একজন সুপরিচিত বৈজ্ঞানিক (অনেকে বলেন, বাট্টান্ড রাসেল) একবার জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে জনসাধারণের কাছে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পৃথিবী কি করে সূর্যকে প্রদক্ষিন করে,  আমার সূর্য কি করে আমাদের নীহারিকা (Galaxy) অর্থাৎ বিরাট একটি তারকা সংগ্রহের কেন্দ্রকে প্রদক্ষিন করে ঘোরে। বক্তৃতা শেষে ঘরের পিছন থেকে ছোটখাটো এক বৃদ্ধা উঠে দাঁড়িয়ে বললেনঃ “এতক্ষণ আপনি আমাদের যা বলেছেন- সব বাজে কথা। পৃথিবীটা আসলে চ্যাপ্টা, আর রয়েছে বিরাট এক কচ্ছপের পিঠের উপর।“ বৈজ্ঞানিক বিজ্ঞের হাঁসি হেসে বললেন, “কচ্ছপটা কার উপর দাঁড়িয়ে আছে?” বৃদ্ধা বললেন, “ছোকরা, তুমি বেশ চালাক- খুব চালাক। তবে তলায় পর পর সবই কচ্ছপ রয়েছে।“

মহাবিশ্ব অসংখ্য কচ্ছপের স্তম্ভ- এ চিত্র অধিকাংশের কাছেই হাস্যকর মনে হবে। কিন্তু আমরা বেশী জানি এ কথা ভাবব কেন? মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা কি জানি এবং কিভাবে জানি? মহাবিশ্ব এসেছে কোত্থেকে এবং যাচ্ছেই বা কোথায়? মহাবিশ্বের কি কোন শুরু ছিল? যদি থেকে থাকে তাহলে তার আগে কি হয়েছিল? কালের চরিত্র কি? কাল কি কখনো শেষ হবে? পদার্থবিদ্যার ইদানিং কালের আবিষ্কারের সাহায্যে (সে আবিষ্কারগুলি অংশগত হয়েছে কিছু অকল্পনীয় প্রযুক্তিবিদ্যার সাহায্যে) এই সমস্ত বহু দিনের বহু প্রাচীন প্রশ্নগুলির কিছু কিছু উত্তরের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কোনো দিন হয়তো এই উত্তরগুলিকে পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিন করার মতো স্বতঃপ্রতীয়মান মনে হবে। কিম্বা হয়তো মনে হবে কচ্ছপের স্তম্ভের মতো হাস্যকর। এ সম্পর্কে শুধুমাত্র কালই (সে যাই হোক) বলতে পারবে।

প্রাচীনকালে ৩৪০ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্ধে গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টোটল তাঁর অন দি হেভেন্স (ON THE HEAVENS- মহাকাশ সম্পর্কে) বইতে পৃথিবী যে একটি বৃত্তাকার গোলক এবং একটা চ্যাপ্টা থালা নয়- এ সম্পর্কে দুটি ভাল যুক্তি দেখাতে পেরেছিলেন। প্রথমত, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, চন্দ্রগ্রহণের কারণ সূর্য এবং চন্দ্রের মাঝখানে পৃথিবীর আসা। চন্দ্রের উপর পৃথিবীর ছায়া সব সময়েই গোলাকৃতি। পৃথিবী গোলাকৃতি বলেই এটা সম্ভব। পৃথিবী যদি চ্যাপ্টা থালার মতো হত তা হলে সূর্য যখন থালার কেন্দ্রের ঠিক নিচে অবস্থান করছে- তখনই গ্রহণ না হলে ছায়াটি হতো লম্বাটে এবং উপবৃত্তাকার (elliptical)। দ্বিতীয়ত, গ্রীকরা তাঁদের ভ্রমণের ফলে জানতেন দক্ষিন দিক থেকে দেখলে উত্তর দিক থেকে দেখার তুলনায় ধ্রুবতারাকে (North Star)আকাশের অনেক নিচুতে দেখা যায়। (যেহেতু ধ্রুবতারা উত্তর মেরুর উপরে অবস্থিত, সেজন্য উত্তর মেরুর একজন পর্যবেক্ষকের মনে হয় তারাটি ঠিক তার মাথার উপরে। কিন্তু বিষুবরেখা থেকে দেখলে মনে হয় তারাটির অবস্থান দিকচক্রবালে)। মিশর এবং গ্রীস থেকে ধ্রুবতারার আপাতদৃষ্ট অবস্থানের পার্থক্য পর্যালোচনা করে অ্যারিস্টোটল পৃথিবীর পরিধির একটা অনুমান করেছিলেনঃ চার লক্ষ স্ট্যাডিয়া (stadia)। স্ট্যাডিয়ামের (Stadium) দৈর্ঘ্য ঠিক কতটা সেটা জানা যায় না। তবে প্রায় ২০০ গজ হয়তো ছিল। তা হলে ইদানিং কালের স্বীকৃত মাপের তুলনায় অ্যারিস্টোটলের অনুমান প্রায়  দ্বিগুণ। পৃথিবী বৃত্তাকার এ তথ্যের সপক্ষে গ্রীকদের আরো একটি যুক্তি ছিল। তা না হলে দিকচক্রবাল থেকে জাহাজ আসবার সময় প্রথম কেন পাল দেখা যাবে এবং তারপরে কেন দেখা যাবে জাহাজের কাঠামোটা?

অ্যারিস্টোটল ভাবতেন পৃথিবীটা স্থির এবং সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ ও তারকারা পৃথিবীর চারদিকে বৃত্তাকার পথে চলমান। তিনি এটা বিশ্বাস করতেন তার কারণ অতীন্দ্রিয়বাদী (mystical) যুক্তিতে তিনি বিশ্বাস করতেন, পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র এবং বৃত্তাকার পথে সবচাইতে নিখুঁত। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে টোলেমী (Ptolemy) এই  ধারণা বিস্তার করে ব্রক্ষ্মান্ডের একটি সম্পূর্ণ প্রতিরূপ (cosmological model) তৈরি করেছিলেন। পৃথিবী ছিল কেন্দ্রে এবং তাকে ঘিরে ছিল আটটি গোলক। এই গোলকগুলি বহন করত চন্দ্র, সূর্য, তারকা এবং সেই যুগে জানিত পাঁচটি গ্রহ- বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি এবং শনি (চিত্র ১.১) গ্রহগুলি নিজেরা তাদের নিজ নিজ গোলকের সঙ্গে যুক্ত ক্ষুদ্রতর বৃত্তে ভ্রমণ করে। এই বিবরণ ব্যাখ্যা করত তাদের আকাশে পর্যবেক্ষণ করা পথের জটিলতা। সবচাইতে বাইরের গোলকে থাকে তথাকথিত স্থির তারকাগুলি, এই তারকাগুলি পরস্পর সাপেক্ষ সব সময়ই একই অবস্থানে থাকে কিন্তু তারা একত্রে আকাশের এপার থেকে ওপারে ঘোরে। শেষ গোলকের বাইরে কি থাকত সেটা কখনোই স্পষ্ট ছিল না। তবে সেটা নিশ্চিত ভাবেই মানুষের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের অংশ ছিল না।

