যুক্তি ছয়ঃ জ্যোতিষীর ব্যর্থতার একটি প্রধান কারণ জাতকের জন্ম সময়ের ভ্রান্তি জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রধান অবলম্বন জন্ম-সময়। বেশির ভাগ ঘড়িই ঠিক সময় দেয় না। দিলেও ঠিক জন্ম মুহূর্তেই ঘড়ির সঠিক সময় দেখা অনেক সময় সম্ভব হয় না। হাসপাতালে জন্ম- সময় সঠিক রাখার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই জাতকের জন্ম-সময় ঠিক থাকে না। জন্ম-সময়ের ত্রুটির জন্য জন্মকালীন গ্রহ-অবস্থান নির্ণয়ের ভুল হয়। ভুলের উপর নির্ভর করে জ্যোতিষবিচার করলে ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক । কিন্তু এই ভুলের দায়িত্ব জাতকের জন্ম-সময় রক্ষাকারীর, জ্যোতিষীর নয়।
বিরুদ্ধ যুক্তিঃ যাঁরা জ্যোতিষ-ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন, তাঁরা জাতকদের দেওয়া জন্ম- সময় দেখেই তো গণনা করেন এবং সেই গণনার উপর ভিত্তি করে নানা সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে দামি দামি গ্রহরত্ন কেনান। এই সময় তো তাঁরা ভুলে থাকতে ভালবাসেন শতকরা প্রায় একশোভাগ জাতকের ক্ষেত্রেই সঠিক জন্ম-সময় লিপিবন্ধ করা হয়নি। জ্যোতিষীরা তখন তো জাতকদের জন্ম-সময় ভ্রান্তির প্রসঙ্গ তুলে জ্যোতিষীদের দ্বারস্থ হওয়া থেকে বিরত করেন না; বলেন না, আপনাদের জন্ম-সময় যেহেতু সঠিক হওয়ার সম্ভবনা প্রায় শূণ্য, তাই আমাদের এ বিষয়ে সঠিক গণনা করার সম্ভাবনাও শূণ্য। অতএব সেই শতকরা একশোভাগ ভুল গণনার জন্য আপনাদের অর্থগ্রহণ করা যেমন নীতিহীন কাজ, তেমনই নীতিহীন কাজ সেই ভুল গণনার উপর ভিত্তি করে আপনাদের গ্রহরত্ন ধারণ করতে নির্দেশ দিয়ে অর্থের পরিপূর্ণ অপচয় করানো।”
কিন্তু জ্যোতিষীরা তো এমনটা ঘটান না, এমনটা বলেন না। তখন তো জ্যোতিষীরা ছক-টক কেটে পটাপট জাতকের চারিত্রিক গঠন বিষয়ে, অতীত বিষয়ে বলে বহু ক্ষেত্রেই জাতকদের বিশ্বাস অর্জন করে নেন এবং ভবিষ্যদ্বাণী, সমস্যা সমাধানের হদিশ দেন।
কেন এমনটা মেলে ? কখনই জ্যোতিষীরা জন্ম- সময়ের ভ্রান্তির প্রশ্ন হাজির করেন ? জ্যোতিষশাস্ত্র মতে বাস্তবিকই জন্ম সময় কতটা নিখুঁত হওয়া প্রয়োজন ? একটু দেখা যাক ।
ফলিতজ্যোতিষ নিয়ে পড়শুনা করেছি। পড়ে বাস্তবক্ষেত্রে পরীক্ষা করে স্পষ্টতই বুঝেছি, ফলিতজ্যোতিষ নেহাতই একটা চান্সের ব্যাপার, অর্থাৎ মিলতেও পারে, নাও মিলতে পারে । আবার জ্যোতিষশাস্ত্র মতে গণনা না করে, জাতকদের বাহ্যিকভাবে দেখে, তার আচার- আচরণ বিচার করে, কথাবার্তার ধরণ দেখে তাদের সম্বন্ধে অনেক কিছু ঠিক-ঠাক বলে দিয়ে বহু জাতককেই বিস্মিত করে দিয়েছি। একজনের জামা, কাপড়, জুতো, ঘড়ি, চেহারা