শুধু আদিবাসীঊ সমাজেই নয়, গ্রামে-গঞ্জে, আধা শহরে এমনকি খোদ কলকাতাতেও ‘কুলো চালান’ দিব্বি ‘চলছে-চলবে’ করে ঠিকই টিকে রয়েছে। কুলো চালানে বিশ্বাসী সংখ্যাও কম নয়। আসলে একবার কুলো চালানে নিজে অংশ নিলে অবিশ্বাস করা বেজায় কঠিন। কেন কঠিন, সে আলোচনায় যাওয়ার আগে কুলো চালানে কি হয়, তাই নিয়ে একটু আলোচনা করে নিলে বোধহয় মন্দ হবে না।
যে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-তে দেওয়া সম্ভব তার সবই নাকি কুলো-চালানে জেনে নেওয়া সম্ভব। যেমন ধরুন- ‘আমি পরীক্ষায় পাশ করব কি না?’ ‘আমার প্রমোশনটা এবারে হবে কি না?’ ‘এ বছরের মধ্যে আমার চাকরী হবে কি না?’ ‘সুদেষ্ণার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে কি না?’ ‘এ বছর মেয়ের বিয়ে দিতে পারব কি না?’ ‘আমার ঘড়িটা গঙ্গাধার চুরি করেছে কি না?’ ‘চাদু হাসদা আমার গরুটাকে বান মেরেছে কি না?’ এমনি হাজারো প্রশ্নের উত্তর মিলতে পারে। তবে প্রশ্ন পিছু নগদ দক্ষিণা চাই। দক্ষিণা নেবেন ওঝা, গুণীন তা তান্ত্রিক, যিনি মন্ত্র পড়ে কুলোকে চালাবেন। কুলো ঘুরবে, বিনা হাওয়াতেই ঘুরবে।
কুলো চালানে’র কুলোর একটু বৈশিষ্ট্য আছে। না, একটু ভুল বললাম। কুলোতে বৈশিষ্ট্য নেই। তবে এই কুলোর উঁচু কানায় গেঁথে দেওয়া হয় ধারাল ছুঁচলো লম্বা কাঁচি। যে কাঁচি দিয়ে নাপিতেরা চুল ছাঁটে, সেই ধরনের কাঁচিই কুলো চালানে ব্যবহৃত হয়। কাঁচির হাতল বা আঙ্গুল ঢোকাবারা দিকটা থাকে কুলোর ওপরে। তলার ছবিটা দেখলে একটা আন্দাজ পাবেন।
কুলোতে তৈরি হল। ওঝা মন্ত্রও পড়ল। কিন্তু তারপর? তারপর নয়, মন্ত্র পড়ার সময়ই প্রশ্নকর্তা কাঁচির একদিকের হ্যান্ডেলের তলায় একটা আঙ্গুল রাখেন। সাধারণত তর্জনী স্থাপন করতে বলা হয়। অন্য হ্যান্ডেলের তলায় তর্জনী রাখেন প্রশ্নকর্তার পরিচিত কেউ অথবা গুণীন স্বয়ং। আবার একটা ছবি দিলে কেমন হয়?
গুণীন এবার প্রশ্নকর্তাকে বলেন, আপনি মনে মনে আপনার প্রশ্নটা ভাবতে থাকুন। গভীর ভাবে ভাবতে থাকুন। আপনার প্রশ্নের উত্তর যদি ‘হ্যাঁ হয়, দেখবেন কুলোটা আপনা থেকে ঘুরে যাবে আর, উত্তর যদি ‘না’ হয়, কুলোটা ঘুরবে না। একই রকমভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে।
প্রশ্নকর্তা ভাবতে থাকেন। এবং বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে দেখা যায় কুলোটি কখনো ঘুরে যাচ্ছে। কখনো বা রয়েছে নিশ্চল।
কুলোর এই ঘুরে যাওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে প্রশ্নকর্তার অবচেতন মন।
ওঝার কথায় প্রশ্নকর্তা বিশ্বাস করলে একসময় ভাবতে শুরু করেন, বাস্তবিকই মন্ত্রপূত কুলোটা সমস্ত প্রশ্নের ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ -জাতীয় উত্তর দিতে সক্ষম। উত্তরটা ‘হ্যাঁ’ হওয়ার প্রতি প্রশ্নকর্তার আগ্রহ বেশি থাকলে তার অবচেতন মন নিজের অজান্তেই আঙ্গুল নেড়ে কাঁচি ঘুড়িয়ে কুলোকে ঘুড়িয়ে দেয়। প্রশ্নকর্তার অবচেতন মন ‘না’ উত্তরে আগ্রহী হলে কাঁচির তলাকার আঙ্গুল স্থীর থাকে। অতএব স্ত্রীর থাকে কুলো। অবেচতন মনের এই জাতীয় কান্ড-কারখানা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল না থাকলে প্রশ্নকর্তা অবশ্যই বিশ্বাস করে নিতে বাধ্য হন, তাঁর প্রশ্নের উত্তরেই মন্ত্রপূত কুলো ঘুরছে অথবা স্থির থাকছে।
জানগুররু কাঁচি ধরলেও সাধারণত সে তার আঙ্গুল স্থির রেখে দেয়। কারণ সে এই
মনস্তত্ত্বটুকু জানে, তার আঙ্গুল নেড়ে কুলো চালাবার কোনও প্রয়োজন নেই। কুলো চালাবে প্রশ্নকর্তার অবচেতন মন।
