যুক্তি আটঃ কার্ল সেগান, ডিন্সমোর অল্টার, জন ফিলিপস, ক্যারেন্স ক্লেমিনিশ, বার্ট জে বোক প্রমুখ বিজ্ঞান পণ্ডিতদের মতে পৃথিবী থেকে গ্রহ-নক্ষত্রগুলো এতই দূরে রয়েছে যে পৃথিবীর উপর গ্রহগুলোর মহাকৰ্ষজনিত বল, চুম্বকক্রিয়া ও অন্যান্য ক্রিয়ার প্রভাব নিতান্তই নগন্য ।
এইসব জ্যোতিষবিরোধীরা হয় শুধুমাত্র বিরোধীতা করতে, নতুবা এই বিষয়ে সম্যক জ্ঞানের অভাব থেকেই এই ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করেছেন।
দূরে থাকলেই বা বল কম হলেই যে প্রভাবও কমবে, এমনটা কিন্তু সর্ব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। জ্বলন্ত উদাহরণ, হোমিওপ্যাথ।
ধরা গেল, একজন রোগীকে হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক ‘নেট্রাম মিউর ২০০’ শক্তিমাত্রা দিলেন। নেট্রাম মিউরের অর্থ সোডিয়াম ক্লোরাইড যা কিনা ওই রোগী বা আমরা সকলেই প্রতিদিনই যথেষ্ট পরিমাণে খেয়ে থাকি সাধারণ লবণ হিসেবে। রোগী ওই ওষুধ খেয়েই কিন্তু রোগমুক্ত হলেন।
এখন একটা প্রশ্ন আসে, এতদিন বোগী প্রচুর লবণ খেয়েও রোগ মুক্ত হলেন না, আর চিকিৎসক যে ওষুধ দিলেন, তাতে লবণের উপস্থিতি এতই সামান্য যে নেই বললেই চলে। অতি সামান্য পরিমাণ লবণের প্রভাব কি তবে মানব-শরীরে এই ক্ষেত্রে প্রচুর লবণের চেয়ে অনেক বেশি ছিল ?
২০০ শক্তির নেট্রাম মিউর-এ কতটুকু লবণ থাকে একটু দেখা যাক ।
১ গ্রাম লবণের সঙ্গে ৯ গ্রাম সুগার মিল্ক অথবা সুরাসার মেশান হলে হবে ১ শক্তি মাত্রার নেট্রাম মিউর। আবার ঐ শক্তিমাত্রা থেকে ১ গ্রাম নিযে ৯ গ্রাম সুগার মিল্ক মেশালে শক্তিমাত্ৰা বেড়ে হবে ২। আবার এই ২ শক্তিমাত্রার ১ গ্রামের সঙ্গে ৯ গ্রাম সুগার মিল্ক মেশালে তৈরি হবে ৩ শক্তিমাত্রার নেট্রাম মিউর। এই প্রক্রিয়ায় বাড়াতে ২০০ শক্তিমাত্ৰার নেট্রাম মিউর যখন তৈরি হবে তখন তাকে এক অণু লবণও থাকবে না। কারণ শক্তিমত্রা ২২ হলে প্রতি ১০ গ্রামে একটি বেশি অণু থাকবে না। সুতরাং ২০০ শক্তিমাত্রা ওষুধ লবণের অণুর উপস্থিতির প্রশ্ন অবান্তর। তাহলে দেখা যাচ্ছে হোমিওপ্যাথ ওষুধের ক্ষেত্রে বস্তুর উপস্থিতির স্বল্পতা শক্তিমাত্রা বৃদ্ধিই করেছে। অর্থাৎ সব সময় কোনও কিছুর দূরত্বের ব্যাপকতা বা উপস্থিতির পরিমাণগত স্বল্পতার দ্বারা প্রভাবের ক্ষীণতা প্রমাণ হয় না. এমন কি এও প্রমাণিত হয় না, পৃথিবীর জীবের উপর গ্রহদের প্রভাব যেহেতু অতি সামান্য তাই মানুষের উপব ক্রিয়াহীন থাকবে ।
এই যুক্তিটি হাজির করেছেন কয়েকজন নামী-দামী জ্যোতিষী, যাঁদের মধ্যে ডঃ অসিতকুমার চক্রবর্তীও অন্যতম।
