যুক্তি এগারোঃ প্রতিটি মানুষের হাতের রেখা আঙুলের ছাপ ভিন্নতর। তাই আজও আঙুলের ছাপ, হাতের ছাপ দেখে অপরাধী চিহ্নিতকরণের কাজ সম্পন্ন করে চলেছে অপরাধবিজ্ঞান ।
একটি মানুষের ভাগ্যের সঙ্গে আর একটি মানুষের ভাগ্য কখনই পরিপূর্ণভাবে এক নয়, তা সে একই সময়ে জন্মালেও। আর তাই দুটি মানুষের হাতের রেখা এক নয়। এই দুয়ের সম্পর্কই প্রমাণ করে হস্তরেখার মধ্যেই সাংকেতিক চিহ্নে লিখিত রয়েছে মানুষের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ ।
এই সংকেত উদ্ধার একদিনে সম্ভব হয়নি। হাজার হাজার বছর ধরে শত-সহস্র হস্তরেখাবিদদের পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে হস্তরেখা-বিদ্যা। পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এই সিদ্ধান্ত তাই বিজ্ঞান।
বিরুদ্ধ যুক্তিঃ অনেক হস্তরেখাবিদদের অনেক ভবিষ্যদ্বাণী মিলে গেছে, শুধুমাত্র এই যুক্তিতে জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিজ্ঞান বলে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ অনেক হস্তরেখাবিদদের অনেক ভবিষ্যদ্বাণী মেলেনি, এটাও কিন্তু বাস্তব সত্য।
কেন মেলে, কেন মেলে না সে কথা আগেই আলোচনা করেছি। তাই সে আলোচনায় আবার ফিরে আসার প্রয়োজন দেখি না। বরং আমরা এখন আলোচনা করবো, হাতের রেখা কী, কেন ইত্যাদি প্রসঙ্গ নিয়ে ।
চোখের সামনে নিজের হাতটা মেলে ধরলেই দেখতে পাব তিনটি-স্পষ্ট মোটা বেখা এবং তা ছাড়াও অনেক ছোট, বড়, সূক্ষ্ম, স্পষ্ট বহু রেখা। রেখা দিয়ে তৈরি অনেক চিহ্নও চোখে পড়তে পারে। এ-গুলো কোনও দুটি রেখার কাটা-কুটি, বহু রেখাব কাটা-কুটি, বৃত্তাকারের রেখা, ত্রিকোণাকারের রেখা, চতুষ্কোণের মত রেখা, ইত্যাদি। এ ছাড়াও প্রতিটি আঙুলের ভাঁজেব তিনটি স্থানে থাকে এক বা একাধিক স্পষ্ট মোটা রেখা। মোটা দাগের বেখাগুলোকে বলা হয় ভাঁজ বা crease। সূক্ষ্ম রেখাগুলোকে বলা হয় ridge |
ভাঁজ বা crease আমরা দেখতে পাব প্রতিটি আঙুলের ভাঁজের জায়গায় এবং হাতের তালুর তিনটি স্থানে। হাতের তালুর এই ভাঁজগুলোকে হস্তরেখাবিদরা বলেন হৃদয়রেখা (heart-line), শিরোরেখা (head-line) এবং আয়ুরেখা (life line ) ।
হাতের ভাঁজ ও রেখাগুলো তৈরি হওয়ার কারণ শিশু গর্ভে থাকাকালীন হাত দুটি মুঠিবন্ধ করে রাখে। ফলে হাতের তালুতে আঙুলের ভাঁজে বেশি কুঁচকে থাকা জায়গাগুলোতে তৈরি হয় ভাঁজ এবং কম কুঁচকে থাকা জায়গাগুলোতে তৈরি হয় রেখা ।
শিশুরা কেন এমনটা হাত মুঠোবন্দী করে বাখে ? এই প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে নৃতত্ববিদদের ধারণা পূর্বপুরুষদের গাছের ডাল মুঠিবদ্ধ করে ধরে রাখার অভ্যেসটাই বংশগতি সূত্রে চলে আসছে। হাত ও আঙুলের ভাঁজগুলো আমাদের হাতের নড়াচড়ায়, আঙুল চালনায় সাহায্য করে। নৃবিজ্ঞানীদের ( anthropologists) মতে তালুর প্রধান তিনটি ভাঁজ আমাদের আঙুলগুলোকে চালনা করতে সাহায্য করে। আপনার বুড়ো আঙুলটি চালিয়ে দেখুন, দেখবেন আয়ুরেখাটিও চালিত হচ্ছে।
জন্ম থেকেই যারা বুড়ো আঙুল ছাড়া জন্মায় তারা
আয়ুরেখা ছাড়াই জন্মায়। আয়ুরেখাই যদি জাতকের আয়ুর
মাপকাঠি হয়, তবে আয়ুরেখা ছাড়া এইসব জাতক
জীবনধারণ করে কী করে ?
