ভূমিকা

নারী প্ৰথম বই আকারে বেরিয়েছিলো ১৯৯২-এর ফেব্রুয়ারির বইমেলায়। বেরোতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিলো, এবং মেলার শেষ দিকে বেরোতে-না-বেরোতেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো প্রথম সংস্করণ। শুরু থেকেই নারী উপভোগ করে অশেষ জনপ্রিয়তা, এবং প্রচণ্ড ধাক্কা দেয় বদ্ধ প্রথাগতদের, ও উল্লসিত অনুপ্রাণিত করে ভবিষ্যৎমুখিদের। বইটি অল্প সময়েই বদলে দেয় নারী সম্পর্কে প্রথাগত ধারণা। তখনও অনেক বাকি ছিলো। লেখার, সংস্করণ পরম্পরায় আমি যোগ করতে থাকি নতুন নতুন বিষয়; বেরোতে থাকে একের পর এক পুনর্মুদ্রণ। নারী নন্দিত হয়েছিলো ব্যাপকভাবে, এবং হয়ে উঠেছিলো মৌলবাদীদের আক্রমণের লক্ষ্য। আমিও লক্ষ্য হয়ে উঠি আক্রমণের। প্রকাশের তিন বছর পর জানতে পারি সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বইটি নিষিদ্ধ করার, তারপর অনেক দিন কিছু শুনি নি; হঠাৎ ১৯ নভেম্বর ১৯৯৫-এ আমার অনুজ টেলিফোনে জানায় যে নারী নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জাতীয়তাবাদী সরকার তখন বিপন্ন, তাদের সময় ফুরিয়ে এসেছে, চলছে তীব্র আন্দোলন; পতনের আগে তাড়াহুড়ো ক’রে তারা নিষিদ্ধ ক’রে যায় বইটি। বইটিকে যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা আমি নিশ্চিতভাবে জানতে পারি। পরদিন পত্রিকা পড়ে। নারী নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে দেশে বিদেশে প্রতিবাদ হয়েছিলো, কিন্তু প্ৰতিবাদে আমাদের কোনো সরকারই বিচলিত হয় না, আটলতায় তারা অদ্বিতীয়। বাংলাবাজার পত্রিক প্রথম পাতায় প্ৰকাশ করে দীর্ঘ প্রতিবেদন, যার শিরোনাম ছিলো ‘নারী বাজেয়াপ্ত, লেখক হুমায়ুন আজাদ বললেন আমার হাসি পেয়েছে, একদিন ওরাই অনুতপ্ত হবে; বিভিন্ন পত্রিকায় লে রোতে থাকে সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়। সংবাদ-এ সম্পাদকীয় বেরোয় ‘নারী’, ডেইলি স্টার-এ সম্পাদকীয় বেরোয় ‘এ ফুলিশ ব্যান’; আমেরিকার “উইমেন্স ওয়ার্ল্ড” দীর্ঘ প্ৰবন্ধ প্ৰকাশ করে ‘ঢাকা ব্যান্স হুমায়ুন আজাদস নারী’ নামে। এমন বহু সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় বেরিয়ে জানায় যে বইটির নিষিদ্ধকরণ তারা মেনে নেন নি। বিবেকের কাছে আমাদের কোনো সরকার কখনো পরাস্ত হয় নি; জাতীয়তাবাদীরাও হয় নি।

নারী নিষিদ্ধ করা কি ঠিক হয়েছে?– আমার মনে প্রশ্ন জাগে। আমি বিনোদনকারী নই; আমার অনেক কিছুই আপত্তিকর প্রথাগতদের কাছে; আমি তো কিছুই মেনে নিই নি, যা তাদের পুজোর বিষয়। আমার সব বইই কি নিষিদ্ধ হতে পারে না? কিন্তু প্রকৃত বইকে কেউ নিষিদ্ধ করে রাখতে পারে না; যারা নিষিদ্ধ করে, তারা ধ্বংস হয়, বেঁচে থাকে বই। এ-পর্যন্ত নিষিদ্ধ হয়েছে যতো প্রকৃত বই, সেগুলোর কোনাটিই লুপ্ত হয়ে যায় নি, আরো জীবন্ত হয়ে উঠেছে; দেখিয়ে দিয়েছে যারা নিষিদ্ধ করেছে, তারাই ছিলো ভ্ৰান্ত। কী অপরাধে নিষিদ্ধ করেছে বইটি? সরকার আমাকে কিছুই জানায় নি; তাই আমি দু-একজন অনুরাগীকে দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রাসঙ্গিক কাগজপত্র সংগ্রহের চেষ্টা করি। কাগজপত্র পেয়ে আমি বেদনার্ত হই; দেখি নারী নিষিদ্ধকরণের আদেশ প্রচারিত হয়েছে। একজন সহকারী সচিবের স্বাক্ষরে, যে নারী। আদেশে বলা হয়েছে ‘পুস্তকটিতে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি তথা মৌলিক বিশ্বাসের পরিপন্থী আপত্তিকর বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ায় সরকার কর্তৃক ফৌজদারী কার্যবিধির ৯৯ “ক” ধারার ক্ষমতা বলে বর্ণিত পুস্তকটি বাজেয়াপ্ত হইল…।’ সাথে দু-পাতার একটি সুপারিশ, যা করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দুটি বিশেষজ্ঞ–একটি দ্বীনি দাওয়াত ও সংস্কৃতি বিভাগের, আরেকটি ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির পরিচালক:- তারা এ-বিশাল বইটি থেকে ১৪টি বাক্য উদ্ধৃত ক’রে পরামর্শ দিয়েছে : উপরোক্ত উদ্ধৃতি ও মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বইটি বাজেয়াপ্ত করার সুপারিশ করা যায়।’ এতো বড়ো বইটি পড়ার শক্তি ওই দুই মৌলবাদীর ছিলো না; তারা বইটি থেকে কয়েকটি বাক্য তুলে পরামর্শ দেয় নিষিদ্ধ করার। ওইগুলোর মধ্যে রয়েছে– ‘নারীর প্রধান শক্ৰ এখন মৌলবাদী’, ‘১৯৯১-এর উপসাগরীয় যুদ্ধের পূর্বমুহুর্তে সৌদি আরবের মতো আদিম পিতৃতন্ত্রও নারীদের ঘর থেকে বের করে লাগিয়েছে নানা কাজে’ ধরনের বাক্য। নারীর নিষিদ্ধকরণ আমি মেনে নিই নি, বইটি নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে ৪ ডিসেম্বর ১৯৯৫-এ আবেদন করি উচ্চবিচারালয়ে; আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম, ইদ্রিসুর রহমান, ব্যারিস্টার তানিয়া আমির, শিরীন শারমিন চৌধুরী। বইটি নিষিদ্ধকরণ আদেশকে কেনো অবৈধ বলে গণ্য করা হবে না, ৭ দিনের মধ্যে তার কারণ দর্শানোর জন্যে স্বরাষ্ট্র ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও আরো দুজনকে নির্দেশ দেয় উচ্চবিচারালয়। বামন কুৎসিত মৌলবাদী একটি লোক আমার সাথে দেখা করে, সে জানায় তারই আবেদনে নিষিদ্ধ হয়েছে নারী, আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ। তারপর কেটে যায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর; কিছুই শোনা যায় না, আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি, মামলার কথা প্ৰায় ভুলে যাই।

