হানিফ দাঁড়িয়ে আছে জারুল গাছের নীচে।
জায়গাটা বেশ সুবিধাজনক, গাছ গাছড়ায় ঝুপড়ির মত হয়ে আছে–দূর থেকে তাকে দেখার উপায় নেই। টর্চের আলো ফেললেও বোঝা যাবে না। কিছু কিছু বেআক্কেল লোক টর্চের আলো রাস্তায় ফেলার বদলে আশে পাশের ঝোপ ঝাড়েও ফেলে। তবে আশার কথা হল টর্চওয়ালা লোক এই অঞ্চলে নেই বললেই হয়। যে দু’একজন আছে তারা ব্যাটারি বাচাবার জন্যে খুট করে খানিকটা আলো ফেলেই টর্চ নিভিয়ে ফেলে।
ভাদ্র মাস।
তালপাকা গরম পড়েছে। হানিফের গায়ে মার্কিন কাপড়ের মোটা পাঞ্জাবী। গা অসম্ভব ঘামছে। অবশ্যি এই রকম অবস্থায় সব সময় তার গা ঘামে। মাঘ মাস হলেও ঘামতো। বড় ধরনের কোন কাজের আগে আগে তাঁর এমন হয়। মানুষ মারা সহজ কোন কাজ না। বড় কাজ।
হানিফ দাঁড়িয়ে আছে নওয়াবগঞ্জের মুনশি রইসুদ্দীন নামের একজন লোককে খুন করার জন্যে। মুনশি রইসুদ্দিনকে সে চেনে না। লোকটা ভাল কি মন্দ তাও জানে না। তবে মন্দ হবারই সম্ভাবনা। ভাল নির্বিরোধী কোন মানুষকে কেউ খুন করতে চায় না।
অবশ্যি লোকটি ভাল হলেও কিছু যায় আসে না। কাজটা করে দিলে হানিফ পাঁচ হাজার টাকা পাবে এটাই আসল কথা। পাঁচ হাজারের মধ্যে এক হাজার তাকে দেয়া হয়েছে। বাকি চার হাজার কাজ শেষ হলে পাওয়া যাবে। আজ কাজ শেষ হলে আজ রাতেই। এইসব ব্যাপারে টাকা পয়সা নিয়ে কেউ ঝামেলা করে না। মাঝে মাঝে বেশীও পাওয়া যায়।
তিন বছর আগে এই রকম একটা কাজের জন্যে দুই হাজার টাকা বেশী পাওয়া গেল। ছ’হাজারের চুক্তি হয়েছিল। পুরো টাকাটা পাওয়ার পর হানিফ বলল, বখশীস দেবেন না? মোবারক শাহ নামের আধবুড়ো মানুষটা অতি দ্রুত মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, অবশ্যই দিব। অবশ্যই দিব। তৎক্ষনাৎ দু’হাজার টাকা দিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল, আপনে খুশী তো?
এই একটা মজার ব্যাপার, কাজ শেষ হবার পর তাকে আপনি আপনি করে বলা হয়। এর আগে তুমি। হানিফের ধারণা ভয়ের চোটে আপনি বলে।
হানিফ মোবারক শাহ নামের বুড়ো লোকটাকে বলেছিলো—আমি বসতেছি। কাজ ঠিকমত সমাধা হয়েছে কি-না খোঁজ নিয়ে আসেন, তারপর যাব।
মোবারক শাহ চমকে উঠে বলেছিল—তার দরকার হবে না। আপনের কথা যোল আনা বিশ্বাস করতেছি। আপনার বসতে হবে না, আপনি যান।
একটু বসি। এক কাপ চা খাই।
মোবারক শাহ ফ্যাকাশে মুখে বলেছে, চায়ের আয়োজন বাড়িতে নাই। আপনে দোকানে গিয়া চা খান। ভংতি টাকা দিতাছি। এই বলে পাঁচ টাকার ময়লা একটা নোট বের করে দিল। হানিফ নোটটা পকেটে রাখতে রাখতে মনে মনে হেসেছে। লোকটার ভয় দেখতে মজা লাগছে, হারামজাদা, মানুষ মারবার সময় খেয়াল ছিল না?
