(ত্রিশ)
উকিল সাহেবের বাড়ি পৌঁছিয়া বছির তাহার বইগুলি সামনে লইয়া বসিল। যেমন করিয়াই হউক পড়াশুনায় ভাল তাহাকে হইতে হইবে। সেই আট আনার পয়সা দিয়া সে একটি কেরোসিনের কুপী আর কিছু কেরোসিন তৈল কিনিয়া আনিল। তারপর উকিল সাহেব যখন নয়টার পর তার হারিকেন লণ্ঠনটি লইয়া অন্দরে চলিয়া গেলেন সে তাহার কুপী জ্বালাইয়া পড়িতে বসিল।
এইভাবে দশ বার দিন পরে তার কেনা কেরোসিন তৈল ফুরাইয়া গেল। তখন সে ভাবিতে বসিল, কি করিয়া পড়াশুনা করা যায়? সামনে রাস্তার উপর একটি বাতি জ্বলিতেছিল সে তাহার পড়ার বইখানি লইয়া রাস্তার সেই বাতিটির নিচে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া পড়িতে আরম্ভ করিল। কতদিন পড়িতে পড়িতে পা অবশ হইয়া আসে। কিন্তু শরীরের কষ্টের দিকে চাহিলে ত তাহার চলিবে না। সে পড়াশুনা করিয়া বড় ডাক্তার হইবে। দেশের। চারিদিকে নানান নির্যাতন চলিতেছে। বড় হইয়া সে এই নির্যাতন দূর করিবে। তার ত শারীরিক কষ্টের দিকে চাহিলে চলিবে না।
ইতিমধ্যে বছির ও মাওলানা সাহেবকে সঙ্গে লইয়া উকিল সাহেব আরও তিন চারটি গ্রামে যাইয়া বক্তৃতা করিলেন। ভাজন ডাঙা গ্রামে কমিরদ্দী সরদার নামডাকের লোক। তাহার অবস্থাও আশেপাশের সকলের চাইতে ভাল। উকিল সাহেব খবর পাইলেন, সে ইসলামের নিয়ম-কানুন বরখেলাপ করিয়া পদ্মা নদীতে দৌড়ের নৌকা লইয়া বাইচ খেলায় আর তার বাড়িতে গানের দল আনিয়া মাঝে মাঝে জারী গানের আসর বসায়। ইহাতে আশেপাশের যত সব মুসলমান ভাইরা গোমরাহ হইয়া যাইতেছে। সুতরাং এই গ্রামে যাইয়াই সকলের আগে উকিল সাহেব তার দীন ইসলামী ঝাণ্ডা তুলিবেন। লোক মারফত তিনি আগেই শুনিয়াছিলেন, কমিরদ্দী সরদার খুব নামডাকের মানুষ। শত শত লোক তাহার হুকুমে ওঠে বসে। তাই এবারের সফরে স্থানীয় জমিদার সরাজান চৌধুরী সাহেবকে তিনি সঙ্গে করিয়া লইলেন।
এই সব সভায় সাধারণতঃ বেশী লোক জমা হয় না। কিন্তু সভা হইবার ঘণ্টাখানেক আগে জমিদার সাহেবের তিন চারজন পেয়াদা তকমাওয়ালা চাপকানের উপর জমিদারের নিজ নাম অঙ্কিত চাপরাশ ঝুলাইয়া যখন অহঙ্কারী পদক্ষেপে সভাস্থলে আসিতেছিল তখন গ্রামবাসীদের চক্ষে তাক লাগিয়া গেল। তারপর জমিদার সাহেব নিজে যখন তাঁহার তাজী ঘোড়াটায় চড়িয়া গ্রামে প্রবেশ করিলেন তখন গ্রামের কুকুরগুলির সহিত ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা তাঁহার পিছে পিছে যে ভাবে শব্দ করিয়া ছুটাছুটি করিতে লাগিল, তাহাতে গ্রামবাসীদের কৌতূহল চরমে পৌঁছিল। তাহারা দল বাঁধিয়া সভাস্থলে আসিয়া উপস্থিত হইল। জমিদার সাহেবের ঘোড়ার পিঠে সুদৃশ্য গদি, গলায় নকসী চামড়ার সঙ্গে নানা রকমের ঘুঙুর। সেই ঘুঙুর আবার ঘোড়ার নড়নে-চড়নে বাজিয়া উঠিতেছে। দেখিয়া দেখিয়া গ্রামবাসীদের সাধ মেটে না। কেহ কেহ সাহস করিয়া জমিদার সাহেবের বরকন্দাজদের সঙ্গে কথা বলিয়া নিজেকে ধন্য মনে করে। তাহারা কি সহজে কথা বলে? তিন চারটি প্রশ্ন করিলে এক কথার উত্তর দেয়। এও কি কম সৌভাগ্য? মূল জমিদার সাহেবের দিকে কেহ ফিরিয়াও তাকায় না।
