বেলগাছিয়া থেকে সেকেণ্ড ক্লাস ট্রামে চেপে ওরা হাতিবাগানে চলে এল। এতক্ষণে অর্কর শরীর ম্যাজম্যাজ করছে, দুচোখ ভারী। মনে মনে বিলুর ওপর ভীষণ চটে যাচ্ছিল ও। হাতিবাগানে নেমে বিলু বলল, ওস্তাদ, পেটে একটু চা ঢেলে নিই চল।
প্রথম প্রথম এই ওস্তাদ কিংবা গুরু সম্বোধনে অস্বস্তি হত অর্কর। পরে বুঝেছে ওগুলো কথার মাত্রা, কোন মানে না করেই বলা হয়। দুই অক্ষরের যে শব্দটি পুরুষাঙ্গের পরিচয় তাও ওরা ব্যবহার করে অসাড়ে। কোন মানে হয় না কিন্তু কথা বলার সময় ওই ব্যবহার বেশ জোর আনে। কথাটা কখনও ব্যবহার করতে পারেনি অর্ক। জিভে যেন আটকে যায়। ও বিলুর দিকে তাকাল। ওদের দলটায় বিলুকেই সবচেয়ে বুদ্ধিমান বলে মনে হয়। চট করে রাগে না কিন্তু কাজ গোছাতে পারে। বাবা চায় না এদের সঙ্গে সে মেশে। শুধু খিস্তি করা ছাড়া বিলুর আর কোন দোষ নেই। অন্তত খুরকি কিংবা কিলার থেকে বিলু অনেক ভাল। এদের সঙ্গে সে মিশছে বছর তিনেক। গত বছর থেকে ঘনিষ্ঠ। হাঁটতে হাঁটতে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, তুই কখনও জেল খেটেছিস?
বিলু আচমকা প্রশ্ন শুনে বেশ অবাক গলায় বলল, কেন বে?
এমনি জিজ্ঞাসা করছি।
থানায় গিয়েছিলাম তিনবার, কোর্টে যেতে হয়নি।
ম্যানেজ করেছিলি?
ম্যানেজ না করলে চলে গুরু?
বাঁদিকের একটা গলির মুখে ভাঁড়ের চায়ের দোকান। তার বেঞ্চিতে বসল ওরা। চায়ে চুমুক দিয়ে ভাল লাগল অর্কর। ও হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, তোর দেশ কোথায় ছিল বে?
পাকিস্তান।
দূর বে, বাংলাদেশ বল।
বাবা বলে পাকিস্তান; ওসব দিয়ে কি দরকার?
না, জিজ্ঞাসা করছি। তুই দেখেছিস?
ফোট! আমি শালা এখানে পয়দা হয়েছি। তবে বাবা হেভি গুল মারে, এই ছিল তাই ছিল। মাইরি জন্মাবার পর কোন দিন খাঁটি ঘি-এর লুচি খাইনি।
কথাটা অর্কর মনে লাগল। সে কি নিজে কখনও খেয়েছে? নিচু গলায় বলল, আমাদের দেশ মাইরি পাকিস্তানে ছিল না কিন্তু আমিও খাইনি। একদিন খেলে হয়।
চায়ের দাম মিটিয়ে দিল অর্ক। এখন শরীর একটু ভাল লাগছে। সিনেমা হলটার সামনে এসে ওর চক্ষুস্থির হয়ে গেল। বিরাট ভিড়। এখন সবে নটা বাজে বোধহয় কিন্তু কমসে কম হাজারখানেক লোক জটলা পাকাচ্ছে। মেয়েদের লাইনটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে অনেকদূর। ছবিটার কথা অর্ক শুনেছে অনেকদিন কিন্তু অভ্যেস নেই বলে দেখতে আসার ইচ্ছে হয়নি। হলের কোলাপসিবল দরজা বন্ধ। ছেলেদের লাইনে জোর মারপিট শুরু হয়েছে। পাঁচ ছয়টা ছেলে লাইন ম্যানেজ করছে। ওদের সামনে একটা ছেলেকে বেধড়ক পেটালো ওরা। জামা ছিঁড়ে ছেলেটা লাইন ছেড়ে চলে গেল। হঠাৎ মেয়েদের লাইনে চিৎকার শুরু হল। অর্ক দেখল