আপনে তা হইলে এখন যান। বেশীক্ষণ থাকা ঠিক না।
হানিফ উদাস গলায় বলল, কোন অসুবিধা নাই।
আপনে হইলেন বিদেশী লোক, আপনেরে সন্দেহ করবো।
আরে না, কী সন্দেহ করবো? এত বড় গঞ্জ, বিদেশী লোক তো থাকবই। এক গ্লাস পানি দিতে বলেন।
পানি দিতেছি। পানি খেয়ে তাড়াতাড়ি চলে যান।
পানি খাওয়ার পরও হানিফ যায় না। জর্দা দিয়ে পান খেতে চায়। পান মুখে দিয়ে বিড়ি ধরায়। উদাস ভঙ্গিতে টানতে থাকে।
আসলে কাজ শেষ হবার পরপরই জায়গা ছেড়ে চলে যেতে তার ইচ্ছা করে না। বড়ই ক্লান্ত লাগে। ঘুম পায়। তাছাড়া এইসব ঘটনার পর কি সব কথাবার্তা রটে সেইগুলিও শুনতে ইচ্ছা করে। থানা থেকে পুলিশ সাহেব এসে চারদিকে মিথ্যা আতংক জাগিয়ে তোলে। একে ধমকায়, তাকে ধমকায় — এইগুলি দেখতে ভাল লাগে। পুলিশ সাহেব মুখে দুঃখ এবং রাগ রাগ ভাব ফুটাতে চেষ্টা করেন, কিন্তু পারেন না। পুলিশ সাহেবের মুখ দেখেই মনে হয় তিনি গভীর আনন্দবে করছেন। খুন খারাবি মানেই তাঁদের পকেটে কিছু কাঁচা পয়সা। কাজেই এইসব ঘটনায় তাঁরা আনন্দিতই হবেন। এটাই স্বাভাবিক। খুব কম করে হলেও দশ বারজনকে ধরে হাজতে পুরে দিবেন। ওদের ছাড়াতে টাকা লাগবে। খুনীর শত্রুদের টাকা দিতে হবে। যে খুন হয়েছে তার আত্মীয় স্বজনদেরও টাকা খরচ করতে হবে। টাকারই খেলা।
পায়ের কাছে মড়মড় শব্দ হল। হানিফ চমকে খানিকটা সরে গেল। সাপ-খোপ হতে পারে। ভাদ্র মাস হল সাপের মাস। গরমে অতিষ্ট হয়ে তারা গর্ত ছেড়ে বের হয়। হানিফের সঙ্গে একটা টর্চ আছে। আলো ফেলে দেখবে না-কি ব্যাপারটা কি?, সেটা ঠিক হবে না। আশে পাশে কেউ নেই। টর্চ জ্বালালেও কোন ক্ষতি হবে না, তবু সাবধান থাকা ভাল। পায়ে ঝিঝি ধরে গেছে। কতক্ষণ ধরে সে দাঁড়িয়ে আছে। তা নিজে ধরতে পারছে না। মাঝে মাঝে মনে হয় সময় কাটছেই না, আবার মাঝে মাঝে মনে হয় অতি দ্রুত কেটে যাচ্ছে।
হানিফ বসল।
হাতের আঙ্গুলে আগুন আড়াল করে সিগারেট ধরাল। পকেটে দশটা সিগারেট নিয়ে এখানে এসে দাঁড়িয়েছিল, এখন সিগারেট আছে তিনটা। সাতটা এর মধেই খাওয়া হয়ে গেছে। এর থেকে মনে হচ্ছে রাত কম হয়নি। হানিফ রুমাল দিয়ে ঘাড় মুছল। অন্য সময়ে এতটা ঘামে না। আজ বড় বেশী ঘামছে। মুখের ভেতরটাও নোনতা লাগছে। মানুষের মুখের ভেতরেও কি ঘাম হয়? মনে হয়, হয়। না হলে মুখের ভেতর নোনতা লাগত না।
ঘুট ঘুটে অন্ধকার।
কৃষ্ণপক্ষের রাত, অন্ধকার হবেই। আকাশে মেঘ থাকায় নক্ষত্রের আলোও নেই। খুন করার জন্যে সময়টা ভাল না। এই রকম অন্ধকার রাতে ভুল ভ্রান্তি হয়। ভুল লোক মারা পড়ে। চাঁদনি রাতে হলে ভুল ভ্রান্তি হয় না। কে আসছে দূর থেকে দেখা যায়। সবচে ভাল হয় দিনের বেলা। তবে এই জাতীয় কাজ-কর্ম দিনের আলোয় হয় না বললেই হয়।