টোলেমীর (Ptolemy) প্রতিরূপ থেকে মহাকাশের বস্তুপিন্ডগুলির আকাশে অবস্থান সম্পর্কে মোটামুটি নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব ছিল। সে জন্য টোলেমীকে একটা অনুমান করতে হয়েছিলঃ চন্দ্র এমন একটি পথ পরিভ্রমণ করে, যে পথে অনেক সময় অন্যান্য সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ দেখানো উচিত। এই ত্রুটি টোলেমী বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু তবুও এই প্রতিরূপটি সাধারণভাবে গৃহীত হয়েছিল। অবশ্য সবাই মেনে নেন নই। খ্রীষ্টীয় চার্চ এই প্রতিরূপ গ্রহণ করেছিল। তার কারণ তাদের ধর্মশাস্ত্রের সঙ্গে এই প্রতিরূপের মিল ছিল। এই প্রতিরূপের সুবিধা হল, স্থির তারকাগুলির গোলকের বাইরে স্বর্গ এবং নরকের জন্য অনেকখানি জায়গা পাওয়া যায়।

চিত্রঃ ১.১

নিকোলাস কোপার্নিকাস (Nicholas Copernicus) নামক একজন পোলিশ পুরোহিত ১৫১৪ সালে একটি সরলতর প্রতিরূপ উপস্থাপন করেন (প্রথমে হয়তো নিজেদের চার্চ ধর্মবিরোধী বলবে এই ভয়ে কোপার্নিকাস নিজের প্রতিরূপটি নিজের নাম না দিয়ে প্রচার করেন)। তাঁর ধারণা ছিল সূর্য কেন্দ্রে স্থিরভাবে অবস্থান করে এবং পৃথিবী আর অন্যান্য গ্রহ বৃত্তাকার পথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এই চিন্তাধারাকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে প্রায় এক শতাব্দী লাগে। তারপর জার্মান জোহান কেপলার এবং ইতালীয়ান গ্যালিলিও গ্যালিলি এই দুজন জ্যোতির্বিদ প্রকাশ্য ভাবে কোপার্নিকাসের তত্ত্ব সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করতে শুরু করেন। অথচ, এই তত্ত্ব যে রকম কক্ষের পূর্বাভাস দিয়েছিল তার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা কক্ষের সম্পূর্ণ মিল ছিল না। অ্যারিস্টোটলীয়-টোলেমীয় তত্ত্বের উপর মরণ আঘাত আসে ১৬০৯ খ্রীষ্টাব্দে। সে বছর গ্যলিলিও সদ্য আবিষ্কৃত যন্ত্রের সাহায্যে  রাত্রির পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেন। বৃহস্পতি গ্রহকে দেখবার সময় তিনি কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপগ্রহ অর্থাৎ চন্দ্র দেখতে পান। সেগুলি বৃহস্পতিকে প্রদক্ষিন করছে। এর নিহিত অর্থ হল, অ্যারস্টোটল এবং টোলেমী যা ভাবতেন সেই মতানুসারে যদিও সবারই পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করা উচিত, তবুও সব জিনিসই পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করে  না (অবশ্য তখনও বিশ্বাস করা সম্ভব ছিলঃ পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রে স্থীরভাবে অবস্থান করছে এবং বৃহস্পতির চন্দ্রগুলি অত্যন্ত জটিল পথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। পথটা এমন যে, মনে হয় তারা বৃহস্পতিকে প্রদক্ষিণ করছে। কিন্তু কোপার্নিকাসের তত্ত্ব ছিল অনেক সরল)। একই সময় জোহান কেপলার কোপার্নিকাসের তত্ত্বের পরিবর্তন করেন। তাঁর মতে গ্রহগুলি বৃত্তাকার পথে চলমান নয়, চলমান উপবৃত্তাকারে (ellipse: উপবৃত্ত লম্বাটে একটা বৃত্ত)। শেষ পর্যন্ত পূর্বাভাস এবং পর্যবেক্ষণে মিল হল।

কেপলারের কাছে কিন্তু উপবৃত্তাকার কক্ষ ছিল একটি অস্থায়ী প্রকল্প মাত্র বরং এ প্রকল্প ছিল প্রতিকূল। কারণ উপবৃত্ত স্পষ্টতই বৃত্তের চাইতে কম নিখুঁত। কেপলার আকস্মিক ভাবে আবিষ্কার করেনঃ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে উপবৃত্ত ভাল মেলে। তাঁর ধারণ ছিল, গ্রহগুলিকে সূর্যের চারদিকে ঘুরতে বাধ্য করে চৌম্বক বল। এই ধারণার সঙ্গে এই আকস্মিক আবিষ্কারকে তিনি মেলাতে পারছিলেন না। এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় অনেক পরে ১৬৮৭ খ্রীষ্টাব্দে। স্যার আইজাক নিউটন তাঁর ফিলোজফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটকা (Philosophiae Naturalis Principia Mathematica) গ্রন্থটি প্রকাশ করার পর। এটা বোধ হয়, ভৌতবিজ্ঞান বিজ্ঞান বিষয়ে প্রকাশিত বইগুলির ভিতরে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। এ বইটাতে নিউটন শুধুমাত্র স্থান-কালে বস্তুপিন্ডগুলি কি করে চলাচল করে সে সম্পর্কে তত্ত্বকথাই দেন নি, তিনি এই গতিগুলো বিশ্লেষণ করার জন্য যে জটিল গণিত প্রয়োজন সেটাও সৃষ্টি করেছিলেন। এ ছাড়া নিউটন একটি প্রকল্পিত সর্বব্যাপী মহাকর্ষীয় বিধি উপস্থাপন করেন। এই বিধি অনুসারে মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুপিন্ডই পরস্পরের প্রতি একটি বল দ্বারা আকৃষ্ট হয়, বস্তুপিন্ডগুলি পরস্পরের যত নিকটতর হবে, এই বল ততই শক্তিশালী হবে। তাছারা সে বলের শক্তি বৃদ্ধি হবে বস্তুপিন্ডের ভর বৃদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে। এই বলই বস্তুপিন্ডগুলির মাটিতে পড়ে যাওয়ার কারণ। (প্রচলিত কাহিনী হলঃ নিউটনের মাথায় একটা আপেল পড়াতে নিউটন অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এ কাহিনী প্রায় নিশ্চিতভাবে অপ্রমাণিত। নিউটন নিজে যা বলেছেন, তা হল, তিনি ‘চিন্তা করার মেজাজে’ বসেছিলেন, ‘তখন’ একটা আপেল পড়তে দেখে তাঁর মাথায় মহাকর্ষ সম্পর্কে ধারণা এসেছে)। নিউটন আরো দেখিয়েছিলেন, তাঁর বিধি অনুসারে মহাকর্ষ চন্দ্রকে উপবৃত্তাকার কক্ষে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করায় এবং সূর্যের চারপাশে গ্রহগুলির উপবৃত্তাকার পথে ভ্রমণের কারণও এই মহাকর্ষ।