বিরুদ্ধ যুক্তিঃ হোমিওপ্যাথ ওষুধে মূল ঔষধির উপস্থিতি যত সূক্ষ্ম মাত্রায় হয়, তার শক্তিমাত্রাও ততটা বৃদ্ধি পায়—এই যুক্তিতে জ্যোতিষীরা ঠিক কী প্রমাণ করতে চাইছেন, আমার কাছে আদৌ স্বচ্ছ হলো না। তবে তাঁদের বক্তব্য বার বার পড়ে মনে হয়েছে তাঁরা হোমিওপ্যাথের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর মাত্রার সঙ্গে দূর গ্রহ-নক্ষত্রের সঙ্গে মানুষের ভাগ্যের প্রভাবকে উদাহরণ হিসেবে যুক্ত করতে চেয়েছেন। কিন্তু জ্যোতিষীদের এই যুক্তিকে স্বীকার করলে জ্যোতিষশাস্ত্রকে যে অস্বীকার করতে হয় । কারণ এই যুক্তি অনুসারে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের উপগ্রহ চাঁদের প্রভাবই জীব-জগতে সবচেয়ে কম হওয়া উচিত। আর দৃশ্যমান নক্ষত্রের চেয়েও দূরবর্তী কোটি কোটি নক্ষত্রের প্রভাব হওযা উচিত প্রবলতর।
কিন্তু বাস্তবে এ কী দেখছি? যে সব তা-বড় জ্যোতিষীরা হোমিওপ্যাথির দৃষ্টান্ত হাজির করছেন, তাঁরাই আবার মানুষের ভাগ্য গণনার ক্ষেত্রে চন্দ্র, সূর্যের প্রভাবকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। ওঁরা সবচেয়ে কাছের উপগ্রহ (জ্যোতিষ মতে গ্রহ) চন্দ্রের অবস্থান অনুসারে জাতকের রাশি নির্ণয় করছেন। এবং বহু ক্ষেত্রেই লগ্নের পরিবর্তে বাশি থেকে গণনা করে জ্যোতিষ-বিচার করছেন।
অনেক গ্রহই পৃথিবী থেকে সূর্যের যা দূরত্ব, তার চেয়েও বেশি দূরে অবস্থান করে। তখন কোন যুক্তিতে ওইসব গ্রহের প্রভাবের চেয়েও সূর্যের প্রভাব বেশি বলে জ্যোতিষশাস্ত্রে বিবেচিত হয় ?
সাতাশটি নক্ষত্রের প্রভাবের কথাই জ্যোতিষশাস্ত্রে লেখা রয়েছে। কিন্তু সাতাশটি নক্ষত্রের চেয়ে বহু গুণ দূরে থাকা কোটি কোটি নক্ষত্রের প্রভাবের কথা তো জ্যোতিষশাস্ত্রে লেখা নেই। অথচ জ্যোতিষীদের এই যুক্তি অনুসারে আরো দূরে অবস্থানের সুবাদে মানব-জীবনে এইসব নক্ষত্রেদের প্রভাব অবশ্যই হওয়া উচিত নয় গ্রহ ও সাতাশ নক্ষত্রের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। এইসব দূরবর্তী নক্ষত্রদের প্রভাব বিচার না করলে তো জ্যোতিষশাস্ত্রই ব্যর্থ হতে বাধ্য। যে কোনও একটি তুচ্ছ গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব নির্ণয়ে সামান্যতম ভুল করলে, একটি গণনা ভুল হলে যেখানে বহু মানুষের জীবনের বহু পূর্বনির্ধারিত ঘটনা পাল্টে যায়, সেখানে কোটি কোটি নক্ষত্রের বিশাল বিশাল প্রভাব গণনার মধ্যে না আনলে জ্যোতিষশাস্ত্ৰ তো ‘আহাম্মকের শাস্ত্র’ হয়ে দাঁড়তে বাধ্য ।
স্বল্পতাই যদি শক্তিব বা প্রভাবের দৃষ্টান্ত হিসেবে সর্বত্র প্রযোজ্য হয়, তবে আমরা নিশ্চয়ই বলতে পারি—জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে যে যত কম জানে, সে তত বড় জ্যোতিষী।