কিছুক্ষণ পরে সভা আরম্ভ হইল। উকিল সাহেব দাঁড়াইয়া প্রস্তাব করিলেন, “জন-দরদী প্রজাবৎসল জমিদার মিঃ সরাজান চৌধুরী সাহেব এই সভায় তসরিফ এনেছেন। জমিদারী। সংক্রান্ত বহু জরুরী কার্য ফেলিয়া তিনি শুধু আপনাদের খেদমতের জন্যই এখানে আসিয়াছেন। আমি প্রস্তাব করি তিনি এই সভায় সভাপতির পদ অলঙ্কত করুন।”
মাওলানা সাহেব এই প্রস্তাব সমর্থন করিলেন। জমিদার সাহেব সভাপতির জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারে আসিয়া উপবেশন করিলেন।
প্রথমে মাওলানা সাহেব বক্তৃতা আরম্ভ করিলেন! গোর আজাব হইতে আরম্ভ করিয়া হজরতের ওফাত পর্যন্ত শেষ করিয়া তিনি বলিতে লাগিলেন, “ভাই সাহেবানরা! বড়ই আফসোসের কথা, আপনাদের এই গ্রামের কমিরদ্দী সরদার মুসলমান ভাইগো সঙ্গে লয়া পদ্মা নদীতে নৌকা বাইচ খেলায়। তার চায়াও আফসোসের কথা, সেই নৌকা বাইচ খেলানো হয় হিন্দুগো পূজা-পার্বণের দিনি। আরও আফসোসের কথা, কমিরদ্দী সরদার। তার বাড়িতি জারী গানের আসর বসায়। বিচার গানের বাহেজ করায়। আমার খোদাওন। তালা জাল্লেজালালুহু কোরান শরীফে ফরমাইয়াছেন, যে গানের দল বায়না করে, নৌকা বাইছ দ্যায় এমন লোককে পয়জার মাইরা শায়েস্তা করা প্রত্যেক মোমিন মুসলমানের পক্ষে ফরজ। আইজ আপনাগো এহানে আমরা আইছি দেহনের লাইগা, আপনারা এই। নাফরমানি কাজের কি বিচারডা করেন।”
এমন সময় একটি যুবক উঠিয়া বলিল, “সভাপতি সাহেব! এই সভায় আমি কিছু বলতে চাই।”
মাওলানা সাহেব সভাপতির কানে কানে বলিলেন, “ওই যুবকটি কলেজে পড়ে–কমিরদ্দী সরদারের পুত্র।”
কিন্তু সভাপতি সাহেব মাওলানা সাহেবের ইঙ্গিত বুঝিলেন না। তিনি ভাবিলেন, এই যুবক হয়ত মাওলানা সাহেবকেই সমর্থন করিবে। প্রকাশ্যে বলিলেন, “আচ্ছা! শোনা যাক যুবকটি কি বলতে চায়।”
যুবকটি এবার বলিতে আরম্ভ করিল, “ভাই সকল! ইতিপূর্বে আপনারা মাওলানা সাহেবের বক্তৃতা শুনেছেন। আমার পিতা হিন্দুর তেহারের দিন দৌড়ের নৌকাখানি নিয়া বাচ খেলান। আপনারা সকলেই জানেন, ইসলাম ধর্মের মূলনীতি হল একতা, সকলে দলবদ্ধ হয়ে থাকা! আল্লার এবাদত বন্দেগী করতেও তাই দলবদ্ধ হয়ে করার নির্দেশ। যে জামাতে যত লোক সেখানে নামাজ পড়লে তত ছওয়াব। আপনারা সকলেই ঈদের দিন মাঠে যেয়ে নামাজ আদায় করেন। সেখানে লক্ষ লোক একত্র হয়ে নামাজ পড়েন। এর। অন্তর্নিহিত কথা হল শত্রু-পক্ষীয়রা জানুক মুসলমানেরা