একটা রোগা মতন মেয়ে একজন মহিলার চুলের মুঠি চেপে ধরে টানছে। মহিলাটি মোটাসোটা তবু সেই চেহারায় দুহাতে মেয়েটি আঁচড়াতে চেষ্টা করছে। লাইনের অন্যান্য মেয়েরা তারস্বরে চিৎকার করছে। এদের ব্যাপার দেখে ছেলেদের মারামারি থেমে গেল। সেই মাস্তান ছেলেরা এদের সামনে এসে জোর হাততালি দিতে লাগল। একজন আবার হেঁড়ে গলায় শোলের ডায়লগ বলতে লাগল। অবিকল আমজাদ খান। মেয়ে দুটোর কোন হুঁস নেই। তারা মাটিতে পড়ে গিয়েও পরস্পরকে ছাড়ছে না। এইসময় একটা পুলিস ভ্যান সামনে এসে দাঁড়াতেই বিলু বলল, খেল শুরু হল।
একজন অফিসার ভ্যান থেকে নেমে চিৎকার করলেন, অ্যাই চোপ! কেউ মারামারি করবে না। মারামারি করা খুব খারাপ।
আমজাদ খান সেই গলায় বলল, খুব খারাপ স্যার, কিন্তু ওরা খুব লড়ে যাচ্ছে।
ঠিক তখনি কোলাপসিবল গেট ফাঁক হতেই প্রথমে ঢোকার জন্যে তাড়াহুড়ো লেগে গেল। অর্ক দেখল রোগা মেয়েটা চটপট মাটি ছেড়ে দৌড়ে গেল লাইনের মধ্যে। মোটাসোটা মহিলা তড়িঘড়ি লাইনে ঢুকে গেলেন। এতক্ষণের অত উত্তেজক মারামারির কোন মূল্য থাকল না। অর্ক বিলুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, টিকিট পাবি কি করে?
পেয়ে যাব।
যা বে! আমি মরে গেলেও ওখানে ঢুকব না। দ্যাখ দ্যাখ পুলিশ লাঠি চার্জ করছে। শালা, বড় হলে পুলিশ হতে হবে।
তুই হতে পারবি, তোর ফিগার আছে। দু’হাত ভরে দুই নম্বর লুটবি। লে বে, টাকাটা বের কর।
টিকিট কোথায়?
তুই আমাকে অবিশ্বাস করছিস অক্ক। এ লাইনে অবিশ্বাস করলে কোন কাজ চলে না। ব্যবসা হয় বিশ্বাসের ওপরে।
অত্যন্ত অনিচ্ছায় পকেট থেকে টাকাগুলো বের করল অর্ক। বের করবার সময় হারখানার কথা মনে পড়ায় সে চট করে দেখে নিল সেটা পকেটেই আছে। বিলুকে হারখানার কথা কিছুতেই বলা যাবে না। টাকাটা হাতে নিয়ে গুণে ফেলল বিলু। তারপর দশটা টাকা অর্কর হাতে দিয়ে বলল, এটা রাখ, ভাগাভাগি করে নেব।
কেন?
তুই শালা ধুর নাকি বে! টিকিটগুলো ক্যাশ না করা পর্যন্ত হাওয়া খাব নাকি? অক্ক, আজ থেকে আমরা হলাম পাটনার, মনে রাখিস।
অর্ককে সেখানেই দাঁড় করিয়ে বিলু হলের দিকে চলে গেল। অর্ক দেখল লাঠি চার্জের পর লাইন বেশ শান্ত হয়েছে। ছয়জন ছেলে আর চারজন মেয়েকে এক একবারে কোলাপসি গেটের ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে টিকিটের জন্যে। বিলু সামনের ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলে অর্কর মন খুঁতখুঁত করতে লাগল। টাকাটা নিয়ে বিলু হাপিস হয়ে যাবে না তো! যদি হয় তাহলেও অর্কর কিছু বলার নেই। কারণ টাকাটা ন্যাড়ার মায়ের আর সে-ই নিজে কাল রাত্রে ছাই হয়ে গেছে। কিন্তু টাকাটা অনেকক্ষণ পকেটে ছিল, বিলু কি ঢপ দেবে!