কোপার্নিকাসের প্রতিরূপ টোলেমীর মহাকাশের নানা গোলক (celestical spheres) সম্পর্কে ধারণা দূরীভূত করে এবং তার সঙ্গে দূরীভূত হয় মহাকাশের একটি স্বাভাবিক সীমানা রয়েছে সেই ধারণা। পৃথিবীর নিজ অক্ষে আবর্তনের দরুন স্থির তারকাগুলির আকাশে আড়াআড়ি ঘূর্ণন (across the sky)  ছাড়া ‘সেগুলির’ অবস্থানের কোন পরিবর্তন দেখা যায় না। এইজন্য স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা হয়েছিল যে ওগুলি আমাদের সূর্যের মতোই বস্তু, তবে তাদের অবস্থান আরো দূরে।

নিউটন বুঝতে পেরেছিলেন তার মহাকর্ষীয় তত্ত্ব অনুসারে তারকাগুলির পরস্পরকে আকর্ষণ করা উচিত। সুতরাং মনে হয়েছিল তারা মূলত গতিহীন থাকতে পারে না। কোনো একটি বিন্দুতে কি তাদের একসঙ্গে পতন হবে না? সে যুগের আর এক জন চিন্তানায়ক রিচার্ড বেন্টলীকে (Richard Bentley) ১৬৯১ খৃষ্টাব্দে একটি পত্রে নিউটন যুক্তি দেখিয়েছিলেন, এ রকম হতে পারত শুধু মাত্র যদি তারকাগুলির সংখ্যা সীমিত হতো এবং তারা যদি স্থানের একটি সীমিত অঞ্চলে বিতরিত (distributed) থাকে, তা হলে এ রকম হবে না। কারণ, পতিত হওয়ার মতো কোনো কেন্দ্রবিন্দু থাকবে না।

অসীমত্ব নিয়ে বলতে গেলে কি রকম ভুল হতে পারে এই যুক্তি তার একটা দৃষ্টান্ত। একটি অসীম মহাবিশ্বে প্রতিটি বিন্দুকেই একটি কেন্দ্র বলা যেতে পারে। তার কারণ প্রতিটি বিন্দুরই সর্বদিকে অসীম সংখ্যক তারকা থাকবে। অনেক পরে বোঝা গিয়েছিল নির্ভুল দৃষ্টিভঙ্গি হবে শুধু সীমিত পরিস্থিতির বিচার করা। সেই পরিস্থিতিতে তারকাগুলি পরস্পরের উপর পতিত হবে। তারপর প্রশ্ন করা উচিত এই অঞ্চলের বাইরে যদি মোটামুটি সমরূপে বিতরিত আরো অনেক তারকাকে যোগ করা যায়, তা হলে কি পরিবর্তন হতে পারে। নিউটনের বিধি অনুসারে বাড়তি তারকাগুলি মূল তারকাগুলির ব্যাপারে গড়ে কোন পার্থক্য সৃষ্টি করবে না। সুতরাং তারকাগুলি একই দ্রুতিতে পতিত হবে। আমরা যতখুশি তারকা যোগ করতে পারি। তবুও তারা সর্বদা নিজেদের উপরে (but they will always collapse in on themselves) পতিত হয়ে চুপসে যাবে। এখন আমরা জানি মহাবিশ্বের এমন একটি স্থির প্রতিরূপ অসম্ভব যে প্রতিরূপে মহাকর্ষ সব সময়ই আকর্ষণ করে।

বিংশ শতাব্দীর আগেকার চিন্তা জগতের আবহাওয়া সম্পর্কে একটি আকর্ষণীয় ব্যাপার হল কেউই মহাবিশ্ব বিস্তৃত হচ্ছে কিম্বা সংকুচিত হচ্ছে এ রকম প্রস্তাব উত্থাপন করেন নি। সাধারণত মেনে নেওয়া হয়েছিল, হয় মহাবিশ্ব চিরকালই অপরিবর্তিত অবস্থায় বর্তমান ছিল, নয়তো কোন এক সীমিত কালে আমরা মহাবিশ্বকে যেরূপে দেখছি, মোটামুটি সেরূপেই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল। অংশতঃ এর কারণ, লোকে চিরন্তন সত্য বিশ্বাস করতে চাইত, তাছাড়া নিজেরা বৃদ্ধ হয়ে মরে গেলেও মহাবিশ্ব চিরন্তন ও অপরিবর্তনশীল- এই চিন্তায় তাঁরা সান্ত্বনা পেতেন।

এমন কি যারা বুঝতে পেরেছিলেন যে নিউটনের মহাকর্ষীয় তত্ত্ব থেকে বোঝা যায় মহাবিশ্ব স্থিতাবস্থায় থাকতে পারে না, তাঁরাও মহাবিশ্ব প্রসারমান এ রকম প্রস্তবনা করেন নি। বরং তাঁরা মহাকর্ষ তত্ত্বের পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা বলতে চেয়েছিলেন, অত্যন্ত বেশি দূরত্বে মহাকর্ষ বিকর্ষণ করে। এর ফলে গ্রহগতি সম্পর্কে তাঁদের পূর্বাভাসে বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয় নি। বরং অসীমভাবে বিতরিত তারকাগুলির ভারসাম্যের অবস্থা অনুমোদন করেছেন তার কারণ, নিকটতর তারকাগুলির আকর্ষণবল এবং দূরতর তারকাগুলির বিকর্ষণবল ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু এখন আমরা বিশ্বাস করি এ রকম ভারসাম্য হবে অস্থির। কোনো একটি অঞ্চলে তারকাগুলি যদি পরস্পরের সামান্য নিকটতর হয় তা হলে তাদের অন্তর্বর্তী আকর্ষণী বলগুলি শক্তিশালী হবে এবং বিকর্ষণী বলের উপর প্রভুত্ব করবে। সুতরাং তারকাগুলি পরস্পরের প্রতি পড়তেই থাকবে। আবার অন্যদিকে তারকাগুলি সামান্য দূরতর হয় তাহলে বিকর্ষণবল প্রভুত্ব করবে এবং তারা পরস্পর হতে দূরতর হতেই থাকবে।

