংশ নারী কাজ করে ঘরে ও বাইরে, যদিও তাদের বাইরের কাজ স্বীকৃতি পায় না, আর মূল্য পায় না ঘরের কাজ। রবীন্দ্রনাথ চিন্তিত উচ্চবর্ণের নারীদের সম্পর্কেই, এবং প্রকৃতির দোহাই দিযে তাদেরই আটকে রাখতে চান ঘরে। নিম্নশ্রেণীর নারীরা নরকে যাক, সেটা তাঁর ভাবনার ব্যাপার নয়। নারীর দুরবস্থা যে পুরুষতন্ত্রেরই চক্রান্তের ফল, একথার প্রতিবাদ করেছেন তিনি সমস্ত পুরুষতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়ে।

রবীন্দ্রনাথ নারীমুক্তির আন্দোলনের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখিয়ে তাকে বলেছেন ‘কোলাহল’, এবং নারী-অধীনতাকে সমর্থন করতে গিয়ে বলেছেন এমন কথা, যা শুধু নারীমুক্তির বিরুদ্ধেই যায় না, যায় মানুষের সব রকমের মুক্তির বিরুদ্ধেই :

‘আজকাল পুরুষাশ্রয়ের বিরুদ্ধে যে একটা কোলাহল উঠেছে, সেটা আমার অসংগত এবং অমঙ্গলজনক মনে হয়। পূর্বকালে মেয়েরা পুরুষের অধীনতাগ্রহণকে একটা ধর্ম মনে করত; তাতে এই হত যে, চরিত্রের ওপর অধীনতার কুফল ফলতে পারত না, অর্থাৎ হীনতা জন্মাত না, এমন-কি অধীনতাতেই চরিত্রের মহত্ত্ব সম্পাদন করত। প্ৰভুভক্তিকে যদি ধর্ম মনে করে তা হলে ভূত্যের মনে মনুষ্যত্বের হানি হয় না।‘

এর অর্থ হচ্ছে অধীনতা মেনে নেয়াই মহত্ত্ব ও মনুষ্যত্ব; অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্ৰতিবাদ বা বিদ্রোহ অন্যায়। এ-ধরনের বিশ্বাস অত্যন্ত ভয়ঙ্কর; এমন প্রতিক্রিয়াশীলতার উদ্দেশ্য সব রকমের শোষণকে তরল আধ্যাত্মিকতা দিয়ে গ্রহণযোগ্য ক’রে তোলা। নারী আন্দোলন তাঁর কাছে অমঙ্গলজনক, তা হ’তে পারে; কিন্তু তা মঙ্গলজনক নারীদের ও অধিকাংশ মানুষের জন্যে, যারা বিশ্বাস করে সাম্যে। নারী-আন্দোলন অসংগত হবে কেনো? তার বিশ্বাস পরাধীন থাকাই সঙ্গত; এ-ধরনের বিশ্বাসের সীমা বাড়িয়ে দিলে দাঁড়ায় যে রাজনীতিক স্বাধীনতা চাওয়াও অসঙ্গত, যা সব সময়ই বলে সাম্রাজ্যবাদীরা। ‘পূর্বকালে মেয়েরা পুরুষের অধীনতাগ্রহণকে একটা ধর্ম মনে করত’ বলে যে-সত্যে তিনি বিশ্বাস করেন, তাও সত্য নয়। মেয়েরা পুরুষাধীনতাকে ধর্ম মনে করতো না, পুরুষেরাই ওটাকে ধর্ম বলে চাপিয়ে দিয়েছিলো নারীদের ওপর, যেমন বৰ্ণভেদকেও ধর্ম বলে চাপিয়ে দিয়েছে শক্তিমানেরা। প্রতিক্রিয়াশীলতার পক্ষে খুব বিশ্ৰী যুক্তি দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ : তাঁর মতে অধীনতা মেনে নিলে চরিত্রের মহত্ত্ব সম্পাদিত হয়! এর অর্থ হচ্ছে খাঁটি দাসের চরিত্রই মহত্ত্বসম্পন্ন, বিদ্রোহী দাসেরা মহত্ত্বহীন। ভৃত্যের চরিত্রের মহত্ত্ব রক্ষার উপায় হচ্ছে জন্মজন্মান্তর ধ’রে ভূত্য থাকা! রবীন্দ্রনাথ, যাকে মনে করা হয় নিজের সময়ের থেকে অনেক অগ্রসর, পিছিয়ে ছিলেন নিজের সময়ের থেকে হাজার বছর।

রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস কিছু মানুষ জন্মে প্ৰভু হয়ে, আর কিছু মানুষ জন্মে দাস হয়ে; তাই তিনি মনে করেন, ‘কতকগুলি অবশ্যম্ভাবী অধীনতা মানুষকে সহ্য করতেই হয়।’ নারীর পুরুষাধীনতা, তার মতে, অবশ্যম্ভাবী, নারীকে তা সহ্য করতেই হবে; শুধু তা-ই নয়, পুরুষাধীনতাই নারীর জন্যে ধর্ম। পুরুষতন্ত্রের অবিচল অনুসারী। রবীন্দ্রনাথ স্বামীকে দেখেন নারীর দেবতারূপে, যাকে ভক্তি করা নারীর জন্যে ধর্ম। রবীন্দ্রনাথের চোখে পরিবার, সামাজিক সংস্থা নয়, দেবমন্দির, যার অধিষ্ঠিত দেবতার নাম স্বামী; স্ত্রী তার, জন্মজন্মান্তরের, ভক্ত :

‘পতিভক্তি বাস্তবিকই স্ত্রীলোকের পক্ষে ধর্ম। আজকাল একরকম নিষ্ফল ঔদ্ধত্য ও অগভীর ভ্ৰান্ত শিক্ষার ফলে সেটা চলে গিয়ে সংসারের সামঞ্জস্য নষ্ট করে দিচ্ছে এবং স্ত্রী পুরুষ উভয়েরই আন্তরিক অসুখ জন্মিয়ে দিচ্ছে। কর্তব্যের অনুরোধে যে-স্ত্রী স্বামীর প্রতি একান্ত নির্ভর করে সে তো স্বামীর অধীন নয়, সে কর্তব্যের অধীন।‘

ধর্ম যে বড়ো প্রতারণা ও পুরুষতন্ত্রের বলপ্রয়োগসংস্থা, তা মনে জাগার কথা নয় প্রথা ও পুরুষাধিপত্যবাদী রবীন্দ্রনাথের; তিনি বরং দাসত্বকেই মহিমান্বিত করেছেন ধর্মরূপে। স্বামীস্ত্রী মিলে গ’ড়ে তোলে একটি সামাজিক সংস্থা-পরিবার, তাতে ভক্তির কথা ওঠে না; তবে পুরুষ নারীকে দাসী ক’রেই স্বস্তি পায় নি, নিজেকে দেবতার স্তরে উঠিয়ে স্ত্রীর আনুগত্যকে ক’রে তুলেছে ঐশ্বরিক। শুধু আনুগত্যে নিশ্চিন্ত বোধ করেন না রবীন্দ্রনাথ, তিনি চান নিশ্চিত ভক্তি, কেননা ভক্তি হচ্ছে আত্মসমর্পণের বা সত্তাবিলোপের চূড়ান্তরূপ। ‘পতিভক্তি’র মতো একটি মধ্যযুগীয় ধারণা ও শব্দ যে তিনি ব্যবহার করেছেন, তা আমাদের খুব বিস্মিত করে। স্বামীর অধীনতাকে তিনি বিধিবদ্ধ করতে চেয়েছেন আধ্যাত্মিক ও ইহজাগতিক দু-রকম যুক্তি দিয়েই : স্বামীর অধীনে থাকা নারীর জন্যে একদিকে আধ্যাত্মিক ধর্ম, আরেক দিকে ইহজাগতিক কর্তব্য! দু-ধরনের শিকলেই নারীকে বেঁধেছেন তিনি। মনে রাখা দরকার যে এ-রবীন্দ্রনাথ আশি বছর বয়স্ক বৃদ্ধ নন, ঐর বয়স উনত্রিশ! সংসারের সামঞ্জস্য নষ্ট হওয়ার জন্যে তিনি দোষী করেছেন। আজকালকার ‘একরকম নিম্বফল ঔদ্ধত্য ও অগভীর ভ্রান্ত শিক্ষা’কে। রবীন্দ্ৰনাথ যাকে ‘নিস্ফল ঔদ্ধত্য’ বলেছেন, তা ঔদ্ধত্য নয়, অধিকার দাবি, এবং গত একশো বছরে প্রমাণিত হয়েছে যে তা নিস্ফল নয়, বেশ সফল। তিনি যাকে ‘অগভীর ভ্রান্ত শিক্ষা’ বলেছেন, তাও অগভীর নয়, ভ্রান্ত তো নয়ই, তা-ই প্রকৃত শিক্ষা; আর রবীন্দ্রনাথ নারীর জন্যে যে-শিক্ষার কথা ভেবেছেন, তার গভীরতা- অগভীরতার কথাই ওঠে না, কেননা তা আসলে কোনো শিক্ষাই নয়।

স্বামীকে যিনি মনে করেন নারীর দেবতা, তিনি যে অবধারিতভাবে হবেন নারীমুক্তির বিরোধী, এটা আগে থেকেই ধ’রে নিতে পারি; আর রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাই। তিনি নারীমুক্তির বিরোধী হয়ে ওঠেন বিলেত থেকে ফেরার পরপরই; তাই তিনি মেনে নিতে পারেন নি নারীমুক্তি-আন্দোলনকারীদের। নারীদের আধুনিক শিক্ষা দেয়ারও তিনি ছিলেন বিরুদ্ধে। রবীন্দ্ৰনাথ জীবনে নানা ধরনের প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করেছেন, তারা সবাই যে তাঁর সত্যিকার প্রতিপক্ষ ছিলো, এমন নয়; অনেক সময় তিনি নিজেই ছিলেন প্রতিপক্ষ। প্রতিপক্ষের সাথে রবীন্দ্রনাথের লড়াইয়ের রীতি হচ্ছে তিনি প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করেন, তারপর উপহাস আর ব্যঙ্গ করেন। যদিও নারীমুক্তি-আন্দোলনকারীরা তার সাথে কোনো লড়াইয়ে লিপ্ত হন নি, তবুও তিনিই এগিয়ে গিয়ে লড়াইয়ে নামেন তাদের সাথে; এবং উপচে পড়ে তাঁর উগ্র পুরুষতান্ত্রিক ঘেন্না :

‘আজকাল একদল মেয়ে ক্রমাগতই নাকী সুরে বলছে, আমরা পুরুষের অধীন, আমরা পুরুষেব আশ্রয়ে আছি, আমাদের অবস্থা অতি শোচনীয়। তাতে করে কেবল এই হচ্ছে যে, স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধবন্ধন হীনতা প্রাপ্ত হচ্ছে; অথচ সে-বন্ধন ছেদন করবার কোনো উপায় নেই।‘

তাঁর অবজ্ঞা আর ঘেন্না দেখে মনে হয় তিনি কোনো আসন্ন বিপর্যয়ের মুখে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছেন শেষ খড়কুটো। তাঁর সংবেদনশীলতার অভাবও শোচনীয়; নারীমুক্তির দাবি তাঁর কাছে উপহাসের ব্যাপার- ‘নাকী সুরে’ বিলাপ। মনে হচ্ছে আদি-মধ্য-আধুনিক সমস্ত পুরুষতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি ঠেকাবেন নারীমুক্তি। তিনি ধ’রে নিয়েছেন নারীদের মুক্তি কখনো ঘটবে না, বা নারীদের মুক্তি ঘটা অনুচিত ও ক্ষতিকর। তিনি যাকে বলেছেন ‘স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধবন্ধন’, তা প্ৰভু ও এক বা একাধিক দাসীর বন্ধন, যাতে বাঁধা নারী। তিনি ওই বন্ধনের হীনতাপ্ৰাপ্তির ভয়ে উদ্বিগ্ন, যদিও সত্য হচ্ছে আন্তরিকভাবে ওই বন্ধন কখনোই উন্নত ছিলো না। নারীমুক্তির ব্যাপারটিকে ভুলও বুঝেছেন রবীন্দ্রনাথ; তিনি মনে করেছেন নারীমুক্তির অর্থ হচ্ছে নারীরা বিয়ে করবে না। এমন একটা ভয় অবশ্য ছিলো ভিক্টোরীয়দের মনে; তারা মনে করতো নারী যদি মুক্তি পায়, পুরুষের পেশা অধিকার করে, সমান হয়ে ওঠে পুরুষের, তবে তারা বিয়ে করতেই অস্বীকার করবে। এটাও নারী সম্পর্কে পুরুষের ভুল ধারণার ফল : পুরুষ নিজের কামকেই প্রধান ক’রে দেখে দমিয়ে রেখেছে নারীর কাম, মনে করেছে কাম নারীর জন্যে খুবই গৌণ ব্যাপার, ওটা না হ’লেও চলে নারীর। তাই নারী যদি স্বায়ত্তশাসিত হয়, তবে নারীর বিয়ের কোনো দরকার পড়বে না; তখন পুরুষ তার মহৎ কামের অগ্নিতে জ্বলবে একলা। নারী মুক্তি চেয়েছে পুরুষের অধীনতা থেকে, বিয়ে থেকে নয়; তবে বিয়ে যে করতেই হবে, মাংসকে সুখী করার জন্যে বিয়েই যে বিকল্পহীন উপায়, তাও নয়। বিয়ে একটি প্রথা।

তিনি ভিক্টোরীয়দের মতো প্রকৃতির দোহাই দেন বারবার, ঘোষণা করেন প্রকৃতির বিধান বা নারীর নিয়তি হচ্ছে পুরুষাধীনতা :

‘নানা দিক থেকে দেখা যাচ্ছে, সংসারের কল্যাণ অব্যাহত রেখে স্ত্রীলোক কখনো পুরুষের আশ্রয় ত্যাগ করতে পারে না। প্রকৃতি এই স্ত্রীলোকের অধীনতা কেবল তাদের ধর্মবুদ্ধির উপরে রেখে দিয়েছেন তা নয়, নানা উপায়ে এমনই আটঘটি বেঁধে দিয়েছেন যে, সহজে তার থেকে নিস্কৃতি নেই। অবশ্য পৃথিবীতে এমন অনেক মেয়ে আছে পুরুষের আশ্রয় যাদের আবশ্যক করে না, কিন্তু তাদের জন্যে সমস্ত মেয়ে-সাধাবণের ক্ষতি করা যায় না।‘

নারীকে পুরুষের অধীনে থাকতে হবে ‘সংসারের কল্যাণ অব্যাহত’ রাখার জন্যে, ও নারীর বিবেকের আদেশে; তবে নির্বোধ নারী সংসার কল্যাণেব কথা প্রাজ্ঞ পুরুষের মতো অতোটা ভাবতে নাও পারে, আর বিবেক বা ‘ধর্মবুদ্ধি’ নাও থাকতে পারে তার; তাই রাবীন্দ্রিক প্রকৃতি আগে থেকেই নিয়েছে উপযুক্ত ব্যবস্থা;–পুরুষের অধীনে রাখার জন্যে প্রাকৃতিক শেকলে বেঁধে নারীকে পাঠিয়েছে পুরুষের কারাগারে! প্রকৃতি পুরুষের ধর্মবুদ্ধির ওপর আস্থাশীল, তাই আটঘটি বেঁধে পুরুষকে পাঠায় নি; কিন্তু প্রকৃতি নারীকে বিশ্বাস করে না, প্রকৃতির আস্থা নেই নারীর ধর্মবুদ্ধিতে, তাই নারীকে করেছে দুর্বল, তাকে দিয়েছে প্রতি মাসের বিশ্ৰী ব্যাপার, দিয়েছে নিজের ভেতরে মানুষ জন্মানোর শাস্তি! তাই উদ্ধার নেই নারীর, তাকে মেনে নিতেই হবে পুরুষের অধীনতা! নারীকে থাকতে হবে পুরুষের আশ্রয়ে; রবীন্দ্রনাথের মতে নারীর জন্যে এটাই লাভজনক, মুক্তি নারীর জন্যে ক্ষতিকর। প্ৰগতিবিরোধী হিন্দু ও ভিক্টোরীয় মানসিকতার মিশ্ররূপ মূর্ত দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথের মধ্যে। তিনি অবশ্য বলেছেন যে তার মতের সাথে স্ত্রীশিক্ষা ও স্ত্রীস্বাধীনতার কোনো বিরোধ নেই; তবে বিরোধ রয়েছে প্ৰচণ্ড, কেননা তিনি ‘স্ত্রীশিক্ষা ও স্ত্রীস্বাধীনতা’ বলতে যা বোঝেন, তা শিক্ষাও নয়, স্বাধীনতাও নয়।

রবীন্দ্ৰনাথ আটাশ-উনত্রিশ বছর বয়সে হয়ে ওঠেন চমৎকারভাবে প্ৰগতিবিরোধী। উনত্রিশ বছর বয়সে দ্বিতীয়বার বিলেতে যান তিনি, তবে তার প্রথম ও দ্বিতীয় বিলেত যাত্রার মধ্যে রয়েছে দু-মেরুর বৈপরীত্য : প্ৰথমবার তিনি গিয়েছিলেন ইউরোপের কাছে শিখতে, দ্বিতীয়বার যান ইউরোপকে শেখাতে, যদিও ইউরোপকে শেখানোর কাজটি করেন তিনি মনে মনে। নিজেকে তিনি গণ্য করেন এক তরুণ ভারতীয় গুরু ব’লে, যিনি ইউরোপ সম্পর্কে তৈরি ক’রে ফেলেছেন বা আহরণ করেছেন এমন এক ভুল দর্শন যে কর্ম-আবিষ্কার-উন্নতি মানুষকে অসুখী করে, আর ইউরোপ যেহেতু ওইসব করছে, তাই ইউরোপ খুব অসুখী! দ্বিতীয়বারের বিলেত যাত্রার বিবরণ লেখেন তিনি য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারিতে (১৮৯১), যার খসড়া অংশে প্রকাশ পায় ইউরোপ ও নারী সম্পর্কে তাঁর পুরোনো ভারতীয় বদ্ধ মানসিকতা। তিনি পরে তা বাদ দেন বই থেকে; তবে নারী সম্পর্কে তার ওই সময়ের মত মেলে ‘প্রাচ্য ও প্রতীচ্য” (১২৯৮, রব; ১২, ২৩৬-২৫০) প্রবন্ধে। তিনি বলেন, ‘য়ুরোপে সভ্যতা যত অগ্রসর হচ্ছে স্ত্রীলোক ততই অসুখী হচ্ছে’, যা শুনলে মনে হয় সুখ সম্বন্ধে সর্বজ্ঞ এক মহর্ষি বলছেন জীবনের সারকথা। এখানে অবশ্য কথা বলছেন রুশো, যার মতে সভ্যতা কৃত্রিম ব্যাপার, যা মানুষের সুখ নষ্ট করে। রবীন্দ্রনাথ একে একটু সংশোধন ক’রে প্রয়োগ করেন ইউরোপি নারীর ক্ষেত্রে। তার উক্তি পুরোপুরি ভুল ধারণার ফল : ‘সুখ’ ব্যাপারটিই বিভ্রান্তিকর, কেননা তা একান্তভাবেই ব্যক্তিগত; আর সভ্যতার অগ্রসরতা নারীপুরুষ উভয়েরই জন্যে হয়েছে কল্যাণকর। তার কথার মধ্যে রয়েছে এক গোপন তুলনাও;– তিনি বলতে চান ভারতে সভ্যতা এগোচ্ছে না ব’লে ভারতীয় নারীরা খুব সুখে আছে!