এর দ্বারা স্পষ্টইতই প্রমাণিত হয়, আয়ুবেখা আদৌ আয়ুর পরিমাপক নয়, বুড়ো আঙুল চালনার ক্ষেত্রে সহায়ক মাত্র ।
১৯৮৭-র নভেম্বর থেকে ১৯৮৮-র জানুযারি পর্যন্ত কলকাতার চারটি হাসপাতালে একটি বে-সরকারী পরীক্ষা চালান হয় ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির উদ্যোগে। জন্মকালীন, জন্মের আগে, অথবা জন্মের অল্প সময়ের মধ্যে মারা যাওয়া একশোটি শিশুর ওপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছিল ওদের প্রত্যেকেরই আয়ুরেখা ছিল। আয়ুরেখা থাকা সত্ত্বেও ওদের আয়ু কেন শূণ্য ? কি জবাব দেবেন জোতিষীরা ? জ্যোতিষীরা আবারও এই ধরনের সমীক্ষা চালানে আমার বক্তব্যের সত্যতা এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের অসারতার প্রত্যক্ষ প্রমাণ অবশ্যই পাবেন ।
বয়েস বাড়লেও হাতের তালু ও আঙুলের ভাঁজগুলো পাল্টায় না। তবে অনেক রেখা ও চিহ্ন পাল্টে যায়, এমন কি মুছেও যায় অনেক সময়। হাতের তালুর চামড়ার নীচের মাংসপেশীগুলোর সংকোচন-প্রসারণের ফলেই রেখার এই ধরনের পরিবর্তন, সৃষ্টি বা বিলোপ ঘটে থাকে। এই পেশী সংকোচণ আবার ব্যক্তিব জীবনযাত্রা প্রণালীর ওপরও সাধারণভাবে নির্ভরশীল। রেখাগুলো মানুষের ভাগ্যের নির্দেশক নয়, ভাগ্যের অনিবার্যতার নির্ণযক নয়।
এর পরও কোনও জ্যোতিষী যদি গোঁ ধরে বলতেই থাকেন-“হাতের রেখা নির্ধারিত ভাগ্যের নির্দেশক”, তবে তাঁর বিরুদ্ধে যুক্তিবাদীদের সবচেয়ে জোরাল প্রশ্ন হলো-যে হাতের রেখা দেখে জ্যোতিষী জাতকের পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্য জানতে পারে, সেই হাতের রেখা পাল্টে গেলে পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যই তো ওলট-পালট হয়ে যাবে। আর সেই সঙ্গে জাতকের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কীত কয়েক হাজার মানুষদের জীবনের পূর্ব নির্ধারিত ঘটনাও যাবে পাল্টে। আবার কয়েক হাজার মানুষের সঙ্গে সম্পর্কীত কয়েক হাজার গুণিতক কয়েক হাজার অর্থাৎ কয়েক নিযুত সংখ্যাক মানুষের ভাগ্যের পূর্বনির্ধারিত ঘটনা যাবে পাল্টে । ওই নিযুত সংখ্যক মানুষের ভাগ্য পাল্টে গেলে তার প্রভাব পড়বে কয়েক নিযুত গুণিতক কয়েক নিযুত মানুষের ভাগ্যে । এই ভাগ্য পরিবর্তন চলতেই থাকবে এই ধরনের গুণিতকের নিয়মেই। ভাগ্য বাস্তবিকই নির্ধারিত হলে একটি জাতকের ভাগ্যের সামান্যতম পরিবর্তন পৃথিবীর মানুষদের নির্ধারিত ভাগ্যের ভারসাম্যকে ওলট-পালট করে দিতে বাধ্য। হাতের রেখা যেহেতু বহু মানুষেরই পাল্টায়, তাই “হস্তরেখা শাস্ত্রটি বিজ্ঞান” এই দাবি মূখর্তা বা শঠতারই নির্দেশক ।