অসীম স্থির মহাবিশ্ব সম্পর্কে আর একটি আপত্তি সাধারণত আরোপ করা হয় জার্মান দার্শনিক হাইনরিক ওলবারসের (Heinrich Olbers) উপরে। তিনি এই তত্ত্ব সম্পর্কে লিখেছিলেন ১৮২৩ সালে। আসলে নিউটনের সমসাময়িক অনেকেই এই সমস্যা উত্থাপন করেছিলেন। এমন কি ওলবারসের প্রবন্ধটি এর বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুক্তিপূর্ণ প্রথম প্রবন্ধ নয় কিন্তু এটাই প্রথমে বহু লোকের নজরে এসেছিল। মুশকিল হল, একটি অসীম স্থীর মহাবিশ্বে দৃষ্টির প্রতিটি রেখাই একটি তারকার পৃষ্ঠে গিয়ে শেষ হবে। সুতরাং আশা করা যাবে রাত্রিতেও সমস্ত আকাশ সূর্যের মতো উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। এর বিরুদ্ধে ওলবারসের যুক্তি ছিল দূরতর তারকা থেকে নির্গত আলোক অন্তর্বর্তী পদার্থের শোষণের ফলে ক্ষীণতর হবে। কিন্তু এরকম যদি ঘটে তা হলে শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী পদার্থও এমন উত্তপ্ত হবে যে সেগুলি তারকার মতো তপোদ্দীপ্ত হয়ে উঠবে। সে ক্ষেত্রে রাতের আকাশের সম্পূর্ণটাই সূর্যপৃষ্ঠের মতো উজ্জ্বল হবে। এই সিদ্ধান্ত এরাবার একমাত্র উপায় এই অনুমান করা যে তারকাগুলি চিরকালই ভাস্বর নয়, তার ভাস্বরতা অতীতের কোন সীমিত কালে শুরু হয়েছে। সেক্ষত্রে বিশোষণকারী পদার্থ হয়তো এখনো উত্তপ্ত হয়ে ওঠেনি, কিম্বা হয়তো সুদূরের তারকাগুলি থেকে আলোক এখনো আমাদের কাছে এসে পৌঁছায় নি। এর ফলে আর একটি প্রশ্ন আমাদের কাছে উপস্থিত হয়, সেটা হল তারাগুলি প্রথম জ্বলল কি করে?

অবশ্য এর অনেক আগেই মহাবিশ্বের শুরু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কয়েকটি আদিম সৃষ্টিতত্ত্ব এবং ইহুদী/ক্রীশ্চান/মুসলিম ঐতিহ্য অনুসারে মহাবিশ্বের শুরু একটি সীমিত অতীত কালে এবং সে কাল খুব সুদূর অতীতে নয়। এই রকম একটা শুরুর সপক্ষে ছিল এই বোধ যে মহাবিশ্বের অস্তিত্বের জন্য একটি “প্রথম কারণ (first cause)” প্রয়োজন। (মহাবিশ্বের ভিতরে আপনি সব সময়ই একটি ঘটনার ব্যখ্যা হিসাবে অন্য একটি পূর্বতন ঘটনাকে কারণ হিসাবে উল্লেখ করেন। কিন্তু মহাবিশ্বের নিজের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করার একমাত্র উপায় হল তারও একটা শুরু আছে এই অনুমান)। সেন্ট অগাস্টিন তাঁর বই দি সিটি অব গড (The City of God- ঈশ্বরের নগর)- এ আর একটি যুক্তি উল্লেখ করেছেন। তিনি দেখালেন, সভ্যতার প্রগতি হচ্ছে এবং কোন কাজ কে করছিলেন এবং কোন প্রযুক্তি কার দ্বারা বিকাশ লাভ করেছিল সেটা আমাদের মনে থাকে। সুতরাং মানুষ এবং হয়তো মহাবিশ্বেরও অস্তিত্ব খুব বেশি দিনের হয়। সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কীয় পুস্তক (Book of Genesis) অনুসারে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে খৃষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে। সেন্ট অগাস্টিন (St. Augustine) এ তথ্য মেনে নিয়েছেন। (আকর্ষণীয় ব্যাপার হল এই তারিখ এবং দশ হাজার বছর আগেকার শেষ তুষার যুগের সমাপ্তি খুব বেশি দূরবর্তী নয়। প্রত্নতত্ত্ববিদরা বলেন, সভ্যতার সত্যিকারের শুরু সে সময় থেকেই।)

অন্যদিকে অ্যারিস্টোটল এবং গ্রীক দার্শনিকদের অধিকাংশই সৃষ্টি সম্পর্কীয় ধারণা পছন্দ করতেন না। কারণ এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ভাবগত হস্তক্ষেপ বড় বেশি হয়েছে। সেইজন্য তাঁরাও বিশ্বাস করতেন, মানব জাতি এবং তার চারপাশের বিশ্ব চিরকাল ছিল এবং থাকবে। প্রাচীনরা প্রগতি সম্পর্কে পূর্বোল্লিখিত যুক্তিগুলি আগেই বিচার করেছেন। তাঁদের উত্তর ছিল মাঝে মাঝেই বন্যা কি ঐ রকম কোনো বিপর্যয় ঘটেছে এবং মানবজাতিকে বারবার পিছনে ঠেলে সভ্যতার একেবারে শুরুতে নিয়ে গিয়েছে।