সংখ্যায় কত–তাহাদের একতা। কত দূর। ইসলামের নির্দেশ মত লক্ষ লক্ষ লোক নামাজের সময় নীরবে ওঠে বসে। জগতের কোন জাতির মধ্যে এমন শৃঙ্খলা দেখা যায় না। আমার পিতা যে নৌকা বাইজ খেলান তাহাতেও গ্রামবাসীদের মধ্যে একতা বৃদ্ধি পায়। মুসলমান ভাইদের নিয়ে আমার পিতা যে হিন্দুর পূজা-পার্বণে নৌকা বাইজ খেলান তার পেছনেও একটা সত্য আছে। আপনারা জানেন, মাঝে মাঝে আমাদের দেশে নমু মুসলমানে দাঙ্গা হয়। ক গ্রামের লোকের সঙ্গে অপর গ্রামের লোকের দাঙ্গা হয়। আমাদের গ্রামের ইজ্জত যাতে রক্ষা হয় সেজন্য আমাদের সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হয়! সেবার দীগনগরের হাটে আমাদের গ্রামের লস্কর তালুকদার মুরালদার লোকদের হাতে মার খেয়ে এলো। পরের হাটে আমাদের লোকজন দলবদ্ধ হয়ে মুরালদার লোকদের বেদম মারপিট করে এলো। সেই হতে আমাদের গ্রামের লোকদের সবাই ভয় করে চলে। হিন্দুর পূজা-পার্বণে বহুলোক একত্র জমা হয়। সেখানে নৌকা বাচ খেলে আমার পিতা প্রতিপক্ষদের নৌকাগুলিকে হারিয়ে দিয়ে আসেন। হাজার হাজার লোক জানতে পারে, ভাজনডাঙার লোকদের শক্তি কত। তাই কেউ আমাদের বিপক্ষে দাঁড়াতে সাহস করে না। এক কালে হয়ত হিন্দু মুসলমানে রেশারেশি ছিল। তাই হিন্দুর উৎসবের দিন হাজার হাজার হিন্দুর মধ্যে মুসলমানেরা দৌড়ের নৌকা নিয়ে তাদের প্রতাপ দেখিয়ে আসত। সেই থেকে হয়ত হিন্দুর পূজা-পার্বণে মুসলমানের নৌকা বাচ খেলান রেওয়াজ হয়েছে। আমার পিতা হিন্দুর তেহারে নৌকা বাচ খেলান কিন্তু হিন্দুর পূজায় অংশ গ্রহণ করেন না। হিন্দুর প্রতিমাকে খোদা বলেও সেজদা। করেন না। বরঞ্চ হিন্দুর উৎসবে মুসলমান পয়গাম্বরদের কাহিনী গানের মাধ্যমে প্রচার। করে আসেন। আমি ত কতবার দেখেছি, আমাদের দৌড়ের নৌকা থেকে ইমাম হোসেনের জারী গান শুনে বহু হিন্দু অশ্রু বিসর্জন করেছে। আপনারা আজ যদি আমাদের গ্রামের লোকদের মধ্যে বাচ খেলানো বন্ধ করেন তবে আমাদের গ্রামের একতা নষ্ট হয়ে যাবে। গ্রামের লোকদের সঘবদ্ধ হয়ে কাজ করার ক্ষমতা কমে যাবে।”
যুবকটির বলিবার ভঙ্গী এমনি চমৎকার যে সভায় লোক নীরবে তার কথাগুলি শুনিতেছিল। উকিল সাহেব ধূর্তলোক। দেখিলেন, এই যুবকের বক্তৃতায় সভার মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হইয়া যায়। তিনি মাওলানা সাহেবের কানে কানে কি বলিলেন। মাওলানা সাহেব যুবকটিকে থামাইয়া দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মিঞা, যে এত বক্তৃতা করতাছাও, মুহির দাড়ি কাইটা ত এহেবারে নমশূদ্রের মত দেখতি ঐছ। আর ইংরাজী বাঙলা নাছারা কিতাব ত অনেক পড়ছাও। কোরান কিতাবের কোন খবরনি রাহ? মিঞাসাবরা! এই বেদাড়ি নাছারার ওয়াজ কি আপনারা হুনবেন?”