চোখ, কথাবার্তা অনেক সময়ই তার আর্থিক অবস্থা, রুচি, শিক্ষাদীক্ষা, কোন পরিবেশে মানুষ, কোন বিষয়ে উৎসাহী ইত্যাদির হদিশ দেয়। চোখ-মুখের চেহারা, শরীরের গঠন, শ্বাস নেবার শব্দ, বসার অস্বস্তি ইত্যাদি দেখে ব্লাড সুগারের রোগী, কলেস্টোরলের রোগী, হৃদরোগী, পেটের গোলমালের রোগী, হাঁপানী রোগী বা অর্শরোগীকে অনেক সময়ই চিহ্নিত করা যায়। জাতক কি ধরনের প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন জানা থাকলে অনেক সময় বলা সম্ভব, “আপনি নিজের চেষ্টায় দাঁড়িয়েছেন”, “আপনার প্রতিষ্ঠার পিছনে রয়েছে অন্যের সাহায্যের হাত” ইত্যাদি। চেহারা দেখেই অনেক সময় বলে দেওয়া যায়, “আপনার জীবনে অনেক নারী পুরুষ আসবে।” অনেক অর্থ-প্রতিষ্ঠিত বা প্রতিষ্ঠিত মানুষকে যদি বলেন, “আপনার যতখানি নাম-যশ, প্রতিষ্ঠা পাওয়া উচিৎ ছিল তা আপনি পাননি।” দেখবেন জাতক আপনার কথায় বেজায় খুশি হয়ে উঠবে। আপনি একটু বুঝে-সমঝে কাউকে যদি বলেন, “পরিবারের জন্য, বন্ধুবান্ধবদের জন্য আপনি প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করেছেন, কিন্তু বিনিময়ে অনেক সময়ই তাঁদের কাছ থেকে আন্তরিক, কৃতজ্ঞ’ ব্যবহার পাননি, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁরা অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন।” দেখবেন জাতক ভাবাবেগের শিকার হয়ে পড়েছেন, অনেক গোপন খবরই আপনার কাছে গড় গড় করে বলে চলেছেন। একজনের চেহারা দেখলে, কথা শুনলে তার মানসিকতার আঁচ করাও অনেক ক্ষেত্রেই মোটেই কঠিন ব্যাপার নয়। আপনি দু-একটি কথা বলে জাতকের আস্থা পেলেই দেখবেন, জাতক আপনাকে আপনজন মনে করে মনের জানালা খুলে দিয়েছেন। আপনার কাছ থেকে সহানুভূতি শুনে, মনের মত কথা শুনে এইসব জাতকরাই পরিচিত জনের কাছে আপনার গুণগানে পঞ্চমুখ হবেন। প্রেম বা বিয়ের ক্ষেত্রে “ধরি মাছ, না ছুঁই পানি” করলে তো পোয়াবারো, না হলেও সফলতা বা বিফলতা, যে পক্ষেই মত দিন সেই মত মোটামুটি শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ঠিক বা ভুল ঘটারই সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। ঠিক হলে নাম আরও বাড়বে। ভুল হলেও চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই । জাতকের আবেগকে ঠিকমত সুড়সুড়ি দিন, তাঁর প্রতি সহানুভূতি জানান, দেখবেন তিনিও আপনার ভক্ত হয়ে উঠেছেন। জাতক তখন অন্যদের কাছে আপনার প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলার সময় আপনার জ্যোতিষবিচারের ব্যর্থতার দিকগুলো এড়িয়ে সফলতার প্রসঙ্গ এনে আপনার জ্যোতিষবিচারের অভ্রান্ততার কথাই প্রমাণ করতে চাইবেন।
