যুক্তি সাতঃ ‘৭৫-এর সেপ্টেম্বরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হিউম্যানিস্ট পত্রিকায় ১৮৬জন বিজ্ঞানীর জ্যোতিষ-বিরোধী বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। এঁদের অনেকেই প্রতিষ্ঠিত। ১৮জন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এও সত্যি। কিন্তু তাঁর সঙ্গে এ-কথাও সত্যি এই ১৮৬জন বিজ্ঞানী নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে বা জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে পরীক্ষা কবে তারপর এই ধরনের সিদ্ধান্ত তাঁরা পৌঁছোননি। বক্তব্যটি খসড়া করেছিলেন বিজ্ঞানী বার্ট জে বোক। অন্যরা জ্যোতিষচর্চা না করেই অর্থাৎ জ্যোতিষশাস্ত্রের সত্যতা আছে কি না তা না জেনেই সাক্ষর করেছিলেন—এই মাত্র ।
যে দেশে বিজ্ঞানীর সংখ্যা কুড়ি লক্ষ, সেখানে জ্যোতিষবিরোধীতা করেছেন মাত্র ১৮৬ জন। যে তথাকথিত স্ব-ঘোষিত যুক্তিবাদীরা ১৮৬ জন বিজ্ঞানীর জ্যোতিষবিরোধীতাকে জ্যোতিষশাস্ত্রের ভ্রান্তির অকাট্য প্রমাণ বলে হৈ-চৈ করে বেড়াচ্ছেন তাঁদের যদি প্রমাণ করে দিই এর চেয়েও বেশি সংখ্যক বিজ্ঞানীরা জ্যোতিষশাস্ত্রের স্বপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন, তখন কি তাঁরা মেনে নেবেন—জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান ?
“পরাশর, ভৃগু, জেমিনি, বরাহমিহির প্রমুখ ঋষিরা যে শাস্ত্রের প্রণেতা সেই শাস্ত্রকে মিথ্যা বা অসভ্য মানুষের বিশ্বাস বলে মনে করলে, তাঁদেরও মিথ্যাবাদী এবং অসভ্য বলে মেনে নিতে হয়। তাঁরা অসভ্য হলে আমরা তাঁদের বংশধররাও অসভ্য বলে চিহ্নিত হই।
‘এছাড়া পৃথিবীখ্যাত প্রাচীন বিজ্ঞানী পিথাগোরাস, টলেমী, গ্যালিলিও, টাইকোরাহা, কেপলার, ভাস্কর, শ্রীপতি প্রমুখ এবং বর্তমানকালের বহু বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীরা যে শাস্ত্রের পক্ষে বলিষ্ঠ মত প্রকাশ করেছেন, সেই শাস্ত্রে আস্থা জানাতে লজ্জা কোথায় ? ”
এই যুক্তিটুকু ডঃ অসিত চক্রবর্তীর ‘জ্যোতিষ-বিজ্ঞান কথা’ বইটির ৫৭ পৃষ্ঠা থেকে তুলে দিয়েছি, জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিজ্ঞান বলে প্রমাণ করতে এই ধরনের আক্রমণমুখী যুক্তি বহু জ্যোতিষীদের কাছেই খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
বিরুদ্ধ যুক্তিঃ জ্যোতিষশাস্ত্রের পক্ষে বা বিপক্ষে কতজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী বা বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব মত প্রকাশ করলেন এমন সংখ্যাতত্ত্বের নিরিখে কোনও মতকে মেনে নেওয়া যুক্তিবাদীদের কাছে একান্তভাবেই মূল্যহীন। কারণ বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিনির্ভর মানুষ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চায় পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। কোন পক্ষ সংখ্যাগুরু, কোন পক্ষে নামী-দামীদের সমর্থন বেশি, তা দেখে নয়। ইতিহাস বার বার এ শিক্ষাই দিয়েছে, বহু ক্ষেত্রেই সংখ্যাগুরুদের, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের মতামতও বাতিল হয়েছে আবর্জনার মতই। তেমনটি না হলে আজও আমাদের মেনে নিতে হতো ভূ-কেন্দ্রীক বিশ্বতত্বকে। অতএব আমি চাই যুক্তিনির্ভর মানসিকতা নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে। এ-কথাগুলো আলোচনায় আগে এসেছিল, কিন্তু প্রয়োজনে আবারও উল্লেখ করতে হলো ।