২৯ ফেব্রুয়ারি ২০০০-এ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এক ডিভিশন বেঞ্চে নারীর মামলাটি গ্রহণ করার আবেদন করেন; তাব আবেদন গৃহীত হয়ে যায। আমি কৃতজ্ঞ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের কাছে। আমি জানতামও না তিনি আবেদন করেছেন, পরের দিন জানতে পারি; তারপর দ্রুত এগোয় মামলাটি; ৭ মার্চ ২০০০-এ দুজন বিচারপতি রায় দেন যে নারী নিষিদ্ধকরণ আদেশ অবৈধ। আমি উপস্থিত ছিলাম, প্রথম বুঝতে পারি নি যে একটি ঐতিহাসিক রায় ঘোষিত হযে গেছে। যখন বুঝতে পারি তখন উল্লসিত হয়ে উঠতে পারি নি, আমি বেদনা বোধ করতে থাকি দেশের কথা ভেবে। এ কী বদ্ধ অন্ধ সমাজের লেখক আমি, যেখানে অবৈধভাবে একটি বই নিষিদ্ধ হয়ে থাকে বছরের পর বছর ; এটি যে একটি ঐতিহাসিক যুগান্তরকারী রায়, তা বুঝতে পারে নি আমাদের পত্রিকাগুলোও পরের দিন দেখি তারা মেতে আছে তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে, চিন্তা ও বক্তব্য প্রকাশের আমাদের রয়েছে যে-সাংবিধানিক অধিকার, যা মেনে চলছিলো না। সরকারগুলো, আমাদের উচ্চবিচারালয় যে বক্তব্য প্রকাশের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তা বুঝে উঠতে পারেন নি তাঁরা। অশুভ তাঁরা বোঝেন, শুভ বোঝেন না। নারী সম্ভবত বাঙলাদেশে একমাত্র বই যেটি উচ্চবিচারালয়ের আদেশে পেয়েছে। পুনপ্রকাশের অধিকার; এটি এক বিরাট ঘটনা- শুধু নারীর জন্যে নয়, বাঙলাদেশের চিন্তা ও সৃষ্টিশীলতার জন্যেও। কোনো মৌলিক লেখকই মেনে নিতে পারে না প্রথাগত বিশ্বাস, সিদ্ধান্ত, নির্দেশ; তার কাজ ওসব বিশ্বাস সিদ্ধান্ত নির্দেশ অতিক্রম করে যাওয়া, যদিও আমাদের লেখকেরা প্রথাগত বিশ্বাস সিদ্ধান্ত নির্দেশেই স্বস্তি বোধ করেন। রাষ্ট্রের উচিত নয় কোনো ভাবাদর্শ অধিবাসীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া; কেননা সমস্ত ভাবাদৰ্শই ভুল ও অচিরস্থায়ী। ধর্মানুভূতি এক বাজে কথা, এটা বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রমাণ সম্ভব নয়। রাষ্ট্র বিশ্বাস করতে পারে ভুতপ্রেতে, কিন্তু কোনো মননশীল মানুষের পক্ষে তা মেনে নেয়া অসম্ভব। পৃথিবী এখন যেসব বিশ্বাস পোষণ করে, তার সবই ভুল, কেননা সেগুলো পৌরাণিক; রাষ্ট্রগুলো আজো আমাদের পৌরাণিক জগতে বাস করতে বাধ্য করে। আমি পৌরাণিক সংস্কৃতি ও অসভ্যতা থেকে বেরিয়ে পড়তে চাই; নারীর পাতায় পাতায় সেই অভিলাষ রয়েছে। অজস্র পাঠক অপেক্ষা ক’রে ছিলেন নারীর জন্যে; আমি সুখী যে বইটি আবার তাদের হাতে পৌঁছোলো।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x