আমাদের দেশের সমাজব্যবস্থায় জ্যোতিষীর কাছে যাঁরা যান, তাঁদের বেশিরভাগই সমস্যাপীড়িত অথবা জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাসী। তাঁদের এই বিশ্বাস পরিবেশগতভাবেই এসেছে। তাই জ্যোতিষীরা যখন এইসব জাতকদের বাহ্যিকভাবে দেখে আচার-আচরণ শুনে অনেক কিছু বলে যান, তখন জাতকরা মিলে যাওয়া কথাগুলোই মনে রাখেন, না মেলা কথাগুলো ভুলে যান, অথবা উল্লেখ না করাই পছন্দ করেন। এইসব জাতকরা কিন্তু অবশ্যই চান জ্যোতিষীটির প্রতি তাঁর একান্ত বিশ্বাস আপনার মধ্যেও সংক্রামিত করতে।
আবার বলি, এইসব মিলে যাওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক বা বেঠিক জন্ম-সময় আদৌ কাজ করে না। তিনিই সফল জ্যোতিষী, যিনি মানুষের মন ভাল বোঝেন। নামী-দামী জ্যোতিষী অমৃতলাল “জ্যোতিষীদের ভবিষ্যদ্বাণী কেন মেলে না” শিরোনামের প্রবন্ধে জানাচ্ছেন, ভবিষ্যদ্বাণীকে সফল করতে হলে জ্যোতিষীদের হতে হবে মনস্তাত্বিক, তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। অমৃতলাল বাস্তবিকই ঠিক কথা বলেছেন। সফল ‘জ্যোতিষী হতে এইসব ‘গুণেরই প্রয়োজন, জাতকের সঠিক জন্ম-সময় নয় ।
ধরা গেল আপনি আপনার ঠিক জন্ম-সময় জানতে পেরেছেন । তিন জ্যোতিষীকে আপনি ওই একই জন্ম-সময় দিলেন গণনার জন্য। গ্রহ-অবস্থান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে একজন গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা, একজন দিকসিদ্ধ পঞ্জিকা এবং একজন এফিমেরিস-এর সাহায্য গ্রহণ করলেন। ফলে হয়তো দেখা গেল তিন জ্যোতিষী জাতকের লগ্ন বসিয়েছেন সিংহ, কন্যা এবং তুলা । কিন্তু দেখবেন তা সত্বেও এঁদের প্রত্যেকের ভবিষ্যদ্বাণী কিছু না কিছু সফল হয়েছে। একই জন্ম-সময় দিলেও রাশি বা গ্রহ-অবস্থান বিভিন্ন জ্যোতিষীর গণনায় অনেক সময়ই ভিন্নতর হয়েই থাকে বিভিন্ন পঞ্জিকায় ও এফিমেরিসে গ্রহসংস্থান ভিন্ন ভিন্ন থাকার দরুণ। গ্রহ- অবস্থানেই যেখানে মতান্তর, সেখানে জ্যোতিষী কোন মতকে গ্রহণ করবেন ? জ্যোতিষী যে মতটিকে গ্রহণ করবেন সেটাই যে অভ্রান্ত, এই বিষয়ে নিশ্চয় তিনি সোচ্চারে মত প্রকাশ করবেন। বাস্তব সত্য এই যে, সব রকম পদ্ধতিতে গণনা করা ভবিষ্যদ্বাণীই কিছু না কিছু মেলে। আবার জ্যোতিষশাস্ত্রের সাহায্য না নিয়ে মনস্তত্ব, তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও দূরদৃষ্টির সাহায্য নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করলেও দেখবেন কিছু কিছু মিলে যাচ্ছে। অর্থাৎ এই মেলা বা না মেলার সঙ্গে জাতকের সঠিক ছক বা সঠিক জন্ম-সময়ের কোনও সম্পর্ক নেই, প্রমাণ হিসেবে আপনি রাশিচক্রের প্রতিটি ঘরকে এক একবার লগ্ন হিসেবে ধরে গণনা করলেই দেখতে পাবেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিছু কিছু ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যাচ্ছে।