যুবকটি কি বলিতে যাইতেছিল। সভাপতি সাহেব তাহাকে থামাইয়া বলিলেন, “চুপ কর, তুমি বেয়াদপ। ময়মুরব্বী চেন না। মাওলানা সাহেবকে বলতে দাও।”
মাওলানা সাহেব আরম্ভ করিলেন, “ভাই সাহেবানরা! আমার খোদা কইছেন, এমন দিন আইব যহন আলেম-ওস্তাদের কথা লোকে শুনব না। নাছারা লোকের কথায় মানষি কান দিব। কিন্তু আপনাগো কয়া যাই, আইজ যদি আপনারা এই কমিরদ্দী সরদারের বিচার না করেন তয় এহানে আমি জান কবজ কইরা দিব। আল্লার কোরান আগুনে পুড়াইয়া দিব, সগল মুসলমানগো আপনারা কি এমনি গোমরাহ হয়া থাকতি বলেন? আমাগো হুজুর জমিদার সাহেব! তানির কাছেও আমি বিচারডা সঁইপা দিয়া এই আমি বইলাম। কমিরদ্দী সরদারের বিচার যতদিন না অবি, রোজ কেয়ামত পর্যন্ত আমি এহানে বয়া থাকপ।”
মাওলানা সাহেব আসন গ্রহণ করিলে জমিদার সাহেব কমিরী সরদারকে ডাকিয়া বলিলেন, “মিঞা! তোমার দৌড়ের নৌকাখানা তুমি আজ নিজ হাতে ভাঙবে কিনা সেই কথা বল?”
কমিরদ্দীন বলিলেন, “আমার পুলাপানরে যেমুন আমি বালবাসি তেমনি বালবাসি আমার নাওখানা। আমার জান থাকতি এই বাইচের নৌকা ভাঙবার দিব না।”
জমিদার সাহেব তখন বললেন,”মিঞা! মনে থাকে যেন তোমার কাছে আমি বছরে পঁচিশ টাকা খাজনা পাই। সে খাজনা নালিশ না করে নেব না। তোমার ভিটায় যেদিন ঘুঘু চরবে সেদিন তোমার খাজনা চাব! বেশ, তোমার বাইচের নৌকা তুমি কেমন করে চালাও তাই আমি দেখব।”
মাওলানা সাহেব বলিয়া উঠিলেন, “হুজুর! অতদুর যাওনের দরকার নাই। আপনার পেয়াদাগো একটা হুকুম দ্যান। কমিরীকে বাইন্দা ফেলাক। দেহি এর শরীয়তে বিচার। করতি পারি কিনা?”
জমিদার সাহেবকে হুকুম দিতে হইল না। তিন চারজন পেয়াদা কমিরদ্দী সরদারকে আসিয়া আক্রমণ করিল। সরদার হাতের লাঠিখানায় এক ঘুরান দিয়া তাহাদিগকে ফেলিয়া দিল। তখন গ্রামের দুই দলে মারামারি আরম্ভ হইল! গ্রামে যাহারা কমিরদ্দী সরদারের ঐশ্বর্য দেখিয়া ঈর্ষা করিত তাহারা জমিদার সাহেবের পক্ষ লইল। বাড়ি বাড়ি হইতে বোঝায় বোঝায় সড়কি লাঠি আনিয়া এ-দলে ও-দলে তুমুল দাঙ্গা চলিল। ইতিমধ্যে মাওলানা সাহেব তাহার কেতাব কোরান বগলে করিয়া পালাহঁয়া জান বাঁচাইলেন। জমিদার সাহেব থানায় খবর দিবার ওজুহাতে ঘোড়ায় সোয়ার হইয়া চলিলেন। উকিল সাহেব বহুপূর্বেই বছিরকে সঙ্গে লইয়া সভাস্থল ত্যাগ করিয়াছেন।
ইহার পর দুই দলের মধ্যে সদর কোর্টে মামলা চলিতে লাগিল। উকিল সাহেবের বৈঠকখানা বহু লোকের সমাগমে পূর্বের চাইতে আরও সরগরম হইতে লাগিল।
এই ঘটনার পর উকিল সাহেব কিছুদিনের জন্য গ্রাম দেশে সভা-সমিতি করিতে আর বাহির হইলেন না। তাহার প্রয়োজনও ছিল না। কারণ তাহার বৈঠকখানায় লোকজনের আনাগোনা দেখিয়া প্রতিদিন দুএকজন মামলাকারী আসিয়া তাহাকে উকিল নিযুক্ত করিতে লাগিল।