কৃষ্ণপক্ষে কাজ করতে হবে বলেই হানিফ গতকাল সন্ধ্যায় দুই ব্যাটারীর এই টর্চ লাইটটা কিনেছে। কাজ করার আগে মুখে আলো ফেলে দেখে নিতে হবে লোক ঠিক আছে কি-না। একবার আলো ফেললেই চিনতে পারবে। আলো না-ফেলে হটা দেখেও চিনতে পারবে–লোকটা হাঁটে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ডান পায়ে কোন দোষ টোষ মনে হয় আছে।
লোকটাকে সে যাতে চট করে চিনতে পারে সেই উদ্দেশ্যে গতকাল তার সঙ্গে আলাপও করেছে। লোকটা প্রতিদিন ভোর আটটার ট্রেনে মোহনগঞ্জ থেকে যায় বারহাট্টা, ফিরে রাত দশটার ট্রেনে। দলিল লেখক। দলিল লেখকরা সাধারণত হতদরিদ্র হয়,এ সেই শ্রেণীর না। এর পয়সা কড়ি ভাল আছে। বাড়িতে টিনের বড় বড় দুটো ঘর। বাংলাঘরের পশ্চিমদিকে টিউবওয়েল। লম্বা বাঁশের আগায় এন্টেনা দেখে বোঝা যায় টেলিভিশন আছে। নিশ্চয়ই ব্যাটারীতে চালায়। এই অঞ্চলে এখনো ইলেকট্রিসিটি আসে নি। ব্যাটারীতে টিভি চালানো খরচান্ত ব্যাপার। তবে লোকটা কঞ্জুষ ধরনের। গতকাল সকালে কিছুক্ষণ সঙ্গে থাকায় তার স্বভাব চরিত্র পরিষ্কার বোঝা গেছে। হানিফ ডিসট্রিক বোর্ডের সড়কে তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল। মোহনগঞ্জ রেলষ্টেশন পর্যন্ত সঙ্গে সঙ্গে যাবে, এতে চেহারাটা মনে গাথা হয়ে যাবে। অন্ধকারেও চিনতে অসুবিধা হবে না।
লোকটা মাটির দিকে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে ডিসট্রিক্ট বোর্ডের সড়কে উঠে এল। হানিফ সঙ্গে সঙ্গে বলল, ভাইজানের সঙ্গে ম্যাচবাক্স আছে? একটা সিগারেট ধরাব। রইসুদ্দিন সরু চোখে তাকাল। নিতান্ত অনিচ্ছায় দেয়াশলাই এর বাক্স বের করল। হানিফ তার সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিল। হাসি মুখে বলল, নেন ভাইজান, আপনেও একটা ধরান। লোকটা তৎক্ষণাৎ হাত বাড়িয়ে সিগারেট নিল। নিতান্ত অপরিচিত একজন মানুষের কাছ থেকে সিগারেট নিতে বিন্দুমাত্র সংকোচ বা দ্বিধা দেখাল না। কঞ্জুষ প্রকৃতির লোকজনের এই হচ্ছে লক্ষণ। যা পাওয়া যায় তাই নিয়ে নেয়া।
হানিফ বলল, ইষ্টিশানের দিকে যান না-কি ভাইজান?
হুঁ।
আমি একজন চাউলের পাইকার। চাউল কিনতে আসছিলাম, দরে বনল না। এই দিকে চাইলের দর বেশী।
হুঁ।
লোকটা সব কথার জবাব এক অক্ষরে দিচ্ছে। কঞ্জুষ ধরনের মানুষদের এটাও একধরনের আচরণ। মুখের কথাও তাদের কাছে টাকা পয়সার মতন। সহজে খরচ করতে চায় না। লোকটা বাজারে ঢোকার মুখে এক খিলি পান কিনল। হানিফ সঙ্গে আছে একবার জিজ্ঞেস করল না পান খাবে কি-না।
অথচ কিছুক্ষণ আগেই তার কাছ থেকে সিগারেট নিয়ে বিনা দ্বিধায় খেয়েছে। আশ্চর্য লোক।
হানিফ দুপুরের দিকে রইসুদ্দিনের বাড়িতে গিয়েও উপস্থিত হল। এটা তার দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। কাজ কর্ম করার আগে ঐ বাড়িতে একবার যাবেই। রইসুদ্দিনের বাড়ি ঘর তার পছন্দ হল। হিন্দু বাড়ির মত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাড়ি। ফুটফুটে একটা সবুজ জামা পরা মেয়ে বাংলা ঘরের উঠান ঝাট দিচ্ছে। হানিফ মধুর গলায় বলল, ও মা তুমি এই বাড়ির?