বহু শহর ও শহরতলীতেই খাঁচাবন্দী টিয়া কী বুলবুলি নিয়ে বসেন জ্যোতিষী। খাঁচার সামনে সাজান থাকে সারি সারি খাম। জাতক পয়সা দিলে জ্যোতিষী খাঁচার দরজা খুলে দেন। পাখিটি এসে কোনও একটি খামকে টান দেয়। জ্যোতিষী খামের ভিতর থেকে বের করেন এক টুকরো কাগজ। তাতেই লেখা থাকে ভবিষ্যদ্বাণী। জ্যোতিষী কাগজটি পড়ে শোনান জাতককে। জাতক মাথা নেড়ে জানাতে থাকেন তাঁর অনেক কথাই মিলছে। জ্যোতিষী খামটা জায়গা মত গুঁজে রাখার পর আবারও যদি জাতক পয়সা দিতেন, আবারও পাখিটি বেরিয়ে এসে টান লাগাত কোনও একটি খামে। সেটি অন্য কোনও খাম হলেও পড়লেই দেখা যেত জাতকের জীবনে কিছু কিছু ঘটনা এক্ষেত্রেও মিলে যাচ্ছে। আমি এই ধরনের পরীক্ষা করে তারপরই এই সিদ্ধান্তে এসেছি।
জন্ম-সময় কোনটি এই নিয়েও তো জ্যোতিষীদের মধ্যে রয়েছে নানা মত। কোনও জ্যোতিষী মাতৃগর্ভ থেকে শিশুটির পুরোপুরিভাবে বেরিয়ে আসার সময়কে জন্ম-সময় ধরেন, কোনও জ্যোতিষী জন্ম সময় হিসেবে গণ্য করেন শিশুর মস্তিষ্ক মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসার সময়কে, কোনও জ্যোতিষী নাড়ি কাটার সময়কে জন্ম-সময় হিসেবে গণ্য করেন। আবার কোনও জ্যোতিষী মনে করেন জাতক যে মুহূর্তে মাতৃ জঠরে এলো সেটাই তার জন্ম- সময়। তান্ত্রিক জ্যোতিষী মদনগোপাল সেন ‘তন্ত্রের দর্শন ও ভাগ্যদর্শন’ শিরোনামের একটি লেখাতেও জানিয়েছেন তান্ত্রিক জ্যোতিষীরা জন্ম সময় বলতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়কে গ্রহণ করেন না। তাঁরা জাতকের মাতৃজঠরে আসার মুহূর্তকেই জন্ম সময় বলে গ্রহণ করেন।
জাতকের মাতৃজঠরে আসার মুহূর্ত জানা—সে তো এক দুরূহ কর্ম। তাহলে তো সঠিক জন্ম-সময়ের অভাবে জ্যোতিষীরা জাতকদের ভবিষ্যৎ বিষয়ে কিছু বলতেই পারবে না।
এ বিষয়ে আশার আলো দেখাচ্ছেন জ্যোতিষী-সম্রাট ডঃ অসিত কুমার চক্রবর্তী। তাঁর ‘জ্যোতিষবিজ্ঞান কথা’ বইয়ের ২৮ পৃষ্ঠায় বলছেন, “জ্যোতিষশাস্ত্র মতে কোন নারী কখন গর্ভবর্তী হবেন বা হবেন না, তা আগে থেকেই জানিয়ে দেওয়া সম্ভব।”
ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত হলে স্বভাবতই কোন দিন কোন মুহূর্তে একজন নির্দিষ্ট পুরুষ একজন নির্দিষ্ট নারীর সঙ্গে মিলিত হবেন, সে তো তাদের জন্ম মুহূর্তেই নির্ধাবরিত হয়ে গেছে। যে মুহূর্তে একজন নারীর গর্ভ হওয়ার কথা ঠিক হয়ে রয়েছে, সেদিন তাকে গর্ভবতী হতেই হবে । আর জ্যোতিষশাস্ত্রের সাহায্যে পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যকে জানা বাস্তব সত্য হলে জ্যোতিষীরা গণনা করে জাতকের মাতৃজঠরে আসার মুহূর্তটি বলে দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে একাধিক ‘যদি’, ‘তবে’ ‘কিন্তু’ ইত্যাদি ভিড় করেছে। ‘যদি’ ভাগ্যপূর্বনির্ধারিত হয়, ‘পুরুষকার’ নামক ভাগ্য পাল্টে দেওয়ার মত উদ্যোগের বাস্তব অস্তিত্ব না থাকে এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের দ্বারা বাস্তবিকই একজন জাতকের জীবনের প্রতিটি পূর্বনির্ধারিত ঘটনা বা মুহূর্ত গণনা করে বলা সম্ভব হয়, তবেই ডঃ চক্রবর্তীর যুক্তিকে আমরা গ্রহণ করতে পারি। কিন্তু ডঃ চক্রবর্তী এই বইটিতেই তো ফলাও করে পুরুষকারের বাস্তব অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করেছেন। ধরা গেল ‘ক’ বাবু একজন লেখক। ‘খ’ বিবি একজন কলগাল। পূর্বনির্ধারিত হয়ে রয়েছে ক’বাবু ও খ’বিবির দেহ-মিলন হেতু ১৯৮৯এর ৩১ জুলাই রাত ১১টা ৩৩ মিনিট ১৮ সেকেণ্ডে খ’বিবি গর্ভবর্তী হবেন। ক’বাবুর ভিতরকার পুরষকার হঠাৎ জেগে উঠল। তিনি ঠিক করলেন, খ’বিবির পিছনে সময় নষ্ট না করে তার উপন্যাসের বাকি অংশটা শেষ করতে বসবেন। পুজো সংখ্যার লেখা নিয়ে বসলেন ক’বাবু। খ’বিবি মিথ্যেই হা-পিত্তেশ করে ক’বাবুর পথ চেয়ে শেষ পর্যন্ত রাগ থামাতে নিজের বাড়ির ডজন দু’য়েক কাপ ডিস ভাঙলেন । কিন্তু শেষ পর্যন্ত নীট ফল দাঁড়ালো এই ক’বাবুটির পুরুষকার খ’বিবিকে ৩১ জুলাই রাত দুপুরে গর্ভবতী হতে দিল না। অতএব জ্যোতিষগণনা করে ডঃ চক্রবর্তী খ’বিবির গর্ভসঞ্চার এবং জাতকের জন্ম-সময় ‘৮৯-এর ৩১ জুলাই রাত ১১টা ৩৩ মিনিট ১৮ সেকেন্ড বলে যখন জাতকের ভাগ্য গণনা নিয়ে দিস্তার পর দিস্তা কাগজ খরচ করে চলেছেন, তখন ক’বাবুর পুরুষকার প্রমাণ করে দিল, নারী কখন গর্ভবর্তী হবে জ্যোতিষশাস্ত্রের পক্ষে তা জানান অসম্ভব ।
ডঃ চক্রবর্তী আলোচনা প্রসঙ্গে জানিয়েছেন ধর্ম জ্যোতিষশাস্ত্রকে স্বীকার করে। কিন্তু তিনি কী জানেন ধর্মীয় নেতা স্বামী অভেদানন্দ তাঁর ‘মরণের পারে’ বইটিতে জানিয়েছেন, “পিতামাতা এই দেহ গঠনের সাহায়ক মাত্র, তাছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের সাহায্যেই প্রাকৃতিক নিয়মকে রক্ষা করে দেহগঠনে সমর্থ হয় সূক্ষ্মশরীর । পিতামাতা আত্মাকে সৃষ্টি করেন না। তা সম্পূর্ণ অসম্ভব। যতক্ষণ পর্যন্ত না আত্মা পিতামাতার অভ্যন্তরে আবির্ভূত হয় এবং প্রাণীবীজটিকে লালন করে ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের জন্ম অসম্ভাব্যই থাকে।” (পৃষ্ঠা- ৬২)