মিনিট পনের বাদে ফিরে এল বিল। অর্ক খুশি হল, পেলি?
না পাটনার। ওই চায়ের দোকানে বসতে বলল।
চায়ের দোকানে কেন?
ওখানেই লেনদেন হবে।
সিনেমা হাউস ছাড়িয়ে একটু এগোতেই একটা জীর্ণ চায়ের দোকান চোখে পড়ল অর্কর। গোটা আটেক তাদের বয়সী ছেলে সেখানে বসে আছে। বিলুর সঙ্গে ঢুকে অর্ক একটা বেঞ্চিতে বসতেই মন্তব্য কানে এল, এরা খোঁচড় নাকি বে?
হলে হবে। কোন খানকির বাচ্চা নাক গলালে লাস পড়ে যাবে!
উত্তরটা শুনে কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল অর্কর। সে বিলুর দিকে তাকাতেই বিলু চোখ মারল। তারপর বলল, দেশলাই আছে?
অর্ক মাথা নাড়ল না।
একটা চারমিনার দুই আঙ্গুলে গুঁজে বিলু চারপাশে তাকাল। তারপর যে ছেলেটি লাশ ফেলবে বলেছিল তার দিকে তাকিয়ে বলল, ওস্তাদ, আগুন আছে?
প্রচণ্ড কালো, মুখ চোখ ভাঙ্গা, লাল জামা পরা ছেলেটা বিলুর দিকে তাকাল। অর্ক দেখল ছেলেটা বেশ বিরক্তি সত্ত্বেও পকেট থেকে দেশলাই বের করে খুব জোরে ছুঁড়ে দিল বিলুর দিকে। ছোঁ মেরে সেটাকে লুফে নিয়ে বিলু সিগারেটটা ধরাল মন দিয়ে। তারপর বেঞ্চি ছেড়ে উঠে গেল লাল জামার কাছে, ওস্তাদ, পহেলে পুছোঁ কৌন হ্যায় উসকি বাদ বাত বোলো। সেমসাইড গোল হয়ে যাচ্ছে।
ছেলেটার মুখ আরও কঠিন হল, কি চাই এখানে?
চা খেতে এসেছি।
লাল জামা হাঁক দিল, গণা, ওদের চা দে খেয়ে ফুটে যাক।
বিলু মাথা নাড়ল, আবার সেমসাইড হচ্ছে ওস্তাদ।
লাল জামা ঘুরে বসল, মানে?
অমাদা বলেছে এখানে বসতে।
অমাদা বলেছে! লাল জামার মুখ থেকে কথাটা বের হতেই অন্যান্যরা নড়ে চড়ে বসল। অর্ক বুঝল কেউ তাদের ভাল চোখে দেখছে না।
লাল জামা বলল, আরে, আমি সাফ বলে দিচ্ছি। নতুন পার্টি ঢোকাতে চাইলে হেভি কিচাইন হয়ে যাবে।
বিলু বলল, আমরা নতুন নই।
নতুন নই! হা হা করে হেসে উঠল লাল জামা, এ খোমা অ্যাদ্দিন কোন গাদিতে ঝুলিয়েছিলে চাঁদ!
আমি আসতাম না, আমার দোস্ত আসতো, খুরকি।
খুরকি? অর্ক লক্ষ্য করল ছেলেটার মুখের চেহারা পাল্টে গেল আচমকা। সে বিলুর মুখের দিকে চোখ ছোট করে দেখতে লাগল।
বিলু হাসল, খোমা দেখে নাও ওস্তাদ। অনেক খেলেছ এতক্ষণ। খুরকি আমাদের পাঠিয়েছে ওর মাল নিয়ে যেতে। আপত্তি আছে?
লাল জামা বলল, খুরকি কোথায়?
শরীর খারাপ।
ওকে বলো মানাদা ডেকেছে। ও শালা মানাদাকেও টপকেছে। মানাদাই এই হলের সঙ্গে প্রথম বন্দোবস্ত করেছিল, আমরা এখনও মানাদাকে হিস্যা দিই।
বিলু বলল, বলব। কিন্তু আর কি সেমসাইড হবে?