কালে মহাবিশ্বের কোন শুরু ছিল কিনা এবং মহাবিশ্ব স্থানে সীমিত কিনা এ বিষয়ে পরবর্তীকালে দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট ১৭৮১ সালে প্রকাশিত তাঁর মহান (এবং অতি দুর্বোধ্য) গ্রন্থ ক্রিটিক অব পিওর রিজন- এ (Critique of Pure Reason) বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছেন। প্রশ্নগুলিকে তিনি বিশুদ্ধযুক্তির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ (অর্থাৎ বিরোধাভাস) বলেছেন। তার কারণ মহাবিশ্বের একটা আরম্ভ রয়েছে এ তত্ত্ব বিশ্বাস করার স্বপক্ষে যেমন দৃঢ় যুক্তি রয়েছে তেমন দৃঢ় যুক্তি রয়েছে মহাবিশ্ব চিরকালই ছিল এই যুক্তির স্বপক্ষে। তত্ত্বের স্বপক্ষে তাঁর যুক্তি ছিল মহাবিশ্বের যদি কোনো আরম্ভ না থেকে থাকে, তাহলে যে কোন ঘটনার পূর্বেই একটা অসীম কাল থাকা উচিত। তাঁর মতে এটা অসম্ভব। বিরোধী যুক্তির স্বপক্ষে যুক্তি, মহাবিশ্বের যদি শুরু থেকে থাকে, তাহলে তার পূর্বে একটা অসীম কাল ছিল। তাই যদি হয়, তাহলে একটি বিশেষ সময়ে মহাবিশ্বের আরম্ভ কেন হবে? তত্ত্বের স্বপক্ষে এবং তার বিরোধী তত্ত্বের স্বপক্ষে যুক্তিগুলি আসলে একই। দুটোরই ভিত্তি তার অব্যক্ত অনুমানঃ মহাবিশ্ব চিরকাল থাকুক কিম্বা না থাকুক কাল চিরন্তন ভাবে অতীতে রয়েছে। এরপর আমরা দেখব, মহাবিশ্বের আরম্ভের আগে কাল সম্পর্কীয় কল্পন অর্থহীন। এটা প্রথম দেখিয়েছিলেন সেন্ট অগাস্টিন। তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, মহাবিশ্ব সৃষ্টির আগে ঈশ্বর কি করছিলেন,অগাস্টিন তাঁর উত্তর দেন নিঃ এই ধরণের প্রশ্ন যারা করেন তিনি তাঁদের জন্য তৈরি করেছিলেন নরক। তার বদলে তাঁর উত্তর ছিল মহাবিশ্বের কাল ঈশ্বরসৃষ্ট। মহাবিশ্বের আরম্ভের আগে কালের অস্তিত্ব ছিল না।

যখন অধিকাংশ লোকেরই বিশ্বাস ছিল মহাবিশ্ব মূলত স্থির এবং অপরিবর্তনশীল তখন মহাবিশ্বের আরম্ভ ছিল কি ছিল না- এ প্রশ্ন আসলে ছিল অধিবিদ্যা (Metaphysics) এবং ধর্মতত্ত্বের (theology)। যা পর্যবেক্ষণ করা হয় তার দুরকম ব্যাখ্যাই অতি সুষ্ঠুভাবে দেওয়া সম্ভব। অর্থাৎ মহাবিশ্বের অস্তিত্ব চিরকালই ছিল- এই তত্ত্বের ভিত্তিতে; কিম্বা একটি সীমিতকালে মহাবিশ্বকে এমনভাবে চালু করা হয়েছে যার ফলে মনে হয় মহাবিশ্বের অস্তিত্ব চিরকালই ছিল- এই তত্ত্বের ভিত্তিতে। কিন্তু ১৯২৯ সালে এডুইন হাবল (Edwin Hubble) একটি যুগনির্দেশক (and mark) পর্যবেক্ষণ করেন। সেটা হল, যে দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন, সে দিকে দেখা যাবে সুদূরের নীহারিকাগুলি আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অন্য ভাষায় বলা চলে প্রসারমাণ। এর অর্থ হল অতীত যুগে বস্তুপিন্ডগুলি পরস্পরের নিকটতর ছিল। আসলে মনে হয়েছিল দশ কিম্বা কুড়ি হাজার মিলিয়ন (১০,০০,০০০) বছর আগে সবগুলি নীহারিকা একই জায়গায় ছিল সুতরাং সে সময় মহাবিশ্বের ঘনত্ব ছিল অসীম। এই আবিষ্কার শেষ পর্যন্ত মহাবিশ্বের আরম্ভের প্রশ্নকে বিজ্ঞানের এলাকায় নিয়ে আসে।

হাবলের পর্যবেক্ষণ থেকে মনে হয় একটা কাল ছিল যার নাম দেওয়া হয়েছে বৃহৎ বিস্ফোরণ (big bang)। তখন ছিল অসীম ক্ষুদ্র মহাবিশ্ব (infinitesimally) এবং তার ঘনত্বও ছিল অসীম। এই রকম অবস্থায় বিজ্ঞানের সব বিধিই ভেঙ্গে পড়ে। সুতরাং ভেঙ্গে পড়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা। এর পূর্বকালে যদি কোন ঘটনা ঘটে থাকে, তা হলে বর্তমান কালে যে ঘটনাগুলি ঘটছে, সে ঘটনাগুলিকে তারা প্রভাবিত করতে পারে না। তাদের অস্তিত্ব অগ্রাহ্য করা যেতে পারে, কারণ পর্যবেক্ষণের উপর তার কোন প্রভাব থাকবে না। বলা যেতে পারে বৃহৎ বিস্ফোরণের নাম (big bang) কালের শুরু। অর্থাৎ পূর্বতন কালের কোন সংজ্ঞা দেওয়া যাবে না। দেশ দৃঢ়ভাবে একথা বলা উচিত যে, কালের আরম্ভ সম্পর্কে আগে যা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে এর অনেক পার্থক্য। পরিবর্তনশীল মহাবিশ্বে আরম্ভ এমন একটা জিনিস যা মহাবিশ্ব বহির্ভূত কোন সত্তা আরোপ করেছে। এই আরম্ভের কোন ভৌত প্রয়োজনীয়তা নেই। কল্পনা করা যেতে পারে আক্ষরিক অর্থে অতীতের যে কোন কালে ঈশ্বর মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। অন্যদিকে, মহাবিশ্ব যদি বিস্তারমান  হয় তা হলে আরম্ভ কেন থাকবে তার একটা ভৌত কারণ থাকতে পারে। তবুও কল্পনা করা যেতে পারে বৃহৎ বিস্ফোরনের মুহূর্তে ঈশ্বর মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। কিম্বা সৃষ্টি করেছেন বৃহৎ বিস্ফোরনের পরে। কিন্তু এমন ভাবে সৃষ্টি করেছেন যেন মনে হয় একটা বৃহৎ বিস্ফোরণ হয়েছিল। তবে বৃহৎ বিস্ফোরণের আগে সৃষ্টি হয়েছিল এ রকম অনুমান করা হবে অর্থহীন। প্রসারমাণ মহাবিশ্ব স্রষ্টাকে অস্বীকার করে না। কিন্তু সম্ভবত করে তিনি কাজটি করেছেন তার উপর একটা সময়সীমা আরোপ করে।