অর্থাৎ, একজোড়া সুস্থ-সবল ও জন্মদানে সক্ষম নারী-পুরুষ তাদের দেহ-মিলনের সাহায্যে কখনই কোনও মানুষের জন্ম দিতে পারে না। নতুন মানুষটি জন্ম নেবে কিনা তা সম্পূর্ণই নির্ভর করে বিদেহী আত্মার ইচ্ছের উপর। কোনও নারীর গর্ভবর্তী হওয়াটা যদি আত্মার একান্তই ইচ্ছাধীনই হয়, তবে গর্ভবর্তী হওয়াটা কখনই পূর্বানির্ধারিত হতে পারে না। আর শুধুমাত্র পূর্বনির্ধারিত হলেই জ্যোতিষ গণনায় নির্ণয় করা সম্ভব যদি অবশ্য দাবি মত বাস্তবিকই জ্যোতিষশাস্ত্র মত গণনা করে ভবিষ্যৎ বলার ব্যাপারটা সত্যি হয়। সাধারণ মানুষ প্রমাণহীন কার ব্যক্তি-বিশ্বাসকে গ্রহণ করবে ? স্বঘোষিত জ্যোতিষসম্রাট ডঃ চক্ৰবৰ্তী, না স্বঘোষিত বিজ্ঞানী-ধর্মনেতা স্বামী অভেদানন্দের ? জোতিষসম্রাটের কোন মতটিকেই বা গ্রহণ করা হবে-ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত, না ভাগ্য পুরুষকারের দ্বারা নির্ধারিত ? পুরুষকারকে স্বীকার করলে জন্মকালীন গ্রহ অবস্থান দেখে জাতকের ভাগ্য নির্ণয় করা ব্যাপারটাকেই অস্বীকার করতে হয়, অস্বীকার করতে হয় জ্যোতিষশাস্ত্রকে।
না, কোনও ব্যক্তি-বিশ্বাসেরই এক কাণা-কড়িও দাম নেই যুক্তির কাছে, বিজ্ঞানের কাছে। আবারও সেই পুবোন কথাটাই মনে করিয়ে দিই, যুক্তি ও বিজ্ঞান পরীক্ষিত সত্যকেই শুধু গ্রহণ করে এবং করবে।
জ্যোতিষীদের কাছে পরমশ্রদ্ধেয় বরাহমিহিরের বিহদজ্জাতক-এ বলা হয়েছে—গর্ভধারণকালে শনি ও মঙ্গল উভয়ই যদি কন্যা বা মিথুন রাশির শেষ নবাংশে থাকে এবং বলবান শুভ গ্রহ দ্বারা দৃষ্ট না হয়, আর ঐ লগ্নে চন্দ্র থাকে, এবং বলবান শুভগ্রহের দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়ে শনি ও মঙ্গলের দ্বারা পূর্ণ-দৃষ্ট হয় তবে কুব্জ জন্ম হয়। মীন লগ্নে গর্ভাধান হলে, যদি ঐ লগ্নে শনি, চন্দ্র ও মঙ্গলের পূর্ণ দৃষ্টি থাকে, কিন্তু শুভ গ্রহের দৃষ্টি বর্জিত হয় তাহলে পঙ্গু জন্ম হয়। গর্ভাধানকালে রবি, মঙ্গল, শনি ও চন্দ্র যদি কর্কট বা মীন রাশির শেষ নবাংশ থেকে শুভ গ্রহের দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হয় তবে বধিরের জন্ম হয়। এছাড়া হীনাঙ্গ, অন্ধ ও বামন ইত্যাদির ক্ষেত্রেও গর্ভাধানকালীন বিভিন্ন গ্রহ-অবস্থানের কথা বলা আছে। অনেক জ্যোতিষী এইসব শাস্ত্রবাক্যকে পরম বিশ্বাসে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এইসব শাস্ত্রবাক্যের সত্যতা প্রমাণ করতে আজ পর্যন্ত কেউই এগিয়ে আসেন নি। অর্থাৎ এ-সব শাস্ত্রবাক্য বিশ্বাসের গণ্ডিতেই আবদ্ধ রয়েছে।
এবার ভাবুন তো, জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে নানা মুনির নানা মতের মাঝখান থেকে আমরা জন্ম-সময় বলতে কোন মতটিকে গ্রহণ করবো ?