ঠিক আছে। কিন্তু দশটার বেশী টিকিট।
এক কুড়ি। আমাদের সঙ্গে বাতচিত হয়ে গেছে। যে যার করে খাও গুরু। বিলু ফিরে এল অর্কর পাশে। অর্ক বিলুকে এতক্ষণ অবাক হয়ে দেখছিল। রোগা ক্ষয়াটে চেহারা নিয়ে বিলু কি রোয়াবে কথা বলে গেল এতক্ষণ। সে কি নিজে এরকম পারত! ও দেখল সবাই এবার তার দিকে তাকাচ্ছে। ঠোঁট বেঁকিয়ে কিলার ভঙ্গীতে অর্ক চেঁচাল, কি বে, চা কি বাগানে পয়দা হচ্ছে এখনও?
গলার স্বর এবং ভঙ্গী অনেকটাই কিলার মত মনে হল অর্কর। ওপাশ থেকে সাড়া এল, দিচ্ছি।
হঠাৎ বাইরে দুদ্দাড় করে মানুষজন ছুটতে লাগল। ওরা দোকানে বসেই দেখল পুলিস লাঠি। উঁচিয়ে তাড়া করেছে। লাল জামার কাছে একজন এসে বলল, টিকিট নেই বলে কাউন্টার বন্ধ করে দিয়েছে বলে পাবলিক রঙ নিচ্ছে।
অর্ক চা খেতে খেতে অনুভব করল ওর শরীরের সেই ম্যাজম্যাজানি ভাবটা আর নেই, এমনকি ঘুমও পাচ্ছে না। ঠিক তখনই আবে অমাদা এসে গেছে এসো ওস্তাদ ইত্যাদি হাঁকডাকে ভরে গেল দোকান। অর্ক দেখল একটি আধবুড়ো লোক চায়ের দোকানে ঢুকে সন্ত্রস্ত ভঙ্গীতে চারধারে তাকিয়ে নিয়ে বলল, বাইরে পুলিস প্যাঁদাচ্ছে।
লাল জামা বলল, যুগ যুগ জীও গুরু। যত প্যাঁদাবে তত লাভ।
অমাদা মাথা নাড়ল, ঠিক। আজ আরও চারআনা বেশী লাগবে।
সঙ্গে সঙ্গে লাল জামা ছুটে এল, কি কিচাইন করছ অমাদা, তোমার সঙ্গে মানাদা রেট ঠিক করে গিয়েছে, এখন বেশী চাইলে দেব কি করে?
অমাদা হাত নাড়ল, দর আবার কি! রোজ রোজ যেমন কমছে বাড়ছে তেমন চলবে। আজকের যা ডিম্যাণ্ড তাতে চারআনা বেশী পড়বে।
কথাটা শেষ করে অমাদা দোকানের খদ্দেরদের মুখ ভাল করে দেখল, মারপিট হচ্ছে যখন রাস্তায় তখন ঝাঁপটা বন্ধ করে দে। বাইরের কেউ এখানে নেই তো?
লাল জামা মাথা নাড়ল, না। কিন্তু তুমি খুরকিকে মাল দিচ্ছ কেন?
অমাদা বলল, কে খুরকি?
বেলগাছিয়ার খুরকি।
ওরে বাবা, ওকে না দিলে উপায় আছে! খুরকি যেন কাঁদের পাঠিয়েছে এখানে? অমাদা একটা বেঞ্চিতে বসতেই কয়েকজন সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দিল। বিলু হাত তুলল।
তাকে দেখে নিয়ে অমাদা টিকিট বিতরণ শুরু করল। অর্ক দেখল গোছ গোছ টিকিট হাত বদল হয়ে যাচ্ছে। সাধারণত নিচু আর মাঝারি শ্রেণীর টিকিট অমাদা এনেছে। তবে চার আনা বেশী দিতে হচ্ছে বলে অনেকে যত টিকিট নেবে ভেবেছিল তত নিতে পারছে না। বিলু বেশ কিছু টিকিট ম্যানেজ করে আদ্ধেক অর্ককে দিল, এগুলো শুক্রবার পর্যন্ত তোর কাছে রেখে দে। কেউ যেন টের না পায়।
তোর কাছে রেখে দে না।
না বে, বাইরে বের হলেই খোঁচড় ধরতে পারে। একজনকে ধরলে আর একজনের মাল বেঁচে যাবে।
চোখের সামনে দোকানটা সাফ হয়ে গেল। যে যার টিকিট নিয়ে এক এক করে বেরিয়ে পড়েছে। অমাদা টাকাগুলো থলিতে পুরে বিড়ি ধরাল,একটা ডবল হাফ দাও।
বিলু অর্ককে ইশারা করে বেরিয়ে পড়ল। কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট এতক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে বিলু বলল, এ হপ্তার খরচটা ম্যানেজ হয়ে গেল অক।
কি করে বিক্রি করবি?
