বোশেখ শেষে বালুচরের বোরো ধানের থান,
সোনায় সোনা মেলিয়ে দিয়ে নিয়েছে কেড়ে প্রাণ।
বসন্ত সে বিদায় বেলায় বুকের আঁচলখানি,
গেঁয়ো নদীর দুপাশ দিয়ে রেখায় গেছে টানি।
চৈত্রদিনের বিধবা চরের সাদা থানের পরে,
নতুন বর্ষে ছড়িয়ে দিল সবুজ থরে থরে
না জানি কোন গেঁয়ো তাতি গাঙ চলিবার চলে,
জল-ছোঁয়া তার শাড়ির কোণে পাড় বুনে যায় চলে।
মধ্য চরে আউশ ধানের সবুজ পারাবার,
নদীর ধারে বোরো ধানের দোলে সোনার পাড়।
চৈত্রদিনের বৈরাগিনী সবুজ আঁচল সনে,
মুখখানিরে আবছা ঢেকে সাজল বিয়ের কনে।
মাথায় তাহার বক-শিশুরা মেলি কোমল ডানা,
সাদা সাদা মেঘের মতো উড়ায় চাদরখানা।
গেঁয়ো পথে চলতে আজি অনেক মায়া লাগে,
বুকের পরে পা দিলে ধান জড়িয়ে ধরে তাকে।
অমন সবুজ অমন কোমল মাটির সাথে মিশে,
কে পারে ভাই চলতে তারে পায়ের তবে পিষে।
হাটে যাওয়ার পথটি তো তাই অনেক হলো ঘোর,
কাজল-তলার ওপাশ দিয়ে দিঙনগরের-মোড়;
তার পরেতে হালট গেছে একটু আঁকা-বাঁকা,
গরুর পায়ের ক্ষুরে ক্ষুরে ছবির মতো আঁকা।
সেখান দিয়ে চলতে চাষী সকল কথা ভোলে,
বন্ধু ভাই-এর কাঁধটি ধরে ধানের কথা তোলে।
সাত পুরুষে এমন ফসল দেখিনি কেউ চোখে,
মেঘ যেন কেউ বিছিয়ে দেছে তাদের গেঁয়ো চকে;
চাষীর মুখে তারিখ শুনে ধান শিশুরা তাই,
হেলে দুলে লাজে আকুল নাই লুকাবার ঠাই।
আকাশ ছিল সুনীল যখন ছিল না মেঘ লেখা,
তখন চাষী শুকনো মাঠে দিয়ে লাঙ্গল-রেখা;
আকাশের ওই দেবতা সাথে পেতেই যেন আড়ি,
ধুল ধুলা ধুল চোতের ধুলায় ধানকে দিল ছাড়ি।
তারা যেন সৈন্য তাহার পাতাল-পাথার ফাঁড়ি,
আনল অথই মেঘের বাহার সবুক স্নেহে কাড়ি।
আকাশ হতে নামল না মেঘ পাতাল হতে আনি,
সারা মাঠের বুকের পরে হর্ষে দিল টানি।
দেবতা যেন হারায় ভয়ে সুনীল আকাশ থেকে,
চাষার সবুজ খেতের পরে হর্ষ হেঁকে হেঁকে।
ওগো চাষী! গাঁয়ের চাষী! সেলাম তোমার পায়,
বাড়ি তোর উজান চড়ে কিংবা গফর গাঁয়;
ম্যালেরিয়ায় মরছ তুমি রুগণ জবুথবু;
সারাটি দিন মরছ খেটে পাও না খেতে তবু।
লক্ষ টাকা দেশকে দিয়ে হয়নি তোমার নাম,
দেশের তরে প্রাণ দেবে কি? নয় সে তোমার কাম।
একলা যে কোন বনের ধারে নাম-না-জানা গাঁয়,
সারাটা দিন রৌদ্রে পুরে সাজাও মেঠো মায়।
সব দুনিয়ার খোরাক জোগাও নিজেই থেকে ভুক,
অভাগারা তাও বোঝো না এইটে বড়ো দুখ।
খোদার ছোটো যদিও তুমি, অনেক ছোটো নয়,
সৃষ্টি করার চাইতে পালন তুচ্ছ কেবা কয়।
তোমার গেঁয়ো মাঠটি আমার মক্কা হেন স্থান, সাধ করে আজ লুটিয়ে সেথা জুড়াই সকল প্রাণ।