অবচেতন মন দিয়ে আংটি চালানোর বিষয়ে ভূতে ভর নিয়ে আলোচনায় যেহেতু যথেষ্ট সময় নিয়েছি, তাই আর আপনাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম না। শুধু এটুকু বলি- আপনি নিজে কুলো চালানোর কুলো নিয়ে বসুন। সঙ্গী করুন কাউকে। তাকে বলুন, কোনও প্রশ্ন গভীর ভাবে চিন্তা করতে। তবে প্রশ্নটা যেন এমন হয় যাতে তার উত্তর ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’তেই পাওয়া যায়। একমনে চিন্তা করতে শুরু করলেই প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ হলে কুলো ঘুরবে, ‘না’ হলে কুলো স্থির থাকবে।
একটু অপেক্ষা করলেই দেখতে পাবেন মজা। দেখবেন, আপনার সঙ্গীর বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে কুলো কখনো ঘুরছে, কখনো বা স্থির থাকছে।
এমন পরীক্ষার মধ্যে দিয়েই বুঝতে পারবেন জানগুরু বা তান্ত্রিকদের কুলো-পড়া মন্ত্রের বুজরুকি।
“অলৌকিক নয়,লৌকিক- ২য় খন্ড ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
♦ কিছু কথাঃ যুক্তিবাদ প্রসঙ্গে
একঃ ভূতের ভর
♦ ভূতের ভরঃ বিভিন্ন ধরন ও ব্যাখ্যা
♦ গুরুর আত্মার খপ্পরে জনৈকা শিক্ষিকা
♦ প্রেমিকের আত্মা ও এক অধ্যাপিকা
ভূতে পাওয়া যখন ম্যানিয়াস ডিপ্রেসিভ
♦ সবার সামনে ভূত শাড়ি করে ফালা
♦ গ্রামে ফিরলেই ফিরে আসে ভূতটা
♦ একটি আত্মার অভিশাপ ও ক্যারেটে মাস্টার
দুইঃ পত্র পত্রিকার খবরে ভূত
♦ ট্যাক্সিতে ভূতের একটি সত্যি কাহিনী ও এক সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক
♦ এক সত্যি ভূতের কাহিনী ও এক বিজ্ঞানী
♦ বেলঘরিয়ার গ্রীন পার্কে ভূতুরে বাড়িতে ঘড়ি ভেসে বেড়ায় শূন্যে
♦ দমদমের কাচ-ভাঙ্গা হল্লাবাজ-ভূত
তিনঃ যে ভূতুরে চ্যালেঞ্জের মুখে বিপদে পড়েছিলাম
চারঃ ভূতুরে চিকিৎসা
♦ ফিলিপিনো ফেইথ হিলার ও ভূতুরে অস্ত্রোপচার
♦ ফেইথ হিলার ও জাদুকর পি.সি. সরকার (জুনিয়র)
♦ পরকাল থেকে আসা বিদেহী ডাক্তার
♦ বিদেহী ডাক্তার দ্বারা আরোগ্য লাভ
♦ ডাইনী সম্রাজ্ঞী ঈপ্সিতার ভূতুরে চিকিৎসা
পাঁচঃ ভূতুরে তান্ত্রিক
♦ গৌতম ভারতী ও তাঁর ভূতুরে ফটোসম্মোহন
♦ ভূতুরে সম্মোহনে মনের মত বিয়েঃ কাজী সিদ্দীকির চ্যালেঞ্জ
ছয়ঃ ডাইনি ও আদিবাসী সমাজ
বাঁকুড়া জেলা হ্যান্ডবুক, ১৯৫১ থেকে
♦ ডাইনি, জানগুরু প্রথার বিরুদ্ধে কি করা উচিৎ
♦ ডাইনি হত্যা বন্ধে যে সব পরিকল্পনা এখুনি সরকারের গ্রহণ করা উচিৎ
♦ জানগুরুদের অলৌকিক ক্ষমতার রহস্য সন্ধানে
সাতঃ আদিবাসী সমাজের তুক-তাক, ঝাড়- ফুঁক
♦ ‘বিষ-পাথর’ ও ‘হাত চালান’এ বিষ নামান
আটঃ ঈশ্বরের ভর
♦ ঈশ্বরের ভর কখনো মানসিক রোগ, কখনো অভিনয়
♦ কল্যাণী ঘোষপাড়ায় সতীমা’ইয়ের মেলায় ভর
♦ হাড়োয়ার উমা সতীমার মন্দিরে গণ-ভর
♦ আর একটি হিস্টিরিয়া ভরের দৃষ্টান্ত
♦ একই অঙ্গে সোম-শুক্কুর ‘বাবা’ ও মা’য়ের ভর
♦ অবাক মেয়ে মৌসুমী’র মধ্যে সরস্বতীর অধিষ্ঠান (?) ও প্রডিজি প্রসঙ্গঃ
♦ প্রডিজি কি? ও কিছু বিস্ময়কর শিশু প্রতিভা
♦ বংশগতি বা জিন প্রসঙ্গে কিছু কথা
♦ বিস্ময়কর স্মৃতি নিয়ে দু-চার কথা
♦ দুর্বল স্মৃতি বলে কিছু নেই, ঘাটতি শুধু স্মরণে
♦ মানবগুণ বিকাশে বংশগতি ও পরিবেশের প্রভাব
♦ মানবগুণ বিকাশে পরিবেশের প্রভাব
♦ মানব-জীবনে প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব
♦ মানব-জীবনে আর্থ-সামাজিক পরিবেশের প্রভাব
♦ মানব জীবনে সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রভাব
♦ অবাক মেয়ে মৌসুমীর রহস্য সন্ধানে
♦ বক্সিংয়ের কিংবদন্তী মহম্মদ আলি শূন্যে ভাসেন আল্লা-বিশ্বাসে!