এই সব ঝামেলার মধ্যে বছিরের পড়াশুনার বড়ই ব্যাঘাত হইতে লাগিল। এখন আর উকিল সাহেব গ্রামদেশে বক্তৃতা করিতে যান না বলিয়া তাহার ভাগ্যে প্রতি রবিবারে যে ভাল খাবার জুটিত তাহা বন্ধ হইয়া গেল। দুই বেলা সামান্য ডাল ভাত খাবার খাইয়া তাহার শরীর দিনে দিনে কৃশ হইতে লাগিল। স্কুলের ছুটির পর এমন ক্ষুধা লাগে। তখন সে নিকটস্থ পানির কল হইতে এক গ্লাস পানি আনিয়া ঢোক ঢোক করিয়া গেলে। তাহাতে উপস্থিত পেটের ক্ষুধা নিবারণ হয় বটে, কিন্তু খালি পেটে পানি খাইয়া মাঝে মাঝে বেশ। পেটে ব্যথা হয়। সন্ধ্যাবেলা বই-পুস্তক সামনে লইয়া বসে আর ঘড়ির দিকে চাহে। কখন। নয়টা বাজিবে। কখন উকিল সাহেব অন্দরে ঢুকিবেন। বাড়ির চাকর যখন অল্প পরিমাণ ভাত আর সামান্য ডাল লইয়া তার ঘরে ঢোকে তখন তার মনে হয় কোন ফেরেস্তা যেন তাহার জন্য বেহেস্তী খানা লইয়া আসিয়াছে। সেই ডালভাত সম্পূর্ণ খাইয়া সে টিনের থালাখানা ধুইয়া যে পানিটুকু পায় তাহাও খাইয়া ফেলে।
কতদিন রাত্রে ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া স্বপ্নে দেখে কোথায় যেন সে গিয়াছে। তাহার মায়ের মতই দেখিত একটি মেয়ে কত ভাল ভাল খাবার নিজ হাতে তুলিয়া তাহাকে খাওয়াইতেছে। ঘুম ভাঙিলে সে মনে মনে অনুতাপ করে, আহা! আর যদি একটু ঘুমাইয়া থাকিতাম তবে আরও কিছুক্ষণ ধরিয়া সেই ভাল ভাল খাবারগুলি খাওয়ার আনন্দ পাইতে পারিতাম। শহরের কোথাও মিলাদ হইলে সে সুযোগ পাইলেই রবাহূত ভাবে সেখানে যায়। তার নিজ গ্রামে কোথাও মিলাদ হইলে সমবেত লোকদিগকে ভুরীভোজন করানো হয়। শহরের মিলাদে সেরূপ খাওয়ানো হয় না। কোথাও শ্রোতাদিগের হাতে মাত্র চার পঁচখানা বাতাসা বা একখানা করিয়া জিলাপী দেওয়া হয়। শুধু এই সামান্য দু’একখানা বাতাসা বা জিলাপীর লোভেই সে মিলাদে যায় না। ওয়াজ করিবার সময় মৌলবী সাহেব যখন বেহেস্তের বর্ণনা করেণ সেই বেহেস্তে গাছে গাছে সন্দেশ, রসগোল্লা ধরিয়া আছে। ইচ্ছামত পাড়িয়া খাও। হাত বাড়াইলেই বেহেস্তী মেওয়ার গাছের ডাল নামিয়া আসে। কত আঙ্গুর, বেদানা, ডালিম! মানুষে আর কত খাইবে। এই সব বর্ণনা শুনিতে তার ক্ষুধার্ত দেহ কোথাকার যেন তৃপ্তিতে ভরিয়া যায়। বোধ হয়, এই জন্যই গ্রামের অনাহারী লোকদের। কাছে মিলাদের ওয়াজ এত আকর্ষণীয়।
কিন্তু খাবার চিন্তা করিলেই ত বছিরের চলিবে না। তাহাকে যে বড় হইতে হইবে। বড় ডাক্তার হইতে হইবে। পাঠ-পুস্তকের অবাধ্য কথাগুলিকে সে বার বার পড়িয়া আয়ত্ত করে। লাইট পোষ্টের নীচে কোন কোন সময়ে সে সারা রাত্র দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া পড়ে। স্কুলের ছুটির পর অবসর সময়ে সে যে কোথাও বেড়াইতে যাইবে তাহার উপায় নাই। এখন লোকজনের বেশী আনাগোনা হওয়ায় উকিল সাহেবের বাড়ির ফুট-ফরমাস, কাজকর্ম আরও অনেক বাড়িয়াছে। এই ত শহরের কাছেই রহিমদ্দী দাদার। বাড়ি–মেনাজদ্দী মাতবরের বাড়ি। কতবার সে ভাবিয়াছে তাহাদের ওখানে যাইয়া বেড়াইয়া আসিবে; কিন্তু কিছুতেই ফুরসত করিয়া উঠিতে পারে নাই।
“বোবা কাহিনী” উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