জ্যোতির্বিজ্ঞান যখন জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্র এই দুটি শাখায় ভাগ হয়ে যায় তখন বহু জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিজ্ঞানসাধনার পাশাপাশি কৌতূহলবশত অথবা দ্বিধাগ্রস্থভাবে অথবা বিশ্বাস নিয়ে জ্যোতিষচর্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন। ফলে জ্যেতিষশাস্ত্র কলেবরে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু শ্রদ্ধেয় বহু জ্যোতির্বিজ্ঞানী জ্যোতিষে বিশ্বাস করতেন, অথবা এ-যুগের কিছু বিজ্ঞানী ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব জ্যোতিষে বিশ্বাস কবেন এই যুক্তিতে জ্যোতিষশাস্ত্রের সত্যতা প্রমাণিত হয় না। কারণ, বিজ্ঞানের কাছে ব্যক্তি-বিশ্বাসের দাম এক কাণা-কড়িও নয় ।
প্রাচীন যুগের বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ‘অসভ্য’ বা ‘মিথ্যাবাদী’ এমন অভিযোগ কোনও যুক্তিবাদী বা বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ তুলেছেন—এমনটা আমার জানা নেই। অনুমান করতে অসুবিধে হয় না, সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত করতে, তাঁদের আবেগকে সুড়সুড়ি দিতেই এমন সব অশালীন, স্পর্শকাতর কথা বলা হচ্ছে, লেখা হচ্ছে। তবে পাশাপাশি এ-কথাটাও স্মরণযোগ্য, প্রাচীনযুগের বহু জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাই ভূ-কেন্দ্রীক বিশ্বতত্ত্বে বিশ্বাস করতেন, বরাহমিহির একটি পতাকা পুঁতে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, পৃথিবী স্থির বলেই পতাকা একটা নির্দিষ্ট দিকে ওড়ে না। পৃথিবী ঘুরলে বাতাসে পতাকা শুধু একই দিকে উড়তো; যেমন একটা পতাকা হাতে কেউ দৌড়তে থাকলে পাতাকা তার বিপরীত দিকেই ওড়ে।
অসভ্য মানুষদের বংশধররা অসভ্যই থেকে যাবে, এমনটা ডঃ চক্রবর্তীর কেন মনে হলো, বুঝলাম না। এটা তো বাস্তব সত্য, এক সময় মানুষ অসভ্যই ছিল. ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়েই আমবা বর্তমান অবস্থায় পৌঁচেছি।
কেউ যদি মনে করে থাকেন, বুঝতে পেরে থাকেন, কারো ব্যক্তি বিশ্বাস (তা সে যত বড় মানুষই হোন না কেন) কখনই বিনা পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণে বিজ্ঞানের সত্য বলে গৃহীত হতে পারে না, তবে দোষটা কোথায় ? এতে লজ্জিত হওয়ারও কোনও কারণ দেখি না।
একটি বিখ্যাত বাংলা সাপ্তাহিকের সম্পাদকীয় কলমে জ্যোতিষশাস্ত্রের পক্ষে লেখা হয়েছিল, “এ আগ্রহ বিজ্ঞানমনষ্কর থাকতে পারে এবং আছেও।”…..”জ্যোতিষীর কাছে বিজ্ঞানী যান এ ঘটনা বিরল নয়।”
কিন্তু এই ধরনের কিছু ঘটনা কখনই জ্যোতিষশাস্ত্রের অভ্রান্ততার প্রমাণ নয়। বড় জোর এটুকুই প্রমাণিত হতে পারে, ওই বিজ্ঞানীরা জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাসী। কিন্তু তাতে জ্যোতিষশাস্ত্র যে বিজ্ঞান, এ-কথা প্রমাণিত হচ্ছে কী ভাবে ?