রবীন্দ্রনাথ নারীকে পুরুষের অধীনে ও ঘরে আটকে রাখার জন্যে আধ্যাত্মিক, সামাজিক, নৈতিক কোনো অস্ত্রই অব্যবহৃত রাখেন নি; এবং শেষ অস্ত্রটি, আধুনিক কালে যার মহিমার শেষ নেই, সে-বৈজ্ঞানিক অস্ত্রটিও ব্যবহার করতে ভোলেন নি। তিনি নিউটনীয় সৌরলোকের দু-রকম শক্তির রূপ দেখেছেন নারীপুরুষের মধ্যে :

‘স্ত্রীলোক সমাজের কেন্দ্রানুগ (centrapetal ) শক্তি; সভ্যতার কেন্দ্রাতিগ শক্তি সমাজকে বহির্মুখে যে-পরিমাণে বিক্ষিপ্ত করে দিচ্ছে, কেন্দ্ৰানুগ শক্তি অন্তরের দিকে সে-পরিমাণে আকর্ষণ করে আনতে পারছে না।…স্ত্রীলোকের রাজত্ব ক্রমশ উজাড় হয়ে যারার উপক্রম হয়েছে।‘

‘কেন্দ্ৰানুগ : কেন্দ্রাতিগ’ পরিভাষা ব্যবহার ক’রে রবীন্দ্রনাথ যে-কথাটিকে বৈজ্ঞানিকভাবে আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করেছেন, তার সরল বাঙলা অনুবাদ হচ্ছে যে নারীর জগত ঘর, আর পুরুষের জগত বাইর। নিউটনীয় সৌরজগতের সাথে ভিক্টোরীয়দের মতো তিনি সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন পরিবারের, এবং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন নারীপুরুষের পৃথক জগত ও ভূমিকা। তবে এটা বিজ্ঞান নয়, অপবিজ্ঞান। সভ্যতার সংকটের জন্যে তিনি দায়ী করেছেন নারীকে; পুরুষ তার সাফল্যের জন্য বেরিয়ে পড়েছে বাইরে, শেষ নেই তার কর্ম-উত্তেজনার, কিন্তু নারী ঘরকে আকর্ষণীয় ক’রে তুলতে পারছে না বলে পুরুষ ঘরের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে না। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ছন্দ, দেখা দিচ্ছে সভ্যতার সংকট। এর জন্যে দায়ী নারী। পুরুষ তো বেরিয়ে পড়বেই, নারীর কাজ তাকে ঘরে ফিরিয়ে এনে সুখশান্তিতে ভ’রে দেয়া, কিন্তু নারী তা আর পারছে না। রাসকিনও নারীপুরুষকে দেখেছেন এভাবেই। রুশো, রাসকিন ও আরো অসংখ্য ভিক্টোরীয়র মতো রবীন্দ্রনাথ নারীকে দেখছেন ঘরের সম্রাজ্ঞীরূপে, তিনি চান নারী থাকুক সেখানেই; নারী ঘরে না থাকলেই নষ্ট হয় সমাজের সামঞ্জস্য। নারীপুরুষকে এমন কেন্দ্রানুগ : কেন্দ্রাতিগ, ঘর : বাইর ধরনের সম্পূর্ণ বিপরীত ভূমিকায় ও ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য একটিই; নারীকে পুরুষের অধীনে রাখা। নারী কেনো হবে কেন্দ্রানুগ, তার কেন্দ্রাতিগ হওয়ার কোনো বাধা নেই; পুরুষ কেনো হবে শুধু কেন্দ্রাতিগ, তার কেন্দ্রানুগ হওয়ার কোনো বাধা নেই। নারীপুরুষ একই সাথে হতে পারে ঘর ও বাইর, কেন্দ্রানুগ ও কেন্দ্রাতিগ; কিন্তু পুরুষতন্ত্র তা ভাবতে পারে না। প্রথা হিশেবে যা চ’লে এসেছে, তাকেই রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন পদার্থবিজ্ঞানের ধ্রুব সূত্ৰ!

রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমের নারীমুক্তির আন্দোলনকে মনে করেছেন সমাজের সামঞ্জস্যনাশের পরিণতি। যদি পশ্চিমি সভ্যতার কেন্দ্ৰানুগ-কেন্দ্রাতিগ শক্তি ঠিক মতো কাজ করতো, অর্থাৎ নারী থাকতো ঘরে আর পুরুষ বাইরে, তাহলে, তার বিশ্বাস, এমন নারীমুক্তির আন্দোলন দেখা দিতো না। ধ’রে নিতে পারি। যে তখন যেহেতু ভারতে ইউরোপীয় ধরনের নারীমুক্তির আন্দোলন দেখা দেয় নি, তাই ভারতীয় সমাজের সামঞ্জস্য ছিলো অটুট, বা ভারতীয় পুরুষেরা সমাজের সামঞ্জস্য রক্ষা করতো। সে-উপায়ে যেভাবে তারা পুনায় থামিয়ে দিয়েছিলো নারীমুক্তিবাদী রামাবাইর বক্তৃতা! নারীমুক্তির ব্যাপারটিকে সম্পূর্ণ ভুল বুঝে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :

‘য়ুরোপে স্ত্রীলোক পুরুষের সঙ্গে সমান অধিকারপ্রাপ্তির যে-চেষ্টা করছে সমাজের এই সামঞ্জস্যনাশই তার কারণ বলে বোধ হয়। নরোয়েদেশীয় প্ৰসিদ্ধ নাট্যকার ইবসেন-রচিত কতকগুলি সামাজিক নাটকে দেখা যায়, নাট্যোক্ত অনেক স্ত্রীলোক প্রচলিত সমাজবন্ধনের প্রতি একান্ত অসহিষ্ণুতা প্ৰকাশ করছে, অথচ পুরুষেরা সমাজপ্রথার অনুকূলে। এইবকম বিপরীত ব্যাপার পড়ে আমার মনে হল, বাস্তবিক, বর্তমান য়ুবোপীয় সমাজে স্ত্রীলোকের অবস্থাই নিতান্ত অসংগত।‘

রবীন্দ্রনাথ এখানে প্রস্তাব করেছেন এক ভয়ঙ্কর প্রগতিবিরোধী তত্ত্ব যে সমান অধিকার পাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে সমাজের সামঞ্জস্যনাশ। তার কাছে অসাম্য হচ্ছে সামাজিক সামঞ্জস্য, আর সাম্যের অধিকার দাবি হচ্ছে সমাজের সামঞ্জস্য নষ্ট করা। তাঁর তত্ত্বানুসারে দরিদ্র সাম্য দাবি করতে পারবে না ধনীর সাথে, শোষিত সাম্য দাবি করতে পারবে না শোষকের সাথে, নারীও সাম্য দাবি করতে পারবে না পুরুষের সাথে; তাতে নষ্ট হয়ে যাবে সামাজিক সঙ্গীতের সুর, বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য। অসাম্যই যে সামঞ্জস্যহীনতা, বিভিন্ন ধরনের অসাম্যের জন্যেই যে মানবসমাজ আজো সামঞ্জস্যহীন, তাই অসাম্য দূর ক’রেই যে প্রতিষ্ঠা করতে হবে প্রকৃত সামঞ্জস্য বা সৌন্দর্য, তা মনে পড়ে নি তাঁর। নারীমুক্তিবাদীরা চাইছিলো সমাজের বিশুদ্ধ সামঞ্জস্য সৃষ্টি করতে, তা তিনি বোঝেন নি, কেননা তার মধ্যে প্রবলভাবে কাজ করছিলো প্ৰথা। তিনি ইবসেনের ‘পুতুলের খেলাঘর’ (১৮৭৯) নাটকের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, তবে তিনি নোরা হেলমারের বিদ্রোহের প্রকৃতি অনুভব করার মতো সংবেদনশীল ছিলেন না। ইবসেন নাটকটিতে সরলভাবে বলেছেন যে নারী মানুষ। নোরা, লৈঙ্গিক বিপ্লবের প্রথম নায়িকা, যা প্রকাশ করে তা ‘অসহিষ্ণুতা’ নয়, সে সূচনা করে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপ্লবের। নোরা তার স্বামীকে বলে :

‘তুমি আমার প্রতি সব সময়ই সদয় ছিলো। তবে তোমার গৃহটি ছিলো খেলাঘর। আমি ছিলাম তোমার পুতুল বউ, যেমন আমাদের বাড়িতে আমি ছিলাম বাবার পুতুল মেয়ে; আর এখানে শিশুরা আমার পুতুল। তুমি যখন আমাকে নিয়ে খেলতে তখন আমার খুব মজা লাগতো, যেমন শিশুদের নিয়ে আমি যখন খেলতাম তখন তারা খুব মজা পেতো। টোরভান্ড, এই হচ্ছে আমাদের বিয়ে… সন্তানদের মানুষ করার জন্যে আমি কীভাবে উপযুক্ত? তার আগে আমার আরেক কাজ আছে। আমি প্রথম শিক্ষা দেবো নিজেকে–তুমি আমাকে তাতে সহায়তা করাব মতো মানুষ নও। আমার নিজেকেই তা করতে হবে। আর সে-জন্যেই আমি ছেড়ে যাচ্ছি। তোমাকে, নিজেকে আর আমার চার পাশের সব কিছু বোঝার জন্যে আমাকে দাঁড়াতে হবে সম্পূর্ণ একলা! সে-জন্যেই আমি আর তোমার সাথে থাকতে পারি না…’

এমন কথায় সমগ্র পুরুষতন্ত্র ও রবীন্দ্রনাথ আহত বোধ করবেন, এবং আহত বোধ করে নোরার স্বামীও। খাঁটি পুরুষাধিপত্যবাদী স্বামী হিশেবে সে নোরাকে বোঝায় স্বামী ও সন্তানের প্রতি নারীর রয়েছে ‘পবিত্র দায়িত্ব’; সবার আগে নোরা হচ্ছে ‘স্ত্রী ও মা’। কিন্তু নোরা মনে করে অন্যরকম :

‘আমার বিশ্বাস সবার আগে আমি একজন মানুষ, ঠিক তুমি যেমন; বা আমি চেষ্টা করবো একজন মানুষ হয়ে উঠতে। টোরভাল্ড, আমি জানি অধিকাংশ মানুষই মনে করবে যে তুমিই ঠিক, আর ওই ধরনের কথা পাওয়া যাবে বইপুস্তকে; তবে অধিকাংশ মানুষ কী বলে আর বইতে কী পাওয়া যায়, তা নিয়ে আমি খুশি থাকতে পারি না। নিজের জন্যে সব কিছু আমার নিজেকেই ভাবতে হবে, বুঝতে হবে…’

নোরা, ও পশ্চিমের নারীমুক্তিবাদীরা, নারীর জন্যে চেয়েছে মানুষের অধিকার; তারা অভিনয় করতে চায় নি। পুরুষতন্ত্রের দেয়া স্ত্রী বা মায়ের পার্টে। এটা কোনো অসঙ্গত ব্যাপার না হ’লেও রবীন্দ্রনাথের কাছে তা ‘অসংগত’। বৈষম্য আর নারীর পুরুষাধীনতা সঙ্গত তাঁর কাছে। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, ইউরোপের ‘স্ত্রীলোকেরা যেন তাদের স্ত্রীস্বভাবের জন্যে লজ্জিত।‘ রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করেন ‘স্ত্রীস্বভাব’ ব’লে একটা কৃত্রিম বিকৃত জিনিশে, যা মিল বাতিল ক’রে দিয়েছিলেন ‘নারী-অধীনতায়’ (১৮৬৯)।

‘এক দশক আগে প্ৰথমবার বিলেতে গিয়ে সেখানকার নারীদের স্বাধীনতা দেখে তার মনে হয়েছিলো যে ভারতীয়রা নিজেদের প্রয়োজনে নারীদের ক’রে তুলেছে ‘জন্তু’ আর ‘জড়পদাৰ্থ’। এক দশকের মধ্যে তিনি নিজেই হয়ে ওঠেন একজন আদর্শ ভারতীয়, যিনি নারীদের ক’রে রাখতে চান ওই জন্তু আর জড়পদার্থ, যিনি বিশ্বাস করেন না নারীমুক্তিতে, যিনি প্রচার করেন ভারতীয় নারীর সুখের রূপকথা :

‘আমরা তো দেখতে পাই আমাদের দেশের মেয়েরা তাদের সুগোল কোমল দুটি বাহুতে দু-গাছি বালা পরে সিঁথের মাঝখানটিতে সিঁদুরের রেখা কেটে সাদাপ্রসন্ন মুখে স্নেহ প্ৰেম কল্যাণে আমাদের মধুর করে রেখেছেন। কখনো কখনো অভিমানের অশ্রুজলে তাদের নয়নপল্লব আর্দ্র হয়ে আসে, কখনো-বা ভালবাসার গুরুতর অত্যাচারে তাদের সরল সুন্দর সুখশ্ৰী ধৈর্যগম্ভীর সকরুণ বিষাদে স্নানকান্তি ধারণ করে;…যা হোক, আমাদের গৃহলক্ষ্মীদের নিয়ে আমরা তো বেশ সুখে আছি এবং তাঁরা যে বড়ো অসুখে আছেন এমনতরো আমাদের কাছে তো কখনো প্রকাশ করেন নি, মাঝের থেকে সহস্ৰ ক্রোশ দূরে লোকের অনৰ্থক হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায় কেন।‘

যে-চোখে রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন এখানে ভারতীয় নারীদের, সে-চোখকে অন্ধ বললে ভুল বলা হয় না। তিনি নারীদের দেখেছেন পুরুষতন্ত্রের চোখে, আর রোম্যানটিকের দৃষ্টিতে; তার চোখে পড়েছে নারীর সুগোল কোমল বাহু, দু-গাছি বালা, স্নেহ প্রেম কল্যাণের মতো কল্পিত ব্যাপারগুলো। এ-বৰ্ণনা পড়ে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ বাস্তব নারীদের কখনো দেখেন নি, বা দেখেছেন সামন্ত সচ্ছল পরিবারের অবাস্তব নারীদের, যাদের ছিলো সুগোল বাহু, এবং তা কোমলও, আর তাতে বালাও ছিলো; কিন্তু অধিকাংশ ভারতীয় নারীর রূপ সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভারতীয় নারীর দুর্দশা থেকে গেছে তার চোখের আড়ালে। ‘আমাদের গৃহলক্ষ্মীদের নিয়ে আমরা তো বেশ সুখে আছি’, তার এ-স্বীকারোক্তি হয়তো সত্য; তবে তারা যে বড়ো অসুখে আছেন এমনতরো আমাদের কাছে তো কখনো প্ৰকাশ করেন নি, একথা সত্য নয়। নারীরা তাদের অসুখের কথা বলেছে বা জানিয়েছে বারবার, কিন্তু পুরুষতন্ত্র তাতে কান দেয় নি, বা তাদের স্তব্ধ করে দিয়েছে। যেমন স্তব্ধ করেছে তারা রমাবাইকে। নারী যে অসুখী হতে পারে, তা-ই বিশ্বাস করতে পারে নি পুরুষাধিপত্যবাদীরা রবীন্দ্রনাথ তাদেরই একজন।

তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘আমাদের সমাজের যেরকম গঠন, তাতে সমাজের ভালোমন্দ যা-ই হোক আমাদের স্ত্রীলোকেরা বেশ রকম সুখে আছেন। ইংরেজেরা মনে করতে পারেন লনটেনিস না খেললে এবং ‘বলে’ না নাচলে স্ত্রীলোক সুখী হয় না, কিন্তু আমাদের দেশের লোকের বিশ্বাস, ভালোবেসে এবং ভালোবাসা পেয়েই স্ত্রীলোকের প্রকৃত সুখ। তবে সেটা একটা কুসংস্কার হতেও পারে।’ একজন খাঁটি প্রথাবাদী ভারতীয় হিশেবে রবীন্দ্রনাথ জোর ক’রেই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে সুখে আছে ভারতীয় নারীরা। সুখ ব্যাপারটি খুবই মানসিক, সুখে থাকতে পারে রবীন্দ্রনাথের ভূত্য আর অসুখে থাকতে পারেন প্ৰভু রবীন্দ্রনাথ, তবে ভারতীয় নারীরা আসলে বেশ রকম সুখে ছিলো না। তিনি লন টেনিস খেলা আর বল নাচাকে নিন্দা করেছেন, তিনি মনে করেন ওগুলো নারীর সুখের জন্যে দরকার নয়; কিন্তু তিনি যদি ভারতীয় নারীদের কাছে জানতে চাইতেন এ-সম্পর্কে, তাহলে যে-উত্তর পেতেন তাতে ক্ষুব্ধ বোধ করতেন। দেখতেন খেলতে আর নাচতে চায় ভারতীয় নারীরাও! তিনি বিশ্বাস করেন, ‘ভালোবেসে এবং ভালোবাসা পেয়েই স্ত্রীলোকের প্রকৃত সুখ।’ তার উপলব্ধি চমৎকার, তবে প্রশ্ন হচ্ছে পুরুষের সুখ কীসে;–ভালো না বেসে, ভালোবাসা না পেয়ে? পুরুষের জন্যে কি ভালোবাসা নিরর্থক? পুরুষ কি এমন জন্তু, যার দরকার নেই ভালোবাসার ও ভালোবাসা পাওয়ার? রবীন্দ্রনাথ নারীকে মনে করেছেন খেলার পুতুল, টোরভান্ডের মতো তিনিও পছন্দ করেন পুতুল খেলতে; মনে করেন নারীর কাজ হচ্ছে পুরুষকে ভালোবাসা, আর কখনো কখনো পুরুষের আদর পাওয়া। পুরুষের এ-ভালোবাসা যে অপমান, তা বুঝেছিলো রবীন্দ্রনাথের ‘নারীর উক্তি’র নারীটি; সে জানিয়েছিলো, ‘আছি যেন সোনার খাঁচায় /একখানি পোষ-মানা প্ৰাণ! /এও কি বুঝাতে হয়–/প্রেম যদি নাহি রয়/হাসিয়ে সোহাগ করা শুধু অপমান।’ ভারতীয় নারী হয়তো প্রাণভ’রে ভালোবেসেছে তাদের পুরুষদের, কিন্তু তারা ভালোবাসা পায় নি, পেয়েছে সোহাগের নামে অপমান। তবে ওই সোহাগও জোটে নি। অধিকাংশ নারীর ভাগ্যে।

রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস, ‘আমাদের পরিবারে নারীহৃদয় যেমন বিচিত্রভাবে চরিতার্থতা লাভ করে এমন ইংরেজ-পরিবারে অসম্ভব।‘ ইংরেজ পরিবারের তুলনায় হিন্দু/ব্ৰাহ্ম পরিবারে নারীহৃদয়ের বিচিত্ৰভাবে চরিতার্থ লাভের যে-বিবরণ তিনি দিয়েছেন, তা চূড়ান্তরূপে মর্মস্পর্শী। নারীর ধারাবাহিক লাঞ্ছনাকে তিনি বলেছেন নারী হৃদয়ের চরিতার্থতা/ ভারতীয় নারীহৃদয়ের চরিতার্থতা প্রমাণের জন্যে তিনি তুলনা করছেন ইংরেজ চিরকুমারী ও ভারতীয় বিধবার মধ্যে :

‘বাহ্য সাদৃশ্যে আমাদের বিধবা য়ুরোপীয় চিরকুমারীর সমান হলেও প্রধান একটা বিষয়ে প্রভেদ আছে। আমাদের বিধবা নারীপ্রকৃতি কখনো শুষ্ক শূন্য পতিত থেকে অনুর্বরতা লাভের অবসর পায় না। তাঁর কোল কখনো শূন্য থাকে না, বাহু দুটি কখনো অকৰ্মণ্য থাকে না হৃদয় কখনো উদাসীন থাকে না। তিনি কখনো জননী কখনো দুহিতা কখনো সখী। এইজন্যে চিরজীবনই তিনি কোমল সরস স্নেহশীল হয়ে থাকেন। বাড়ির অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে তাঁর বহুকালের সুখদুঃখময় প্রীতির সখিত্ববন্ধন, বাড়ির পুরুষদেব সঙ্গে স্নেহভক্তিপরিহাসের বিচিত্র সম্বন্ধ; গৃহকার্যের ভার যা স্বভাবতই মেয়েরা ভালোবাসে তাও তার অভাব নেই।…বরং একজন বিবাহিত রমণীর বিড়ালশাবক এবং ময়না পোষবার প্রবৃত্তি এবং অবসর থাকে, কিন্তু বিধবাদের হাতে হৃদয়ের সেই অতিরিক্ত কোণটুকুও উদ্যুবৃত্ত থাকতে প্রায় দেখা যায় না।‘

রবীন্দ্রনাথের মতো একজন স্পর্শকাতর রোম্যানটিক কবি কী ক’রে এতো সংবেদনহীন হয়ে উঠতে পারেন, তা ভাবতেও শোক জাগে। তিনি স্তব করেছেন পৃথিবীর সবচেয়ে শোচনীয় মর্মান্তিক এক ব্যাপারের। হিন্দু বিধবা সব ধরনের বিধবার মধ্যে শোচনীয়তম, তার জীবন হচ্ছে ধারাবাহিক সতীদাহ; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাকেই বলেছেন ‘হৃদয়ের চরিতার্থতা’। যার জীবন সম্পূর্ণ শূন্য শুষ্ক পতিত অনুর্বর, তার জীবনকে কতকগুলো নিরর্থক শব্দে পূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ কি মনে করেন যে বিধবার জীবন ব্যর্থ হতে পারে, কিন্তু তার নারীপ্ৰকৃতি হয়ে ওঠে বিচিত্ৰভাবে চরিতার্থ, কেননা তার আশ্রয়দাতা পরিবারটি তাকে এতো কাজ দেয় যে তাতেই সে ভরে ওঠে? রবীন্দ্রনাথের বর্ণনা বাস্তবভাবে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় যে বিধবার নিজের সন্তান না থাকলেও পরের সন্তান পালন করতে করতে কাটে তার সকাল থেকে সন্ধ্যা। পরের সন্তান পালন কী কঠিন কাজ, তা জানে শুধু বিধবারাই। ‘তিনি কখনো জননী কখনো দুহিতা কখনো সখী’;–এটা মধুর শোনালেও মধুর ব্যাপার নয়, খুবই বিষাক্ত ব্যাপার। এর বাস্তব অনুবাদ হচ্ছে বিধবা এমন মানুষ, যার নিজের কোনো সত্তা নেই জীবন নেই, সে ঘোরে অন্যদের কেন্দ্র করে; তার জীবন নিরবচ্ছিন্ন লাঞ্ছনার, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে তাই মধুর। ‘গৃহকার্যের ভার যা স্বভাবতই মেয়েরা ভালোবাসে তাও তাঁর অভাব নেই’, এর প্রথমাংশ সত্য না হ’লেও দ্বিতীয়াংশ খুবই সত্য যে বিধবা ক’রে থাকে দাসীর কাজ, আর তার কাজের কোনো শেষ নেই। ওই কাজের জন্যে সে পারিশ্রমিক পায় না, তার ভাগ্যে জোটে লাঞ্ছনা। ‘একজন বিবাহিত রমণীর বিড়ালশাবক এবং ময়না পোষবার প্রবৃত্তি এবং অবসর থাকে’, কিন্তু তা থাকে না বিধবার; এর কারণ এ নয় যে তার হৃদয়পাত্র থেকে অমৃত উপচে পড়েছে, এসব তুচ্ছ কাজ করার মতো অবসর তার নেই। এর কারণ হচ্ছে দাসীর কোনো সুযোগ নেই ওই সব সামন্ত শখের। বিধবা হচ্ছে দণ্ডিত নারী, যে কোনো অপরাধ করে নি; কিন্তু রবীন্দ্ৰনাথ নিরপরাধ নারীর ওই দণ্ডকেই মনে করেন। হৃদয়ের চরিতার্থতা!

এ-সময়ে (১৮৯১) তিনি নারীমুক্তি সম্পর্কে স্বেচ্ছায় বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন নারীমুক্তিবাদী কৃষ্ণভাবিনী দাসের সাথে। কৃষ্ণভবিনী ‘শিক্ষিতা নারী’ (১২৯৮) নামের একটি প্রবন্ধে দাবি করেন নারীশিক্ষা, চান কিছুটা স্বাধীনতা। নারীকে ঘরছাড়া করার কোনো উদ্দেশ্য তার ছিলো না, তিনিও চেয়েছিলেন শিক্ষার সাহায্যে উন্নতজাতের নারী উৎপাদন করতে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ব্যগ্র হয়ে পড়েন নারীকে ঘরে আটকে রাখার জন্যে। তিনি নিজেকে দেখেন পুরুষতন্ত্রের মুখপাত্ররূপে, যাকে বাঁচানো তার কাজ, যার মহিমা রক্ষা করা তাঁর দায়িত্ব। পুরুষই যে নারীকে আটকে রেখেছে ঘরে, কৃষ্ণভাবিনীর এ-অভিযোগ কাটানোর জন্যে তিনি আবার দোহাই দেন প্রকৃতির [উদ্ধৃত, অনন্যা (১৩৯৪, ১৯)] :

‘প্রকৃতিই রমণীকে বিশেষ কাৰ্যভার ও তদনুরূপ প্রবৃত্তি দিয়া গৃহবাসিনী করিয়াছেন–পুরুষের সাৰ্ব্বভৌমিক স্বার্থপরতা ও উৎপীড়ন নহে–অতএব বাহিরের কর্ম দিলে তিনি সুখীও হইবেন না, সফলও হইবেন না।‘

উনিশশতকের বাঙালি নারীরা নিজেদের অবস্থা বর্ণনার জন্যে দুটি রূপক ব্যবহার করেছেন বারবার : পিঞ্জর ও কারাগার। গৃহকে তারা দেখেছেন ওই রূপকে, তাঁরা দাবি করেছেন নারীকে সেখানে ঢুকিয়েছে পুরুষেরাই। কৃষ্ণভাবিনীও তা-ই বলেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ একে মনে করেন প্রকৃতির শাশ্বত বিধান। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস প্রকৃতিই বিকলাঙ্গ ক’রে তৈরি করেছে নারীকে, তাই তাকে থাকতে হবে ঘরে, মানতে হবে পুরুষাধিপত্য। ভিক্টোরীয়দের মতো রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নিজেকে উৎসর্গ করাই নারীত্ব। এ-সম্পর্কে কৃষ্ণভাবিনী যা বলেন, তা অবিস্মরণীয় [উদ্ধৃত, অনন্যা (১৩৯৪, ২০)] :

‘পরোপকার ও অন্যের জন্যে জীবন ধারণ করা যেমন নারীর উদ্দেশ্য, রমণী তেমনি নিজের নিমিত্তও বাঁচিয়া থাকে।‘

কৃষ্ণভাবিনীর উক্তির প্রথমাংশ উগ্র পুরুষতন্ত্রের সাথে আপোষ, আর দ্বিতীয়াংশ নিজেকে আবিষ্কার। নোরার মতো কৃষ্ণভাবিনী শুধু নিজের জন্যে বাঁচতে চান নি, জীবন ধারণ করতে চেয়েছেন প্রধানত পরেরই জন্যে, একটুকু শুধু বেঁচে থাকতে চেয়েছেন নিজের জন্যে। পুরুষতন্ত্র আর রবীন্দ্রনাথ তাতে রাজি নন; তিনি চান নারী হবে ক্রুশবিদ্ধ জিসাস, ত্যাগ স্বীকার করে যাবে আমরণ। নারীর যে-স্তব করেন তিনি, তা পুরুষ করেছে বারবার নারীকে নিজের বশে রাখার জন্যে [উদ্ধৃত, অনন্যা (১৩৯৪, ২১)] :

‘নারী নারী বলিয়াই শ্রেষ্ঠ। তিনি পুরুষের কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করিলে যে শ্ৰেষ্ঠতর হইবেন তাহা নহে বরং বিপরীত ঘটিতে পারে, তাহাতে তাঁহাদের চরিত্রের কোমলতা, সহিষ্ণুতা ও দৃঢ়তার সমাঞ্জস্য নষ্ট হওয়া আশ্চৰ্য নহে।‘

ভিক্টোরীয়রা নারীকে পুরুষের থেকে উৎকৃষ্ট ব’লে অবিরাম প্রশংসা করেছে, কিন্তু তাকে অধীনে রাখার সব রকম কৌশল নিয়েছে; ‘উৎকৃষ্ট’ কথাটি ছিলো এক নিরর্থক সুভাষণ। সে-নারীই ছিলো তাদের কাছে উৎকৃষ্ট, যে পুরুষের অধীনে থাকে। একে বিদ্রুপ ক’রে উনিশ শতকের এক বিলেতি ব্যঙ্গচিত্রকর একটি ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন, যাতে একটি পুরুষ চেয়ারে বসে তার স্ত্রীর দিকে পা বাড়িয়ে দিয়ে বলছে, ‘হে নারী, সৃষ্টির শ্ৰেষ্ঠ, মানবতার সমাজী, মানবজাতির জননী, আমার জুতো খোলো’ [দ্র ট্যানাহিল। (১৯৮০, চিত্র ১৯)]। মিল বলেছিলেন এটা এক পরিহাস যে উৎকৃষ্টরা থাকবে নিকৃষ্টদের অধীনে! নারী নারী বলিয়াই শ্ৰেষ্ঠ এক শূন্য বুলি। রবীন্দ্রনাথ ভালোভাবেই বিশ্বাস করেন ভিক্টোরীয় ঘরে বাইরে বা ভিন্ন এলাকাতত্ত্বে, এবং বিশেষ ধরনের নারীস্বভাবে। তিনি নারীকে মনে করেন প্রকৃতির হাতে তৈরি বিশেষ এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ, যাতে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে যদি নারী চেষ্টা করে বাইরে আসার। ওই দুর্ঘটনায় নষ্ট হয়ে যাবে নারীর স্বভাব-কোমলতা, সহিষ্ণুতা, দৃঢ়তা! নারীর স্বভাব যে পুরুষতন্ত্রেরই তৈরি, তা ভাবেন নি রবীন্দ্রনাথ।

নারী সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি ও বদ্ধমূল ক’রে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ বিশ-একুশ বছর বয়সে, যা তিনি পুষেছেন আশি বছর বয়স পর্যন্ত। নারীর দুটি বিপরীত ধ্রুবরূপে বিশ্বাস করেছেন তিনি; প্রিয়া ও জননী, উর্বশী ও কল্যাণী, বা পতিতা ও গৃহিণী। প্রিয়া-উৰ্বশী-পতিতা নারীর একরূপ, জননী-কল্যাণী-গৃহিণী আরেক রূপ। প্রথম রূপটির স্বপ্ন দেখেছেন তিনি কবিতার জন্যে, দ্বিতীয় রূপটিকে তিনি চেয়েছেন বাস্তবে। তার কবিতা, গল্প, উপন্যাসে এ-রূপ দুটি ফিরে ফিরে এসেছে। এ-রূপ দুটি তিনি পেয়েছেন হিন্দুপুরাণের সমুদ্রমন্থন উপাখ্যানে, এবং এদের মনে করেছেন শাশ্বত, চিরন্তন। নারীকে তিনি স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত, আর্থনীতিকভাবে স্বনির্ভর দেখতে চান নি। তাঁর কয়েকটি কবিতা পড়ে দেখতে চাই তিনি নারীকে দেখেছেন কী রূপে, আর কোন রূপ চেয়েছেন স্বপ্নে ও বাস্তবে। ‘ উর্বশী’ [১৩০২, চিত্রা] কবিতাটিতে পাওযা যায় নারীর এক রূপ, যে ‘নহ মাতা, নহ কন্যা, নাহ বধু’, সে ‘সুন্দরী রূপসী’। তার জন্ম হয়েছিলো ‘মন্থিত সাগরে’। সে সৌন্দর্য, কিন্তু সে ‘বৃন্তহীন পুষ্প’, তার জীবন ট্র্যাজিক বেদনাপূর্ণ, কেননা সে কল্যাণী নয়। নারীর ওই রূপের জন্যে তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতে পারেন, কিন্তু তাকে গৃহে কামনা করেন না। বলাকার (১৩২১) ২৩-সংখ্যক কবিতায়ও মেলে নারীর দুই রূপ :