শো শুরু হবার পনের মিনিট আগে আসব। ততক্ষণে অন্য শালাদের টিকিট শেষ হয়ে যাবে। চারটাকা নাফা রাখব দেখিস।
পুলিস যদি ধরে!
আমার ওপর ভরসা কর ওস্তাদ। তোকে তো বলেছি আমি এখনও শ্বশুরবাড়ি যাইনি। চ, সটকাট করি।
নলিনী সরকার স্ট্রীট দিয়ে কেন যাচ্ছে প্রথমে ধরতে পারেনি অর্ক, পরে খেয়াল হল লেক টাউনের কথা। এইসব উত্তেজনার মধ্যে অর্ক বিলাস সোমের কথাটা ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু লেক টাউনে গিয়ে কি হবে? লোকটা যদি মরে যায় তাহলে পুলিস কি তাকে ঝামেলায় ফেলতে পারে? ওর আর একবার আফসোস হল নিজের ঠিকানাটা হসপিটালে দেওয়ার জন্যে।
হঠাৎ বিলু বলল, তোদের অ্যাকসিডেন্টটা ঠিক কোথায় হয়েছিল?
আর জি করের মুখে।
পুরো ঘটনাটা বল তো!– বিলুর দিকে তাকাল অর্ক। না, হারের কথা বলবে না সে। ওটা আছে জানলেই শালা ভাগ বসাবে। নিজে যদিও জানে না কোথায় কার কাছে হারখানা বিক্রি করা যায়, তবু ভাগীদার চায় না। সে। প্রায় সবটাই খুলে বলার পর বিলু বলল, পার্টি মালদার বলে মনে হচ্ছিল?
বাঃ, নিজের গাড়ি আছে, টাই পরে যখন।, তার মানেই যে মাল আছে তা নাও হতে পারে। চল বাড়িতে গিয়ে দেখব।
সাতচল্লিশ নম্বর বাসে চেপে ওরা লেকটাউনে চলে এল। বাসে উঠেই বিলু বলেছিল, কেমন আছ ওস্তাদ!
কণ্ডাক্টর ওদের বয়সী একটা ছেলে, কাঁধ অবধি চুল, ভাঙ্গা চোয়াল, ঘাড় নেড়েছিল, কিলার খবর কি?
কাল থেকে হাপিস।
কি ব্যাপার?
ঠিক জানি না।
ওরা টিকিট দিল না, কণ্ডাক্টরও চাইল না। দরজায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো বিলু। এখন গাড়ি প্রায় ফাঁকা। কয়েকটা টান দিয়ে সে সিগারেটটা কণ্ডাক্টরকে দিয়ে দিল। অর্ক দেখল বাসের কিছু লোক তাদের দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু কিছু বলছে না।
লেকটাউনে নেমে বিলু বলল, ঠিকানাটা কি পড়!
পকেট থেকে লাইসেন্সটা বের করে অর্ক ঠিকানা পড়ল। জয়া সিনেমার পেছনের রাস্তায় ওদের যেতে হবে। অর্ক বলল, গিয়ে কোন লাভ হবে না। পুলিস নিশ্চয়ই ওদের খবর দিয়েছে। বিলু বলল, তা তো দিতেই পারে। কিন্তু তোর কাজ তুই করবি চল, বলা যায় না কি থেকে কি হয়।
নম্বর মিলিয়ে বাড়িটাকে খুঁজে পেতে দেরি হল না। দোতলা ঘিয়ে রঙের বাগানওয়ালা বাড়ি। সুন্দর দেখতে। গেটে লেখা, কুকুর হইতে সাবধান। অর্ক বলল, কুকুর আছে।
যা বে!