হ।
আমার জন্য গেলাসে কইরা পানি আনতে তিয়াশ লাগছে।
মেয়েটি ভিতরে চলে গেল। কেমন হেলতে দুলতে যাচ্ছে। দেখতে ভাল লাগছে। পঁাচ ছয় বছর বয়স হবে, কিন্তু পরিষ্কার কাজ কর্ম। কি সুন্দর করে উঠান ঝাট দিচ্ছে। মেয়েটি ফিরে এল খালি হাতে। চিকন সুরে বলল, চাপ কল থাইক্যা পানি খাইতে কইছে।
আচ্ছা আচ্ছা। তুমি চাপ কলে চাপ দেও আমি পানি খাই।
মেয়েটি খুব উৎসাহের সঙ্গে কলে চাপ দিয়ে পানি বের করল। মনে হল সে পানি বের করার কাজটায় খুব মজা পায়।
তোমার নাম কি গো?
ময়না।
বড় ভাল নাম–ময়না। রইসুদ্দিন সাব তোমার কে হয়?
বাজান হয়।
আচ্ছা আচ্ছা ভাল।
হানিফের একটু মন খারাপ হল। ঘটনা ঘটে গেলে এই মেয়ে নিশ্চয়ই ডাক ছেড়ে কাঁদবে। কাঁদলেও কিছু করার নেই। ঘটনা সে না ঘটালে অন্য কেউ ঘটাবে। ব্যাপার একই। মাঝখান থেকে এতগুলি টাকা হাতছাড়া হবে। টাকার খুবই দরকার। হাত এখন একেবারে খালি। তার বৌ খানিকটা সৌখিন ধরনের মেয়ে, অভাব সহ্য করতে পারে না। একবেলা উপাস দিলেই চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলে। ছেলে মেয়ে গুলোকে ধরে ধরে পিটায়। সাপের মত ফোঁস ফোঁস করতে করতে করতে বলে — সর, সর।
টাকাটা পাওয়া গেলে মাস ছয়েকের জন্য নিশ্চিন্ত। শ্যামগঞ্জ বাজারের মেয়ে মানুষটার কাছেও তাহলে ইজ্জত নিয়ে যাওয়া যাবে। মেয়ে মানুষটা বড় তুচ্ছ করছে। গত মাসে একবার গিয়েছিল, দরজা ধরে কঠিন গলায় বলল, আইজ যান গিয়া ঘরে লোক আছে।
হানিফ আবার সিগারেট ধরাল। আর একটা মাত্র বাকি আছে। শেষ সিগারেটটা ধরানো যাবে না। কাজের শেষে একটা সিগারেট ধরাতেই হয়। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। সিগারেটের আগুন খুব সাবধানে বৃষ্টির ফোঁটা থেকে আড়াল করে রাখতে হচ্ছে। বৃষ্টির ফোটায় আগুন নিভে গেলে সিগারেট আর ধরানো যাবে না। রাতের ট্রেন আসতে আজ এত দেরী করছে কেন কে জানে। লোকাল ট্রেইনগুলির আসা যাওয়ার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। খুব বেশী দেরী করলে রইসুদ্দিন নামের রোগা কঞ্জুষ লোকটা হয়ত আসবেই না। বারহাট্টায় আত্মীয় বাড়িতে থেকে যাবে। আরো একটা দিন অপেক্ষা করতে হবে। এইসব কাজে অপেক্ষার যন্ত্রণা বড় যন্ত্রণা। একবার এই রকম একটা কাজে এগারোদিন অপেক্ষা করা লাগলো। লোকটাকে কিছুতেই একা পাওয়া যায় না। সঙ্গে সব সময় একজন না একজন থাকে। অতি সাবধানী লোক। এত সাবধান হয়েও অবশ্যি শেষ রক্ষা হয়নি। কপালে মরণ লেখা থাকলে সাবধান হয়েও লাভ হয় না। লখিন্দর লোহার ঘর বানিয়েও বাঁচতে পারে নি।