‘কোন ক্ষণে
সৃজনের সমুদ্রমন্থনে
অতলের শয্যাতল ছাড়ি
একজন উর্বশী, সুন্দরী,
বিশ্বের কামনা-রাজ্যে রানী,
স্বর্গের অপ্সরী।
অন্যজনা লক্ষ্মী সে কল্যাণী,
স্বর্গের ঈশ্বরী।

রবীন্দ্রচিন্তায় এ-দু-নারী আদিম, চিরন্তনী, শাশ্বতী; এদের পরিবর্তন নেই, এরা রবীন্দ্রনাথ ও পুরুষতন্ত্রের দুই নারী স্টেরিওটাইপ। তাই নারী চিরকালই থেকে যাবে। পৌরাণিক উর্বশী, যে কামনার তৃপ্তি যোগাবে পুরুষের, আর কল্যাণী, যে পুরুষের গৃহকে ক’রে তুলবে স্বর্গের মতো সুখকর। এরা পরস্পরের বিপরীত; উর্বশী রূপসী, সে বেশ্যা, তাকে দেবদানব আর পুরুষ কেউ গ্রহণ করে নি; আর কল্যাণীকে পুরুষ বন্দী করেছে নিজের গৃহে। নারীর দু-রূপকে পুরুষ ও রবীন্দ্রনাথ যেভাবে দেখেছেন, তাতে নারী হয়ে উঠেছে এক শোচনীয় প্রাণী; যাকে গৃহে গ্ৰহণ করা হয় নি, সে হয়েছে বেশ্যা-তার কাজ সকলের চিত্ত ও শরীরবিনোদন; আর যাকে গ্ৰহণ করা হয়েছে, সে হয়েছে দাসী। নারীর এ-দু-রূপই কাজ করেছে তাঁর কবিতার প্রেরণারূপে, সম্ভবত উর্বশী রূপটিই তাকে বেশি প্রেরণা দিয়েছে, তবে তিনি স্তব করেছেন নারীর কল্যাণী বা দাসী রূপটির। কল্যাণীর ভবনখানি, রবীন্দ্রনাথের ‘কল্যাণী’ [১৩০৭, ক্ষণিক ] কবিতার পরিকল্পনা অনুসারে, পুষ্পকানন-মাঝে সাধারণত থাকে না, তবে একথা ঠিক যে ‘কল্যাণী, নিত্য আছ আপন গৃহকাজে।’ ভিক্টোরীয়দের ‘অ্যাঞ্জেল ইন দি হাউজ’ আর রবীন্দ্রনাথের ‘কল্যাণী’ দেবী, তাই ভাবতেই বিবমিষায় ধরে যে দেবী সরক্ষণ করছে গৃহকাজ, অর্থাৎ দাসীবৃত্তি। পুরুষ দেবীকে ক’রে তুলেছে গৃহপরিচারিকা! এ-দাসীর নামে তিনি ‘সর্বশেষের শ্রেষ্ঠ’ গানটি উৎসর্গ করেছেন, তাকে উপাধি দিয়েছেন ‘স্বর্গের ঈশ্বরী’, এবং তাকে করেছেন পার্থিব নারীর অনুসরণীয় আদর্শ : ‘রূপসীরা তোমার পায়ে রাখে পূজার থালা,/বিদুষীরা তোমার গলায় পরায় বরমালা।’ রূপসীরা ওই দাসীকে পুজো করে, বিদুষীরা তাকে অভিনন্দিত করে! অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের সারকথা হচ্ছে নারীর রূপের মূল্য নেই, জ্ঞানের মূল্য নেই। আরো, নারীর মহিমা তার গৃহকাজে বা দাসীত্বে; এবং তাকে বন্দী ক’রে রাখতে হবে গৃহে।

রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নারীকে হ’তে হবে নারী; পুরুষ হবে কবি, শিল্পী, বিজ্ঞানী, শাসক প্রভৃতি, অর্থাৎ প্ৰভু বা স্রষ্টা। পুরুষতন্ত্র যে-ছকে তৈরি করেছে ও দেখতে চায় নারীকে, তিনি নারীকে দেখেন সে-ছক অনুসারেই; নারী যখন ছক ভেঙে ফেলে, তখন দেখা দেয় বিপর্যয়। এমনকি তিনি নিজেও যখন ছক ভেঙে নারীকে ব্যক্তি ক’রে তোলেন, তখন অবিলম্বে তাকে পুনর্বিন্যস্ত করেন ছকের মধ্যে। ‘সাধারণ মেয়ে’ [১৩৩৯, পুনশ্চ] কবিতাটিতে মেলে এর পরিচয়। মালতী এ-কবিতায় নিতে চেয়েছে মহৎ প্রতিশোধ। দেবযানীর মতো অভিশাপ দেয়ার সুযোগ সে পায় নি, তাই সে গণিতে হ’তে চেয়েছে প্ৰথম, বিলাতে গিয়ে সম্ভবত করতে চেয়েছে ডক্টরেট। নরেশ যদি তাকে বিয়ে করতো, তবে সে ঢাকাই শাড়ি পরে কপালে সিঁদুর মেখে হয়ে উঠতো প্রথাগত কল্যাণী–তার নাম হতো শ্ৰীমতি মালতী দাসী; তবে ব্যর্থতা যেমন অনেক মহৎ কাজের প্রেরণা, মালতীর প্রেমের ব্যর্থতাও মালতীকে অনুপ্রাণিত করে মহৎ প্রতিশোধের স্বপ্ন দেখতে। মালতী ছক ভেঙে বেরিয়ে পড়ে; প্রতারিত প্রেমিকা দিবাস্বপ্নে হয়ে ওঠে মেধাবী ছাত্রী;–সাহিত্যের নয়, গণিতের। সে বিলেতে যায়, তার কৃতিত্বে মুগ্ধ হয়ে পড়ে চারপাশ। তবে মালতী ছক ভাঙতে-না-ভাঙতেই রবীন্দ্ৰনাথ তাকে ফিরিয়ে আনেন পুরুষতন্ত্রের চিরন্তন ছকের মধ্যে :

‘মেয়েটাকে দাও পাঠিয়ে য়ুরোপে।
সেখানে যারা জ্ঞানী, যারা বিদ্বান, যারা বীর,
যারা কবি, যারা শিল্পী, যারা রাজা,
দল বেঁধে আসুক ওর চার দিকে।
জ্যোতির্বিদেব মতো আবিষ্কার করুক ওকে–
শুধু বিদুষী ব’লে নয়, নারী ব’লে:
ওর মধ্যে যে বিশ্ববিজয়ী জাদু আছে
ধরা পড়ুক তার রহস্য—‘

যদি নারীত্বই হয় তার শ্রেষ্ঠ পরিচয়, তাহলে গণিতে প্রথম শ্ৰেণী আর বিলেতে গবেষণা হয়ে ওঠে শোচনীয় পণ্ডশ্রম। মালতী এতো কিছু ক’রেও অর্জন করে নি কোনো সাফল্যই, তার পরম সাফল্য পরনে ঢাকাই শাড়ি আর কপালে সিঁদুরে! জ্ঞানী, বিদ্বান, বীর, কবি, শিল্পী, রাজারা ওর মাঝে আবিষ্কার করবে এক ছক-বাঁধা নারীকে, আর বিদুষী মালতী, রবীন্দ্রনাথের ‘কল্যাণী’ কবিতা অনুসারে, বরণমালা পরাবে কল্যাণী বা দাসীর কণ্ঠে। এ-ছকের মধ্যেই নারীকে রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। এমনকি তার বিদ্রোহী নারী, যে উদ্ধত প্রশ্ন করে : ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার /কেন নাহি দিবে অধিকার /হে বিধাতা?’, যে ঘোষণা করে, ‘যাব না বাসরকক্ষে বধূবেশে বাজায়ে কিঙ্কিণী’, সেও ছকের মধ্যেই থেকে বলে; “যাহা মোর অনির্বাচনীয় /তারে যেন চিত্তমাঝে পায় মোর প্রিয়’ [‘সবলা’ (১৩৩৫); মহুয়া)]। ওই অনির্বচনীয়টুকু হচ্ছে নারীত্ব, যা পুরুষতন্ত্রের অত্যন্ত প্রিয়।

ছক-ভাঙা নারীকে ছকের মধ্যে পুনর্বিন্যস্ত করার সফল উদাহরণ চিত্রাঙ্গদা (১২৯৯)। চিত্রাঙ্গদা ভিক্টোরীয় ঘরেবাইরে বা পৃথক এলাকা বা সহচরীতিত্ত্বের এক নিরীক্ষা, যাতে প্রমাণ করা হয়েছে যে নারী স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত হওয়ার অযোগ্য; সে হ’তে পারে বড়জোর পুরুষের সহচরী। ভিক্টোরীয়রা নারীকে ততোটুকু শিক্ষা দিতে রাজি হয়েছিলো, যতোটুকুতে তারা হতে পারে স্বামীর যোগ্য সহচরী:–নারী নিজে প্রধান হয়ে উঠবে না, পুরুষই থাকবে প্রধান, নারী পালন করবে। সহকারী সহচরীর ভূমিকা। নারী যদি ছক ভেঙে বেরিয়ে পড়ে, তবে তাকে ছকের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে হবে যে-কোনো কৌশলে, বা ঠেলে তাকে ঢুকিয়ে দিতে হবে ঘরের কারাগারে। টেনিসনের প্রিন্সেস (১৮৪৭, ১৮৫৩) কাব্যে পাওয়া যায়। এর আদর্শ ভিক্টোরীয় রূপ। ওই কাব্যে বিদ্রোহী স্বায়ত্তশাসনলিঙ্গু রাজকন্যা আইডাকে ক’রে তোলা হয় স্বামীর পদানত, তার প্রতিষ্ঠিত নারী-বিশ্ববিদ্যালয়কে হাসপাতালে রূপান্তরিত ক’রে ওই বিদ্রোহিনীকে পরিণত করা হয় পুরুষেয় সেবিকা ও স্বামীর সহচরীতে। পুরুষতন্ত্র প্রতিশোধ নেয় চরমভাবে।

‘চিত্রাঙ্গদা’র কাঠামো অভিন্ন, একটি বিদ্রোহী স্বাধীন রাজকন্যাকে এতে কামের সহযোগিতায় রূপান্তরিত করা হয় পুরুষের সহচরীতে। চিত্রাঙ্গদার শুরু ছক-ভাঙা নারীরূপে, আর তার বিলুপ্তি ঘটে ছকবদ্ধ নারীতে; ভিক্টোরীয় পুরুষতন্ত্রের তৈরি ছকে তাকে চমৎকারভাবে পুনর্বিন্যস্ত করেন রবীন্দ্রনাথ, যাতে মুগ্ধ হয় পুরুষেরা, এবং উন্নতজাতের নারী-উৎপাদনকারীরা। কাব্যনাটকটির যে-অংশ নারী-স্বাধীনতার বিভ্রান্তিকর শ্লোগান হিশেবে খ্যাতি অর্জন কবেছে, তা হচ্ছে [চিত্রাঙ্গদা : ১১] :

‘আমি চিত্রাঙ্গদা।
দেবী নহি, নহি আমি সামান্য রমণী।
পূজা কবি রাখিবে মাথায়, সেও আমি
নই; অবহেলা করি পুষিয়া রাখিবে
পিছে, সেও আমি নাহি। যদি পার্শ্বে রাখ
মোরে সংকটের পথে, দুরূহ চিন্তার
যদি অংশ দাও, যদি অনুমতি কর
কঠিন ব্ৰতের তব সহায় হইতে,
যদি সুখে দুঃখে মোরে কর সহচরী,
আমার পাইবে তবে পরিচয়।‘

এখানে পাওয়া যাচ্ছে এক ভিক্টোরীয় চিত্রাঙ্গদাকে, যে স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত হওয়ার সমস্ত স্বপ্ন বাতিল ক’রে বেছে নিয়েছে সহচরীর ভূমিকা। সে দেবী নয়, দাসী নয়, তবে স্বাধীন সত্তাও নয়; সে পুরুষের সহচরী বা প্রিয় পরগাছা। সে নিজে যাবে না। কোনো সংকটের পথে, নিজে করবে না কোনো দুরূহ চিন্তা, নিজে গ্রহণ করবে না। কোনো কঠিন ব্ৰতা; ওই সমস্ত কাজ পুরুষের, সে-সব করবে। তার স্বামী, সে হয়ে থাকবে স্বামীর সহচরী, বা শিক্ষিত দাসী। রুশো-রাসকিন নারীকে দিতে চেয়েছিলেন এ-ধরনের শিক্ষাই। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছিলো ‘রঘুবংশ’-এর ‘প্রিয়শিষ্যা ললিতে কলাবিধৌ’ শ্লোকটি, পছন্দ ছিলো স্ত্রীর সখি, সচিব, মিত্রের ভূমিকা; এর সাথে মিলে গিয়েছিলো ভিক্টোরীয় মতবাদ যে নারী হবে স্বামীর সহচরী। চিত্রাঙ্গদায় সহচরী নামের সুভাষিত দাসীর ভূমিকায় বিলুপ্তি ঘটে এক স্বায়ত্তশাসিত তরুণীর। চিত্রাঙ্গদার সাথে মিল আছে শেষের কবিতার (১৩৩৬) লাবণ্যের, তাকেও চিত্রাঙ্গদার মতো ছকের মধ্যে পুনর্বিন্যস্ত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। লাবণ্যের বাবা অধ্যক্ষ অবনীশ দত্ত মেয়েকে বিদুষী ক’রে গ’ড়ে তুলতে চেয়েছিলো; কিন্তু মেয়েটি একদিন জ্ঞান বাদ দিয়ে জেগে ওঠে কামের মধ্যে, যেমন জেগে উঠেছিলো চিত্রাঙ্গদাও। রবীন্দ্রনাথ মেয়েদের জ্ঞান সহ্য করেন না, তাদের জাগিয়ে তোলেন কামে বা প্ৰেমে-নারীত্বে; এবং মনে করেন এখানেই নারীর জীবনের সার্থকতা। তবে ওই প্ৰেমই নারীর জীবনকে ব্যর্থ ক’রে দেয়, নারী হয়ে ওঠে পুরুষের দাসী বা সহচরী। পুরুষতন্ত্রের শেখানো প্ৰেম নারীর জন্যে এক বড়ো সমস্যা।

রবীন্দ্রচিন্তায় পুরুষ অনন্য সত্তা, পুরুষ স্রষ্টা, ধ্যানী, শিল্পী, নারী গৌণ। সাতাত্তর বছর বয়সে লেখা ‘নারী’ [১৯৩৭, সনাই] নামের একটি কবিতার উল্লেখযোগ্য অংশ এমন :

‘  স্বাতন্ত্র্যস্পর্ধায় মত্ত পুরুষেরে করিবারে বশ
যে-আনন্দরস
রূপ ধরেছিল রমণীতে ,
ধরণীর ধমনীতে
তুলেছিল চাঞ্চল্যের দোল
রক্তিম হিল্লোল ,
সেই আদি ধ্যানমূর্তিটিরে
সন্ধান করিছে ফিরে ফিরে
রূপকার মনে-মনে
বিধাতার তপস্যার সংগোপনে ।…
পুরুষের অনন্ত বেদন
মর্তের মদিরা-মাঝে স্বর্গের সুধারে অন্বেষণ ।…
সেই পূর্ণ লোকে —
সেই ছবি আনিতেছ ধ্যান ভরি
বিচ্ছেদের মহিমায় বিরহীর নিত্যসহচরী । ‘

এর অর্থ আদিতে ছিলো পুরুষ, যে স্বাধীন স্বাতন্ত্র্যস্পর্ধী, স্বর্গের অধিবাসী। তখন নারী ছিলো না। নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছিলো পুরুষের অনন্ত স্বাতন্ত্র্যস্পৃহা নিয়ন্ত্রণের জন্যে, নারী দেখা দিয়েছিলো আনন্দরূপে। কে সৃষ্টি করেছিলো নারীকে? সৃষ্টি করেছিলো সম্ভবত পুরুষ নিজেই, পুরুষই নারীর বিধাতা, নারী পুরুষের ধ্যানলব্ধ মূর্তি। তবে নারী সে-মূর্তি আর আনন্দ ধ’রে রাখতে পারে নি, তাই পুরুষ শিল্পী হয়ে বারবার সৃষ্টি করছে সে-মূর্তি। পৃথিবীতে নারী আছে, কিন্তু তারা পৃথিবীর শস্তা মদ, পুরুষ এ-মর্ত্যের মদেই আস্বাদ করার চেষ্টা করছে স্বর্গের সুধা। পুরুষ স্বৰ্গ থেকে নির্বাসিত হয়ে নানা শিল্পকলায় সৃষ্টি করছে আদিনারীকে। পৃথিবীতে যে-নারীরা আছে, তারা একদা অপূর্ব আলোতে উদ্ভাসিত ছিলো, এখন নেই। পুরুষ তাই চিরবিরহী, তার স্বপ্নে আছে আদিনারী; পার্থিব নারী পুরুষের সহচরী মাত্র। এ-নারী পুরুষের সেবা করবে, গৃহকাজ করবে, পুরুষ একে সম্ভোগ করতে করতে স্বপ্ন দেখবে আদি ধ্যানমূর্তিটির! কাব্যিকভাবে একে স্বর্গীয় মনে হতে পারে, তবে গদ্যে বা বাস্তবে এ খুবই শোচনীয় ব্যাপার।

রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো গল্প-উপন্যাসও কল্যাণী বা গৃহবন্দী নারীর স্তব। নারীর বেদনা স্থান পেয়েছে তাঁর কথাসাহিত্যে, তবে তা প্রেমহীনতার বেদনা, নারীর স্বায়ত্তশাসনহীনতার বেদনা নয়। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী নারীর রূপও এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু তাকে তিনি স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন নি। তাঁর কোনো কোনো উপন্যাস, যেমন ‘দুই বোন’ (১৩৩৯), লেখা হয়েছে দুই নারীতত্ত্ব–নারীর এক রূপ উর্বশী আরেক রূপ কল্যাণী–প্রমাণের জন্যে; কোনো কোনো উপন্যাস, যেমন ঘরে-বাইরে (১৩২৩), চার অধ্যায় (১৩৪১), লেখা হয়েছে পৃথক এলাকা তত্ত্ব প্রমাণ করার জন্যে। তিনি বিশ্বাস করেন গৃহ আর ভালোবাসা পেলে এবং ভালোবাসতে পারলেই চরিতার্থ নারীর জীবন। বাইরের জগত নারীর জগত নয়, সেখানে নারী প্রবেশ করলে শুভকে গ্ৰাস করে অশুভ, দেখা দেয় সর্বনাশ। প্রেমের ওপর চরম গুরুত্ব দিয়ে রবীন্দ্রনাথ নষ্ট করেছেন নারীদের সম্ভাবনা। প্ৰেম নামক ভাবাবেগ নারীপুরুষ উভয়ের জীবনেরই খণ্ডকালীন সত্য, কিন্তু প্রেমই জীবনের সাফল্য নয়; ভাবাবেগকাতর একটা সময় কেটে যাওয়ার পর পুরুষ প্রেমের জন্যে কাতরতা বোধ করে না, কিন্তু নারী কেনো আত্মবিনাশ ঘটাবে ওই প্রেমেই? প্ৰেমকে কিংবদন্তিতে পরিণত করেছে পুরুষতন্ত্রই, তবে পুরুষ নিজেকে তার গ্রাস থেকে মুক্ত রেখে নারীকে ঠেলে দিয়েছে প্রেমের কারাল গ্রাসে। বাইরের জগত প্রেমের নয়, তা স্বাধীনতা ও সাফল্যের। ওই স্বাধীনতা ও সাফল্য রবীন্দ্রনাথ রেখেছেন। পুরুষের জন্যে, আর নারীকে গ্রস্ত ক’রে রেখেছেন প্রেমের ভাবালুতার মধ্যে! নারী হবে বাইরে সফল পুরুষের অনুরাগিণী। রবীন্দ্রনাথের নারীদের মধ্যে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বিদ্রোহী ‘স্ত্রীর পত্র’-এর (১৯১৪) মৃণাল। সে তার স্বামীকে জানিয়েছে, ‘আমি আর তোমাদের সেই সাতাশ-নম্বর মাখন বড়ালের গলিতে ফিরব না’; কারণ সে জেনেছে ‘সংসারের মাঝখানে মেয়েমানুষের পরিচয়টা’ কী। তবে সংসার ছেড়ে মৃণাল গিয়েছে শ্ৰীক্ষেত্রে সমুদ্রের ধারে জগদীশ্বরের কাছে। পুরুষ যে ওই জগদীশ্বরের নামেই তাকে মেয়েমানুষ ক’রে রেখেছে, তা জানে না মৃণাল। মৃণাল স্বামীর ঘরে ফিরে নাও আসতে পারে, তবে সে বাইরের জগতে প্রতিষ্ঠা পাবে না; তার বিদ্রোহ বাইরের জগতে প্রতিষ্ঠালাভের নয়। ঘরে-বাইরে উপন্যাসে পৃথক এলাকা তত্ত্ব প্রমাণের জন্যে রবীন্দ্রনাথ নিরীক্ষা চালিয়েছেন। বিমলার ওপর; এবং দেখিয়েছেন বাইরে গেলে নারী সর্বনাশ করে বাইরের ও ঘরের। বিমলার জীবন তখনি সার্থক যখন সে অবনত স্বামীপ্রেমে, আর ব্যর্থ যখন সে সাড়া দেয় বাইরের হাতছানিতে; চার অধ্যায় এ-তত্ত্বের আরেক নিরীক্ষা ও প্রমাণ। সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি রবীন্দ্রনাথের চোখে খুবই জঘন্য, আর তা চরম জঘন্য হয়ে ওঠে যখন তাতে যোগ দেয় নারী। নারী সন্ত্রাসে যাবে না, তারা যাবে প্রেমে; আর প্রেমের পবিত্র জায়গা হচ্ছে গৃহ, যেখানে নারী হবে তার স্বামীর খণ্ডকালীন খেলার পুতুল ও আমরণ দাসী।

রবীন্দ্রনাথের আমেরিকায় (১৯১৭) প্রদত্ত বক্তৃতার একগুচ্ছ প্রকাশিত হয় পারসনালিটি (১৯১৭) গ্রন্থে। বইটির শেষ নিবন্ধের নাম ‘নারী”। বইটি বাঙলাদেশে দুষ্পপ্ৰাপ্য ব’লে আমি পড়ার সুযোগ পাই নি, তবে কেতকী কুশারী (১৯৮৫, ২৪৮-২৫৩) পশ্চিম ও নারী সম্পর্কে এ-বইতে রবীন্দ্ৰমতের যে-পরিচয় দিয়েছেন, তাতে দেখা যায় এতে পশ্চিম ও নারী সম্পর্কে তাঁর পুরোনো ধারণারই (১৮৯১) পুনরাবৃত্তি করেছেন তিনি। দ্বিতীয়বার তিনি যখন ইউরোপে গিয়েছিলেন, তখন তিনি মনে মনে নিজেকে গণ্য করেছিলেন এক তরুণ ভারতীয় ঋষি ব’লে, এবং ইউরোপ সম্পর্কে উচ্চারণ করেছিলেন অনেক গ্ৰহণঅযোগ্য বাণী, তবে তখন পশ্চিম তাঁর বাণী শোনার জনো প্রস্তুত হয় নি। আমেরিকায় বক্তৃতার সময় তিনি নোবেলপ্রাপ্ত প্রাচ্যের পুরোহিত, যাঁর কথা টিকেট কেটে শুনতে চায় আমেরিকা, এবং তিনি পশ্চিমকে শোনান প্রচুর ভারতীয় কথামৃত। তিনি বলেন, পশ্চিমা সভ্যতা বড়ো বেশি পুরুষালি হয়ে উঠেছে ব’লেই ভরে গেছে সংকটে। এ-সংকটের সমাধান হচ্ছে নারী : ‘অবশেষে সে-সময় এসেছে, যখন প্ৰবেশ করতে হবে নারীকে, ক্ষমতার এ-বেপরোয়া গতির মধ্যে নারীকে সঞ্চারিত করতে হবে আপন জীবনছন্দ’ [দ্ৰ কেতকী (১৯৮৫, ২৪৮)]। রবীন্দ্রনাথ তিরষ্কার করছেন পুরুষ ও পশ্চিমের পুরুষালি সভ্যতাকে, কেননা পশ্চিমকে সমালোচনা করাই ছিলো তখন প্রাচ্য ঋষিত্ব; তবে তিনি তা করতে পারেন না, কেননা ‘পুরুষ’ বলতে তিনি বোঝেন যে অসামান্য ভাবকে, পশ্চিমের পুরুষ তা-ই। পুরুষ, রবীন্দ্ৰচেতনায়, কল্পনাপ্রতিভা, সৃষ্টি, গতি, অনন্ত অস্থিরতা, উদ্ভাবন, বিধাতা যাকে সম্পূর্ণ সৃষ্টি করতে পারে নি ব’লে যে নিরন্তর সৃষ্টি ক’রে চলছে নিজেকে। তাই তিনি পশ্চিমের পুরুষদের নিন্দা করতে পারেন না, কেননা তারা করেছে পুরুষেরই কাজ। রবীন্দ্রনাথ যেহেতু পশ্চিমকে বাণী শোনাতে গেছেন, তাই পশ্চিমের যে-পুরুষ কাজ করেছে তাঁরই আদর্শ অনুসারে, তাকেই তিনি আক্রমণ করেছেন। তবে এ-বাহ্যিক আক্রমণ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলে দেখি রবীন্দ্রনাথ সমালোচনা করেছেন আসলে নারীকেই, যারা নিজেদের জীবনছন্দ সঞ্চার করতে ব্যর্থ হয়েছে সভ্যতায়, তাই পশ্চিমের সভ্যতা ভরে গেছে সংকটে। রবীন্দ্রনাথের পুরুষধারণা ‘নারী’ (১৯৩৭) কবিতায় যেমন, গদ্যেও তেমনি; ‘পশ্চিম যাত্রীর ডায়ারি’তে (১৩৩৬) পুরুষ এমন :

‘পুরুষের কর্মপথে এখনো তার সন্ধানচেষ্টায় শেষ হয় নি। কোনো কালেই হবে না। অজানার মধ্যে কেবলই সে পথ খনন করছে, কোনো পরিণামের প্রান্তে এসে আজও সে অবকাশ পেলে না। পুরুষের প্রকৃতিতে সৃষ্টিকর্তার তুলি আপন শেষ রেখাটা টানে নি। পুরুষকে অসম্পূর্ণই থাকতে হবে (রর : ১৯, ৩৭৯)।
গতিবেগমত্ত পুরুষের চলমান সৃষ্টি সর্বদাই স্থিতির একটা মূল সুরকে কানে রাখতে চায়; পুরুষের শক্তি তার অসমাপ্ত সাধনার ভার বহন ক’রে চলবার সময় সুন্দরেব প্রবর্তনার অপেক্ষা রাখে (রবী; ১৯, ৩৮০)।‘

রবীন্দ্রনাথের পুরুষধারণার সাথে পশ্চিমের পুরুষকে মিলিয়ে নিলে দেখি পাশ্চাত্য পুরুষ অন্যায় করে নি কোনো; তারা যা করছে, তাকেই পুরুষের কাজ বলে মনে করেন রবীন্দ্রনাথ। পুরুষ সন্ধান করবে, গতিবেগমত্ত হয়ে ছুটে চলবে, উদ্ভাবন করবে, নিজের অসম্পূর্ণ রূপটিকে সম্পূর্ণ করে তুলবে। তাই পশ্চিমে যদি কোনো সংকট সৃষ্টি হয়ে থাকে, তা পুরুষের দোষ নয়, দোষ নারীরই; কেননা নারীই তার রবীন্দ্ৰকথিত ‘জীবনছন্দ সঞ্চার করতে পারে নি। সভ্যতায়, গতিবেগমত্ত পুরুষকে শোনাতে পারে নি তার স্থিতির মূল সুর’। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য নারীকে দোষী করতে চান না, দোষী করেন পশ্চিমের পুরুষকেই, কেননা তিনি দণ্ড দিতে চান পশ্চিমা সভ্যতাকে। এটা খুবই অন্যায় দণ্ড। রাসকিন বলেছিলেন পুরুষ যখন যুদ্ধ বাধায়, তার জন্যে পুরুষের চেয়ে নারীই বেশি দোষী; কেননা নারী তার নারীত্ব দিয়ে পুরুষকে শান্তির দিকে টেনে রাখতে পারে নি! রবীন্দ্রনাথও অনেকটা তাই বলেন, নারী সম্পর্কে তাঁর ধারণা রাসকিনের ধারণার মতোই। পুরুষ যোগাবে সভ্যতার গতি, নারী যোগাবে স্থিতি; তাহলেই সভ্যতা হয়ে উঠবে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতার মতো ছন্দাবেদ্ধ। পুরুষ গতি, তাই সে তার স্বাভাবিক গতিকে সঞ্চার করবেই সভ্যতায়; নারীর কাজ যদি হয় সভ্যতায় স্থিতি সঞ্চার করা, আর তা যদি না পারে নারী, তবে দণ্ড প্ৰাপ্য নারীরই। তাই রবীন্দ্ৰনাথ পশ্চিমের সভ্যতার সংকটের জন্যে মূল দোষী করেছেন নারীকে, যদিও রবীন্দ্রনাথ তা অবধান করেন নি। রবীন্দ্রনাথ সভ্যতায় নারীর যে-ভূমিকা নির্দেশ করেন, তা হচ্ছে ছক-বাঁধা কল্যাণীর ভূমিকা, যার কাজ পুরুষকে গৃহের স্থিতির মধ্যে মাঝেমাঝে স্থিত ক’রে পুরুষের অনন্ত গতিকে ছন্দোবদ্ধ করা। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘স্থিতির আদর্শ নারীর প্রকৃতি-দ্বারা গভীরভাবে সমাদৃত’, নারীর কাজ হচ্ছে ‘জীবনের পোষণ, সংরক্ষণ ও আরোগ্যসাধন’। নারীর যে-প্রকৃতি ও ভূমিকা তিনি নির্দেশ করেছেন, তা নারীকে সীমাবদ্ধ করে রাখে গৃহে, আর তাকে পংক্তিভুক্ত ক’রে রাখে আদিম পশুরই সাথে। তিনি মনে করেন, নারীর দায়িত্ব ছিলো পশ্চিমা সভ্যতার সেবিকারূপে আবির্ভূত হওয়া, নারী হবে সভ্যতার ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, কিন্তু নারী তা পারে নি। রবীন্দ্রনাথ নারীকে প্রকাশ্যে দোষী করেন নি; কিন্তু পশ্চিমা সভ্যতার সংকটের দায়ভার, রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনছন্দ’ ও ‘স্থিতির মূল সুর’ তত্ত্বানুসারে, বইতে হচ্ছে নারীকেই। রবীন্দ্রনাথ আগের মতো এ-প্রবন্ধেও বলেন যে নারীর স্থান হচ্ছে গৃহ। রাসকিনের মতোই গৃহকে একটু সম্প্রসারিত করে বলেন, ‘মানবিক জগতই নারীর জগত’ [দ্র কেতকী (১৯৮৫, ২৮৪-২৮৫)]। তবে ওই মানবিক জগত গৃহেরই সম্প্রসারিত রূপ; সেখানে সেবা আছে, গ্ৰীতি আছে, কল্পনাপ্রতিভা নেই, আবিষ্কার বা সৃষ্টি নেই।

রবীন্দ্রনাথের নারী জৈবিক। জৈবিক হওয়ার অর্থ হচ্ছে নারী মানুষ হয়ে ওঠে নি; তার কাজ সন্তান ধারণ আর লালন ক’রে সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখা। পুরুষের কাজ সভ্যতা সৃষ্টি করা। রবীন্দ্রনাথের নারীর মূল কাজ যেখানে গর্ভধারণ আর প্রসব, সেখানে পুরুষের কাজ হচ্ছে সভ্যতা সৃষ্টি; মৃণালিনী দেবীর গর্ভধারণ করবে, টিকিয়ে রাখবে মানবপ্রজাতিকে, আর রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ক’রে চলবেন সভ্যতা। প্রাণসৃষ্টি এক দরকারি আদিম কাজ, সেটা সভ্যতা সৃষ্টি নয়, ওই কাজটি নারীর; ওই কাজ কাউকে মহৎ বা মানুষ করে না। পুরুষ করে সভ্যতা সৃষ্টির মহৎ কাজ; রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘এই প্রাণসৃষ্টি-বিভাগে পুরুষের প্রয়োজন অত্যত্র, এইজন্যে প্রকৃতির একটা প্রবল তাগি থেকে পুরুষ মুক্ত। প্রাণের ক্ষেত্রে ছুটি পেয়েছে ব’লেই চিত্তক্ষেত্রে সে আপন সৃষ্টিকার্যের পত্তন করতে পারলে। সাহিত্যে কলায় বিজ্ঞানে দর্শনে ধর্মে বিধিব্যবস্থায় মিলিয়ে যাকে আমরা সভ্যতা বলি সে হল প্রাণপ্ৰকৃতির পলাতক ছেলে পুরুষের সৃষ্টি’ (পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি, রর : ১৯, ৩৮০)। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেন ‘জীবনের পোষণ, সংরক্ষণ’, তা কোনো কৃতিত্বের ব্যাপার নয়, তাকে রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নারীর প্রধান সীমাবদ্ধতা। রবীন্দ্ৰনাথ সভ্যতা থেকেই বহিষ্কার ক’রে দিয়েছেন নারীকে তিনি মনে করেন সভ্যতা সম্পূর্ণরূপে পুরুষের সৃষ্টি; এবং পুরুষ তা পেরেছে, কেননা পুরুষকে জীবন পোষণ আর সংরক্ষণ করতে হয় নি। এ-সভ্যতা যে পুরুষতান্ত্রিক, তাতে সন্দেহ নেই; কিন্তু সভ্যতা শুধু পুরুষের সৃষ্টি নয়, নারী আছে এর ভিত্তিতে আর ওপরকাঠামোতে, কিন্তু পুরুষাধিপত্যবাদীদের মতো রবীন্দ্রনাথের তা মনে পড়ে নি। তিনি বলেন, ‘প্ৰাণের টানে মেয়ে আটকা পড়েছে আর পুরুষ ছুটেছে মনের তাড়ায়’ (পশ্চিমাযাত্রীর ডায়ারি, রব : ১৯, ৩৮২)। দুটি বিপরীত বস্তু পাচ্ছি। এখানে : প্ৰাণ আর মন; নারী ওই প্রাণসৃষ্টি সৃষ্টি করে চলছে সভ্যতা। এর অর্থ হচ্ছে নারী মানহীন প্রাণী, যার কাজ নিজের অভ্যন্তরে নতুন প্রাণ সৃষ্টি করা। নারী যেখানে জৈবস্তরে রয়ে গেছে, সেখানে পুরুষ উত্তীর্ণ হয়েছে অভিনব দেবতার স্তরে :

