শ্লোকঃ ৪
ন কর্মণামনারম্ভান নৈষ্কর্ম্যং পুরুষোহশ্নুতে।
ন চ সন্ন্যসনাদেব সিদ্ধিং সমধিগচ্ছতি ।। ৪ ।।
ন- না; কর্মণাম-শাস্ত্রীয় কর্মের; অনারম্ভাৎ- অনুষ্ঠান না করে; নৈষ্কর্ম্যম- কর্মফল থেকে মুক্তি; পুরুষ- মানুষ; অশ্নুতে- লাভ করে; ন- না; চ- ও; সন্ন্যসনাৎ- কর্মত্যাগের দ্বারা; এব- কেবল; সিদ্ধিম- সাফল্য; সমধিগচ্ছতি—লাভ করে।
গীতার গান
বিহিত কর্মের নিষ্ঠা না করি আরম্ভ।
নৈষ্কর্ম জ্ঞান যে চর্চা হয় এক দম্ভ।।
বিহিত কর্মের ত্যাগে চিত্তশুদ্ধি নয়।
কেবল সন্ন্যাসে কার্যসিদ্ধি নাহি হয়।।
অনুবাদঃ কেবল কর্মের অনুষ্ঠান না করার মাধ্যমে কর্মফল থেকে মুক্ত হওয়া যায় না, আবার কর্মত্যাগের মাধ্যমেও সিদ্ধি লাভ করা যায় না।
তাৎপর্যঃ শাস্ত্রের নির্দেশ অনুযায়ী বিধি-নিষেধের আচরণ করার ফলে যখন অন্তর পবিত্র হয় এবং জড় বন্ধনগুলি শিথিল হয়ে যায়, তখন মানুষ সর্বত্যাগী জীবনধারায় সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণ করার যোগ্য হয়। অন্তর পবিত্র না হলে- সম্পূর্ণভাবে কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত না হলে সন্ন্যাস গ্রহণ করার কোন মানেই হয় না। মায়াবাদী জ্ঞানীরা মনে করে, সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করা মাত্রই অথবা সকাম কর্ম পরিহার করা মাত্রই তারা তৎক্ষণাৎ নারায়ণের মতো ভগবান হয়ে যায়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু তা অনুমোদন করছেন না। অন্তর পবিত্র না করে, জড় বন্ধন মুক্ত না হয়ে সন্ন্যাস নিলে, তা কেবল সমাজ-ব্যবস্থায় উৎপাতেরই সৃষ্টি করে। পক্ষান্তরে, যদি কেউ ভক্তিযোগে ভগবানের কৃপা লাভ করেন, ভগবান নিজেই সেই কথা বলেছেন। স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে ভয়াৎ। এই ধর্মের স্বল্প আচরণ করলেও জড় জগতের মহাভয় থেকে ত্রাণ পাওয়া যায়।
শ্লোকঃ ৫
ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্মকৃৎ।
কার্যতে হ্যবশঃ কর্ম সর্বঃ প্রকৃতিজৈগুর্ণৈঃ ।। ৫ ।।
ন- না; হি- অবশ্যই; কশ্চিৎ- কেউ; ক্ষণম- ক্ষণ মাত্রও; অপি- ও; জাতু- কখনো; তিষ্ঠতি- থাকতে পারে; অকর্মকৃৎ- কর্ম না করে; কার্যতে- করতে বাধ্য হয়; হি- অবশ্যই; অবশঃ- অসহায়ভাবে; কর্ম- কর্ম; সর্বঃ- সকলে; প্রকৃতিজৈঃ- প্রকৃতিজাত; গুণৈঃ- গুণসমূহের দ্বারা।
গীতার গান
ক্ষণেক সময় মাত্র না করিয়া কর্ম।
থাকিতে পারে না কেহ স্বাভাবিক ধর্ম।।
প্রকৃতির গুণ যথা সবার নির্বন্ধ।
সেই কার্য করে যাতে কর্মের বন্ধ।।
অনুবাদঃ সকলেই মায়াজাত গুণসমূহের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অসহায়ভাবে কর্ম করতে বাধ্য হয়; তাই কর্ম না করে কেউই ক্ষণকালও থাকতে পারে না।
তাৎপর্যঃ কর্তব্যকর্ম না করে কেউই থাকতে পারে না। আত্মার ধর্মই হচ্ছে সর্বক্ষণ কর্মরত থাকা। আত্মার উপস্থিতি না থাকলে জড় দেহ চলাফেরা করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে জড় দেহটি একটি নিষ্প্রাণ গাড়ি মাত্র, কিন্তু সেই দেহে অবস্থান করে আত্মা সর্বক্ষণ তাকে সক্রিয় রাখার কর্তব্যকর্ম করে যাচ্চে এবং এই কর্তব্যকর্ম থেকে সে এক মুহূর্তের জন্যও বিরত হতে পারে না। সেই হেতুঃ জীবাত্মাকে কৃষ্ণভাবনার মঙ্গলমূ কর্মে নিয়োজিত করতে হয়, তা না হলে মায়ার প্রভাবে মোহাচ্ছন্ন হয়ে জীবাত্মা অনিত্য জড়-জাগতিক কর্মে ব্যাপৃত থাকে। জড়া প্রকৃতির সংস্পর্শে আসার ফলে আত্মা জড় গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে, তাই এই জড় গুণের কলুষ থেকে মুক্ত হবার জন্য শাস্ত্র-নির্ধারিত কর্মের আচরণ করতে হয়। কিন্তু আত্মা যখন শ্রীকৃষ্ণের সেবায় স্বাভাবিকভাবে নিযুক্ত হয়, তখন সে যা করে, তার পক্ষে তা মঙ্গলময় হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভাগবতে (১/৫/১৭) বলা হয়েছে –
ত্যক্তা স্বধর্মং চরণাম্বুজং হরে-
র্ভজন্নপক্কোহথ পতেত্ততো যদি।
যত্র ক্ক বাভদ্রমভুদমুষ্য কিং
কো ব্যর্থ আপ্তোহভজতাং স্বধর্মতঃ।।