মহাবিশ্বের চরিত্র সম্পর্কে বলতে হলে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিম্বা শেষ আছে কিনা এই সমস্ত প্রশ্নের আলোচনা করতে হলে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কাকে বলে সে সম্পর্কে আপনার একটা স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। সাধারণ সরল মানুষ যা মনে করেন সেটা হল- তত্ত্ব মহাবিশ্বের একটা প্রতিরূপ (model), কিম্বা প্রতিরূপ মহাবিশ্বের একটা সীমিত অংশের এবং আমরা যা পর্যবেক্ষণ করছি, তার সঙ্গে প্রতিরূপের পরিমাণগুলিকে সম্পর্কযুক্ত করে এ রকম কতগুলি নিয়ম। আমি এই দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নিচ্ছি। এর অস্তিত্ব শুধুমাত্র আমাদের মনে। তার অন্য কোন বাস্তবতা নেই (এর অর্থ যাই হোক না কেন)। একটা তত্ত্বকে ভাল তত্ত্ব বলা যেতে পারে যদি সে তত্ত্ব দুটি প্রয়োজন সিদ্ধ করেঃ যে প্রতিরূপে কয়েকটি মাত্র যাদৃচ্ছিক (arbitrary) উপাদান রয়েছে তার ভিত্তিতে পর্যবেক্ষণের একটা বিরাট শ্রেণীকে নির্ভুলভাবে অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে হবে এবং ভবিষ্যৎ পর্যবেক্ষণফল সম্পর্কেও তাকে নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী অবশ্যই করতে হবে। উদাহরণ- অ্যারিস্টোটলের তত্ত্বঃ সব জিনিসই ক্ষিতি (earth), মরুৎ (air), অগ্নি (fire), এবং অপ (water)- এই কটি উপাদান নিয়ে গঠিত। এ তত্ত্ব সারল্য অনুমোদনের উপযুক্ত ছিল। কিন্তু এ তত্ত্ব কোন নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেনি। অন্যদিকে নিউটনের মহাকর্ষীয় তত্ত্বের ভিত্তি ছিল সরলতর। এ তত্ত্ব অনুসারে বস্তুপিন্ডগুলি পরস্পরকে একটি বল দ্বারা আকর্ষণ করে। সে বল তাদের ভর (mass) নামের একটি পরিমাণের আনুপাতিক (proportional) এবং তাদের পারস্পারিক দূরত্বের বর্গের ব্যস্ত আনুপাতিক (inversely proportional)। কিন্তু তবুও এ তত্ত্ব চন্দ্র, সূর্য এবং গ্রহগুলির গতি সম্পর্কে অতি উচ্চমানের নির্ভুলতা সম্পন্ন ভবিষ্যদ্বাণী করবে।

যে কোন ভৌততত্ত্ব সব সময়ই সাময়িক (provisional)। এর অর্থ হল, এটা একটি প্রকল্প মাত্র। আপনি কখনোই একে প্রমাণ করতে পারেন না। একটি তত্ত্বকে পরীক্ষার ফল যতবারই সত্য প্রমাণিত করুন না কেন পরের পরীক্ষার ফল যে তত্ত্বকে সত্য প্রমাণিত করবে, তত্ত্বের বিরুদ্ধে যাবে না- এ সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত হতে পারেন না। অন্য দিকে, তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীর বিরোধী একটি মাত্র পর্যবেক্ষণও তত্ত্বকে অপ্রমাণ করতে পারে। বিজ্ঞানের দর্শনের দার্শনিক কার্ল পপার (Karl Popper) জোরের সঙ্গেই বলেছেন, একটি ভাল তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য হল যে, সে তত্ত্ব এমন কতগুলি ভবিষ্যদ্বাণী করবে যে ভবিষ্যদ্বাণীগুলি নীতিগতভাবে অপ্রমাণ কিম্বা মিথ্যা প্রমাণ করা সম্ভব হবে। যতবারই নতুন পরীক্ষায় দেখা যায় পর্যবেক্ষণ মূলক ফলের সঙ্গে তত্ত্বের মতৈক্য রয়েছে, তত্ত্ব ততবারই বেঁচে থাকে এবং তত্ত্বে আমাদের বিশ্বাসও বাড়ে। কিন্তু যদি কখনো কোন নতুন পর্যবেক্ষণে দেখা যায়- এ মতানৈক্য নেই, তা হলে তত্ত্বটিকে হয় পরিত্যাগ করতে হবে নয়তো তার পরিবর্তন করতে হবে। অন্তত পক্ষে এই রকমই হবে বলে অনুমান করা যায়। কিন্তু যিনি পর্যবেক্ষণ করছেন তাঁর যোগ্যতা সম্পর্কে আপনি সব সময়ই প্রশ্ন করতে পারেন।

কার্যক্ষেত্রে যা ঘটে তা হলঃ যে নতুন তত্ত্ব উদ্ভাবন করা হয় সেটা আসলে পুরাতন তত্ত্বেরই বিস্তৃতি। উদাহরণঃ বুধগ্রহ নিয়ে অত্যন্ত নির্ভুল পর্যবেক্ষণের ফলে দেখা গেল নিউটনের মহাকর্ষীয় তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে  বুধগ্রহের গতির সামান্য পার্থক্য রয়েছে। আইনস্টাইনের ব্যাপক অপেক্ষবাদ গতি সম্পর্কে নিউটনের তত্ত্বের চাইতে সামান্য পৃথক একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। আইনস্টাইন যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তার সঙ্গে পর্যবেক্ষণফল মিলে গেল। কিন্তু নিউটনের তত্ত্বের সঙ্গে মিলল না। এটাই ছিল নতুন তত্ত্ব মেনে নেওয়ার একটা প্রামাণ্য কারণ। আমরা কিন্তু ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে নিউটনের তত্ত্ব এখনো প্রয়োগ করি। তার কারণ, সাধারণত আমরা যেসব ক্ষেত্রে কাজ করি সে সমস্ত ক্ষেত্রে নিউটনীয় তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী এবং ব্যাপক অপেক্ষবাদের ভবিষ্যদ্বাণীর ভিতরে পার্থক্য সামান্যই (নিউটনের তত্ত্বের আর একটি বিরাট সুবিধা হল আইনস্টাইনের তত্ত্ব নিয়ে কাজ করার চাইতে নিউটনের তত্ত্ব নিয়ে কাজ করা অনেক সহজ)।