আমরা কী তবে সংখ্যাগুরুদের মতামতকেই গ্রহণ করবো ? কোন যুক্তিতে ? সংখ্যাগুরুর মতামত, শুধুমাত্র এই যুক্তিতে ? আমরা তো হাজার হাজার বছর ধরেই দেখতে পাচ্ছি, কিভাবে সংখ্যাগুরুদের বহু মতামত যুক্তির কাছে বিজ্ঞানের কাছে এক সময় মিথ্যে হয়ে গেছে । সংখ্যাগুরুদের মতামতকে সম্মান দিতে গেলে আমাদের তো আজও সোচ্চারে বলা উচিত, পৃথিবীর চারপাশে সূর্য পাক খেয়ে চলেছে। মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞানের সত্য কোনও নির্বাচনের ব্যাপার নয় যে, সংখ্যাগুরুদের মতামতই শুধু গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে ।
এবার আরও একটা মজার দিকে আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি। ধরুন একজন জাতকের ভাগ্য গণনার জন্য কয়েকজন জ্যোতিষীর সাহায্য নিলাম আমরা। এঁরা একই জাতকের জন্ম-সময় হিসেবে গ্রহণ করলেন মাতৃজঠরে আসার সময়, মাতৃজঠর থেকে মাথাটুকু বের করার সময়, ভূমিষ্ঠ হওয়ার অর্থাৎ মাতৃজঠর থেকে পুরোপুরি বের হওয়ার সময় এবং নাড়ি কাটার সময়। এইসব বিভিন্ন জন্ম-সময় নিয়ে গণনা করা সত্ত্বেও দেখা যাবে প্রত্যেক জ্যোতিষীরই কিছু কিছু গণনা মিলে যাচ্ছে। অর্থাৎ, ‘জন্ম-সময়’, ‘লগ্ন-নিৰ্ণয়’ ইত্যাদি বিষয়গুলোই একান্তভাবে অর্থহীন ৷
জাতক কখনো কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জ্যোতিষীর মতামত গ্রহণ করার পর জ্যোতিষবিচার ভ্রান্ত হতে দেখে জ্যোতিষী ও জ্যোতিষশাস্ত্রের অভ্রান্ততা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলে জ্যোতিষী নিজের এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের অক্ষমতা ঢাকতে জাতকের জন্ম-সময়ের যাথার্থতা নিয়ে পাল্টা সংশয় প্রকাশ করেন। বাস্তবে জ্যোতিষশাস্ত্রমতে সাধারণভাবে লগ্নমধ্যবর্তীকালে পনের মিনিট, আধ ঘন্টা, এমন কি এক ঘন্টার পার্থক্য জন্ম-সময় ধরলেও লগ্ন অপরিবর্তিতই থাকে। সঠিক সময়ের প্রশ্ন শুধু লগ্ন পরিবর্তনের সন্ধিকালে উঠতে পারে ।
যমজ সন্তানের ক্ষেত্রে সাধারণত দেখা যায় দুই-জাতকের ছকই সর্বাংশে এক, এমন কি নক্ষত্রের প্রভেদও থাকে না। অথচ বাস্তব জীবনে যমজ জাতক বহু ক্ষেত্রেই ভিন্নতর জীবন নির্বাহ করেন। এমনও দেখা যায়, একজন উচ্চশিক্ষিত, অপরজন নিম্নশিক্ষিত, একজন শান্ত, অপরজন অশান্ত, একজন মোটা, অন্যজন রোগা, একজন সাহসী, অন্যজন ভীরু, একজন ধনী, অপরজন দরিদ্র, একজন প্রতিষ্ঠিত, অন্যজন অপ্রতিষ্ঠিত। এঁদের ক্ষেত্রে বৈপরিত্যের কারণ দর্শাতে জ্যোতিষীরা দুই যমজ জাতকের জন্ম-সময়ের ব্যবধানকে দায়ী করেছেন। সাধারণভাবে যমজ জাতকদের লগ্নকাল, গ্রহ ও নক্ষত্রের সম্বিবেশ কিন্তু একই দেখা যায়।
অতএব জন্ম সময়ের ভ্রাস্তির যুক্তিটিও শেষ পর্যন্ত আদৌ ধোপে টেকে না।