“যদি কেউ কৃষ্ণভাবনা গ্রহণ করে এবং তখন সে যদি শাস্ত্র-নির্দেশিত বিধি-নিষেধগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে না মেনেও চলে অথবা তার স্বধর্ম পালনও না করে, এমন কি সে যদি অধঃপতিত হয়, তা হলেও তার কোন রকম ক্ষতি বা অমঙ্গল হয় না। কিন্তু সে যদি পবিত্র হবার জন্য শাস্ত্র-নির্দেশিত সমস্ত আচার-আচরণ পালনও করে, তাতে তার কি লাভ, যদি সে কৃষ্ণভাবনাময় না হয়?” সুতরাং কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করার জন্যই শুদ্ধিকরণের পন্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। তাই, সন্ন্যাস আশ্রমের অথবা যে-কোন চিত্তশুদ্ধি করণ পন্থার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃতের চরম লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করা। তা না হলে সব কিছুই নিরর্থক।
শ্লোকঃ ৬
কর্মেন্দ্রিয়াণি সংযম্য য আস্তে মনসা স্মরণ।
ইন্দ্রিয়ার্থান বিমূঢ়াত্মা মিথ্যাচারঃ স উচ্যতে ।। ৬ ।।
কর্মেন্দ্রিয়াণি- পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়; সংযম্য- সংযত করে; যঃ- যে; আস্তে- অবস্থান করে; মনসা- মনের দ্বারা; স্মরণ- স্মরণ করে; ইন্দ্রিয়ার্থান- ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ; বিমূঢ়- মূঢ়; আত্মা- আত্মা; মিথ্যাচারঃ- কপটাচার; সঃ- তাকে; উচ্যতে- বলা হয়।
গীতার গান
কর্মেন্দ্রিয় রোধ করি মনেতে স্মরণ।
ইহা নাহি চিত্তশুদ্ধি নৈষ্কর্ম কারণ।।
অতএব সেই ব্যক্তি বিমূঢ়াত্মা হয়।
ইন্দ্রিয়ার্থ মিথ্যাচারী শাস্ত্রেতে কহয়।।
অনুবাদঃ যে ব্যক্তি পঞ্চ-কর্মেন্দ্রিয় সংযত করেও মনে মনে শব্দ, রস আদি বিষয়গুলি স্মরণ করে, সেই মূঢ় অবশ্যই নিজেকে বিভ্রান্ত করে এবং তাকে মিথ্যাচারী ভন্ড বলা হয়ে থাকে।
তাৎপর্যঃ অনেক মিথ্যাচারী আছে, যারা কৃষ্ণভাবনাময় সেবাকার্য করতে চায় না, কেবল ধ্যান করার ভান করে। কিন্তু এতে কোন কাজ হয় না। কারণ, তারা তাদের কর্মেন্দ্রিয়গুলিকে রোধ করলেও মন তাদের সংযত হয় না। পক্ষান্তরে, মন অত্যন্ত তীব্রভাবে ইন্দ্রিয়-সুখের জল্পনা-কল্পনা করতে থাকে। তারা লোক ঠকানোর জন্য দুই-একটি তত্ত্বকথাও বলে। কিন্তু এই শ্লোকে আমরা জানতে পারছি যে, তারা হচ্ছে সব চাইতে বড় প্রতারক। বর্ণাশ্রম ধর্মের আচরণ করেও মানুষ ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করতে পারে, কিন্তু বর্ণাশ্রম ধর্ম অনুসারে মানুষ যখন তার স্বধর্ম পালন করে, তখন ক্রমে ক্রমে তার চিত্ত শুদ্ধ হয় এবং সে ভগভদ্ভক্তি লাভ করে। কিন্তু যে ব্যক্তি যোগী সেজে লোক ঠকায়, সে আসলে ত্যাগীর বেশ ধারণ করে ভোগের চিন্তায় মগ্ন থাকে, সে হচ্ছে সব চাইতে নিকৃষ্ট স্তরের প্রতারক। মাঝে মাঝে দুই-একটি তত্ত্বকথা বলে সরলচিত্ত সাধারণ মানুষের কাছে তার তত্ত্বজ্ঞান জাহির করতে চায় কিন্তু বুদ্ধি দিয়ে বিচার করলে দেখা যায়, সেগুলি তোতাপাখির মতো মুখস্ত করা বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর মায়াশক্তির প্রভাবে ঐ ধরণের পাপাচারী প্রতারকদের সমস্ত জ্ঞান অপহরণ করে নেন। এই প্রকার প্রতারকের মন সর্বদাই অপবিত্র এবং সেই জন্য তার তথাকথিত লোকদেখানো ধ্যান নিরর্থক।
৯. পঞ্চম অধ্যায়ঃ কর্মসন্ন্যাস-যোগ
১২. অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রক্ষ্ম-যোগ
১৫. একাদশ অধ্যায়ঃ বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ
১৭. ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
১৮. চতুর্দশ অধ্যায়ঃ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৯. পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ পুরুষত্তম-যোগ
২০. ষোড়শ অধ্যায়ঃ দৈবাসুর- সম্পদ-বিভাগযোগ
২১. সপ্তদশ অধ্যায়ঃ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
২৪. বর্তমান সংস্করণ সম্পর্কে টীকা
শ্রীমদ্ভগভদ গীতা সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