বিজ্ঞানের চরম উদ্দেশ্য হল এমন একটি তত্ত্ব দান করা যে তত্ত্ব সম্পূর্ণ মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ বৈজ্ঞানিকরা যে পথ গ্রহণ করেন সেটা হল সমস্যাকে দুটো ভাগে ভাগ করা। প্রথমত, কালের সঙ্গে মহাবিশ্বের কি রকম পরিবর্তন হয় সে সম্পর্কে একাধিক বিধি (law)  রয়েছে (আমরা যদি জানি একটি বিশেষ কালে মহাবিশ্ব কি রকম দেখায়, তা হলে পরবর্তী যে কোন কালে মহাবিশ্ব কি রকম দেখাবে সেতাও ঐ ভৌত বিধিগুলি আমাদের বলে দেবে)। দ্বিতীয়ত, রয়েছে মহাবিশ্বের প্রারম্ভিক অবস্থার প্রশ্ন। অনেকে মনে করেন, বিজ্ঞানের শুধু প্রথম অংশটা নিয়েই চিন্তা করা উচিত। তাঁদের ধারণা, প্রারম্ভিক অবস্থার প্রশ্নটি অধিবিদ্যা (metaphysics) কিম্বা ধর্মের (religion) বিষয়। তাঁরা বলবেন ঈশ্বর সর্বশক্তিমান (omnipotent)। তিনি ইচ্ছে করলে যেভাবে খুশী মহাবিশ্ব মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতে পারতেন। তা হতে পারে, কিন্তু সেক্ষত্রে তিনি মহাবিশ্বকে সম্পূর্ণ যাদৃচ্ছিক (arbitrary) পদ্ধতিতেও বিকশিত করতে পারতেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, মহাবিশ্বকে তিনি বেশ নিয়মবদ্ধ রূপে কতগুলি বিশেষ বিধি (law) অনুসারে বিকশিত করেছিলেন। সুতরাং মনে হয় প্রারম্ভিক অবস্থার নিয়ামক বিধির অস্তিত্ব অনুমান করাও একই রকম যুক্তিসঙ্গত।

দেখা যায় একবারে মহাবিশ্বের বিবরণ দেওয়ার মতো একটা তত্ত্ব উদ্ভাবন করা শক্ত, তার বদলে আমরা সমস্যাটাকে টুকরো টুকরো করে ভেঙ্গে নিই এবং কতগুলি আংশিক তত্ত্ব আবিষ্কার করি। এই আংশিক তত্ত্বগুলির প্রতিটি, সীমিত শ্রেণীর কয়েকটি পর্যবেক্ষণ ফলের বিবরণ দান করে এবং সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে। এ তত্ত্ব অন্য পরিমাণগুলির (quantities) ক্রিয়াকে অগ্রাহ্য করে কিম্বা কয়েকটি সরল সংখ্যাগুচ্ছকে সেগুলির প্রতিনিধি হিসেবে স্থাপন করে। হতে পারে এ পথ সম্পূর্ণ ভুল। মহাবিশ্বের প্রতিটি জিনিসই যদি প্রতিটি জিনিসের উপরে মূলগতভাবে নিরভশীল হয়, তা হলে সমস্যার অংশগুলি সম্পর্কে বিচ্ছিন্ন ভাবে অনুসন্ধান করলে সম্পূর্ণ সমাধানের নিকটবর্তী হওয়া অসম্ভব হতে পারে। তবুও অতীতে আমাদের যে প্রগতি হয়েছে, নিশ্চিতভাবে সেটা এই পদ্ধতিতে। এ বিষয়ে একটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হল নিউটনের মহাকর্ষীয় বিধি। এ তত্ত্ব আমাদের বলে, দুটি বস্তুপিণ্ডের অন্তর্বর্তী মহাকর্ষীয় বল প্রতিটি বস্তুপিন্ডের সঙ্গে সংযুক্ত একটি সংখ্যার উপর নির্ভরশীল। সেটা হল তার ভর। কিন্তু বস্তুপিন্ডগুলি কি উপাদান নিয়ে গঠিত তার সঙ্গে এ বল সম্পর্কহীন। সুতরাং তাদের কক্ষ গণনার জন্য সূর্য এবং গ্রহগুলির গঠন তার সঙ্গে এ বল সম্পর্কহীন। সুতরাং তাদের কক্ষ গণনার জন্য সূর্য এবং গ্রহগুলির গঠন এবং উপাদান সম্পর্কে কোনো তত্ত্বের প্রয়োজন হয় না।

আজকাল বৈজ্ঞানিকরা দুটি মূলগত আংশিক তত্ত্বের বাগ্বিধিতে মহাবিশ্বের দান করেন। ব্যাপক অপেক্ষবাদ এবং কোয়ান্টাম মেকানিকস (কণাবাদী বলবিদ্যা)। এ দুটি তত্ত্ব এ শতাব্দীর প্রথম বর্ষের বিরাট বৌদ্ধিক কৃতিত্ব। ব্যাপক অপেক্ষবাদ মহাকর্ষীয় বল এবং মহাবিশ্বের বৃহৎ মানের (large scale) গঠন সম্পর্কে বিবরণ দান করে, অর্থাৎ, যে গঠনের মাপ মাত্র কয়েক মেইল থেকে শুরু করে মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন (১- এর পিঠে চব্বিশটা শূন্য) মাইল পর্যন্ত। শেষেরটা হল পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের মাপ। অন্যদিকে কণাবাদী বলবিদ্যার কাজকর্ম অতি ক্ষুদ্র মানের পরিঘটনা (externely small scale) নিয়ে। যথা, এক ইঞ্চির এক মিলিয়ন ভাগের এক মিলিয়ন ভাগ। দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা জানি এই দুটি তত্ত্বের পারস্পারিক অসঙ্গতি রয়েছে। দুটো তত্ত্বই নির্ভুল হতে পারে না। আধুনিক পদার্থবিদ্যার একটি প্রধান প্রচেষ্টা এবং এ বইয়ের একটি প্রধান বক্তব্য এমন একটি তত্ত্ব অনুসন্ধান করা যার ভিতরে দুটো তত্ত্বই থাকবে- মহাকর্ষ সম্বন্ধীয় কোয়ান্টাম তত্ত্ব। এ রকম তত্ত্ব এখনো আমাদের নেই। হয়তো এরকম তত্ত্বে পৌঁছাতে আমাদের বহু দেরী। কিন্তু এই তত্ত্বের কি কি গুণ থাকা আবশ্যিক হবে তার অনেকটাই এখন আমরা জানি। পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে আমরা সেসব মহাকর্ষ সম্পর্কীয় কোয়ান্টাম তত্ত্বের কি কি ভবিষ্যদ্বাণী করা আবশ্যিক হবে তার অনেকটাই আমাদের জানা।