হ্যাঁ, লেখা আছে, দ্যাখ না।
বিলু চোখ বোলালো, আমি তাহলে ঢুকছি না। ওরে শালা, বড়লোকের কুত্তা খুব হারামি হয়।
অর্ক হেসে ফেলল ওর ভয় দেখে, তাহলে চল ফিরে যাই।
তোর তো ভয় নেই, তুই ঢোক না।
কি বলব?
যা ঘটনা তাই বলবি। প্রথমে মাল খেয়েছিল বলবি না, ওটা আমাদের ইস্ক্রু হবে। যা বে। কুকুরটাকে বাঁধতে বলে আমায় ডাকবি।
বিলু গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। নুড়ি দিয়ে সাজানো প্যাসেজে পা দিতেই মেঘ গর্জন করে উঠল যেন। অর্ক থমকে গিয়েছিল। সতর্ক চোখে সে দেখল বারান্দার গায়ে জানলার গ্রিলের ফাঁকে বিরাট একটা কুকুর ছটফট করছে তাকে দেখে, ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছে। এগোবে কিনা বুঝতে পারছিল না অর্ক, পেছন থেকে বিলু সাহস দিল, কিছু হবে না, এগিয়ে যা। হারামিটা বেরুতে পারবে না।
অর্ক আরো খানিকটা এগোতেই ভেতর থেকে একটি মেয়ের গলা ভেসে এল, সাট আপ ম্যাক, হোয়াটস দ্য প্রব্লেম!
গলা শুনে ম্যাক আরও উত্তেজিত হল। দুটো পা গ্রিলের ওপর তুলে দিয়ে দাঁতগুলো বের করে চেঁচিয়ে যাচ্ছে সমানে।
তারপরেই নীল ম্যাক্সি পরা একটি মেয়ে এসে দাঁড়াল গ্রিলের পাশে। কুকুরের বিশাল মাথায় হাত রেখে অত্যন্ত বিরক্ত চোখে অর্ককে দেখে জিজ্ঞাসা করল, কি চাই?
মেয়েটি মোটেই লম্বা নয়। কিন্তু শরীরে বাড়াবাড়ি রকমের যৌবন। চোখ মুখের অভিব্যক্তিতে যে সফিস্টিকেশন তার সাক্ষাৎ কোনদিন পায়নি অর্ক। হঠাৎ সে আবিষ্কার করল তার জিভ শুকিয়ে গেছে, কথা বলতে পারছে না। মেয়েটি আবার জিজ্ঞাসা করল, কি চাই, চাঁদা?
মাথা নাড়ল অর্ক। তারপর কোনরকমে বলল, বিলাস সোম।
ড্যাডি বাড়িতে নেই। ওঃ, ম্যাক, চলে এস। মেয়েটি চলে যাচ্ছিল, অর্ক তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আপনারা কোন খবর পাননি?
কি খবর?
ওঁর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে!
অ্যাকসিডেন্ট? ও মাই গড! মা, মা, তাড়াতাড়ি এস! চিৎকার করতে করতে মেয়েটি ছুটে গেল ভেতরে। এবং কি আশ্চর্য, কুকুরটাও হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল। অর্ক বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিলুর দিকে তাকাল। বিলু রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। হঠাৎ অর্কর মনে হল, বিলুটা অত্যন্ত কুৎসিত দেখতে। এই বাড়িতে একদম মানাবে না। ভেতরে একটি ঈষৎ খসখসে কণ্ঠ বাজল, কত আজে বাজে লোক আসে সব কথা বিশ্বাস করতে হবে!
এইসময় গ্রিলের আড়ালে একজন মধ্যবয়সিনী এসে দাঁড়ালেন। হাতহীন জামা এবং কাঁধ ছোঁওয়া চুল। মুখে এই সকালেও বেশ প্রসাধন। ভ্রূ কুঁচকে অর্ককে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে?