‘মেয়েদের সৃষ্টির আলো যেমন এই প্রেম তেমনি পুরুষের সৃষ্টিব আলো কল্পনাবৃত্তি। পুরুষের চিত্ত আপন ধ্যানেব দৃষ্টি দিয়ে দেখে, আপনি ধ্যানের শক্তি দিয়ে গড়ে তোলে। We are the dreamers of dreams-এ কথা পুরুষের কথা। পুরুষের ধ্যানই মানুষের ইতিহাসে নানা কীর্তির মধ্যে নিরন্তর রূপ পরিগ্রহ কবছে।… নারীর সৃষ্টি ঘরে, এই জন্যে সব-কিছুকেই সে যত্ন করে জমিয়ে রাখতে পারে: তাব ধৈর্য বেশি কেননা, তার ধারণার জায়গাটা বড়ো। পুরুষের সৃষ্টি পথে পথে, এই জন্যে সব-কিছুর ভার লাঘব করে দিয়ে সমগ্রকে সে পেতে ও রাখতে চায়। এই সমগ্রের তৃষ্ণা, এই সমগ্রের দৃষ্টি, নির্মম পুরুষের কত শত কীর্তিকে বহুব্যয়, বহুত্যাগ, বহু পীড়নের উপন: স্থাপিত করেছে।…পুরুষের কল্পনাবৃত্তির সাহস এত অত্যন্ত বেশি তার কারণ, স্থিতির ক্ষেত্রে স্থির হযে বসে বিচিত্রের সহস্ৰ খুঁটিনাটিকে মমত্বের আঁকড়ি দিয়ে জড়িয়ে ধরবার দীর্ঘ সময় তাব কখনো ছিল না। এই জন্যে সৃষ্টির প্রয়োজনে প্ৰলয় করতে তার দ্বিধা নেই (পশ্চিমাযাত্রীর ডায়ারি, রব : ১৯, ৩৮৫-৩৮৬)।

এ-বৰ্ণনায় নারী সামান্য প্রাণী পুরুষের তুলনায়; নারীর রয়েছে তুচ্ছ প্রেম আর গৃহ, তাও পুরুষেরই জন্যে; আর পুরুষের রয়েছে ‘কল্পনাবৃত্তি’, রয়েছে ‘ধ্যানের দৃষ্টি’, সে সৃষ্টি করে ‘ধ্যানের শক্তি দিয়ে’। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছিলো ও’শনেসির “আমরা সঙ্গীতরচয়িতা, /এবং আমরা স্বপ্নের স্বাপ্লিক” পংক্তিগুচ্ছ, অনেক স্থানে তিনি এগুলো উল্লেখ করেছেন কবির নাম না নিয়ে- মূল কবির নাম না নেয়া তার স্বভাব (যেমন The Religion of Man -এ ‘The Music Maker’ পরিচ্ছেদে), এখানে উল্লেখ করেছেন; এবং রবীন্দ্রনাথের পুরুষ হচ্ছে সঙ্গীতরচয়িতা, স্বপ্নের স্বাপ্লিক, তার ধ্যান রূপ পরিগ্রহ করছে নানা কীর্তির মধ্যে। পুরুষ তৈরি করে চলছে নতুন পথ, সমগ্রের তৃষ্ণায় আর্ত তার প্রকৃতি, এবং সৃষ্টির জনো ধ্বংস করতেও পুরুষ দ্বিধাহীন তাই দু-দুটি মহাযুদ্ধ এবং সভ্যতার সংকটের জন্যে রবীন্দ্রনাথ দায়ী করতে পারেন না পশ্চিমের পুরুষকে, কেননা তারা সৃষ্টির প্রয়োজনে আয়োজন করেছিলো প্রলয়ের। এ-পুরুষের তুলনায় নারী একটি জরায়ু। পুরুষের পুরুষতান্ত্রিক ভাববাদী মহত্ত্ব বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ অক্লান্ত :

[ক] পুরুষের অধ্যবসায়ের কোথাও সমাপ্তি নেই, এইজন্যেই সুসমাপ্তির সুধারাসের জন্যে তার অধ্যবসায়ের মধ্যে একটা প্রবল তৃষ্ণা আছে। মেয়েদের হৃদয়ের মাধুর্য এই রসই তাকে পান করায়। পুরুষের সংসারে কেবলই চিন্তার দ্বন্দু, সংশয়ের দোলা, তর্কের সংঘাত, ভাঙাগড়ার আবর্তন—এই নিরন্তর প্রয়াসে তার ক্ষুব্ধ দোলায়িত চিত্ত প্ৰাণলোকের সরল পরিপূর্ণতার জন্যে ভিতরে ভিতরে উৎসুক হয়ে থাকে (পশ্চিমাযাত্রীর ডায়ারি, রব : ১৯,৩৮১)।

[খ] পুরুষ তার আপনি জগতে বারে বারে নূতন আগন্তুক। আজ পর্যন্ত কতবার সে গড়ে তুলেছে আপন বিধিবিধান। বিধাতা তাকে তার জীবনের পথ বাঁধিয়ে দেন নি; কত দেশে কত কালে তাকে আপন পথ বানিয়ে নিতে হল (‘নারী’, কালাস্তর, রব : ২৪, ৩৭৮)।

[গ] পুরুষের সৃষ্টি বিনাশের মধ্যে তলিয়ে যায়, নূতন করে বাঁধতে হয় তার কীর্তির ভূমিকা।…পুরুষের বিচিত সভ্যতায় আদিকাল থেকে এইরকম ভাঙা-গড়া চলছে (‘নারী’, কালান্তর, রব : ২৪, ৩৭৮)।

[ঘ] নানা বিঘ্ন কাটিয়ে অবস্থার প্রতিকূলতাকে বীর্যের দ্বারা নিজের অনুগত করে পুরুষ মহত্ত্ব লাভ করে (‘নারী’ কালান্তর, রব : ২৪, ৩৭৯)।

রবীন্দ্রনাথের পুরুষ নিরন্তর সক্রিয় দেবতা, সে বিধাতার থেকেও শক্তিমান; সে অবিরাম সৃষ্টি ক’রে চলছে নিজেকে, সম্পূর্ণ করছে বিধাতার অসম্পূর্ণ কাজ। রাসকিনের মতোই বলেছেন রবীন্দ্রনাথ যে পুরুষের কেবলই চিন্তার দ্বন্দ্ব, সংশয়, সংঘাত, ভাঙাগড়া; নারী হচ্ছে ওই দেবতার শান্তির পানীয়। রবীন্দ্রবিশ্বে নারীর প্রয়োজন বেশি নয়, পুরুষকে সন্তান ও প্ৰেম দেয়ার জন্যেই দরকার নারী। পুরুষ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা ভাববাদী ও পুরুষতান্ত্রিক।

পুরুষ, রবীন্দ্রনাথের ধারণা, পুরুষ হয়েছে এজন্যে যে প্রাণসৃষ্টিতে পুরুষের ভূমিকা ক্ষণউত্তেজনার; আর নারী নারী হয়েছে ওই প্রাণ সৃষ্টি, পোষণ আর সংরক্ষণ করতে গিয়েই। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন আদিম শেকলে নারীকে বেঁধেছে। প্রকৃতি, তাই নারী রয়ে গেছে প্রাকৃতিক আদিম স্তরে। নারীর এ-আদিমতার কথা রবীন্দ্রনাথ বারবার বলেছেন, এমনকি ১৩৪৩-এ নিখিলবঙ্গ-মহিলা কর্মীসম্মিলনে যখন তিনি ‘নারী’ বিষয়ে প্ৰবন্ধ পড়েন, তখনও নারীদের তাদের আদিমতার কথা স্মরণ করাতে ভোলেন নি। রবীন্দ্ৰচেতনায় নারী :

[ক] জীবপ্রকৃতিব একটা বিশেষ অভিপ্রায় তার মধ্যে চরম পরিণতি পেয়েছে। সে জীবধাত্রী, জীবপালিনী: তাব সম্বন্ধে প্রকৃতির কোনো দ্বিধা নেই। প্রাণসৃষ্টি প্রাণপালন ও প্ৰাণতোষণের বিচিত্র ঐশ্বৰ্য তার দেহে মনে পর্যাপ্ত (পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি, রব : ১৯, ৩৮০)।

[খ] প্ৰকৃতির ব্যবস্থায় মেয়ের একটা জায়গা পাকা করে পেয়েছে, পুরুষরা তা পায় নি (পশ্চিমাযাত্রীর ডায়ারি, রব : ১৯, ৩৮৩)।

[গ] মানুষের সৃষ্টিতে নারী পুরাতনী। নারীসমাজে নারীশক্তিকে বলা যেতে পারে আদ্যাশক্তি। এই সেই শক্তি যা জীবলোকে প্রাণকে বহন করে, প্ৰাণকে পোষণ করে।…প্রাণসাধনার সেই আদিম বেদন প্রকৃতি দিয়েছেন নারীর রক্তে, নারীর হৃদয়ে। জীবপালনের সমস্ত প্ৰবৃত্তিজাল প্রবল করে জড়িত করেছেন নারীর দেহামনের অন্তুতে অন্তুতে। এই প্রবৃত্তি স্বভাবতই চিত্তবৃত্তির চেযে হৃদয়বৃত্তিতেই স্থান পেয়েছে গভীর ও প্রশস্তভাবে। এই সেই প্রবৃত্তি নারীর মধ্যে যা বন্ধনজাল গাঁথছে নিজেকে ও অন্যকে ধরে রাখবার জন্যে প্রেমে, মেহে, সকরুণ ধৈৰ্যে। মানবসংসারকে গড়ে তোলবার, বেঁধে রাখবার এই আদিম বাঁধুনি (‘নারী’, কালান্তর, রুর : ২৪, ৩৭৭)।

[ঘ] তাই গৃহে নারী যেমনি প্রবেশ করেছে কোথা থেকে অবতীর্ণ হল গৃহিণী, শিশু যেমনি কোলে এল মা তখনই প্রস্তুত। জীবরাজ্যে পরিণত বুদ্ধি এসেছে অনেক পরে (নারী’, কালান্তর, রব ২৪, ৩৭৮)।

পারসন্যালিটিতে (১৯১৭) রবীন্দ্রনাথের যে-কথা কেতকী কুশারীর (১৯৮৫, ২৪৮) অনুবাদে হয়েছে ‘জীবনের পোষণ, সংরক্ষণ ও আরোগ্যসাধনা’, তাকে রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমাযাত্রীর ডায়ারিতে (১৩৩৬) বলেছেন, ‘প্রাণসৃষ্টি প্রাণপালন ও প্রাণতোষণ’; এবং এ-ই হচ্ছে নারীর মৌল কাজ। নারীর এ-কাজটি আদিম জৈবিক, এবং রবীন্দ্রনাথের মতে এটা উদ্দেশ্যহীন ঘটনা নয়; ‘জীবপ্রকৃতির একটা বিশেষ অভিপ্ৰায়’ নারীর মধ্যে ‘চরম পরিণতি পেয়েছে’। নারী হচ্ছে প্রকৃতির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জরায়ুসম্বলিত জীব। প্রকৃতি দ্বিধাহীনভাবে প্রাণসৃষ্টির দায়িত্ব দিয়েছে নারীকে। একথা তিনি ১৯১৭তে, ১৯১৯-এ, ১৯৩৬-এ বলেছেন; এবং এতে বিশ্বাস করেন তিনি যৌবনকাল থেকেই। ১৯৩৬-এ তিনি নারীদের সভায়ই বলেছেন, ‘মানুষের সৃষ্টিতে নারী পুরাতনী’; নারী ‘জীবলোকে প্রাণকে বহন করে, প্ৰাণকে পোষণ করে’, ‘প্রাণসাধনার সেই আদিম বেদনা প্রকৃতি দিয়েছেন নারীর রক্তে’, এবং জীবপালনের সমস্ত প্রবৃত্তিজাল প্রবল করে জড়িত করেছেন নারীর দেহমানের তত্ত্বতে তন্তুতে।’ নারী সন্তানধারণ করে, প্রসব করে এটা সত্য; তবে রবীন্দ্রনাথ এখানে নারীকে প্রকৃতির সঙ্গে যেভাবে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে দিয়েছেন, তাতে প্ৰকাশ পেয়েছে নারী সম্পর্কে তাঁর ভাববাদী পুরুষতান্ত্রিক ধারণা। পুরুষতন্ত্র এমন ধারণা পোষণ করে যে নারী পুরুষের থেকে অনেক বেশি ‘প্রাকৃতিক’; ভারতীয় অঞ্চলে প্রকৃতি ও নারীর ভেদ অস্বীকার করে নারীকে ‘প্রকৃতি’ই বলা হয়। পুরুষতন্ত্র মনে করে যে নারী অচ্ছেদ রূপে জড়িত প্রকৃতির সাথে, তাই নারীর পক্ষে অসম্ভব প্রকৃতি থেকে উত্তীর্ণ হওয়া। অন্যদিকে পুরুষের রয়েছে দ্বৈত প্রকৃতি : পুরুষ তার দ্বিতীয় প্রকৃতির সাহায্যেই সৃষ্টি করে সভ্যতা। পুরুষ সম্বন্ধে ভাববাদী ধারণা জোর দেয় পুরুষের এ-দ্বিতীয় প্রকৃতির ওপর, যেমন জোর দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, এবং পুরুষকে ক’রে তুলেছেন দেবতা। পুরুষতন্ত্র নারীর জন্যে নির্দেশ করেছে একক প্রকৃতি, যা জড়িত আদিম জৈবিকতার সাথে; আর পুরুষের জন্যে দ্বৈত প্ৰকতি, যার দ্বিতীয়টি পুরুষকে করেছে। জৈবিকতা-পেরিয়ে-যাওয়া মানুষ। এটা শুধু পুরুং, তন্ত্রের দার্শনিকতা নয়, এর রয়েছে বাস্তব রূপ : এটা জীবনকে ভাগ করেছে দুটি পৃথক এলাকায়, একটি গাৰ্হস্থ ও অন্যটি সামাজিক জীবন। পুরুষ জীবন যাপন করে দু-এলাকায়ই, তবে সামাজিক এলাকায়ই পুরুষ যাপন করে তার মানবিক জীবন। গাৰ্হস্থ্য জীবন হচ্ছে পুরুষের জৈবিক জীবন, আর সামাজিকটি তার মানবিক জীবন। গাৰ্হস্থ্য জীবন হচ্ছে প্রকৃতির, প্রয়োজনের, অস্বাধীনতার জীবন, যেখানে বাস করে নারী; আর পুরুষ এ-জীবনকে পেরিয়ে সামাজিক জীবনে লাভ করে মনুষ্যত্ব, স্বাধীনতা। নারী গাৰ্হস্থ্যু জৈবিকতার জীবনে জড়িয়ে আছে রবীন্দ্ৰকথিত ‘প্রাণসৃষ্টি প্রাণপালন ও প্রাণতোষণের’ জন্যে, এবং এটাকে তিনি ও পুরুষতন্ত্র একটা পাশবিক কাজ ব’লেই মনে করেন। এর প্রভাব এতো প্রবল যে নারীবাদী দ্য বোভোয়ারও মনে করেছেন যে সন্তানধারণ ও প্রসব একটি হীন পাশবিক কাজ, এবং নারী অভিশপ্ত এ-জৈবিক অভিশাপে। এ-অভিশাপের ফলেই নারী বন্দী হয়ে আছে গৃহে, আদিম প্রকৃতির শেকলে জড়িয়ে আছে, তার মুক্তি নেই। নারী বন্দী হয়ে আছে মানবপ্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার অমানবিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই! শুলামিথ ফায়ারস্টোন এ-তত্ত্বটিকে তার যৌক্তিক উপসংহারে নিয়ে গিয়ে বলেছেন, নারী-অধীনতার মূল কারণ হয় যদি সন্তানপ্রজনন, তাহলে নারীমুক্তির জন্যে দরকার নারীর সন্তানধারণ করতে অস্বীকার করা [দ্র ওব্রিয়েন (১৯৮২, ১০৪)]। মানবপ্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নারীর নয়; পুরুষ যদি চায় যে টিকে থাকুক মানবপ্রজাতি, তাহলে তাকে উদ্ভাবন করতে হবে সে-প্ৰযুক্তি, যা টিকিয়ে রাখবে মানবপ্রজাতিকে।