এই লোক অবশ্যি সাবধানী না। একা একাই ঘুরা ফিরা করে। তার এত বড় একজন শত্রু আছে তা বোধহয় জানেও না। না জানাই ভাল। জানলে সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। মৃত্যু ভয় নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল। তাছাড়া মরাটা ভয়াবহ কিছু না। একদিন না একদিন সবাইকেই মরতে হবে। রোগে ভুগে বিছানায় শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে মরার চেয়ে এইভাবে মরে যাওয়া ভাল। কষ্ট অনেক কম। মৃত্যুর পর শহীদের দরজা পাওয়ারও একটা সম্ভাবনা থাকে। অপঘাতে মৃত্যু হলে শহীদের দরজা পাওয়া যায়–মৌলানা সাহেব একবার ওয়াজে বলেছিলেন। অপঘাতে মৃত্যু আর পেটের অসুখে মৃত্যু। এই দুয়ের জন্যে আছে শহীদের দরজা। মওলানা সাহেবদের সব কথা কেন জানি বিশ্বাস হতে চায় না। পেটের অসুখে মৃত্যু হলে শহীদের দরজা পাওয়া যাবে কি জন্যে? কারণটা কি? সত্যি হলে অবশ্যি ভালই হয়। তাহলে বড় মেয়েটা শহীদের দরজা পায়। মেয়েটা মারা গেল পেটের ব্যাথায়। কোন চিকিৎসা করতে পারে নি। কি চিকিৎসা। করাবে, হাতে নাই একটা পয়সা। মেয়েটা ছটফট করেছে আর বলেছে–বাজান আমারে ডাক্তারের কাছে লইয়া যাও।
হানিফ নিয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার সাহেব গম্ভীর মুখে বলেছিলেন–পেট কাটা লাগবে। তিন হাজার টাকা খরচ হবে কমসে কম। আছে টাকা? না থাকলে সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করে দে।
হানিফ তাও পারেনি। মেয়েটা কোলের উপর ছটফট করতে করতে মরল। বড় মেয়েটার মৃত্যুর পর মানুষ মারার প্রথম কাজটা হানিফ করে। যে মানুষটাকে প্রথম মারে তার নাম ছিল দবীর। মরার সময় সেও অবিকল তার মেয়ের মত ছটফট করতে করতে হানিফকে বলল, আফনে আমারে ডাক্তারের কাছে লইয়া যান।
কি আশ্চর্য কথা। যে তার পেটে ছোরা বসিয়েছে তাকেই অনুরোধ করছে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। মৃত্যুর সময় মানুষ অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড কারখানা করে। কেন করে কে জানে? একবার এক লোকের পেটে ছোরা বসাবার পর দু’হাতে পেট চেপে বসে পড়তে পড়তে খুবই অবাক হওয়া গলায় জিজ্ঞেস করেছিল — ভাইজান আপনের নাম কি?
মৃত্যুর সময় মানুষের মাথায় বোধহয় কিছু একটা হয়। সব গোলমাল হয়ে যায়। তার বড় মেয়েরও তাই হয়েছিল। মৃত্যুর ঠিক আগে আগে সে তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল–বাজান আপনে হাসতাছেন ক্যান? কি হইছে?
হানিফ তখন হাসছিল না। চিৎকার করে কাঁদছিল। সেই কান্না মৃত্যুর সময় মেয়েটার কাছে হাসি হয়ে ধরা পড়ল।
পিঁপড়া কামড়াচ্ছে।
রাতে পিঁপড়া কামড়ায় না, কিন্তু এখন কামড়াচ্ছে কেন কে জানে? হানিফ ঝোপের আড়াল থেকে বের হয়ে এল। প্রায় তার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল রইসুদ্দিন আসছে। পা টেনে টেনে আসছে।
হানিফ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। শেষ সিগারেটটা রয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তা ধরানো যাবে। তবে দিয়াশলাই ভিজে গেছে। ভেজা দেয়শলাই দিয়ে এ সিগারেট ধরানো সমস্যা হতে পারে, এই নিয়েই সে খানিকটা চিন্তিত এবং বিষণ্ণ।
“অয়োময়” গল্প সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