অ্যাকসিডেন্ট। কাল রাত্রে
তুমি কে?
আমি ওঁর সঙ্গে ছিলাম।
তুমি বিলাসের সঙ্গে ছিলে?
হ্যাঁ। মানে আমাকে উনি লিফট দিচ্ছিলেন।
ইমপসিল। বিলাস কাউকে লিফট দেয় না। তাছাড়া অ্যাকসিডেন্ট হলে পুলিস খবর দিত। তোমার সাহস তো খুব, আমি যদি এখন তোমাকে পুলিসে ধরিয়ে দিই। ধমকে উঠলেন মহিলা।
বিশ্বাস করুন, আমি মিথ্যে কথা বলছি না। এই দেখুন, ওঁর ড্রাইভিং লাইসেন্স। এখান থেকেই ওঁর ঠিকানা পেয়েছি। পকেট থেকে সেটা বের করে গ্রিলের ফাঁক গলিয়ে মহিলাকে দিল।
লাইসেন্স হাতে নিয়ে মহিলা একটু নার্ভাস হলেন। তিনি অর্কর কপাল এবং হাতের দিকে তাকালেন, এটা তুমি কোত্থেকে পেলে?
গাড়িতে ছিল। পরে পেয়েছি।
কোথায় থাক তুমি?
বেলগাছিয়াতে।
মহিলা চিৎকার করে কাউকে ডাকলেন, দরজা খুলে দে।
খানিক বাদেই একটা বুড়ো চাকর দরজা খুলে দিতে মহিলা বললেন, ভেতরে এসো।
অর্ক ঘরে ঢুকতেই কুকুরটা সাঁৎ করে তার সামনে চলে এল। মহিলা বললেন, সোফায় বসো। ওঠার চেষ্টা করলে ম্যাক তোমাকে ছিঁড়ে খাবে। আমি থানায় ফোন করে তোমার কথা বলছি।
অসহায় অর্ক সোফায় বসতেই কুকুরটা তার সামনে পেছনের পা ভেঙ্গে বসল। মহিলা ততক্ষণে রিসিভার তুলেছেন। সেই মেয়েটি ডিভানে বসে আছে, চাকরটা দরজায়।
লাইন পাওয়া মাত্র মহিলা কথা বললেন, হ্যালো, আমি লেকটাউন থেকে বলছি। আমার নাম সুরুচি সোম। বিলাস সোম আমার স্বামী। কি বললেন? আমাকে খুঁজছেন। অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে! কখন? আর জি করে! কি আশ্চর্য, এতক্ষণ খবর দেননি কেন? ঠিকানা ছিল না এটা মানতে হবে? ভাগ্যিস একটি ছেলে খবর দিল এসে। কণ্ডিশন ভাল নয়, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।
টেলিফোন রেখেই মহিলা মেয়েটির দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, সু তোমার ড্যাডির অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। এক্ষুনি যেতে হবে।
মেয়েটি চিৎকার করে উঠল মুখে হাত চাপা দিয়ে। মহিলা বললেন, ডোন্ট বি সিলি। তুমি ভেতর থেকে আমার ব্যাগটা এনে দাও। আর নবীন, তুমি জলদি ট্যাক্সি ডেকে আন।
অর্ক হতচকিত হয়ে ব্যাপারটা দেখছিল। মহিলা এবার ওকে জিজ্ঞাসা করলেন, বিলাস কি ড্রাঙ্ক ছিল?
হ্যাঁ।
কোত্থেকে তোমাকে লিফট দিয়েছে?
বিডন স্ট্রীট।
কথাটা শুনেই মুখ বিকৃত করলেন মহিলা, ওঃ, দ্যাট বিচ। শিক্ষা হয় না পুরুষগুলোর। সেই স্ট্রীট গার্লটার কাছেই গিয়েছিল। তোমাকে ও লিফট দিল কেন? ঠিক আছে, যেতে যেতে শুনবো।
ঘরখানার দিকে তাকিয়ে অর্কর মনে হল, এরা কি সুন্দর ঘরে থাকে, কি সাজিয়ে গুছিয়ে। কিন্তু বিচ শব্দটার মানে কি?
“কালপুরুষ” গল্প সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