রবীন্দ্রনাথ নারীকে গৃহে দেখতে চান, এবং সব সময় মনে করেছেন প্রকৃতিই নারীর মধ্যে নিজের অভিপ্ৰায় বাস্তবায়িত করার জন্যে নিয়েছে। এ-ব্যবস্থা। পুরুষই যে নারীকে ঢুকিয়েছে ঘরে, একথা তিনি স্বীকার করতে চান নি। ১৯৩৬-এ নারীদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি এ-মত কিছুটা বদলান; স্বীকার করেন, ‘মেয়েদের হৃদয়মাধুর্য ও সেবানৈপুণ্যকে পুরুষ সুদীর্ঘকাল আপনি ব্যক্তিগত অধিকারের মধ্যে কড়া পাহারার বেড়া দিয়ে রেখেছে’ (‘নারী’, কালান্তর, রব : ২৪, ৩৭৯)। পুরুষকে এবার তিনি স্নেহের সাথে দায়ী করেন; এবং সাথেসাথে উচ্চারণ করেন এক সাংঘাতিক কথা : ‘মেয়েদের নিজের স্বভাবেই বাঁধন-মানা প্রবণতা আছে, সেইজন্যে এটা সর্বত্রই এত সহজ হয়েছে‘ (ওই, ৩৭৯)। অর্থাৎ নারীদের মধ্যে রয়েছে জন্মক্রীতদাসের বৈশিষ্ট্য, তাই পুরুষ পেরেছে নারীকে বন্দী করতে। পুরুষ যে-জন্যে গৃহে অবরুদ্ধ করেছে নারীকে, তা হচ্ছে ‘হৃদয়মাধুর্য ও সেবানৈপুণ্য’, বা নারীত্ব, যা নারী পেয়েছে প্রকৃতির কাছ থেকে। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নারীর থাকতেই হবে ওই গুণ : ‘প্রকৃতির কাছ থেকে তারা পেয়েছে অশিক্ষিতাপটুত্ব, মাধুর্যের ঐশ্বর্য তাদের সহজে লাভ করা। যে মেয়ের স্বভাবের মধ্যে দুর্ভাগ্যক্রমে সেই সহজ রসটি না থাকে, কোনো শিক্ষায়, কোনো কৃত্রিম উপায়ে সংসারক্ষেত্রে সে সার্থকতা পায় না’ (ওই, ৩৭৯)। রবীন্দ্রনাথের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান হচ্ছে ছকবাধা নারীত্ব নামের ‘সহজ রসটি’, যার অভাবকে তিনি মনে করেন ‘দুৰ্ভাগ্য’। কোনো শিক্ষাই ওই রসাভাবের ক্ষতিপূরণ করতে পারে না; নারী কবি, বৈজ্ঞানিক, প্রধান মন্ত্রী হ’লেও বা নোবেল পুরস্কার পেলেও কিছু যায়-আসে না, ওই সব নারীর দুর্ভাগ্য মাত্র। তার সব সাফল্যই, রবীন্দ্ৰমতে, চরম ব্যর্থতা, যদি তার না থাকে ওই সহজ রসটি।

রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নারীর পক্ষে কবি-বৈজ্ঞানিক-প্রধান মন্ত্রী হওয়া অস্বাভাবিক, কেননা নারী সহজাতভাবেই পায় নি মানুষের সে-গুণ, যা দরকার ওই সব সামাজিক-মানবিক সাফল্যের জন্যে। ‘পুরুষের আছে বীৰ্য আর মেয়েদের আছে মাধুর্য’; আর ‘মেয়েদের সৃষ্টির আলো যেমন এই প্ৰেম তেমনি পুরুষের সৃষ্টির আলো কল্পনাবৃত্তি’ (পশ্চিম যাত্রীর ডায়ারি, রব; ১৯, ৩৭৯, ৩৮৫)। প্ৰেম-মাধুর্য নারীকে গৃহে আটকে রাখে, তা মধুর ও আলোকিত করে ঘরকে; আর পুরুষের বীর্য ও প্রতিভা উপভোগ ও আলোকিত করে বিশ্ব ও সভ্যতাকে। নারীর ব্যর্থতার মূলে তার জরায়ু; রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘বস্তৃত জীবপালনের কাজটাই ব্যক্তিগত। সেটা নৈর্ব্যক্তিক তত্ত্বের কোঠায় পড়ে না, সেই কারণে তাঁর আনন্দ বৃহৎ তত্ত্বের আনন্দ নয়; এমন-কি, মেয়েদের নৈপুণ্য যদিও বহন করেছে রস, কিন্তু সৃষ্টির কাজে আজও যথেষ্ট সার্থক হয় নি’ (‘নারী’, কালাস্তর, রব :২৪, ৩৭৯)। পিতৃতন্ত্রের প্রতিনিধিরা এমন বিশ্বাস পোষণ ও প্রচার করেছেন ধর্মগ্রন্থে, দর্শনশাস্ত্রে, সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, ও তাদের সব কিছুতে; নারীর প্রতিভার সৃষ্টিকে তারা শুধু অবহেলাই করেন নি, নারীর প্রতিভা থাকতে পারে বলেই বিশ্বাস করেন নি তারা। নারীর প্রতিভাহীনতার কারণ তার জরায়ু, তার অপরাধ সে পালন করে মানুষকে গর্ভে ধারণের মতো অমানবিক কাজ। নারী কীভাবে কাটাবে তার এ-প্রতিবন্ধিতা? যদি জরায়ই তার শক্ৰ হয়, তাহলে জরায়ুকেই বাতিল ক’রে দিতে হবে তার। নারীকে যদি সৃষ্টশীল হতে হয়, তাহলে সন্তানধারণ ও লালনের ব্যক্তিগত কাজ অস্বীকার ক’রে মন দিতে হবে নৈর্ব্যক্তিক কাজে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ নারীকে নৈব্যক্তিক কাজের এলাকায় ঢোকার অনুমতি দিতে রাজি নন।

নারী কী কাজের উপযুক্ত, ঘরের বাইরে গেলে নারীকে মানায় কোন কাজে? নারীর মানানসই কাজের নমুনা রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন জাপানযাত্রীতে (১৯১৯)। বর্মীনারীদের কর্মের হিল্লোল দেখে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ তাদের দিয়েছেন। এ-প্ৰশংসাপত্ৰ :

‘লোকের কাছে শুনতে পাই এখানকার পুরুষেরা অলস ও আরামপ্ৰিয়, অন্য দেশের পুরুষের কাজ প্রায সমস্তই এখানে মেয়েরা কবে থাকে। হঠাৎ মনে আসে, এটা বুঝি মেয়েদের উপরে জুলুম করা হয়েছে। কিন্তু, ফলে তো তার উলটোই দেখতে পাচ্ছি–এই কাজকর্মের হিল্লোলে মেয়েরা আরো যেন বেশি করে বিকশিত হয়ে উঠেছে। কেবল বাইরে বেরতে পারাই যে মুক্তি তা নয়, অবাধে কাজ করতে পাওয়া মানুষের পক্ষে তাধ চেয়ে বড়ো মুক্তি। পরাধীনতাই সব চেয়ে বড়ো বন্ধন নয়, কাজের সংকীর্ণতাই হচ্ছে সব চেয়ে কঠোর খাঁচা।

এখানকাব মেয়েরা সেই খাঁচা থেকে ছাড়া পেয়ে এমন পূর্ণতা ও আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তারা নিজের অস্তিত্ব নিয়ে নিজের কাছে সংকুচিত হয়ে নেই; রমণীর লাবণ্যে যেমন তারা প্রেয়সী, শক্তির মুক্তিগৌরবে তেমনি তারা মহীয়সী! কাজেই যে মেয়েদের যথার্থ শ্ৰী দেয়, সাঁওতাল মেয়েদের দেখে তা আমি প্রথম বুঝতে পেরেছিলুম। তারা কঠোর পরিশ্রম করে, কিন্তু কারিগর যেমন কঠিন আঘাতে মূর্তিটিকে সুব্যক্ত করে তোলে তেমনি এই পরিশ্রমের আঘাতেই এই সাঁওতাল মেয়েদের দেহ এমন নিটোল, এখন সুব্যক্ত হয়ে ওঠে; তাদের সকল প্রকার গতিভঙ্গিতে এমন একটা মুক্তির মহিমা প্ৰকাশ পায়’ (জাপানযাত্রী, রক্স : ১৯, ৩১৫০)।

কী কাজ করতে দেখেছেন তিনি ওই নারীদের? অধ্যাপকের, চিকিৎসকের, প্রকৌশলীর, বিজ্ঞানীর, পৌরপতির, সেনাপতির, মন্ত্রীর? এমন কোনো কাজে তিনি দেখেন নি তাদের; দেখেছেন হয়তো মেয়েরা বাজারে যাচ্ছে, চাষ করছে, পানি আনছে, মাঠে গরু নিয়ে যাচ্ছে, বা কারখানায় করছে শ্রমিকের কাজ। তিনি মনে করেন এ-ধরনের কাজে বিকশিত হয় মেয়েরা। তিনি উপলব্ধি করেছেন যে কাজই মেয়েদের যথার্থ শ্ৰী দেয়, কিন্তু তিনি কি চাইবেন জোড়াসাঁকোর মেয়েরাও ওই ধরনের কাজ ক’রে অর্জন করুক ‘যথাৰ্থ শ্ৰী’? তিনি তা চাইবেন না; তাই রবীন্দ্রনাথ বর্মীনারীদের যে-প্ৰশংসাপত্র দিয়েছেন, তার মূল্য বেশি নয়। পৃথিবী জুড়েই মেয়েরা চিরকাল ধ’রে এ-ধরনের নিম্নকাজ করে আসছে, তা সৌন্দর্যসৃষ্টির জন্যে নয়; সামাজিক ব্যবস্থাই তাদের বাধ্য করেছে এসব কাজে। সাঁওতাল মেয়েদের কাজেরও তিনি প্রশংসা করেছেন, তাদের কাজের থেকে অবশ্য তার চোখে বেশি পড়েছে ওই নারীদের দৈহিক নিটোলতা। কাজ তাদের দেহকে নিটোল করে নি, কাজ নারীদেহকে নিটোল করলে পৃথিবী জুড়েই দরিদ্র নারীদের দেহ নিটোল হতো, রূপসীশ্রেষ্ঠরা দেখা দিতো সামাজিক শূদ্ৰদের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন বাইরের শারীরিক কাজ মেয়েরা ভালোই করতে পারে, এবং এটা যদি তারা করে, বেশ হয়, বা মেয়েদের খামোখা বাইরে বেরোনো ঠিক নয়, তাদের বাইরে বেরোনো উচিত শুধু কাজ করতে। তিনি মুগ্ধ হয়েছেন নারীদের ভূমিদাসী বা শ্রমিকের কাজ করতে দেখে।

তিনি মনে করেন মেয়েরা ভালো দাসীবৃত্তিতেই; জাপানি দাসীদের দেখে তাঁর মনে হয়েছে :

‘এখানকাব ঘরকন্নার মধ্যে প্রবেশ কলে সব-চেয়ে চোখে পড়ে জাপানি দাসী। … যেন মানুষের সঙ্গে পুতুলের সঙ্গে, মাংসের সঙ্গে মোমের সঙ্গে মিশিয়ে একটা পদার্থ: আর সমস্ত শরীরে ক্ষিপ্ৰতা, নৈপুণ্য, বলিষ্ঠতা।… জানালার বাইরে চেয়ে দেখলুম, প্রতিবেশীদের বাড়িতে ঘবকন্নার হিল্লোল তখন জাগতে আরম্ভ করেছে–সেই হিল্লোল মেয়েদের হিল্লোল। ঘরে ঘরে এই মেয়েদের কাজের ঢেউ এমন বিচিত্র বৃহৎ এবং প্রবল ক’রে সচরাচব দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু, এটা দেখলেই বোঝা যায়, এমন স্বাভাবিক আর কিছু নেই। দেহযাত্ৰা জিনিসটার ভাব আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত মেয়েদেরই হাতে; এই দেহযাত্রার আযোজন উদ্যোগ মেয়েদের পক্ষে স্বাভাবিক এবং সুন্দর। কাজেই এই নিয়ত তৎপরতায় মেয়েদের স্বভাব যথার্থ মুক্তি পায় ব’লে শ্ৰীলাভ করে। বিলাসের জড়তায় কিম্বা যে-কারণেই হোক, মেয়েরা যেখানে এই কর্মতৎপরতা থেকে বঞ্চিত সেখানে তাদের বিকার উপস্থিত হয়, তাদের দেহমনের সৌন্দর্যহানি হতে থাকে, এবং তাদের যথার্থ আনন্দের ব্যাঘাত ঘটে (জাপানযাত্রী, রব : ১৯, ৩৩৫)।

রবীন্দ্রনাথের জাপানি দাসীবন্দনার নিচে লুকিয়ে আছে নারীদের কর্মযোগ্যতা সম্বন্ধে এক ভীতিকর দর্শন : দাসীবৃত্তি নারীদের জন্যে স্বাভাবিক। নারীদের রূপান্তরিত করতে হবে দাসী নামের পদার্থে, একাকার করে দিতে হবে মানুষ-মোম-মাংসকে; তারা হিল্লোল জাগিয়ে কাজ করবে, এতে তাদের স্বভাব বিকাশ লাভ ক’রে হয়ে উঠবে সুন্দর। ‘স্বাভাবিক’ হচ্ছে ‘প্রাকৃতিক’-এর অন্যনাম; তাই রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নারীদের দাসীবৃত্তি প্রাকৃতিক। নারীদের বিলাস অবৈধ, কাজ না করলে বিকৃত হয় নারীরা, হানি ঘটে তাদের দেহমানসৌন্দর্যের। মনু বিধান দিয়েছিলেন যে নারীদের কাজ দিয়ে ব্যস্ত রাখতে হবে সব সময়, নইলে নারীরা পরপুরুষের চিন্তায় নষ্ট হয়ে যাবে; বাইবেলে ঈশ্বর ও গুণবতী ভাৰ্যার প্রশংসা করে বলেছে যে সে আলস্যের খাদ্য খায় না। জাপানি দাসীরা আলস্যের অন্ন তো খায়ই না, বরং তারা কাজকে পরিণত করে সৌন্দর্যের হিল্লোলে, বা কর্মনাট্যে, যা অনুমোদন করবেন মনু আর ঈশ্বর, যার বন্দনা করেন রবীন্দ্রনাথ। নারীরা শুধু দাসীত্বে সফল নয়, রবীন্দ্ৰনাথ দেখেছেন তারা ব্যবসাও করতে পারে :

‘এই ব্যবসাটি এই স্ত্রীলোকেরই নিজের হাতে তৈরি। আমি যে-কথা বলছিলুম এই ব্যবসায়ে তারই প্রমাণ দেখতে পাই। মানুষের মন বোঝা এবং মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধ রক্ষা করা স্ত্রীলোকের স্বভাব সিদ্ধ;… কর্মকুশলতা মেয়েদের স্বাভাবিক।…যে-সব কাজে দৈহিক বা মানসিক সাহসিকতার দরকার হয় না সে-সব কাজ মেয়েরা পুরুষের চেয়ে ঢের ভালো করে করতে পারে, এই আমার বিশ্বাস।… যে-সব কাজে উদ্ভাবনার দরকার নেই, যে-সব কাজে পটুতা পরিশ্রম ও লোকের সঙ্গে ব্যবহারই সব-চেয়ে দরকার, সে-সব কাজ মেয়েদের’ ( জাপানযাত্রী, রব :১৯, ৩২৩)।

রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার করেছেন নারীদের কয়েকটি স্বাভাবিক বা প্ৰাকৃতিক বৈশিষ্ট্য : নারীরা মানুষের মন বুঝতে পারে; মানুষের সাথে সম্বন্ধ রক্ষা করতে পারে; এবং তারা কর্মকুশল। পিতৃতন্ত্র নারীদের এ-গুণগুলোর প্রশংসা করে আসছে কয়েক সহস্ৰক ধরে, এবং নারীরা যাতে বিরত না হয় এগুলোর চর্চা থেকে তার ওপর রেখেছে তীক্ষ দৃষ্টি। এগুলো দাসদের গুণ; মন বুঝে চলতে হয় তাদের, নইলে তাদের পড়তে হয় বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে; সম্বন্ধও রক্ষা করতে হয় তাদের, এবং কর্মকুশলতায় তারা জয় করে প্রভুর মন। স্বাধীন পুরুষের কাছে এসব কাপুরুষতা; কিন্তু নারী যেহেতু দাসশ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত, যেমন দাবি করেছেন আমূল নারীবাদীরা, তাই তারা চলার চেষ্টা করে অপরের মন বুঝে, মানিয়ে নিতে চায় অপরের সাথে। একে স্বাভাবিক বলার অর্থ হচ্ছে শূদ্ৰদের শূদ্ৰত্ব স্বাভাবিক। পিতৃতন্ত্র সমস্ত সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যাপারকে জৈবিক ও শাশ্বত বলে গণ্য করেছে, রবীন্দ্রনাথও করেছেন। পুরুষতন্ত্র নারীদের বিকৃত করে নিজের উপযোগী ক’রে নিয়েছে, এসব নারীদের স্বাভাবিক স্বভাব নয়। নারীরা ব্যবসা করতে পারে, এতে তিনি বিশ্বাস করেন, এবং তার প্রমাণও তিনি পেয়েছেন; তবে তিনি ব্যবসা বলতে বোঝেন মুদিদোকান চালানো, যার যোগ্য নারীরা। নারীরা যে শারীরিকভাবে দুর্বল, এটা সকলের জানা; রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নারীরা মানসিকভাবেও দুর্বল। ‘যে-সব কাজে দৈহিক বা মানসিক সাহসিকতার দরকার হয় না’, রবীন্দ্রনাথের মতে, সে-সব করতে পারে নারীরা। তাঁর এ-মত অভিনব নয়, পুরুষ নারীদের সম্পর্কে এ-ধারণা পোষণ ও প্রচার করে আসছে পিতৃতন্ত্রের সূচনাকাল থেকেই। রুশো ‘এমিল’-এ এটা আলোচনা করেছেন বিশদভাবে; রবীন্দ্রনাথের মত রুশোর মতেরই প্ৰতিধ্বনি। নারী যেমন শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী তেমনি প্রতিবন্ধী মানসিকভাবে; তারা করতে পারে সে-সব কাজ যাতে ‘উদ্ভাবনার দরকার নেই’, যাতে ‘পটুতা পরিশ্রম ও লোকের সঙ্গে ব্যবহারই সব-চেয়ে দরকার’। রবীন্দ্ৰনাথ নারীদের প্রশংসাপত্র দিয়েছেন যে তারা ব্যবসা করতে পারে, তবে ‘ব্যবসা’ বলতে তিনি আসলে ব্যবসা বোঝান নি। ব্যবসার জন্যে দরকার সাহস, উদ্ভাবন শক্তি, তাই নারীরা ব্যবসার উপযুক্ত নয়; রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নারী বড়োজোর হতে পারে মুদি; তিনি তা বিলেতে দেখেছেন, জাপানে দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ যেমন নারীপুরুষের পৃথক এলাকায় বিশ্বাসী, তেমনি নারী যখন বাইরের কাজে আসে তখনও তিনি নারীপুরুষের পৃথক কাজে বিশ্বাসী। একশ্রেণীর তুচ্ছ কাজ আছে, যা করবে নির্বোধ দুর্বল নারী; আর অধিকাংশ সভ্যতার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করবে। উদ্ভাবনশীল সাহসী পুরুষ। নারী হবে মুদি, সেবিকা, বিমানবালা, পুরুষ নিৰ্বাহীর ব্যক্তিগত সহকারী; আর পুরুষ হবে সভ্যতার নিয়ন্ত্রক।