আপনি যদি বিশ্বাস করেন, মহাবিশ্ব যাদৃচ্ছিক নয় এবং সুনিশ্চিত কতগুলি বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তাহলে শেষ পর্যন্ত আংশিক তত্ত্বগুলিকে একত্রিত করে একটি ঐক্যবদ্ধ সম্পূর্ণ তত্ত্ব গড়তে হবে এবং সে তত্ত্ব মহাবিশ্বের সবটারই বিবরণ দান করবে। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ সম্পূর্ণ তত্ত্বের অনুসন্ধানের ব্যাপারে একটা মূলগত স্ববিরোধীতা (paradox) রয়েছে। উপরে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব  সম্পর্কে যে সমস্ত ভাবধারার খসড়া দেওয়া হয়েছে, তাতে অনুমান করে নেওয়া হয়েছে আমরা যুক্তিবাদী জীব। আমাদের ইচ্ছামতো পর্যবেক্ষণের স্বাধীনতা রয়েছে এবং যা পর্যবেক্ষণ করছি তা থেকে যৌক্তিক অবরোহী সিদ্ধান্ত (logical deduction) নেওয়ারও স্বাধীনতা আমাদের রয়েছে। এরকম একটা পরিকল্পনায় আমাদের মহাবিশ্ব পরিচালনা সম্পর্কীয় বিধিগুলি ক্রমশ নিকটতর হওয়ার দিকে অবিচ্ছিন্ন অগ্রগতির সম্ভাবনা রয়েছে, এ রকম অনুমান যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু সত্যই যদি একটা ঐক্যবদ্ধ সম্পূর্ণ তত্ত্ব থাকে তাহলে সে তত্ত্ব আমাদের কার্যক্রমও নির্ধারণ করবে। সুতরাং, সে তত্ত্ব নিজেই আমাদের সেই তত্ত্ব অনুসন্ধানের ফলাফল নির্ধারণ করবে। সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে যে আমরা সঠিক সিদ্ধান্তই নেব, এ তত্ত্ব কেন সেটা নির্ধারণ করবে? একই ভাবে সে তত্ত্ব কি সাক্ষ্য থেকে আমাদের ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে একই রকম ভাবে সাহায্য করতে পারে না? কিম্বা কোনো সিদ্ধান্তেই না পৌঁছাতে?

এই সমস্যার আমি একটাই সমাধান করতে পারি। সে সমাধানের ভিত্তি ডারউইনের স্বাভাবিক নির্বাচন সম্পর্কীয় নীতি (Principle of natural selection)। চিন্তনটা হলঃ স্বতত বংশরক্ষণকারী যে কোনো জীবগোষ্ঠীর ভিতর বিভিন্ন ব্যক্তির জেনেটিক পদার্থ (genetic material) এবং লালন পালনে নানা পার্থক্য হবে। এই পার্থক্যের অর্থ হবে কিছু ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিদের তুলনায় তাদের চতুরপারসের জগৎ সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এবং সেই অনুসারে কাজ করতে পারবে অনেক ভাল ভাবে। এই সমস্ত ব্যক্তির বেঁচে থাকা এবং বংশবৃদ্ধি করার সম্ভাবনা বেশী। সুতরাং তাদের আচরণ এবং চিন্তার ধরণ আধিপত্য করবে। আমরা যাকে বুদ্ধি এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বলি সেগুলি বেঁচে থাকার পক্ষে একটা সুবিধা বহন করছে এ তথ্য অতীত সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে সত্য। ব্যাপারটা এখনো একই রকম রয়েছে কিনা সেটা স্পষ্ট নয়। আমাদের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলি হয়তো আমাদের সবাইকে ধ্বংস করতে পারে। তারা যদি ধ্বংস নাও করে তবুও একটি ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব আমাদের বাঁচার সম্ভাবনার ব্যাপারে খুব একটা পার্থক্য সৃষ্টি না করতে পারে। কিন্তু মহাবিশ্ব যদি নিয়মানুসারে বিবর্তিত হয়ে থাকে তা হলে আমরা আশা করতে পারি স্বাভাবিক নির্বাচনের ফলে আমরা যে যৌক্তিক ক্ষমতা লাভ করেছি, সে ক্ষমতার অস্তিত্ব এবং কর্মক্ষমতা আমাদের ঐক্যবদ্ধ সম্পূর্ণ তত্ত্বের অনুসন্ধানের সময়ও থাকবে এবং আমাদের ভুল সিদ্ধান্তের পথে নিয়ে যাবে না।

আমাদের যে আংশিক তত্ত্বগুলি রয়েছে, সেগুলি অতি চরম ক্ষেত্রগুলি ছাড়া অন্য প্রায় সব ক্ষেত্রেই নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করার পক্ষে যথেষ্ট। সেইজন্য ব্যবহারিক কারণে মহাবিশ্ব সম্পর্কে চরম তত্ত্বের অনুসন্ধানের যুক্তি খুঁজে পাওয়া মুশকিল (যদিও এ কথা স্মরণ করা উচিত যে অপেক্ষবাদ এবং কণাবাদী বলবিদ্যার বিরুদ্ধে একই রকম যুক্তি প্রয়োগ করা যেত। কিন্তু এই তত্ত্বগুলিই আমাদের পারমাণবিক শক্তি এবং মাইক্রো-ইলেকট্রনিক বিপ্লব দিয়েছে)। সুতরাং একটা ঐক্যবদ্ধ সম্পূর্ণ তত্ত্ব আবিষ্কার আমাদের প্রজাতিকে বাঁচতে সাহায্য নাও করতে পারে। এমন কি, এ তত্ত্ব আমাদের জীবন যাত্রার ধরণের উপরেও কোনো প্রভাব বিস্তার না করতে পারে। কিন্তু সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ বিভিন্ন ঘটনাকে অসংযুক্ত এবং ব্যাখ্যার অতীত ভেবে সন্তুষ্ট হয় নি। মানুষ আকাঙ্ক্ষা করেছে পৃথিবীর অন্তর্নিহিত নিয়ম বুঝতে। এখনো আমরা জানতে চাই কেন আমরা এখানে বসেছি এবং কোত্থেকে এখানে এসেছি? জ্ঞানের জন্য মানুষের গভীরতম আকাঙ্ক্ষা অবিচ্ছিন্ন অনুসন্ধানের সপক্ষে যুক্তি হিসাবে যথেষ্ট। এবং আমাদের সর্বনিম্ন আকাঙ্ক্ষা হল, যে মহাবিশ্বে আমরা বাস করি তার সম্পূর্ণ বিবরণ।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x