রবীন্দ্রনাথ, তার কালের অধিকাংশ মহাপুরুষের মতোই, বিরোধী ছিলেন নারীমুক্তির; যে-নারীরা পুরুষাধিপত্য থেকে নিজেদের মুক্তির কথা বলে, তারা বিকারগ্রস্ত ব’লে বিশ্বাস করেন তিনি। প্রাকৃতিক স্বাভাবিক নারী কল্যাণী হয়ে থাকবে গৃহে, প্রেম হবে তাদের জীবনের মূলধন; শুধু বিকৃত নারীরাই প্রতিষ্ঠা পেতে চায় বাইরে। পশ্চিমাযাত্রীর ডায়ারিতে (১৩৩৬) তিনি লিখেছেন :

‘প্রকৃতিস্থ অবস্থায় সাধারণত কোনো মেয়ের দল বলে না, পুরুষকে সম্পূর্ণ বর্জন করাটাই তাদের জীবনের চরম ও মহোচ্চ লক্ষ্য। সম্প্রতি কোথাও কোথাও কখনো এমন কথার আভাস শোনা যায়, কিন্তু সেটা হল আস্ফালন। প্রাণের রাজ্যে মেয়েদের যে চিরকেলে স্থান আছে সেখানকার বন্দরের নোঙর ছিঁড়ে মনটাকে নিয়ে তারা নিরুদেশ হয়ে যাবে, এমন কথা দুই-একজন মেয়ে বলতেও পারে: কারণ যাত্রারম্ভে ভাগ্যদেবতা যখন জীবনের সম্বল স্ত্রীপুরুষের মধ্যে বাঁটোয়ারা করে দেয় তখন প্যাক করবার সময় কিছু যে উলটোপালটা হয় না, তা নয়’ (বর : ১৯, ৩৮৩)।

নারীমুক্তির কথা, রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস, কোনো নারী ‘প্রকৃতিস্থ’ অবস্থায় বলতে পারে না; উন্মাদিনীরাই শুধু বলতে পারে এমন অস্বাভাবিক কথা। নারীমুক্তি হচ্ছে পাগলামো! তিনি পশ্চিমের নারীমুক্তিবাদীদের লক্ষ্য ক’রেই এসব বলেছেন, তাদের ক্রিয়াকলাপকে নিন্দা করেছেন ‘আস্ফালন’ বলে। তিনি চান নারী থাকবে ‘প্ৰাণের রাজ্যে’ চিরস্থায়ীভাবে; নারী সন্তান ধারণ ও প্রসব করবে, মনের রাজ্যে তার অধিকার নেই। যদি কোনো নারী মনের রাজ্যে ঢুকতে চায়, বুঝতে হবে তার ভেতরে রয়েছে কোনো গোলমাল। যে-নারী কবিতা লেখে, বিজ্ঞানচর্চা করে সে বিকৃত, প্রকৃতি ভুল করে তার ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে একটা পুরুষকে। যারা বাইরে নারী আর ভেতরে পুরুষ, তারা অবশ্যই বিকৃত। রবীন্দ্রনাথের প্যাকিংতত্ত্ব অনুসারে কৃতী সব নারীই বিকৃত : স্বর্ণকুমারী দেবী, বা বেগম রোকেয়া, মেরি ওলস্টোনক্রাফ্‌ট্‌, জর্জ এলিয়ট, মাদাম ক্যুরি বিকৃত, তাঁদের ভেতরে প্রকৃতি ভুল ক’রে বোঝাই করেছে পুরুষের স্বভাব। রবীন্দ্রনাথের এ-মতের সাথে মিল আছে ফ্রয়েডের ‘পুংগূঢ়ৈষা’র, যার সারকথা হচ্ছে ব্যর্থ বিকৃত নারীরাই প্রতিষ্ঠা চায় বাইরের জগতে। মেয়েরা মুক্তি চায় কেনো? তার কারণ নির্দেশ করেছেন রবীন্দ্রনাথ :

একদল মেয়ে বলতে শুরু করেছে যে, ‘মেয়ে হওয়াতে আমাদের মগৌরব, আমাদের ক্ষতি। অৰ্থাৎ, আমাদের আত্মপ্রকাশের ধাবায় পুরুষের সঙ্গে প্রভেদটাতে পীড়া পাচ্ছি।’ এর থেকে বোধ হচ্ছে, একদিন যে পুরুষ সাধক ছিল এখন সে হয়েছে বণিক (পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি, রব :১৯, ৩৯১)।

পুরুষ সম্পর্কে অসাধারণ ভাববাদী ধারণা পোষণ রবীন্দ্রনাথের স্বভাব; যে-পুরুষ সফলভাবে নারীকে গৃহে আটকে রাখতো, সে তাঁর চোখে সাধক; যে-পুরুষ নারীকে আটকে রাখতে পারছে না, সে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের চোখে সবচেয়ে ঘৃর্ণিত মানুষ-বণিক। তিনি আরো বলেছেন, ‘পুরুষ একদিন ছিল মিষ্টিক, ছিল অতল রসের ডুবারি। এখন হয়েছে মেয়েদের মতোই সংসারী।’ (ওই, ৩৯২)। পুরুষ বণিক হয়ে পড়েছে, সংসারী হয়ে পড়েছে, তাই নারী ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে চাইছে, এটা বেশ আধ্যাত্মিক ভারতবর্ষীয় ব্যাখ্যা। নারীরা কেনো মুক্তি চায়, রবীন্দ্রনাথের এ-রচনা লেখার সময় তা নারীরা বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ কি নারীবাদীদের কোনো লেখা পড়ার আগ্রহ বোধ করেন নি কখনো?

১৯৩৬-এর অক্টোবরে রবীন্দ্রনাথ নিখিলবঙ্গ-মহিলা কর্মীসম্মিলনে পড়েন ‘নারী’ (কালান্তর, রব :২৪, ৩৭৭-৩৮৩) প্ৰবন্ধটি। প্ৰবন্ধটি লিখেছিলেন তিনি নারীদের আমন্ত্রণে যে-নারীরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাঁরা ছিলেন মুক্ত বা মুক্তিপিপাসু, বা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘অপ্ৰকৃতিস্থ’, বা ভুলপ্যাককরা। প্রবন্ধটিতে পাই দুই রবীন্দ্রনাথকে : এক রবীন্দ্রনাথ পিতৃতান্ত্রিক, যিনি নারীকে মনে করেন প্রকৃতির অভিপ্ৰায় বাস্তবায়নের মাংসল যন্ত্র, যার কাজ সন্তানধারণ ও পালন, যে বইছে ‘আদিপ্রাণের সহজ প্রবর্তনা’ নিজের স্বভাবের মধ্যে; আরেক রবীন্দ্রনাথ, অনেকটা বাধ্য হয়ে, মেনে নেন যে নারীকে বেরিয়ে আসতে হবে বাইরে। যে-নারীরা আর কল্যাণী হয়ে থাকতে চান না, তাদের আমন্ত্রণে তাদের সম্মেলনে এসে রবীন্দ্রনাথ তাঁদের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে বলবেন, এমন অরুচিকর স্বভাব ছিলো না তাঁর। তিনি খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন নতুন নারীদের সাথে। এ-প্রবন্ধে নারীবাদবিরোধী রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ওপরে দিয়েছি, এখন দেখতে চাই রবীন্দ্রনাথ কতোটা মেনে নিয়েছেন নারীমুক্তিকে। কৃতজ্ঞ বোধ করছি নিখিলবঙ্গ-মহিলা কর্মীদের প্রতি, কেননা তারা নিজেদের সভায় আমন্ত্ৰণ ক’রে উদ্ধার করেছিলেন পিতৃতান্ত্রিক রবীন্দ্রনাথকে। তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ না জানালে তাঁর তিরোধান ঘটতো নারীমুক্তিবিরোধী পুরুষতন্ত্রের এক বড়ো পুরোহিত রূপে; আমন্ত্রিত হয়ে রূপান্তরিত হন রবীন্দ্রনাথ, কাটিয়ে ওঠেন নিজের আযৌবন প্রগতিবিরোধিতা, স্বীকার ক’রে নেন নারীমুক্তিকে, অনেকটা বাধ্য হয়ে। নারীরাই সৃষ্টি করেন এক নতুন রবীন্দ্রনাথকে, যখন তাঁর বয়স পঁচাত্তর। যে-নারীমুক্তি একদিন তাঁর কাছে ছিলো অপ্রকৃতিস্থ ভুলপ্যাককরা একদল নারীর আস্ফালন, তা এখন তার কাছে হয়ে ওঠে অনিবাৰ্য :

‘এ দিকে প্রায় পৃথিবীর সকল দেশেই মেয়েরা আপন ব্যক্তিগত সংসারের গণ্ডি পেরিয়ে আসছে। আধুনিক এসিয়াতেও তার লক্ষণ দেখতে পাই। তার প্রধান কারণ সর্বত্রই সীমানা-ভাঙার যুগ এসে পড়েছে।…বাহিরের সঙ্গে সংঘাতে অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে, নূতন নূতন প্রয়োজনের সঙ্গে আচার-বিচারের পরিবর্তন অনিবাৰ্য হয়ে পড়ছে’ (ওই ৩৭৯-৩৮০)।

অনেক কাল তিনি বিশ্বাস করতেন প্রকৃতিই নারীকে বন্দী করেছে। ঘরে, এখন প্রকৃতির সে-অমোঘ নিয়ম হয়ে ওঠে। ‘আচার-বিচার’ অর্থাৎ প্রথা। তাঁর সব বিশ্বাসই বাতিল হয়ে যায় এর ফলে। যে-গৃহ একদা ছিলো তার চোখে নারীর অনিবাৰ্য এলাকা, তা হয়ে ওঠে। অতীতের ব্যাপার :

‘কালের প্রভাবে মেয়েদের জীবনের ক্ষেত্র এই-যে স্বতই প্রসারিত হয়ে চলেছে, এই-যে মুক্তসংসারের জগতে মেয়েরা আপনিই এসে পড়ছে, এতে করে আত্মরক্ষা এবং আত্মসম্মানের জন্যে তাদের বিশেষ করে বুদ্ধির চর্চা, বিদ্যার চর্চা, একান্ত আবশ্যক হয়ে উঠল’ (ওই, ৩৮১)।

রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন মেয়েদের এলাকা ‘স্বতই প্রসারিত হয়ে চলেছে’, ‘মুক্তসংসারের জগতে মেয়েরা আপনিই এসে পড়েছে’; তবে একটু ভুল বুঝেছেন তিনি, কেননা ঘটনাটি এতো স্বতই-ও আপনিই ঘটে নি। এর জন্যে নারীদের লড়াই করতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সাথেও। যে-রবীন্দ্রনাথ নারীদের বিশেষ বুদ্ধি ও বিদ্যায় বিশ্বাসী ছিলেন না, তিনি এখন তার আবশ্যক বোধ করেন নারীদের জন্যে; তিনি দেখেন তার ‘কল্যাণী’র বদলে গেছে, বদলে দিচ্ছে পুরুষের সভ্যতাকে :

‘ঘরের মেয়েরা প্রতিদিন বিশ্বের মেয়ে হয়ে দেখা দিচ্ছে। এই উপলক্ষে মানুষের সৃষ্টিশীল চিত্তে এই-যে নূতন চিত্তের যোগ, সভ্যতায় এ আর-একটি তেজ এনে দিলে। আজ এর ক্রিয়া প্রত্যক্ষে অপ্রত্যক্ষে চলছে। একা পুরুষের গড়া সভ্যতায় যে ভারসামঞ্জস্যের অভাব প্রায়ই প্ৰলয় বাধাবার লক্ষণ আনে, আজ আশা করা যায় ক্ৰমে সে যাবে সাম্যের দিকে … একটিমাত্র বড়ো আশ্বাসের কথা এই যে, কল্পান্তের ভূমিকায় নূতন সভ্যতা গড়বার কাজে মেয়েরা এসে দাঁড়িয়েছে–প্ৰস্তুত হচ্ছে তারা পৃথিবীর সর্বত্রই। …এখন অন্ধসংস্কারের কারখানায় গড়া পুতুলগুলো নিয়ে খেলা করা আর তাদের সাজবে না। তাদের স্বাভাবিক জীবপালিনী বুদ্ধি, কেবল ঘরের লোককে নয়, সকল লোককে রক্ষার জন্যে কায়মনে প্রবৃত্ত হবে’ (ওই, ৩৮২-৩৮৩)।

তাঁর এতোদিন প্রিয় ছিলো ভুবনের মেয়েকে ভবনেয় মেয়েরূপে দেখা, বিশ্বাস ছিলো প্রকৃতির বিধান তাই। এক সময় মনে করতেন তিনি মেয়েরা বাইরে এলে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে; এখন তিনি তাদের প্রতিভাকে, যাতে তাঁর বিশ্বাস ছিলো না, কাজে লাগাতে চাইলেন সভ্যতার ভারসাম্য সৃষ্টিতে। নারী পুরুষকে অনুপ্রাণিত ক’রে, নিজের নারীত্বকে সভ্যতায় সংক্রমিত ক’রে পুরুষালি সভ্যতাকে কোমল করবে, বিধান করবে সভ্যতার সামঞ্জস্য, এমন কথা তিনি আগে (১৯১৭) বলেছেন; তবে এখন যে-ভারসাম্যের কথা বলেন তা প্রকৃতিতে ভিন্ন। তবে নারী যে সন্তান জন্ম দেয় আর লালন করে, তা ভোলেন নি তিনি, তাই নারীকে দেন ‘সকল লোককে রক্ষার দায়িত্ব’। রবীন্দ্রনাথের মুক্ত নারী হয়ে ওঠে সব মানুষের মা। তাহলে পুরুষ কী করবে? রবীন্দ্রনাথ নারীপুরুষের নতুন সভ্যতার রূপরেখাও আঁকেন :

‘সভ্যতা সৃষ্টির নূতন কল্প আশা করা যাক। এ আশা যদি রূপ ধারণ করে তবে এবারকার এই সৃষ্টিতে মেয়েদের কাজ পূর্ণ পরিমাণে নিযুক্ত হবে সন্দেহ নেই। নবযুগের এই আহ্বান আমাদের মেয়েদের মনে যদি পৌঁছে থাকে। তবে তাদের রক্ষণশীল মন যেন বহু যুগের অস্বাস্থ্যকর আবর্জনাকে একান্ত আসক্তিব সঙ্গে বুকে চেপে না ধলে। তাঁরা যেন মুক্ত করেন হৃদয়কে, উজ্জ্বল করেন বুদ্ধিকে, নিষ্ঠা প্রয়োগ করেন জ্ঞানের তপস্যায়। সামনে আসছে নূতন সৃষ্টির যুগ’ (ওই ৩৮৩)।

রবীন্দ্রনাথ নতুন কল্প আশা করেন, যাতে পুরোপুরি অংশ নেবে নারীরা। তবে তিনি যেনো মনে করেন এ-নতুন কল্প সূচনা করেছে পুরুষ, তারা ডাকছে নারীকে, আর নারীদের দায়িত্ব হচ্ছে নিজেদের রক্ষণশীলতা ছেড়ে নতুন কল্প সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করা। অভিযুক্ত করছেন তিনি নারীদেরই, যেনো তারা হৃদয়কে মুক্ত আর, বুদ্ধিকে উজ্জ্বল করে নি ব’লে, জ্ঞানের তপস্যায় নিষ্ঠা প্রয়োগ করে নি ব’লে বিলম্বিত হয়েছে নতুন কল্প। কিন্তু ব্যাপারটি সম্পূর্ণ বিপরীত, পুরুষেরাই—যাদের মধ্যে আছেন রবীন্দ্রনাথও, সর্বশক্তিতে প্রতিরোধ ক’রে এসেছে নতুন কল্পকে। তবু সুখকর হচ্ছে যে পঁচাত্তর বছব বয়সে রূপান্তরিত হন রবীন্দ্রনাথ, এবং আরো সুখকর হচ্ছে যে নারীরাই রূপান্তরিত করেছিলো তাঁকে।

 

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x